রসগোল্লা

রসগোল্লা

‘চুঙ্গিঘর’ কথাটা বাংলাভাষাতে কখনও খুব বেশি চালু ছিল না বলে আজকের দিনে অধিকাংশ বাঙালি যদি সেটা ভুলে গিয়ে থাকে, তবে তাই নিয়ে মর্মাহত হবার কোনও কারণ নেই। ইংরেজিতে একে বলে ‘কাস্টম হাউস’, ফরাসিতে ‘দুয়ান’, জর্মনে ‘ৎসল-আমট’, ফার্সিতে ‘গুমুরূক’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এতগুলো ভাষাতে যে এই লক্ষ্মীছাড়া প্রতিষ্ঠানটার প্রতিশব্দ দিলুম তার কারণ আজকের দিনে আমার ইয়ার, পাড়ার পাঁচু, ভুতো সবাই সরকারি, নিম সরকারি, মিন-সরকারি পয়সায় নিত্যি নিত্যি কাইরো কান্দাহার প্যারিস-ভেনিস সর্বত্র নানাবিধ কনফারেন্স করতে যায় বলে, আর পাকিস্তান-হিন্দুস্থান গমনাগমন তো আছেই। ওই শব্দটি জানা থাকলে তড়িঘড়ি তার সন্ধান নিয়ে আর পাঁচজনের আগে সেখানে পৌঁছতে পারলে তাড়াতাড়ি নিষ্কৃতি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ওটাকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা কস্মিনকালেও করবেন না। বরঞ্চ রহমত কাবুলিকে তার হকের কড়ি থেকে বঞ্চিত করলে করতেও পারেন কিন্তু তার দেশের ‘গুমুরূক’টিকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা করবেন না। ‘কাবুলিওয়ালা’ ফিল্ম আমি দেখিনি। রহমত বোধ করি সেটাতে তার ‘গুমুরূক’কে এড়াবার চেষ্টা করেনি।

কেন? ক্রমশ প্রকাশ্য।

ডাক্তার, উকিল, কসাই, ডাকাত, সম্পাদক এবং (সম্পাদকরা বলবেন, লেখক) এদের মধ্যে সক্কলের প্রথম কার জন্মগ্রহণ হয় সেকথা শক্ত। যারই হোক, তিনি যে চুঙ্গিঘরের চেয়ে প্রাচীন নন সে-বিষয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই। মানুষে মানুষে লেনদেন নিশ্চয়ই সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছিল এবং সেই মুহূর্তেই তৃতীয় ব্যক্তি বলে উঠল, “আমার ট্যাক্সোটা ভুলো না কিন্তু’–তা সে তৃতীয় ব্যক্তি গাঁয়ের মোড়লই হন, পঞ্চাশখানা গাঁয়ের দলপতিই হন, কিংবা রাজা অথবা তাঁর কর্মচারীই হন। তা তিনি নিন, আমার তাতে কোনও আপত্তি নেই, কারণ এযাবৎ আমি পুরনো খবরের কাগজ ছাড়া অন্য কোনও বস্তু বিক্রি করিনি। কিন্তু যেখানে দু পয়সা লাভের কোনও প্রশ্নই ওঠে না, সেখানে যখন চুঙ্গিঘর তার না-হকের কড়ি না-হক চাইতে যায়, তখনই আমাদের মনে সুবুদ্ধি জাগে, ওদের ফাঁকি দেওয়া যায় কী প্রকারে?

এই মনে করুন, আপনি যাচ্ছিলেন ঢাকা। প্যাক করতে গিয়ে দেখেন মাত্র দুটি শার্ট ধোপার মারপিট থেকে গা বাঁচিয়ে কোনও গতিকে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়েছে। ইস্টিশানে যাবার সময় কিনলেন একটি নয়া শার্ট। বাস, আপনার হয়ে গেল। দর্শনা পৌঁছতেই পাকিস্তানি চুঙ্গিঘর হুলুধ্বনি দিয়ে দর্শনী চেয়ে উঠবে। তার পর আপনার শার্টটির গায়ে হাত বুলবে, মস্তক আঘ্রাণ করবে এবং শেষটায় ধৃতরাষ্ট্র যে-রকম ভীমসেনকে আলিঙ্গন করেছিলেন ঠিক সেইরকম বুকে জড়িয়ে ধরবে।

আপনার পাঁজর কখানা পটপট করতে আরম্ভ করেছে, তবু শুকনো মুখে চিচি করে বলবেন, ‘ওটা তো আমি নিজের ব্যবহারের জন্য সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। ওতে তো ট্যাক্স লাগবার কথা নয়।’

আইন তাই বলে।

হায় রে আইন! চুঙ্গিওলা বলবে, “নিশ্চয়। কিন্তু ওটা যদি আপনি ঢাকাতে বিক্রি করেন?’

তর্কস্থলে ধরে নিলুম, আপনার পিতামহ তর্কবাগীশ ছিলেন তাই আপনি মূখের ন্যায় তর্ক তুললেন, ‘পুরনো শার্টও তো ঢাকাতে বিক্রি করা যায়।’

এই করলেন ভুল। তর্কে জিতলেই যদি সংসারে জিত হত তবে সক্রাতেসকে বিষ খেতে হত না, যিশুকে ক্রুশের উপর শিব হতে হত না।

চুঙ্গিওলা জানে, জীবনের প্রধান আইন চুপ করে থাকা, তর্ক করার বদভ্যাসটি ভালো নয়। এক্কেবারেই হয় না ওতে বুদ্ধিশক্তির চালনা।

কী যেন এক অজানার ধেয়ানে, দীর্ঘ আরস্ট্রিপের পশ্চাতের সুদূর দিকচক্রবালের দিকে তাকিয়ে বলবে, ‘তা পারেন।’

তার পর কাগজ পেনসিল নিয়ে কী সব টরে-টক্কা করবে। তার পর বলবে, ‘পনেরো টাকা।’

আপনার মনের অবস্থা আপনিই তখন জানেন–আমি আর তার কী বলে দেব! ব্যাপারটা যখন আপনার সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম হল, তখন আপনি ক্ষীণতম কণ্ঠে বললেন, ‘কিন্তু এই শার্টটার দামই তো মাত্র চার টাকা।’

চুঙ্গিওলা একখানা হলদে কাগজে চোখ বুলিয়ে নেবে। আপনি এটাতে দরখাস্ত করেছিলেন এবং নতুন শার্টটার উল্লেখ করেননি। চুঙ্গিওলার কাছে তার সরল অর্থ, আপনি এটা স্মাগল করে নিয়ে যাচ্ছিলেন, পাচার করতে চেয়েছিলেন, হাতে-নাতে বেআইনি কর্ম করতে গিয়ে ধরা পড়লে তার জরিমানা দশ টাকা, জেলও হতে পারত, আফিং কিংবা ককেইন হলে– এ যাত্রা বেঁচে গেছেন।

সেই হলদে কাগজখানা অধ্যয়ন করে কোনও লাভ নেই। কারণ তার প্রথম প্রশ্ন ছিল :

১। আপনার জন্মের সময় যে কাঁচি দিয়ে নাড়ি কাটা হয়েছিল, তার সাইজ কত?

এবং শেষ প্রশ্ন :

২। আপনার মৃত্যুর সন ও তারিখ কী?

 আপনি তখন শার্টটির মায়া ত্যাগ করে ঈষৎ অভিমানভরে বললেন, ‘তা হলে ওটা আপনারা রেখে দিন।’

কিন্তু ওইটি হবার জো নেই। আপনি ঘড়ি চুরি করে পেয়েছিলেন তিন মাসের জেল। ঘড়ি ফেরত দিলেই তো আর হাকিম আপনাকে ছেড়ে দেবে না। শার্ট ফেরত দিতে চাইলেও রেহাই নেই।

তখন শার্টটা চড়বে নিলামে। এক টাকা পেলে আপনি মহাভাগ্যবান। জরিমানাটার অবশ্য নড়নচড়ন হল না।

ঢাকা থেকে ফিরে আসবার সময় ভারতীয় চুঙ্গিওলা দেখে ফেললে আপনার নতুন পেলিকান ফাউন্টেন পেনটি। কাহিনীর পুনরাবৃত্তি করে লাভ নেই। আপনি ভাবলেন, ভারত এবং পাকিস্তান উভয়েই এ কর্মে নতুন, তাই প্যাসেঞ্জারকে খামকা হয়রান করে। বিলেত-ফিলেতে বোধ হয় চুঙ্গিঘর টুরিস্টদের নিছক মনোরঞ্জনাৰ্থে। তবে শুনুন।

আমার এক বন্ধু প্রায়ই ইউরোপ-আমেরিকা যান। এতই বেশি যাওয়া-আসা করেন যে, তাঁর সঙ্গে কোথাও দেখা হলে বলবার উপায় নেই, তিনি বিদেশ যাচ্ছেন না ফিরে আসছেন। ওই যেরকম ঢাকার কুট্টি গাড়ওয়ান, এক ভদ্রলোককে ভি-শেপের গেঞ্জি উল্টো পরে যেতে দেখে জিগ্যেস করেছিল, ‘কর্তা আইতেছেন, না যাইতেছেন?’

তিনি নেমেছেন ইটালির ভেনিস বন্দরে জাহাজ থেকে। ঝাণ্ডু ব্যবসায়ী লোক। তাই চুঙ্গিঘরের সেই হলদে কাগজখানায় যাবতীয় প্রশ্নের সদুত্তর দিয়ে শেষটায় লিখেছেন, “এক টিন ভ্যাকুয়াম পাড় ভারতীয় মিষ্টান্ন। মূল্য দশ টাকা।’ অস্কার ওয়াইল্ড যখন মার্কিন মুলুকে বেড়াতে গিয়েছিলেন, তখন চুঙ্গিঘর পাঁচজনের মতো তাকেও শুধিয়েছিল, ‘এনিথিং টু ডিক্লেয়ার?’ তিনি আঙুল দিয়ে তাঁর মগজের বাক্সটি বারকয়েক ট্যাপ করে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘মাই জিনিয়াস’। আমার পরিচিতদের ভিতর ওই ঝাণ্ডুদাই একমাত্র লোক, যিনি মাথা তো ট্যাপ করতে পারতেনই সঙ্গে সঙ্গে হার্টটা ট্যাপ করলেও কেউ কোনও আপত্তি করতে পারত না।

জাহাজখানা ছিল বিরাট সাইজের– ঝাণ্ডুদা’র বপুটি স্বচক্ষে দেখেছেন যাঁরা, তাঁরাই আমার কথায় সায় দেবেন যে, তাঁকে ভাসিয়ে রাখা যে-সে জাহাজের কর্ম নয়– তাই সেদিন চুঙ্গিঘরে লেগে গিয়েছিল মোহনবাগান ভর্সস ফি-স্টার-টিম ম্যাচের ভিড়। ঝাণ্ডুদা পঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। হঠাৎ মনে পড়ল ইতালির ‘কিয়ান্তি’ জিনিসটি বড়ই সরেস এবং সরস। চুঙ্গিঘরের কাঠের খোয়াড়ের মুখে দাঁড়িয়েছিল এক পাহারাওলা। তাকে হাজার লিরার একখানা নোট দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন কয়েক বোতল ‘কিয়ান্তি’ রাস্তার ওধারের দোকান থেকে নিয়ে আসতে। পাহারাওলা খাঁটি খানদানি লোকের সংস্পর্শে এসেছে ঠাহর করতে পেরে খাঁটি নিয়ে এল তিন মিনিটেই। পূর্বেই বলেছি ঝাণ্ডুদা জন্মেছিলেন তাগড়াই হার্ট নিয়ে জাহাজের পরিচিত অপরিচিত তথা চুঙ্গিঘরের পাহারাওলা, সেপাই, চাপরাসি, কুলি, সবাইকে ‘কিয়ান্তি’ বিলোতে লাগলেন দরাজ দিলে। ‘স্বাস্থ্যপান’ আরম্ভ হওয়ার পূর্বেই ঝাণ্ডুদার ডাক পড়ে গেল চুঙ্গির কাউন্টারে মাল খালাসিতে তাঁর পালা এসে গেছে। নিমন্ত্রিত রবাহূত সব্বাইকে দরাজ হাত দু খানা পাখির মতো মেলে দিয়ে বললেন, ‘আপনারা ততক্ষণে ইচ্ছে করুন, আমি এই এলুম বলে।’ ‘কিয়ান্তি’ রানিকে বসিয়ে রাখা মহাপাপ।

ঝাণ্ডুদা’র বাক্স-পেঁটরায় এত সব জাত-বেজাত হোটেলের লেবেল লাগানো থাকত যে, অগা চুঙ্গিওলাও বুঝতে পারত এগুলোর মালিক বাস্তুভিটার তোয়াক্কা করে না তাই জীবন কাটে হোটেলে হোটেলে। আজকের চুঙ্গিওলা কিন্তু সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে আরম্ভ করলে, প্রথম ভাগের ছেলে যে-রকম বানান ভুল করে করে বই পড়ে। লোকটার চেহারা বদখত। টিঙটিঙে রোগা, গালদুটো ভাঙা, সে-গালের হাড়দুটো জোয়ালের মতো বেরিয়ে পড়েছে, চোখদুটো গভীর গর্তের ভিতর থেকে নাকটাকে প্যাসনের মতো চেপে ধরেছে, নাকের তলায় টুথব্রাশের মতো হিটলারি গোঁপ। পূর্বেই নিবেদন করেছি, ঝাণ্ডুদা ঝাণ্ডু লোক, তাই তিনি মানুষকে তার চেহারা থেকে যাচাই করেন না। এবারে কিন্তু তাঁকেও সেই নিয়মের ব্যভিচার করতে হল। লোকটাকে আড়চোখে দেখলেন, সন্দেহের নয়নে আমার কানে কানে বললেন, ‘শেক্সপিয়ার নাকি বলেছেন, রোগা লোককে সমঝে চলবে।’ আমার বিশ্বাস, আজ যে শেপিয়ারের এত নামডাক সেটা ওইদিন থেকেই শুরু হয় কারণ ঝাণ্ডুদা আত্মনির্ভরশীল মহাজন, কারও কাছ থেকে কখনও কানাকড়ি ধার নেননি। তিনি ঋণ স্বীকার করাতে ওইদিন থেকে শেকস্‌পিয়ারের যশ-পত্তন হয়।

চুঙ্গিওলা শুধালে, ‘ওই টিনটার ভিতর আছে কী?’

‘ইন্ডিয়ান সুইটস।’

‘ওটা খুলুন।’

 “সে কী করে হয়? ওটা আমি নিয়ে যাব লন্ডনে। খুললে বরবাদ হয়ে যাবে যে?’

চুঙ্গিওলা যে-ভাবে ঝাণ্ডুদা’র দিকে তাকালেন তাতে যা টিন খোলার হুকুম হল, পাঁচ শো ঢ্যাঁঢরা পিটিয়ে কোনও বাদশাও ও-রকম হুকুমজারি করতে পারতেন না।

ঝাণ্ডুদা মরিয়া হয়ে কাতর নয়নে বললেন, ‘ব্রাদার, এ-টিনটা আমি নিয়ে যাচ্ছি আমার এক বন্ধুর মেয়ের জন্য লন্ডনে– নেহাতই চিংড়ি মেয়ে। এটা খুললে সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

এবারে চুঙ্গিওলা যে-ভাবে তাকালে, তাতে আমি হাজার ঢ্যাঁঢরার শব্দ শুনতে পেলুম।

বিরাট-লাশ ঝাণ্ডুদা পিঁপড়ের মতো নয়ন করে সকাতরে বললেন, ‘তা হলে ওটা ডাকে করে লন্ডন পাঠিয়ে দাও, আমি ওটাকে সেখানেই খালাস করব।’

আমরা একবাক্যে বললুম, ‘কিন্তু তাতে তো বড় খরচা পড়বে। পাউন্ড পাঁচেক-নিদেন।’

হ্রস্বশ্বাস ফেলেই বললেন, ‘তা আর কী করা যায়।’

 কিন্তু আশ্চর্য, চুঙ্গিওলা তাতেও রাজি হয় না। আমরাও অবাক। কারণ এ আইন তো সক্কলেরই জানা।

ঝাণ্ডুদা একটুখানি দাঁত কিড়মিড় খেয়ে লোকটাকে আইনটার মর্ম প্রাঞ্জল ভাষায় বোঝালেন। তার অর্থ টিনের ভিতরে বাঘ-ভালুক ককেইন-হেরয়িন যা-ই থাক, ও-মাল যখন সোজা লন্ডনে চলে যাচ্ছে তখন তার পুণ্যভূমি ইতালি তো আর কলঙ্কিত হবে না।

আমরা সবাই কসাইটাকে বোঝাবার চেষ্টা করলুম, ঝাণ্ডুদার প্রস্তাবটি অতিশয় সমীচীন এবং আইনসঙ্গতও বটে। আমাদের দল তখন বেশ বিরাট আকার ধারণ করেছে। ‘কিয়ান্তি’-রানির সেবকের অভাব ইতালিতে কখনও হয়নি– প্রাচুর্য থাকলে পৃথিবীতেও হত না। এক ফরাসি উকিল কাইরো থেকে পোর্ট সঈদে জাহাজ ধরে– সে পর্যন্ত বিন ফিজে লেকচার ঝাড়লে। চুঙ্গিওলার ভাবখানা সে পৃথিবীর কোনও ভাষাই বোঝে না।

ঝাণ্ডুদা তখন চটেছেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘শালা, তবে খুলছি। কিন্তু ব্যাটা তোমাকে না খাইয়ে ছাড়ছিনে।’ তার পর ইংরেজিতে বললেন, ‘কিন্তু তোমাকে, ওটা নিজে খেয়ে পরখ করে দেখতে হবে এটা সত্যি ইন্ডিয়ান সুইটস কি না।’

শয়তানটা চট করে কাউন্টারের নিচে থেকে টিন-কাটার বের করে দিলে। ফরাসি বিদ্রোহের সময় গিলোটিনের অভাব হয়নি।

ঝাণ্ডুদা টিন-কাটার হাতে নিয়ে ফের চুঙ্গিওলাকে বললেন, “তোমাকে কিন্তু ওই মিষ্টি পরখ করতে হবে নিজে, আবার বলছি।’

চুঙ্গিওলা একটু শুকনো হাসি হাসলে। শীতে বেজায় ঠোঁট ফাটলে আমরা যে-রকম হেসে থাকি।

ঝাণ্ডুদা টিন কাটলেন।

কী আর বেরোবে? বেরোল রসগোল্লা। বিয়ে-সাদিতে ঝাণ্ডুদা ভূরি ভূরি রসগোল্লা স্বহস্তে বিতরণ করেছেন–ব্রাহ্মণ-সন্তানও বটেন। কাঁটা-চামচের তোয়াক্কা না করে রসগোল্লা হাত দিয়ে তুলে প্রথমে বিতরণ করলেন বাঙালিদের, তার পর যাবতীয় ভারতীয়দের, তার পর আর সবাইকে অর্থাৎ ফরাসি, জার্মান, ইতালীয় এবং স্প্যানিয়ার্ডদের।

মাতৃভাষা বাংলাটাই বহুত তকলিফ বরদাস্ত করেও কাবুতে আনতে পারিনি, কাজেই গণ্ডা-তিনেক ভাষায় তখন বাঙালির বহুযুগের সাধনার ধন রসগোল্লার যে বৈতালিক গীতি উঠেছিল তার ফটোগ্রাফ দিই কী প্রকারে?

ফরাসিরা বলেছিল, ‘এপাতাঁ!’

 জর্মনরা, ‘ক্লর্কে!’

ইতালিয়ানরা, ‘ব্রাভো!’

স্প্যানিশরা, ‘দেলিচজো, দেলিচজো।’

 আরবরা, ‘ইয়া সালাম, ইয়া সালাম!’

তামাম চুঙ্গিঘর তখন রসগোল্লা গিলছে। আকাশে বাতাসে রসগোল্লা। কিউবিজম বা দাদাইজুমের টেকনিক দিয়েই শুধু এর ছবি আঁকা যায়। চুঙ্গিঘরের পুলিস-বরকন্দাজ, চাপরাসি-স্পাই সক্কলেরই হাতে রসগোল্লা। প্রথমে ছিল ওদের হাতে ‘কিয়ান্তি’, আমাদের হাতে রসগোল্লা। এক লহমায় বদলাবদলি হয়ে গেল।

.

আফ্রিকার এক ক্রিশ্চান নিগ্রো আমাকে দুঃখ করে বলেছিলেন, ক্রিশ্চান মিশনারিরা যখন আমাদের দেশে এসেছিলেন তখন তাদের হাতে ছিল বাইবেল, আমাদের ছিল জমিজমা। কিছুদিন বাদেই দেখি, ওঁদের হাতে জমিজমা, আমাদের হাতে বাইবেল।

আমাদের হাতে ‘কিয়ান্তি’।

ওদিকে দেখি, ঝাণ্ডুদা আপন ভুঁড়িটি কাউন্টারের উপর চেপে ধরে চুঙ্গিওলার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলছেন বাংলাতে—’একটা খেয়ে দেখ।’ হাতে তাঁর একটি সরেস রসগোল্লা।

চুঙ্গিওলা ঘাড়টা একটু পিছনের দিকে হটিয়ে গম্ভীর রূপ ধারণ করেছে।

ঝাণ্ডুদা নাছোড়বান্দা। সামনের দিকে আরেকটু এগিয়ে বললেন, “দেখছ তো, সবাই খাচ্ছে। ককেইন নয়, আফিঙ নয়। তবু নিজেই চেখে দেখ, এ বস্তু কী?’

চঙ্গিওলা ঘাড়টা আরও পিছিয়ে নিলে। লোকটা অতি পাষণ্ড। একবারের তরে ‘সরি-টরি’ও বললে না।

হঠাৎ, বলা-নেই, কওয়া-নেই, ঝাণ্ডুদা তামাম ভূঁড়িখানা কাউন্টারের উপর চেপে ধরে কাক করে পাকড়ালেন চুঙ্গিওলার কলার বাঁ হাতে আর ডান হাতে থেবড়ে দিলেন একটা রসগোল্লা ওর নাকের উপর। ঝাণ্ডদার তাগ সবসময়েই অতিশয় খারাপ।

আর সঙ্গে সঙ্গে মোটা গলায়, ‘শালা, তুমি খাবে না। তোমার গুষ্টি খাবে। ব্যাটা, তুমি মস্করা পেয়েছ? পই পই করে বললুম, রসগোল্লাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে, চিংড়িটা বড় নিরাশ হবে, তা তুমি শুনবে না!’– আরও কত কী।

ততক্ষণে কিন্তু তাবৎ চুঙ্গিঘরে লেগে গিয়েছে ধুন্দুমার। চুঙ্গিওলার গলা থেকে যেটুকু মিহি আওয়াজ বেরুচ্ছে তার থেকে বোঝা যাচ্ছে সে পরিত্রাণের জন্য চাপরাশি থেকে আরম্ভ করে ইলদুচে মুসোলিনি– মাঝখানে যত সব কনসাল, লিগেশন মিনিস্টার, অ্যাম্বাসেডর প্লেনিপটিনশিয়ারি– কারুরই দোহাই কাড়তে কসুর করছে না। মেরি মাতা, হোলি যিসস, পোপঠাকুর তো বটেই।

আর চিৎকার-চেঁচামেচি হবে না কেন? এ যে রীতিমতো বে-আইনি কর্ম। সরকারি চাকুরেকে তার কর্তব্যকর্ম সমাধানে বিঘ্ন উৎপাদন করে তাকে সাড়ে তিনমণি লাশ দিয়ে চেপে ধরে রসগোল্লা খাওয়াবার চেষ্টা করুন আর সেঁকো খাওয়াবারই চেষ্টা করুন, কর্মটির জন্য আকছারই জেলে যেতে হয়। ইতালিতে এর চেয়ে বহুত অল্পেই ফাঁসি হয়।

ঝাণ্ডুদার কোমর জাবড়ে ধরে আমরা জনাপাঁচেক তাঁকে কাউন্টার থেকে টেনে নামাবার চেষ্টা করছি। তিনি পর্দার পর পর্দা চড়াচ্ছেন, ‘খাবি নি, ও পরান আমার, খাবি নি, ব্যাটা–’ চুঙ্গিওলা ক্ষীণকণ্ঠে পুলিসকে ডাকছে। আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে আমার মাতৃভূমি সোনার দেশ ভারতবর্ষের ট্রাঙ্ককলে যেন কথা শুনছি। কিন্তু কোথায় পুলিস? চুঙ্গিঘরের পাইক বরকন্দাজ, ডাণ্ডা-বরদার, আস-সরদার বেবাক চাকর-নফর বিলকুল বেমালুম গায়েব! এ কী ভানুমতী, এ কী ইন্দ্রজাল।

দেখি, ফরাসি উকিল আকাশের দিকে দু হাত তুলে অর্ধনিমীলিত চক্ষে, গদগদ কণ্ঠে বলছে : ‘ধন্য পুণ্যভূমি ইতালি, ধন্য পুণ্যনগর ভেনিস! এ ভূমির এমনই পুণ্য যে হিদেন রসগোল্লা পর্যন্ত এখানে মিরা দেখাতে পারে। কোথায় লাগে “মিরাকল অব মিলান” এর কাছে– এ যে সাক্ষাৎ জাগ্রত দেবতা, পুলিস-মুলিস সবাইকে ঝেঁটিয়ে বার করে দিলেন এখান থেকে! ওহোহো, এর নাম হবে “মিরা দ্য রসগোল্লা”।’

উকিল মানুষ, সোজা কথা প্যাঁচ না মেরে বলতে পারে না। তার উচ্ছ্বাসের মূল বক্তব্য, রসগোল্লার নেমকহারামি করতে চায় না ইতালীয় পুলিস-বরকন্দাজরা। তাই তারা গা-ঢাকা দিয়েছে।

আমরা সবাই একবাক্যে সায় দিলুম। কিন্তু কে এক কাষ্ঠরসিক বলে উঠল, ‘রসগোল্লা নয়, কিয়ান্তি।’ আরও দু’চার পাষণ্ড তায় সায় দিলে।

ইতিমধ্যে ঝাণ্ডুদাকে বহুকষ্টে কাউন্টারের এদিকে নামানো হয়েছে। চুঙ্গিওলা রুমাল দিয়ে রসগোল্লার থ্যাবড়া মুছতে যাচ্ছে দেখে তিনি চেঁচিয়ে বললেন, ‘ওটা পুঁছিস নি; আদালতে সাক্ষী দেবে– ইগজিবিট নাম্বার ওয়ান।’

ওদিকে তখন বেটিং লেগে গিয়েছে, ইতালিয়ানরা ‘কিয়ান্তি’ পান করে, না রসগোল্লা খেয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে কিন্তু ফৈসালা করবে কে? তাই এ-বেটিঙে রিস্ক নেই। সবাই লেগে গিয়েছে।

কে একজন ঝাণ্ডুদাকে সদুপদেশ দিলে, ‘পুলিস ফের এসে যাবে। ততক্ষণে আপনি কেটে পড়ুন।’

তিনি বললেন, ‘না, ওই যে লোকটা ফোন করছে। আসুক না ওদের বড়কর্তা।’

তিন মিনিটের ভিতর বড়কর্তা ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন। ফরাসি উকিলের বোধ হয় সবচেয়ে বড় যুক্তি ঘুষ! এক বোতল ‘কিয়ান্তি’ নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ঝাণ্ডুদা বাধা দিয়ে বললেন, ‘নো।’

তার পর বড় সাহেবের সামনে গিয়ে বললেন, ‘সিন্নোর, বিফো ইউ প্রসিড, অর্থাৎ কি না ময়না-তদন্ত আরম্ভ হওয়ার পূর্বে আপনি একটি ইন্ডিয়ান সুইটস্ চেখে দেখুন।’ বলে নিজে মুখে তুললেন একটি। আমাদের সবাইকে আরেক প্রস্থ বিতরণ করলেন।

বড়কর্তা হয়তো অনেক রকমের ঘুষ খেয়ে ওকিবহাল এবং তালেবর। কিংবা হয়তো কখনও ঘুষ খাননি। ‘না বিইয়ে কানাইয়ের মা’ যখন হওয়া যায় এবং স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র যখন এ-প্রবাদটা ব্যবহার করে গেছেন তখন ‘ঘুষ না-খেয়েও দারোগা’ তো হওয়া যেতে পারে।

বড়কর্তা একটি মুখে তুলেই চোখ বন্ধ করে রইলেন আড়াই মিনিট। চোখ বন্ধ অবস্থায়ই আবার হাত বাড়িয়ে দিলেন। ফের। আবার।

এবারে ঝাণ্ডুদা বললেন, ‘একফোঁটা কিয়াত্তি?’

কাদম্বিনীর ন্যায় গম্ভীর নিনাদে উত্তর এল, ‘না। রসগোল্লা।’

 টিন তখন ভোঁ-ভোঁ।

 চুঙ্গিওলা তার ফরিয়াদ জানালে।

কর্তা বললেন, ‘টিন খুলেছ তো বেশ করেছ, না হলে খাওয়া যেত কী করে?’ আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কী করতে? আরও রসগোল্লা নিয়ে আসুন।’ আমরা সুড়সুড় করে বেরিয়ে যাবার সময় শুনতে পেলুম, বড়কর্তা চুঙ্গিওলাকে বলছেন, ‘তুমিও তো একটা আস্ত গাড়ল। টিন খুললে আর ওই সরেস মাল চেখে দেখলে না?’

‘কিয়ান্তি না রসগোল্লা’ সে-বেটের সমাধান হল।

 ইতালির প্রখ্যাত মহিলা-কবি ফিলিকাজা গেয়েছেন :

‘ইতালি, ইতালি, এত রূপ তুমি কেন ধরেছিলে, হায়!
অনন্ত ক্লেশ লেখা ও-ললাটে নিরাশার কালিমায়।’

আমিও তাঁর স্মরণে গাইলুম :

রসের গোলক, এত রস তুমি কেন ধরেছিলে, হায়!
ইতালির দেশ ধর্ম ভুলিয়া লুটাইল তব পায়!