চিল্কা

চিল্কা

সন্ধ্যাবেলা গোলাপের কুঁড়িটির দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলুম। প্রকৃতি যেন যুগ যুগ ধরে কোটি কোটি কুঁড়ি তৈরি করার পর আজ এ কুঁড়িতে তার পরিপূর্ণতা পেয়েছে।

সকালবেলা বাগানে গিয়ে দেখি, সে কুঁড়িটি ফুটেছে। কুঁড়ির ভেতরে প্রকৃতি গোপনে গোপনে পাপড়ির যে নিখুঁত সামঞ্জস্য সাজিয়ে রেখেছিল সেই সামঞ্জস্য নিয়েই পাপড়িগুলো বাতাসের গায়ে শরীর মেলে দিয়েছে। রেণু যেন রাজকুমারীর, আর চতুর্দিকে সার বেঁধে তাঁর সখীরা এক নিস্তব্ধ নৃত্য আরম্ভ করে দিয়েছেন।

চুপ করে দেখতে দেখতে আমার মনে হল, সন্ধেবেলার কুঁড়িতে দেখেছিলুম এক সৌন্দর্য আর সকালবেলাকার ফোঁটা-ফুলে দেখেছি আরেক সৌন্দর্য। এই পরিবর্তনটি যদি আমার চোখের সামনে ঘটত তবে এই দুই সৌন্দর্যের ভেতর আরও কত সৌন্দর্য দেখতে পেতুম। কিন্তু সে তো হবার নয়; ফুল ফোটে এত ধীরে ধীরে যে তার বিকাশ আর পরিবর্তন তো চোখে পড়ে না। সমস্ত রাত কুঁড়ির কাছে জেগে রইলেও সৌন্দর্যের ক্রমবিকাশে তার ভিন্ন ভিন্ন রূপ আমার চোখ এড়িয়ে যাবে।

ভগবান আমার সে ক্ষোভ চিল্কার পারে ঘুচিয়ে দিলেন।

অতি ভোরে চিল্কার সার্কিট-হাউসে ঘুম ভাঙল, বারান্দায় কাচ্চাবাচ্চাদের কিচির-মিচির শুনে। লাঙ্গুল-আশ্রমের ছেলেমেয়েগুলো তা হলে নিশ্চয়ই দুপুর-রাতে এসে পৌঁছেছে।

দরজা খুলে পুব আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, আমার বাগানের সেই গোলাপকুঁড়ি। শুধু এ কুঁড়ির রঙ একটু বেশি লালচে। আমার আর পুব আকাশের মাঝখানে বিস্তীর্ণ জলরাশির উপর এক ফালি সিঁথির সিঁদুর। কিংবা যেন কোনও রক্তাম্বরধারিণী গরবিনী চিল্কার উপর দিয়ে পুব সাগরের পানে যেতে যেতে রক্তাম্বরী নিংড়ে নিংড়ে জল ফেলে ফেলে আমার ওই কুঁড়ির পেছনে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছেন।

সুন্দরীর কথা ভুলে গিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলুম কুঁড়ির দিকে। সে কুঁড়ি ফুটতে আরম্ভ করেছে। শুধু এর পাপড়ির আকার অন্যরকমের। সোজা, ধারালো তলোয়ারের মতো এক একটি সূর্যরশ্মি দ্বিগ্নলয়ের অন্তরাল থেকে হঠাৎ পূর্ব গগন পানে ধেয়ে ওঠে। অসংখ্য রশ্মি অর্ধচক্রাকারে আকাশ ছেয়ে ফেলেছে। তাদের কেন্দ্র- ঘুমন্ত রাজকুমারীর এখনও দেখা নেই। আকাশের লাল ক্রমেই কমে আসতে লাগল। চিল্কার রাঙা জলের ফালি গোলাপি হয়ে হয়ে শেষটায় নীলাম্বরী পরতে আরম্ভ করেছে।

চতুর্দিকে আর সবকিছু পার, যেন হিমানীর গ্লানি মাখা।

সবিতা স্বপ্রকাশ হলেন। আলোতে আলোতে হিমানীর সর্ব-গ্লানি ঘুচে যাচ্ছে। পুব আকাশের দিকে ধেয়ে-ওঠা সূর্য-অসিরাজি সবিতা সংহরণ করে নিয়েছেন। জাদুকর তার ভানুমতীর ইন্দ্রজাল অদৃশ্য করে পূর্ণ মহিমায় রঙ্গমঞ্চে একা দাঁড়িয়ে রইলেন।

আমারই চোখের সামনে আমার বাগানের গোলাপের কুঁড়িটি ফুটে উঠল। এর সম্পূর্ণ ফোঁটাটি আমি প্রাণভরে দেখলুম। এর কিছুই ফাঁকি গেল না। কিন্তু এ ফোঁটা গোলাপের ফোঁটার চেয়ে কত লক্ষ গুণ গম্ভীর। এর ব্যাপ্তি বিশ্বচরাচর ছড়িয়ে এবং হয়তো ছাড়িয়ে।

আমার মনে আর কোনও ক্ষোভ রইল না।

আলো ফুটেছে, কিন্তু জলে বাতাসে, ডাঙায় আকাশে এখনও যেন কী এক আবেশ জড়ানো। চিল্কার জল কেমন যেন একটা নীলুফরি রঙ মেখে নিয়েছে। এ রঙ সমুদ্রের জল চেনে না, দেশের বিলে, বিদেশের ব্লু ডানয়ুবেও নীলের এ আভাস আমি কখনও দেখিনি। তবে কি চিল্কা একদিকে যেমনদ, অন্যদিকে তেমনি সমুদ্রের সঙ্গে জোড়া বলে শাদায় আর নীলে মিশে গিয়ে নিলুফরি রঙ ধরেছে তাই হবে। বর্ষায় নাকি নদীর অপর্যাপ্ত জলহদে নেমে এসে তার লোনা জলকে মিঠা করে দেয়। শীতে নাকি সমুদ্রের জোয়ারের মারে জল ফের লোনা হয়ে যায়।

নীলুফরির মাঝখানে ওই বিরাট কালো পোচ কিসের? মন্দমধুর ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে বলে সে-পপাঁচ আবার অল্প অল্প দুলছে। স্টিমলঞ্চ ক্রমেই কালো পোঁচের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখি সেই কালো ফালিটা জল ছেড়ে আকাশের দিকে হাওয়ায় ভর করে উড়ে চলল– লক্ষ লক্ষ পাখি। এরা নাকি এসেছে সাইবেরিয়া থেকে, হিমালয় থেকে। ঠিকই তো; এদের হাত আমি দেখেছি খাসিয়া পাহাড়ের পায়ের কাছে, ডাউঁকির হাওরে হাওরে, চেরাপুঞ্জির জলে ভর্তি বিলে বিলে।

চিল্কার সমস্ত সৌন্দর্য এক মুহূর্তে অন্ধকার হয়ে গেল। হৃৎপিণ্ডটা কে যেন শক্ত হাতে মুচড়ে দিল, বুক থেকে কী যেন একটি উঠে এসে গলাটাকে বন্ধ করে দিল। আর যেন ঢোক গিলতে পারছিনে।

.

মাথার উপরকার সমস্ত আকাশ ছেয়ে ফেলে শুভ্র মল্লিকার পাপড়ি ছড়াল কে? পাপড়িগুলো। অতি ধীরে ধীরে কেঁপে কেঁপে, এদিক ওদিক হয়ে হয়ে জলের দিকে নেমে আসছে। বিলেতের বরফ-বর্ষণ এর কাছে হার মানে।

এ তো সেই পাখিগুলোর বুক। এদের পিঠের রঙ কালো। তাই তারা যখন জলে বসে থাকে তখন মনে হয়, এরা হ্রদের নীল চোখের কৃষ্ণাঞ্জন, আর আকাশ থেকে যখন নেমে আসে তখন উপরের দিকে তাকিয়ে দেখি সিত-মল্লিকা-বর্ষণ।

পাশে ভাগ্নি কৃষ্ণা বসে ছিল। বললে, ‘মামা, এই দেখ, চিল্কার দেবী কালী-মা’র দ্বীপ। ওখানে জল নেই, ঘাস নেই। তোমার টাকের মতো সবকিছু খা-খা করছে।’

টাকের কথা ওঠাতে বিরক্ত হয়ে দ্বীপের দিকে না তাকিয়ে তাকালুম রোষ-কষায়িত লোচনে কৃষ্ণার চোখের দিকে। সেখানে দেখি চিল্কার মাধুরী। কৃষ্ণার চোখের শাদা যেন শাদা হতে হতে নীলুফরি হয়ে গিয়েছে আর তার গায়ের কালো রঙ দিয়ে চোখের চতুর্দিকে স্বয়ং বিশ্বকর্মা এঁকে দিয়েছেন কৃষ্ণাঞ্জন।

ভগবান একই সৌন্দর্য কত না ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখান! শিশুর খলখলে হাসি আমি শুনেছি নিঝরিণীর কলকল রোলে, বিগলিত মাতৃস্তন্য দেখেছি আরবের মরুভূমির বুক ফেটে বেরিয়ে আসা সুধারসে, নবজাত শিশুর গাত্রগন্ধে পেয়েছি প্রথম আষাঢ়ের ভিজে মাটির গন্ধ।

.

রসময় পাঠক, এইবারে আমি তোমার একটু করুণা ভিক্ষা করি। আমি কাব্যরস ভিন্ন অন্য আরও দু একটি রসের সন্ধান করি। তারই একটি খাদ্যরস। চিল্কার এ পাখির রস আমি চেখেছি দেশে। আবার লোভ হল। সঙ্গে ছিল স-বন্দুক পারিকুদের রাজা। তার এবং তার বন্দুকের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালুম। সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে চিল্কার কালীকে স্মরণ করে বললুম, ‘গোটা পাঁচেক পাখি দাও না, মা!’ তার পর ভাবলুম, না, অত বেশি চাওয়া-চাওয়ি ভালো নয়, দেবীকে দেখাতে হবে, আমি কত অল্পতেই সন্তুষ্ট হই। মনে মনে বললুম, আচ্ছা, না হয়, পাঁচটা নাই-বা দিলে। গোটা দুত্তিন দিলেই হবে। আমার খাঁই মাইজি বড্ডই কম।

বলেই একটা ইরানি গল্প মনে পড়ে যাওয়াতে হাসি পেল। এক ইরানি দরবেশ ভগবানকে উদ্দেশ করে বললে, ‘হে আল্লাতালা, আমাকে হাজার পঁচিশেক তুমান দাও। আমি তোমার কিরে কেটে বলছি, তার থেকে পাঁচ হাজার তুমান গরিব-দুঃখীদের ভেতর দান-খয়রাত করে বিলোব। আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না? আচ্ছা, তা হলে তোমার পাঁচ হাজার মান কেটে নিয়ে আমাকে বিশ হাজারই দাও।’

চিল্কা হ্রদ বিস্তর ছোট দ্বীপে ভর্তি। মাত্র একটি ছাড়া নাকি সব কটাতেই মিষ্টি জল পাওয়া যায়। এসব দ্বীপে থাকে গরিব জেলেরা। ডাঙার সঙ্গে এদের কোনও যোগসূত্র নেই। এদের পোস্ট-অফিস নেই, টেলিগ্রাফের তার ডাঙার সঙ্গে দ্বীপের মানুষকে কাছাকাছি এনে দেয়নি। আর আপন দ্বীপের বাইরে বিশ্বসংসারের কাকেই-বা এরা চেনে যে ওরা এদের টেলিগ্রাম পাঠাবে, ওরা এদের কুশল সংবাদ জানতে চাইবে।

আমি ভাবলুম, আমার দেশে নাগা-গারোরা পর্যন্ত মাঝে মাঝে পাহাড় থেকে নেমে, পায়ে হেঁটে কিংবা বাসে করে শহরে যায়। এটা সেটা দেখে, ফুটপাথের দোকানে বসে চা খায়, সিনেমা যায়, কেনাকাটাও করে। এই উড়িষ্যারই আদিবাসীরা মাঝে মাঝে বন থেকে বেরিয়ে এসে আমার বাড়িঘরদোর দেখে, হয়তো মনে মনে সংকল্প করে, বনের ভেতরই ওদের জীবনকে আরও সমৃদ্ধ করবে। কিন্তু চিল্কার দ্বীপবাসীরা সৃষ্টির সেই আদিমকাল থেকেই দ্বীপবাসী। আজ যেসব জিনিসপত্র দিয়ে তারা মাছ ধরে দু হাজার বৎসর পূর্বেও তাই দিয়ে তারা মাছ ধরেছে। সভ্যতার শ্রীবৃদ্ধি, বিজ্ঞানের প্রসার এদের কোনও কাজে লাগেনি।

হয়তো ভালোই আছে। ফার্সিতে বলে, ‘দূর বাশ, খুশ বাশ।’ দূরে আছে, ভালোই আছে। টমাস কেম্পিসও বলেছেন, ‘যতবার আমি মানবসমাজে গিয়েছি ততবারই আমি খানিকটে মনুষ্যত্ব হারিয়ে বাড়ি ফিরেছি।’ হয়তো সভ্যতার আওতায় না এসে এরা সত্যই সভ্যতর।

চিল্কার বড় দ্বীপ পারিকুদ। ডাঙা থেকে মাইল আষ্টেক দূরে হবে। দ্বীপে নেমে খানিকক্ষণ চলার পর মনে হল, কোথায় চিল্কা, কোথায় তার নীলুফরি জল, কোথায় দূর-দূরান্তের সিন্ধু-রেখা আর কোথায়ই-বা কৃষ্ণপক্ষ পক্ষীর শুভ্র বক্ষের মল্লিকা বর্ষণ। এ তো দেখছি, পুব-বাংলার পাড়া গাঁ। রাস্তার উপর সাদা ধুলো। দু দিকে রাস্তার জন্য মাটি ভোলা পলে লাইন বেঁধে ডোবার সারি। তাতে ফুটেছে ছোট ছোট শ্বেতপদ্ম, রক্তপদ্ম। মাছরাঙা ওড়াউড়ি করছে আর মাঝে মাঝে এক পায়ে দাঁড়িয়ে ধ্যানমগ্ন বক। মোষগুলো গলা অবধি জলে ডুবিয়ে চোখ বন্ধ করে ধীরে গম্ভীরে মাথা নাড়ছে। শুধু পুব-বাংলার জমির মতো এ জমি উর্বরা নয়; তাই ক্ষেত-খামারের চিহ্ন কম।

রোদ চড়ছে। দূর গ্রামের শ্যামশ্রীর দিকে তাকিয়ে চোখ জুড়ায়। ওইখানে পৌঁছতে পারলে হয়। শহরের লোক; এতখানি হেঁটে অভ্যেস নেই। ক্লান্তি বোধ হচ্ছে।

সঙ্গে পারিকুদের রাজা। রাজবাড়িতে পৌঁছে দু দণ্ড জিরিয়ে নিলুম। সেখানে বিরাট বিরাট কৌচ সোফা, দশ-হাতি খাড়া আয়না, জগদ্দল কাবার্ড আলমারি, সোনার সিংহাসন, মার্বেল-টপ টেবিল, বাথটাব, ঝাড়-ফানুস, আর কত কী! ওসব ওই গরিব জেলেদের পয়সায়? অবিশ্বাস্য।

কলকাতা থেকে ট্রেনে এসেছে চিল্কার পার অবধি। তার পর কত চেল্লাচেল্লি হৈ-হুঁল্লোড়ের ভেতর এগুলোকে নৌকায় চাপানো হয়েছে, নামাতে হয়েছে, কত লোক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এগুলোকে রাজবাড়ি পর্যন্ত কাঁধে করে বয়ে এনেছে, পড়ি-মরি হয়ে উপরের তলায় তুলেছে।

শুধু রাজপরিবার এগুলো ব্যবহার করেন। রাজপরিবার বলতে উপস্থিত রাজা আর রানি। আর আজ সকালের মতো আমরা।

.

সূর্য মধ্যগগনে। লঞ্চ পুবদিকে সমুদ্রের পানে ধাওয়া করেছে, যেখানে হ্রদের সঙ্গে সমুদ্রের সঙ্গম।

পূর্বদিগন্তে যেখানে সমুদ্র আর হ্রদ আকাশের সঙ্গে মিশেছে সে জায়গা ঝাপসা হয়ে আছে। মনে হয় হ্রদ দূরে যেতে যেতে হঠাৎ যেন কোথাও অসীম শূন্যে লীন হয়ে গিয়েছে। গ্রীষ্মের দ্বিপ্রহরে গরমের দেশের দগ্ধতাম্র দিগন্তে যে অস্বচ্ছ ছায়ানৃত্য আরম্ভ হয়, এখানে যেন তারই এক অন্যরূপ। এখানে যে অশরীরী বাষ্প-নৃত্য আরম্ভ হয়েছে আর তারই আড়ালে হ্রদের শেষ, সমুদ্রের আরম্ভ, সমুদ্রবক্ষে আকাশের চুম্বনে সবকিছু ঢাকা পড়ে গিয়েছে।

তাই পশ্চিমমুখো হয়ে বসলুম ডাঙার দিকে তাকিয়ে।

পাখিরা সব গেল কোথায়? শুধু দু একটি ঝাক হেথা হোথায়। বোধহয় ঠাণ্ডা দেশের প্রাণী বলে দ্বীপের গাছতলার ঠাণ্ডাতে আশ্রয় নিয়েছে।

কত রকমের নীল রঙ দেখছি।

হ্রদের জল দুপুর-রোদে অতি হালকা ফিকে নীল হয়ে গিয়েছে। হ্রদের পরে পাড়ের গ্রামের রঙ এমনিতে ঘন সবুজ কিন্তু এখন দেখাচ্ছে হ্রদের জলের চেয়ে একটুখানি ঘনতর নীল। গ্রামের পেছনে পাহাড়, তার রঙ আরও একটু বেশি ঘন নীল। এবং সর্বশেষে পাহাড়ের পেছনের আকাশ ঘোর নীল।

এ কী করে সম্ভব হয় জানিনে। গ্রামের গাছপালা, পাহাড়ের ঝোঁপঝাড় হয় সবুজ রঙের কিন্তু আজ এরা নীলের ছোপ মেখে নিল কী করে? তবে কি আমার আর পাড়ের মাঝখানে দীর্ঘ নীল বিস্তৃতি আমার চোখ দুটিকে নীলাঞ্জন– কিংবা নীল চশমা পরিয়ে দিয়েছে যে আমি সবকিছুই নীল দেখছি?

মেজিশিয়ানরা দেখেছি মাথার উপরে হাত তুলে এক প্যাক তাস ছেড়ে দেয় আর আলগা আলগা তাসগুলো জুড়ে গিয়ে ভাঁজে ভাঁজে নেমে আসে। এখানে যেন আকাশের অন্তরাল থেকে কোনও এক জাদুকর আকাশ, পাহাড়, বন, জল, এই হরতন, চিরিতন, রুহিতন, ইশকাপনের চারখানা তাস জুড়ে দিয়ে ভাঁজে ভাঁজে লটকে দিয়েছেন। কিন্তু এ ওস্তাদ লাল-কালোর দু রঙ না নিয়ে, মেলাই তসবির না একে, এক নীলের ভিন্ন ভিন্ন আভাস নিয়ে অপূর্ব এক ভেলকিবাজি দেখাচ্ছেন।

হ্রদের বুকে হাওয়া এতটুকু আঁচড় কাটেনি একেবারে সম্পূর্ণ নিখিরকিচ। শুধু আমাদের লঞ্চ যেন চিরুনির মতো ইন্দ্রপুরীর কোনও এক রমণীর দীর্ঘ বিন্যস্ত নীলকুন্তলে সিঁথি কেটে কেটে সমুদ্র-সীমান্তের দিকে এগিয়ে চলেছে। সিথির দু দিকে চূর্ণ কুন্তলের ফেলনা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে কিন্তু এ গরবিনীর কুন্তলদাম এমনই বিপুল যে চিরুনি বেশিদূর এগোতে-না এগোতেই দেখতে পাই, দু দিকের ঘন কুন্তল সিথিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।

চতুর্দিকে অসীম শান্তি পরিব্যাপ্ত। শুধু লঞ্চের মোটরটার একটানা শব্দ কর্ণে পীড়া দেয়। সান্ত্বনা শুধু এইটুকু, এই নীলিমার সৌন্দর্যমাধুরীতে ডুব দিলে কানে এসে মোটরের শব্দ পৌঁছয় না।

যোগশাস্ত্রে পতঞ্জলি চিত্তবৃত্তি-নিরোধের অনেক পন্থার নির্দেশ দিয়েছেন। এটা দিলেন না কেন?

.

এবারে সূর্যাস্ত। পশ্চিমের আকাশ হয়ে গিয়েছে টুকটুকে লাল। আকাশ যেন প্রথমটায় তার নীল কপালের সিঁথিতে একফালি সিঁদুর মেখেছিলেন, তার পর তার থোকা কচি হাতে এলোপাতাড়ি থাবড়া দিয়ে এখানে-ওখানে খাবলা খাবলা সিঁদুর লাগিয়ে দিয়েছে। মা শেষটায় সমস্ত মাথায় সিঁদুর মেখে নিয়েছেন।

নীলে লালে মিশে গিয়ে বেগুনি হয়? তাই বোধহয়। হ্রদের জল বেগুনি হয়ে গিয়েছে।

আজকের সূর্যাস্ত বড় অল্প সময়েই শেষ হয়ে গেল। আকাশে মেঘ থাকলে তারা সূর্যাস্তের লালিমা খানিকটে শুষে নেয় এবং সূর্য পাহাড়ের আড়ালে চলে যাওয়ার পরও মাহফিল শেষের তানপুরার রেশের মতো খানিকক্ষণ আকাশ বাতাস-জলস্থল রাঙিয়ে রাখে।

দিল্লির কবি গালিব সাহেব এই ‘শেষ রেশটুকু’র ওপর হাড়ে হাড়ে চটা ছিলেন। তার দুরবস্থা তখন চরমে। বাড়িখানা ঝুরঝুরে। এক বন্ধুকে চিঠি লিখেছিলেন, ‘অগর পানি বরস্তা এক ঘণ্টা, তো ছৎ বরসতি দো ঘটে’–‘জল যদি বর্ষে এক ঘণ্টা তো ছাত বর্ষে দুঘন্টা!’

দু এক ঝাঁক পাখি এখানে-ওখানে। পারিকুদের রাজাকে বললুম, ‘দু একটা মার না।’

রাজার রাজকীয় চাল। পাখি দেখলে চাকরকে ধীরে সুস্থে বলেন, ‘বন্দুকো।’ চাকর রাজার রাজা! তার চাল আরও ভারিক্কি। আরও ধীরেসুস্থে কেস খুলে বন্দুক এগিয়ে দেয়। রাজা গদাইলস্করি চালে বন্দুকো জোড়া লাগিয়ে বলেন, ‘কার্তুজো’। ক-রে, ক-রে সব যখন তৈরি তখন পাখিরা সাইবেরিয়ায় চলে গিয়েছে। তবে কি রাজার তাগ খারাপ?

তবু ভদ্রতার খাতিরে দু একটা গুলি ছুড়লেন। ফলং শূন্যং।

আমার একটা গল্প মনে পড়ে গেল।

বড়লাট গেছেন বরোদায় পাখি শিকারে। আমাদের ওস্তাদ শিকারি রহমত মিয়া গেছেন সঙ্গে। সন্ধ্যায় যখন ওস্তাদ বাড়ি ফিরলেন তখন বাচ্চা শিকারিরা উদগ্রীব হয়ে শুধালে, বড়লাট সায়েবের তাগ কী রকম? ওস্তাদ প্রথমটায় রা কাড়েন না। শেষটায় চাপে পড়ে বললেন, ‘বড়লাটের মতো শিকারি হয় না, আশ্চর্য তাঁর তাগ। কিন্তু আজ খুদাতালা পাখিদের প্রতি সদয় (মেহেরবান) ছিলেন।’

.

পূর্ব-পশ্চিমে যেন দেখন-হাসি, ইলেকটিরিতে খবর পাঠাল, না বয়স্কাউটের নিশানে নিশানে কথাবার্তা। পশ্চিমের লালের ইশারায় পুব লাল হয়। সেই লাল ফিকে হচ্ছে– কী গোপন কায়দায় তার খবর পূর্বে পৌঁছচ্ছে? মাঝের বিস্তীর্ণ আকাশ তো ফিকে, কোনও রঙ নেই, ফেরার নেই। কী করে এর হাসি ওর গায়ে গিয়ে লাগে, এর বেদনা ওর বুকের সাড়ায় প্রকাশ পায়?

.

আধা আলো-অন্ধকারে সাতপাড়া দ্বীপে নামলুম। আম-বাগানের ভেতর ছোট একটি ডাক-বাংলো। লাঙ্গুল আশ্রমের কাচ্চাবাচ্চারা কিচিরমিচির করছে। খানিক পরে চিল্কা হ্রদের তাজা মাছ-ভাজার গন্ধ নাকে এল। সর্বাঙ্গে ক্লান্তি, কখন খেলুম কখন ঘুমিয়ে পড়লুম, কিছু মনে নেই।

শেষরাত্রে ঘুম ভাঙল। দেখি আমার অজানাতে বাতিওলারা এসে আসমানের ফরাশে এখানে ওখানে তারার মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখে গিয়েছে। এবারে শেষ রাত্রের মুশায়েরা বসবে। আমগাছ মাথা দোলাবে, ঝিবি নূপুর বাজাবে, পুবের বাতাস মজলিসের সর্বাঙ্গে গোলাপ-জল ছিটিয়ে ঠাণ্ডা করে যাবে।

তার পর দেখি দূর সাগরের ওপারে লাল মদের ভাঁড় থেকে চাঁদ উঠলেন ধীরে ধীরে, গা টেনে টেনে। সকলের মুখে হাসি ফুটল। অন্ধকার আকাশে যেসব মোসাহেবরা গা-ঢাকা দিয়েছিলেন তাঁদেরও চেনা গেল। ছোট বাচ্চা যেমন মুশায়েরার মাঝখানে ঘুমিয়ে পড়ে, আমি আবার তেমন ঘুমিয়ে পড়লুম।

ভোর হল। আজ আমার ছুটি শেষ। আপিসের কথা মনে পড়তেই সর্বাঙ্গ হিম হয়ে গেল। লঞ্চে উঠে পাড়ের পানে রওনা দিলুম। সে সকালেও অনেক নবীন সৌন্দর্য দেখা দিয়েছিল কিন্তু আপিসের জুজু আমার পঞ্চেন্দ্রিয় অসাড় করে দিয়েছে। যেন ডুবসাঁতার দিয়ে ডাঙায় পৌঁছে, আপিস আর অদৃষ্টকে অভিসম্পাত দিতে দিতে কটক এলুম।