উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়– নির্বাসিতের আত্মকথা

উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়– নির্বাসিতের আত্মকথা

কোনও কোনও বই পড়ে লেখকেরা আপন আপন ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বড় নিরাশ হন। যাদের সত্যকার শক্তি আছে, তাদের কথা হচ্ছে না, আমি ভাবছি আমার আর আমার মতো আর পাঁচজন কমজোর লেখকের কথা।

প্রায় ত্রিশ বৎসর পর পুনরায় ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’ পুস্তিকাখানি আদ্যন্ত পড়লুম। পাঠকমাত্রই জানেন, ছেলেবেলায় পড়া বই পরিণত বয়সে পড়ে মানুষ সাধারণত হতাশ হয়। ‘নির্বাসিতের’ বেলা আমার হল বিপরীত অনুভূতি, বুঝতে পারলুম কত সূক্ষ্ম অনুভূতি কত মধুর বাক্যভঙ্গি, কত উজ্জ্বল রসবাক্য, কত করুণ ঘটনার ব্যঞ্জনা তখন চোখে পড়ে। সাধুভাষার মাধ্যমে যে এত ঝকঝকে বর্ণনা করা যায়, সে ভাষাকে যে এতখানি চটুল গতি দিতে পারা যায়, ‘নির্বাসিত’ যাঁরা পড়েননি, তাঁরা কল্পনামা করতে পারবেন না।

কিন্তু প্রশ্ন, এই বই পড়ে আপন ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে হতাশ হলুম কেন?

হায়, এরকম একখানা মণির খনির মতো বইয়ের চারটি সংস্করণ হল ত্রিশ বৎসরে! তা হলে আর আমাদের ভরসা রইল কোথায়?

***

১৯২১ (দু চার বছর এদিক-ওদিক হতে পারে) ইংরেজিতে একদিন শান্তিনিকেতন লাইব্রেরিতে দেখি একগাদা বই গুরুদেবের কাছ থেকে লাইব্রেরিতে ভর্তি হতে এসেছে। গুরুদেব প্রতি মেলে বহু ভাষায় বিস্তর পুস্তক পেতেন। তাঁর পড়া হয়ে গেলে তার অধিকাংশ বিশ্বভারতী পুস্তকাগারে স্থান পেত। সেই গাদার ভিতর দেখি, ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’।

বয়স অল্প ছিল, তাই উপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম জানা ছিল না। বইখানা ঘরে নিয়ে এসে এক নিশ্বাসে শেষ করলুম। কিছুমাত্র বাড়িয়ে বলছিনে, এ বই সত্য সত্যই আহার-ন্দ্রিা ভোলাতে পারে। ‘পৃথিবীর সব ভাষাতেই এরকম বই বিরল; বাংলাতে তো বটেই।’

পরদিন সকালবেলা গুরুদেবের ক্লাসে গিয়েছি। বই খোলার পূর্বে তিনি শুধালেন, ‘উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “নির্বাসিতের আত্মকথা” কেউ পড়েছ?’ বইখানা প্রকাশিত হওয়ামাত্র রবীন্দ্রনাথের কাছে এসেছে; তিনি সেখানা পড়ে লাইব্রেরিতে পাঠান; সেখান থেকে আমি সেটাকে কব্জা করে এনেছি, অন্যেরা পড়বার সুযোগ পাবেন কী করে? বয়স তখন অল্প, ভারি গর্ব অনুভব করলুম।

বললুম, ‘পড়েছি।’

 শুধালেন, ‘কী রকম লাগল?’

 আমি বললুম, ‘খুব ভালো বই।’

 রবীন্দ্রনাথ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘“আশ্চর্য” বই হয়েছে! এরকম বই বাংলাতে কম পড়েছি।’

বহু বত্সর হয়ে গিয়েছে বলে আজ আর হুবহু মনে নেই রবীন্দ্রনাথ ঠিক কী প্রকারে তার প্রশংসা ব্যক্ত করেছিলেন। আমার খাতাতে টোকা ছিল এবং সে খাতা কাবুল-বিদ্রোহের সময় লোপ পায়। তবে একথা আমার পরিষ্কার মনে আছে যে, রবীন্দ্রনাথ বইখানার অতি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন।

বিখ্যাত লেখককে দেখার সাধ সকলেরই হয়। আমি যে সে কারণে উপেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলুম তা নয়। আমার ইচ্ছা ছিল দেখবার যে বারো বৎসর নরকযন্ত্রণার পর তিনি যে তাঁর নিদারুণ অভিজ্ঞতাটাকে হাসি-ঠাট্টার ভিতর দিয়ে প্রকাশ করলেন তার কতখানি সত্যই তার চরিত্রবলের দরুন এই বিশেষ রূপ নিল আর কতখানি নিছক সাহিত্যশৈলী মাত্র। অর্থাৎ তিনি কি সত্যই এখনও সুরসিক ব্যক্তি, না অদৃষ্টের নিপীড়নে তিক্ত স্বভাব হয়ে গিয়েছেন।

গিয়ে দেখি পিতা-পুত্র বসে আছেন।

বেশ নাদুস-নুদুস চেহারা (পরবর্তী যুগে তিনি রোগা হয়ে গিয়েছিলেন), হাসিভরা মুখ আর আমার মতো একটা আড়াই ফোঁটা ছোকরাকে যে আদর করে কাছে বসালেন, তার থেকে তৎক্ষণাৎ বুঝে গেলুম যে, তার ভিতর মানুষকে কাছে টেনে আনবার কোনও আকর্ষণী ক্ষমতা ছিল, যার জন্যে বাংলা দেশের তরুণ সম্প্রদায় তাঁর চতুর্দিকে জড় হয়েছিল।

ছেলেটিকেও বড় ভালো লাগল। বড্ড লাজুক আর যে সামান্য দু একটি কথা বলল, তার থেকে বুঝলুম, বাপকে সে শুধু যে ভক্তি-শ্রদ্ধাই করে তা নয়, গভীরভাবে ভালোও বাসে।

অটোগ্রাফ শিকারের ব্যসন তখন বাংলা দেশে চালু হয়নি। তবে সামান্য যে দু একজন তখনকার দিনে এ ব্যসনে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁরা শুধু স্বাক্ষরেই সন্তুষ্ট হতেন না, তার সঙ্গে সঙ্গে কিছু কুটেশন বা আপন বক্তব্য লিখিয়ে নিতেন। আমার অটোগ্রাফে দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, অবনীন্দ্রনাথ, প্রফুল্ল রায়, লেভি, অ্যান্ড্রুজ প্রমুখের লেখা তো ছিলই, তার ওপর গগনেন্দ্রনাথ, নন্দলাল, অসিতকুমার, কারপেলেজের ছবিও ছিল।

উপেনবাবুকে বইখানা এগিয়ে দিলুম।

এর পিছনে আবার একটুখানি ইতিহাস আছে।

বাজে-শিবপুরে শরৎচন্দ্রকে যখন তাঁর স্বাক্ষর এবং কিছু একটা লেখার জন্য চেপে ধরেছিলুম, তখন তিনি জিগ্যেস করেছিলেন বিশেষ করে তার কাছেই এলুম কেন? আমি আশ্চর্য হয়ে বলেছিলুম, আপনার লেখা পড়ে আপনার কাছে না আসাটাই তো আশ্চর্য!

শরৎবাবু একটুখানি ভেবে লিখে দিলেন, ‘দেশের কাজই যেন আমার সকল কাজের বড় হয়।’

আমি জানি শরৎচন্দ্র কেন ওই কথাটি লিখেছিলেন। তখন তিনি কংগ্রেস নিয়ে মেতেছিলেন।

তার পর সেই বই যখন রবীন্দ্রনাথকে দিলুম, তখন তিনি শরৎচন্দ্রের বচন পড়ে লিখে দিলেন–

‘আমার দেশ যেন উপলব্ধি করে যে, সকল দেশের সঙ্গে সত্য সম্বন্ধ দ্বারাই তার সার্থকতা।’

এর ইতিহাস বাঙালিকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না। জাতীয়তাবাদ ও বিশ্বমৈত্রী নিয়ে তখন রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্রের তর্ক আলোচনা হচ্ছিল।

উপেনবাবুকে অটোগ্রাফ দিতে তিনি দুটি লেখা পড়ে লিখে দিলেন–

‘সবার উপরে মানুষ সত্য
তাহার উপরে নাই।’

***

ছেলেবেলায় বইখানা পড়েছিলুম এক নিশ্বাসে কিন্তু আবার যখন সেদিন বইখানা কিনে এনে পড়তে গেলুম তখন বহুবার বইখানা বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকতে হল। বয়স হয়েছে, এখন অল্পেতেই চোখে জল আসে আর এ বইয়েতে বেদনার কাহিনী অল্পের ওপর দিয়ে শেষ হয়নি। সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব বোধহয় বইখানির সেখানেই। উপেন্দ্রনাথ যদি দস্তয়েকির মতো পুঙ্খানুপুঙ্খ করে তাঁর কারাবাস আর আন্দামানজীবন (জীবন না বলে মৃত্যু’ বলাই ঠিক) বর্ণনা করতেন তবে আমাদের মনে কোন জাতীয় অনুভূতির সৃষ্টি হত বলা সুকঠিন কিন্তু এই যে তিনি নির্বাসিতদের নিদারুণ দুঃখ-দুর্দৈবের বহুতর কাহিনী প্রতিবারেই সংক্ষিপ্ততম বর্ণনায় শেষ করে দিয়েছেন এতে করেই আমাদের কল্পনা তার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়ে কত হৃদয়বিদারক ছবি এঁকে আমাদের হৃদয়কে মথিত করেছে কত বেশি। সেটা হল প্রকৃত শক্তিশালী লেখকের লক্ষণ। যেটুকু ব্যঞ্জনার পাখা প্রয়োজন উপেন্দ্রনাথ সেইটুকু মাত্র দিয়েই আমাদের উড়িয়ে দিলেন। উপেন্দ্রনাথ স্বয়ং যে উদ্ধৃতি আপন পুস্তকে ব্যবহার করেছেন আমি সেইটে দিয়ে তাঁর এ অলৌকিক ক্ষমতার প্রশস্তি গাই;

‘ধন্য ধন্য পিতা দশমেস গুরু
যিন চিড়িয়াঁসে বাজ তোড়ায়ে’

‘ধন্য ধন্য পিতঃ হে দশম গুরু! চটক দিয়া তুমি বাজ শিকার করাইয়াছিলে; তুমি ধন্য!’(১)

উপেন্দ্রনাথ দস্তয়েফস্কির মতো শক্তিশালী লেখক নন; দস্তয়েফস্কির মতো বহুমুখী প্রতিভা তাঁর ছিল না কিন্তু একথা বারবার বলব দস্তয়েফস্কির ‘সাইবেরিয়া কারাবাস’ উপেন্দ্রনাথের ‘আত্মকথা’র কাছে অতি নিশ্চয় হার মানে।

সবচেয়ে মামুলি জিনিস নিয়েই উপেন্দ্রনাথের শক্তির পরিচয় দিই। ভাষার দখল অনেক লোকেরই আছে কিন্তু একই ভাষার ভিতর এতরকমের ভাষা লিখতে পারে কজন? একশ সত্তর পাতার বইয়ে ফলাও করে বর্ণনা দেবার স্থান নেই অথচ তার মাঝখানেই দেখুন সামান্য কয়টি ছত্রে কী অপরূপ গুরুগম্ভীর বর্ণনা :

‘গানটা শুনিতে শুনিতে মানস-চক্ষে বেশ স্পষ্টই দেখিতাম যে, হিমাচলব্যাপী ভাবোত্ত জনস ভয়করার স্পর্শে সিংহগর্জনে জাগিয়া উঠিয়াছে; মায়ের রক্তচরণ বেড়িয়া বেড়িয়া গগনস্পর্শী রক্তশীর্ষ উত্তাল তরঙ্গ ছুটিয়াছে; দুলোক ভূলোক সমস্তই উন্মত্ত রণবাদ্যে কাঁপিয়া উঠিয়াছে। মনে হইত যেন আমরা সর্ববন্ধনমুক্ত– দীনতা, ভয় মৃত্যু আমাদের কখনও স্পর্শ করিতে পারিবে না।’ (২)

পড়ে মনে হয় যেন বিবেকানন্দের কালীরূপ বর্ণনা শুনছি :

‘নিঃশেষে নিবেছে তারাদল
মেঘ আসি আবরিছে মেঘ
স্পন্দিত ধ্বনিত অন্ধকার
গরজিছে ঘূর্ণ বায়ুবেগ
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত পরান
বহির্গত বন্দিশালা হতে
 মহাবৃক্ষ সমূলে উপাড়ি
ফুৎকারে উড়ায়ে চলে পথে’।(৩)

 উপরের গম্ভীর গদ্য পড়ার পর যখন দেখি অত্যন্ত দিশি ভাষায়ও তিনি নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন ঠিক তেমনি জোর দিয়ে তখন আর বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। শুধু যে সংস্কৃত শব্দের ওজস্ এবং প্রসার সম্বন্ধে তিনি সচেতন তাই নয়, কলকাতা অঞ্চলের পুরো-পাক্কা তেতো-কড়া ভাষাতেও তার তেমনি কায়েমি দখল।

বারীন বলিল- “এতদিন স্যাঙ্গাতেরা পট্টি মেরে আসছিলেন যে, তারা সবাই প্রস্তুত; শুধু বাংলা দেশের খাতিরে তারা বসে আছেন। গিয়ে দেখি না, সব ঢুঁঢু। কোথাও কিছু নেই, শুধু কর্তারা চেয়ারে বসে বসে মোড়লি কচ্ছেন। খুব কষে ব্যাটাদের শুনিয়ে দিয়ে এসেছি”।(৪)

এ ভাষা হুতোমের ভাষা; এর ব্যবহার অতি অল্প লেখকই করেছেন। এককালে পশ্চিম বাংলার লোকও আরবি-ফারসি শব্দের প্রসাদগুণ জানতেন ও কায়দামাফিক সেগুলো ব্যবহার করে ভাষার জৌলুস বাড়াতে কসুর করতেন না। ক্রমে ক্রমে এ ঐতিহ্য পশ্চিমবঙ্গে লোপ পায় অথচ পূর্ববাংলার লেখকদের মেকদারবোধ কম ছিল বলে তারা এ বাবদে অনেক জায়গায় লাভের বদলে লোকসানই করেছেন বেশি। উপেন্দ্রনাথ তাগ-মাফিক আরবি ফারসিও ‘এস্তেমাল’ করতে জানতেন।

‘কোনওরূপে হিন্দুকে মুসলমান ভাণ্ডারীর খানা খাওয়াইয়া তাহার গোঁফ ছাটিয়া দিয়া একবার কলমা পড়াইয়া লইতে পারিলে বেহস্তে যে খোদাতাল্লা তাহাদের জন্য বিশেষ আরামের ব্যবস্থা করিবেন, এ বিশ্বাস প্রায় সকল মোল্লারই আছে।’(৫)

কিন্তু উপেন্দ্রনাথ ছিলেন একদম ন-সিকে বাঙালি। তাই,

‘আমরা হিন্দু-মুসলমান সকলকার হাত হইতে নির্বিচারে রুটি খাই দেখিয়া মুসলমানেরা প্রথম প্রথম আমাদের পরকালের সদ্গতির আশায় উল্লসিত হইয়া উঠিয়াছিল, হিন্দুরা কিঞ্চিৎ ক্ষুণ্ণ হইয়াছিল; শেষে বেগতিক দেখিয়া উভয় দলই স্থির করিল যে, আমরা হিন্দুও নই, মুসলমানও নই আমরা বাঙালি।(৬)

বাঙালির এরকম নেতিবাচক রমণীয় সংজ্ঞা আমি আর কোথাও শুনিনি।

 কিন্তু এসব তাবৎ বস্তু বাহ্য।

না সংস্কৃত না আরবি-ফারসি, না কলকত্তাই সবকিছু ছাড়িয়ে তিনি যে খাঁটি মেটে বাংলা লিখতে পারতেন তার কাছে দাঁড়াতে পারেন আজকের দিনের কজন লেখক?

‘শচীনের পিতা একদিন তাহার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছিলেন। জেলে কীরকম খাদ্য খাইতে হয় জিজ্ঞাসা করায় শচীন লপসীর নাম করিল। পাছে লপসীর স্বরূপ প্রকাশ পাইয়া পিতার মনে কষ্ট হয় সেই ভয়ে শচীন লপসীর গুণগ্ৰাম বৰ্ণনা করিতে করিতে বলিল, “লপসী খুব পুষ্টিকর জিনিস”। পিতার চক্ষু জলে ভরিয়া আসিল। তিনি জেলার বাবুর দিকে মুখ ফিরাইয়া বলিলেন- “বাড়িতে ছেলে আমার পোলাওয়ের বাটি টান মেরে ফেলে দিত; আর আজ লপসী তার কাছে পুষ্টিকর জিনিস”। ছেলের এ অবস্থা দেখিয়া বাপের মনে যে কী হয় তাহা কখনও ভালো করিয়া বুঝি নাই, তবে তাহার ক্ষীণ আভাস যে একেবারে পাই নাই তাহাও নয়। একদিন আমার আত্মীয়-স্বজনেরা আমার ছেলেকে আমার সহিত দেখা করাইতে লইয়া আসিয়াছিলেন। ছেলের বয়স তখন দেড় বৎসর মাত্র; কথা কহিতে পারে না। হয়তো এ জন্মে তাহার সহিত আর দেখা হইবে না ভাবিয়া তাহাকে কোলে লইবার বড় সাধ হইয়াছিল। কিন্তু মাঝের লোহার রেলিংগুলো আমার সে সাধ মিটাইতে দেয় নাই। কারাগারের প্রকৃত মূর্তি সেইদিন আমার চোখে ফুটিয়াছিল।’(৭)

***

স্থাপত্যের বেলা ব্যাপারটা চট করে বোঝা যায়, কিন্তু সাহিত্যে অতটা সোজা নয়। তাজমহলকে পাঁচগুণ বড় করে দিলে লালিত্য সম্পূর্ণ লোপ পেত, যদিও ওই বিরাট বস্তু তখন আমাদের মনকে বিস্ময় বিমূঢ় করে দিত, আর আমরা স্তম্ভিত হয়ে বলতুম, ‘এ কী এলাহী ব্যাপার!’ ফলে শাহজাহান যে প্রিয়ার বিরহে কাতর হয়ে ইমারতখানা তৈরি করেছিলেন, সে কথা বেবাক ভুলে যেতুম।

আর তাজমহলকে ছোট করে দিলে কী হয়, তা তো নিত্যি নিত্যি স্পষ্ট চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। শ্বেতপাথরের ক্ষুদে তাজমহল মেলা লোক ড্রইংরুমে সাজিয়ে রাখেন। পাঁচজন তার দিকে ভালো করে না তাকিয়েই গৃহস্বামীকে জিগ্যেস করেন, তিনি আগ্রায় গিয়েছিলেন কবে? ভদ্রলোকের আগ্রা গমন সফল হল– ক্ষুদে তাজ যে কোণে সেই কোণেই পড়ে রইল।

সাহিত্যের বেলাও অনেক সময় প্রশ্ন জাগে, ‘এ উপন্যাসখানা যেন বড় ফেনিয়ে লেখা হয়েছে কিংবা অন্য আরেকখানা এতটা ঊর্ধ্বশ্বাসে না লিখে আরও ধীরে-মন্থরে লিখলে ঠিক আয়তনে গিয়ে দাঁড়াত।’ ‘যোগাযোগ’ পড়ে মনে হয় না, এই বইখানাকে বড় কিংবা ছোট করা যেত না, ‘গোরা’র বেলা মাঝে মাঝে সন্দেহ জাগে, হয়তো এ অনবদ্য পুস্তকখানা আরও ছোট করলে তার মূল্য বাড়ত।

আমার মনে হয় ‘আত্মকথা’ সংক্ষেপে লেখা বলে সেটি আমাদের মনে যে গভীর ছাপ রেখে গিয়েছে, দীর্ঘতর হলে হয়তো সেরকম অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারত না। আবার মাঝে মাঝে মনে হয়, এ বইখানা লিরিক না করে এপিক করলেই ভালো হত। এ বই যদি ‘ওয়র অ্যান্ড পিসের’ মতো বিরাট ক্যানভাস নিয়ে চিত্রিত করা হত তবে বুঝি তার উপযোগী মূল্য দেওয়া হত। কিন্তু এ বিষয়ে কারও মনে দ্বিধা উপস্থিত হবে না যে, লিরিক হিসেবে এ বই এর চেয়ে কি বড় কি ছোট কিছুই করা যেত না।

বই আরম্ভ করতেই চোখে পড়ে প্রথম বিপ্লবী যুগের এই তরুণদের হৃদয় কী অদ্ভুত সাহস আর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কী অবিশ্বাস্য তাচ্ছিল্যে ভরা ছিল। পরবর্তী যুগে ইংরেজের জেলখানার স্বরূপ আমরা চিনেছিলুম এবং শেষের দিকে জেলভীতি সাধারণের মন থেকে তো একরকম প্রায় উঠেই গিয়েছিল, কিন্তু যে যুগে এঁরা হাসিমুখে কারাবরণ করেছিলেন, সে যুগের যুবকদের মেরুদণ্ড কতখানি দৃঢ় ছিল, আজ তো আমরা তার কল্পনাই করতে পারিনে। উল্লাস, কানাই মৃত্যুদণ্ডের আদেশ শুনে হেসেছিল যেন কাঁধ থেকে বেঁচে থাকার একটা মস্ত বোঝা নেমে গেল। আজ যখন বাংলা দেশের দিকে তাকাই, তখন বারংবার শিরে করাঘাত করে বলতে ইচ্ছে করে, ‘হে ভগবান, সে যুগে তুমি অকৃপণ হস্তে বাংলা দেশকে এত দিয়েছিলে বলেই কি আজ তোমার ভাণ্ডার সম্পূর্ণ রিক্ত হয়ে গিয়েছে?’

অথচ রুদ্র মহাকাল এই তরুণদের হৃদয়ে এবং জীবনে যে তাণ্ডব-নৃত্য করে গেলেন, যার প্রতি পদক্ষেপে বঙ্গদেশের লক্ষ লক্ষ কুটির আন্দোলিত হল, বাঙালি হিন্দুর ইষ্টদেবী কালী করালী যখন বারংবার হুঙ্কার দিয়ে বললেন, মে ভুখা-’ তখন যে এই বঙ্গসন্তানগণ প্রতিবারে গম্ভীরতর হুঙ্কার দিয়ে বলল–

“কালী তুই করালরূপিণী/আয় মাগো আয় মোর কাছে,”

যূপকাষ্ঠে স্বেচ্ছায় স্কন্ধ দিয়ে বলল, ‘হানো, তোমার খড়গ হানো’, তখনকার সেই বিচিত্র ছবি উপেন্দ্রনাথ কী দম্ভহীন অনাড়ম্বর অনাসক্তিতে চিত্রিত করে গেলেন।

দক্ষিণ ভারতের মথুরা, মাদুরায় এক তামিল ব্রাহ্মণের বাড়িতে কয়েক মাস বাস করার সৌভাগ্য আমার একবার হয়েছিল। গৃহকত্রী প্রতি প্রত্যূষে প্রহরাধিককাল পূর্বমুখী হয়ে রুদ্র বীণা বাজাতেন। একদিন জিজ্ঞাসা করলুম, ‘আজ আপনি কী বাজলেন বলুন তো! আমার মনের সব দুশ্চিন্তা যেন লোপ পেল।’ বললেন, ‘এর নাম “শঙ্করবরণম”–সন্ন্যাসী রাগও একে বলা হয় কারণ এ রাগে আদি, বীর, করুণ কোনওপ্রকারের রস নেই বলে একে শান্ত রসও বলা হয়। কিন্তু শান্ত অবস্থাকে তো রসাবস্থা বলা চলে না, তাই এর নাম সন্ন্যাস রাগ।’

উপেন্দ্রনাথের মূল রাগ সন্ন্যাস রাগ।

অথচ এই পুস্তিকা হাস্যরসে সমুজ্জ্বল।

তা হলে তো পরস্পরবিরোধী কথা বলা হল। কিন্তু তা নয়। উপেন্দ্রনাথ তাঁর সহকর্মীদের জীবন তথা বাংলা দেশের পতনঅভ্যুদয়বন্ধুরপন্থা নিরীক্ষণ করেছেন অনাত্মীয় বৈরাগ্যে– তাই তার মূল রাগ সন্ন্যাস এবং তার প্রকাশ দিয়েছেন হাস্যরসের মাধ্যমে, দুঃখ-দুর্দৈবকে নিদারুণ তাচ্ছিল্যের ব্যঙ্গ দিয়ে এ বড় কঠিন কর্ম–কঠোর সাধনা এবং বিধিদত্ত সাহিত্যরস একাধারে না থাকলে এ ভানুমতী অসম্ভব।

আমার প্রিয় চরিত্র ডন কুইকসট। উপেন্দ্রনাথ বিপরীত ডন।

ডন এবং উপেন্দ্রনাথের সাহস অসীম; দুইজনেই পরের বিপদে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে শাণিত তরবারি নিয়ে আক্রমণ করেন, অন্যায় অত্যাচারের সামনে দু জনই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড লোহিতরঙে রঞ্জিত দেখেন।

পার্থক্য শুধু এইটুকু, উইন্ডমিলকে ডন মনে করেন দৈত্য, দাসীকে মনে করেন রাজনন্দিনী, ভেড়ার পালকে মনে করেন জাদুকরের মন্ত্র-সম্মোহিত পরীর দল।

আর উপেন্দ্রনাথ দেখেন বিপরীত। কারাগারকে ভাবেন রঙ্গালয়, কারারক্ষককে মনে করেন সার্কাসের সং, পুলিস বাহিনীকে মনে করেন ভেড়ার পাল।

এই নব ডন কুইকসটকে বারবার নমস্কার ॥

———–

১. নির্বাসিতের আত্মকথা, চতুর্থ সংস্করণ, পৃ. ১৬০।

 ২. আত্মকথা, পৃ. ৬৬।

৩. সত্যেন দত্তের অনুবাদ।

 ৪. আত্মকথা, পৃ. ৩৩।

৫. আত্মকথা, পৃ. ১১৯।

৬. আত্মকথা, পৃ. ১২১।

৭. আত্মকথা, পৃ. ৬৯, ৭০।