রামমোহন রায়

রামমোহন রায়

ভারত এবং আরব ভূখণ্ডের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আদান-প্রদান কবে থেকে আরম্ভ হয়েছে, তার সম্যক আলোচনা এখনও হয়নি। গোড়ার দিকে যেসব সংস্কৃত বইয়ের আরবি তর্জমা হয়, সেগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে অনুবাদকদের সংস্কৃত ভাষাজ্ঞান খুব গভীর ছিল না। পরবর্তী যুগে দেখা দিলেন এক পণ্ডিত, যাঁর সঙ্গে তুলনা দিতে পারি, এমন পণ্ডিত পৃথিবীতে কমই জন্মেছেন।

সেই দশম-একাদশ শতাব্দীতে যখন ‘ম্লেচ্ছে’র পক্ষে সংস্কৃত শেখার কোনও পন্থাই উন্মুক্ত ছিল না, তখন গজনির মামুদ বাদশার সভাপতি আল-বিরুনি, অতি উৎকৃষ্ট সংস্কৃত শিখে ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বাঙ্গসুন্দর চর্চা করে আরবি ভাষাতে একখানা অতি উপাদেয় প্রামাণিক গ্রন্থ লেখেন। বইখানি সে যুগের হিন্দু জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনের একখানা ছোটখাটো বিশ্বকোষ বলা যেতে পারে।

পাঠান যুগে আরবি-ফার্সিতে কিঞ্চিৎ সংস্কৃত চর্চা হয়, কিন্তু আসল চর্চা আরম্ভ হয় আকবরের সময় এবং আল-বিরুনির পর যদি সত্য পণ্ডিতের অনুসন্ধান কেউ করে তবে যেতে হয় আকবরের পৌত্রের যুগে শাহজাহানের পুত্র দারা-শিকুহ’র কাছে। আরবি-ফার্সি-সংস্কৃত এ তিন ভাষাতেই তার পাণ্ডিত্য ছিল অসাধারণ এবং ভক্তিমার্গে–তা সে হিন্দুই হোক আর মুসলমানই হোক– হেন সূক্ষ্মতত্ত্ব নেই, যা তাঁর পাণ্ডিত্যের চৌহদ্দির বাইরে পড়ে।

তার পর ভারতবর্ষের যে অবিশ্বাস্য অধঃপতন আরম্ভ হয়, তার ইতিহাস সকলেই জানেন। টোল-চতুষ্পাঠী, মক্তব-মাদ্রাসায়, সংস্কৃত এবং আরবি-ফার্সি কোনও গতিকে বেঁচে রইল মাত্র– এর বেশি জোর করে কিছু বলা যায় না।

তার পর এই হতভাগ্য ভারতবর্ষেই এবং আমাদের পরম শ্লাঘার সম্পদ এই বাংলা দেশেই জন্মালেন এক বাঘা পণ্ডিত, এক জবরদস্ত মৌলবি যিনি কি আল-বিরুনি, কি দ্বারা-শিকুহ যে কারও সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে পারেন।

শুধু তাই নয়, নানা দ্বন্দ্ব নানা সংঘাতের উর্ধ্বে যে সত্যশিবসুন্দর আছেন, যাঁর অস্তিত্ব স্বীকার করলে পরস্পরবিরোধী সংঘাত মাত্রই লোপ পায়, সেই সত্যশিবসুন্দরকে তিনি হৃদয়ে অনুভব করেছিলেন, মনোজগতে স্পষ্টরূপে ধারণা করতে পেরেছিলেন বহুবিধ ঐতিহ্যের সম্মিলিত সাধনার ভিতর দিয়ে। বাল্যকালে তিনি শিখেছিলেন আরবি-ফারসি, পরবর্তীকালে সংস্কৃত এবং সর্বশেষে হিব্রু, গ্রিক, লাতিন। হিন্দু, মুসলমান, ইহুদি, খ্রিস্ট– এই চার ধর্মজগতে তিনি অনায়াসে অতি স্বচ্ছন্দে শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ করে, অন্তরের খাদ্য অন্বেষণ করে যে শক্তি সঞ্চয় করতে পেরেছিলেন, তাই নয়, সে শক্তির প্রসাদাৎ পরবর্তী বাংলা দেশ এবং ভারতবর্ষ যে নব নব অভিযানের পথে বেরিয়েছিল, তার কিঞ্চিৎ কল্পনা আমরা আজ করতে পারি আমাদের অদ্যকার জীবন্ত অবস্থা থেকে।

রামমোহন বলতে কী বোঝায়, তার সর্বাঙ্গসুন্দর ধারণা রবীন্দ্রনাথের ছিল, ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের ছিল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, তাঁর বহুমুখী পাণ্ডিত্য ও প্রতিভার সম্যক চর্চা এখনও হয়নি। ‘দেশে’র এক পৃষ্ঠা সে কর্মের জন্য প্রশস্ত নয়। এবং এ অধম সে শাস্ত্রাধিকার থেকে বঞ্চিত।

নিপীড়িত হলেই সে ব্যক্তি মহাজন, একথা বলা চলে না, কিন্তু মহাজনমাত্রই নিপীড়িত হন, সে বিষয়ে আমার মনে সন্দেহ নেই। রাজার ভাগ্যে সে নিপীড়ন এসেছিল, চাষিদের কাছ থেকে নয়– সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না– তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন সর্বধর্মের পণ্ডিতগণ।

আরবি ভূমিকা (মুকদ্দমা) সম্বলিত তিনি যে ফারসি কেতাব রচনা করেন, তার নাম ‘তুহফাতুল মুওয়াহহিদীন’ (একেশ্বরবাদীর উদ্দেশে উপঢৌকন) এবং সে গ্রন্থে তিনি আল্লার সত্যরূপের যে বর্ণনা মুসলমান ধর্মশাস্ত্র তন্ন তন্ন করে বয়ান করলেন, সে রূপ সে বর্ণনা ক্রিয়াকাণ্ডে নিমজ্জিত তৎকালীন মুসলমান পণ্ডিতজনকে বিন্দুমাত্র উল্লসিত করেনি। পরবর্তী যুগে মৌলবি-মৌলানা, আলি-উলামা তাঁকে জবরদস্ত মৌলবিরূপে স্বীকার করেছিলেন বটে, কিন্তু তাঁকে ‘মুতাজিলা’ (স্বাধীনচেতা)– গোঁড়ারা যেরকম ভদ্র ব্রাহ্মকে ‘বেহ্মজ্ঞানী’ নাম দিয়ে তাচ্ছিল্য করেন– নাম দিয়ে তাঁর সৎ ধর্ম প্রচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রচার করেছিলেন।

হুবহু সেই বিরুদ্ধাচরণই তো তিনি পেয়েছিলেন ‘স্বধর্মী’দের কাছ থেকে। অদ্বৈতের অনুসন্ধান ঊনবিংশ শতাব্দী প্রায় ম্লেচ্ছাচারের মতো বর্জনীয় বলে মনে করেছিলেন– এ ইতিহাস সকলেই জানেন।

আবার হুবহু তৃতীয় দফায় তিনি বিরুদ্ধাচরণ পেলেন খ্রিস্টান মিশনারিদের কাছ থেকে। যে খ্রিস্টধর্ম তখন বাংলা দেশে প্রচারিত হচ্ছিল সে ধর্ম কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দু বা মুসলমান যে কোনও ধর্মের চেয়ে কোনও দিক দিয়ে আধ্যাত্মিকতায় উৎকৃষ্ট ছিল না। হিন্দু এবং মুসলমান ধর্মে রামমোহন যে সত্য উপলব্ধি করেছিলেন, সেই আগের অনুসন্ধানে তিনি বাইবেলে যে খ্রিস্টকে আবিষ্কার করলেন, যে খ্রিস্ট ‘কেরামতি’ করেন না, অর্থাৎ তিনি জলকে মদ বানাবার ভেল্কিবাজি দেখান না, সাতখানা রুটি দিয়ে পাঁচ হাজার লোককে পরিতৃপ্ত করার চেষ্টাও করেন না।

যে খ্রিস্টান মিশনারিরা এতকাল ধরে রামমোহনের কুসংস্কারবর্জিত স্বাধীন চিন্তাবৃত্তির প্রশংসা করেছিলেন, তাঁরাই হলেন সবচেয়ে ক্রুদ্ধ। উচ্চকণ্ঠে সর্বত্র ঘোষণা করলেন, ‘রামমোহন মূর্খ, রামমোহন যিশুকে চিনতে পারেনি, অলৌকিক কর্ম (কেরামতি) বাদ দিলে যে যিশু দাঁড়ান, তিনি প্রকৃত যিশু নন।’

হিন্দু-মুসলমান সে যুগে কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তাঁদের বিরুদ্ধ-ব্যবহার রামমোহনকে বিস্মিত কিংবা বিচলিত করেনি। কিন্তু খ্রিস্টানদের এ ব্যবহারে তিনি নিশ্চয়ই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন– আজ ডিন ইনগ সেটা বুঝতে পারবেন।

তিন ধর্মের গলা মেলানো একই প্রতিবাদে রামমোহন বিচলিত কিংবা পথভ্রষ্ট হননি সে আমাদের পরম সৌভাগ্য ॥