ফিল্মের ভাষা

ফিল্মের ভাষা

থিয়েটারের কপাল মন্দ, পাঠান-মোগলের আপন দেশে ওটার রেওয়াজ নেই। তাই পাঠান রাজারা এদেশে জমে বসার পর গাইয়ে-বাজিয়েদের ডেকে পাঠালেন, পটুয়াদেরও ডাক পড়ল, নাচিয়েরাও বাদ গেল না আর এমারত বানানেওলাদের তো কথাই নেই। সংস্কৃত যদি তখন এ দেশের চালু এবং সহজ ভাষা হত তা হলে সংস্কৃত নাট্যও যে বাদশার দরবারে কদর পেত সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, কারণ হিন্দি কদর পেয়েছিল এবং এ দেশে বাঙলা কদর পাওয়ার ফলে পরাগল খান, ছুটি খানের মহাভারত লেখা হয়েছিল।

সংস্কৃতে লেখা আমাদের নাট্য ঠিক মুসলিম আগমনের শুরুতে এদেশে কতখানি চালু ছিল বলা কঠিন। ইংরেজ ঐতিহাসিকেরা বলেন, সংস্কৃত তখন মৃত ভাষা, ওসব নাট্য তখন প্রায় উঠে গিয়েছে। আমি কিন্তু কিঞ্চিৎ ভিন্নমত পোষণ করি।

পূর্বেই স্বীকার করেছি, পাঠান আমলে সংস্কৃত মৃত ভাষা, কিন্তু সংস্কৃত নাটক তো সম্পূর্ণ সংস্কৃতে লেখা হয়। তুলনা দিয়ে কথাটা পরিষ্কার করি।

শেক্সপিয়র জানতেন, তিনি রাজা-রাজড়া এবং শিক্ষিতজনদের জন্যই আপন নাটক লিখছেন। কিন্তু অন্য একটি তত্ত্বও বিলক্ষণ জানতেন যে তাঁদের সংখ্যা কম, এবং বেঞ্চি গ্যালারি ভরভরাট করে নাটকটাকে জম-জমাট করে তোলে টাঙাওলা-বিড়িওয়ালার দল। কাজেই তাঁর নাটকে ওদেরই মতো চরিত্র ওদেরই ভাষায় কথা কয়, বিশেষ করে ভাঁড়টি সবসময়ই রাজা-প্রজা দু দলকেই খুশি করতে জানে।

ঠিক সেইরকম গুপ্ত যুগের কালিদাসও জানতেন যে, তাঁর যুগের ‘টাঙাওলা’ ‘বিড়িওলা’ সংস্কৃত বোঝে না, অথচ রাজা-রাজড়ারা নাটক চান সংস্কৃতে। ওদিকে তিনি শেক্সপিয়রের মতো বুঝতেন যে, জনসাধারণকে খুশি না করে কোনও নাটকই বক্স-আপিস ভরতে পারে না। গোলাপফুল খাপসুরৎ জিনিস। কিন্তু পাতা-কাঁটা ওটাকে খাড়া করে না ধরলে ওটা শুধু শূন্যে শূন্যে ঝুলতে পারে না। তাই তিনি তাঁর নাটকে ব্রাহ্মণ আর রাজা ছাড়া আর সবাইকে দিয়ে কথা কওয়াতেন তখনকার দিনের চালু ভাষা প্রাকৃতে। আর শুধু কি তাই? রাজার সংস্কৃতে শোধানো প্রশ্নের উত্তর দাসী যখন প্রাকৃতে দিত তখন কালিদাস তার উত্তরের ভিতর রাজার প্রশ্নটি এমনভাবে জড়িয়ে দিতেন যে সংস্কৃত না-জাননেওলা শ্রোতাও দুই পক্ষের কথাই পরিষ্কার বুঝে যেত। দাসীর তুলনা দিয়েই যদি জিনিসটা বোঝাতে হয় তবে বলতে হবে, ‘এ যেন বাঁদীকে ঠেঙিয়ে বিবিকে সোজা রাখা’র মতো রাজা এবং প্রজা উভয় দর্শককে সোজা রাখা।

তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কালিদাসের নাটক সর্বজনপ্রিয় ছিল।

তার পর প্রশ্ন উঠতে পারে, ঠিক মুসলমান আগমনের প্রাক্কালে জনসাধারণ কি কালিদাসের আমলের প্রাকৃত বুঝত? এ প্রশ্নের উত্তর দেবার মতো এলেম আমার পেটে নেই। তবে তার এক শ বছর পেরোবার পূর্বেই আমির খুসরৌ যে-হিন্দি ব্যবহার করেছেন সে হিন্দি অনেকটা ওই প্রাকৃতের মতোই। এবং এখানে আরও একটি কথা আছে। জনসাধারণ ততদিনে কালিদাসের নাটক দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে, এবং নিরক্ষর দর্শক একটা ফিলিম তিনবার দেখবার পর যে কতখানি মনে রাখতে পারে সেকথা শিক্ষিত জন জানেন না। আমার এক চাকর (বস্তুত এই গণতন্ত্রের ইনকিলাবি যুগে ‘মনিব’ বলাই ভালো) পাড়াতে নয়া ছবি এলেই একটানা সাত দিন ধরে সেই ছবি দেখতে যেত। আমি অবাক হয়ে ভাবতুম, নাগাড়ে সাতদিন ধরে একই ছবি দেখে কী করে? পরে তার গুনগুনোনি থেকে বুঝলুম, ছবির চৌদ্দখানা গানই সে রপ্ত করতে চায় এবং করে ফেলেছেও। অনেক হিন্দি গানের বিস্তর কথা না বুঝতে পেরেও! অবশ্য আমার এ মন্তব্যে ভুল থাকতেও পারে। কারণ আমি এ জীবনে তিনখানা হিন্দি ছবিও দেখিনি এবং অন্য কোনও পুণ্য করিনি বলে এই পুণ্যের জোরেই স্বর্গে যাব বলে আশা রাখি। তবে বলা যায় না, সেখানে হয়তো হিন্দি ছবি দেখতে হবে। কারণ এক ইরানি কবি মহাপ্রলয়ের পরে যে শেষ বিচার হবে তারই স্মরণে অনেকটা এই ভয়ই করেন–

‘শেষ-বিচারেতে খুদার সমুখে দাঁড়াব তো নিশ্চয়,
মানুষের মুখ আবার দেখিব। এইটুকু মোর ভয়।’
 ‘মরা ব রূজ-ই কিয়ামৎ গামি কি হস্ত ঈন অস্ত
কি রু-ই মরদুমে আলম দুবারা বায়দ দীদ।’(১)

 যদি প্রশ্ন শোধান সে কী করে হয়?– তুমি হিন্দি ফিলিম্ বর্জন করার পুণ্যে স্বর্গে গেলে, সেখানে আবার তোমাকে ওই ‘মাল’ই দেখতে হবে কেন? তবে উত্তরে নিবেদন, কামিনীকাঞ্চনসুরা বর্জন করার ফলে আপনি যখন স্বর্গে যাবেন তখন কি ইন্দ্রসভায় ওইগুলোরই ছড়াছড়ি দেখতে পাবেন না?

তখন যদি আপনি এক কোণে মুখ গুমড়ো করে বসে থাকেন তবে কি সেটা খুব ভালো দেখাবে?

থাক্। কোথা থেকে কোথা এসে পড়লুম! মূর্খকে চটালে এই তো বিপদ! আবোল-তাবোল বকে।

মোদ্দা কথা এই, পাঠান-মোগল যুগে নাট্যাভিনয় রাজানুকম্পা পেল না বলে আমরা এখন তার খেসারতি ঢালছি। এবং দ্বিতীয় কথা– নাট্যে, ফিলিমে ভাষা জিনিসটাকে অবহেলা করলে ক্ষতি হয়। এমনকি যদিও বহু গুণী বলে থাকেন, ‘সাইলেন্স ইজ গোল্ডেন’ তবু সাইলেন্ট ফিলিম চলল না। বাঙলা ফিলিম যখন সেই সাইলেন্স্ ভাঙল তখন থেকে আজ পর্যন্ত যে ভাষা সে বলল তারই দিকে এ-প্রবন্ধের নল চালনা।

সাত শ বছর পরে ইংরেজ আমলে হল ঠিক তার উল্টো। কলাজগতে ইংরেজের প্রধান সম্পদ তার থিয়েটার। শেক্সপিয়রের মতো নাট্যকার নাকি পৃথিবীতে নেই। ইংরেজ বলল, ‘চালাও থিয়েটার।’ কিন্তু প্রশ্ন, কে করবে থিয়েটার?

ইতোমধ্যে বাঙালি বিলেত যেতে আরম্ভ করেছে। সেখানে একাধিক নেশার সঙ্গে সে থিয়েটারের নেশাটাও রপ্ত করে এল।

বাঙলা গদ্য এবং পদ্য তখন দুই-ই বড় কাঁচা।

আর জনসাধারণের ভাষা? তারও মা-বাপ নেই। একদিকে শেষ মোগলের ফারসি-উর্দুর শেষ রেশ, অন্যদিকে সুলতানুটি-গোবিন্দপুরের ঐতিহ্যহীন স্ল্যাঙ-দুয়ে মিলে তার যা চেহারা সেটা কিছুদিন পরে পাওয়া যায় হুতোমের নকশায়। অন্যদিকে বিদ্যাসাগরের অতি ভদ্র অতি মার্জিত ভাষা।

এ যুগের নাটকের ভাষা তাই শব্দতত্ত্বের স্বর্গভূমি। কিন্তু নাটকে যে স্বচ্ছন্দ ভাষার প্রয়োজন তার বড়ই অভাব। সব নাট্যকারই যেন ঠিক মানানসই ভাষাটির জন্য চতুর্দিকে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন।(২)

মাইকেলের পৌরাণিক নাট্যে বিদাসাগরি ভাষা; তাঁর ‘একেই কি বলে সভ্যতা’তে কলকাতার স্ল্যাঙ; ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’তে গ্রামাঞ্চলের একাধিক ভাষা; এবং দীনবন্ধু মিত্রের ভাষাতে বিদ্যাসাগরি ও গ্রাম্য দুই-ই।

‘নীলদর্পণ’ সে যুগের বাঙলার বেদনা প্রকাশ করেই যে বিখ্যাত হয়েছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু আমার মনে হয়, বিদ্যাসাগরি ভাষা ও মুসলমান চাষার ভাষা এ দুয়ের সম্মেলনও তার জন্য অনেকখানি দায়ী। অবশ্য শুধুমাত্র ভাষার বাহার যদি শুনতে চান তবে ‘বুড়ো শালিকে’র মতো নাটক হয় না। হিন্দু গৃহস্থ, হিন্দু চাকর, মুসলমান চাষা, চাষার বউ, হিন্দু দাসী এদের সকলের আপন আপন ভাষার সূক্ষ্মতম পার্থক্য মাইকেল যে কী কৃতিত্বের সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন তার তুলনা বাঙলা সাহিত্যে কোথাও নেই। নাটক হিসেবে এ বই উত্তম– সাহিত্য হিসেবে ভাষার বাজারে এ বই কোহিনূর।

অবাঙালির জন্য পারসি থিয়েটার কবে প্রতিষ্ঠিত হয় আমি ঠিক জানিনে, কিন্তু বিস্তর বাঙালিও সেখানে যেত ও উর্দু-গুজরাটিতে মেশানো নাটক বুঝতে যে তাদের বিশেষ অসুবিধে হত না সে-তথ্য কিছু অজানা নয়। ‘ছি ছি এত্তা জঞ্জাল’ জাতীয় জনপ্রিয়, বাঙলা-উর্দুতে মেশানো খিচুড়ি ঠাট্টা ব্যঙ্গের ভাষা কিছুটা হুতোম আর কিছুটা পারসি থিয়েটারের কল্যাণে।

ইতোমধ্যে ভাষাসমস্যার অনেকখানি সমাধান হয়ে যায় বঙ্কিমের কল্যাণে। বঙ্কিমের ভাষানির্মাণে কোন কোন উপাদান আছে সেকথা আজ স্কুলের ছেলে পর্যন্ত জানে। ডি.এল. রায় শ্রেণি এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন।

এইখানে এসে আমাদের সবাইকে– বিশেষ করে রবীন্দ্র-শিষ্যদের একটু বিপদে পড়তে হয়। রবীন্দ্রনাথের চলতি ভাষা যে তার ছোটগল্প-উপন্যাসের মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন কথ্য ভাষাকে প্রভাবান্বিত করেছে সেকথা আমরা সবাই জানি, এবং তার প্রভাব যে আমাদের রঙ্গমঞ্চেও পড়েছে সে-ও প্রতি মুহূর্তে কানে বাজে। কিন্তু আমার মনে হয় তার নাটকের ভাষা এত বেশি মার্জিত, এত বেশি সূক্ষ্ম যে নাট্যশালার আটপৌরে কাজ তা দিয়ে চালানো যায় না। তাই বোধহয় তাঁর নাটকের মূল্য সাহিত্য হিসেবে যত না সম্মান পেয়েছে এবং পাবে, নাট্য হিসেবে ততখানি পায়নি, পাবে কি না সন্দেহ।

***

গোড়ার দিকে ফিলিমের কোনও দুশ্চিন্তা ছিল না। কারণ সে তখন ভাষণ না করে শোভা বর্ধন করত। টকি আসার সঙ্গে সঙ্গে চিন্তাশীল চিত্ৰচালককেই মনস্থির করতে হল টকির ভাষা ও উচ্চারণ হবে কী? এ মুশকিলের একটা অতি সহজ সমাধান আছে। শরত্যাবুর ‘নিষ্কৃতি’ করতে হলে তার ডায়ালগের ভাষা দিলেই হল। এর আর ভাবনা কী?

মুশকিল আসান অত সহজ না। প্রথমত কোনও কোনও বর্ণনা ডায়ালগে প্রকাশ করতে হয়; তখন উপায়? সেটা তৈরি করে দেবে কে? সে কলম আছে কার? রবীন্দ্রনাথের বারোটি গান নিয়ে যখন দম্ভী লেখকেরা মাঝখানে মাঝখানে ‘আপন’ গদ্য জুড়ে দিয়ে কিমপিয়ার (কঁপের) করেন, এবং দুই পাকা গানের মাঝখানে সেই কাঁচা বাঙলা শুনতে হয় তখন মনে হয়, না, থাক বাবা, বাড়ি যাই?

কিন্তু সেইটেই প্রধান শিরঃপীড়া নয়। আসল বেদনা অন্যখানে। বইয়ের লেখা ডায়ালগ আর সিনেমায় উচ্চারিত কথাবার্তা এক জিনিস নয়। বই বন্ধুজনের সঙ্গে পড়ে শোনানো যায় তার পাল্লা অদূর অবধি। নাট্যে, পর্দায় সেটা অত্যধিক সাহিত্যিক। অবশ্য নিছক ফিলিমের জন্য লেখা রাবিশের কথা এখানে হচ্ছে না।

অন্যদিকে সিনেমার ভাষাতে যদি কোনও সাহিত্যিক মূল্যই থাকে তবে সে ইসথেটিক পর্যায়ে উঠতে পারবে না। এই হল আমাদের দু-মুখো সাপ, ডিলেমা, প্যারাডকস– যা খুশি বলতে চান বলুন।

প্রথম যখন মানুষ পাথরের বাড়ি তৈরি করতে শিখল তখন পূর্বতর যুগের কাঠের বাড়ির অনুকরণে পাথরের বাড়ি তৈরি করত; বাঙলা দেশে হঁট চালু হওয়ার পর প্রথমটায় সে খড়ের চাল অনুকরণ করেছে; বেতারের বয়স হয়েছে– এখনও সে নাটক করার সময় ‘থিয়েডারে’র (থিয়েটারের নয়) অনুকরণ করে– ফিলিম কেন অনুকরণ করতে যাবে?

————

১. The only thing which troubles me about the Resurrection day is this, That one will have to look once again on the faces of mankind.

২. শুনেছি সর্বপ্রথম নাকি এক রাশান এদেশে থিয়েটার করেন। তিনি তখন ইংরেজের পৃষ্ঠপোষকতা কতখানি পেয়েছিলেন, তার প্রভাব পরবর্তী যুগের বাঙলা থিয়েটারে কতখানি পড়েছিল, এসব প্রশ্ন ভাষার বিচারে অবান্তর।