মামদোর পুনর্জন্ম

মামদোর পুনর্জন্ম

সংস্কৃত ভাষা আত্মনির্ভরশীল। কোনও নতুন চিন্তা, অনুভূতি কিংবা বস্তুর জন্য নবীন শব্দের প্রয়োজন হলে সংস্কৃত ধার করার কথা না ভেবে আপন ভাণ্ডারে অনুসন্ধান করে, এমন কোনও ধাতু বা শব্দ সেখানে আছে কি না যার সামান্য অদলবদল করে কিংবা পুরনো ধাতু দিয়ে নবীন শব্দটি নির্মাণ করা যায় কি না। তার অর্থ অবশ্য এ নয় যে, সংস্কৃত কস্মিনকালেও বিদেশি কোনও শব্দ গ্রহণ করেনি। নিয়েছে, কিন্তু তার পরিমাণ এতই মুষ্টিমেয় যে, সংস্কৃতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষা বলাতে কারও কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়।

প্রাচীন যুগের সব ভাষাই তাই। হিব্রু, গ্রিক, আবেস্তা এবং ঈষৎ পরবর্তী যুগের আরবিও আত্মনির্ভরশীল এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বয়ংসম্পূর্ণ।

বর্তমান যুগের ইংরেজি ও বাঙলা আত্মনির্ভরশীল নয়। আমরা প্রয়োজনমতো এবং অপ্রয়োজনেও ভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ নিয়েছি এবং নিচ্ছি। পাঠান-মোগল যুগে আইন-আদালত খাজনা-খারিজ নতুনরূপে দেখা দিল বলে আমরা আরবি ও ফারসি থেকে প্রচুর শব্দ গ্রহণ করেছি। পরবর্তী যুগে ইংরেজি থেকে এবং ইংরেজির মারফতে অন্যান্য ভাষা থেকে নিয়েছি, এবং নিচ্ছি।

বিদেশি শব্দ নেওয়া ভালো না মন্দ সে প্রশ্ন অবান্তর। নিয়েছি, এবং এখনও সজ্ঞানে আপন খুশিতে নিচ্ছি এবং শিক্ষামাধ্যমরূপে ইংরেজিকে বর্জন করে বাঙলা নেওয়ার পর যে আরও প্রচুর ইউরোপীয় শব্দ আমাদের ভাষায় ঢুকবে, সে সম্বন্ধেও কারও কোনও সন্দেহ নেই। আলু-কপি আজ রান্নাঘর থেকে তাড়ানো মুশকিল, বিলিতি ওষুধ প্রায় সকলেই খান, ভবিষ্যতে আরও নতুন নতুন ওষুধ খাবেন বলেই মনে হয়। এই দুই বিদেশি বস্তুর ন্যায় আমাদের ভাষাতেও বিদেশি শব্দ থেকে যাবে, নতুন আমদানিও বন্ধ করা যাবে না।

পৃথিবীতে কোনও জিনিসই সম্পূর্ণ অসম্ভব নয়। অন্তত চেষ্টা করাটা অসম্ভব না-ও হতে পারে। হিন্দি উপস্থিত সেই চেষ্টাটা করছেন– বহু সাহিত্যিক উঠে-পড়ে লেগেছেন, হিন্দি থেকে আরবি, ফারসি এবং ইংরেজি শব্দ তাড়িয়ে দেবার জন্য। চেষ্টাটার ফল আমি হয়তো দেখে যেতে পারব না। আমার তরুণ পাঠকেরা নিশ্চয়ই দেখে যাবেন। ফল যদি ভালো হয় তখন তাঁরা না হয় চেষ্টা করে দেখবেন। (বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ স্বচ্ছন্দে লিখেছেন, ‘আব্রু দিয়ে, ইজ্জত দিয়ে, ইমান দিয়ে, বুকের রক্ত দিয়ে।’ নজরুল ইসলাম ‘ইনকিলাব’ ইনক্লাব’ নয়– এবং ‘শহীদ’ শব্দ বাঙলায় ঢুকিয়ে গিয়েছেন। বিদ্যাসাগর ‘সাধু’ রচনায় বিদেশি শব্দ ব্যবহার করতেন না, বেনামিতে লেখা ‘অসাধু’ রচনায় চুটিয়ে আরবি-ফারসি ব্যবহার করতেন। আর অতিশয় নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হরপ্রসাদ আরবি-ফারসি শব্দের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা ‘আহাম্মুখী’ বলে মনে করতেন। ‘আলাল’ ও ‘হুতোম’-এর ভাষা বিশেষ উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল; সাধারণ বাঙলা এ সোতে গা ঢেলে দেবে না বলে তার উল্লেখ এস্থলে নিষ্প্রয়োজন এবং হিন্দির বঙ্কিম স্বয়ং প্রেমচন্দ্র হিন্দিতে বিস্তর আরবি-ফারসি ব্যবহার করছেন।

এস্থলে আরেকটি কথা বলে রাখা ভালো। রচনার ভাষা তার বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করে। শঙ্করদর্শনের আলোচনায় ভাষা সংস্কৃতশব্দ-বহুল হবেই, পক্ষান্তরে মোগলাই রেস্তোরাঁর বর্ণনাতে ভাষা অনেকখানি ‘হুতোম’ ঘ্যাঁষা হয়ে যেতে বাধ্য। ‘বসুমতী’র সম্পাদকীয় রচনার ভাষা এক– তাতে আছে গাম্ভীর্য, ‘বাঁকা চোখে’র ভাষা ভিন্ন– তাতে থাকে চটুলতা।

***

বাঙলায় যেসব বিদেশি শব্দ ঢুকেছে তার ভিতরে আরবি, ফার্সি এবং ইংরেজিই প্রধান। সংস্কৃত শব্দ বিদেশি নয় এবং পর্তুগিজ, ফরাসিস, স্প্যানিশ শব্দ এতই কম যে, সেগুলো নিয়ে অত্যধিক দুশ্চিন্তা করার কোনও কারণ নেই।

বাঙলা ভিন্ন অন্য যেকোনো ভাষার চর্চা আমরা করি না কেন, সে ভাষার শব্দ বাঙলাতে ঢুকবেই। সংস্কৃত চর্চা এদেশে ছিল বলে বিস্তর সংস্কৃত শব্দ বাঙলায় ঢুকেছে, এখনও আছে বলে অল্পবিস্তর ঢুকছে, যতদিন থাকবে ততদিন আরও ঢুকবে বলে আশা করতে পারি। স্কুল-কলেজ থেকে যে আমরা সংস্কৃতচর্চা উঠিয়ে দিতে চাইনে তার অন্যতম প্রধান কারণ বাঙলাতে এখনও আমাদের বহু সংস্কৃত শব্দের প্রয়োজন, সংস্কৃত চর্চা উঠিয়ে দিলে আমরা অন্যতম প্রধান খাদ্য থেকে বঞ্চিত হব।

ইংরেজির বেলাতেও তাই বিশেষ করে দর্শন, নন্দনশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা ইত্যাদি জ্ঞান এবং ততোধিক প্রয়োজনীয় বিজ্ঞানেরও শব্দ আমরা চাই। রেলের ইঞ্জিন কী করে চালাতে হয়, সে সম্বন্ধে বাঙলাতে কোনও বই আছে বলে জানিনে, তাই এসব টেকনিকল শব্দের প্রয়োজন যে আরও কত বেশি সে সম্বন্ধে কোনও সুস্পষ্ট ধারণা এখনও আমাদের মনের মধ্যে নেই। সুতরাং ইংরেজি চর্চা বন্ধ করার সময় এখনও আসেনি।

একমাত্র আরবি-ফারসি শব্দের বেলা অনায়াসে বলা যেতে পারে যে, এই দুই ভাষা থেকে ব্যাপকভাবে আর নতুন শব্দ বাঙলাতে ঢুকবে না। পশ্চিম বাঙলাতে আরবি-ফারসির চর্চা যাব যাব করছে, পুব বাঙলায়ও এসব ভাষার প্রতি তরুণ সম্প্রদায়ের কৌতূহল অতিশয় ক্ষীণ বলে তার আয়ু দীর্ঘ হবে বলে মনে হয় না এবং শেষ কথা আরব-ইরানে অদূর ভবিষ্যতে যে হঠাৎ কোনও অভূতপূর্ব জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা আরম্ভ হয়ে বাঙলাকে প্রভাবান্বিত করবে তার সম্ভাবনাও নেই।

কিন্তু যেসব আরবি-ফারসি শব্দ বাঙলাতে ঢুকে গিয়েছে তার অনেকগুলো যে আমাদের ভাষাতে আরও বহুকাল ধরে চালু থাকবে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই এবং দ্বিতীয়ত, কোনও কোনও লেখক নতুন বিদেশি-শব্দের সন্ধান বর্জন করে পুরনো বাঙলার চণ্ডী থেকে আরম্ভ করে ‘হুতোম’ পর্যন্ত– অচলিত আরবি-ফারসি শব্দ তুলে নিয়ে সেগুলো কাজে লাগাবার চেষ্টা করছেন। কিছুদিন পূর্বেও এই এক্সপেরিমেন্ট করা অতিশয় কঠিন ছিল কিন্তু অধুনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে বাধ্য হয়ে পুরনো বাঙলা পড়তে হয়– তারা এইসব শব্দের অনেকগুলো অনায়াসে বুঝতে পারবে বলে অচলিত অনেক আরবি-ফারসি শব্দ নতুন মেয়াদ পাবে।

এই পরিস্থিতির সামনে জীবন্মুত এসব শব্দের একটা নতুন খতেন নিলে ভালো হয়।

***

সংস্কৃত, গ্রিক, বাঙলা আর্য ভাষা, আরবি, হিব্রু সেমিতি ভাষা। ফারসি, উর্দু, কাশ্মিরি, সিন্ধিও আর্য ভাষা, কিন্তু এদের ওপর সেমিতি আরবি ভাষা প্রভাব বিস্তার করেছে প্রচুর। উত্তর ভারতের অন্যান্য ভাষাদের মধ্যে বাঙলা এবং গুজরাতিই আরবি ভাষার কাছে ঋণী, কিন্তু এই ঋণের ফলে বাঙলার মূল সুর বদলায়নি। গুজরাতির বেলাও তাই।

হিব্রু এবং আরবি সাহিত্যের ঐশ্বর্য সর্বজনবিদিত। ঠিক সেইরকম প্রাচীন আর্য ভাষা ফারসি তার ভগ্নি সংস্কৃতের ন্যায় খ্রিস্টের জন্মের পূর্বেই সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠেছিল। আরবরা যখন ইরান জয় করে তখন তারা ইরানিদের তুলনায় সভ্যতা-সংস্কৃতিতে পশ্চাৎপদ। কিন্তু তারা সঙ্গে আনল যে ধর্ম সেটি জরথুস্ত্রি ধর্মের চেয়ে প্রগতিশীল, সর্বজনীন এবং দুঃখীর বেদনা উপশমকারী। ফলে তাবৎ ইরান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল এবং আপন ভাষা ও সাহিত্য বর্জন করে আরবিকে রাষ্ট্রভাষা ও সংস্কৃতির বাহনরূপে স্বীকার করে নিল। আরবি ভাষা ও সাহিত্যে তাই ইরানিদের দান অতুলনীয়।

চারশত বৎসর পরে কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হল। ইরানিদের আপন ভাষা তখন মাহমুদ বাদশার উৎসাহে নবজন্ম লাভ করে নব নব সাহিত্য-সৃষ্টির পথে এগিয়ে চলল। বাল্মীকি যেরকম আদি এবং বিশ্বজগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, ফিরদৌসিও এই নব ইরানি (ফারসি) ভাষার আদি এবং শ্রেষ্ঠ কবি। আরবি থেকে শব্দ এবং ভাবসম্পদ গ্রহণ করে ফারসি সাহিত্য যে অভূতপূর্ব বিচিত্র রূপ ধারণ করল তা আজও বিশ্বজনের কাছে বিস্ময়ের বস্তু। রুমি, হাফিজ, সাদি, খৈয়াম আপন আপন রশিমণ্ডলে সবিতাস্বরূপ। সেমিতি আরবি এবং আর্য ফারসি ভাষার সংঘর্ষের ফলেই এই অনির্বাণ হোমানলের সৃষ্টি হল।

পরবর্তী যুগে এই ফারসি সাহিত্যই উত্তর ভারতে ব্যাপকরূপে প্রভাব বিস্তার করল। ভারতীয় মক্তব-মাদ্রাসায় যদিও প্রচুর পরিমাণে আরবি ভাষা পড়ানো হয়েছিল তবু কার্যত দেখা গেল ভারতীয় আর্যগণ ইরানি আর্য সাহিত্য অর্থাৎ ফারসির সৌন্দর্যে অভিভূত হলেন বেশি। উর্দু সাহিত্যের মূল সুর তাই ফারসির সঙ্গে বাঁধা– আরবির সঙ্গে নয়। হিন্দি গদ্যের ওপরও বাইরের যে প্রভাব পড়েছে সেটা ফারসি– আরবি নয়।

একদা ইরানে যেরকম আর্য ইরানি ভাষা ও সেমিতি আরবি ভাষার সংঘর্ষে নবীন ফারসি জন্মগ্রহণ করেছিল, ভারতবর্ষে সেই সংঘর্ষের ফলে সিন্ধি, উর্দু ও কাশ্মিরি সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। কিন্তু আরবির এই সংঘর্ষ ফারসির মাধ্যমে ঘটেছিল বলে কিংবা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, ভারতবর্ষীয় এ তিন ভাষা ফারসির মতো নব নব সৃষ্টি দিয়ে ঐশ্বর্যশালী সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারল না। উর্দুতে কবি ইকবালই এ তত্ত্ব সম্যক হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন ও নতুন সৃষ্টির চেষ্টা করে উর্দুকে ফারসির অনুকরণ থেকে কিঞ্চিৎ নিষ্কৃতি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

***

বাঙলা আর্যভূমি, কিন্তু এ ভূমির আর্যগণ উত্তর ভারতের অন্যান্য আর্যের মতো নন। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার স্থান এখানে নয়। তাই মাত্র কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি।

১. বাঙলা দেশকে যখনই বাইরের কোনও শক্তি শাসন করতে চেষ্টা করেছে তখন বাঙালি বিদ্রোহ করেছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আপন স্বাধীনতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। পাঠান যুগে বাঙলা অতি অল্পকাল পরাধীন ছিল এবং মোগল যুগেও মোটামুটি মাত্র জাহাঙ্গীর থেকে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত বাঙলা দিল্লির শাসন মেনেছে।

২. অন্যান্য আর্যদের তুলনায় বাঙালি কিছুমাত্র কম সংস্কৃতচর্চা করেনি, কিন্তু সে চৰ্চা সে করেছে আপন বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে। আদিশূর থেকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সকলের বহু চেষ্টাতেও বাঙালি উত্তর ভারতের সঙ্গে স্ট্রিমলাইনৃড় হয়ে সংস্কৃত পদ্ধতিতে সংস্কৃত বর্ণমালার উচ্চারণ করেনি এবং বাঙলাতে সংস্কৃত শব্দ উচ্চারণ করার সময় তো কথাই নেই।

৩. বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যসৃষ্টি তার পদাবলি কীর্তনে। এ সাহিত্যের প্রাণ এবং দেহ উভয়ই খাঁটি বাঙালি। এ সাহিত্যে শুধু যে মহাভারত্নে শ্রীকৃষ্ণ বাঙলায় খাঁটি কানুরূপ ধারণ করেছেন তাই নয়, শ্রীমতী শ্রীরাধাও যে একেবারে খাঁটি বাঙালি মেয়ে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ভাটিয়ালির নায়িকা, বাউলের ভক্ত, মুর্শিদিয়ার আশিক ও পদাবলির শ্রীরাধা একই চরিত্র একই রূপে প্রকাশ পেয়েছেন।

বাঙালির চরিত্রে বিদ্রোহ বিদ্যমান। তার অর্থ এই যে, কি রাজনীতি, কি ধর্ম, কি সাহিত্য যখনই যেখানে সে সত্য শিব সুন্দরের সন্ধান পেয়েছে তখনই সেটা গ্রহণ করতে চেয়েছে; এবং তখন কেউ ‘গতানুগতিক পন্থা’ ‘প্রাচীন ঐতিহ্য’-র দোহাই দিয়ে সে প্রচেষ্টায় বাধা দিতে গেলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। এবং তার চেয়েও বড় কথা,– যখন সে বিদ্রোহ উচ্ছলতায় পরিণত হতে চেয়েছে, তখন তার বিরুদ্ধে আবার বিদ্রোহ করেছে।

এ বিদ্রোহ বাঙালি হিন্দুর ভিতরই সীমাবদ্ধ নয়। বাঙালি মুসলমানও এ কর্মে পরম তৎপর। ধর্ম বদলালেই জাতির চরিত্র বদলায় না।

***

পাঠান আমলে বাঙলা দেশে আরবি-ফারসির চর্চা ব্যাপকভাবে হয়নি। সে যুগে বাঙলাতে লিখিত সরকারি দলিলপত্রে পর্যন্ত আরবি-ফারসি টেকনিকল শব্দ প্রায় নেই। মহাপ্রভু এবং তাঁর শিষ্যদের কেউ কেউ মুসলমান ধর্মের সঙ্গে সুপরিচিত হওয়া সত্ত্বেও সে যুগের বাঙলা সাহিত্যে আরবি-ফারসি শব্দ অতি অল্প।

খাস পাঠান যুগে তো কথাই নেই, মোগল যুগের প্রারম্ভেও কবি আলাওল যে কাব্য রচনা করেছেন তাতে সংস্কৃত ভাষার প্রাধান্যই লক্ষণীয়—

 উপনীত হৈল আসি যৌবনের কাল।
 কিঞ্চিৎ ভুরুর-ভঙ্গে যৌবন রসাল ॥
আড় আঁখি বঙ্ক-দৃষ্টি ক্রমে ক্রমে হয়।
ক্ষণে ক্ষণে লাজে তনু যেন শিহরয় ॥
 সম্বরয় গিম-হার, কটির বসন।
চঞ্চল হইল আঁখি, ধৈরয-গমন ॥
চোররূপে অনঙ্গ অঙ্গেতে আসে যায়।
বিরহ বেদনা ক্ষণে ক্ষণে মনে ভায় ॥

এ ধরনের কাব্য তখন মুসলমানদের ভিতর কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছিল তার বর্ণনা পাই অন্য এক কবির কাছ থেকে। সৈয়দ সুলতান বলেন,

আপনা দীনের বোল্ একা না বুঝিল।
পরস্তব-সকল লৈয়া সব রহিল ৷

(দীন = ধর্ম; পরস্তব = পরধর্ম কীর্তন। এর পূর্বেই মুসলমানরা পদাবলী কীর্তন রচনা আরম্ভ করেছেন এবং কাজী ফয়জউল্লার ‘গোরক্ষ বিজয়’ মুসলমানদের ভিতর লোকপ্রিয় হয়ে গিয়েছে।)

মুসলমানরা আপন ধর্মচর্চা না করে ‘হিন্দুয়ানি’ কাব্য নিয়ে মেতে আছে দেখে মুসলমান মোল্লা-মৌলবিগণ তারস্বরে আপন প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং আরবি-ফারসিতে ধর্মচর্চা করবার জন্য বারবার কড়া ফতোয়া জারি করেছেন।

তখন সৈয়দ সুলতান বললেন, ‘আমরা বাঙলা ছাড়ব না; কিন্তু মুসলমান শাস্ত্রচর্চাও করব। তাই বাঙলাতেই মুসলমান শাস্ত্রচর্চা হবে।’

আরবি-ফারসি ভাষে কিতাব বহুত।
আলিমানে বুঝে, না বুঝে মূর্খসুত।
যে সবে আপন বুলি না পারে বুঝিতে।
পাঁচালী রচিলাম করি আছয়ে দৃষিতে ॥
আল্লায় বলিছে, ‘মুই যে-দেশে যে-ভাষ,
সে-দেশে সে-ভাষে কইলুম রসুল প্রকাশ।’

 (আলিমান = আলিমগণ = পণ্ডিতগণ; রসূল আল্লার প্রেরিত পুরুষ, পয়গম্বর।)

অতি মোক্ষম জবাব। সৈয়দ সুলতান কুরানের বচন উদ্ধৃত করে সপ্রমাণ করলেন, বাঙলাতেই বাঙালি মুসলমানের শাস্ত্রচর্চা করা ফরজ– অবশ্য করণীয়।

সৈয়দ সুলতান কিন্তু আটঘাট বেঁধে পয়গম্বর সাহেবের বাণী বাঙলাতে প্রকাশ করেছেন। নিতান্ত যে কটি আরবি শব্দ ব্যবহার না করলেই নয়, তিনি মাত্র সেগুলোই ব্যবহার করেছেন এবং প্রচলিত হিন্দু ধর্মের মাধ্যমেই ইসলাম প্রকাশ করেছেন।

তোমার সবের মুই জানো হিতকারী।
ইমান-ইসলামের কথা দিলাম প্রচারি ॥
যেরূপে সৃজন হইল সুরাসুরগণ।
যেরূপে সৃজন হইল এ তিন ভুবন ॥
যেরূপে আদম ইবা সৃজন হইল।
যেরূপে যতেক পয়গম্বর উপজিল ॥
বঙ্গেতে এসব কথা কেহ না জানিল।
নবী-বংশ পাঁচালীতে সকল শুনিল।

এস্থলে দ্রষ্টব্য, হিন্দু-মুসলমান উভয়কে মুসলমান ধর্ম বোঝাতে গিয়ে কবি এমন সব বস্তুর উল্লেখ করেছেন, যা মুসলমান ধর্মে নেই। ‘সুর’ ‘অসুর’ কল্পনা ইসলামে নেই। ‘তিন ভুবন’ ইসলামে নেই, আছে ‘দুই ভুবন’। তাঁর পুস্তকের নাম ‘নবীবংশ’ ও হিন্দু ‘হরিবংশের’ অনুকরণ– আরবিতে এই ধরনের নাম নেই।

এমনকি তিনি পয়গম্বর হজরত মুহম্মদকে ‘অবতার’ আখ্যা দিয়ে মোল্লাদের মতে পাপ করেছেন; কারণ মুসলিম শাস্ত্রমতে আল্লা মনুষ্যদেহ গ্রহণ করে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন না, তিনি মানুষদের একজনকে বেছে তাঁকে তাঁর মুখপাত্র করেন। সৈয়দ সুলতান কিন্তু বলছেন–

মুহম্মদ রূপ ধরি নিজ অবতার।
নিজ অংশ প্রচারিত হইতে প্রচার।

আর সবচেয়ে বড় তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন সৈয়দ সাহেব, এই দুইটি ছত্রে–

যারে যেই ভাষে প্রভু করিল সৃজন।
সেই ভাষা তাহার, অমূল্য সেই ধন ॥

এই দুটি ছত্রে যে কত বড় সত্য নিহিত আছে, সে তত্ত্ব কি আমরা আজও বুঝতে পেরেছি? এই সৈয়দ সুলতানকে তখনকার দিনের মোল্লা-মৌলবিরা ইসলামের ঐক্য নষ্ট হয়ে যাবে, আরবির মর্যাদা লোপ পাবে এই ভয় দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁকে ‘মুনাফিক’ অর্থাৎ ‘ভণ্ড’ অর্থাৎ ‘ধর্মধ্বংসকারী’ আখ্যা দিয়ে ‘ফতোয়া’ পর্যন্ত জারি করেছেন। সাহসী কবি কিন্তু অকুণ্ঠ ভাষায় তাঁর মাতৃভাষা বাঙলার জয়গান গেয়ে গেছেন। এ লোক যদি প্রকৃত বাঙালি না হয়, তবে বাঙালি কে?

সে শুভবুদ্ধি, সে সাহস কি আজও আমাদের হয়েছে? কেউ বলে ‘রাষ্ট্রের অখণ্ডতার জন্য হিন্দি গ্রহণ কর’, কেউ বলে ‘ইংরেজি বর্জন করলে আমরা বর্বর হয়ে যাব।’ হায়, বাঙলার পদমর্যাদা কেউ স্বীকার করে না।

যখন দ্বন্দ্ব নেই, সংঘাত নেই, তখন মাতৃভাষার গৌরবগান গেয়ে লম্ফ-ঝম্ফ করে সবাই; কিন্তু যুগসন্ধিক্ষণে, নানা প্রলোভন-বিভীষিকার সম্মুখে মাতৃভাষাকে নিজের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষা বলতে পারাতেই প্রকৃত সাহস, প্রকৃত জ্ঞান উপলব্ধির লক্ষণ। সৈয়দ সুলতানের দুইশত বৎসর পরে ইংরেজি ভাষা বাঙালিকে প্রলোভন দেখিয়েছিল আরেকবার। কিন্তু মুসলমান সুলতানের ন্যায় খ্রিস্টান মাইকেল তখন উচ্চকণ্ঠে বাঙলার জয়গান গেয়েছিলেন।

সৈয়দ সুলতানের অনুকরণকারীরা কিন্তু তাঁর মতো বিচক্ষণ ভাষাবিদ ছিলেন না : ফলে বাঙলাতে যে পরিমাণে আরবি-ফারসি শব্দ প্রবেশ করতে লাগল তাতে ভাষার বৈশিষ্ট্য বিপন্ন হতে লাগল। ইতোমধ্যে– মোগল যুগের শেষের দিকে–উর্দু ভাষাও বাঙলা দেশে প্রবেশ করেছে। তাই তখন যে বাঙলা পাচ্ছি তার উদাহরণ–

বিশ্বনাথ বিশ্বাসে বুঝায়ে বলে বাছা।
দুনিয়ামে এসাভি আদমি রহে সাঁচা।
ভালা বাওয়া কাহে তো মৃত্যুকাল কাছে।…
রাতদিন যৈসা তৈসা সুখ দুঃখ হোয়ে ॥
 জানা গেল বাত যাওয়া জানা গেল বাত।
কাপড়া লেও আও আও মেরা সাথ ॥

যুক্তি নয়, অজুহাত হিসেবে বলা যেতে পারে, আকবরের আমল থেকে বহুল ফারসি শিক্ষাদানের ফলে বাঙলা দেশে তখন প্রচুর লোক বিস্তর আরবি-ফারসি শব্দ দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছে। এটি কিন্তু কোনও সংযুক্তি নয়। কারণ আজ আমরা দৈনন্দিন জীবনে বিস্তর ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি : তাই বলে সাহিত্যসৃষ্টির সময় বে-এক্তেয়ার হয়ে যত্র-তত্র ভূরি ভূরি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করিনে।

কিন্তু সত্য কবি পথভ্রষ্ট হন না। তার প্রকৃত নিদর্শন আমরা পাই, চট্টগ্রামের মহিলা কবি ‘শ্ৰীমতী রহীমুন্নিসা’র (আশা করি ‘শ্রীমতী’ লেখাতে কেউ আপত্তি করবেন না, কারণ তিনি নিজেই তাঁর কাব্যে আপন পরিচয় দেবার সময় লিখেছেন–

‘স্বামী আজ্ঞা শিরে পালি লিখি এ ভারতী।
রহিমুনিচা নাম জান আদ্যে ছিরীমতী ॥’)।

এই মহিলা কবির সঙ্গে হালে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সুপণ্ডিত ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, পূর্ববঙ্গের বাঙলা একাডেমীর প্রথম ডাইরেক্টর (বাঙলা-একাডেমী পত্রিকা, ১ম সংখ্যা, পৌষ ১৩৬৩, পৃ. ৫৩)। তাঁর মতে ‘১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ হইতে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই রহীমু’নিসা আবির্ভূত হয়েছিলেন।’ ইনিও সৈয়দ সুলতানের মতো সৈয়দ বংশের মেয়ে এবং পরিবারে প্রচুর আরবি-ফারসির চর্চা থাকা সত্ত্বেও সুস্থ-সবল এবং মধুর বাংলায় কবিতা রচনা করে গিয়েছেন।

এঁর হাতের লেখা খুব সম্ভব সুন্দর ছিল। তাই বোধ করি তার স্বামী তাঁকে কবি আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ নকল করতে আদেশ দেন :

শুন গুণিগণ হই এক মন,
লেখিকার নিবেদন।
অক্ষর পড়িলে টুটা পদ হৈলে
শুধারিত সর্বজন ॥
পদ এই রাষ্ট্র। হেন মহাকষ্ট
পুঁথি সতী পদ্মাবতী।
 আলাওল মণি বুদ্ধি বলে গুণী,
বিরচিল এ ভারতী ॥
 পদের উতি বুঝি কি শকতি,
মুই হীন তিরী জাতি।
স্বামীর আদেশ মানিয়া বিশেষ
সাহস করিল গাঁথি ॥

রহীমুন্নিসার স্বরচিত কাব্য অল্পই পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে তাঁর একটি ‘বারমাস্যা’ বড়ই করুণ এবং মধুর। পূর্ববঙ্গের কবিরা সচরাচর প্রিয়বিরহে বারমাস্যা রচনা করেছেন– রহীমুন্নিসা ভ্রাতৃশোকে ভার তাঁর নব বারমাস্যা রচনা করেছেন।

আশ্বিনেতে খোয়াময় কান্দে তরুলতায়
ভাই বলি কান্দে উভরায়।
আমার কান্দনি শুনি বনে কান্দে কুরঙ্গিণী
জলে মাছ কান্দিয়া লুকায় ॥

খোয়া = কুয়াশা

অন্য এক স্থলে ‘কন্যাহারা জননী’র শোকাতুরার ক্রন্দন প্রকাশ করেছেন অতুলনীয় সরল বাঙলায়–

নয়া সন নয়া মাস ফিরে বারে বার।
মোর জাদু গেল ফিরি না আসিল আর ॥

এঁর রচনায় সত্যই মধুর কবি-প্রতিভা ‘বারেবার’ ধরা পড়ে। পাঠকদের মূল প্রবন্ধটি পড়তে অনুরোধ জানাই।

***

ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বন্দ্ব প্রধানত ইংরেজির সঙ্গে। এবং সেই দ্বন্দ্ব বিদ্রোহরূপ ধারণ করল পুব বাঙলার ভাষা আন্দোলনে ১৯৫১-৫২ খ্রিস্টাব্দে। বাঙলা আবার জয়ী হল– কিন্তু এবারে তার জয়মূল্য দিতে হল বুকের রক্ত দিয়ে– কিন্তু আব্রু, ইজ্জত, ইমান দিয়ে নয়। পাকিস্তান হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব বাঙলার লোক বাঙলাতে আরেক দফে আরবি-ফারসি শব্দ আমদানি করে ভাষাকে ‘পাক’ করতে প্রলোভিত হল না!

তাই এই প্রবন্ধের নাম দিয়েছি ‘মামদো’র পুনর্জন্ম। ‘মামদো’রই যখন কোনও অস্তিত্ব নেই, তখন তার পুনর্জন্ম হবে কী প্রকারে? পুর্ব বাঙলার লেখকদের স্কন্ধে আরবি-ফারসি শব্দের মামদো ভর করবে, আর তারা বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে আরবি-ফারসিতে অর্থাৎ ‘যাবনী মেশালে’ কিচিরমিচির করতে আরম্ভ করবে, বিজাতীয় সাহিত্য সৃষ্টি করবে– যার মাথামুণ্ডু পশ্চিম বাঙলার লোক বুঝতে পারবে না, সে ভয় ‘স্বপ্ন, মায়া, মতিভ্রম’।