শিক্ষা-প্রসঙ্গে

শিক্ষা-প্রসঙ্গে

কিছুকাল আগে বোম্বায়ে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় শ্রীযুক্ত রাধাকৃষ্ণণ বলেন, এদেশের সবচেয়ে বড় কর্তব্য আপামর জনসাধারণের ভেতর শিক্ষার প্রচার ও প্রসার করা এবং বেকার-সমস্যার নিরঙ্কুশ সমাধান করা।

এ অতি সত্য কথা– এমনকি পৃথিবীর বর্বরতম দেশও এ তত্ত্ব মেনে নেবে। কিন্তু প্রশ্ন, শিক্ষার বিস্তার এবং প্রসার করা যায় কী প্রকারে? পূর্ববঙ্গে একটি প্রবাদ আছে :

‘যত টাকা জমাইছিলাম
শুঁটকি মাছ খাইয়া
 সকল টাকা লইয়া গেল
গুলবদনীর মাইয়া।’

 যত রকমের খাজনা হতে পারে, যত প্রকারের ন্যায্য-অন্যায্য ট্যাক্স হতে পারে সবই তো চাঁদপানা মুখ করে দিচ্ছি। সরকারের হাতে সে টাকা জমা হচ্ছে এবং তার বেবাক খরচ হয়ে যাচ্ছে, এ-খাতে ও-খাতে, অর্থাৎ গুলবদনীর মাইয়াই সব টাকা নিয়ে যাচ্ছে, শিক্ষা-বিস্তারের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তার শতাংশের এক অংশও উদ্বৃত্ত থাকছে না।

কাজেই গ্রামে গ্রামে পাঠশালা খুলি কী করে, পুরনোগুলোই-বা চালু রাখি কোন কৌশলে?

কিন্তু আমার মনে হয় পুরনো স্কুল চালু রাখা আর নতুন স্কুল খোলাই শিক্ষাবিস্তারের জন্য প্রধান কর্ম নয়।

অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গিয়েছে, কোনও বিশেষ গ্রামে গত পঞ্চাশ বৎসর ধরে একটি ভালো পাঠশালা উত্তমরূপে চালু আছে, প্রতি বৎসর দশ-বারোটি ছেলে শেষ পরীক্ষা পাস করে বেরিয়ে যাচ্ছে, কেউ কেউ বৃত্তিও পাচ্ছে, কিন্তু তবু যে কোনও সময় আপনি সে গ্রামে গিয়ে যদি হিসাব নেন, কটি ছেলে লিখতে পড়তে পারে, তবে দেখবেন দশ-বারোটির বেশি না; বাদবাকি আর সবই লেখাপড়া ভুলে গিয়েছে এবং যে দশ-বারোটি কেঁদে-ঝাঁকিয়ে পড়তে পারে তারাও শীঘ্রই সম্পূর্ণ নিরক্ষর হয়ে যাবে। অবশ্যই আমি এস্থলে সাধারণ চাষা-মজুরের কথাই ভাবছি– মধ্যবিত্ত কিংবা বিত্তশালী পরিবারের কথা উঠছে না।

এর কারণ অনুসন্ধান করলে দেখতে পাবেন– আমরা চাষার ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে দিয়ে ভাবি, আমাদের কর্তব্য শেষ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এ কথা ভাবিনে, তারা পরীক্ষায় পাস করার পর পড়বে কী! তারা পুনরায় নিরক্ষর হয়ে যায়, তার একমাত্র কারণ তাদের কাছে পড়বার মতো কিছু থাকে না।

ইয়োরোপের চাষা-মজুর আমাদের মতো গরিব নয়। তারা যে নিরক্ষর হয়ে যায় না, তার একমাত্র কারণ তারা খবরের কাগজ পড়ে এবং মেয়েরা ক্যাথলিক হলে প্রেয়ার বুক আর প্রটেস্ট্যান্ট হলে বাইবেল পড়ে। অবসর সময়ে হয়তো একখানা নভেল কিংবা ভ্রমণকাহিনী পড়ে, কাজ না থাকলে হয়তো তারা চিঠি-চাপাটিও লেখে, কিন্তু এগুলো আসল কারণ নয় আসল কারণ খবরের কাগজ, প্রেয়ার বুক এবং বাইবেল।

স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আমাদের চাষা খেতে পায় না, সে খবরের কাগজ কেনার পয়সা পাবে কোথায়?

তাই দেখতে পাবেন, সে-চাষা কোনও গতিকে তার ছেলেকে পাঠশালা পাসের সময় একখানা রামায়ণ কিংবা মহাভারত কিনে দিতে পেরেছিল তার বাড়িতে তবু কিছুটা সাক্ষরতা বেঁচে থাকে। এই আংশিক বাঁচাওতাটা কিন্তু প্রধানত বাঙলা দেশে। হিন্দিভাষীদের তুলসী রামায়ণ পড়ে সে লাভ হয় না, কারণ তুলসীদাসের ভাষা আর আধুনিক হিন্দিতে প্রচুর তফাত। তুলসীদাসের ভাষা দিয়ে আজকের দিনে চিঠি লেখা যায় না– কাশীরাম কিংবা কৃত্তিবাসের ভাষার সঙ্গে কিন্তু আধুনিক বাংলার খুব বেশি পার্থক্য নেই।

তাই দেখতে পাবেন মুসলমান চাষা পাঠশালা পাসের পর খুব শিগগিরই নিরক্ষর হয়ে যায়, কারণ সে রামায়ণ-মহাভারত পড়ে না এবং বাংলাভাষায় এরকম ধরনের সহজ সরল মুসলমানি ধর্মপুস্তক নেই। ভারতবর্ষের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে পরিস্থিতিটা কিরকম তার খবর আমার জানা নেই, তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস এর পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান করলে আমরা শিক্ষাবিস্তারের জন্য বিস্তর হদিস পাব।

তা হলে ওষুধ কী?

যে উত্তর সকলের প্রথম মনে আসবে সে হচ্ছে, গ্রামে গ্রামে লাইব্রেরি বসানো। কিন্তু অত টাকা জোগাবে কোন গৌরী সেন? সরকার তো দেউলে। তা হলে?

এইখানে এসে আমিও আটকা পড়ে যাই। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি নতুন স্কুল খোলার চেয়েও বড় কাজ, পড়ার জিনিস সাক্ষর ছেলে-মেয়েদের হাতে দেওয়া বিনি পয়সায় কিংবা অতি অল্প দামে।

আমি বহু বৎসর ধরে এ সমস্যা নিয়ে মনে ভোলপাড় করেছি, বহু গুণীর সঙ্গে আলোচনা করেছি, দেশ-বিদেশে উন্নত অনুন্নত সমাজে অনুসন্ধান করেছি তারা এ সমস্যার সমাধান কী প্রকারে করে, কিন্তু কোনও ভালো ওষুধ এখনও খুঁজে পাইনি। আমার পাঠকেরা যদি এ সম্পর্কে তাঁদের সুচিন্তিত অভিমত আমাকে জানান, তবে তার আলোচনা করলে আমরা লাভবান হব সন্দেহ নেই।

অন্য এক বক্তৃতায় শ্রীযুক্ত রাধাকৃষ্ণণ বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের কর্তব্য ছাত্রদের ‘স্পিরিচুয়াল’ ডিরেকশান দেওয়া।

আমার মনে হয়, এইমাত্র আমরা যে সমস্যা নিয়ে বিব্রত হয়েছিলুম সেই সমস্যারই এ আরেকটা দিক।

‘স্পিরিচুয়াল’, বলতে শ্রীরাধাকৃষ্ণণ নিশ্চয়ই ‘রিলিজিয়ান’ বলতে চাননি– তা হলে হাঙ্গামা অনেকখানি কমে যেত–তাই মোটামুটি ধরা যেতে পারে, তিনি আমার প্রয়োজনের দিকটাতেই ইঙ্গিত করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান কর্ম ছাত্রকে তার দেশের বৈদগ্ধের সঙ্গে সংযুক্ত করা এবং এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, ভারতীয় বৈদগ্ধ্যে আত্মার ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য প্রয়োজনের অধিক সুস্বাদু আহার্য রয়েছে। কাজেই ধরে লওয়া যেতে পারে, অধ্যাপকেরা যদি ছাত্রকে ভারতীয় বৈদগ্ধের প্রতি অনুসন্ধিৎসু করতে পারেন, সে-বৈদগ্ধের উত্তম উত্তম বস্তুর রসাস্বাদ করাতে শেখান, তবে ছাত্র নিজের থেকেই তার প্রয়োজনীয় আধ্যাত্মিক ধন চিনে নিতে পারবে। সকলেরই কাজে লাগবে এবং মুষ্টিযোগ যখন মুষ্টিগত নয়, তখন ছাত্রের সামনে। গন্ধমাদন রাখা ছাড়া উপায় নেই– যে যার বিশল্যকরণী বেছে নেবে।

কিন্তু সমস্যা তৎসত্ত্বেও গুরুতর। ছেলেদের পড়তে দেব কী? ভারতীয় বৈদগ্ধ্যের শতকরা পঁচানব্বই ভাগ সংস্কৃত-পালিতে, তিন ভাগ ইংরেজিতে, আর মেরেকেটে দু ভাগ বাংলায়। অথচ আজকের দিনে সব ছেলেকে তো আর জোর করে বি. এ. অনার্স অবধি সংস্কৃত পড়াতে পারিনে। এবং তাতেই-বা কী লাভ? ক জন সংস্কৃতে অনার্স গ্র্যাজুয়েটকে অবসর সময়ে সংস্কৃত বইয়ের পাতা ওল্টাতে আপনি আমি দেখেছি? সংস্কৃত গড় গড় করে পড়া শিখতে হলে টোল ছাড়া গত্যন্তর নেই।

অতএব মাতৃভাষাতেই আমাদের বৈদগ্ধ্যচর্চা করতে হবে।

এবং সেখানেই চিত্তির। আজ যদি আপনি বেদ, উপনিষদ, ষড়দর্শন, কাব্য, অলঙ্কার, নৃত্যনাট্য-সঙ্গীতশাস্ত্র বাংলা অনুবাদে পড়তে চান তবে একবার ঘুরে আসুন কলেজ স্কোয়ারের বইয়ের দোকানগুলোতে। যেসব বইয়ের বাংলা অনুবাদ হয়ে গিয়েছে সেগুলোই জোগাড় করতে গিয়ে আপনাকে চোখের জলে নাকের জলে হতে হবে।

আর কত শত সহস্র পুস্তক যে আপনার পড়তে ইচ্ছা হবে, অথচ অনুবাদ নেই তার হিসেব করবে কে?

হিন্দিওয়ালাদের তো আরও বিপদ। আমাদের চেয়ে ওদের অনুবাদসাহিত্য অনেক বেশি কমজোর। এই দিল্লির কনট সার্কাসে আমি হিন্দি বইয়ের দোকানে সার্কাসের ঘোড়ার মতোই চক্কর লাগাই–আজ পর্যন্ত কোনও সংস্কৃত বইয়ের উত্তম হিন্দি অনুবাদ চোখে পড়ল না, যেটি বাড়িতে এনে রসিয়ে রসিয়ে পড়ি।

মারাঠি ভাষায় তবু কিছু আছে, গুজরাতিতে আরও কম। আসামিতে প্রায় কিছুই নেই, ওড়িয়ার খবর জানিনে- তবে যেহেতু শিক্ষিত আসাম এবং উড়িষ্যা-সন্তান মাত্রই বাংলা পড়তে পারেন তাই তাদের জন্য বিশেষ দুশ্চিন্তা করতে হবে না।

মোদ্দা কথায় ফিরে যাই। রাধাকৃষ্ণণ তো দায় চাপিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর অর্থাৎ অধ্যাপকদের ওপর। কিন্তু হায়, তাঁদের তো দরদ নেই এসব জিনিসের প্রতি। আর স্বয়ং রাধাকৃষ্ণণের যদি দরদ থাকত তবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে উপরাষ্ট্রপতি হতে গেলেন কেন??