ভাষা ও জনসংযোগ

ভাষা ও জনসংযোগ

‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র দোল সংখ্যায় (১৯৫৩) শ্ৰীযুত প্রবোধচন্দ্র সেন ‘বাংলা-সাহিত্যের অতীত এবং ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক একটি সুচিন্তিত এবং বহু তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন। হিন্দি ইংরেজি বনাম বাংলাভাষা ও সাহিত্য নিয়ে যারা কৌতূহলী, তাদের সকলকে আমি এই প্রবন্ধটা পড়তে অনুরোধ করি– তাঁরা লাভবান হবেন।

আমার আলোচনায় জানা-অজানাতে প্রবোধচন্দ্রের অনেক যুক্তি এসে গিয়েছে এবং আসবে। প্রবোধচন্দ্র না হয়ে অন্য কোনও কাঁচা লেখক হলে আমি আমার লেখাতে পদে পদে তাঁর উদ্ধৃতির ঋণ স্বীকার করতুম– কিন্তু এর বেলা সেটার প্রয়োজন নেই, কারণ প্রবোধবাবু লব্ধপ্রতিষ্ঠ পণ্ডিত, তার একমাত্র উদ্দেশ্য বাংলা ভাষা যেন তার ন্যায্য হক পায় এবং সেই হক সপ্রমাণ করার জন্য কে তার লেখা থেকে কতখানি সাহায্য পেল, সে সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ উদাসীন। এবং আমার বিশ্বাস, দরকার হলে তিনিও অন্য লেখকের রচনা থেকে যুক্তি-তর্ক আহরণ করতে কুণ্ঠিত হবেন না। আমার লেখা তাঁকে সাহায্য না-ই করল।

প্রাচ্যে যে বড় বড় আন্দোলন হয়ে গিয়েছে, সেসব আন্দোলন শুধু যে তার জন্মভূমিতেই সফল হয়েছে তাই নয়, তার ঢেউ পশ্চিমকেও তার সুপ্তিতে জাগরণ এনে দিয়েছে, সেসব আন্দোলনকে আমরা সচরাচর ধর্মের পর্যায়ে ফেলে নবধর্মের অভ্যুদয় নাম দিয়ে থাকি। ভারতবর্ষে তাই বৌদ্ধ ও জৈনদের দুই বৃহৎ আন্দোলনকে আমরা ধর্মের আখ্যা দিয়েছি; সেমিতি ভূমিতে ঠিক ওই রকমই দুই মহাপুরুষকে কেন্দ্র করে দুটি জোরালো আন্দোলন সৃষ্ট হয় তাদের নাম খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলাম।

আজকের দিনে ধর্ম বলতে আমরা প্রধানত বুঝি, মানুষের সঙ্গে ভগবানের সম্পর্ক। পূজা-অর্চনা কিংবা কৃচ্ছ্রসাধন ধ্যানাদি করে, কী করে ভগবানকে পাওয়া যায় ধর্ম সেই পন্থা দেখিয়ে দেয়, এই আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু একটুখানি ধর্মের ইতিহাস অধ্যয়ন করলেই দেখতে পাবেন, ভগবানকে পাওয়ার জন্য যতখানি মাথা ঘামিয়েছে তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি চেষ্টা করেছে, মানুষে মানুষে সম্পর্ক সভ্যতর করার জন্য। ধর্ম চেষ্টা করেছে, ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য কমাতে, অন্ধ-আতুরের আশ্রয় নির্মাণ করাতে– এক কথায়, এমন এক নবীন সমাজ গড়ে তুলতে যেখানে মানুষ মাৎস্যন্যায় বর্জন করে, একে অন্যের সহযোগিতায় আপন আপন শক্তির সম্পূর্ণ বিকাশ করতে পারে। বৌদ্ধ এবং জৈনধর্ম এইসব কাজেই মনোযোগ করেছে বেশি– ভগবানের সান্নিধ্য এবং তার সাহায্য সম্বন্ধে উদাসীন হয়ে।

বিত্তশালী এবং পণ্ডিতের সংখ্যা সংসারে সবসময়েই কম ছিল বলে বড় আন্দোলনকারী মাত্রই এদের উপেক্ষা করে জনগণকে কাছে আনতে– এমনকি খেপিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন প্রাণপণ। তাই তারা বিত্তশালী এবং পণ্ডিতের ভাষা উপেক্ষা করে যে-ভাষার কথা বলেছেন, সেটা জনগণের ভাষা। তথাগতের ভাষা তকালীন গ্রাম্য ভাষা পালি এবং মহাবীরের ভাষা অর্ধ-মাগধী, খ্রিস্টের ভাষা হিব্রুর গ্রাম্য সংস্করণ, আরামেয়িক এবং মুহম্মদের (দ.) ভাষা আরবি। আরবি সে-যুগে এতই অনাদৃত ছিল যে, আরবেরাই আশ্চর্য হল, এ ভাষায় আল্লাহ তাঁর কুরআন প্রকাশ (অবতরণ= নাজিল) করলেন কেন? তারই উত্তর কুরআনে রয়েছে–

আল্লাহ বলেছেন :

“Had we sent as
 A Quaran (in a language)
Other than Arabic, they would
 Have said : why are not
 It’s verses explained in detail
What! (a book) not in Arabic
And (a Messenger an Arab?)”

অর্থাৎ “আমরা যদি আরবি ভিন্ন অন্য কোনও ভাষাতে কুরআন পাঠাতুম, তা হলে তারা বলত, এর বাক্যগুলো ভালো করে বুঝিয়ে বলা হয়নি কেন? সে কী! বই আরবিতে নয় অথচ পয়গম্বর আরব?”

আল্লাহ স্পষ্টভাষায় বলেছেন, আরব পয়গম্বর যে আরবি ভাষায় কুরআন অবতরণের ভাষা ব্যবহার করবেন সেই তো স্বাভাবিক, অন্য যে কোনও ভাষায় (এবং সে যুগে হিব্রু ছিল পণ্ডিতের ভাষা) সে কুরআন পাঠানো হলে মক্কার লোক নিশ্চয়ই বলত, ‘আমরা তো এর অর্থ বুঝতে পারছিনে।’

গণ-আন্দোলন সবচেয়ে বড় কথা– আপামর জনসাধারণ যেন বক্তার বক্তব্য স্পষ্ট বুঝতে পারে।

তাই মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের চতুর্দিকে যে আন্দোলন গড়ে উঠল, তার ভাষা বাংলা, তুকারামের ভাষা মারাঠি (তিনি ব্যঙ্গ করে বলেছেন, সংস্কৃতই কেবল সাধুভাষা?– তবে কি মারাঠি চোরের ভাষা), কবীরের ভাষা সে-সময়ে প্রচলিত হিন্দি এবং তিনিও বলেছেন, “সংস্কৃত কূপজল (তার জন্য ব্যাকরণের দড়ি-লোটার প্রয়োজন) কিন্তু ‘ভাষা’ (অর্থাৎ চলিত ভাষা) ‘বহতা’ নীর– যখন খুশি ঝাঁপ দাও, শান্ত হবে শরীর।” রামমোহন, দয়ানন্দ আপন আপন মাতৃভাষায় তাঁদের বাণী প্রচার করেছিলেন, আর রামকৃষ্ণ যে বাংলা ব্যবহার করে গিয়েছেন, তার চেয়ে সোজা সরল বাংলা আজ পর্যন্ত কে বলতে পেরেছেন? এমনকি বিদ্যাসাগর মহাশয়ও তাঁর বিপক্ষ দলকে উপদেশ দিয়েছেন সংস্কৃত না লিখে বাংলায় উত্তর দিতে। তিনি নিজেও সংস্কৃত লেখেননি, যদিও তিনি সংস্কৃত জানতেন আর সকলের চেয়ে বেশি।

আমার মনে হয় বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের পতনের অন্যতম কারণ সেদিনই জন্ম নিল, যেদিন বৌদ্ধ ও জৈন পণ্ডিতেরা দেশজ ভাষা ত্যাগ করে সংস্কৃতে শাস্ত্রালোচনা আরম্ভ করলেন। দেশের সঙ্গে যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল; ওদিকে সংস্কৃতে শাস্ত্রচর্চা করতে ব্রাহ্মণদের ঐতিহ্য ঢের ঢের বেশি– বৌদ্ধ-জৈনদের হার মানতে হল।

পৃথিবীজুড়ে আরও বহু বিরাট আন্দোলন হয়ে গিয়েছে– পণ্ডিতি ভাষাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, মাতৃভাষার ওপর পরিপূর্ণ নির্ভর করে।

এইবারে নিবেদন ইতিহাস আলোচনা করে দেখান তো পৃথিবীর কোথায় কোন মহান এবং বিরাট আন্দোলন হয়েছে জনগণের কথ্য এবং বোধ্য ভাষা বর্জন করে?

এ তত্ত্ব এতই সরল যে, এটাকে প্রমাণ করা কঠিন। স্বতঃসিদ্ধ জিনিস প্রমাণ করতে গেলেই প্রাণ কণ্ঠাগত হয়।

আটঘাট বেঁধে পূর্বেই প্রমাণ করেছি, এসব আন্দোলন নিছক ধর্মান্দোলন (অর্থাৎ আত্মা-পরমাত্মাজনিত) নয়; এদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অংশ অনেক বেশি গুরুত্বব্যঞ্জক।

তাই ভারতবর্ষ এখন যে নবীন রাষ্ট্র নির্মাণের চেষ্টা করছে, তার সঙ্গে এইসব আন্দোলনের পার্থক্য অতি সামান্য এবং তুচ্ছ। এই যে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করা হয়েছে, তার সাফল্যের বৃহদংশ নির্ভর করবে জনগণের সহযোগিতার ওপর– এ কথা পরিকল্পনার কর্তাব্যক্তিরা বহুবার স্বীকার করেছেন এবং ক্রমেই বুঝতে পারছেন, উপর থেকে পরিকল্পনা চাপিয়ে কোনও দেশকে উন্নত করা যায় না যদি নিচে থেকে জনগণের হৃদয়মন থেকে সাড়া না আসে, সহযোগিতা জেগে না ওঠে।

আমাদের সর্ব প্রচেষ্টা, সর্ব অর্থব্যয়, সর্ব কৃম্প্রসাধন সম্পূর্ণ নিষ্ফল হবে যদি আমরা আমাদের সর্ব পরিকল্পনা সর্ব প্রচেষ্টা জনগণের বোধ্য ভাষায় তাদের সম্মুখে প্রকাশ না করি। এ বিষয়ে আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ নেই।

আমি জানি, ভারতবর্ষ এগিয়ে যাবেই, কেউ ঠেকাতে পারবে না, শুধু যারা অন্তহীনকাল ধরে ইংরেজির সেবা করতে চান, তাঁরা ভারতের অগ্রগামী গতিকে মন্থর করে দেবেন মাত্র।

এ বিশ্বাস না থাকলে আমি বারবার নানা কথা এবং একাধিকবার একই কথা বলে বলে আপনাদের বিরক্তি ও ধৈর্যচ্যুতির কারণ হতুম না।