রবীন্দ্র-সঙ্গীত ও ইয়োরোপীয় সুরধারা

রবীন্দ্র-সঙ্গীত ও ইয়োরোপীয় সুরধারা

প্রায়ই প্রশ্ন শুনতে পাওয়া যায়, ইয়োরোপ রবীন্দ্রনাথকে কতখানি চিনতে পেরেছিল, আর আজ যে ইয়োরোপে রবীন্দ্রনাথের নাম কেউ বড় একটা করে না তার কারণ কী?

এ প্রশ্নের উত্তর দেবার পূর্বে আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। সে প্রশ্ন স্বগত– আমরা, অর্থাৎ বাঙালিরাই রবীন্দ্রনাথকে কতখানি চিনি? রবীন্দ্রনাথের কাব্যপ্রতিভা, নাট্যনির্মাণক্ষমতা, দার্শনিক চিন্তাশক্তি, সার্বভৌমিক ধর্মানুভূতি, ঔপন্যাসিক অন্তদৃষ্টি, বৈজ্ঞানিক কৌতূহল, ঐতিহ্যগত শিক্ষাদান প্রচেষ্টা, বৈয়াকরণিক অনুসন্ধিৎসা– সবকিছু মিলিয়ে তার অখণ্ডরূপ হৃদয়মনে আঁকার কথা দূরে থাক, যেখানে তিনি ভারতের তথা পৃথিবীর সব কবিকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন তারই সম্পূর্ণ পরিচয় পেয়েছেন কজন বাঙালি?

কবিতার কথাই ধরা যাক। সেখানে দেখি কেউ কেউ কল্পনা ছাড়িয়ে কবির সঙ্গে কল্পলোকে ‘হংসবলাকা’র পাখা মেলতে নারাজ, কেউবা ‘মহুয়া’তে পৌঁছে বঁধুকে ‘মহুয়া’ নাম ধরে ডেকেই সন্তুষ্ট, আর রোগশয্যায় কবিকে সঙ্গ দিতে রাজি অতি অল্প দুঃসাহসী রসজ্ঞ। কাউকে দোষ দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়; আমি নিজে গুরুদেবের গদ্য কবিতার রস পাই না। কাজেই আমরা সকলেই পরমানন্দে অন্ধের হস্তীদর্শন করছি কিন্তু আমাদের চরম সান্ত্বনা, এ সংসারের অধিকাংশ অন্ধ আপন আপন যষ্টি ত্যাগ করে বৃহত্তর লোকের ক্ষীণতম আভাস পাওয়ার জন্য অঙ্গুষ্ঠপরিমাণ উদগ্রীব নয়।

 এ কথাও বলা বৃথা যে রবীন্দ্রকাব্যের সম্পূর্ণ রস পাই আর না-ই পাই, তার কাব্যজগতের মূল সুরটি আমরা ধরতে পেরেছি। মনে পড়ছে বিশ্বভারতীর সাহিত্যসভায় এক তরুণ লেখক রবীন্দ্রনাথ ও কালিদাসের কাব্যে প্রধান দুটি মিল দেখিয়ে একখানা সরেস প্রবন্ধ পড়েছিলেন– বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ও কালিদাস উভয়েই বর্ষার ও প্রেমের কবি। প্রবন্ধ পাঠ শেষ হলে সভাপতি রূপে কবিগুরু লেখাটির প্রচুর প্রশংসা করে বলেন যে, যদিও মিল দুটি স্বীকার্য তৎসত্ত্বেও প্রশ্ন, এই দুই বস্তু বাদ দিয়ে ভারতীয় কোনও কবি কি লিখতে পারতেন? রবীন্দ্রনাথ সালঙ্কার আপন বক্তব্য প্রকাশ করেছিলেন এতদিন পরে স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করে তার প্রতিবেদন দেওয়া আমার পক্ষে ‘সাহিত্যিক’ সাধুতার পরিচায়ক হবে না, তবে ভাবখানা অনেকটা এই ছিল যে রাফায়েল মাদোন্না এঁকেছেন, অজন্তাকারও মাতাপুত্র এঁকেছেন কিন্তু দু জনের ভিতর সত্যিকার মিল কতদূর?

অর্থাৎ রবীন্দ্রকাব্যের মূল সুর যদি এই শ্রেণিরই হয় তবে তার কোনও মূল্য নেই।

 (এ স্থলে অবান্তর হলেও একটি কথা না বললে হয়তো প্রবন্ধলেখকের প্রতি অন্যায় করা হবে। যদিও রবীন্দ্রনাথের মতে প্রবন্ধটি স্বতঃসিদ্ধ বস্তু সপ্রমাণ করে ব্যর্থতার প্রমাণ দিয়েছিল তবু সভাস্থ আর পাঁচজন সে মত পোষণ করেননি, এবং বিশ্বভারতীর যে কোনও ছাত্র এরকম প্রবন্ধ লিখতে পারলে আত্মপ্রসাদ লাভ করতেন।)।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাব্যপ্রতিভার মহত্তম এবং মধুরতম বিকাশ তার গানে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলতেন যে তিনি তাঁর গানে প্রকৃতিকেও হারাতে পেরেছেন এবং সে গর্বটুকু একটি গানে অতি অল্প কথায় প্রকাশ করেছেন :

আজ এনে দিলে, হয়তো দিবে না কাল–
 রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল।
এ গান আমার শ্রাবণে শ্রাবণে
 তব বিস্মৃতি স্রোতের প্লাবনে
ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে তরণী
বহি তব সম্মান ॥

 শুধু কদমফুল। প্রকৃতির কত নগণ্য সৌন্দর্যবস্তু মানুষের কত উচ্চ আশা-আকাঙ্ক্ষা, ক্ষুদ্র দুঃখ-দৈন্য রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত স্পর্শমণির স্পর্শে হেমকান্ত সফল পরিপূর্ণতায় অজরামর হয়ে গিয়েছে, এবং ভবিষ্যতে– ক্যাথলিকদের ভাষায় বলি, ক্যাননাইজড হয়ে যুগ যুগ ধরে বাঙালির স্পর্শকাতর হৃদয়ের শ্রদ্ধাঞ্জলি আকর্ষণ করবে।

অথচ আজকের দিনে এ কথাও সত্য যে অল্প বাঙালিই রবীন্দ্রনাথের আড়াই হাজার গানের আড়াই শ গান শোনবার সৌভাগ্য লাভ করেছেন।

তবে কি আমরা রবীন্দ্রনাথের কবিত্বে প্রতিভার যথেষ্ট পরিচয় পাইনি? সেকথাও সত্য নয়। আমরা এতক্ষণ বাঙালি যুধিষ্ঠিরকে শুধু তাঁর নরক দর্শন করাচ্ছিলুম এবং সেই সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেবার চেষ্টা করছিলুম যে বাঙালির পক্ষেও যদি রবীন্দ্রনাথকে সম্পূর্ণরূপে চেনা এত কঠিন হয় তবে অবাঙালির পক্ষে, বিশেষত সাহেবের পক্ষে– তা তিনি ইংরেজই হোন আর জর্মনই হোন– সম্পূর্ণ অসম্ভব।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রবীন্দ্রনাথ যখন ইউরোপ যান তখন তিনি বিশেষ করে জর্মনিতে রাজাধিরাজের সম্মান পান। সে সম্মানের কাহিনী বিশ্বভারতী লাইব্রেরিতে নানা ভাষায় সযত্নে রক্ষিত আছে।

তার পর রবীন্দ্রনাথ আবার জর্মন যান ১৯৩০ সালে। মারমুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশস্ততম গৃহে রবীন্দ্রনাথ বক্তৃতা দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কী এক জয়ন্তী উপলক্ষে সমস্ত জৰ্মনির বিদ্বজ্জন তখন মারবুর্গে সমবেত; তাঁরা সকলেই সে সভায় উপস্থিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে ধর্ম সম্বন্ধে একটি রচনা পাঠ করেন। অধ্যাপক অটো সে বক্তৃতার জর্মন অনুবাদ করেন। শ্ৰোতৃমণ্ডলী মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় রচনা পাঠ শুনেছিল এবং পাঠ শেষ হলে যে উচ্ছ্বসিত প্রশংসাধ্বনি উঠেছিল, তার তুলনা দেবার মতো ভাষা আমার নেই।

সেদিন বিকেলবেলা মারবুর্গের পুস্তকবিক্রেতাদের দোকানে গিয়ে অনুসন্ধান করলুম, রবীন্দ্রনাথের কোন কোন পুস্তকের জর্মন অনুবাদ পাওয়া যায়। নির্ঘন্ট শুনে আশ্চর্য হলুম– গীতাঞ্জলি, গার্ডেনার, চিত্রা, ডাকঘর, সাধনা এবং নেশানালিজম! মাত্র এই কখানি বই নিয়ে আর ইংরেজি ভাষায় এক বক্তৃতা শুনে জর্মনরা এত মুগ্ধ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এবং এখনও আছে যে, ইংরেজি বা জনে এই কখানা বই পড়ে রবীন্দ্রনাথের আসল মহত্ত হৃদয়ঙ্গম করা অসম্ভব।

তখনই আমার বিশ্বাস হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে জর্মনির এই উচ্ছ্বাস দীর্ঘস্থায়ী হবে না। গীতাঞ্জলির ধর্মসঙ্গীত জর্মন মনকে চমক লাগাতে পারে, গার্ডেনারের প্রেমের কবিতাও জাদু বানাতে পারে, সাধনার রচনাও বিদ্যুৎশিখার মতো ঝলকাতে পারে কিন্তু এসব দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠতর এবং শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টির অনুবাদ অপরিহার্য।

কিন্তু কোনও ব্যাপক অনুবাদকার্য কেউ হাতে তুলে নেননি। তার কারণ অনুসন্ধান করতে হলে অনেক গবেষণার প্রয়োজন। উপস্থিত শুধু সবচেয়ে বড় দুঃখটা নিবেদন করি।

রবীন্দ্রনাথের গানের মতো হুবহু গান জর্মনে আছে এবং সেগুলো জর্মনদের বড় প্রিয়। এগুলোকে ‘লিডার’ বলা হয় এবং শুধু লিডার গাইবার জন্য বহু জর্মন গায়ক প্রতিবছর প্যারিস, লন্ডন যায়। এসব লিডারের কোনও কোনও গানের কথা দিয়েছেন গ্যোটের মতো কবি, আর সুর দিয়েছেন বেটোফেনের মতো সঙ্গীতকার।

আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের গানে গ্যোটে-বেটোফেনের সমন্বয়। একাধারে এই দুই সৃজনপন্থার সম্মেলন হয়েছিল বলে রবীন্দ্রসঙ্গীত জর্মন লিডারের চেয়ে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ। অনুভূতির সূক্ষ্মতা, কল্পনার প্রসার, এবং বিশেষ করে সুর ও কথার অঙ্গাঙ্গী বিজড়িত অর্ধনারীশ্বর পৃথিবীর কোনও গান বা ‘লিডার’ জাতীয় সৃষ্টিতে আজ পর্যন্ত অবতীর্ণ হননি রবীন্দ্রসঙ্গীতে যেরকম হয়েছে।

বাঙালিকে বাদ দিলে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রকৃত মূল্য একমাত্র জর্মনিই ঠিক বুঝতে পারবে।

কোনও ব্যাপক অনুবাদ তো হলই না, এমনকি রবীন্দ্রনাথের গানও জর্মন-কণ্ঠে গীত হল না।

কাজেই ‘সাত দিনের ভানুমতি’ আট দিনের দিন কেটে গেল। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস যেদিন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মতো অনুবাদক কবি ইয়োরোপে জন্মাবেন সেদিন ইয়োরোপ–

‘চিনে নেবে চিনে নেবে তারে।’