বাঙালি মেনু

বাঙালি মেনু

বয়স হয়েছে, যখন খুশি রেস্তোরাঁয় ঢুকে মমলেট-কটলেট হুকুম দিতে লজ্জা করে। আর যখন বয়স হয়নি তখন জেবে সিঙ্গিল চায়েরও রেস্ত থাকত না বলে রেস্তোরাঁয় ঢোকবার উপায় ছিল না।

ভগবান দয়াময়। তিনি সবকিছুই দেন, কিন্তু তার ‘টাইমিং’টা বড্ডই খারাপ। বৃদ্ধকে দেন। তরুণী ভার‍্যা এবং হোটেলে যাবার পয়সা। উনিশ শতকের নাটক-বেলে একেই বলা হত ‘অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস’।

অসময়ে বৃষ্টি। ট্রাম থেকে নেমেই রেস্তোরাঁতে ঢুকতে হল। বহুকাল পরে কলকাতা ফিরেছিও বটে– পুরনো যাবতীয় প্রতিষ্ঠান আগেরই মতো চালু আছে কি না দেখার বাসনাটাও রয়েছে।

একখানা আলুর চপ আর এক কাপ চা।

শুনেছি সায়েবরা মাস্টার্ড খান শুধু শূকর এবং আরেকটা নিষিদ্ধ মাংসের সঙ্গে। মুর্গি, মটন, মাছের সঙ্গে তাঁরা রাই খান না। মুর্গি, মটনের সঙ্গে নাই-বা খেলেন, কিন্তু মাছের সঙ্গে সরষে যেন রবীন্দ্রসঙ্গীতে কথার সঙ্গে সুরের মিল– এ তত্ত্বটা সায়েবরা এদেশে দু শ বছর থেকেও শিখল না দেখে তাজ্জব মানতে হয়।

তা সে যা-ই হোক, আমি সরষে খাই সব জিনিসের সঙ্গে এই নিতান্ত সন্দেশ-রসগোল্লা ছাড়া। তাই আলুর চপের মটনকিমা সরষে সংযোগে খেতে খেতে ছোকরাকে বললুম, ‘সরষেটা ভালো না।’

 ম্যানেজার শুনতে পেয়ে বললে, ‘হক কথা বলেছেন, স্যার, কিন্তু বিলিতি মাস্টার্ডের ওপর সরকার ট্যাক্সো যা লাগিয়েছেন তার ঝাঁঝটা মাস্টার্ডের চেয়েও বেশি।’

আমি বললুম, ‘তবে নাকচ করে দিন বিলিতি মাস্টার্ড; চালান দেশের তৈরি খাঁটি প্লেন কাসুন্দি। খরচাও কম পড়বে।’

ম্যানেজার আমার দিকে হাবার মতো তাকালে। বোধ হয় ভাবলে, আমি নিতান্তই গাঁইয়া। তা আমি বটিও।

দিশি-বিলিতি কোনও মাস্টার্ডই কাসুন্দির সামনে দাঁড়াতে পারে না। কাসুন্দিতে থাকে মিঠে-কড়া, মোলায়েম-মোলায়েম ঝাঁজ– আর বিলিতি মাস্টার্ডের ঝাঁজ চাষাড়ে, ফরাসি মাস্টার্ডে বদখদ মিষ্টি-মিষ্টি ভাব।

যবে থেকে আমার পাশের বাড়িতে এক দার্শনিক এসে উঠেছেন, পাড়ার আমাদের সক্কলের গায়ে দর্শনের হাওয়া লেগেছে। আমরা এখন আর তথ্য নিয়ে তর্ক করিনে, তত্ত্ব কারে কয় তারই চিন্তা করি। আমি তাই কাসুন্দির খেই ধরে তত্ত্বচিন্তায় মনোনিবেশ করলুম। আমরা আপন জিনিসের সম্মান দিতে জানিনে। হিন্দিতে যাকে বলে ‘ঘরকি মুর্গি দাল বরাবর’ অর্থাৎ ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’।

তখন মনে পড়ে গেল, গেল লড়াইয়ের সময় আমাকে এক মার্কিন অফিসার আফসোস করে বলেছিল, কলকাতায় বাঙালি-রান্না খাবার রেস্তোরাঁ নেই। তাকে এক বাঙালি নিমন্ত্রণ করে ডাল-চচ্চড়ি খাইয়েছিল, সেই থেকে বেচারি তামাম কলকাতা চষে বেড়িয়েছে বাঙালি রান্নার সন্ধানে, আর পেয়েছে শুধু মমলেট-কটলেট-ডেভিল কিংবা কোর্মা-পোলাও-কালিয়া। সে চেয়েছে এক ঘটি জল, পেয়েছে তিনখানা বেল।

দর্শনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে শোপেনহাওয়ার বলেছেন, ‘অমা যামিনীর অন্ধকার অঙ্গনে অন্ধের অনুপস্থিত অসিত অশ্বডিম্বের অনুসন্ধান।’ কলকাতায় বাঙালি রান্নার রেস্তোরাঁ অনুসন্ধান এই একই গোত্রীয় কলকাতায় প্রথম আশ্চর্য!

অথচ দেখুন ইংরেজি (কিংবা ট্র্যাশ বলতে পারেন), মোগলাই, চীনা, মাদ্রাজি, গুজরাতি (‘অন্নপূর্ণা’ দ্রষ্টব্য– খাওয়া না-খাওয়ার জিম্মেদার আপনি) বহু রকমের রান্নাই এই কলকাতায় পাবেন। রোস্ট কবাব চপ সুয়েজ ইডলিডোসে করহি, ফরাসি একেলোপ দ্য ভো ও শাতোব্রিয়া, এমনকি ভিয়েনার ভিনার শিংসেল পর্যন্ত পাবেন। পাবেন না শুধু ঘ্যাঁট, অম্বল।

তাই ভাবছি, আপনাতে-আমাতে একটা বাঙালি রেস্তোরাঁ খুললে হয় না?

বাঙালি সর্বভুক। তাই বাঙালি প্রবাদ ‘লোহা খাইনে শক্ত বলে, “–” খাইনে গন্ধ বলে।’ তাই বলে কি আমাদের রেস্তোরাঁয় সবকিছু থাকবে? উঁহু! আমাদের মাপকাঠি হবে–বাড়িতে আমাদের মা-মাসীরা আটপৌরে এবং পোশকি যেসব রান্না করেন।

তা হলে এইবারে ‘মেনু’টা তৈরি করা যাক।

কিন্তু তার পূর্বেই স্থির করতে হয়, খেতে দেবেন কিসে?

আমি মনস্থির করেছি– কাঁসা কিংবা পেতলের থালায়। সাদা কিংবা কালো পাথরের থালারও ব্যবস্থা থাকবে; নিতান্ত সাত্ত্বিক জনের জন্য শালপাতা, কলা-পাতার ব্যবস্থাও থাকবে। সব কটা থাক্ আর নাই থাক– চীনে বাসন ছুরি-কাঁটা বারণ।

এখন আহারাদি।

১। ভাত আতপ এবং সেদ্ধ, লুচি, পরোটা, বাকরখানি (বাদ দিলে চলবে না, পুব-বাঙলার বিস্তর লোক কলকাতায় আস্তানা গেড়েছেন), ঘি-ভাত, পোলাও। কিছু বাদ পড়ল না তো? ভেবে দেখুন। এ ‘মেনু’ তৈরি করা তো একজনের কর্ম নয়। আমি শুধু একটা পয়লা খসড়া করে দিচ্ছি।

এ-স্থলে আরেকটি তত্ত্ব খুলে কই। রেস্তোরাঁ প্রতিষ্ঠানটি মোটামুটি ইয়োরোপীয়; তাই কোনও কোনও বাবদে আমাদের নকল করতে হবে ইয়োরোপকে– অর্থাৎ প্যারিসকে, কারণ রেস্তোরাঁ-লোকের বৈকুণ্ঠ প্যারিসে। তাই ‘মেনু’ বানাবার পরিচ্ছেদ, অনুচ্ছেদ, পদ ফরাসি কায়দাতেই যুক্তিসম্মত এবং অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ। ফরাসি ‘মেনু’ আরম্ভ হয় হরেক রকম রুটির বর্ণনা দিয়ে (আমিও তাই ভাত-লুচি-পোলাও দিয়ে বিসমিল্লা পড়েছি), তার পর অর দ্য অভ্র, সুপ, ডিম, ফিশ ইত্যাদি ইত্যাদি। অতএব–

২। তেতো :–

উচ্ছেভাজা, করেলাসেদ্ধ, নালতে শাক (ইন সিজন– মৌসুমি কালে)। এইবারে ভাবুন, কিংবা মা-মাসীকে জিগ্যেস করুন, আর কী কী তেতো আছে– আমার দুর্ভাগ্য, যে-অঞ্চলে জন্ম আমার, সেখানে, তেতোটার খোলতাই নেই। পশ্চিমাঞ্চলে স্টাফট–অর্থাৎ মাংসের পুর দেওয়া-করেলা খায়, কিন্তু বিবেচনা করি তার রেওয়াজ বাঙলা দেশে নেই।

৩। ডাল : মুগ, ছোলা, মসুর, কলাই ইত্যাদি। তার পর ডালের সঙ্গে সজনের ডাটা, কেউ বা দু চারটে বড়ি দেয়। অতএব ডালের দু ভাগ– প্লেন এবং মেশানো, যেমন পূর্বেই বলেছি ডাল আ লা ডাঁটা; কিংবা আ লা নারকেল অর্থাৎ ডালে নারকেলের টুকরো থাকবে।

৪। ভাজা : নিয়ে কিন্তু বিপদ। কারণ এতক্ষণ দিব্যি নিরামিষ চলছিল, এখন ভাজা নিরামিষ, আমিষ, ডিম তিন প্রকারই হতে পারে।

অতএব

(ক) আলু, পটল, বেগুন, কুমড়ো…

(খ) ডিমভাজা, মমলেট..

(গ) মাছভাজা (ইলিশ, রুই, পুঁটি, পোনা …)

কাজেই খ এবং গ-কে হয়তো ‘ডিম’ এবং ‘মাছের অনুচ্ছেদ’ পুনরাবৃত্তি করতে হবে। ‘ক্রস রেফেরেন্স’ দিতে পারেন, কিন্তু ভয়, তা হলে ‘মেনু’ হয়তো জর্মন ডক্টরেট থিসিসের প্রকার এবং আকার নিয়ে নেবে। উপস্থিত অবশ্য আমি সেই নিষ্ঠা নিয়েই এই মহামূল্যবান নির্ঘণ্ট নির্মাণের প্রয়াসী হচ্ছি, কিন্তু তৈরি মালে তো ও-জিনিস ওতরালে চলবে না।

৫। ছেচকি ছোঁকা– ছক্ক– চচ্চড়ি–লাবড়া (লাফড়া)।

এইবারে আমার পেটের এলেম বেরিয়ে গেল। এগুলোর মধ্যে একটা আরেকটার সূক্ষ্ম পার্থক্য আমি জানিনে। যদিও খাবার সময় রাঁধুনিকে অপটু ঠাওরালে এ-বিষয়ে উচ্চাঙ্গের বক্তৃতা দিতে কসুর করিনে। আর পাঁচজন কান পেতে শোনে, কারণ তারা জানে আমার চেয়েও কম। দু একবার যে কানমলা খাইনি তাও নয়। সে কথা যাক। এখন প্রশ্ন, এ-অনুচ্ছেদের মূল হেডিং নেবেন কী এবং তার পদ বাতলাবেন কী কী?

করে করে আসবেন, মাছ মাংস– তার কত অনুচ্ছেদ, তস্য ছেদ, পদ, পদ-ভেদ–ডালনা, ঝোল, কালিয়া, মালাই সহযোগে, ডাবের ভিতর, কলাপাতায় পেঁচিয়ে, দমে দিয়ে, সরষে মেখে খোদায় মালুম, কোথায় গিয়ে পৌঁছব।

 তাই আমার প্রস্তাব : একখানা ফুলস্ক্যাপ কাগজ নিন এবং রেস্তোরাঁর মেনুর কায়দায় একখানা বাঙালি মেনু তৈরি করুন দু পাতা জুড়ে, অর্থাৎ ফুলস্ক্যাপ কাগজের ভাজ খুলে যতটা জায়গা পান। এর বেশি কাগজ নিতে পারবেন না, কারণ পূর্বেই বলেছি মেনু থিসিস নয়। আবার শিটখানা যেন টায়-টায় ভর্তি হয়। ফাঁক থাকলে চলবে না। আমি যে পরিচ্ছেদ-অনুচ্ছেদ দিয়ে প্যাটার্ন বাতলালুম সেটা একদম অবজ্ঞা করে আপনি আপন মেনু বানাবেন। কোন জিনিসের কত দাম সেটা আপনি বলতে পারেন, না-ও পারেন। না-বলাই ভালো। কারণ ‘কসটিং’ ব্যাপারটা বড়ই কঠিন। রেস্তোরাঁ-ম্যানেজার অভিজ্ঞতা থেকে সেটা স্থির করবেন।

‘একস্ট্রা’ অনুচ্ছেদটি ভুলবেন না। তাতে থাকবে, কাঁচা লঙ্কা, চাটনি (ধনে, পুদিনা…), আচার (আম, জারক নেবু…) ইত্যাদি এবং কাসুন্দি।

যে-কাসুন্দি নিয়ে আলোচনা আরম্ভ করেছিলুম।

 এইবারে বিবেচনা করুন।