ফরাসি-বাঙলা

ফরাসি-বাঙলা

রবীন্দ্রনাথ নাকি কোনও এক স্থলে খেদ করেছেন আমরা ইয়োরোপের যেটুকু চিনলুম সেটা ইংরেজের মারফতে।

তিনি ঠিক কী বলেছিলেন মনে নেই বলে অপরাধ মেনে নিবেদন করি, ইংরেজ বরঞ্চ চেষ্টা করেছে আমরা যেন ইয়োরোপকে না চিনতে পারি।

ইংরেজ যখন এদেশে রাজত্ব করত তখন দুটি প্রচারকমে মেতে থাকতে সে বড় আনন্দ পেত। তার প্রথম, বিশ্বজনকে জানানো যে, ভারতীয়েরা ড্যাম নিগার, কালা আদমি, তাদের কোনওপ্রকারের কলচর নেই। দ্বিতীয়, ভারতীয়দের জানানো, ইংরেজ পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জাত এবং তাই (আ ফর্তেরিয়রি) ইয়োরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ নেশন তো বটেই। প্রমাণস্বরূপ শেক্সপিয়রের নাম করল।

আমরা তখন আমাদের বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে যাচাই-পরখ করে দেখলুম, কথাটা ঠিক শেক্সপিয়রের মতো কবি পৃথিবীতে কম– নেই বললেও চলে। ইংরেজিতেই পড়লুম, ফরাসি-জর্মন-ওলন্দাজ-দিনেমার সবাই একথা স্বীকার করেছে। তাই আমরা ইংরেজের বাদবাকি দাবিগুলোও সুড়সুড় করে মেনে নিলুম। ঘড়েল মিথ্যে সাক্ষী– কনফিডেন্স ট্রিকস্টার– এইভাবেই সরল জনকে আপন সব পচা মাল পাচার করে দেয়।

ইংরেজ কিন্তু একথা বলতে ভুলে গেল, উপন্যাসে তার টলস্টয় নেই, গল্পে তার মপাসাঁ নেই, চিত্রকলায় তার রাফায়েল নেই, ভাস্কর্যে তার মাইকেল এঞ্জেলো নেই, দর্শনে কান্ট নেই, নৃত্যে পাভলোভা নেই, ধর্মে লুথার নেই, সঙ্গীতে বেটোফেন নেই।

বিশেষ করে বেটোফেনের কথাই তুললুম।

ইংরেজ জাত সুর-কানা। তাই সে বেটোফেনের নাম করে না। তাই ইংরেজের বাড়িতে সঙ্গীত-চর্চা নেই। যদি থাকত তবে এ দেশের বড় সায়েবদের বাড়িতেও সে চর্চা আসন পেত। আমরাও ইয়োরোপীয় সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিত হতুম। ইংরেজ চর্চা করল এবং আমাদের শেখাল– জ্যাজু, যেটা তার খুড়তুতো ভাই মার্কিন শিখল তাদের গোলাম নিগ্রোদের কাছ থেকে।

অতি অবশ্য আমাদেরও দোষ আছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা হাজারে হাজারে ফ্রান্স-জর্মনি-ইতালি-রুশে যায়নি বটে, কিন্তু শতে শতে তো গিয়েছে। তাদের মধ্যে যে ক জন ইয়োরোপের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন তাঁদের সংখ্যা এক হাতের এক আঙুলে গোনা যায় (এবং আশ্চর্য, যে মহাজন আমাদের সঙ্গে ফরাসি সাহিত্যের ঘনিষ্ঠতম পরিচয় ঘটিয়ে দিলেন তিনি কখনও ফ্রান্সে যাননি তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর)।

‘দেশ’ পত্রিকার এ সংখ্যা ফরাসিস সাহিত্য নিয়ে। অতএব সেই বিষয়বস্তুর ভিতরেই নিজেকে সীমাবদ্ধ করি।

ইংরেজি ভাষা গম্ভীর এবং জটিল কিন্তু তার প্রসাদগুণও আছে। ফরাসি চটুল ও রঙিন। অতিশয় গম্ভীর বিষয় আলোচনা করার সময়ও ফরাসি কেমন যেন একটুখানি তরল থেকে যায়। পক্ষান্তরে রসিকতা করার সময়ও ইংরেজি তার দার্চ সম্পূর্ণ বর্জন করতে পারে না। চার্লস ল্যাম, এমনকি জেরম্ কে জেরম্ পর্যন্ত যে ভাষা ব্যবহার করেছেন সেটা ধ্রুপদ। উড়হাউসে এসে আমরা সর্বপ্রথম চটুলতা পাই।

কিন্তু এই বাহ্য। ফরাসি ভাষার সর্বপ্রধান গুণ তার স্বচ্ছতা, তার সরলতা। ফরাসিরা নিজেই বলেন, ‘যে বস্তু স্বচ্ছ (ক্ল্যার, ক্লিয়ার) নয় সে জিনিস ফরাসি নয়।’ আমাদের দেশে আজকাল যে দুর্বোধ্য অবোধ্য পদ্য বেরোয় সে ‘মাল’ প্রথম যখন ফ্রান্সে বেরুতে আরম্ভ করল তখন গুণী আনাতোল ফ্ৰাস বলেছিলেন, ‘সে মধুর ললিত বয়সে মানুষ অবোধ জিনিস ভালোবাসে আমার সে বয়স পেরিয়ে গিয়েছে; আমি আলো ভালোবাসি।’ তাই আরেক গুণী শেষ কথা বলেছেন, ‘স্বচ্ছতা, স্বচ্ছতা পুনরপি স্বচ্ছতা।’

ফরাসি চটুলতা হয়তো অনেকেই অপছন্দ করতে পারেন কিন্তু ফরাসি স্বচ্ছতা বাঙলা ভাষা এবং সাহিত্যে যদি আসত তবে আর কিছু না হোক, আমাদের মনন-সাহিত্য যে অনেকখানি লোকপ্রিয় হত সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। শ্ৰীযুত সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যদি আরও একটুখানি ফরাসি আওতায় আসতেন তবেই ঠিক বোঝা যেত তাঁর দেবার মতো সত্যিই কিছু ছিল কি না। এ বিষয়ে বরঞ্চ বলব, শ্ৰীযুত অন্নদাশঙ্করের লেখা অনেকখানি ফরাসিস।

শব্দতত্ত্ব এবং ভাষাতাত্ত্বিকেরা ঠিক ঠিক বলতে পারবেন কিন্তু সাধারণ পাঠক হিসেবে আমার নিবেদন, বাঙলা ভাষার ওপর ফরাসি ভাষার (Language) প্রায় কোনও প্রভাবই পড়েনি। বাঙলাতে কটি ফরাসি শব্দ ঢুকেছে সেকথা প্রায় আঙুলে গুনেই বলা যায়। অবশ্য এইটেই শেষ যুক্তি নয়; আমরা বাঙলাতে প্রচুর আরবি এবং ফারসি শব্দ নিয়েছি বটে কিন্তু ওই দুই ভাষার প্রভাব আমাদের ওপরে প্রায় নেই। কিন্তু অন্য কোনও বাবদেও ফরাসি ভাষার প্রভাব বাঙলার ওপর আমি বড় একটা পাইনি।

সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমার ব্যক্তিগত দৃঢ়বিশ্বাস ইনি ফরাসি সাহিত্যের যতখানি চর্চা করেছেন ততখানি চর্চা বাঙলা দেশে তো কেউ করেনইনি, অল্প ইংরেজ জর্মন ইতালীয়ই– অর্থাৎ অফরাসিস–করেছে। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাট্য, কবিতা, ভ্রমণ-কাহিনী, কত বিচিত্র বস্তুই তিনি ফরাসি থেকে অনুবাদ করে বাংলায় প্রচার করেছেন। এই যে ইংরেজি এবং ফরাসি পাশাপাশি জাতের ভাষা– সেই ইংরেজিতেই পিয়ের লোতির লেখা ‘ভারত ভ্রমণ’ অনুবাদ করতে গিয়ে ইংরেজ অনুবাদক হিমশিম খেয়ে গিয়েছেন অথচ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অনুবাদে মূল ফরাসি যে ঠিক ঠিক ধরা পড়েছে তাই নয়, প্রাচ্যদেশীয় আবহাওয়াও সম্পূর্ণ বজায় রয়েছে।

এই জ্যোতিরিন্দ্রের বাঙলা ভাষাতেই ফরাসি ভাষার কোনও প্রভাব দেখতে পাওয়া যায় না।

***

বরঞ্চ ফরাসি শৈলীর (style) প্রভাব বেশ কিছুটা আছে।

বাঙলা সাহিত্যের ঐতিহাসিকরা পাকাপাকিভাবে বলতে পারবেন, বাঙলার কোন লেখক সর্বপ্রথম ফরাসির সঙ্গে বাঙলার যোগসূত্র স্থাপন করেছিলেন; আমি শুধু সার্থক সাহিত্যিকদের কয়েকজনের কথাই তুলব।

মাইকেলের সার্থক সৃষ্টিমাত্রই গম্ভীর– সংস্কৃত এবং লাতিনের ক্লাসিকাল গুণের সঙ্গে তিনি তাঁর বীণার তার বেঁধে নিয়েছিলেন। ওদিকে তিনি আবার অতি উত্তম ফরাসি জানতেন নতুন ভাষা তিনি যে কত তাড়াতাড়ি শিখতে পারতেন, সেকথা আজকের দিনের ভাষার ব্যবসায়ীরা কিছুতেই বিশ্বাস করবেন না কিন্তু সে ‘রঙিলা ঘরানা’ তাঁর ভাষার ওপর কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি।(১) তাই কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনে তিনি লা ফঁতেনের ধরনে ‘ফাবল’ (ফেবল) রচনা করলেন কেন? লা ফঁতেন তাঁর অনেক গল্প নিয়েছেন ঈশপের গম্ভীর গ্রিক থেকে, কিন্তু লিখছেন অতি চটুল ফরাসি কায়দায়। অথচ তাঁরই অনুকরণে যখন মাইকেল বাঙলাতে ‘ফাবল’ রচনা করেছেন তখন তিনি গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলছেন,

‘রসাল কহিল উচ্চে স্বর্ণলতিকারে–’

 দুই সুর একেবারে ভিন্ন। অথচ মাইকেলের প্রায় সবকটি ‘ফাবলে’র উৎস লা ফঁতেন।

প্রহসনেও তাই। বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ-র মূলে মলিয়ের। অথচ শৈলীতে গম্ভীর।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা পূর্বেই নিবেদন করেছি। যদিও তার আপন ভাষাতে ফরাসি প্রভাব নেই তবু তিনি অনুবাদের মারফতে যে শৈলী এবং বিষয়বস্তুর অবতারণা করে গেলেন তার প্রভাব বাঙলা সাহিত্যের দূর-দূরান্ত কোণে পৌঁছে গিয়েছে এবং আরও বহুদিন ধরে পৌঁছবে।

তোয়েফিল-গতিয়ে, এমনকি বাজাও মপাসাঁ’র পূর্বে কয়েকটি সার্থক ছোটগল্প লিখেছেন কিন্তু আজ শুধু ফরাসিস না, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড স্বীকার করে, মোসই ছোটগল্পের আবিষ্কর্তা। তিনিই প্রথম দেখিয়ে দিলেন, দীর্ঘ উপন্যাস না লিখেও পাঠককে কী প্রকারে কাহিনী-রসে আপুত করা যায় (‘কণ্ঠহার’ গল্প নিয়ে সাত-ভলুমি ‘জাঁ ক্ৰিস্তফ’ লেখা যায়)। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জন্য ডসতেয়ফকির মতো ভলুম না লিখেও ‘সূত্ররূপে’ সেই রস পাঠকের মনে সঞ্চারিত করা যায়।

আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস ছোটগল্প লেখক রবীন্দ্রনাথ যবে থেকে জ্যোতিরিন্দ্র ঠাকুরের মারফতে মপাসাঁকে চিনতে শিখলেন তবে থেকেই তাঁর গল্প ঋজু কাঠামো নিয়ে সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে আত্মপ্রকাশ পেল (অবশ্য প্রথম থেকেই তাঁর গল্পে থাকত প্রচুর গীতরস) এবং পরবর্তী যুগে তিনি অন্য এক মিসটিক নবরসে ছোটগল্পকে এক নবরূপ দান করেন।

***

দান্তে, শেক্সপিয়র, গ্যোটে, কালিদাস কেউই পৃথিবীর সুদূরতম সাহিত্যকে এতখানি প্রভাবান্বিত করতে পারেননি মপাসাঁ যতখানি করেছেন। এটম বম্ হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার কিন্তু বাইসি ও সেলাইয়ের কল যেরকম গ্রামে গ্রামে পৌঁছেছে এটম বম্। শেক্সপিয়র সেরকম সাহিত্যে সাহিত্যে নব নব সৃষ্টির অনুপ্রেরণা দিতে পারেননি।(২)

অথচ আজও যখন কোনও মানুষের জীবনের কোনও এক অদ্ভুত বিচিত্র অভিজ্ঞতা আসে সে তখন তার প্রকাশ দেবার চেষ্টা করে ছোটগল্পের মাধ্যমে, অর্থাৎ মপাসাঁ’র কাঠামো নিয়ে। ইংরেজ, জর্মন, রুশ, বাঙলা এসব অর্বাচীন সাহিত্যের কথা বাদ দিন, অতিশয় প্রাচীন চীন-আরবির মতো ক্লাসিকাল সাহিত্যেও আজকের দিনে মপাসাঁ ছোটগল্পে আদি গল্পগুরু বাল্মীকি। সবাই তারই রাজেন্দ্র সঙ্গমে, দীন যথা যায় দূর তীর্থ দরশনে।

***

বাংলা সাহিত্যে মপাসাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ শিষ্য প্রভাত মুখোপাধ্যায়। তিনি ফরাসি জানতেন কি শৈলী-আলোচনায় সে প্রসঙ্গ অবান্তর। তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তস্য শিষ্য রবীন্দ্রনাথ পড়েছিলেন এবং এদের মাধ্যমে মপাসাঁ’র শরণ নিয়েছিলেন। বাঙলা দেশের কোনও গল্পলেখকই প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের মতো মপাসাঁ’র এত কাছে আসতে পারেনি। মপাসাঁ’র মতো প্রভাতের ছিল সমাজের নানা শ্রেণি, নানা চরিত্র, নানা পরিস্থিতি নিয়ে নবীন নবীন গল্প গড়ে তোলার অসীম ক্ষমতা। মপাসাঁ’র মতো তিনিও কয়েকখানি উপন্যাস লিখেছিলেন। সেখানেও দু জনের আশ্চর্য মিল। ঔপন্যাসিক রূপে মোস ফ্রান্সে বিশেষ কোনও সম্মান পাননি; বাঙলা দেশে প্রভাত মুখোপাধ্যায়েরও সেই অবস্থা।

এ প্রসঙ্গে সর্বশেষ নিবেদন, প্রভাত-পরবর্তী যুগের প্রায় সব বাঙালি গল্প-লেখকই মপাসাঁ’র অনুকরণ করেছেন প্রভাতের মাধ্যমে।

***

এই সময়ে ‘ভারতী’কে কেন্দ্র করে শক্তিশালী এক নতুন কথাসাহিত্যিক গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়। এ গোষ্ঠী অহরহ অনুপ্রেরণা পেত জ্যোতিরিন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। এঁদের ভিতর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সত্যেন্দ্র দত্ত, চারু বন্দ্যোপাধ্যায়, মণি গাঙ্গুলী ও সৌরীন্দ্র মুখোপাধ্যায়। এঁরা প্রধানত ফরাসি সাহিত্য থেকে অনুপ্রেরণা সঞ্চয় করে বাঙলা দেশে এক নতুন ফরাসিস ‘গুলস্তান’ বানাতে আরম্ভ করলেন। এঁদের একটা মস্ত সুবিধে ছিল এই যে, এঁরা রবীন্দ্রনাথের গড়া আধুনিকতম বাঙলার সম্পূর্ণ ব্যবহার করবার সুযোগ পেয়েছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সে সুযোগ পাননি বলে তাঁর ভাষা ছিল বিদ্যাসাগরী। এঁরা রবীন্দ্রনাথের সাবলীল ভাষা ব্যবহার করাতে তখনকার দিনের বাঙালি পাঠকের মর্মদ্বারে দরদী আঘাত হানতে পেরেছিলেন।

সবচেয়ে ‘তাজ্জব ভেল্কিবাজি’ দেখালেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। তা-ও আবার কাব্যে। এক ভাষার কবিতা যে অন্য ভাষাতে তার আপন রূপরসগন্ধস্পর্শ নিয়ে এরকমভাবে প্রকাশ পেতে পারে এর কল্পনাও বাঙালি পাঠক এর পূর্বে কখনও করতে পারেনি। সত্যেন্দ্রনাথের পূর্বে কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, হেম বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, এমনকি রবীন্দ্রনাথও বিদেশি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন কিন্তু এক ‘সম্ভাবশতক’ ছাড়া অন্য কোনও বই জনপ্রিয় হতে পারেনি। স্বামী বিবেকানন্দ নাকি বলেছেন, অনুবাদ মাত্রই কাশ্মিরি শালের উল্টোদিকের মতো; মূল নকশার সন্ধান হাতে পাওয়া যায় বটে, কিন্তু আর সব সৌন্দর্য উল্টো পিঠে ওতরায় না। সত্যেন্দ্রনাথ দেখিয়ে দিলেন, ওতরায়, এবং মাঝে মাঝে উল্টোদিকটাও মূলের চেয়ে বেশি মূল্য ধরতে জানে।

যাঁরা সত্যেন্দ্র দত্তের অনুবাদ মূলের সঙ্গে মিলিয়ে পড়েছেন তাঁরাই আমার কথায় সায় দেবেন। অন্যতম বিখ্যাত অনুবাদক কান্তি ঘোষ বহুবার একথা বলেছেন। তিনি নেই। তাই আজকের দিনের সবেধন নীলমণি নরেন্দ্র দেবকে আমি সাক্ষী মানছি।

তোয়েফিল গতিয়ে, রঁসার ল্যকঁৎ দ্য লিল, ভেরলেন, বদলের, য়ুগো (Hugo), শেনিয়ে, মিস্ত্রাল, ভেরেরেন, ভালমোর, বেরাজেঁ–কত বলব?–কত না জানা-অজানা কবির কত না কবিতা দিয়ে তিনি তাঁর কুম্ভ ‘তীর্থ সলিল’ পূর্ণ করলেন, কত দেশের কত ‘তীর্থরেণু’ বাঙালির কপালে ছুঁইয়ে দিলেন।

ঋগ্বেদে আছে, হে অগ্নি, তুমি আমাদের পুরোহিত, কারণ তুমি আমাদের সর্ব আহুতি দেবতাদের কাছে নিয়ে যাও। সত্যেন্দ্রনাথ বহু দেশের বহু কবির পুরোহিত।

***

কথাসাহিত্যেও ওই সময়ে প্রচুর ফসল ফলল। গতিয়ে, য়্যুগো, মেরিমে, দোদে, মপাসাঁ, দ্যুমা, বালজাক ইত্যাদি বহু লেখকের বহু ছোটগল্প এবং উপন্যাসও বাঙলায় অনূদিত হল। এ গোষ্ঠীর কার্যকলাপ বাঙলা সাহিত্যে কতখানি স্থায়ী মূল্য ধরে তার বিচার একদিন হবে; উপস্থিত বলতে পারি এঁরা বাঙলা সাহিত্যে যে ফরাসি উদারতার আমন্ত্রণ জানালেন তার ফলে পরবর্তী যুগের বাঙালি লেখক গোড়ার থেকেই সঙ্কীর্ণতামুক্ত হয়ে সাহিত্যের আরাধনা করতে পেরেছিলেন। হঠাৎ একদিন বাঙলা সাহিত্যে শরৎচন্দ্রের আবির্ভাবের ফলে এঁদের লোকপ্রিয়তা ক্রমে ক্রমে কমে গিয়ে একদিন সম্পূর্ণ লোপ পায়। কিন্তু শরতের মোহ কেটে যাওয়ার পর আজ পর্যন্ত কেন যে কেউ এঁদের হেমন্তের সফলতা সন্ধান করে না সে এক আশ্চর্যের বস্তু।

***

বাঙলায় ফরাসি সাহিত্য প্রসঙ্গে শুধু প্রমথ চৌধুরী সম্বন্ধে পূর্ণাঙ্গ একটি প্রবন্ধ লিখতে হয়। ইনিই একমাত্র বাঙালি সাহিত্যিক যাঁকে সর্বার্থে ফরাসিস আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। একমাত্র এরই ভাষাটিতে ইভনিং ইন প্যারিসের খুশবাই পাওয়া যায়। এঁর শৈলী ফরাসি শ্যাম্পেনের মতো বুদ্বুদিত, ফেনায়িত। এমনকি এর বিষয়বস্তুও মাঝে মাঝে ফরেসডাঙার ধুতি পরে মজলিসে এসে বসে। বাংলা সাহিত্যে বহু পণ্ডিত, বহু দার্শনিক, বহু কলাবিদ এসেছেন, কিন্তু একমাত্র এঁকেই সত্য বিদগ্ধজন বলা যেতে পারে। এবং সে বৈদগ্ধ্য ফরাসি বৈদগ্ধ্য।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ফরাসিদের সঙ্গে বাঙালির চারি চক্ষের মিলন ঘটিয়েছিলেন; প্রমথনাথে দুই সাহিত্যের গভীরতম প্রণয়ালিঙ্গন।

এঁর সাহিত্যসৃষ্টি হয়তো বাঙলা দেশ একদিন ভুলে যাবে কিন্তু এই বাঙালি ফরাসিস চরিত্রকে বাঙালি কখনও ভুলবে না।

প্রমথনাথের শেষ বয়সে ভারতীয় গোষ্ঠীর মুমূর্ষ অবস্থায় রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে ফরাসি পণ্ডিত সিলভা লেভি এদেশে আসেন। তাঁর চতুর্দিকে তখন এক ফরাসি পণ্ডিতমণ্ডলীর সৃষ্টি হয়। এঁদের প্রধান ফণী বোস(৩), প্রবোধ বাগচী, মণি গুপ্ত, শশধর সিংহ, বিধুশেখর ভট্টাচার্য, ক্ষিতিমোহন সেন। এঁদের কেউই প্রচলিতাৰ্থে সাহিত্যে নামেননি কিন্তু এঁদের মাধ্যমে আমরা এদেশে সর্বপ্রথম ফরাসি পাণ্ডিত্যের সন্ধান পাই। এতদিন আমরা জানতুম, ইয়োরোপীয় ‘প্রাচ্য-বিদ্যামহার্ণব’ বলতে বোঝায় ইংরেজ। এরা প্রথম দেখিয়ে দিলেন, ফরাসি ভারতবর্ষে ব্যাপকভাবে রাজত্ব না করেও ভারতীয় শাস্ত্রের চর্চা করেছে প্রচুর।(৪) বিশেষ করে আমাদের চিত্রকলা সঙ্গীতাদি। প্রবন্ধের গোড়ার দিকেই বলেছি সাহিত্য ছাড়া অন্য রসে ইংরেজ বঞ্চিত। ফরাসিরা সেখানে যথার্থ গুণী। মণি গুপ্তের অনুবাদে বাঙালি তার সন্ধান পাবে। শান্তা দেবী এই সময়েই বিশ্বভারতীতে ফরাসি শেখেন।

এই গোষ্ঠীর বাইরে আর দু জন পণ্ডিতের নাম করতে হয়। মুহম্মদ শহীদুল্লা এবং সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। দিলীপ রায় আর কালিদাস নাগও এই যুগের লোক।

***

কিন্তু আমাদের জোড়া কুতুব-মিনার? বঙ্কিম এবং রবীন্দ্রনাথ? তা হলে দীর্ঘতম প্রবন্ধ লিখতে হয়। এ যুগের ঋষি দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, imitation-এর বাঙলা অনুকরণ; aping-এর বাংলা কী? ‘হনুকরণ’! যাঁরা ফরাসির ‘হনুকরণ’ করেন তাঁদের উল্লেখ আমি এ প্রবন্ধে করিনি। পদস্খলন সকলেরই হয়। পূর্বোল্লিখিত লেখকদের কেউ কেউ হয়তো অজানাতে মাত্রাধিক্য করেছেন কিন্তু এ দুটি লোক সম্বন্ধে অধম নিঃসংশয়।

বঙ্কিম কিঞ্চিৎ ফরাসিস জানতেন। কিন্তু তিনি ইংরেজির মাধ্যমে কঁৎ-কে চিবিয়ে খেয়েছিলেন। পূর্বসূরিগণের প্রসাদাৎ কঁৎ ফরাসি তর্কালোচনায় যে শুভবুদ্ধির (rationality-র) চরমে পৌঁছেন, বঙ্কিম সেই শাণিত অস্ত্র নিয়ে হিন্দুধর্ম রণাঙ্গনে প্রবেশ করেন। এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে তার সবিস্তর আলোচনা অসম্ভব। তাই এই আক্ষেপ দিয়েই বঙ্কিমালোচনা শেষ করি, হায়, তাঁর এই শুভবুদ্ধির অনুসরণ আর কেউ করল না কেন? যে লোক ইস্তেক দয়াসাগরের খেলাফে তলোয়ার খাড়া করেছিল তার অনুকরণ অনুসরণ, এমনকি ‘হনুকরণ’ও কেউ করল না কেন?

রবীন্দ্রনাথের ওপর মপাসাঁর ছায়া পড়েছিল সেকথা পূর্বেই বলেছি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সহকর্মীরূপে তিনি ফরাসি কবিতানাট্য এমনকি ‘শারাদ’-ও পড়েছিলেন। তারই ফলে–

Celui qui me lira, dans les
siecle, un soir,
Troublant mes vers

ইত্যাদি ইংরেজিতে শব্দে শব্দে অনুবাদ :

One who will read me, after centuries, one evening, turning over my verses

‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’ হয়ে বেরুল। কিন্তু প্রথম কয়েক ছত্রের পরেই রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে চলে গিয়েছেন।

ঠিক সেই সময় মেটারলিঙ্কের ‘নীলপাখি’ যে কাঠামোতে(৫) লেখা রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’, ‘অরূপরতন’ সেই কাঠামো নিয়ে, কিন্তু উভয় নাটকের বিষয়বস্তু নির্বাচনে এবং রসনির্মাণে রবীন্দ্রনাথ মেটারলিঙ্ককে অনেক পিছনে ফেলে গিয়েছেন। এবং সর্বশেষ নাটকদ্বয় ‘মুক্তধারা’ এবং ‘রক্তকরবী’-র কাঠামোও রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ নিজস্ব ভাষা, শৈলী, রসনির্মাণ পদ্ধতি রাবীন্দ্রিক তো বটেই।

আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, অরবিন্দ ঘোষ (ইনি উত্তম ফরাসি জানতেন)– এঁদের মতো প্রতিভাবান লেখকের রচনাতে এর প্রভাব, ওঁর ছায়াপাতের অনুসন্ধান করে কোনও লাভ নেই। হীনপ্রাণ লেখক সর্বক্ষণ ভয়ে মরে, ওই বুঝি লোকে ধরে ফেলল, সে অমুকের কাছ থেকে ধার নিয়েছে; তাই সে মহাজনদের বাড়ির ছায়া মাড়ায় না। বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ নিজেরাই এত বড় মহাজন যে, তারা যত্রতত্র অনায়াসে বিচরণ করেন। ক্ষুদ্রতম লেখকের বাড়িতেও পাত ফেলতে তাদের কণামাত্র ভয় নেই। তাদের ঘানিতে যাই ফেল না কেন, স্নেহঘন হয়ে বেরিয়ে আসবে।

এইবারে শেষ প্রশ্ন : ফরাসির ওপর বাঙলা কোনও প্রভাব ফেলতে পেরেছে কি?

রলাঁ যেরকম বহু বাঙালি লেখককে প্রভাবান্বিত করেছেন, ঠিক তেমনি, তিনিও বাঙালি গুণী-জ্ঞানীদের সন্ধান রাখতেন। ব্রাহ্ম আন্দোলন, শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে তার জ্ঞান এবং এঁদের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। বহু ফরাসি এঁরই মারফতে বাঙলা দেশের অনেক কিছু চিনতে শিখেছে।

পূর্বেই বলেছি, লেভির সঙ্গ পেয়ে বাঙালি গুণী ফরাসি পাণ্ডিত্যের চর্চা করেছিল। লেভি নিজে করলেন উল্টোটা। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গ পেয়ে তাঁর সাহায্যে করলেন ‘বলাকা’র ফরাসি অনুবাদ। আজ যদি শুনি, পাণিনি কোনও এক চীনা কবির রচনা সংস্কৃতে অনুবাদ করেছিলেন তা হলে যেরকম আশ্চর্য হব।

শ্রীমতী আঁদ্রে কারপেলেজ ফরাসিতে একখানা সঞ্চয়িতা বের করেন। তার নাম ‘ফ্যই দ্যা ল্যাঁদ’—’লিভজ অব ইন্ডিয়া’। এই চয়নিকায় বাঙালি ও বাঙলা সাহিত্য নিয়েই আলোচনা ছিল প্রধানত। দুর্ভাগ্যক্রমে বইখানা আমার হাতের কাছে নেই।

এবং নেই, শান্তিনিকেতনে ফরাসি ভাষার প্রাক্তন অধ্যাপক ফের্না বেনওয়ার রচনাবলি। অমিয় চক্রবর্তীর সহযোগিতায় তিনি ‘মুক্তধারা’র ফরাসি অনুবাদ প্রকাশ করেছিলেন ‘লা মাশিন’ (দি মেশিন) নাম দিয়ে। এর পরবর্তী যুগে বাঙলা সম্বন্ধে আরও বিস্তর লেখা ফরাসিতে প্রকাশ ও প্রচার করেছিলেন।

এবং মারাত্মক নেই, রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে ফরাসি প্রেসের অভিমত, অভ্যর্থনা, অকুণ্ঠ প্রশংসা। রবীন্দ্রনাথ যতবার ফ্রান্সে গিয়েছেন, যখনই তার চিত্রকলার প্রদর্শনী হয়েছে, ফ্রান্স তখনই বাঙলা দেশ সম্বন্ধে সচেতন হয়ে তাঁকে স্বীকার করেছে। প্যারিসে স্বীকৃতি পাওয়া সহজ কর্ম নয়– এসব প্রেস-কাটিংস্ অনুসন্ধিৎসু পাঠক শান্তিনিকেতন লাইব্রেরিতে পাবেন। সে এক বিরাট ব্যাপার!

অর্থাৎ হাতের কাছে কিছুই নেই– ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই’—

তাই আর কেউ বলার পূর্বেই স্বীকার করে নিই, এ লেখা সম্পূর্ণ অসম্পূর্ণ।

————

১. বরঞ্চ গৌর বসাককে লেখা চিঠিগুলোতে প্রচুর ফরাসি ফ্রিভলিটি পাবেন।

২, হেমচন্দ্র বিস্তর শেক্সপিয়র অনুবাদ করেছিলেন, কিন্তু বাঙলাতে আজ পর্যন্ত কেউ শেক্সপিয়রের অনুকরণ করেননি।

৩. ইনি যৌবনেই দেহত্যাগ করেন, কিন্তু এঁর রচনা তখনই বাঙালির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।

৪. পরবর্তী যুগে ভিটারনিৎস জর্মন পাণ্ডিত্যের সঙ্গে এবং তুচ্চি ইতালির পাণ্ডিত্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটান। এঁদের সবাই এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে, বিশ্বভারতীতে।

৫. ‘লোয়াজো ব্ল্য’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বাঙলায় অনুবাদ করেন।