কোনও গুণ নেই তার–

কোনও গুণ নেই তার–

বেহারি ভাইয়ারা (সদর্থে) বাংলা ভাষা এবং বাঙালির ওপর খড়গহস্ত হয়েছেন শুনে বহু বাঙালি বিচলিত হয়েছেন। বাঙালির প্রতি অন্যান্য প্রদেশের মনোভাব যদি বাঙালিরা সবিস্তর জানতে পান তবে আরও বিচলিত হবেন– কিন্তু সৌভাগ্য বলুন আর দুর্ভাগ্যই বলুন, বাংলা দেশের লোক মারাঠি-গুজরাতি ভাষা নিয়ে অত্যধিক ঘাটাঘাটি করে না বলেই খবর পায় না। তাবৎ মারাঠি-হিন্দি-গুজরাতি আমাদের প্রতি অশ্রদ্ধা পোষণ করেন একথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু উত্তর-ভারতবর্ষের সর্বত্রই যে ঈষৎ বাঙালি-বিদ্বেষ বর্তমান আছে সেকথা অস্বীকার করবার যো নেই।

কিন্তু বিচলিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। তবে বাংলা ভাষা তথা বাঙালি বৈদগ্ধ্য সম্বন্ধে অন্যান্য প্রদেশ কেন যে ঈর্ষাপরায়ণ সে তত্ত্বের অনুসন্ধান করিলে আমরা তাদের অনেকখানি ক্ষমা করতে পারব। ক্ষমা মহত্ত্বের লক্ষণ তো বটেই, তদুপরি আমরা যখন সর্বপ্রদেশের মধ্যে প্রীতি এবং সৌহার্দ্য কামনা করি, তখন এ বিষয়ে আমাদেরই সকলের চেয়ে বেশি সচেতন হওয়া উচিত। আপন প্রদেশ সম্বন্ধে আমরাই যেমন সর্বপ্রথম গর্ব অনুভব করে ‘সপ্তকোটি কণ্ঠে’ উল্লাসধ্বনি করে উঠেছিলুম, ঠিক তেমনি আমরাই সর্বপ্রথম ক্ষুদ্র প্রাদেশিকতা বর্জন করে পাঞ্জাব-সিন্ধু-গুজরাট-মারাঠা-দ্রাবিড়-উৎকল-বঙ্গের ভিতর দিয়ে ভারতভাগ্যবিধাতার রূপ দেখতে চেয়েছিলুম। আজ না হয় বাংলা দেশ সর্বজনমান্য নেতার অভাবে অনাদৃত, আজ না হয় কেন্দ্রে আমরা চক্রবর্তী নেই, তাই বলে বাংলা দেশ আরও বহুকাল যে এরকম ধারা সর্বজ্ঞশালার প্রান্তভূমিতে অনাদৃত থাকবে ও কথা বিশ্বাস করার চেয়ে আত্মহত্যা বহুগুণে শ্লাঘানীয়। তাই প্রাদেশিক ক্ষুদ্রতা দূর করার কর্তব্য আমাদেরই স্কন্ধে।

অবাঙালিরা যে বাঙালির দিকে বক্রদৃষ্টিতে তাকান তার প্রধান কারণ এই নয় যে বাঙালি যেখানে যায় সেখানকার হনুমানজি, রণছোড়জি (আসলে ঋণ ছোড়জি অর্থাৎ যিনি মানুষকে সর্বপ্রকার ঋণমুক্ত করিতে সাহায্য করেন) বা অম্বামাতার সেবা না করে কালীবাড়ি স্থাপনা করে কিংবা বিদ্যার্জন করবার জন্য গণপতিকে পুজো না করে সরস্বতাঁকে আহ্বান করে– কারণ সকলেই জানেন এ বাবদে তাবৎ ভারতবাসী একই গড্ডালিকার তাঁবেতে পড়েন। খুলে বলি।

বেদের ইন্দ্র, বরুণ, যম, প্রজাপতিকে দৈনন্দিন ধর্মজীবন থেকে বাদ দিয়ে শুধু বাঙালিই যে ব্রাত্য হয়ে গিয়েছে তা নয়, ভারতবর্ষের কোনওখানেই এদের জন্য আজ আর কোনও মন্দির নির্মিত হয় না। শিব আর বিষ্ণু কী করে যে এঁদের জায়গা দখল করে নিলেন সে আলোচনা উপস্থিত নিষ্প্রয়োজন– অথচ বেদে এদের অনুসন্ধান করতে হয় মাইক্রোস্কোপ দিয়ে– এমনকি বাঙালি যেমন সামাজিক ধর্মচর্চায় মা কালীকে ডাকাডাকি করে, উত্তর ভারতে তেমনি হনুমানজি, গুজরাতে রণছোড়জি, মহারাষ্ট্রে অমাতা।

বেদনাটা সেখানে নয়। বাঙালির পয়লা নম্বরের ‘দোষ’ সে মাছ-মাংস খায়! কি উত্তর, কি দক্ষিণ– সর্বত্রই ব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য উচ্চ শ্রেণির হিন্দুরা মাছ-মাংস খান না এবং উভয় বস্তুর খাদককে ঘৃণার চক্ষে দেখেন। মহারাষ্ট্রের সারস্বত ব্রাহ্মণগণ মাছ খান (এঁদের এক শাখার নাম গৌড়ীয় সারস্বত ও কিম্বদন্তি এই যে, তারা আসলে বাঙালি), তাই সেখানকার চিৎপাবন, দেশস্থ এবং করাড় ব্রাহ্মণগণ, সারস্বতদের অবজ্ঞার চোখে দেখেন– যেন মাছ খেয়ে সারস্বত ব্রাহ্মণরা হিন্দু সমাজ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছেন। এই খাওয়াটা দোষ না গুণ সে আলোচনা পণ্ডিত এবং বৈদ্যরাজ করবেন; উপস্থিত আমার বক্তব্য এই যে, মাছ-মাংস খায় বলেই বাঙালি সনাতন হিন্দুধর্মের কাছাকাছি থাকতে পেরেছে। নিরামিষে আসক্তি জৈন ধর্মের লক্ষণ– কারণ বৌদ্ধ গৃহীরা পর্যন্ত মাছ-মাংস খান এবং নিমন্ত্রিত শ্ৰমণও উভয় বস্তু প্রত্যখ্যান করেন না। জৈনদের প্রতি আমাদের ব্যক্তিগত বিদ্বেষ নেই ও ‘হস্তিনাং তাডৎমান পিণ গচ্ছেৎ জৈন মন্দিরম’ উপদেশটি অবাঙালিই দিয়েছেন। রাজপুতরা মাছ-মাংস খান, তাই বোধ করি মীরাবাঈ গেয়েছেন–

ফলমূল খেয়ে হরি যদি মেলে
তবে হরি হরিণের।

কাজেই মাছ-মাংস খাওয়ার জন্যে যদি বাঙালি অন্যান্য প্রদেশের বিরাগভাজন হয় তাতে শোক করবার কিছুই নেই। তার অর্থ শুধু এই যে, বাঙালি ভারতব্যাপী জৈন প্রভাবের ফলে সনাতন ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়নি।

আমাদের দুই নম্বরের দোষ আমরা পরীক্ষা, আত্মা ইত্যাদি শব্দ সংস্কৃত কায়দায় পরীক্ষা আমা উচ্চারণ করি না। সংস্কৃত ভাষা পড়বার সময় এসব শব্দ কীভাবে উচ্চারণ করতে হবে সে আলোচনা পরে হবে, উপস্থিত দ্রষ্টব্য আমরা কেন বাঙলায় এসব শব্দ বাংলা কায়দায় উচ্চারণ করি।

এর উত্তরে প্রথমেই বলতে হয়, হিন্দি-গুজরাতি-মারাঠিরাও করেন। সাধারণ হিন্দি বলার সময় সবাই ক্ষত্রিয়কে শত্রিয় বলে, লক্ষ্মণঝোলাকে লছমনঝোলাই বলে থাকেন। অর্থাৎ যে ধ্বনি পরিবর্তনের ফলে বাঙলা দেশ থেকে সংস্কৃত উচ্চারণ লোপ পায়, সেই ধ্বনি পরিবর্তন অন্যান্য প্রদেশেও ঘটেছিল– যার ফলে লক্ষ্মণ লছমন হয়ে যান। পরবর্তী যুগে দেশজ হিন্দি, বাংলা, গুজরাতির ওপর যখন সংস্কৃত তার আধিপত্য চালাতে গেল তখন আর সব প্রদেশ সে আধিপত্য মেনে নিল, কিন্তু বাংলা স্বীকার করল না। বাঙালি তখন সেই ধ্বনিপরিবর্তনের আইন মেনে নিয়ে সংস্কৃত শব্দও বাংলা কায়দায় উচ্চারণ করতে লাগল। এস্থলে বাঙালি পৃথিবীর আর সব জাত যা করেছে, তাই করল– ইংরেজ, ফরাসি অথবা জর্মন যখন তার ভাষাতে গ্রিক বা লাতিন শব্দ উচ্চারণ করে তখন সেগুলো আপন আপন ভাষার ধ্বনি পরিবর্তন দিয়েই করে, এমনকি গোটা বাক্যও আপন কায়দায় উচ্চারণ করে (ইংরেজ এবং ভারতীয় আইনজ্ঞেরা nisi শব্দকে লাতিন নিসি উচ্চারণ না করে নাইসাই করেন, a priori-কে আ প্রিয়োরি না বলে এ প্রায়োরাই বলেন)। হিন্দি গুজরাতি মারাঠি ইত্যাদি ভাষা সাধারণ শব্দের ধ্বনি পরিবর্তন মেনে নিয়েছে এমনকি মারাঠিরা জ্ঞানেশ্বরকে দানেশ্বর বলেন! কিন্তু অপেক্ষাকৃত অচলিত সংস্কৃত শব্দ সংস্কৃত পদ্ধতিতে উচ্চারণ করে।

অর্থাৎ আমরা consistent এবং অন্যান্য প্রদেশ এ নীতিটা মানেন না।

অবাঙালিরা তাই ভাবেন আমরা সংস্কৃত উচ্চারণ ‘বিকৃত’ করে তার ওপর ‘অত্যাচার’ করেছি।

কিন্তু ফলে দাঁড়িয়েছে এই যে, বাঙলা খুব তাড়াতাড়ি স্বাধীন হতে পেরেছে। আজ যে বাঙলা সাহিত্য হিন্দি, মারাঠি বা গুজরাতিকে ছাড়িয়ে অনেক দূরে এগিয়ে যেতে পেরেছে, তার অন্যতম প্রধান কারণ আমরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছি। একবার ভেবে দেখলেই হয় আমরা যদি আজও বিদ্যাসাগরী বাংলা লিখতুম তা হলে ‘মেজদিদি’, ‘বিন্দু’, ‘জ্যাঠাইমা’ চরিত্র আঁকা অসম্ভবপর হত কি না? ইংরেজের অত্যাচার-জর্জরিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে প্রশ্ন করলেন, ‘এই ভূতের খাজনা দেবো কিসে?’ উত্তরে বললেন, ‘শ্মশান থেকে মশান থেকে, ঝোড়ো হাওয়ায় হা হা করে উত্তর আসে, আব্রু দিয়ে, ইজ্জত দিয়ে, ঈমান দিয়ে, বুকের রক্ত দিয়ে।’ এ উত্তর বিদ্যাসাগরী বাংলায় কখনও রূপ পেত?

ভাষা এবং সাহিত্য সৃষ্টিতে আমাদের স্বাধীন হবার প্রচেষ্টা প্রসূত নয়, সংস্কৃতের প্রতি অবজ্ঞাজনিত নয়। ধর্ম জানেন, ভট্টপল্লী, নবদ্বীপ তথা বাংলা দেশে সংস্কৃত চর্চা অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় কিছুমাত্র কম নয়, কিন্তু বাঙলা বাঙলা এবং সংস্কৃত সংস্কৃত। বাংলা ভাষা যখন আপন নিজস্বতা খুঁজছিল তখন সে জানত না যে ইংরেজি ফরাসি জর্মন একদা লাতিনের দাস্যবৃত্তি থেকে মুক্তিলাভ করেই যশস্বিনী হয়েছে। বাঙলার এই প্রচেষ্টা ভগবানের দান এবং এই প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ জন্মেছিলেন বঙ্কিম এবং রবীন্দ্রনাথ।

ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে এখনও বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেনি। প্রার্থনা করি, তারা যেন মহত্তর রবীন্দ্রনাথ, বিরাটতম বঙ্কিম পান; কিন্তু ততদিন যদি আমরা এদের নিয়ে গর্ব না করি তবে আমাদের নিমকহারামির অন্ত থাকবে না।

***

অবাঙালিরা যখন বাঙালির প্রতি বিরক্ত হন তখন তাদের মুখে অনেক সময়ই শুনতে পাওয়া যায়, তোমরা বাঙালিরা আর কিছু পারো না পারো একটা জিনিসে তোমরা যে ওস্তাদ সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, তোমাদের কেউ যদি সামান্য একটুখানি কিছু করতে পারে, তবে তাই নিয়ে তোমরা এত লাফালাফি মাতামাতি, সোজা ইংরেজিতে তাকে এত ‘বুসট’ করো যে অবাঙালি পর্যন্ত সেই প্রোপাগান্ডার ঠ্যালায় শেষটায় মেনে নেয় যে, যাকে নিয়ে কথা হচ্ছে সে লোকটা সত্যি জব্বর কিছু একটা করেছে বটে। এই যেমন তোমাদের রবীন্দ্রনাথ।

বাঙালি মাত্রেই এরকম ধারা কথা শুনলে পঞ্চ গোনবার উপদেশটা যে নিতান্ত অর্বাচীনের ফতোয়া সে সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ হয়ে অবাঙালিকে বেশ দু কথা শুনিয়ে দেয় এবং আমিও স্বীকার করি যে শোনাবার হক তার তখন আলবত আছে।

আমি শোনাই না, কারণ আমি জানি অবাঙালি বেচারি পড়েছে মাত্র গীতাঞ্জলি, গার্ডেনার এবং চিত্রাঙ্গদার অনুবাদ। হয়তো আরও দু-একখানা পড়েছে কিন্তু তবু আমি বিশ্বাস করি যে, ইংরেজি যার মাতৃভাষা নয় তার পক্ষে বুঝে ওঠা কঠিন যে এগুলোর মধ্যে এমন কী কবিত্ব, এমন কী তত্ত্ব আছে, যা নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বকবি খেতাব দিয়ে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করা যায়। ইয়েটস্ সাহেব যখন গীতাঞ্জলিকে প্রশংসা করে সপ্তম স্বর্গে তোলেন তখন তার একটা অর্থ করা যায় :– রবীন্দ্রনাথের ইংরেজিতে হয়তো এমন কোনও অদ্ভুত গীতিরস লুকোনো আছে যার স্বাদ পেয়ে ইংরেজিভাষী ইয়েটস প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন কিন্তু আমার মতো বাঙালি অতটা উচ্চাঙ্গ ইংরেজি জানে না এবং আর পাঁচজন অবাঙালি যদি আমারই মতো হয় তাতে আমার রাগ করার কী আছে?

সাধারণ বাঙালি যখন অবাঙালির এই ‘নীচ’ আক্রমণে মার মার করে তেড়ে যায় তখন সে ধরে নিয়েছে যে অবাঙালি রবীন্দ্রনাথের উত্তম উত্তম কাব্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েও নিছক টিটেমি করে বাঙালির নিন্দে করছে। কাজেই ঝগড়াটা শুরু হয় ভুল-বোঝা নিয়ে। কিন্তু একবার ঝগড়া শুরু হয়ে গেলে কাদামাটি ছোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে দু-চারটে পাথরও ছোঁড়া হয়, তখন মানুষ জানা-অজানাতে অন্যায় কথাও বলে ফেলে। তর্কের ঝোঁকে তখন অবাঙালি আমাদের অন্যান্য মহাপুরুষও যে কেবলমাত্র বিজ্ঞাপনের জোরেই খ্যাতনামা হয়েছে সেকথা বলতেও কসুর করে না।

আমি বাঙালি, কাজেই আমার পক্ষে নিরপেক্ষ হওয়া কঠিন। তাই কী করে বুক ঠুকে বলি বলুন যে, রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ ঘোষের বিজ্ঞাপন দেবার প্রয়োজন আমরা কখনও অনুভব করিনি। এঁরা বাঙালির ধর্মজগতের গুরুর আসন গ্রহণ করে বাঙালি জাতটাকে গড়ে তুলেছেন। এ সত্যটা জানি এবং হিন্দি, গুজরাতি, মারাঠি, উর্দু নিয়ে চর্চা করেছি বলে এ তথ্যটাও জানি যে ভগবান বোধহয় বাঙালিকে নিতান্ত নিষ্কর্মা জেনেই দায় করে একমাত্র তাকেই অকৃপণ হস্তে এতগুলো ধর্মগুরু দিয়ে ফেলার পর হুঁশিয়ার হয়ে অন্য প্রদেশগুলোর ওপর কঞ্জুসি চালিয়েছেন।

আজকাল অবশ্যি ধর্ম রায়বাহাদুর খেতাব নিয়ে কি বাংলা, কি বোম্বাই, কি দিল্লি সর্বত্রই পেনশন টানছেন। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ শিষ্য বিবেকানন্দ এবং দূর শিষ্য সুভাষচন্দ্র এবং দেবেন্দ্রনাথের শিষ্য রবীন্দ্রনাথ এই বাঙালির জাতীয়তাবোধ কতখানি জাগ্রত করে দিয়ে গেছেন সেকথা আমরাই এখনও ভালো করে বুঝে উঠতে পারিনি– বিজ্ঞাপন দেবে কে, বুসট আপ করবার গরজ কার? হা ধর্ম!

রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, কেশব সেন আমাদের অচলায়তনের অন্ধ প্রাচীরে অনেকগুলো

জানালা তৈরি করে দিয়েছেন তারি ভিতর দিয়ে আমরা পশ্চিমের জ্ঞানবিজ্ঞানের সন্ধান পেলুম। শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য ও জনগণের সঙ্গে সে ঐতিহ্যের যোগসূত্র সম্বন্ধে আমাদের সচেতন করে দিয়ে গেলেন। তাই এক দিক দিয়ে আমরা যেমন বাইরের জিনিস নিতে শিখলুম অন্য দিক দিয়ে ঠিক তেমনি আপন জিনিসকে অবহেলা না করে আপন সংস্কৃতি-সভ্যতা গড়ে তুললুম।

সবচেয়ে স্বপ্রকাশ হয়েছে এই তত্ত্বটি আমাদের সাহিত্যে। মাইকেল খ্রিস্টান, নজরুল মুসলমান এবং প্রমথ চৌধুরীকে ফরাসি বললে কিছুমাত্র ভুল বলা হয় না। অথচ তিনজনই বাঙালি এবং তাঁরা যে সাহিত্য গড়ে তুলেছেন সেটি বাংলা সাহিত্য। কিন্তু এঁরাই শুধু নন, আর যে পাঁচজন বাঙালি সাহিত্য গড়ে তুলেছেন তাঁদের সকলেই জানা-অজানাতে আমাদের ধর্মগুরুদের উপদেশ সাহিত্যক্ষেত্রে মেনে নিয়েছেন। শরৎচন্দ্রের দরদী ঘরোয়া সাহিত্যের পশ্চাতে রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণের সরলতা, রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী প্রতিভার পিছনে রয়েছে রামমোহনের বিদগ্ধ মনোবৃত্তি।

বহু আকস্মিক ঘটনা, বহু যোগাযোগের ফলে বাংলা সাহিত্য গড়ে উঠেছে। ইংরেজি তথা ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞান, সাহিত্যকলার চর্চা প্রধানত হয়েছিল কলকাতা এবং মাদ্রাজে। কিন্তু তামিল ভাষাভাষীদের মধ্যে যারা এসব দিকে আকৃষ্ট হলেন তারা মাতৃভাষার সেবা করলেন না। ফলে তারা বাঙালির চেয়ে ভালো ইংরেজি শিখলেন বটে– যদিও সে ইংরেজি সাহিত্যে স্থান পাবার উপযুক্ত হল না– কিন্তু তামিল ভাষা সমৃদ্ধ হতে পারল না। মহারাষ্ট্র এবং গুজরাটে লোকমান্য টিলক (কথাটা তিলক নয়) এবং স্বামী দয়ানন্দ জন্মালেন বটে কিন্তু সেসব প্রদেশে ইউরোপীয় সাহিত্য প্রচেষ্টার যথেষ্ট প্রসার হল না বলে মারাঠি, গুজরাতি সাহিত্য আজও বাংলার অনেক পিছনে।

অবজ্ঞাপ্রসূত প্রাদেশিক বিদ্বেষ তা হলে ঘুচবে কবে? যেদিন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন্য প্রদেশের ভাষা শেখবার ব্যাপক ব্যবস্থা হবে সেদিন থেকে। ইংরেজ এ ব্যবস্থা করবার কোনও প্রয়োজন বোধ করেনি তার কারণটাও অনায়াসে বোঝা যায়– কিন্তু আমাদের বেশ ভালো করে মেনে নেওয়া উচিত, সর্বপ্রদেশের সর্বপ্রচেষ্টার সঙ্গে যদি আমাদের বহু ছাত্রছাত্রী বহু প্রাদেশিক ভাষার মাধ্যমে সংযুক্ত না হয়, তবে অবজ্ঞাপ্রসূত এসব বিদ্বেষ কস্মিনকালেও যাবে না, এবং কেবলমাত্র রাষ্ট্রভাষা শিখলেই সব সমস্যার সমাধান হবে না।

প্রত্যেক ছাত্রই যে বারোটা প্রাদেশিক ভাষা শিখবে এ প্রস্তাব কেউ করবে না, মানবে না। ব্যবস্থাটা হবে এই যে, বহু ছাত্র মারাঠি, বহু ছাত্র গুজরাতি, অন্যেরা তামিল অথবা কানাড়া অথবা অন্য কোনও প্রাদেশিক ভাষা শিখবে, তারা ওইসব ভাষা থেকে উত্তম উত্তম পুস্তক বাংলায় অনুবাদ করবে, ঠিক সেইরকম বাঙলা বইও নানা ভাষায় অনূদিত হবে। ফলে এক প্রদেশ অন্য প্রদেশের সাহিত্য চিনতে শিখবে এবং তারপরেও যদি বিদ্বেষ থেকে যায় তবে তার জন্য অন্তত আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিকে দোষ দেওয়া যাবে না।