নাগা

নাগা

৩১ আগস্ট সংসদে প্রশ্নোত্তরকালে প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওয়াহর লাল নেহরু বলেন যে, গত ২৪ মে একদল নাগা ভারতীয় নাগা অঞ্চলে হানা দেয় ও ৯৩টি মুণ্ডু কেটে নিয়ে চলে যায়।

আসামে মিরি, মিশমি, আবর, আকা, দফলা, কুকি, গারো, লুসাই, খাসী, নাগা ইত্যাদি বহু প্রকারের উন্নত অনুন্নত, সভ্য-অসভ্য জাতি আছে। এদের ভিতর খাসী, লুসাই, গারোরা এবং আরও কয়েকটি জাতি বড়ই ঠাণ্ডা মেজাজের এবং সবচেয়ে মারাত্মক নাগারা। এরা এখনও পরমানন্দে নরমাংস ভক্ষণ করে এবং কে কতটা শৌর্যশালী তার বিচার হয় কে কটা মুণ্ডু কাটতে পেরেছে তাই দিয়ে।

নাগা পাহাড়ের যে অংশটুকু ইংরেজ দখল করে সেখানে ইংরেজের সঙ্গে সঙ্গে বিস্তর মিশনারি যায় এবং ফলে অনেক নাগা খ্রিস্টান হয়ে যায়। মিশনারিদের ধর্মপ্রচার ও ইংরেজের আইনকানুনের ভয়ে ব্রিটিশ নাগারা বড় অনিচ্ছায় মানুষ কেটে খাওয়া বন্ধ করে; কিন্তু স্বাধীন ও বর্মী নাগারা এসব ‘ম্লেচ্ছ-সংস্কারে’র কিছুমাত্র তোয়াক্কা না করে সুযোগ পেলেই ব্রিটিশ নাগা অঞ্চলে হানা দিয়ে মুণ্ডু কেটে নিয়ে যেতে থাকে।

বিশেষ করে ব্রিটিশ (বর্তমান ভারতীয়) অঞ্চলেই এরা হানা দেয় কেন?

তার একমাত্র কারণ ব্রিটিশ আইন করে এবং সে আইন ভারতীয়রাও চালু রেখেছেন– ব্রিটিশ নাগাদের ভিতর এক গ্রাম অন্য গ্রামকে হানা দেওয়ার রেওয়াজ বন্ধ করে দেয়। অবশ্য এ আইন নাগারা চাঁদপানা মুখ করে সয়ে নেয়নি– বিস্তর মার খাওয়ার পর অতি অনিচ্ছায় তারা হানাহানি বন্ধ করে। ফলে তারা নির্বীর্য ও শান্তিপ্রিয় হয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে হানাহানির জন্য যেসব অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন সেগুলো লোপ পেতে থাকে।

ওদিকে স্বাধীন নাগারা দেখল এ বড় উত্তম ব্যবস্থা। আপোসে তারা মাঝে মাঝে হানাহানি করে বটে, কিন্তু সেখানে যেমন অন্যের মুণ্ডুটি কাটবার সম্ভাবনা আছে ঠিক তেমনি নিজের মুটি কাটা যাওয়ার বিলক্ষণ সম্ভাবনাও আছে, কারণ উভয় পক্ষই উদয়াস্ত লড়াইয়ের পায়তারা কষে, তীর চোখা রাখে, ধনুকের ছিলে বদলায়। অপিচ ব্রিটিশ নাগারা লড়াই করতে ভুলে গিয়েছে, তীরধনুক যা আছে তা দিয়ে হানাহানি করা যায় না। এদের হানা দিলে প্রাণ যাবার ভয় নেই, গোলায় মজুদ ধান লুট করা যায় আর শূয়ার ছাগল তো নিতান্তই ফাউ। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, একগাদা মুণ্ডু কপাকপ কেটে নিয়ে নির্বিঘ্নে বাড়ি চলে যাওয়া যায়। অন্ততপক্ষে একটা মুণ্ডু না দেখাতে পারলে স্বাধীন নাগা অঞ্চলে বউ জোটে না; কাজেই নাগা সম্বরণদের গত্যন্তর কোথায়?

ভারতীয় নাগারা ফরিয়াদ করে আমাদের বলে, ‘হানাহানি বন্ধ করে দিয়ে তোমরা আমাদের নির্বীর্য করে ফেলেছ। তাই সই। কিন্তু তার ঝুঁকিটা কি তোমাদেরই নেওয়া উচিত নয়? স্বাধীন নাগারা যখন আমাদের গ্রাম আক্রমণ করে তখন আমরা আত্মরক্ষা করতে অক্ষম। তোমাদের কি তখন কর্তব্য নয় পুলিশ সেপাই রেখে আমাদের বাঁচানো?’

অতি হক কথা। কিন্তু প্রশ্ন, এ কর্মটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করা যায় কী প্রকারে? আমাদের সেপাইরা যে নাগাদের ডরায় তা নয়, কারণ নাগাদের হাতে বন্দুক থাকে না। গোটা দুত্তিন মেশিনগান দিয়েই একপাল নাগাকে কাবু করা যায়, কিন্তু বেদনাটা তখন সেখানে নয়। মুশকিল হচ্ছে এই, স্বাধীন নাগারা হানা দেবার পূর্বে শাস্ত্রসম্মত পদ্ধতিতে দিনক্ষণ জানিয়ে দিয়ে শুভাগমন করে না এবং আমাদের পক্ষেও প্রতি পাহাড়ের চুড়ায় সেপাই মোতায়েন করা সম্ভব নয়।

নাগারা দল বেঁধে গাঁ বানিয়ে সমতলভূমিতে বসবাস করে না। তারা থাকে পাহাড়ের চুড়োয় চুড়োয় এবং সে চুড়োগুলোর উচ্চতা তিন থেকে ছ হাজার ফুট। কাজেই এক পাহাড়ের চুড়ো থেকে যদি দেখাও যায় যে অন্য চুড়ো আক্রান্ত হয়েছে তবু সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতেই সব কেচ্ছা খতম হয়ে যায়।

তবে কি নাগাদের আপন হাতে কিছু কিছু বন্দুক-টক দেওয়া যায় না? সেখানে মুশকিল হচ্ছে, নাগাদের ঠিক অতটা বিশ্বাস করা যায় না। কারণ বন্দুক পেলে তারা সোল্লাসে অবিচারে অন্য নাগাদের আক্রমণ করবে। তা হলে সে একই কথাই গিয়ে দাঁড়াল।

নাগারা এই ব্যবস্থাটাই চায়। তারা বলে, তোমরা যখন আমাদের বাঁচাতে পারছ না তখন আমরাই আপন প্রাণ বাঁচাই। এটাতেও আমাদের মন সাড়া দেয় না।

আচ্ছা, তবে কি আমাদের সৈন্যরা স্বাধীন নাগা অঞ্চল আক্রমণ করে তাদের বেশ কিছু ডাণ্ডা বুলিয়ে দিতে পারে না?

পারে। তবে তাতেও ঝামেলা বিস্তর ॥

————

১. বাংলাতে সাধারণ ‘জওহর’ লেখা হয় এবং এ ভুল সংশোধন করা উচিত। ‘জওহর’ কথাটি ফারসিতে একবচন এবং অর্থ বাংলাতে যা তাই। ‘জওয়াহর’ কিংবা ‘জওয়াহির’ শব্দটি ‘জওহর’ শব্দের আরবি ব্যাকরণসম্মত বহুবচন। ‘পণ্ডিতজি’ তাঁর নাম বহুবচনে ব্যবহার করেন এবং আমাদেরও তাই করা উচিত। এ স্থলে আরও উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ফারসিতে আসলে শব্দটি ‘গওহর’; কিন্তু আরবি বর্ণমালায় ‘গ’ নেই বলে আরবরা ‘জওহর’ লেখেন। পরবর্তী যুগে ‘গওহর’ও প্রচলিত হয়। তাই মুসলমানি নাম ‘গৌহর’ ও জওহর, একই।