শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব

ধর্মের ইতিহাসে দেখা যায়, কোনও সভ্য জাতির বিত্তশালী সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা কিংবা অন্য কোনও বোধ্য ভাষাতে যদি ধর্মচর্চা না থাকে তবে সে সম্প্রদায় ক্রিয়া-কর্ম ও পাল-পার্বণ নিয়েই মত্ত থাকে! এই তত্ত্বটি ভারতবাসীর ক্ষেত্রে অধিকতর প্রযোজ্য। কারণ, তারা স্বভাবত এবং ঐতিহ্যবশত ধর্মানুরাগী। তার কোনও বোধ্য ভাষাতে সত্যধর্মের মূলস্বরূপ সম্বন্ধে কোনও নির্দেশ না থাকলে সে তখন সবকিছু হারাবার ভয়ে ধর্মের বহিরাচরণ অর্থাৎ তার খোলস ক্রিয়াকর্মকেই আঁকড়ে ধরে থাকে।(১)

কলকাতা অর্বাচীন শহর। যেসব হিন্দু এ শহরের গোড়াপত্তনকালে ইংরেজের সাহায্য করে বিত্তশালী হন, তাঁদের ভিতর সংস্কৃত ভাষার কোনও চর্চা ছিল না। বাঙলা গদ্য তখনও জন্মলাভ করেনি। কাজেই মাতৃভাষার মাধ্যমে যে তাঁরা সত্যধর্মের সন্ধান পাবেন তারও কোনও উপায় ছিল না। ওদিকে আবার বাঙালি ধর্মপ্রাণ। তাই সে তখন কলকাতা শহরে পাল-পার্বণে যা সমারোহ করল তা দেখে অধিকতর বিত্তশালী শাসক ইংরেজ-সম্প্রদায় পর্যন্ত স্তম্ভিত হল। এর শেষ-রেশ ‘হুতোমে’ পাওয়া যায়।

জাতির উত্থান-পতনেও এ অবস্থা বারবার ঘটে থাকে। এবং সমগ্রভাবে বিচার করতে গেলে তাতে করে জাতির বিশেষ কোনও ক্ষতি হয় না। গরিব-দুঃখীর তথা সমগ্র সমাজের জন্য এর একটা অর্থনৈতিক মূল্য তো আছে বটেই, তদুপরি এক যুগের অত্যধিক পাল-পার্বণের মোহকে পরবর্তী যুগের ঐকান্তিক ধ্যান-ধারণা অনেকখানি ক্ষতিপূরণ করে দেয়।

কিন্তু বিপদ ঘটে, যখন ওই ক্রিয়াকর্মের যুগে হঠাৎ এক বিদেশি ধর্ম এসে উপস্থিত হয়, তার চিন্তাধারা তার সত্যপথ সন্ধানের আন্দোলন-আলোড়ন নিয়ে। এবং ওই ধর্মজিজ্ঞাসার সঙ্গে সঙ্গে যদি অন্যান্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক (কঁৎ, মিল ইত্যাদি) প্রশ্নের যুক্তিতর্কমূলক, আলোচনা-গবেষণা বিজড়িত থাকে তবে ক্রিয়াকর্মাসক্ত সমাজের পক্ষে সমূহ বিপদ উপস্থিত হয়। বাঙালি সমাজের অগ্রণীগণ ইংরেজের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে গিয়ে অনেকখানি ইংরেজি শিখে ফেলেছেন এবং খ্রিস্টধর্মের মূলতত্ত্ব, তার মহান আদর্শবাদ, সেই ধর্মে অনুপ্রাণিত মহাজনগণের সমাজসংস্কার প্রচেষ্টা তাঁদের মনকে বারবার বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে তাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, আমাদের ধর্মে আছে কী, আছে তো শুধু দেখতে পাই অন্তঃসারশূন্য পূজা-পার্বণ, আর ওদের ধর্মে দেখি, স্বয়ং ভগবান পিতারূপে মানুষের হৃদয়দ্বারের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁকে পেলে এই অর্থহীন জীবনযাপন চরম মূল্য লাভ করে, দুঃখ-দৈন্য আশা-আকাঙ্ক্ষা এক পরম পরিসমাপ্তিতে অনন্ত জীবন লাভ করে।

হিন্দুশাস্ত্রের অতি সামান্য অংশও যাঁরা অধ্যয়ন করেছেন তাঁরাই জানেন, এসব কিছু নতুন তত্ত্ব নয়। বস্তুত জীবনসমস্যা ও ধর্মে তার সমাধান এই অবলম্বন করেই আমাদের সর্বশাস্ত্র গড়ে উঠেছে। একদিকে দৈনন্দিন জীবনের অন্তহীন প্রলোভন, অন্যদিকে সত্যনিষ্ঠার প্রতি ধর্মের কঠোর কঠিন আদেশ–এ দুয়ের মাঝখানে মানুষ কী প্রকারে সার্থক গৃহী হতে পারে, সেই পন্থাই তো আমাদের শাস্ত্রকারগণ যুগে যুগে দেখিয়ে গেছেন।

কিন্তু এসব তত্ত্ব যাঁরা জানতেন তারা থাকতেন গ্রামে, তাঁরা পড়তেন পড়াতেন টোল চতুম্পাঠীতে এবং তাঁরা ইংরেজের সংস্পর্শে আসেননি বলে ওদের ধর্ম যে নাগরিক হিন্দুকে নানা প্রশ্নে বিচলিত করে তুলেছে সে সংবাদ তাঁদের কানে এসে পৌঁছয়নি!

আর সবচেয়ে আশ্চর্য, এইসব ‘টোলো’ ‘বিটলে বামুন’-রা যে শুধু পাদ্রি সাহেবদের। সঙ্গে তর্কযুদ্ধে আপন ধর্মের মর্যাদা মহিমা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারত তা নয়, তারা যে কান্ট-হেগেল-এর চেলাদের সঙ্গে বিশুদ্ধ দর্শনের ক্ষেত্রেও সংগ্রাম করতে প্রস্তুত ছিল এ তত্ত্বটিও নাগরিক হিন্দুদের সম্পূর্ণ অজানা ছিল। ‘ঘরের কাছে নিই নে খবর, খুঁজতে গেলাম দিল্লি শহর’ লালন ফকিরের অর্থহীন গীত নয়।(২) এঁরা সত্যই জানতেন না, আমাদের টোলে শুধু স্মার্ত নন, নৈয়ায়িকও ছিলেন, এবং স্মার্তরাও যে শুধু তৈলবট নিয়ে বিধান দিতেন তাই নয়, তারা সে বিধানের সামাজিক মূল্যও যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রমাণ করতে পারতেন।

কলকাতায় চিন্তাশীল গুণীজন তখন এই পরিস্থিতি দেখে বিচলিত হয়েছিলেন।

সৌভাগ্যক্রমে এই সময় রাজা রামমোহন রায়ের উদয় হল। তাঁর ব্রাহ্ম-আন্দোলন যে বাঙালি জাতির কী পরিমাণ উপকার করেছে, এই ব্রাহ্মসমাজের কীর্তিমান পুরুষসিংহ রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যকে যে কী পরিমাণ ঐশ্বর্যশালী ও বহুমুখী করে গিয়েছেন, তার সম্পূর্ণ হিসাব-নিকাশ এখনও শেষ হয়নি। বাঙালি সাধক, বাঙালি লেখক, বাঙালি পাঠক সকলেই সেকথা স্বীকার করেছেন। স্বয়ং শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন–

এদানির ব্রাহ্মধর্ম যায় ছড়াছড়ি
তাহারেও বারবার নমস্কার করি।

‘ছড়াছড়ি’ শব্দে তখনকার দিনে প্রচলিত একটু ক্ষুদ্র তাচ্ছিল্য লুকানো রয়েছে। পরমহংসদেব সেটিকেও নমস্কার করেছেন।

রাজা রামমোহন খ্রিস্টধর্মে মহাপণ্ডিত ছিলেন, মুসলমান ধর্মের ‘জবরদস্ত মৌলভি’ ছিলেন এবং সবচেয়ে বড় কথা, সে যুগে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হলে যে বস্তু সম্পূর্ণ অবান্তর এমনকি অন্তরায়, সেই হিন্দু ধর্ম-শাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য, অতুলনীয় ব্যুৎপত্তি এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টি ছিল।

রাজা জানতেন, সে যুগের হিন্দুকে তর্ক-বিতর্ক করতে হবে খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে। অর্থাৎ খ্রিস্টান মিশনারির সামনে ‘ক’ অক্ষরে ‘কৃষ্ণনাম’ স্মরণে ‘একঘটি’(৩) চোখের জল ফেললেই আপন ধর্মের মাহাত্ম্য সুপ্রতিষ্ঠিত হবে না- খুব বেশি হলে, ভদ্র মিশনারি হয়তো তাকে ভক্ত বলে স্বীকার করবে মাত্র। তাই তাকে প্রমাণ করতে হবে যে, কলকাতার হিন্দুর ক্রিয়াকর্মের পিছনে রয়েছে, হিন্দুর ষড়দর্শন, বুদ্ধ এবং মহাবীরের বিশ্বপ্রেম এবং সর্বপশ্চাতে রয়েছে অহরহ জাজ্বল্যমান বেদবেদান্তের অখও দিব্যদৃষ্টি।

দেশের আপামর জনসাধারণের ভিতর হিন্দুধর্মের নব উন্মাদনা আনতে হলে রাজা রামমোহন হিন্দুধর্মের কোন কোন সম্পদ গ্রহণ এবং প্রচার করতেন সেকথা বলা শক্ত; কিন্তু এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, সে যুগের কলিকাতাবাসী সুসভ্য অথচ আপন শাস্ত্রে অজ্ঞ হিন্দুর সামনে তিনি সর্বশাস্ত্র মন্থন করে উপনিষদগুলোই তুলে ধরে প্রকৃত ঋষির গভীর অন্তদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছিলেন। উপনিষদ থেকেই শঙ্কর-দর্শনের সূত্রপাত এবং শঙ্করের অদ্বৈতবাদ অতিশয় অক্লেশে, পরম অবহেলায় খ্রিস্টানের ট্রিনিটিকে সম্মুখ-সংগ্রামে আহ্বান করতে পারে। উপনিষদের গুণকীর্তন এ ক্ষুদ্র এবং অক্ষম রচনার উদ্দেশ্য নহে– অনুসন্ধিৎসু পাঠক তুর্কি পণ্ডিত অলবিরুনি, মোগল সুফি দারাশিকুহ, (ঔরঙ্গজিবের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা)(৪) এবং জর্মন দার্শনিক শোপেনহাওয়ারের রচনাতে তার ভূরি ভূরি উদাহরণ পাবেন।

ধর্মের যেসব বাহ্যানুষ্ঠান সত্যধর্ম থেকে অতি দূরে চলে গিয়ে অধর্মে রূপান্তরিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে রাজা সংগ্রাম আরম্ভ করলেন সতীদাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরম্ভ করে এবং সে সংগ্রামের জন্য তিনি অস্ত্রশস্ত্র সঞ্চয় করলেন হিন্দু স্মৃতি থেকেই। এস্থলে রাজা বিশ্বজনীন যুক্তিতর্ক ব্যবহার না করে প্রধানত ব্যবহার করলেন হিন্দুশাস্ত্রসম্মত ন্যায় এবং উদাহরণ। রাজা প্রমাণ করলেন যে তিনি দর্শনের যেরকম বিদগ্ধ, ক্রিয়াকর্মের ভূমিতেও অনুরূপ স্মার্ত মল্লবীর।

শাস্ত্রালোচনায় ঈষৎ অবান্তর হলেও এস্থলে বাংলা সাহিত্যানুরাগীর দৃষ্টি তার অতি প্রিয় একটি বস্তুর দিকে আকর্ষণ করি। রাজাকে তাঁর আন্দোলন চালাতে হয়েছিল কলকাতার বাঙালিদের ভিতর। এঁরা সংস্কৃত জানেন না। তাই তাকে বাধ্য হয়ে লিখতে হয়েছিল বাঙলা ভাষাতে। পদ্য এসব যুক্তি-তর্কের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত বাহন। তাই তাঁকে বাঙলা গদ্য নির্মাণ করে তার-ই মাধ্যমে আপন বক্তব্য প্রকাশ করতে হয়েছিল। রাজার পূর্বে-যে বাঙলা গদ্য লেখা হয়নি এসব বলা আমার উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু হিন্দুধর্মের এই তুমুল আন্দোলন আকর্ষণ মন্থনের ফলে যে অমৃত বেরুল তারই নাম বাঙলা গদ্য। পৃথিবীর ইতিহাসে এ জাতীয় ঘটনা বহুবার ঘটেছে; তথাগতের কৃপায় পালি, মহাবীরের কৃপায় অর্ধমাগধী। হজরত মুহম্মদের কৃপায় আরবি গদ্য, লুথারের কৃপায় জর্মন গদ্যের সৃষ্টি। পূর্বেই নিবেদন করেছি, গণবোধ্য মাতৃভাষাতে শাস্ত্রালোচনা না থাকলে ক্রিয়াকর্মের আত্যন্তিক প্রসার পায়; তার বিরুদ্ধে নবধর্ম পত্তন কিংবা সনাতন ধর্মের সংস্কার আন্দোলন আরম্ভ হয়;(৫) এবং সে আন্দোলনকে বাধ্য হয়েই গণ-ভাষার আশ্রয় নিতে হয়।

রাজার প্রচলিত সংস্কার উপনিষদে আপনার দৃঢ়ভঙ্গি নির্মাণ করার ফলে কতকগুলো জিনিস সে অস্বীকার করল। তার প্রথম, সাকার উপাসনা। দ্বিতীয় বৈষ্ণবধর্মের তদানীন্তন প্রচলিত রূপ; ক্রমে ক্রমে গণ-ধর্মের (Folk religion) প্রতি ব্রাহ্মদের অবজ্ঞা স্পষ্টতর হতে লাগল।(৬) প্রমাণ স্বরূপ বলতে পারি, তখনকার দিনে কেন, আজও যদি কেউ ব্রাহ্মমন্দিরের বক্তৃতা দিনের পর দিন শোনে তবু সে উপনিষদের পরবর্তী যুগের ধর্ম-সাধনার অল্প ইঙ্গিতই শুনতে পাবে। তার মনে হবে, উপনিষদ-আশ্রিত ধর্মদর্শনের শেষ হয়ে যাওয়ার পর আজ পর্যন্ত হিন্দুরা আর কোনও প্রকারের উন্নতি করতে পারেননি। এমনকি গীতার উল্লেখও আমি অল্পই শুনেছি। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণের কথা প্রায় কখনওই শুনিনি। বৃন্দাবনের রসরাজ-রসমতীর অভূতপূর্ব অলৌকিক প্রেমের কাহিনী থেকে কোনও ব্রাহ্ম কখনও কোনও দৃষ্টান্ত আহরণ করেননি।

ধর্ম জানেন, আমি ব্রাহ্মদের নিকট অকৃতজ্ঞ নই। পাছে তাঁরা ভুল বোঝেন তাই বাধ্য হয়ে ব্যক্তিগত কথা তুললুম এবং করজোড়ে নিবেদন করছি, আমি মুসলমান, আমার কাছে হিন্দু যা ব্রাহ্মও তা, আমি হিন্দু-ব্রাহ্ম উভয় পন্থার (আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস পন্থা ভিন্ন নয়) সাধু-সন্তদের বারবার নমস্কার করি।

ব্রাহ্মধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ যতই অধ্যয়ন করি ততই দেখতে পাই, ব্রাহ্মরা যেন ক্রমে ক্রমেই জনগণ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন। জনগণকে ব্রহ্মমন্ত্রে দীক্ষিত করে এক বিরাট গণ-আন্দোলন আরম্ভ করার প্রচেষ্টা যেন তাদের ভিতর ছিল না। এ যুগেও তার উদাহরণ পাইনি। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে আজ পর্যন্ত আমি বহু ব্রাহ্ম পরিবারের আতিথ্য লাভ করেছি, ফলে গভীর হৃদ্যতা হয়েছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও ব্রাহ্ম পরিবারের হিন্দু চাকর-বাকরদের ব্রহ্মমন্ত্রে দীক্ষিত করার প্রচেষ্টা দেখিনি। মুসলমান-খ্রিস্টানরা সর্বদাই করে থাকেন বলেই এটা আমার কাছে আশ্চর্যজনক বলে মনে হয়েছিল। আমার মনে হয়, ব্ৰহ্মমন্ত্র সার্বজনীন কিন্তু একথাও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ব্রহ্মজ্ঞানীরা যেকোনো কারণেই হোক সর্বজনকে আহ্বান জানাতে পারেননি। মুসলমানের সমাজে মুটে-মজুর চাকর-বাকরের সংখ্যাই বেশি, হিন্দুর সংকীর্তনে ভাবোল্লাসে নৃত্য করে নিম্ন শ্রেণির প্রচুর হিন্দু আর মন্দিরে আরতির সময় শিক্ষিত হিন্দুকে তো আজকাল দেখতেই পাওয়া যায় না। অথচ পূর্ববঙ্গের ব্রাহ্ম-সম্মেলনে ব্রাহ্ম চাকর-নফর দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

তার জন্য আমি ব্ৰহ্মবাদীদের আদৌ ক্রটি ধরছি না। এঁরা অক্ষম ছিলেন, একথা আমি কখনও স্বীকার করব না। আমার মনে হয়, এঁরা প্রধানত সমাজের নেতৃস্থানীয়দের নিয়েই আপন আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন এবং তাদের মাধ্যমে যে আমাদের মতো বহু হিন্দু-মুসলমান প্রচুর উপকৃত হয়েছিলেন সে বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই।

কিন্তু এ বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই যে হিন্দু-ধর্মের গণরূপ তখন একেবারেই অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল। তার জন্য ব্রাহ্মদের দোষ দিলে অত্যন্ত অন্যায় হবে; দোষ হিন্দুদের। তাদের নেতৃস্থানীয়েরা তখন হয় দীক্ষা নিয়েছেন কিংবা ব্রাহ্মদের প্রতি সহানুভূতিশীল, আপন গরিব জাত-ভাই কী ধর্মকর্ম করছে এবং তার কল্যাণে সত্যধর্মের সন্ধান পাচ্ছে কি না এ বিষয়ে তাঁরা তখন উদাসীন। যেন গণধর্ম নয়, যেন ধর্মে একমাত্র শিক্ষিতজনেরই শাস্রাধিকার।

অতিশয় মারাত্মক পরিস্থিতি। দেশের দশের তা হলে সর্বনাশ হয়। শিক্ষিতজনকেও শেষ পর্যন্ত তার তিক্ত ফল আস্বাদ করতে হয়।(৭)

***

ঠিক সেই সময়ে করুণাময়ের কৃপায় শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আবির্ভাব।

পরমহংসদেবকে সমগ্র এবং সম্পূর্ণভাবে ধারণা করা আমাদের মতো অতি সাধারণ প্রাণীর পক্ষে অসম্ভব, কারণ, আমরা সবকিছুই গ্রহণ করি আমাদের বুদ্ধি দিয়ে– যুক্তিতর্কের ছাঁচে ফেলে। অথচ কেবলমাত্র বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে সাধু-সন্তদের ধারণা করতে গেলে আমরা পাই। বরফের সেই অতি অল্প অংশটুকুর খবর, যেটি জলের উপর ভাসছে। অর্থাৎ বেশিরভাগ বস্তুটি যে ষষ্ঠেন্দ্রিয় তৃতীয় চক্ষু দিয়ে দেখতে হয় সেটি আমাদের নেই। তৎসত্ত্বেও যারা তার বিচার করে তাদের নিয়ে মৃদু হাস্য করে বাউল গেয়েছেন–

ফুলের বনে কে ঢুকেছে সোনার জহুরি
নিকষে ঘষয়ে কমল, আ মরি আ মরি।

যার যেমন মাপকাঠি। স্যাকরার ক্রাইটেরিয়ন তার নিকষ পাথর। সে তাই দিয়ে পদ্মফুলের শুণ বিচার করতে যায়। কিন্তু এর চেয়েও মারাত্মক অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন স্বয়ং পরমহংসদেব– একাধিকবার। নুনের পুতুল সমুদ্রে নেমেছিল তার গভীরতা মাপবে বলে। তিন পা যেতে না যেতেই সে গলে গিয়ে জলের সঙ্গে মিশে গেল।(৮)

তাই নিয়ে কিন্তু কিছুমাত্র শোক করার প্রয়োজন নেই। স্বয়ং রামকৃষ্ণদেবই বলেছেন, তোমার এক ঘটি জলের দরকার। পুকুরে কত জল তা জেনে তোমার কী হবে?(৯)

তাই মাভৈঃ। যারা বলে আমাদের মতো পাপীতাপীর অধিকার নেই পরমহংসের মতো মহাপুরুষের জীবন নিয়ে আলোচনা করার– তারা ভুল বলে। অধিকার আমাদেরই এক মহাপুরুষ অন্য মহাপুরুষের জীবনী লিখতে যাবেন কেন? সে অধিকার গ্রহণ করতে গিয়ে ভুল-ত্রুটি হলে মহাত্মাদের কিছুমাত্র ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। হীন প্রাণকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই সমূহ বিপদের সম্ভাবনা।

পরমহংসদেবের কাছে আসার পূর্বেই চোখে পড়বে, লোকটি কী সরল। এগিয়ে এলে বোঝা যায়, এঁর বাহির-ভিতর দুই-ই সরল। এঁর শরীরটি যেমন পরিষ্কার, এঁর মনটিও তেমনি পরিষ্কার। মেদিনীপুর অঞ্চলে যাকে বলে ‘নিখিরকিচ’– চাঁচা-ছোলা। যেন এইমাত্র তৈরি হয়েছে কাঁসার ঘটিটি– কোনও জায়গায় টোল পড়েনি।

এঁর মতো সরল ভাষায় কেউ কখনও কথা বলেনি। এঁর ভাষার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্য খ্রিস্টের ভাষা ও বাক্যভঙ্গির। আমাদের দেশের এক আলঙ্কারিক বলেছেন, “উপমা কালিদাসস্য”। এর অর্থ শুধু এই নয় যে কালিদাস উত্তম উপমা প্রয়োগ করতে পারতেন, এর অর্থ উপমামাত্রই কালিদাসের, অর্থাৎ উপমার রাজ্যে কালিদাস একচ্ছত্রাধিপতি। আমাদের মনে হয়, উপমাবৈচিত্র্যে পরমহংসদেব কালিদাসকেও হার মানিয়েছেন। কালিদাস ব্যবহার করেছেন শুধু সুন্দর মধুর তুলনা সেগুলো কাব্যের অঙ্গসৌষ্ঠব বৃদ্ধি করে। রামকৃষ্ণের সেখানে কোনও বাছ-বিচার ছিল না। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, ‘তার জাঁতায় যাই ফেল না কেন, ময়দা হয়ে বেরিয়ে আসে।’ পরমহংসের বেলাও ঠিক তাই। কিছু একটা দেখলেই হল। সময়মতো ঠিক সেটি উপমার আকার নিয়ে বেরিয়ে আসবে। এমনকি, যেসব কথা আমরা সমাজে বলতে কিন্তু কিন্তু করি, পরমহংসদেব সর্বজনসমক্ষে অক্লেশে সেগুলো বলে যেতেন। ভগবানকে পেতে হলে কী ধরনের ‘বেগে’র প্রয়োজন সে সম্বন্ধে তাঁর তুলনাটি উল্লেখ এখানে না-ই বা করলুম।

ঠিক এইখানেই আমরা একটি মূল সূত্র পাব। তিনি জনগণের ধর্ম (ফোক রিলিজিয়ন), আচার-ব্যবহার, ভাষা– সব জিনিসকেই তার চরম মূল্য দেবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন বলেই জনগণের ভাষা, বাচনভঙ্গি সানন্দে ব্যবহার করে যেতেন। জনগণের অন্যায়-অধর্ম তিনি স্বীকার করতেন না। কিন্তু যেখানে শুধুমাত্র রুচির প্রশ্ন সেখানে তিনি ‘ধোপ-দুরন্ত’ ‘ফিটফাট’ হবার কোনও প্রয়োজন বোধ করতেন না। ভাষাতে সে-দিনকার ‘ছুঁৎবাই’ রোগ আমরা পেয়েছিলুম ভিক্টোরীয় রিটানিজম থেকে– তখন কে জানত পঞ্চাশ বছর যেতে-না-যেতেই লরেন্স জয়েস এসে আমাদের ছুঁৎবাইয়ের ‘ভণ্ডামি’ লণ্ডভণ্ড করে দেবেন।(১০)

পরমহংসদেব গণধর্ম স্বীকার করে তার চরম মূল্য দিলেন। সাকার উপাসনা গণধর্মের প্রধান লক্ষণ। বাঙালি সেই সাকারের পূজা করে প্রধানত কালীরূপে। কালীমূর্তি দেখলে অ-হিন্দু রীতিমতো ভয় পায়। পরমহংসদেব সেই কালীকে স্বীকার করলেন।

অথচ ‘দূরের কথা’ বিচার করলে আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি বলে পরমহংসদেব আসলে বেদান্তবাদী। কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি, এ তিন মার্গ তিনি আস্থাভেদে একে-একে বরণ করতে বলেছেন। কিন্তু সবকিছু বলার পর তিনি সর্বদাই বলেছেন, ‘কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত ব্রহ্ম ব্যতীত সবকিছু মিথ্যা বলে অনুভব করতে পারনি ততক্ষণ পর্যন্ত সাধনার সর্বোচ্চ স্তরে উঠতে পারবে না। ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা’ বড় কঠিন পথ। জগৎ মিথ্যা হলে তুমিও মিথ্যা, যিনি বলেছেন তিনিও মিথ্যা, তাঁর কথাও স্বপ্নবৎ। বড় দূরের কথা।’

‘কীরকম জানো, যেমন কর্পূর পোড়ালে কিছুই বাকি থাকে না। কাঠ পোড়ালে তবু ছাই বাকি থাকে। শেষ বিচারের পর সমাধি হয়। তখন “আমি” “তুমি”, “জগৎ”, এসবের খবর থাকে না।’

অথচ গণধর্মে নেমে এসে বলেছেন, “যিনি ব্রহ্ম, তিনিই কালী’। যখন নিষ্ক্রিয়, তাঁকে ব্রহ্ম বলে কই। যখন সৃষ্টি স্থিতি, প্রলয় এইসব কাজ করেন, তাঁকে শক্তি বলে কই। স্থির জল ব্রহ্মের উপমা। জল হেলছে দুলছে শক্তি বা কালীর উপমা। ‘কালী সাকার আকার নিরাকার’। তোমাদের যদি নিরাকার বলে বিশ্বাস, কালীকে সেইরূপ চিন্তা করবে।(১১) আর একটি কথা– তোমার নিরাকার বলে যদি বিশ্বাস, দৃঢ় করে তাই বিশ্বাস কর কিন্তু মতুয়ার (dogmatism) বুদ্ধি কর না। তাঁর সম্বন্ধে এমন কথা জোর করে বল না যে তিনি এই হতে পারেন, আর এই হতে পারেন না। বল আমার বিশ্বাস তিনি নিরাকার, আর কত কী হতে পারেন তিনি জানেন। আমি জানি না, বুঝতে পারি না।(১২)

জনগণপূজ্য শক্তির সাকার সাধনা (‘পৌত্তলিকতা’ শব্দটা সর্বা বর্জনীয় এটাতে তাচ্ছিল্য এবং ব্যঙ্গের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে) স্বীকার করে পরমহংসদেব তৎকালীন ধর্মজগতের ভারসাম্য আনয়ন করলেন বটে কিন্তু প্রশ্ন, জড়সাধনার অন্ধকার দিকটা কি তিনি লক্ষ করলেন না?

এইখানেই তাঁর বিশেষত্ব এবং মহত্ত্ব। এই সাকার-সাধনার পশ্চাতে যে জ্ঞেয়-অজ্ঞেয় ব্রহ্মের বিরাট মূর্তি অহরহ বিরাজমান, পরমহংসদেব বারবার সেদিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এই ভারসাম্যই ব্ৰহ্মজ্ঞানী কেশব সেন, বিজয়কৃষ্ণ এবং তাদের শিষ্যদের আকর্ষণ করতে পেরেছিল। তিনি যদি ‘মতুয়া’ কালীপূজক হতেন তবে তিনি পরমহংস হতেন না।

বস্তৃত একটি চরম সত্য আমাদের বারবার স্বীকার করা উচিত : যেইখানেই যেকোনো মানুষ যেকোনো পন্থায় ভগবানের সন্ধান করেছে তাকেই সম্মান জানাতে হয়। এমনকি ক্ষুদ্র শিশু যখন সরস্বতীর দিকে তাকিয়ে তার সাহায্য কামনা করে (হায়, কলকাতায় সরস্বতী পূজার বাহ্য আড়ম্বর দেখে অনেক সময় মনে হয়, এরাই বুঝি এ যুগে দেবীর একমাত্র সাধক) তাকেও মানতে হয়– গাছের পাতা, জলের ফোঁটা যখন মানুষ মাথায় ঠেকায় তার বিলক্ষণ মূল্য আছে। গীতাতে এ সত্যটি অতি সরল ভাষায় বলা হয়েছে।

কিন্তু সাকার-নিরাকার নিয়ে আজ আর তর্ক করে লাভ কী? বাঙলা দেশে আজ আর কজন লোক নিরাকার পূজা করেন তার খবর বলা শক্ত কারণ সে পূজা হয় গৃহকোণে, নির্জনে। আর কলকাতায় বারোয়ারি সাকার পূজার যা আড়ম্বর তা দেখে বাঙলার কত গুণীজ্ঞানী যে বিক্ষুব্ধ হন তার প্রকাশ খবরের কাগজে প্রতি বৎসর দেখি। এইমাত্র নিবেদন করেছি, এরও মূল্য আছে– তাই আমার এক জ্ঞানী বন্ধু বড় দুঃখে বলেছিলেন, কিন্তু কী ভয়ঙ্কর স্ট্রেন করে এস্থলে সে সত্যটি স্বীকার করি।’

সাকার-নিরাকারের আধ্যাত্মিক মূল্য যা আছে তা আছে, কিন্তু এই দ্বন্দ্ব সমাধানের সামাজিক মূল্য কী?

হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, ব্রাহ্ম সকলেই বাঙালি সমাজে সমান অংশীদার। এঁদের ধর্মাচরণ যা-ই হোক না কেন, সমাজে তারা মেলামেশা করছেন অবাধে। একবার ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে এই সহজ মেলামেশা না থাকলে খ্রিস্টান মাইকেল, মুসলমান মুশররফ হুসেন, নজরুল ইসলাম এবং জসীম উদ্‌দীন বাঙলা কাব্যে খ্যাতি অর্জন করতে পারতেন না। সমঝদার ও রসিক জনের গুণগ্রাহিতা ও উৎসাহ লাভ না করে কম কবিই এ সংসারে সার্থক কাব্য সৃষ্টি করতে পেরেছেন। এবং এঁদের সকলেরই উৎসাহী পাঠক এবং গুণগ্রাহী বন্ধু ছিলেন প্রধানত হিন্দুরাই।(১৩)

আধ্যাত্মিক, সামাজিক, রাজনৈতিক যেকোনো মতবৈষম্যের ফলে যদি ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়। একই সমাজের ভিতর অন্তরঙ্গ ভাব বর্জন করেন তবে সেই অখণ্ড, সমগ্র সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি—‘মহতী বিনষ্টি’ হয়; এই তত্ত্বটি সম্বন্ধে সে যুগে কয়জন গুণী সচেতন ছিলেন। মুসলমান সাকার মানে না, কিন্তু তাই বলে তো সে যুগে বাঙালি সমাজের হিন্দু-মুসলমানের মিলন ক্ষুণ্ণ হয়নি? তবে কেন ওই কারণেই ব্রাহ্মে-হিন্দুতে সামাজিক অন্তরঙ্গ গতিবিধি বন্ধ হবে?

পরমহংসদেব এই বিরোধ নির্মূল করতে চেয়েছিলেন বলেই সাকার-নিরাকারের অর্থহীন, অপ্রিয় আলোচনা বর্জন করেননি। তাই বারবার দেখি; তিনি আপন হিন্দু ভক্তবৃন্দ নিয়েই সন্তুষ্ট নন। বারবার দেখি, তিনি উদগ্রীব হয়ে জিগ্যেস করছেন, বিজয় কোথায়, শিবনাথ যে বলেছিল আসবে, বলছেন কেশব আমার বড় প্রিয়। অথচ তিনি তো ব্রাহ্ম ভক্তদের ‘কালীকাল্টে’ কনভার্ট করার জন্য কিছুমাত্র ব্যগ্র নন। তিনি সর্বান্তঃকরণে কামনা করেছিলেন, এদের বিরোধ যেন লোপ পায়।(১৪)

আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস, এই দ্বন্দ্ব অপসারণে অদ্বিতীয় কৃতিত্ব পরমহংসদেবের।

সামাজিক দ্বন্দ সম্বন্ধে এতখানি সচেতন পুরুষ যে তার অর্থনৈতিক সমস্যা সম্বন্ধে সচেতন থাকবেন এ কখনওই হতে পারে না। পক্ষান্তরে, আবার অন্য সত্যও সর্বজন বিদিত– কামিনী-কাঞ্চনে পরমহংসের তীব্র বৈরাগ্য। তার থেকেই ধরে নিতে পারি, অর্থ সমস্যা আপন সত্তায় (Per se) তাঁর সামনে উপস্থিত হয়নি। যারা মুখ্যত অর্থ কামনা করে রামকৃষ্ণদেব তো তাদের উপদেষ্টা নন। যাঁরা মুখ্যত ধর্মজিজ্ঞাসু অথচ অর্থসমস্যায় কাতর তিনি তাদের সে দ্বন্দ্ব সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। কাজেই পরোক্ষভাবে তিনি সমাজের অর্থনৈতিক প্রশ্নেরও সমাধান দিয়েছেন। যে যতখানি কাজে লাগাতে পেরেছে ততখানি উপকার পেয়েছে।

রামকৃষ্ণদেব বহুবার বলেছেন, ‘কলিকালে মানবের অনুগত প্রাণ’। এর অর্থ আর কিছুই নয়– এর সরল অর্থ, ইংরেজের শোষণনীতির শোচনীয় পরিণাম বাঙালির মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় তখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছে। অন্নাভাবে সে তখন এমনই কাতর যে অন্য কোনও চিন্তার স্থান আর তার মস্তকে নেই। যাঁরা ধর্মে অনুরক্ত তারা বারবার পরমহংসদেবকে প্রশ্ন করেছেন, ‘উপায় কী?’

পূর্বেই বলেছি তিনি ছিলেন বেদান্তবাদী। তা হলে তাঁর কাছ থেকে উত্তর প্রত্যাশা করতে পারি যে, জগৎ মায়া-মিথ্যা অনুমিত হলেই অর্থের প্রয়োজন আপনার থেকেই ঘুচে যাবে। কিন্তু তিনি বলেছেন, পাখির মতো দাসীর মতো সংসারের কাজ করে যাবে, কিন্তু মন পড়ে রইবে ভগবানের পায়ের তলায়। অর্থাৎ কলিযুগে সমাজের সে সচ্ছলতা নেই যে তোমাকে অন্ন জোটাবে আর তুমি নিশ্চিন্ত মনে জ্ঞানমাগে আপন মুক্তির সন্ধান পাবে। কলির মানুষের কর্ম থেকে মুক্তি নেই।

ওদিকে যেসব ব্রাহ্ম ভক্তের অর্থাভাব ছিল না, যাঁরা ব্রহ্মজ্ঞানের তপস্বী তাঁদের বারবার বলেছেন, ঈশ্বরকে ব্যাকুল হয়ে ডাকো। কলিযুগে ভক্তি ভিন্ন গতি নেই।

আর সকলকেই একথা বলেছেন, এই জন্মেই যারা সাধনার সর্বশেষ স্তরে পৌঁছতে চায়– রাখাল, নরেন্দ্রের মতো যারা জন্মাবধি জীবন্মুক্ত তাদের কজন বাদ দিলে, আর কটি প্রাণী সে স্তরে পৌঁছতে পারবে সে বিষয়ে তাঁর মনে গভীর সন্দেহ ছিল– তাদের হতে হবে নিরঙ্কুশ জ্ঞানমার্গের সাধক। শুদ্ধ জ্ঞানের সাহায্যে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে, ব্রহ্ম ভিন্ন নিত্যবস্তু কিছুই নেই।

পূর্বেই নিবেদন করেছি, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে সমগ্রভাবে উপলব্ধি করার ক্ষমতা আমার নেই। একথা স্বীকার করেও যদি দম্ভভরে কিছু বলি, তবে বলব, যে সাধক গীতোক্ত কর্ম, জ্ঞান এবং ভক্তির সমন্বয় করতে পেরেছেন তিনি সমগ্র পুরুষ– পরম পুরুষ। কোনও মহাপুরুষকে যদি দম্ভভরে যাচাই করতে চাই, তবে এই তিনটির সমন্বয়েই সন্ধান করব। তার কারণ গীতাতে এই তিন পন্থা উল্লিখিত হওয়ার পর আজ পর্যন্ত অন্য কোনও চতুর্থ পন্থা আবিষ্কৃত হয়নি। এ তিন পন্থার সমন্বয়কারী শ্রীকৃষ্ণের সহচর। তাঁর নাম শ্রীরামকৃষ্ণ।

***

যে পাঠক ধৈর্য সহকারে আমার প্রগলভতা এতক্ষণ ধরে শুনলেন তিনি কৌতূহলবশত স্বতই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন, ‘এ তো হল মানুষের সংসর্গে আগত সমাজে সমুজ্জ্বল রামকৃষ্ণদেব। কিন্তু যেখানে তিনি একা– তাঁর সাধনার লোকে তিনি কতখানি উঠতে পেরেছিলেন? সোজা বাংলায়, ‘তিনি কি ভগবানকে সাক্ষাৎ দেখতে পেয়েছিলেন?’

এর উত্তরে বলব, মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করি, এ প্রশ্নের উত্তর দেবার অধিকার আমাদের কারওরই নেই। এ প্রশ্নের উত্তর জ্ঞানবুদ্ধির অগম্য। রামকৃষ্ণের সমকক্ষজনই এর উত্তর দিতে পারেন।

রামকৃষ্ণদেব বলেছেন, ‘সাধনার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছনোর পরও কোনও কোনও মানুষ লোকহিতার্থে সংসারে ফিরে আসেন। যেমন নারদ শুকদেবাদি।’ একথা ভুললে চলবে না।

স্পষ্টত দেখতে পাচ্ছি, একথাটি স্বামী বিবেকানন্দের মনে গভীর দাগ কেটে গিয়েছিল। লোকহিতার্থে তিনি যে বিরাট শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন নির্মাণ করে যান, এরকম সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান প্রভু তথাগতের পর এযাবৎ কেউ নির্মাণ করেননি।

***

এইবারে শেষ প্রশ্ন দিয়ে প্রথম প্রশ্নে ফিরে যাই।

পরমহংসদেব গীতার তিন মার্গের সমন্বয় করেছিলেন। প্রকৃত হিন্দু সেই চেষ্টাই করবে। কিন্তু তিনি যে ধুতিখানাকে লুঙ্গির মতো পরে আল্লা-আল্লাও করেছিলেন এবং আপন ঘরে টাঙানো খ্রিস্টের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতেন সেকথাও তো জানি। এসবের প্রতি তাঁর অনুরাগ এল কোথা থেকে? বিশেষত যখন একাধিকবার বলা হয়েছে, অ-হিন্দু মার্গে চলবার সময় পরমহংসদেব কায়মনোবাক্যে সেই মার্গকেই বিশ্বাস করতেন।

অনেকের বিশ্বাস চতুর্বেদে বহু দেব-দেবীতে বিশ্বাস অর্থাৎ পলিথেইজমের বর্ণনা আছে। কিন্তু ম্যাক্সমুলার দেখিয়েছেন ঋগ্বেদের ঋষি যখন ইন্দ্রস্তুতি করেন তখন তিনি বলেন—‘হে ইন্দ্র, তুমিই ইন্দ্র, তুমিই অগ্নি, তুমিই বরুণ, তুমি প্রজাপতি, তুমিই সব।’

আবার যখন বরুণমন্ত্র শুনি, তখন সেটিতেও তাই– ‘হে বরুণ, তুমিই বরুণ, তুমিই ইন্দ্র, তুমিই প্রজাপতি, তুমিই সব।’ অর্থাৎ ঋষি যখন যে দেবতাকে স্মরণ করেছেন তখন তিনিই তার কাছে পরমেশ্বররূপে দেখা দিয়েছেন। এ সাধনা বহু-ঈশ্বরবাদের নয়। এর সন্ধান অন্য দেশে পাওয়া যায় না বলে ম্যাক্সমুলার এর নতুন নাম করেছিলেন, ‘হেনোথেয়িজম’।

পরমহংসদেব বেদোক্ত এই পন্থাই বরণ করেছিলেন অর্থাৎ সনাতন আর্য-ধর্মের প্রাচীনতম শ্রুতিসম্পন্ন পন্থা বরণ করেছিলেন। তিনি যখন বেদান্তবাদী তখন বেদান্তই সব কিছু, আবার যখন আল্লা আল্লা করেছেন তখন আল্লাই পরমাল্লা।

এই করেই তিনি সর্বধর্মের রসাস্বাদন করে সর্বধর্ম সমন্বয় করতে পেরেছিলেন।

কোনও বিশেষ শাস্ত্রকে সর্বশেষ, অভ্রান্ত, স্বয়ংসম্পূর্ণ শাস্ত্র বলে স্বীকার করে তিনি অন্য সবকিছুর অবহেলা করেননি।

অনেকের বিশ্বাস, হিন্দু আপন ধর্ম নিয়েই সন্তুষ্ট, অন্য ধর্মের সন্ধান সে করে না।

বহু শতাব্দীর বিজয়-অভিযান ঘাত-প্রতিঘাতের ফলে এযুগের হিন্দু সম্বন্ধে একথা হয়তো খাটে। তাই পরমহংসদেব আপন জীবন দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, সনাতন আর্যধর্ম এ পন্থা কখনও গ্রাহ্য করেনি।

সত্য সর্বত্র বিরাজমান, ঋগ্বেদের এই বাণী, শ্রীরামকৃষ্ণে তারই প্রতিধ্বনি। সর্বত্র এর অনুসন্ধানে সচেতন থাকলে বাঙালি পরমহংসদেবের অনুকরণ অনুসরণ করে ধন্য হবে। বাকিটুকু দয়াময়ের হাতে।

————

১. বর্তমান লেখকের মনে সন্দেহ আছে, শাক্য মুনির আবির্ভাবের ঠিক পূর্বেই এই পরিস্থিতি হয়েছিল। বৈদিক ভাষা তখন প্রায় অবোধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলেই ক্রিয়াকর্ম-যাগযজ্ঞ-পশুহত্যা তখন সত্য-ধর্মের স্থান অধিকার করে বসেছিল। বুদ্ধদেব তখন এরই বিরুদ্ধে সত্যধর্ম প্রচার করেন ও সর্বজনবোধ্য লোকায়ত প্রাকৃত (পরে পালি নামে পরিচিত) ভাষার শরণ নেন।

২. শ্রীশ্রীপরমহংসদেবের গাওয়া গান এরই কাছাকাছি :

আপনাতে আপনি থেকো মন যেও নাকো কারু ঘরে
যা চাবি তা বসে পাবি, খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে।
 শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, অনিল গুপ্ত সংস্করণ, ১ম খণ্ড, ২১৩ পৃ.।

৩. শ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয় কথার আড়।

৪. দারা তাঁর অতুলনীয় ধর্মগ্রস্থ আরম্ভ করেছেন এই বলে : ‘হে প্রভু, তুমি তোমার সুন্দর মুখ কুফর (অবিদ্যা) কিংবা ইমান (বিদ্যা) দু পাশের কোনো অলকগুচ্ছ (জুলুফ) দিয়ে ঢেকে রাখনি’। এই শ্লোক ঈশোপনিষদের ‘অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যেহ বিদ্যামুপাসতে। ততো ভূয় ইব তে তমো ষ উ বিদ্যায়াং রতাঃ ॥’-রই অনুবাদ

৫. বস্তুত, সম্পূর্ণ নতুন ধর্ম পৃথিবীতে কোনো মহাপুরুষ কখনোই আরম্ভ করেননি। বুদ্ধদেব বলতেন, তাঁর পূর্বে বহু বুদ্ধ জন্ম নিয়েছেন, মহাবীর জৈনদের সর্বশেষ তীর্থঙ্কর বা জিন। খ্রিস্ট বলেন, তিনি বিধির বিধান ভাঙতে আসেননি– তিনি এসেছেন তাকে পূর্ণরূপ দান করতে। হজরত মুহম্মদ বলতেন, তার পূর্বে সহস্র পয়গম্বর আবির্ভূত হয়েছেন। বস্তুত এঁদের কেউ বলেননি, আমি প্রথম। প্রায় সকলেই বরঞ্চ বলেছেন, আমিই শেষ।

 ৬. একটা অবিশ্বাস্য গল্প শুনেছি, কোনো ব্রাহ্ম ভক্ত নাকি কদম্বতরুকে ‘অশ্লীল বৃক্ষ’ নাম দিয়েছিলেন। কিন্তু এর থেকে অন্তত এইটুকু বোঝা যায়, হিন্দুরা ব্রাহ্মদের ‘গোঁড়ামি’ সম্বন্ধে তখনকার দিনে কী ধারণা পোষণ করতেন।

৭. রাজনীতির ক্ষেত্রে এই শিক্ষিত-অশিক্ষিতের ব্যবধানের জন্য আমরা যে কী কর্মফল ভোগ করেছি, সে তথ্যের উত্থাপন এস্থলে অবান্তর।

৮. আমাদের ব্যক্তিগত প্রার্থনা, তাই যেন হয়। বাউল গেয়েছেন, ‘যে জন ডুবল, সখী, তার কী আছে আর বাকি গো?’ ঠাকুরও প্রায়ই গাইতেন ‘ডোব ডোব, ডোব।’

৯. এক চীনা সাধক এরই কাছাকাছি এসে বলেছেন, ‘মাই কাপ ইজ স্মল; বাট আই ড্রিঙ্ক অফনার।’

১০. বিদ্যাসাগর মহাশয় এ দ্বন্দ্বের সমাধান না করতে পেরে দু রকম ভাষাই ব্যবহার করতেন। ‘সীতার বনবাসে’র ভাষা সকলেই চেনেন, কিন্তু যেখানে তিনি রামা-শ্যামাকে বিধবাবিবাহের শত্রুদের বিপক্ষে ক্ষেপাতে চেয়েছেন, সেখানে ‘কস্যচিৎ ভাই-পোষ্য’ এই বেনামিতে, ‘ফাজিল-চালাক’, ‘দিলদরিয়া তুখোড় ইয়ার’, ‘তার একটি বেদড়া মন্ত্রী আছে–এটি তারই ত্যাঁদড়ামি’, ‘লোকটা লক্ষ্মীছাড়া বক্কেশ্বর আনাড়ির চূড়ামণি বে অকুফের শিরোমণি’। ইত্যাদি গ্রাম্য বাক্য পরমানন্দে ব্যবহার করেছেন। তিনি যেসব আদিরসাত্মক গল্প ছাপায় (!) প্রকাশ করেছেন সেগুলো সমাজে বললে এখনো সমূহ বিপদের সম্ভাবনা।

১১. শক্তিকে নানা দেশের কবি এবং সাধকগণ নানারূপে কল্পনা করেছেন। কাব্যে বিবেকানন্দের কবিতাই শ্রেষ্ঠতম।

মৃত্যুরূপা মাতা
‘নিঃশেষে নিবিছে তারাদল, মেঘ এসে আবরিছে মেঘ,
স্পন্দিত, ধ্বনিত অন্ধকার, গরজিছে ঘূর্ণবায়ু-বেগ!
লক্ষ লক্ষ উন্মাদ পরান বহির্গত বন্দিশালা হতে,
 মহাবৃক্ষ সমূলে উপাড়ি ফুঙ্কারে উড়ায়ে চলে পথে।
সমুদ্র সংগ্রামে দিল হানা, ওঠে ঢেউ গিরিচূড়া জিনি’
 নভস্তল পরশিত চায়। ঘোররূপা হাসিছে দামিনী,
প্রকাশিছে দিকে দিকে তাঁর মৃত্যুর কালিমামাখা গায়
লক্ষ লক্ষ ছায়ার শরীর!– দুঃখরাশি জগতে ছড়ায়–
নাচে তারা উন্মাদ তাণ্ডবে; মৃত্যুরূপা মা আমার আয়।
 করালী। করাল তোর নাম, মৃত্যু তো নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে;
তোর ভীম চরণ-নিক্ষেপ প্রতি পদে ব্রহ্মাণ্ড বিনাশে
কালী, তুই প্রলয়রূপিণী, আয় মা গো, আয় মোর পাশে
 সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়– মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে
কালনৃত্য করে উপভোগ—-মাতৃরূপা তারি কাছে আসে’। (সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনুবাদ)

ইংরেজিতে এর প্রথম ছত্র ‘The Stars are blotted out!’– আশ্চর্য বোধহয় রবীন্দ্রনাথও অতি বাল্যবয়সে (১৪?) কালী সম্বন্ধে একটি কবিতা লিখেছিলেন।

১২. ডগমাটিজম না করে মনকে খোলা এবং জানা-অজানার মাঝখানেই যে সত্য পন্থা- এর উৎকৃষ্ট প্রকাশ কেনোপনিষদে :

‘নাহং মনন্য সুবেদেতি নো ন বেদেতি বেদ চ।
যো নস্তছেদ দে নো ন বেদেতি বেদ চ ॥’।

 ‘আমি এইরূপ মনে করি না যে, আমি ব্ৰহ্মকে উত্তমরূপে জানিয়াছি; অর্থাৎ “জানি না” ইহাও মনে করি না, এবং “জানি” ইহাও মনে করি না। ‘জানি না যে তাহাও নহে– এবং জানি যে তাহাও নহে’ আমাদের মধ্যে যিনি এই বচনটির মর্ম জানেন, তিনিই ব্রহ্মকে জানেন।’– গম্ভীরানন্দ।

১৩. পূর্ববর্তী যুগে পরাগল, ছুটি খাঁর মতো মুসলমান গুণগ্রাহী ছিলেন বলেই হিন্দুরা মহাভারত অনুবাদ করেছিলেন; পরবর্তী যুগে হিন্দু সমঝদার ছিলেন বলেই সৈয়দ মরতুজা প্রমুখ বহুতর মুসলমান বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শ্রীযতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবিগণ এ সম্বন্ধে অত্যুকৃষ্ট পুস্তিকা দ্রষ্টব্য।

১৪, এ বিষয়ে পরমহংসদেব কতখানি নাছোড়বান্দা ছিলেন তার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ অনুসন্ধিৎসু পাঠক পাবেন, অনিল গুপ্ত সংস্করণ, চতুর্থ খণ্ডের চতুর্থ ভাগে। পাঠক তখন ‘নাছোড়বান্দা’র সত্যপ্রয়োগ সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হবেন।