বাঙালি

বাঙালি

এই যে কলকাতা। জয় মা গঙ্গা!

আর যেন মা তোমায় কুলত্যাগ করে ভিন-দেশে যেতে না হয়।

 আহা, মাইকেল কী কবিতাই না রচেছিলেন–

‘আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়।
তাই ভাবি মনে–’

কিন্তু আশাকে আমি দোষ দিইনে। আশাকে তখনই দোষ দেওয়া যায়, যখন মানুষ হেথাকার শান্তি-সুখ বর্জন করে হোথাকার খ্যাতি প্রতিপত্তির জন্য ছোটে। কিন্তু বঙ্গসন্তান মাত্রই কলকাতা ছাড়ে পেটের দায়ে। হেথায় অন্ন জুটছে না বলেই সে হোথাপানে ধেয়ে যায়– হায়, তার জীবনে স্বাধীনতা কোথায়? তার জীবন’ কথাটিই ভুল। তা না হলে আজ ঢাকার পয়সাওলা ছেলে কলকাতার রাস্তায় ফ্যাফ্যা করছে কেন? কলকাতার বাচ্চাই-বা দিল্লির এর দোরে ওর দোরে হানা দিচ্ছে কেন? তার জীবন তো এখন দৈন্যের জীবন, দু মুঠো অন্নের কাছে গচ্ছিত, একটুকরো কাপড়ের কাছে বেচে দেওয়া।

কিন্তু থাক এসব অপ্রিয় আলোচনা। আপনাদের ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে, আপনারা শাক বাজান আর নাই বাজান ‘মম চিত্ত মাঝে’ ঘন ঘন শাঁক বাজছে।

বড় ব্যক্তিগত হয়ে যাচ্ছে– না? তবে কি না আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, যার জন্মদিন, তা সে পাঁচ বছরের ছেলেই তোক সেদিন সে রাজা। তার চতুর্দিকে সেদিন পর্ব জমে ওঠে, তাকেই সবাই কথা কইতে দেয়। আজ কলকাতায় আমার পুনরায় নবজন্মদিনে আমার সহৃদয় পাঠকরা আমার ভ্যাচর ভ্যাচর কিঞ্চিৎ বা বরদাস্ত করে নেবেন বইকি। শাস্ত্রেরও তার ব্যবস্থা আছে। আমি স্মার্ত নই, তাই আবছা-আবছা মনে পড়ছে, কেউ চৌদ্দ বৎসর (কিংবা সাতও হতে পারে) নিরুদ্দেশ থাকে, তবে তার শ্রাদ্ধ করতে হয়, কিন্তু তার পর যদি হঠাৎ সে ফিরে আসে, তবে তার জন্য নতুন করে জন্মোৎসব ইত্যাদি যাবতীয় ক্রিয়া কর্ম করতে হয়। তাকে মাতৃগর্ভস্থ ছোট বাচ্চাটির মতো দু মুঠো বন্ধ করে আস্তে আস্তে ভূমিষ্ঠ হওয়ার ভান করতে হয়। তার নামকরণ, চূড়াকরণ, এমনকি নতুন করে উপনয়নও হয়। মনে পড়ছে না, তবে বিবেচনা করি, ব্রহ্মচর্যের পর তাকে পুনরায় তার স্ত্রীকে বিয়েও করতে হয়– বিলিতি ধরনের সিলভার, গোল্ডেন ওয়েডিংয়ের মতো। তাতেই-বা কী কম আনন্দোল্লাস, অবশ্য সবকিছুই হয় ঘণ্টাখানেকের ভেতর। এ সবক’টা ব্যবস্থাই আমার বড়ই মনঃপূত, ভাবতে গেলেই হৃদয় প্রসন্ন হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যখন বাচ্চাটির অর্থাৎ লোকটার মায়ের ছবি মনের ওপর ভেসে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের ভাষা একটু পরিবর্তন করে বলি, তিনিও কি সেদিন বধূ-বেশ পরে সীমান্তর উপর অর্ধাবগুণ্ঠন টেনে নিয়ে অন্যান্য অন্তঃপুরিকা কুললক্ষ্মীদের ন্যায় প্রসন্নকল্যাণ মুখে মাঙ্গল্য রচনায় নিরতিশয় ব্যস্ত হন না?

কিন্তু হায় যার মা নেই?

দিল্লি ভালো জায়গা; ভালোবাসি কিন্তু কলকাতাকে।

আসানসোল কিংবা বর্ধমানের কাছে রেলগাড়িতে ঘুম ভাঙল। আগের রাত্রে যুক্ত প্রদেশের কোনও নাম-না জানা জায়গায় ঘুমিয়ে পড়েছিলুম মনে গভীর প্রশান্তি নিয়ে যে, পরদিন সকালবেলাই চোখ মেলব বাঙলা দেশে; তাই না জাগলে আমি হাওড়া পেরিয়ে, শেয়ালদা ছাড়িয়ে যে কহাঁ হাঁ মুলুকে চলে যেতুম, তার খবর কি আই.বি. পর্যন্ত রাখতে পারত? ডাক্তাররা বলেন, মনের শান্তি সর্বোত্তম নিদ্রাদায়িনী– ওনারা তত্ত্বটা লাতিনে বলেন বলে আমি অনুবাদটি ঈষৎ সংস্কৃত-ঘেঁষা করে দিলুম। ঘুম কেন বর্ধমানের কাছাকাছি ভাঙল সেকথাও নিবেদন করছি। চায়ের গন্ধ পেয়ে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, আসাম-বাংলার বাইরে কেউ চা তৈরি করতে জানে না বাংলা প্ল্যাটফর্মের রদ্দি চা-ও দিল্লি-লাহোরের উত্তম উত্তম খানদানি পরিবারের চা-কে খুশবাইতে হার মানাতে পারে। বাংলার চায়ের খুশবাই ঘুম ভাঙাল।

চোখ খুলে দেখি সমুখে বাংলা।

অবশ্য মানতে হবে যুক্তপ্রদেশ-বিহার দুম করে বাঙলা দেশে পরিবর্তিত হয় না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যদি ‘আলোক-মাতাল স্বর্গ-সভার মহাঙ্গন থেকে’ ‘কালের সাগর’ পাড়ি দিয়ে এক মুহূর্তেই শ্যামল মাটির ধরাতলে চলে আসতে পারেন তবে আপনিই-বা কেন এক ঘুমের ডুব-সাঁতার কেটে এলাহাবাদ থেকে বর্ধমান পৌঁছতে পারবেন না? এমনকি, গেল রাত্রিতে যে-লোকটা আপনার কামরায় ঢুকে উপরের বার্থে শুয়েছিল, যাকে আপনি ‘ছাতু’ ভেবে অবহেলা করেছিলেন, সে ব্যক্তি বর্ধমানে পৌঁছে দেখবেন দিব্যি বাংলা বলতে আরম্ভ করছে। আপনার জানটা অকারণে খুশ হয়ে যাবে, গায়ে পড়ে বলবেন, ‘এক কাপ চা হবে স্যার!’

পাঞ্জাবিদের তুলনায় এরা কালো, বেঁটে, রোগা, অনেকেই হাড্ডিসার, এদের সুট কেনার পয়সা নেই, যদি-বা থাকে তবু মাসে দু বার করে প্রেস করিয়ে ব-তরিবত পরতে জানে না, এদের রমণীরা এখনও সেই মান্ধাতার আমলের শাড়ি-ব্লাউজ পরে, পেট-কাটা এক বিঘতি কাঁচুলির উপর অবহেলার দোপাট্টা ফেলে এরা গ্যাট-ম্যাট করে হাঁটতে শিখলে না, এদের বাচ্চারা উঁশ উচ্চারণে ‘ড্যাডি’ ‘মাম্মি’ ‘ও কে’ ‘নো কে’ বলতে শিখলে না— এরাই বাঙালি।

দিল্লির লোক একদা মাংস-রুটি খেত; এখনও তারা রুটি-মাংসই খায়। শুনেছি বাঙালিরা নাকি এককালে মাছ-ভাত খেত। ঠিক বলতে পারব না, এখনও খায় কি না! রেশনে যে-বস্তু পাওয়া যায়, তাকে চাল বলে তারা তাদের বাপ-পিতেমোর খাদ্য চালকে অসম্মান করতে চায় না। এই কিছুদিন পূর্বে হঠাৎ কিছু মাছ ধরা পড়াতে বাঙালি উদ্বাহু হয়ে যে নৃত্যটা দেখালে, তাতে মনে হল– আমি দিল্লিতে বসে ‘আনন্দবাজারে’ পড়েছিলুম– যেন স্বয়ং উর্বশী স্বর্গ থেকে সুধাভাণ্ড নিয়ে বাঙলা দেশে অবতীর্ণ হয়েছেন! ছেলেবেলায় দেখেছি, উদ্বৃত্ত মাছ পচিয়ে পোড়াবার জন্য তেল আর ক্ষেতে দেবার জন্য সার তৈরি করা হয়েছে। যাঁরা এসব করেছেন, তাঁরাও বাঙালি, এরাও বাঙালি।

এককালে এ দেশের শিক্ষিত লোকমাত্রই সংস্কৃত জানতেন কিংবা আরবি-ফার্সি জানতেন। ঊনবিংশ শতকে বাঙলা দেশে যে সাহিত্য গড়ে উঠল, যার তুলনা ভারতের অন্য কোনও প্রদেশে নেই– সে এমারত গড়াতে চুনসুর্কি জোগালে সংস্কৃত এবং কিছুটা আরবি-ফার্সি, আজ সে সৌধের স্তম্ভ তোরণ দেখে বাঙালি মুগ্ধ, কিন্তু শুনতে পাই, দু মুঠো অনের জন্যে সে আজ এতই কাতর যে, জোর করেও তাকে আজ আর সংস্কৃত পড়ানো যাচ্ছে না। তবে একথা ঠিক, তাই নিয়ে সে লজ্জা অনুভব করে, খবরের কাগজে প্রকাশিত চিঠিতে তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। (রাষ্ট্রভাষার পীঠভূমিতে সংস্কৃতচর্চার জন্য চেল্লাচেল্লি হয়, কিন্তু কেউ গা করে না)।

এই লজ্জাটুকু নিয়েই বাঙালি।

তবুও এই বাঙলা দেশ।

 এখনও ধুলো কমেনি, সে ধুলো এখনও লাল, পুরোপুরি বাঙলা দেশ এখনও আরম্ভ হয়নি।

হঠাৎ দেখি লাইনের পাশে পুকুর ভরে রক্তপদ্ম ফুটেছে। সবুজ বাশবনের মাঝখানে ছোট্ট পুকুরটি-কৃষ্ণনীরে রক্ত-সরোজিনী! দিল্লির নিজাম-প্রাসাদের লাল গোলাপের কথাও সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, ক্ষণেকের তরে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল, কিন্তু পরমুহূর্তে মনে পড়ল, তরুণ বয়সে যখন এই অঞ্চলে বসবাস করতে এসেছিলুম তখন প্রথম দর্শনেই এরা আমার হৃদয়ের কতখানি জুড়ে নিয়ে বসেছিল। শরৎ, হেমন্ত, এমনকি, বেশ শীত পড়ার পরও কত দূর পুকুরে পদ্মের সন্ধানে গিয়েছি, কখনও ফিরেছি একটিমাত্র পদ্ম নিয়ে, হাতে ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে, কখনও-বা এক আঁটি বগলে করে। প্রিয়জনকে বিলিয়েছি হাসিমুখে, লোভীজন জোর করে কিছুটা কেড়ে নিয়ে গিয়েছে, ক্ষণেকের তরে ক্ষুণ্ণ হয়েছি কিন্তু বিরক্ত হইনি। ঘরে এসে কলসিতে জিইয়ে রাখবার চেষ্টা করেছি। যতদিন পারা যায়। তার পর তারা একে একে শুকনো মুখে বিদায় নিয়েছে আজ সকালে একজন, কাল সকালে দু জন। বুকে লেগেছে, মনে ভেবেছি, আর পদ্ম আনতে যাব না, আনলেও সব কটি বিলিয়ে দেব, ঘরে রেখে বিদায়-বেদনার ব্যবস্থা করব না।

কিন্তু প্রতিজ্ঞা কি মনে রাখা সোজা? একেই তো জ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন শ্মশান-বৈরাগ্য।

শ্মশান থেকে ফিরে এসে মানুষ আবার কিছুদিন পরে বিয়ে করে সংসার পাতে, আবার বিরহ-বেদনা, মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করে। আমিও শুশান-বৈরাগ্য ভুলে গিয়ে নতুন করে সংসার পেতেছি, আবার তাদের বিদায়-বেলায় স্নান মৃদু গন্ধে বিধুর হয়েছি।

কিন্তু ওই যে লোকে বলে, মার খেতে খেতে মানুষ শক্ত হয়, কই, আমি তো হতে পারলুম না!

তার পর তো দেশ-বিদেশে ঘুরেছি। নরগিস দেখেছি, দায়ুদী কিনেছি, লিলি এঁকেছি, বসরার গোলাপ বুকে গুঁজেছি, বড় বড় ফুলের বাজারের পুষ্প-প্রদর্শনীতে অবাক হয়ে বিদেশি ফুলের জলুস দেখেছি, কিন্তু কখনও বেশিক্ষণের জন্য ভুলে থাকতে পারিনি আমার রক্তপদ্মকে।

বিদেশি বন্ধুরা জিগ্যেস করেছেন মতামত। আমি তাদের ফুলের অকুণ্ঠ প্রশংসা গেয়ে শেষটায় বলেছি, কিন্তু আমাদের পদ্ম ভারি চমৎকার ফুল। এক বন্ধু তখন মৃদু হেসে বলেছিলেন, ‘এ লোকটা বিদেশে ঘোরে স্বদেশ আপন পকেটে রেখে রেখে।’

 এইবার দেশে ফিরেছি। স্বদেশ আর পকেটে পুরে রাখতে হবে না।

জয় মা, গঙ্গে,
ত্রিভুবনতারিণী তরল তরঙ্গে।