ইঙ্গ-ভারতীয় কথোপকথন

ইঙ্গ-ভারতীয় কথোপকথন

দেশে-বিদেশে বহুবার দেখিয়াছি যে, ইংরাজ ও ফরাসির প্রশ্নে ভারতীয় সদুত্তর দিতে পারিতেছেন না। তাহার প্রধান কারণ (১) ভারতীয়রা স্বীয় ঐতিহ্য ও বৈদগ্ধ্যের সঙ্গে সুপরিচিত নহেন– ইহার জন্য প্রধানত আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিই দায়ী। (২) বিদেশি রীতিনীতি সম্বন্ধে অজ্ঞতা– সে জ্ঞান থাকিলে ভারতীয় তৎক্ষণাৎ বিদেশিকে চক্ষে অঙ্গুলি স্থাপন করিয়া দেখাইয়া দিতে পারে যে, সে যাহা করিতেছে তাহা অন্যরূপে বা অল্প কিয়দ্দিন পূর্বে বিদেশিরাও করিত। নিম্নলিখিত কথোপকথন হইতে আমাদের বক্তব্যটি পরিস্ফুট হইবে ও আশা করি কোনও কোনও ভারতীয়ের উপকারও হইবে।

বিদেশি : তোমাকে সেদিন ফির্পোতে দাওয়াত করিয়াছিলাম। তুমি টালবাহানা দিয়া পলাইলে। শুনিলাম, শেষটায় নাকি আমজাদিয়া হোটেলে খাইতে গিয়াছিলে। ফির্পোর খানা রাধে ত্রিভুবনবিখ্যাত ফরাসিস শেফ দ্য কুইজিন। সেই শেফকে উপেক্ষা করিয়া তুমি কোন জংলির রান্না খাইতে গেলে!

ভারতীয় : তোমাদের রান্নার অন্য গুণাগুণ বিচারের পূর্বে একটি অত্যন্ত সাধারণ বস্তুর দিকে তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। লক্ষ করিয়াছ কি না জানি না যে, তোমাদের রান্নায় তিক্ত টক ও ঝাল এই তিন রসের অভাব। অর্থাৎ ছয় রসের অর্ধেক নাই-ঝাল কিছু কিছু দাও বটে কিন্তু তা-ও বোতলে পুরিয়া টেবিলে রাখো, কারণ ওই রসটির প্রতি তোমাদের সন্দেহ ও ভয় এখনও সম্পূর্ণ ঘুচে নাই। কাজেই তোমাদের খানা না খাইয়াই বলা যায় যে, আর যে গুণই থাকুক, বৈচিত্র্য তোমাদের রান্নায় থাকিবে না। শুধু লবণ আর মিষ্ট এই সা, রে লইয়া তোমরা আর কী সুর ভজিবে? দুই-তারা লইয়া বীণার সঙ্গে টক্কর দিতে চাও? আমজাদিয়ার ‘জংলি’ও তাই। তোমার শেকে অনায়াসে হারাইয়া দিবে। দ্বিতীয়ত, তোমাদের ডাইনিং টেবিলে ও রান্নাঘরে কোনও তফাত নাই। তোমরা কুয়েট নামক ভাঙা বোতল–শিশিওয়ালার একটা ঝুড়ি টেবিলের উপর রাখ। নিতান্ত রসকষহীন সিদ্ধ অথবা অগ্নিপকু বস্তু যদি কেহ গলাধঃকরণ না করিতে পারে তবে তাহাকে ডাইনিং টেবিলে পাকা রাঁধুনি সাজিতে হয়। স্নেহজাতীয় পদার্থ সংযোগ করিতে গিয়া অলিভ ওয়েল ঢালো, উগ্রতা উৎপাদনের জন্য রাই সরিষার (মাস্টার্ড) প্রলেপ দাও, কটু করিবার জন্য গোলমরিচের গুঁড়া ছিটাও বোতলটার আবার ছিদ্র রুদ্ধ বলিয়া তাহাকে লইয়া ধস্তাধস্তি করিতে স্কন্ধদেশস্থ অস্থিচ্যুতি ও ধৈর্যচ্যুতি যুগপৎ অতি অবশ্য ঘটে– ভীতু পাঁচক বড় সাহেবের ভয়ে লবণও দিয়াছে কম লক্ষ করিয়াছ কি শতকরা আশিজন সুপ মুখে দিবার পূর্বেই নুন ছিটাইয়া লয়? অতএব লবণ ঢাল। তৎসত্ত্বেও যখন দেখিলে যে ভোদ্রব্য পূর্ববৎ বিস্বাদই রহিয়া গিয়াছে তখন তাহাতে সস্ নামক কিম্ভুতকিমাকার তরল দ্রব্য সিঞ্চন কর। তোমার গাত্রে যদি পাঁচকরক্ত থাকে তুমি তাবৎ প্রলেপসিঞ্চন অনুপানসম্মত বা মেকদার-মাফিক করিতে পারো, কিন্তু আমি বাপু ‘ভদ্রলোকে’র ছেলে, বাড়িতে মা-মাসিরা ওই কর্মটি রান্নাঘরে রন্ধন করিবার সময় করিয়া থাকেন। খানার ঘর আর রান্নাঘরে কি তফাৎ নাই?

সায়েব : রুচিভেদ আছে বলিয়াই তো এত বায়নাক্কা।

ভারতীয়; ওইসব জ্যেষ্ঠতাতত্ত্ব আমার সঙ্গে করিও না। তাই যদি হইবে তবে খানাঘরেই আগুন জ্বালাইয়া লইয়া মাংস সিদ্ধ কর না কেন, গ্রিল কবাব ঝলসাও না কেন? কেহ অর্ধপকু মাংস পছন্দ করে, কেহ পূর্ণপক। সেখানেও তো রুচিভেদ; তবে পাঁচকের হাতে ওই কর্মটি ছাড়িয়া দাও কেন? আসল কথা, এই রুচিভেদ স্বীকার করিয়াও পাঁচক বহুজনসম্মত একটি মধ্যপন্থা বাহির করিয়া লহে ও গুণীরা সেইটি স্বীকার করিয়া অমৃতলোকে পৌঁছেন। রুচিভেদ থাকা সত্ত্বেও গুণীরা শেক্সপিয়র-কালিদাস পছন্দ করেন। কবি কখনও যমক, অনুপ্রাস, উপমা আখ্যানবস্তুর পৃথক পৃথক নির্ঘণ্ট পৃথক পৃথক পুস্তকে দিয়া বলেন না রুচিমাফিক মেকদার-অনুপানযোগে কাব্যসৃষ্টি করিয়া রসাস্বাদন কর।

সায়েব : সে কথা থাকুক। কিন্তু আমজাদিয়ার খানা খাইলে তো হাত দিয়া; সেখানে তো ছুরি-কাঁটার বন্দোবস্ত নাই।

ভারতীয় : না, আছে। ভারতবর্ষ তোমাদের পাল্লায় পড়িয়া দিন দিন এমনি অসভ্য হইয়া পড়িতেছে যে, ভারতীয়রাও ছুরি-কাঁটা ধরিতে শিখিবার চেষ্টা করিতেছে। এ নোংরামি করিবার কী প্রয়োজন তাহা আমি বুঝিয়া উঠিতে পারি না।

সায়েব : নোংরামি? সে কী কথা?

ভারতীয়; নিশ্চয়ই। ওই তো রহিয়াছে তোমার ছুরি, কাঁটা, চামচ; ওই তো ন্যাপকিন। ঘষো আর দেখ, কতটা ময়লা বাহির হয়। আর যেটুকু বাহির হইবে না, তাহা খাদ্যরস সংযোগে অগোচরে পেটে যাইবে। আর আমি আমার আঙুল ঘষি, দেখো কতটা ময়লা বাহির হয়। আর যদি আমার আঙুল ময়লা হয়ই, তবে আমি এখনই টয়লেট ঘরে গিয়ে আচ্ছা করিয়া হাত ধুইয়া লইব। তুমি যদি ছুরি-কাটা লইয়া ওইদিকে ধাওয়া করো তবে ম্যানেজার পুলিশ ডাকিবে, ভাবিবে চৌর্যবৃত্তিতে তোমার হাতেখড়ি হইয়াছে মাত্র। আর শেষ কথাটিও শুনিয়া লও, আমারি আঙুল আমি আমারি মুখে দিতেছি; তুমি যে কাঁটা-চামচ মুখে দিতেছ সেগুলি যে কত লক্ষ পায়োরিয়াগ্রস্তের অধরোষ্ঠে এবং আস্যগহ্বরেও নিরন্তর যাতায়াত করিতেছে তাহার সন্দেশ রাখো কি? চীনারা তোমাদের তুলনায় পরিষ্কার। খাইবার কাঠি সঙ্গে লইয়া হোটেলে প্রবেশ করে।

সায়েব : সেকথা থাকুক (ধুয়া)।

ভারতীয় : হ্যাঁ, আলোচনাটি আমার পক্ষেও মর্মঘাতী। আমারি এক বাঙালি খ্রিস্টান বন্ধু কাঁটা দিয়া ইলিশমাছ খাইতে যান– বেজায় সায়েব কি না– ফলে ইলিশাস্থি তাহার গলা হয় এমনি বেকায়দা বেদুরস্তভাবে যে, তাঁহার শরীরের অস্থিগুলি এখন গোরস্তানে চিরতরে বস্তি গাড়িয়াছে (অশ্রুবর্ষণ)।

সায়েব : আহা! তবে ইলিশ না খাইলেই হয়।

ভারতীয় : ইংরাজ হইয়া বেকন-আণ্ডা না খাইলেই হয়; ফরাসি হইয়া শ্যাম্পেন না খাইলেই হয়; জর্মন হইয়া সসিজ না খাইলেই হয়; বাঙালি হইয়া ইলিশ না খাইলেই হয়, অনশনে প্রাণত্যাগ করিলেও হয়; আত্মহত্যা করিলেও হয়। লজ্জা করে না বলিতে? বাংলার বুকের উপর বসিয়া হোম্ হইতে টিনস্থ বেকন না পাইলে ‘ব্রিটিশ ট্রেডিশন ইন ডেঞ্জার’ বলিয়া কমিশন বসাইতে চাহো, আর আমি গঙ্গার পারে বসিয়া গঙ্গার ইলিশ খাইব না? তাজ্জব কথা!

সায়েব : সে কথা থাকুক (ধুয়া)। কিন্তু ওই বলিলে তোমাদের মেয়েরা রান্না করেন, তাহারা কি শুধুই রান্না করেন? তাহারা এই নির্মম পর্দাপ্রথা মানেন কেন?

ভারতীয় : সে তাঁহারা মানেন; তাহাদিগের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইলে তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিও।

সায়েব : তাঁহাদিগের সঙ্গে তো দেখাই হয় না।

ভারতীয় : সে আমাদের পরম সৌভাগ্য।

সায়েব : (চিন্তিত মনে) কথাটা কি একটু কড়া হইল না? আমরা কি এতই খারাপ?

ভারতীয় : খারাপ-ভালোর কথা জানি না সাহেব। তবে ১৭৫৭ সালে তোমাদের সাথে পীরিতিসায়রে সিনান করিতে গিয়া শুধু যে আমাদের সকলি গরল ভেল তাহা নয়, স্বরাজগামছাখানা হারাইয়া ফেলিয়া দুইশত শীত বৎসর ধরিয়া আকণ্ঠ দৈন্য-দুর্দশা-পঙ্কে নিমগ্ন– ডাঙায় উঠিবার উপায় নাই। পুরুষদের তো এই অবস্থা, তাই মেয়েরা অন্তরমহলে তোমাদিগকে quit করিয়া বসিয়া আছেন।

সায়েব : এসব তো বাইরের কথা; তোমাদের কৃষ্টি, ঐতিহ্য–

ভারতীয় : আরেকদিন হইবে। উপস্থিত আমাকে Quit India গাহিতে রাস্তায় যাইতে হইবে।

[ডিসেম্বর ১৯৪৫]