শ্ৰমণ রিয়োকোয়ান

শ্ৰমণ রিয়োকোয়ান

বাস্তুবাড়ি আমূল ভস্মীভূত হওয়ার পরমুহূর্তেই ক্ষতির পরিমাণটা ঠিক কতদূর হয়েছে অনুমান করা যায় না। যেমন যেমন দিন যায়, এটা-ওটা-সেটার প্রয়োজন হয় তখন গৃহস্থ আস্তে আস্তে বুঝতে পারে তার ক্ষতিটা কতদিক দিয়ে তাকে পঙ্গু করে দিয়ে গিয়েছে।

ইংরেজ রাজত্বের অবসান হয়েছে। আগুন নিবেছে বলে উপস্থিত আমরা সকলেই ভারি খুশি কিন্তু ক্ষতির খতিয়ান নেবার সময়ও আসন্ন। যত শীঘ্র আমরা এ কাজটা আরম্ভ করি ততই মঙ্গল।

ব্যবসা, বাণিজ্য, কৃষি, শিল্পের যে ক্ষতি হয়েছে সে সম্বন্ধে আমরা ইচ্ছা-অনিচ্ছায় অহরহ সচেতন হচ্ছি কিন্তু শিক্ষা-দীক্ষা সংস্কৃতি বৈদগ্ধ্যলোকে আমাদের যে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে গিয়েছে তার সন্ধান নেবার প্রয়োজন এখনও আমরা ঠিক ঠিক বুঝতে পারিনি। অথচ নতুন করে সবকিছু গড়তে হলে যে আত্মবিশ্বাস, আত্মাভিমানের প্রয়োজন হয় তার মূল উৎস সংস্কৃতি এবং বৈদগ্ধ্যলোকে। হটটটদের মতো রাষ্ট্রস্থাপনা করাই যদি আমাদের আদর্শ হয় তবে আমাদের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির কোনওপ্রকার অনুসন্ধান করার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই। কিন্তু যদি আর পাঁচটা সর্বাঙ্গসুন্দর রাষ্ট্রের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াবার বাসনা আমাদের মনে থাকে তবে সে প্রচেষ্টা ‘ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ’।

আত্মাভিমান জাগ্রত করার অন্যতম প্রধান পন্থা, জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে সে-ও একদিন উত্তমর্ণ ছিল, ব্যাপক অর্থে সে-ও মহাজন রূপে বহু দেশে সুপরিচিত ছিল।

কোন দেশ কার কাছে কতটা ঋণী, সে তথ্যানুসন্ধান বড় বড় জাল পেতে আরম্ভ হয় গত শতাব্দীতে। ভৌগোলিক অন্তরায় যেমন যেমন বিজ্ঞানের সাহায্যে লঙ্ঘন করা সহজ হতে লাগল, অন্যের ইতিহাস পড়ার সুযোগও তেমনি বাড়তে লাগল। কিন্তু সে সময়ে আমরা সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃত, ইংরেজের সম্মোহনমন্ত্রের অচৈতন্য অবস্থায় তখন সে যা বলেছে আমরা তাই বলেছি, সে যা করতে বলেছে তাই করেছি।

আমাদের কাছে কে কে ঋণী সেকথা বলার প্রয়োজন ইংরেজ অনুভব করেনি, আমরা যে তার কাছে কত দিক দিয়ে ঋণী সে কথাটাই সে আমাদের কানের কাছে অহরহ ঢ্যাঁটরা পিটিয়ে শুনিয়েছে। কিন্তু ইংরেজ ছাড়া আরও দু-চারটে জাত পৃথিবীতে আছে, এবং ইংরেজই পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ভুবনবরণ্যে মহাজন জাতি একথা স্বীকার করতে তারা প্রস্তুত নয়, এমনকি ইংরেজ যার ওপর রাজত্ব করেছে সে যে একদিন বহু দিক দিয়ে ইংরেজের চেয়ে অনেক বেশি সভ্য ছিল সেকথাটা প্রচার করতেও তাদের বাধে না। বিশেষ করে ফরাসি এবং জর্মন এই কর্মটি পরমানন্দে করে থাকে। কোনও নিরপেক্ষ ইংরেজ পণ্ডিত কখনও জন্মাননি, একথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু অনুভূতির সঙ্গে দূরদ দিয়ে ভারতবাসীকে ‘তোমরা ছোট জাত নও’ একথাটি বলতে ইংরেজের চিরকালই বেঁধেছে।

তাই ঊনবিংশ শতাব্দীতে যদিও আমরা খবর পেলুম যে চীন ও জাপানের বহু লোক বৌদ্ধধর্মাবলম্বী এবং বৌদ্ধধর্ম চীন ও জাপানের আত্মবিকাশে বহু দিক দিয়ে যুগ যুগ ধরে সাহায্য করেছে, তবু, সেই জ্ঞানের ভিতর দিয়ে আমরা এদের সঙ্গে নতুন কোনও যোগসূত্র স্থাপন করতে পারলুম না। এমন সময় এসেছে, চীন ও জাপান যে রকম এ দেশে বৌদ্ধ ঐতিহ্যের। অনুসন্ধানে অধিকতর সংখ্যায় আসবে ঠিক তেমনি আমাদেরও খবর নিতে হবে চীন এবং জাপানের উর্বর ভূমিতে আমাদের বোধিবৃক্ষ পাপী-তাপীকে কী পরিমাণ ছায়া দান করেছে।

এবং একথাও ভুললে চলবে না যে প্রাচ্যলোকে যে তিনটি ভূখণ্ড কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে যশ অর্জন করেছে তারা চীন ভারতবর্ষ ও আরবভূমি। এবং শুধু যে ভৌগোলিক হিসাবে ভারতবর্ষ আরব ও চীন ভূখণ্ডের ঠিক মাঝখানে তা নয়, সংস্কৃতি সভ্যতার দিক থেকেও আমরা এই দুই ভূখণ্ডের সঙ্গমস্থলে আছি। একদিকে মুসলমান ধর্ম ও সভ্যতা এ দেশে এসে আমাদের শিল্পকলাকে সমৃদ্ধ করেছে। আবার আমাদের বৌদ্ধধর্মের ভিতর দিয়ে আমরা চীন-জাপানের সঙ্গে সংযুক্ত। কাজেই ভারতবাসীর পক্ষে আর্য হয়েও একদিকে যেমন সেমিতি (আরব) জগতের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান চলে, তেমনি চীন-জাপানের (মঙ্গোল) শিল্পকলা চিন্তাধারার সঙ্গেও সে যুক্ত হতে পারে। অথচ চীন-আরব একে অন্যকে চেনে না।

তাই পূর্ব ভূখণ্ডে যে নবজীবন সঞ্চারের সূচনা দেখা যাচ্ছে, তার কেন্দ্রস্থল গ্রহণ করবে ভারতবর্ষ। (ব্যবসা-বাণিজ্যের দৃষ্টিবিন্দু থেকে আমাদের লক্ষপতিরা এ তথ্যটি বেশ কিছুদিন হল হৃদয়ঙ্গম করে ফেলেছেন– জাপান হাট থেকে সরে যেতেই আহমদাবাদ ডাইনে, পারস্য-আরব বাঁয়ে জাভা-সুমাত্রাতে কাপড় পাঠাতে আরম্ভ করেছে। ভৌগোলিক ও কৃষ্টি-জাত উভয় সুবিধা থাকা সত্ত্বেও ভারতবর্ষ যদি আপন আসন গ্রহণ না করে তবে দোষ ভগবানের নয়।

উপস্থিত দেখতে পাচ্ছি, আমাদের মৌলভি-মৌলানারা আরবি-ফারসি জানেন। এঁরা এত দিন সুযোগ পাননি– এখন আশা করতে পারি, আমাদের ইতিহাস লিখনের সময় তাঁরা ‘আরবকে ভারতের দান’ অধ্যায়টি লিখে দেবেন ও যে স্থপতিকলা মোগল নামে পরিচিত তার মধ্যে ভারতীয় ও ইরান-তুর্কি কীরূপে মিশ্রিত হয়েছে সে বিবরণ লিপিবদ্ধ করবেন।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমরা চীন এবং জাপানের ভাষা জানিনে। [ বিশ্বভারতীর ‘চীনা-ভবনে’র দ্বার ভালো করে খুলতে হবে, এবং এই চীনা-ভবনকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষে চীন সভ্যতার অধ্যয়ন আলোচনা আরম্ভ করতে হবে।]

জাপান সম্বন্ধে আমাদের কৌতূহল এতই কম যে জাপানে বৌদ্ধধর্মের সম্প্রসারণ সম্বন্ধে আমাদের কোনও জ্ঞানই নেই। [তাই শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র বীরভদ্র রাও চিত্র যখন তাঁর ‘শিল্পী’ কাগজে জাপানে সংগৃহীত ভারতীয় সংস্কৃতির নিদর্শন প্রকাশ করেন তখন অল্প পাঠকই সেগুলো পড়েন। বিশ্বভারতীর আরেক প্রাক্তন ছাত্র শ্রীমান হরিহরণ সাত বৎসর জাপানে থেকে অতি উত্তম জাপানি ভাষা শিখে এসেছেন। সে ভাষা শেখাবার জন্য তার উৎসাহের অন্ত নেই– তাঁর স্ত্রীও জাপানি মহিলা– কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও বিদ্যার্থী তাঁর কাছে উপস্থিত হয়নি।]

বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধ-লেখক জাপানি ভাষা জানে না। কিন্তু তার বিশ্বাস, জাপান সম্বন্ধে সাধারণের মধ্যে কৌতূহল জাগাবার জন্য ইংরেজি এবং অন্যান্য ভাষায় লেখা বই দিয়ে যতটা সম্ভবপর ততটা কাজ আরম্ভ করে দেওয়া উচিত। জাপানি ছাড়া অন্য ভাষা থেকে সংগৃহীত প্রবন্ধে ভুল থাকার সম্ভাবনা প্রচুর, তাই প্রবন্ধ-লেখক গোড়ার থেকেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছে।

ভারতবর্ষীয় যে সংস্কৃতি চীন এবং জাপানে প্রসারলাভ করেছে– সে সংস্কৃতি প্রধানত বৌদ্ধধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। ভারতবর্ষীয় তথা চৈনিক বৌদ্ধধর্ম ও জাপানি বৌদ্ধধর্ম এক জিনিস নয়–তুলনাত্মক ধর্মতত্ত্বের এক প্রধান নীতি এই যে, প্রত্যেক ধর্মই প্রসার এবং বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন বাতাবরণের ভিতর নতুন নতুন রূপ ধারণ করে। জেরুজালেমের খ্রিস্টধর্ম ও প্যারিসের খ্রিস্টধর্মও এক জিনিস নয়, মিশরি মুসলিমে ও বাঙালি মুসলিমে প্রচুর পার্থক্য।

জাপানে যে বৌদ্ধধর্ম বিস্তৃতি লাভ করেছে সে ধর্মও দুই দিক থেকে চর্চা করতে হবে। প্রথমত, জাপানিতে অনূদিত ও লিখিত বৌদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থ– এ কর্ম করবেন পণ্ডিতেরা, এবং এঁদের প্রধান কাজ গবেষণামূলক হবে বলে এর ভিতর সাহিত্য-রস থাকার সম্ভাবনা কম। দ্বিতীয়ত, জাপানি শ্ৰমণ-সাধু-সন্তদের জীবনী পাঠ। আমার বিশ্বাস, উপযুক্ত লেখকের হাতে পড়লে সেসব জীবনী নিয়ে বাংলায় উত্তম সাহিত্য সৃষ্টি হতে পারে।

অধ্যাপক য়াকব ফিশারের লেখা বৌদ্ধ শ্ৰমণ রিয়োকোয়ানের জীবনী পড়ে আমার এ বিশ্বাস দৃঢ়তর হয়েছে। অধ্যাপক ফিশার জাতে জর্মন, রিয়োকোয়ান জাপানি ছিলেন– কিন্তু শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার সঙ্গে বইখানি লেখা হয়েছে বলে সার্থক সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। পুস্তকখানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগার সামান্য কিছুকাল পূর্বে প্রকাশিত হয়েছিল বলে এ দেশে প্রচার এবং প্রসার লাভ করতে পারেনি। বইখানি ইংরেজিতে লেখা, নাম ‘Dew-drops on a Lotus Leaf’। আর কিছু না হোক নামটি আমাদের কাছে অচেনা নয়, ‘নলিনীদলগতজলমতিতরলং’ বাক্যটি আমাদের মোহাবস্থায়ও আমরা ভুলতে পারিনি। শঙ্করাচার্য যখন ‘প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ’ আখ্যায় নিন্দিত হয়েছেন তখন হয়তো জীবনকে পদ্মপত্রে জলবিন্দুর ন্যায় দেখার উপমাটাও তিনি বৌদ্ধধর্ম থেকে নিয়েছেন।

বহু মানবের হিয়ার পরশ পেয়ে
বহু মানবের মাঝখানে বেঁধে ঘর
— খাটে, ছেলে যারা মধুর স্বপ্ন দেখে–
 থাকিতে আমার নেই তো অরুচি কোনও।
তবুও এ-কথা স্বীকার করিব আমি,
উপত্যকার নির্জনতার মাঝে
–শীতল শান্তি অসীম ছন্দে ভরা–
সেইখানে মম জীবন আনন্দঘন ॥

 শ্ৰমণ রিয়োকোয়ানের এই ক্ষুদ্র কবিতাটি দিয়ে অধ্যাপক ফিশার তাঁর রিয়োকোয়ান-চরিত্রের অবতরণিকা আরম্ভ করেছেন।

ফিশার বলেন : রিয়োকোয়ানের আমলের বড় জাগিরদার মাকিনো তাঁর চরিত্রের খ্যাতি শুনে অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে শ্রমণকে সাদরে নিমন্ত্রণ করে পাঠালেন। তাঁর বাসনা হয়েছিল, শ্রমণের কাছ থেকে ধর্মশিক্ষা গ্রহণ করবেন।

মাকিনোর দূত রিয়োকোয়ানের কুঁড়েঘরে পৌঁছাবার পূর্বেই গ্রামের লোক খবর পেয়ে গিয়েছিল যে স্বয়ং মাকিনো রিয়োকোয়ানের কাছে দূত পাঠাচ্ছেন। খবর শুনে অত্যন্ত ব্যতিব্যস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি তাঁর কুটিরের চারদিকের জমি-বাগান সবকিছু পরিষ্কার করে দিল।

রিয়োকোয়ান ভিনগাঁয়ে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে দেখেন কুঁড়েঘরের চতুর্দিক সম্পূর্ণ সাফ। মাকিনোর দূত তখনও এসে পৌঁছয়নি। রিয়োকোয়ানের দুই চোখ জলে ভরে গেল, বললেন, ‘হায় হায়, এরা সব কী কাণ্ডটাই না করেছে। আমার সবচেয়ে আত্মীয় বন্ধু ছিল ঝিঁঝিপোকার দল। এই নির্জনতায় তারাই আমাকে গান শোনাত। তাদের বাসা ভেঙে ফেলা হয়েছে, হায়, তাদের মিষ্টি গান আমি আবার শুনব কবে, কে জানে?’

রিয়োকোয়ান বিলাপ করছেন, এমন সময় দূত এসে নিমন্ত্রণপত্র নিবেদন করল। শোকাতুর শ্ৰমণ উত্তর না দিয়ে একটি ক্ষুদ্র কবিতা লিখে দূতকে দিলেন,

আমার ক্ষুদ্র কুটিরের চারিপাশে,
বেঁধেছিল বাসা ঝরা পাতা দলে দলে–
নৃত্যচটুল, নিত্যদিনের আমার নর্ম্য-সখা
কোথা গেল সব? আমার আতুর হিয়া
 সান্ত্বনা নাহি মানে।
হায় বলো মোর কী হবে উপায় এবে
জ্বলে গিয়ে তারা করিত যে মোর সেবা,
এখন করিবে কেবা?

 ফিশার বলেন, দূত বুঝতে পারল নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।

আমরা বলি, তাতে আশ্চর্য হবারই-বা কী আছে? আমাদের কবি, জাপানের কবি এবং ঝরা পাতার স্থান তো জাগিরদারের প্রাসাদকাননে হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন :

ঝরা পাতা গো, আমি তোমারি দলে
অনেক হাসি অনেক অশ্রুজলে।(১)

 ফিশার বলেন, এই জাপানি শ্ৰমণ, কবি, দার্শনিক এবং খুশখৎকে(২), তিনি আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চান।

রিয়োকোয়ান বহু বৎসর ধরে জাপানের কাব্যরসিক এবং তত্ত্বান্বেষীগণের মধ্যে সুপরিচিত, কিন্তু জনসাধারণের মধ্যে তাঁর খ্যাতি ছড়ায় মাত্র বৎসর ত্রিশ পূর্বে। যে প্রদেশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর প্রব্রজ্যাভূমিতে তিনি কিংবদন্তির রাজবৈদ্য। তাসুকিচি ইরিসওয়া বলেন, ‘আমাদের পিতামহী মারা যান ১৮৮৭ সালে। তিনি যৌবনে রিয়োকোয়ানের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন এবং তাঁর সম্বন্ধে অনেক গল্প আমাকে বলেছেন।’

রিয়োকোয়ানের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯১১ সালে প্রকাশিত এক ক্ষুদ্র পুস্তিকায়। স্বয়ং হকুওসাই সে পুস্তকের জন্য ছবি এঁকে দিয়েছিলেন। তার প্রায় পঁচিশ বৎসর পর রিয়োকোয়ানের প্রিয়া শিষ্যা ভিক্ষুণী তাইশিন রিয়োকোয়ানের কবিতা থেকে ‘পদ্মপত্রে শিশিরবিন্দু’ নাম দিয়ে একটি চয়নিকা প্রকাশ করেন। বিয়োকোয়ানকে কবি হিসেবে বিখ্যাত করার জন্য ভিক্ষুণী তাইশিন এ চয়নিকা প্রকাশ করেননি; তিনিই তাঁকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনবার সুযোগ পেয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি আর যে পাঁচজন তাঁকে চিনতেন, তাঁদের ধারণা ছিল তিনি কেমন যেন একটু বেখাপ্পা, খামখেয়ালি ধরনের লোক, যদিও শ্রমণ হিসেবে তিনি অনিন্দনীয়। এমনকি রিয়োকোয়ানের বিশিষ্ট ভক্তেরাও তাঁকে ঠিক চিনতে পারেননি। তাঁদের কাছেও তিনি অজ্ঞেয় অমর্ত্য সাধক হয়ে চিরকাল প্রহেলিকা রূপ নিয়ে দেখা দিতেন। একমাত্র ভিক্ষুণী তাইশিনই রিয়োকোয়ানের হৃদয়ের সত্য পরিচয় পেয়েছিলেন, চয়নিকা প্রকাশ করার সময় তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, সর্বসাধারণ যেন তার কবিতার ভিতর দিয়ে তাঁর মহানুভব হৃদয়ের পরিচয় পায়।

এ মানুষটিকে চেনা কারও পক্ষেই খুব সহজ ছিল না। তিনি সমস্ত জীবন কাটিয়েছিলেন কবিতা লিখে, ফুল কুড়িয়ে আর ছেলেদের সঙ্গে গ্রামের রাস্তার উপর খেলাধুলা করে। তাতেই নাকি পেতেন তিনি সবচেয়ে বেশি আনন্দ। খেলার সাথি না পেলে তিনি মাঠে, বনের ভিতর আপন মনে খেলে যেতেন। ছোট ছোট পাখি তখন তাঁর শরীরের উপর এসে বসলে তিনি ভারি খুশি হয়ে তাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিতেন। যখন ইচ্ছে ঘুমিয়ে পড়তেন, মদ পেলে খেতে কসুর করতেন না, আর নাচের দলের সঙ্গে দেখা হলে সমস্ত বিকেল-সন্ধ্যা তাদের সঙ্গে ফুর্তি করে কাটিয়ে দিতেন।

বসন্ত-প্রাতে বাহিরিনু ঘর হতে
 ভিক্ষার লাগি চলেছি ভাণ্ড ধরে–
হেরি মাঠ-ভরা নাচে ফুলদল
নাচে পথ-ঘাট ভরে।
 দাঁড়াইনু আমি এক লহমার তরে
কথা কিছু কব বলে
 ও মা, এ কি দেখি! সমস্ত দিন
কী করে যে গেছে চলে!

এই আপনভোলা লোকটির সঙ্গে যখন আর আর সংসারবিমুখ শ্ৰমণদের তুলনা করা যায় তখনই ধরা পড়ে শ্রমণ-নিন্দিত প্রকৃতির সঙ্গে এঁর কবিজন সুলভ গভীর আত্মীয়তাবোধ। এই ‘সর্বং শূন্যং সর্বং ক্ষণিকং’ জগতের প্রবহমান ঘটনাবলিকে তিনি আর পাঁচজন শ্রমণের মতো বৈরাগ্য ও বিরক্তির সঙ্গে অবহেলা করছেন না, আবার সৌন্দর্যবিলাসী কবিদের মতো চাঁদের আলো আর মেঘের মায়াকেও আঁকড়ে ধরতে অযথা শোকাতুর হচ্ছেন না। বেদনাবোধ যে রিয়োকোয়ানের ছিল না তা নয়– তাঁর কবিতার প্রতি ছত্রে ধরা পড়ে, তাঁর স্পর্শকাতর হৃদয় কত অল্পতেই সাড়া দিচ্ছে– কিন্তু সমস্ত কবিতার ভিতর দিয়ে তাঁর এমন একটি সংহত ধ্যানদৃষ্টি দেখতে পাই যার মূল নিশ্চয়ই বৌদ্ধধর্মের নিগূঢ় তত্ত্বের অন্তস্তল থেকে আপন প্রাণশক্তি সঞ্চয় করছে।

অথচ তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধুরা বলে গিয়েছেন তিনি কখনও কাউকে আপন ধর্মে দীক্ষা দেবার জন্য চেষ্টা করেননি, অন্যান্য শ্রমণের মতো বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেননি।

তাই এই লোকটিকে বুঝতে জাপানেরও সময় লেগেছে। ফিশার বলেন, ১৯১৮ সালে শ্ৰীযুক্ত সোমা গায়েষ্ণু কর্তৃক ‘তাইগু রিয়োকোয়ান’ পুস্তক প্রকাশিত হওয়ার পর সমগ্র জাপানে এই শ্রমণের নাম ছড়িয়ে পড়ে।

আজ তাঁর খ্যাতি শুধু আপন প্রদেশে, আপন প্রব্রজ্যাভূমিতে সীমাবদ্ধ নয়। জাপানের সর্বত্রই তাঁর জীবন, ধর্মমত, কাব্য এবং চিন্তাধারা জানবার জন্য বিপুল আগ্রহ দেখা দিয়েছে।

সেই উত্তেজনা, সেই আগ্রহ বিদেশি শিক্ষক যাকব ফিশারকেও স্পর্শ করেছে। দীর্ঘ আড়াই বৎসর একাগ্র তপস্যার ফলে তিনি যে গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন তার কল্যাণে আমরাও রিয়োকোয়ানের সঙ্গে পরিচিত হবার সৌভাগ্য লাভ করেছি। উপরে উল্লিখিত রিয়োকোয়ানের সর্বশ্রেষ্ঠ ভক্ত সোমা গায়েফু ফিশারের গ্রন্থকে সপ্ৰেম আশীর্বাদ করেছেন, এবং এ কথাও বলেছেন যে ফিশারই একমাত্র ইউরোপীয় যিনি শ্রমণ রিয়োকোয়ানের মর্মস্থলে পৌঁছতে পেরেছেন।

জাপানের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে সমুদ্রপারের এক গ্রামে ১৭৫৮ সালে রিয়োকোয়ানের জন্ম হয়। রিয়োকোয়ান-বংশ সে অঞ্চলে আভিজাত্য ও প্রতিপত্তির জন্য সুপরিচিত ছিল। রিয়োকোয়ানের পিতা গ্রামের প্রধান বা অগ্রণীরূপে প্রচুর সম্মান পেতেন।

রিয়োকোয়ানকে বুঝতে হলে তাঁর পিতার জীবনের কিছুটা জানতে হয়। তিনিও কবি ছিলেন এবং তাঁর কবিতাতেও এমন একটি দ্বন্দ্ব সবসময়ই প্রকাশ পায় যে দ্বন্দ্বের অবসান কোনও কবিই এ জীবনে পাননি। সাধারণ কবি এরকম অবস্থায় কাব্য-জীবন ও ব্যবহারিক জীবনকে পৃথক করে নিয়ে পাঁচজনের সঙ্গে যতদূর সম্ভব মিলে মিশে চলবার চেষ্টা করেন, কিন্তু রিয়োকোয়ানের পিতার দ্বন্দ্ব-মুক্তি প্রয়াস এতই নিরঙ্কুশ ও পরিপূর্ণ আন্তরিকতায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল যে তিনি শেষ পর্যন্ত কোনও সমাধান না পেয়ে আত্মহত্যা করেন।

রিয়োকোয়ানের অন্যান্য ভাই-বোনও কবিতা রচনা করে জাপানে খ্যাতিলাভ করেছেন। কিন্তু তাঁদের জীবনও সমাজের আর পাঁচজনের জীবনের মতো গতানুগতিক ধারায় চলতে পারেনি। রিয়োকোয়ানের ছোট দুই ভাই ও এক বোন প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন।

ধন-সম্পত্তি খ্যাতি-প্রতিপত্তি সবকিছুই ছিল, রাজধানীতে রিয়োকোয়ানের পিতা সুপরিচিত ছিলেন, বসগ্রামের অধিবাসীরা রিয়োকোয়ান পরিবারকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখত, তৎসত্ত্বেও কেন পরিবারের পিতা আত্মহত্যা করলেন, তিন পুত্র এক কন্যা চীরবস্ত্র গ্রহণ করলেন এ রহস্যের সমাধান করার চেষ্টা রিয়োকোয়ান-জীবনীকার অধ্যাপক য়াকব ফিশার করেননি। তবে কি জাপানের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন সে যুগে এমন কোনও পক্ষের বিরুদ্ধে হয়ে উঠেছিল যে স্পর্শকাতর পরিবার মাত্রকেই হয় মৃত্যু অথবা প্রব্রজ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে সর্বসমস্যার সমাধান করতে হত? ফিশার সেরকম কোনও ইঙ্গিতও করেননি।

ফিশার বলেন, রিয়োকোয়ান শিশুবয়স থেকেই অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির পরিচয় দেন। আর সব ছেয়েমেয়ে যখন খেলাধুলায় মত্ত থাকত তখন বালক রিয়োকোয়ান তন্ময় হয়ে কনফুসিয়ের তত্ত্ব-গম্ভীর রচনায় প্রহরের পর প্রহর কাটিয়ে দিতেন। তাঁর এই আচরণে যে তাঁর পিতা-মাতা ঈষৎ উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন তার ইঙ্গিত ফিশার দিয়েছেন।

রিয়োকোয়ানের সব জীবনী-লেখকই দুটি কথা বারবার জোর দিয়ে বলেছেন। রিয়োকোয়ান বালক বয়সেও কখনও মিথ্যা কথা বলেননি এবং যে যা বলত তিনি সরল চিত্তে তাই বিশ্বাস করতেন। এই প্রসঙ্গে ফিশার রিয়োকোয়ানের বাল্যজীবনের একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন।

রিয়োকোয়ানের বয়স যখন আট বৎসর তখন তাঁর পিতা তাঁরই সামনে একটি দাসীকে অত্যন্ত কঠিন বাক্য বলেন। দাসীর দুঃখে রিয়োকোয়ান বড়ই ব্যথিত হন ও ক্রুদ্ধনয়নে পিতার দিকে তাকান। পিতা তাঁর আচরণ লক্ষ করে বললেন, “এরকম চোখ করে বাপ-মায়ের দিকে তাকালে তুমি আর মানুষ থাকবে না, ওই চোখ নিয়ে মাছ হয়ে যাবে।’ তাই শুনে বালক রিয়োকোয়ান বাড়ি ছেড়ে অন্তর্ধান করলেন। সমস্ত দিন গেল, সন্ধ্যা হয়ে। এল, তবু তাঁর কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না। উদ্বিগ্ন পিতা-মাতা চতুর্দিকে সংবাদ পাঠালেন। অবশেষে এক জেলে খবর পাঠাল, সে রিয়োকোয়ানকে সমুদ্রপারের পাষাণস্তূপের কাছে দেখতে পেয়েছে। পিতা-মাতা ছুটে গিয়ে দেখেন, তিনি পাষাণস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে আছেন, আর সমুদ্রের ঢেউ তাঁর গায়ে এসে লাগছে। কোলে করে বাড়ি এনে বাপ-মা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি ওখানে নির্জনে সমস্ত দিন কী করছিলে?’ রিয়োকোয়ান বড় বড় চোখ মেলে বললেন, “তবে কি আমি এখনও মাছ হয়ে যাইনি, আমি না দুষ্টু ছেলের মতো তোমাদের অবাধ্য হয়েছিলুম?’

রিয়োকোয়ান কেন যে সমস্ত দিন সমুদ্রপারে জলের কাছে কাটিয়েছিলেন তখন বোঝা গেল। মাছই যখন হয়ে যাবেন তখন জলের কাছে গিয়ে তার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকাই তো প্রশস্ত পন্থা।

সংসার ত্যাগ করেও রিয়োকোয়ান পিতা-মাতা সম্বন্ধে কখনও উদাসীন হতে পারেননি। মায়ের স্মরণে বৃদ্ধ শ্ৰমণ রিয়োকোয়ান যে কবিতাটি রচনা করেন সেটি মায়েরই ভালোবাসার মতো এমনি সরল সহজ যে অনুবাদে তার সব মাধুর্য নষ্ট হয়ে যায়–

সকাল বেলায় কখনও গভীর রাতে
আঁখি মোর ধায় দূর ‘সাদৌ’(৩) দ্বীপ পানে
শান্ত-মধুর কত না স্নেহের বাণী
মা আমার যেন পাঠায় আমার কানে।

————

১. শেলির ‘What if my leaves are falling’ ভিন্ন অনুভূতিতে, ঈষৎ দম্ভপ্রসূত।

২. Calligrapher = সুদর্শন লিপিকার। ৩. রিয়োকোয়ানের মাতা ‘সাদৌ’ দ্বীপে জন্মেছিলেন।