ছুছুন্দর কা সিরপর চামেলি কা তেল

ছুছুন্দর কা সিরপর চামেলি কা তেল

লিঙ্গোয়াফোন রেকর্ডের কথা অনেকেই শুনেছেন। এ রেকর্ডগুলোর সাহায্যে দেশি-বিদেশি যেকোনো ভাষা অতি চমৎকার রূপে শেখা যায়। রেকর্ডগুলোতে বড় বড় ভাষা এবং উচ্চারণবিদরা গোড়ার দিকে খুব সহজ ভাষায় কথাবার্তা বলেছেন ক্রমে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে শেষের রেকর্ডগুলোতে এমনি বেগে বলেছেন যে, সেটা আয়ত্ত করতে পারলে আপনি সে ভাষায় নিজেকে ওকিবহাল বলে পরিচয় দিতে পারবেন। প্রথম একখানা রেকর্ড নিয়ে বারবার সেটা শুনতে হয়। তার পর প্রশ্নকর্তা ও উত্তরদাতার সঙ্গে গলা মিলিয়ে, সামনে পাঠ্যপুস্তকের দিকে চোখ রেখে উচ্চারণ করে যেতে হয়। পাঠ্যপুস্তকে আবার ‘অনুশীলন’ও থাকে। সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোও করতে হয়। ‘কি’ দেওয়া আছে। তাই দিয়ে ভুলগুলো মেরামত করে নিতে হয়।

বুদ্ধিশুদ্ধির বিশেষ প্রয়োজন নেই। শুধু গাধার খাটুনি আর সহিষ্ণুতা বা নিষ্ঠা কিংবা বলতে পারেন লেগে থাকার প্রয়োজন।

আমার অভিজ্ঞতাপ্রসূত ব্যক্তিগত সুদৃঢ় বিশ্বাস, পৃথিবীর বেশিরভাগ জিনিস শেখার জন্য আক্কেল-বুদ্ধি প্রয়োজন অতি সামান্য। আসলে প্রয়োজন গাধার খাটুনি। বাঙলায় বা অন্য যেকোনো ভাষাতে শব্দ-ভাণ্ডারের শ্রীবৃদ্ধি করতে হলে বুদ্ধির প্রয়োজন কোথায়? ‘পদ্ম’ শব্দের প্রতিশব্দ ‘কমল’ ‘সরোজ’ ‘পঙ্কজ’ শিখতে হলে কাউকে মাইকেলের মতো মেধাবী হতে হয় না, প্রয়োজন হয় ওই কর্মে রোজ লেগে থাকা। কারও মুখস্থ হয় একদিনে, কারও লাগে তিনদিন– তফাৎ ওইটুকু মাত্র। স্বয়ং মাইকেলই নাকি বলেছেন, জিনিয়াসের ৯৯% পাপরেশন, অর্থাৎ মাথার ঘাম পায়ে ফেলা, আর মাত্র এক পার্সেন্ট ইন্সপিরেশন অর্থাৎ বিধিদত্ত প্রতিভা।

শুধুমাত্র মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাইকেলের মতো কাব্য রচনা করা যায় না। কিন্তু নিছক খাটুনির জোরে যেকোনো ভাষার অন্তত এতখানি আয়ত্ত করা যায় যে, দেশের ৯৯% লোক তাকে ওই ভাষায় পণ্ডিত বলে মেনে নেয়।

এবং এই সোনার বাঙলার ৯৯% লোক খাটতে রাজি নয়। রেওয়াজ না করেই সে গাওয়াইয়া হয়ে যায়, নিত্য নবীন নাচ কম্পোজ করতে থাকে।

কিন্তু সেকথা থাক। পরনিন্দা বা আপন নিন্দা– আমিও তো বাঙালি বটি করে আমি পুজোর বাজারে রসভঙ্গ করতে চাইনে। তাই মূল কথা আরম্ভ করি।

এই লিঙ্গোয়াফোন রেকর্ড পত্তনের প্রথম যুগে বার্নার্ড শ’ চারটি বক্তৃতা দেন। সেগুলো কিনতে পাওয়া যায়। অতি সুস্পষ্ট উচ্চারণের সুমধুর ভাষণ। ব্যঙ্গকৌতুক, রসসৃষ্টি, আর তথ্য-পরিবেশ তো আছেই।

কথাপ্রসঙ্গে তিনি বলেছেন,

‘.. হয়তো তুমি চালাক ছেলে। আমাকে শুধালে, তা হলে কি আমি সবসময় একই ধরনে কথা বলি?’

‘আমি সঙ্গে সঙ্গেই স্বীকার করে নিচ্ছি, আমি করিনে। কেউই করে না। এই তো এই মুহূর্তে আমি হাজার হাজার গ্রামোফোনওয়ালাদের সামনে কথা বলছি, এদের অনেকেই আমার প্রত্যেকটি শব্দ, প্রত্যেকটি কথা প্রাণপণ বোঝবার চেষ্টা করছে। বাড়িতে আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে যেরকম বেখেয়ালে কথা কই, এখন যদি তোমাদের সঙ্গে সেরকম ধারা কথা কইতে যাই, তা হলে এ রেকর্ডখানা কারও এক কড়ির কাজে লাগবে না; আর এখন তোমাদের সঙ্গে যেরকম সাবধানে কথা বলছি, সেরকম যদি স্ত্রীর সঙ্গে বাড়িতে বলি তা হলে তিনি ভাববেন আমার বদ্ধ পাগল হতে আর বেশি বিলম্ব নেই।

 ‘জনসাধারণের সামনে আমাকে বক্তৃতা দিতে হয় বলে আমাকে সাবধান থাকতে হয় যে, বিরাট হলের হাজার হাজার লোকের শেষ সারির শ্রোতাও যেন আমার প্রত্যেকটি কথা পরিষ্কার শুনতে পায়। কিন্তু বাড়িতে ব্রেকফাস্টের সময় আমার স্ত্রী আমার থেকে মাত্র দু ফুট খানেক দূরে বসে আছেন। তাই বেখেয়ালে এমনভাবে কথা বলি যে, তিনি আমার কথার উত্তর না দিয়ে প্রায়ই বলেন, “ওরকম বিড়বিড় কর না; আর দেখ, কথা বলার সময় অন্যদিকে ঘাড় ফিরিয়ো না। তুমি যে কী বলছ আমি তার কিছু শুনতে পাচ্ছিনে।” এবং তিনি যে সবসময় সাবধানে কথা বলেন তা-ও নয়। আমাকেও মাঝে মাঝে বলতে হয়, কী বললে?’(১) আর তিনি সন্দেহ করেন যে, আমি ক্রমেই কালা হয়ে যাচ্ছি, অবশ্য তিনি সেটা আমাকে বলেন না। আমি সত্তর পেরিয়ে গিয়েছি– কথাটা হয়তো সত্যি।

 ‘কিন্তু এ বিষয়ে কণামাত্র সন্দেহ নেই যে, রাজরানির সঙ্গে কথা বলার মতো আমি যেন আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা কই এবং তারও বলা উচিত যেন তিনি রাজার সঙ্গে কথা বলছেন। তাই উচিত; কিন্তু আমরা তা করিনে।

‘আমাদের আদব-কায়দা দু রকমের একটা পোশাকি, অন্যটা ঘরোয়া। কোনও অপরিচিতের বাড়িতে গিয়ে যদি দরজার ফাঁক দিয়ে ওদের কথাবার্তা শোনো অবশ্য আমি আদপেই বলতে চাইনে যে এরকম অভদ্র আচরণ তোমার পক্ষে আদৌ সম্ভব। কিন্তু তবু, ভাষা শেখার অত্যধিক উৎসাহে তুমি যদি কয়েক মুহূর্তের তরে এরকম অপকর্ম করে শোনো, পরিবারের লোক বাইরে কেউ না থাকলে আপসে কী ধরনে কথা বলে এবং পরে যদি ঘরে ঢুকে ওদের কথা শোনো, তা হলে তোমার সামনে ওদের কথা বলার ধরন দেখে রীতিমতো অবাক হয়ে যাবে। এমনকি, আমাদের ঘরোয়া কায়দা-কেতা পোশাকি কায়দার মতো উত্তম হলেও আসলে আরও ভালো হওয়া উচিত তাদের মধ্যে সবসময়ই পার্থক্য থাকে এবং সে পার্থক্য অন্যসব কায়দাকেতার চেয়ে কথাবার্তাতেই বেশি।

‘মনে কর ঘড়িটাতে দম দিতে ভুলে গিয়েছি; ওটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে! কাউকে তা হলে জিগ্যেস করতে হয়, কটা বেজেছে? অপরিচিত কাউকে জিগ্যেস করলে বলব, কটা বেজেছে, বলতে পারেন?’ সে তখন প্রত্যেকটি কথা পরিষ্কার শুনতে পায়, কিন্তু যদি স্ত্রীকে ওই কথাই শুধাই তবে তিনি সর্বসাকুল্যে শুনতে পান ‘ক’টা বেচ্চে?’ তাই তাঁর পক্ষে যথেষ্ট; কিন্তু তোমাকে জিগ্যেস করলে ওরকম বললে চলবে না। তাই এখন তোমাদের সামনে কথা বলছি স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার চেয়ে অনেক বেশি সাবধানে! কিন্তু লক্ষ্মীটি, ওঁকে সেটি বল না।’

***

শ’ কথাগুলো বলেছেন, প্রধানত উচ্চারণ সম্বন্ধে। কারণ, তিনি রেকর্ডের মারফতে বিদেশিকে ভালো ইংরেজি উচ্চারণ শেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু তার এই নীতি যে ‘আমরা সর্বত্রই একই উচ্চারণে কথা বলিনে’, ভাষা সম্বন্ধে আরও বেশি প্রযোজ্য। শব্দ, ইডিয়ম, প্রবাদ ইত্যাদি আমরা সকলের সামনে একইভাবে বাছাই করে প্রয়োগ করিনে।

শ্বশুরমশায়ের সামনে ঘাড় নিচু করে, হাত-পা দিয়ে বায়ু সমুদ্র মন্থন করা কিছুক্ষণের মতো স্থগিত রেখে বলি,

‘আজ্ঞে, রামবাবু বললেন, ওই ব্যাপার নিয়ে আমি যেন দুশ্চিন্তা না করি।’

 পিতাকে বলি, রামবাবু বলল, ‘যাও ও-কথা তোমাকে ভাবতে হবে না।’

রকের ইয়ারকে বলি, ‘শ্লা রেমোটা কী বলল জানিস? বলল, “যা যা ছোঁড়া, মেলা ডোঁপোমি কত্তি হবে না; আপনার চরকায় তেল দে গে যা।”

শ’ সর্বোচ্চ উদাহরণ দিয়েছেন তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে। সেটা কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয়। তিনি যে তাঁর স্ত্রীকে সমঝে চলতেন, এমনকি ডরাতেনও, সেকথা কারও অজানা নেই। আর ডরায় না কে? ‘পঞ্চতন্ত্র’ পড়ে দেখুন– বিষ্ণুশর্মার লেখাটা নয়, অন্য একজনের। লাইব্রেরি থেকে ধার করে নয়, কিনে। লোকটা অন্নাভাবে আছে।

তাই প্রশ্ন উঠবে, উপরের যে রিপোর্টটি পাত্রভেদে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করছে, সেটি যদি বউয়ের কাছে নিবেদন করি, তবে সেটা কী রূপ নেবে?

সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে, বউ কী শুনতে চান। তিনি যদি শুনতে চান, ‘রামবাবু ওই কাজের ভারটা আপন কাঁধে তুলে নিয়েছেন, আপনাকে তাই নিয়ে আর মাথা ঘামাতে হবে না, তা হলে তো আপনি নিষ্পরোয়া হয়ে গিয়ে তেরিয়া মেরে চড়াকসে বলবেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ গিন্নি, যা কয়েছ।” আমি যতই বলি, “রামবাবু, আপনাকে কিচ্ছুটি চিন্তা করতে হবে না। আমি সব বোঝা কাঁধে নিচ্ছি”, তিনি ততই আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বলেন, “না ভায়া, ও কাজ আমার তোমাকে দেখতে হবে না।” কী আর করি? ওঁর হাতেই সব ছেড়ে দিয়ে এলুম।’

আর যদি গিন্নি উল্টোটা আশা করে থাকেন? অর্থাৎ আপনি যদি মিশনে ফেল মেরে এসে থাকেন? তা হলে? তা হলে ঈশ্বর রক্ষতু।

গলা সাফ করে ইদিক-উদিক তাকিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ‘–’

আবার বলছি তখন ঈশ্বর রক্ষতু। আমি আর কী বলব। চল্লিশ বছর হল বিয়ে করেছি। এখনও সে ভাষা শিখতে পারিনি।

মূল কথায় ফিরে যাই।

এ তো হল কথাবার্তায়। সাহিত্যে এ জিনিসটি আরও প্রকট।

সেখানে কাকে উদ্দেশ করে লিখছেন সেটা তো আছেই, তার ওপর আছে বিষয়বস্তু।

কালীপ্রসন্ন সিংহ যখন মহাভারতের অনুবাদ করেছেন তখন ব্যবহার করেছেন সংস্কৃত শব্দবহুল ভাষা, কারণ বিষয়বস্তু এপিক, গুরুগম্ভীর। ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’য় তিনি ব্যবহার করেছেন ‘রকে’র ভাষা। কারণ সেখানে বিষয়বস্তু ‘বেলেল্লাপনা’, অতএব চটুল এবং সেই কারণেই ‘মেঘনাদবধে’র ভাষা এক, ‘একেই কি বলে সভ্যতা’র ভাষা অন্য। ‘কৃষ্ণচরিত্রে’র ভাষা এক, ‘কমলাকান্তে’র ভাষা অন্য।

এমনকি ধরুন, বিষয়বস্তুও এক, কিন্তু সেখানে পরিবেশ এবং পাত্র ভিন্ন বলে ভাষাও ভিন্ন হল। ‘পারস্য ভ্রমণে’ রবীন্দ্রনাথ কথা বলছেন ওই দেশের অভিজাত সম্প্রদায়, গুণীজ্ঞানীদের সঙ্গে– তাই তার ভাষা এক এবং ‘মরুতীর্থ হিংলাজে’র পাত্রপাত্রী অতি সাধারণ জন– এমনকি রিফর‍্যাফ-–তাই তার ভাষা অন্য; ‘মরুতীর্থ’ ‘পারস্যে’র চেয়ে ভালো না মন্দ সেকথা। উঠছে না। দুটোই রসসৃষ্টি, কিন্তু দুটো আলাদা জিনিস।

অর্থাৎ বিষয়বস্তু—কনটেন্ট– তার শৈলী এবং ভাষা—স্টাইল– নির্বাচন করে। সেখানে উল্টোপাল্টা করলে রসসৃষ্টি হয় না।

‘বঙ্কিমের ভাষার অনুকরণ করবে’–ছেলেবেলা থেকেই সে উপদেশ শুনেছি এবং ধরে নিয়েছি সে ভাষা ‘রাজসিংহ’, ‘দুর্গেশনন্দিনী’র ভাষা।

ওই ভাষা দিয়ে পাড়ার কানাই-বলাইয়ের কাহিনী লিখতে গেলে ফর্ম ও কন্টেন্টের যে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়, তার ফলে বারেবারে তাল কাটে। শরৎ চাটুজ্জের প্রথম যৌবনের লেখাতে তার নিদর্শন প্রচুর পাওয়া যায়। প্রৌঢ় বয়সে তিনি তাঁর আপন ভাষা পেয়ে বিষয়বস্তুর সঙ্গে তাল রেখে অদ্ভুত তবলা শোনালেন।

এমনকি ‘গোরা’, ‘যোগাযোগ’, ‘শেষের কবিতা’র ভাষা দিয়ে ‘কচিসংসদ’ লেখা যায় না।

তাই রবীন্দ্রনাথ বা বঙ্কিমের অনুকরণ (ইমিটেশন) সহজেই হনুকরণ (এপিং) হয়ে যেতে পারে।

———–

১. এখানে শ’ ইচ্ছে করেই ‘আই বেগ ইয়োর পাৰ্ডন’ কিংবা ‘এক্সকিউজ মি’ বলেননি। ইঙ্গিত রয়েছে যে, বাড়িতে স্ত্রীকে আমরা পোশাকি আদবকায়দা দেখাইনে।