পাণ্ডা

পাণ্ডা

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন–

‘নামিনু শ্রীধামে। দক্ষিণে বামে পিছনে সমুখে যত
লাগিল পাণ্ডা, নিমেষে প্রাণটা করিল কণ্ঠাগত।’

এরপর পাণ্ডাদের সহৃদয় অত্যাচারের কথা ফলিয়ে বলবার মতো সাহস আমাদের মতো অর্বাচীন জনের হওয়ার কথা নয়। ওস্তাদরা যখন মিয়াকি তোড়ি’ অর্থাৎ মিয়া তানসেন রচিত ততাড়ি রাগিণী গান তখন গাওয়া আরম্ভ হওয়ার পূর্বে দু হাত দিয়ে দুটি কান ছুঁয়ে নেন। ভাবখানা এই ‘হে গুরুদেব, ওস্তাদের ওস্তাদ, যে গান তুমি গেয়েছ সেটি গাইবার দম্ভ যে আমি প্রকাশ করলুম, তার জন্য আগেভাগেই মাপ চাইছি।’ সাহিত্যক্ষেত্রে আমাদেরও তাই করা উচিত– মাইকেলও তাই করেছেন। আদি কবির স্মরণে বলেছেন, ‘রাজেন্দ্রসঙ্গমে দীন যথা যায় দূর তীর্থদরশনে।’ কালিদাসও বলেছেন– সংস্কৃতটা মনে নেই—‘বজ্ৰমণি ছেদ করার পর সূত্র যেমন অনায়াসে মণির ভিতর দিয়ে চলে যেতে পারে, বাল্মীকির রামায়ণের পর আমার রঘুবংশ ঠিক সেইরূপ।’

শুধু এইটুকু বলে রাখি, পাণ্ডা বলতে ভারতীয় যে মহান জাতের কথা ওঠে তার কোনও জাত নেই। অর্থাৎ শ্রীধামের পাণ্ডা আর আজমিঢ়ের মুসলমান পাণ্ডাতে কোনও পার্থক্য নেই–যাত্রীর প্রাণটা নিমেষে কষ্ঠাগত করবার জন্য এদের বজ্রমুষ্টি ভারতের সর্বত্রই এক প্রকার। ভারতের হিন্দু-মুসলমান মিলনের এর চেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ আর কী হতে পারে? কংগ্রেস যদি এঁদের হাতে দেশের ভারটা ছেড়ে দিতেন তবে ভারত ছেদের যে কোনও প্রয়োজন হত না সে বিষয়ে আমি স্থির-নিশ্চয়। এর জন্য মাত্র একটি প্রমাণ পেশ করছি। উভয় ডোমিনিয়নের মধ্যে সর্বপ্রকারের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ সে কথা সবাই জানেন; কিন্তু এ তথ্যটি কি লক্ষ করেছেন যে, শিখরা তীর্থ করবার জন্য দিব্য পাকিস্তান যাচ্ছেন, পাকিস্তানের মুসলমানেরা হিন্দুস্থানের আজমিঢ় আসছেন, পূর্ব পাঞ্জাবের কাদিয়ান গ্রামে যাচ্ছেন? পাণ্ডার ব্যবসা দুনিয়ার প্রাচীনতম ব্যবসা– ওটাকে নষ্ট করা কংগ্রেস-লিগের কর্ম নয়।

সে কথা যাক। আমি বলছিলুম, বিদেশ যাওয়ার পূর্বে আমার বিশ্বাস ছিল পাণ্ডা জগতের অশোক স্তম্ভ এবং কুতুবমিনার ভারতীয় হিন্দু এবং মুসলমান পাণ্ডা। জেরুজালেমে গিয়ে সে ভুল ভাঙল।

আমি তীর্থপ্রাণ। অর্থাৎ তীর্থ দেখলেই ফুল চড়াই, ‘শিরনি’ বিলাই। ভারতীয় তাবৎ তীর্থ যখন নিতান্তই শেষ হয়ে গেল তখন গেলুম জেরুজালেম। ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমান এই তিন ধর্মের ত্রিবেণি জেরুজালেম। বিশ্বপাণ্ডার ইউ.এন.ও. ওইখানেই। সেখান থেকে গেলুম বেৎলেহেম- প্রভু যিশুর জন্মস্থান।

বড়দিনের কয়েকদিন পরে গিয়েছিলুম। জেরুজালেম-বেলেহেমের বাস সার্ভিস আমাদের স্টেট বাসের চেয়ে অনেক ভালো (বাসের উপর পলায়মান ব্যাঘ্রের ছবি একে কর্তারা ভালোই করেছেন–বাঘ পর্যন্ত ভিড় দেখে ভয়ে পালাচ্ছে)। পকেটে গাইডবুক পাণ্ডার ‘এরজাৎস’– কাঁধে ক্যামেরা হাতে লাঠি। আধঘণ্টার ভিতর বেৎলেহেম গ্রামে নামলুম।

ভেবেছিলুম, দেখতে পাব, বাইবেল বর্ণিত ভাঙাচোরা সরাই আর জরাজীর্ণ আস্তাবল– যেখানে যিশু জন্ম নিয়েছিলেন। সব কঞ্জুর। সবকিছু ভেঙেচুরে তার উপর দাঁড়িয়ে এক বিরাট গির্জা।

গির্জাটি প্রিয়দর্শন অস্বীকার করিনে। আর ভিতরে মেঝের উপর যে মোজায়িক বা পাথরে খচা আলপনা দেখলুম তার সঙ্গে তুলনা দেবার মতো রসসৃষ্টি সেন্ট সোফিয়া, সেন্ট পল কোথাও আমি দেখিনি। সে কথা আরেক দিন হবে।

গাইডবুকে লেখা ছিল, গির্জার নিচে ভূগর্ভে এখনও আছে সেই আস্তাবল– যেখানে প্রভু যিশু জন্মগ্রহণ করেন। সেই গহ্বরে ঢুকতে যেতেই দেখি সামনে এক ছ-ফুটি পাণ্ডা। বাবরি চুল, মান-মনোহর গাল-কম্বল দাড়ি, ইয়া গোপ, মিশকালো আলখাল্লা, মাথায় চিমনির চোঙার মতো টুপি, হাতে মালা– তার এক-একটি দানা বেবি সাইজের ফুটবলের মতো। পাদ্রি পাণ্ডার অর্ধনারীশ্বর।

গুরুগম্ভীর কণ্ঠে শুধাল, ‘হোয়াট ল্যানগুইজ? কেল লাগ? বেলশে শখে? লিসান এ?’ প্রায় বারোটা ভাষায় জিগ্যেস করল আমি কোন ভাষা বুঝি।

সবিনয় বললুম, ‘হিন্দুস্থানি।’

বলল, “দস পিয়াস্তর।’ অর্থাৎ দশ পিয়াস্তর (প্রায় এক টাকা) দর্শনী দাও।

‘দস্’ ছাড়া অন্য কোনও হিন্দুস্থানি সে জানে না বুঝলুম, কিন্তু তাই-বা কী কম? আমি অবাক হয়ে ইংরেজিতে বললুম, ‘প্রভু যিশুর জন্মভূমি দেখতে হলে পয়সা দিতে হয়?’

বলল, ‘হ্যাঁ।’

অনেক তর্কাতর্কি হল। আমি বুঝিয়ে বললুম, ‘আমি ভারতীয়, খ্রিস্টান নই, তবু সাত-সমুদ্র তেরো-নদী পেরিয়ে এসেছি সেই মহাপুরুষের জন্মভূমি দেখতে যিনি সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করেছিলেন গরিব-ধনীর তফাত-ফারাক ঘুচিয়ে দেবার জন্য, যিনি বলেছিলেন কেউ কামিজটা চাইলে তাকে জোব্বাটি দিয়ে দেবে– আর তাঁরই জন্মভূমি দেখবার জন্য দিতে হবে পয়সা?’

শুধু যে চোরা-ই ধর্মের কাহিনী শোনে না তা নয়। আমি উলটো পথ নিলুম- পাণ্ডা ফিরে পর্যন্ত তাকাল না।

গাইডবুকে লেখা ছিল, গহ্বরে যাবার দুটি রাস্তা। একটি গ্রিক অর্থডকস্ প্রতিষ্ঠানের জিম্মায়, অন্যটি রোমান ক্যাথলিকদের। গেলুম সেটির দিকে– গির্জাটি ঘুরে সেদিকে পৌঁছতে হয়।

এখানে দেখি আরেক পাণ্ডা– যেন পয়লাটার যমজ। বেশভূষায় ঈষৎ পার্থক্য।

পুনরপি সেই সদালাপ। ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল।’ অম্মো না-ছোড়-বান্দা।

দিল-দরাজ, খোলা-হাত পাঠক হয়তো অসহিষ্ণু হয়ে বলবেন, ‘তুমি তো আচ্ছা ত্যাঁদোড় বাপু; এত পয়সা খর্চা করে পৌঁছলে মোকামে– এখন দু পয়সার চাবুক কিনতে চাও না হাজার টাকার ঘোড়া কেনার পর? তা নয়, আমি দেখতে চাইছিলুম পাণ্ডাদের দৌড়টা কতদূর অবধি।

এবারে হার মানবার পূর্বে শেষ বাণ হানলুম।

বললুম, ‘দেশে গিয়ে কাগজে লিখব, রোমান ক্যাথলিক প্রতিষ্ঠান কীরকম প্রভু যিশুর জন্মস্থান ভাঙিয়ে পয়সা কামাচ্ছে। আমাদের দেশেও কমুনিটি আছে।’

বলে লাঠিটা বার-তিনেক পাথরে ঠুকে ফিরে চললুম ঘেত ঘোত করে বাসস্ট্যান্ডের দিকে।

পাণ্ডা ডাকল, “শোনো।’

 আমি বললুম, ‘হুঁ।’

‘তুমি সত্যি এত টাকা খরচ করে এখানে এসে দশ পিয়াস্তরের জন্য তীর্থ না দেখে চলে যাবে?’

‘আলবত। প্রভুর জন্মভূমি দেখার জন্য পয়সা দিয়ে প্রভুর স্মৃতির অবমাননা করতে চাইনে।’

খ্যাঁস খ্যাঁস করে দাড়ি চুলকোল অনেকক্ষণ ধরে। তার পর ফিস্ ফিস্ করে কানের কাছে মুখ– বোঁটকা রসুনের গন্ধ– এনে বলল, ‘যদি প্রতিজ্ঞা কর কাউকে বলবে না ফ্রি ঢুকতে দিয়েছি, তবে–’

আমি বললুম, ‘আচ্ছা, এখানে তোমার ব্যবসা মাটি করব না। কিন্তু দেশে গিয়ে বলতে পারব তো?’

তখন হার মানল। আমরা বহু লঙ্কা জয় করেছি!!