প্রথম অংশ : ছন্দপতন
দ্বিতীয় অংশ : মৃত্যুহরণ

সপ্তরিপু – শেষকথা

শেষকথা

জোহরার বড়ো বড়ো চোখের দিকে তাকিয়ে বিদায় নিতে গিয়ে ম্যাকফির বুকের ভেতরটা বার বার মোচড় দিয়ে উঠছিল। কিন্তু এই বয়সেই নিষ্ঠুর বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে একটা ব্যাপার ও শিখতে পেরেছে।

জীবনে কখনো-কখনো বিদায় নেওয়াটা কষ্টের হলেও সেটাই সবদিক থেকে উত্তম। পাতালের নদী থেকে তারা বেরিয়ে এসেছে আজ সাত দিন। এই সাত দিনে অনেককিছু ঘটে গেছে। পাতাল থেকে উঠে এসে ওরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে প্রথমেই গেছে সেই ক্যাম্পে, যেখান থেকে ইংরেজ অফিসারেরা গায়েব হয়েছিল। ক্যাম্পের পাশেই প্রায় শুকনো নালার দশ হাত মাটির নিচে তালুকদার-নায়েবসহ সবকয়টা ইংরেজ অফিসারের লাশ পাওয়া গেছে।

তালুকদারদের লাশ ওদেরকে বুঝিয়ে দিয়ে ইংরেজ অফিসারদের লাশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে মাদ্রাজে। লাশ পাঠানোর পরের দিনই হেনরি স্লিম্যানকে ডেকে পাঠানো হয়। তার সঙ্গেই বিদায় নেওয়ার কথা ছিল ম্যাকফি আর তার দলের। কারণ ওরাও মিশন শেষ করেছে। কিন্তু ম্যাকফি যেতে পারেনি মহাবীর সিংয়ের কারণে।

ঠগীদের সঙ্গে যুদ্ধের সময়ে প্রচণ্ড আহত হয় সে। ঠিক হতে কয়েকদিন লেগে যায়। প্রথমে মনে হয়েছিল তাকে বাঁচানোই মুশকিল হবে। স্থানীয় কবিরাজের সহায়তায় আর নিজের বিপুল শক্তির বলে একটা সময় পরে ঠিক হতে শুরু করে সে। অন্যদিকে প্রাণে বেঁচে গেলেও এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেনি শংকর। প্রচণ্ড প্রহারের ধাক্কায় এখনো অসুস্থ সে। তবে কবিরাজ জানিয়েছে সময় লাগলেও সুস্থ হয়ে যাবে সে। এর পাশাপাশি ম্যাকফির দলে যোগ হয়ছে নতুন একজন সদস্য; ডুম্বুর। ম্যাকফি সিদ্ধান্ত নিয়েছে-ডুম্বুর রাজি থাকলে তাকে নিজের দলে নিয়ে নিবে ও। কারণ এরকম দক্ষ ট্র্যাকার পুরো ভারতবর্ষ খুঁজেও পাবে কি না সন্দেহ আছে।

মাঝের এই সময়টা তালুকদার আর আচার্যদের সঙ্গেই ছিল ম্যাকফি আর ওর দল। দুই পরিবার তাদের শত্রুতা ভুলে এখন এক হয়েছে। তারা সিদ্ধান্তে এসেছে এখন থেকে এলাকা আর ব্যবসা দুটোই ভাগ করে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করবে তারা। প্রথমদিন দেখা সূর্যকান্ত আর বর্তমান সূর্যকান্তের ভেতরে অনেক ফারাক।

দুই পরিবারের তরফ থেকেই অনেক অনেক উপহার দেওয়া হয়েছে ওদেরকে। অনেক অলংকার, প্রাচীন মূর্তি, সোনার গহনা, রত্ন ইত্যাদি-ইত্যাদি। এত উপহার নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় তাই ওরা একটা বড়ো সিন্দুকে ভরে জমিদারদের কাচারি বাড়ির মাটির নিচের ঘরে রেখে দিয়েছে। সূর্যকান্ত কথা দিয়েছে ওরা আবার ফিরে না আসা পর্যন্ত ওটাতে কেউ হাত দিবে না।

এই সময়ের ভেতরে অবশ্য ম্যাকফি আরেকটা কাজ করেছে। এখানে যা যা ঘটেছে তার একটা অংশ সে ডায়েরিতে লিখে জমিদারদের কাচারি বাড়ির নিচের ওই সিন্দুকে রেখে দিয়েছে। তবে ওটাতে পাতাল মন্দিরের বিষয়টা লেখেনি। কারণ সূর্যকান্ত থেকে শুরু করে সবাই মিলে ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ওটা শুধুই অমঙ্গল বয়ে আনবে। কাজেই ওটার বিষয়ে কোনো রেকর্ড না থাকাই ভালো। তবুও ভবিষ্যতে যদি কখনো প্রয়োজন হয় সেকথা ভেবে ও আর হেনরি মিলে একটা ছোটো ম্যাপ বানিয়ে সেটা রেখে দিয়েছে পাতাল থেকে নিয়ে আসা কালী মূর্তিটার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া অতিরিক্ত একটা অংশে। এই মূর্তিটাকেও ভারতে না রেখে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাতালের কথা লেখা না থাকলেও এসবই লেখা আছে ম্যাকফির দিনলিপিতে।

ওদের আরো কয়েকদিন থাকার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু মাদ্রাজ থেকে ডেকে পাঠানো হয়েছে ওদের, কারণ হেনরির সমস্ত প্রমাণ দেখার পর অথরিটি তার কথা বিশ্বাস করেছে। তারা হেনরিকে নির্দেশ দিয়েছে একটা বিশেষ দল গঠন করে সমস্ত ঠগীদের নির্মূল করতে হবে। ম্যাকফি এখনো জানে না, মাদ্রাজ গেলেই তাকে সরাসরি ক্যাপ্টেন থেকে পদোন্নতি দিয়ে হেনরি স্লিম্যানের বিশেষ দলে যোগ দেওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে। মাদ্রাজে হেনরির এই বিশেষ দলের নাম দেওয়া হয়েছে ‘হিজ ইয়ং অফিসার্স’।

তবে এসবের কিছুই জানে না ম্যাকফি। সে জানে বাঙ্গাল মুলুকের মাটিতে তার কাজ শেষ হয়েছে। তাকে এখন বিদায় নিতে হবে। জোহরার বড়ো বড়ো চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না ও।

জোহরাও কিছু বলল না। দুজনার কেউই জানে না আর কোনো দিন দেখা হবে কিনা। ম্যাকফি নিজের পকেট থেকে বের করে একটা জিনিস ধরিয়ে দিল জোহরার হাতে। ‘ঠগীদের সঙ্গে যুদ্ধের দিন রাতে আপনি আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলেন,’ বলে ও নিজের কপালের পাশের কাটা দাগটা দেখিয়ে বলল। এই দাগটা কীভাবে হয়েছিল?’ বলে একবার মাথা নাড়ল ও।

‘এই কথাটা কেউ জানে না। আমার বাবার নীল চাষের ব্যবসা ছিল। ভীষণ অত্যাচারী মানুষ ছিল সে। নেটিভ তো বটেই আমার মাকেও ধরে মারতো সে নিয়মিত। কোনো একদিন মাকে মারার সময় আমার বাবাকে গুলি করি আমি। বাবা আমার গুলিতে মারা যায়, আর এই ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে মা…’ ম্যাকফির গলা বুজে আসতে লাগল। ‘জীবনে প্রথমবার গুলি করার সময়ে বন্দুকের বাঁটের ধাক্কায় কপাল কেটে গেছিল আমার। সেদিনই বাড়ি থেকে পালাই আমি। ওইদিনের পর থেকে কোনো দিনই নিজের স্বজাতির অতিরিক্ত প্রভুত্ব আমি মেনে নিতে পারিনি। একারণেই সাদা চামড়া হবার পরও ছোটোবেলা থেকেই আমি চেষ্টা করেছি ভারতীয় হবার। আমার জন্যে প্রার্থনা করবেন, যেন এই চেষ্টা আমি চালিয়ে যেতে পারি। হয়তো কোনো দিন আমি পুরোপুরি ভারতীয় হতে পারব। হয়তো কোনো দিন আবার ফিরে আসবো এই এলাকায়।’

একবার জোহরার দিকে তাকিয়ে বাউ করে ঘোড়ায় উঠে পড়ল। এই চোখের মায়ায় জড়িয়ে পড়া চলবে না তার। অনেক কাজ বাকি এখনো, অনেক কর্তব্য বাকি। দলের সবাই প্রস্থান করার পর। ধীরে ধীরে নতুন পথ, নতুন জীবনের দিকে পা বাড়াল সে।

ম্যাকফির ঘোড়াটা যতক্ষণ চোখে পড়ল তাকিয়ে রইল জোহরা। ঘোড় সওয়ারেরা দৃষ্টির আড়াল হতেই মখমল কাপড়ের আবরণ খুলে জিনিসটা বের করল জোহরা। সেই দুরবিন, যেটা দেখে বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে উঠেছিল সে। ইংরেজ অফিসারের মুখটা মনের পর্দায় ভেসে উঠতেই দু-ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল দুরবিনের স্বচ্ছ কাচের ওপরে।

***

‘তুমি কি নিশ্চিত?’ বাশার রিফাতের চোখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল। ‘আমার কি আসলেই এমনটা করা উচিত?’

রিফাত কিছু না বলে নিজের ভালো হাতটা বাশারের স্টিয়ারিংয়ের ওপরে রাখা হাতের ওপরে রাখল। ‘আমি নিশ্চিত, বাশার। দেখো ওরা তোমার নিজের মানুষ। তারা যা করেছে করেছে। তুমি যদি এখন তাদের ওপরে রাগ করে দূরে সরে থাকো তবে এক্ষতি কার, বলো? আমি নিশ্চিত তোমার মা বেঁচে থাকলে উনি ও একথাই বলতেন তোমাকে।’

বাশার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ‘আমি যখন বিদেশে বসে মায়ের মৃত্যুর খবর পেলাম, বিশ্বাস করো আমি ভেবেছিলাম আমি আর কোনোদিন স্বাভাবিক হতে পারব না। পাগলের মতো ফিরে এসেছিলাম দেশে। তারপর পুলিশে ঢুকলোাম। যেদিন রাজু আমার হাতে খুন হয় সেদিনের ঘটনা আমি এখনো কাউকেই ঠিকমতো বলিনি। সেদিন আমার আর রাজুর ডিউটি ছিল না। কিন্তু আমরা খবর পাই স্থানীয় এক চোরাচালানীর বড়ো একটা ডিল হতে যাচ্ছে। তবে খবরটা নিশ্চিত ছিল না। তাই অফিসকে না জানিয়েই আমরা সেটা তদারকি করতে গিয়ে ওদের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি। প্রচণ্ড বৃষ্টির ভেতরে গোলাগুলির এক পর্যায়ে রাজু একটা ট্রাকের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলে তীব্র বৃষ্টির ভেতরে ওকে শত্রুপক্ষের লোক মনে করে আমি রাজুকে গুলি করে দেই,’ বলেই বাশার থেমে গেল। কিছুতেই পুরনো আবেগকে বাঁধ মানাতে পারছে না ও।

‘এখন তো সব ঠিক হয়ে গেছে,’ রিফাত বাশারের হাতটা চেপে ধরল।

আসলেই গত কয়েকদিনে অনেক কিছু বদলে গেছে। ওসি মল্লিককে সাসপেন্ড করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একইসঙ্গে বরখাস্ত করা হয়েছে তৌফিককেও। ওসি মল্লিকের পদে ওকেই বসানোর কথা ছিল, কিন্তু ও বিনয়ের সঙ্গে সেটা প্রত্যাখান করে রমিজ দারোগার নাম প্রস্তাব করেছে। কারণ লোকটার রিটায়ারমেন্টের আর বেশি বাকি নেই। অন্তত প্রমোশন পেয়ে রিটায়ার করুক। আবদুল্লাহ প্রমোশন পেয়ে সিনিয়র কনস্টেবল হয়েছে। সে মেডেলেও পেয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে এই কেসের সব আলগা সুতো জোড়া লাগানো হয়েছে। পাতালের সেই মন্দির এখন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে একটা বিশেষ দল গঠন করে ওটার পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু করা হবে খুব দ্রুতই। পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের এই বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রিফাতকে।

তবে জয়া সরকার সেদিন মরেনি। ওইদিন গুলি খাবার পর বাশার ভেবেছিল মারা গেছে জয়া। কিন্তু পরে পুলিশ জায়গামতো পৌঁছে আবিস্কার করে ভীষণ আহত হলেও নিশ্বাস চলছে তার। কিছুদিন যমে-মানুষে লড়াই করার পর ডাক্তার নিরাপদ ঘোষণা করেছে তাকে। তবে অবস্থা এখনো খুব খারাপ। হাসপাতালেই আছে। সুস্থ হবার পর বিশেষ সেল গঠন করে বিচার করা হবে তার। এসবই বেশ কয়েকদিন আগের ঘটনা।

তবে এই মুহূর্তে বাশারকে যা করতে বলছে রিফাত সেটা ওর জন্যে অনেক কঠিন। ওরা বসে আছে ময়মনসিংহ মুক্তাগাছা রোডের একটা বিশেষ জায়গায়। এখানেই ওর নানার বাড়ি, ওর বাবা মারা যাবার পরে যেখানে ছোটোবেলা থেকে বেড়ে উঠেছে ও। মায়ের মৃত্যুর পরে আর কখনো ফিরে আসেনি। রিফাতের অনুরোধেই ও এসেছে এখানে। যাতে পুরনো আত্মীয়দের সঙ্গে বিবাদ মিটিয়ে আবারো মিলেমিশে থাকতে পারে।

বাশার কিছু না বলে ড্যাশবোর্ড থেকে একটা খাম বের করে আনলো। গতকালই চিঠিটা ওর নামে ডাকে এসেছে। চিঠির ভেতরে একটা বিশেষ নিয়োগের ব্যাপারে অনুরোধ করা হয়েছে তাকে। কিছুদিন আগে দেশ জুড়ে আলোচিত অপারেশন ব্ল্যাক বুদ্ধার কমান্ডার সৎ, সাহসী, আর দক্ষ অফিসারদের নিয়ে একটা বিশেষ দল গঠন করার পরিকল্পনা করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাশারের এই কেসে সাফল্য দেখে তাকে ওই দলে নিতে আগ্রহী হয়েছে ওই সেকশনের প্রধান। ওকে প্রমোশন তো দেওয়া হবেই সেই সঙ্গে বিশেষ দলে ওকে গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গাও দেওয়া হবে। বাশার মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে যোগ দিবে ওই বিশেষ দলে।

‘ঠিক আছে তোমার কথাই সই। চলো,’ বলে ও জিপটাকে মূল রাস্তা থেকে বামে নামিয়ে দিল। আগে এই রাস্তা কাঁচা ছিল এখন পাকা হয়েছে। জিপ নিয়ে সোজা একটা বাড়ির সামনে চলে এলো ও। বাড়ির বাইরেই বুড়ো এক লোক মোড়ায় বসে আছে। একটু নজর বুলিয়েই লোকটাকে চিনতে পারল ও। মানুষটা সম্পর্কে ওর নানা হয়, আজহার নাম। ওরা ‘আজু নানা’ ডাকত।

বাশারও তাকিয়ে আছে, লোকটাও তাকিয়ে আছে ওর দিকে। হঠাৎ লোকটা বলে উঠল। ‘এই, এইদিকে আইয়ো। তুমি রাহেলার পোলা না?’

বাশার মাথা নাড়ল, ‘হ, নানা।’

‘এই হুনো হুনো,’ বুড়ো মানুষটা বাড়ির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল। ‘রাহেলার পোলা আইছে। ওমা, লগে দেহি বউও লইয়া আইছে।’

শেষ কথাটা শুনে রিফাতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে উঠল বাশার। শেষ বিকেলের আলোয় রাঙা হয়ে উঠেছে রিফাতের গাল। ওকে পাশে নিয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে পা বাড়াল বাশার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *