প্রথম অংশ : ছন্দপতন
দ্বিতীয় অংশ : মৃত্যুহরণ

সপ্তরিপু – অধ্যায় ৩৩

অধ্যায় তেত্রিশ – সময় : ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ

বৃহত্তর মধুপুর এলাকা, ময়মনসিংহ

যজ্ঞের কাজে নামার আগে সবসময় একই উত্তেজনা কাজ করে ফিরিঙ্গিয়ার ভেতরে।

কারণ যজ্ঞ মানেই এলাহি কাজ-কারবার। তবে আজকের যজ্ঞটা বিভিন্ন কারণে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আজকের যজ্ঞে কয়েকটা ব্যাপার একসঙ্গে ঘটতে চলেছে। যজ্ঞ পালনের সাধারণত তিনটে অংশ থাকে।

প্রস্তুতি, সম্পন্নকরণ আর ভোজ।

তবে আজকের যজ্ঞে বাসনার মাত্রা অনেক বেশি, যে কারণে এই তিনটের বাইরেও আরো দুটো অংশ যোগ করা হবে আজ : বলি আর শপথ।

যজ্ঞের প্রস্তুতি হিসেবে সময় নেওয়া হয় এক হপ্তা, কখনো কখনো দু-হপ্তা কিন্তু এবারের যজ্ঞের জন্যে সময় পাওয়া গেছে স্রেফ একদিন। কারণ যজ্ঞের সময় মেলানোর জন্যে দুটো ব্যাপার খুব গুরুত্বপূর্ণ।

দিনটা সপ্তাহের মঙ্গল, বুধ কিংবা শুক্রবার হতে হবে, সেই সঙ্গে সময়টা হতে হবে চন্দ্র-তিথি। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, সময়টা হতে হবে একবার পথে নামার পর অন্যবার পথে নামার মাঝখানে যে অবসর থাকে সেই সময়। গতবার সফলভাবে পথে নামার পর হিসেব করে দেখা গেছে একদিন পরেই বুধবার, সেই সঙ্গে চন্দ্র-তিথিও বটে। তাই একদিনেই সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে বাধ্য হয়েছে ওরা। তবে অনেক বয়স্ক লোকের এতে আপত্তি ছিল কিন্তু ফিরিঙ্গিয়া কোনো আপত্তি শোনার মানুষ নয়। পথ থেকে ফিরে এসে দিন গণনা করে যখন জানা গেল একদিন পরেই সময়, সে স্রেফ কয়েকঘণ্টা বিশ্রাম নিয়েই কাজে লেগে গেছে। নিজেদের বসতবাড়ি থেকে গোপন পথে চলে এসেছে মন্দিরে। মন্দিরের প্রাঙ্গণেই আগুন জ্বেলে লোহা গরম করে তৈরি করেছে বিশেষ কোদাল।

এই কোদালই হলো ওদের দলের মূল প্রতীক-মা ভবানীর আশীৰ্বাদ। পেহলু মানে রুমাল, সিক্কা মানে সেই রুমালের ভেতরে দেওয়া কয়েন আর কাসসি মানে কোদাল—এই তিনটেই সরাসরি মা ভবানীর আশীর্বাদ।

কথিত আছে পৃথিবীতে তখন রক্তবীজ দানবদের উৎপাত চলছিল। তাদের অত্যাচারে পৃথিবী অতিষ্ঠ। এমনকি দেবী মাতা খোদ তাদের সঙ্গে লড়াইয়ে অবসন্ন, কারণ রক্তবীজদের আঘাত করলে এদের দেহ-নিঃসৃত রক্ত মাটিতে পড়তেই সেখান থেকে আরো শত-শত রক্তবীজের উৎপত্তি হয়। এদের সঙ্গে লড়াইয়ের ক্লান্ত-অবসন্ন দেবী মাতা যখন বিপর্যস্ত তখন তার দেহ-নিঃসৃত ঘাম থেকে জন্ম হয় দুই অনুচরের। এরাই মানুষ। দেবী মাতা তাদের দেখে খুশি হয়ে নিজের কাপড়ের একফালি মানুষদের হাতে উঠিয়ে দিয়ে বললেন, এটাই তাদের অস্ত্র এটা দিয়েই তাদের শত্রু বধ করতে হবে।

অস্ত্র হিসেবে কাপড়ের ফালি দেবার পেছনে কারণ ছিল—এটা দিয়ে খুন করলে শত্রুর রক্তপাত হবে না, রক্তবীজদের সঙ্গে লড়াইয়ে এই ব্যাপারটা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনুচরেরা দেবীর আশীর্বাদে সেই ফালি দিয়ে রুমাল তৈরি করে রক্তবীজদের সঙ্গে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হলো। সেই লড়াইয়ে বিনারক্তপাতে তারা একে একে ফাঁস পরিয়ে ধ্বংস করল সব রক্তবীজদের। যুদ্ধ শেষে দেবী মাতা এই রুমাল চিরতরে তাদের হাতে উঠিয়ে দিয়ে নির্দেশ দিলেন, যারা দেবীর অপমান করে, যারা শত্রুকুলের সৃষ্টি, যারা তোমাদের পাথেয়র যোগানদার তাদেরকে এই রুমাল দিয়ে হত্যা করবে। সেই সঙ্গে দেবীমাতা নিজের একটা দন্ত খুলে দিয়ে বললেন, ‘এই রইল তোমাদের মাটি খোড়ার হাতিয়ার; কোদাল। ফাঁস দিয়ে শত্রু নিধন করে কোদাল দিয়ে কবর খুড়ে মৃতদেহ কবরে রাখবে।’

সেই থেকে কোদাল হয়ে দাঁড়ায় ওদের প্রতিটি দলের প্রতীক, দেবীর আশীর্বাদপুষ্ট হাতিয়ার। তবে প্রতিবার পথে নামার আগে নতুন করে কোদালকে মন্ত্রপূত করে দেবীর আশীর্বাদ পুষ্ট করতে হয়, সেটাই এই যজ্ঞের মূল উদ্দেশ্য।

ফিরিঙ্গিয়া দলের নেতা হিসেবে নিজ হাতে আগের দিনে তৈরি করেছে কোদাল। তৈরি হবার পর মন্দিরে জোড়া দেবীর পায়ের কাছে পবিত্র স্থানে রেখেছে কোদালটা। মাত্র পাঁচ থেকে ছ-ইঞ্চি লম্বা কোদাল, সের দুয়েকের মতো ওজন, কোনো হাতল নেই। এইটাই ওদের দলের প্রতীক হতে যাচ্ছে।

সারারাত দেবী মাতার পায়ের কাছে রাখার পর শুভ সময় দেখে শুরু হয়েছে যজ্ঞ। আগে ওরা বাড়ির ভেতরেই করত, কিন্তু এখন জোড়াদেবীর মন্দিরে দেবী মাতার বেদির সামনেই গোল হয়ে বসেছে সবাই। এরা সবাই অভিজ্ঞ-পোড় খাওয়া- শক্তিশালী খাঁটি ঠগী একেকজন।

ভারতবর্ষে প্রচলিত ঠগীদের ভেতরে এই দল হলো সেরাদেরও সেরা। কারণ বেশিরভাগ ঠগীই সংসার ধর্ম করলেও এরা করে না। মা ভবানীর অনুকম্পাই এদের একমাত্র প্রাণসঞ্চারণী। দলের সবার প্রাণ কেন্দ্রে বসে আছে থুথুরে বুড়ো একজন। এই লোকই আসলে দলের প্রকৃত নেতা। ফিরিঙ্গিয়া তারই পালক সন্তান, কিন্তু সে অথর্ব হয়ে পড়াতে এখন ফিরিঙ্গিয়াই দলের ভারপ্রাপ্ত নেতা।

মন্দিরের প্রবেশ পথ এখন বন্ধ, ভেতরের রুদ্ধদ্বারে দেবীমাতার পায়ের কাছে সবাই গোল হয়ে বসে যেতেই উঠে দাঁড়াল ফিরিঙ্গিয়া। দলের নেতা হিসেবে এবার তার কর্মকাণ্ড শুরু হবে।

পাঁচ ফিট আট ইঞ্চি দীর্ঘ ফিরিঙ্গিয়ার সুঠাম পেশিবহুল দেহটা বিশেষ তেল লাগানোর ফলে একেবারে চকচক করছে। তার পায়ে লাল ধুতি, মাথায় সাদা পাগড়ি, কপালে তিলক। উঠে দাঁড়িয়ে দৃঢ় পায়ে সে দেবী মাতার পায়ের কাছে গিয়ে একেবারে নত হয়ে কোদাল ঢেকে রাখা লাল কাপড়টা সরিয়ে দিল। দুহাতে বিশেষ কায়দায় কোদালের মুখ দক্ষিণ দিকে রেখে উলটো হাঁটতে লাগল গোল হয়ে বসে থাকা লোকগুলোর মাঝামাঝি। দেবী মাতার দিকে পেছন ফেরা বেয়াদবি। সে উলটো হেঁটে গোল বৃত্তের ঠিক কাছাকাছি এসে থেমে গেল। শরীরটা সামান্য একটু ঘুরে গেল দক্ষিণ দিকে, সেই সঙ্গে তার শরীরটা বাঁকা হয়ে একটু ঝুঁকে এলো সামনের দিকে। বৃত্তের মাঝখানে আগে থেকেই একটা ছোটো গর্ত করে রাখা হয়েছিল সেটার ওপরে ধরতেই আরেকজন বয়স্ক ঠগী কোদালটাকে ধীরে ধীরে পরিষ্কার জলে ধুয়ে দিল। তার ধোয়া শেষ হতেই আরেকজন উঠে এলো, এবার সে আরেকটা পাত্র নিয়ে কোদালটাকে ধুয়ে দিল চিনি জলে, একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি হলো আরোদুবার; একবার ঘোল দিয়ে, সবশেষে মদ দিয়ে।

ধৌতকরণ শেষ হতেই একজন এসে গর্তটা বুজিয়ে দিয়ে ওটার ওপরে তৈরি করল একটা ছোটো অগ্নিকুণ্ড, অগ্নিকুণ্ড তৈরি করতে করতে ওদিকে সদ্য ধোয়া কোদালকে সাতটি সিঁদুরের ফোঁটায় সজ্জিত করা হয়েছে। সিঁদুর দেওয়া হতেই সেই কোদাল অগ্নিকুণ্ডের ওপরে এসে সাতবার সেঁকে অগ্নিশুদ্ধ করা হলো। অগ্নিশুদ্ধ হয়ে যেতেই এতক্ষণ গোল হয়ে থাকা বৃত্তটা জোড়া দেবীর দিকে মুখ করে অর্ধবৃত্তাকারে বসে গেল। আর দলনেতা ফিরিঙ্গিয়া অগ্নিশুদ্ধ কোদাল হাতে এগিয়ে গেল বেদির দিকে।

যজ্ঞের এই অংশটাই সবচেয়ে গরুত্বপূর্ণ। কারণ এবার কোদালের শক্তি পরীক্ষা করা হবে। পাশ হলে এইটাই হবে দলের প্রতীক। ফেল হলে এতক্ষণ যা করা হয়েছে সব ব্যর্থ। আবারো নতুন দিন-তারিখ ঠিক করে নতুন করে করতে হবে সব। ফিরিঙ্গিয়া পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল বেদির দিকে। জোড়া দেবীর পায়ের কাছে একটা ছোবড়া ছাড়ানো নারিকেল রাখা আছে। কোদালের কোপে সেটাকে নিখুঁত দুটুকরো করতে হবে। ঠিকমতো দুটুকরো না হলেও সব ব্যর্থ, আবার একাধিক টুকরো হয়ে গেলেও সব ব্যর্থ।

ফিরিঙ্গিয়া মন্ত্রপূত কোদালটা দুহাতে উঠিয়ে ধরল মাথার ওপরে, তারপর সমস্ত শক্তি দিয়ে সেটাকে নামিয়ে আনলো নারকেলটার ওপরে। স্বস্তির সঙ্গে দেখল নারকেলটা নিখুঁত দুটুকরো হয়ে গেছে। আবেগে চোখে জল চলে এলো ফিরিঙ্গিয়ার। দেবীর পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল সে, দেবীর আশীর্বাদ আছে তার ওপরে। দলনেতা হবার পর থেকে সবার অমতে সে বারবার যে ঝুঁকি নিয়েছে, বারবার বিপদে ফেলেছে তার দলের লোককে, সেটা ঠিকই ছিল। দেবী মেনে নিয়েছেন সব। নারকেল দুটুকরো হতেই সমস্বরে সবাই চেঁচিয়ে উঠল, ‘জয় মাভবানী, জয় মাভবানী’।

ফিরিঙ্গিয়া উঠে দাড়াতেই একজন এসে তার হাত থেকে কোদালটাকে নিয়ে গেল। এটা এখন প্রাণ সঞ্চারিত, অগ্নিশুদ্ধ, দেবীর আশীর্বাদপুষ্ট কাসসি। এখন থেকে এটাকে কেউই আর কোদাল বলবে না, সবাই এটাকে ‘কাসসি’ নামেই ডাকবে। পথে নামার আগে এটাকে পবিত্র কোনোস্থানে রাখা হবে, যাতে কারো দৃষ্টি, হাতের ছোয়া কিংবা পায়ের নিচে না পড়ে। সেটা হলে দেবী রুষ্ঠ হবেন। এখন থেকে এই কাসসিই হবে তাদের দলের পথ নির্দেশক, তাদের দলের প্রতীক। ঠগীরা মনে করে পথে নামার পর তাদের সাফল্য ব্যর্থতার অনেকটাই নির্ভর করে এই কাসসির ওপরে।

যজ্ঞের এই পর্যায়ে সাধারণত ওরা আবারো গোল হয়ে বসে যায়। তারপর তাদেরকে পরিবেশন করা হয় তুপানির গুড়। কিন্তু আজ যজ্ঞে একটু পরিবর্তন আনা হবে। কারণ আজ একজন নতুন ঠগীর শপথ করানো হবে। ফিরিঙ্গিয়া সোজা হয়ে দুবার তালি দিল। তার তালি দেওয়ার কিছুক্ষণের ভেতরেই। মন্দিরের দুদিকের মূল প্রবেশপথ দিয়ে কয়েকজন প্রবেশ করল। একজন সামান্য নিচু হয়ে হাঁটছে তার একহাতে ধরে রাখা একটা সাদা রঙের ছাগল। সে ছাগলটাকে নিয়ে এসে দেবী মাতার পায়ের কাছে একটা খুঁটিতে বেঁধে রেখে চলে গেল। অন্যদিক থেকে আরেকজন প্রবেশ করল, তার সঙ্গে সদ্য কৈশোর পেরনো এক যুবক। বয়স বেশি না হলেও ইতিমধ্যেই তাকে দুবার পথে নামতে হয়েছে অন্যদের সঙ্গে। এই দুইবারেই সে নিজের সাহস আর মনের জোর প্রমাণ করেছে। এবার তাকে ঠগী হবার জন্যে সর্বশেষ শপথ নিতে হবে।

সদ্য গোসল করানো সাদা ধুতি-পাগড়ি আর লাল তিলক পরানো ছেলেটাকে এনে দেবীর পায়ের কাছে বসিয়ে দেওয়া হলো। ফিরিঙ্গিয়া এক কলসি পানি হাতে ছাগলটার সামনে এসে মন্ত্র পড়তে পড়তে পরিষ্কার পানির সবটাই ধীরে ধীরে ঢেলে দিল ছাগলটার গায়ে। পানি ঢেলে দিতেই প্রসন্ন চিত্তে সে দেখল ছাগলটা গা ঝাড়ছে। মনে মনে সে ভাবল, যাক দেবীর সমর্থন আছে, ছাগলটা চুপচাপ থাকলে বোঝা যেত দেবী খুশি নয়।

দেবীর প্রসন্নতা অনুভব করে সে বেদির সামনে থেকে একটা খড়্গগ উঠিয়ে নিয়ে তাতে তিলক মাখালো। এরপর সেটাকে ধরিয়ে দিল সেই যুবকের হাতে। এবারই যুবকের ঠগী হবার অন্তিম পরীক্ষা। তাকে এক কোপে ছাগলের মাথাটা ধর থেকে আলাদা করতে হবে। যদি সেটা সে নির্ভয়ে করতে পারে তবে তাকে শপথ করিয়ে অন্যদের মতোই তুপানির গুড় খেতে দেওয়া হবে। আর একবার যে তুপানির গুড় খাবে সে জন্মের মতো ঠগী হয়ে যাবে। আর যদি সে এক কোপে সাহসের সঙ্গে ছাগলের মাথা আলাদা করতে না পারে তবে তাকে আবারো দীক্ষার জন্যে তৃতীয়বারের মতো পথে নামানো হবে, এরপর আবারো যজ্ঞ আবারো বলি দেওয়া, দ্বিতীয়বারের মতো যদি সে বলি দিতে ব্যর্থ হয় তবে তাকেই বলি দেওয়া হবে দেবীর চরণে। অথবা তাকেও ফাঁস পরিয়ে অন্যান্য শিকারের মতোই ভাগ্য বরণ করে নিতে হবে।

ছেলেটা খড়্গগ হাতে ছাগলটার সামনে এসে দাঁড়াল। তার কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। এরকম ক্ষেত্রে সাধারণত ফিরিঙ্গিয়া কোনো ধরনের মায়া অনুভব করে না কিন্তু এই ছেলেটার ব্যাপারটা ব্যতিক্রম। কারণ একে দীক্ষা দিয়েছে সে নিজে। এর ব্যর্থতা তাকে কষ্ট দিবে। আর সফলতা এনে দিবে প্রসন্নতা।

ফিরিঙ্গিয়া বুকে দুই হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে রইল। ছেলেটা খড়ুগ মাথার ওপরে তুলে সমস্ত শক্তি দিয়ে নামিয়ে আনলো ছাগলটার ওপরে। ছিটকে পড়ল ছাগলের রক্তাক্ত সাদা মাথা। ফিরিঙ্গিয়া নিজের ভেতরে একই সঙ্গে স্বস্তি আর উল্লাস অনুভব করল। পেছন থেকে অর্ধবৃত্তাকারে বসে থাকা মানুষগুলো সমস্বরে চিৎকার করে উঠল, ‘জয় মাভবানী, জয় মাভবানী’। ফিরিঙ্গিয়া আনন্দের সঙ্গে খেয়াল করল ছেলেটা যেভাবে রক্তাক্ত খড়্গগ আর ছাগলের কাটা মাথাটা দেখছে তাতে পরিষ্কার বোঝা যায় এই ছেলে একদিন অসাধারণ ঠগী হবে। ফিরিঙ্গিয়া শক্ত করে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরল তাকে।

দুজন এসে ছাগলটাকে নিয়ে গেল আর কাটা মাথাটা ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখল জোড়া-দেবীর পায়ের কাছে। ফিরিঙ্গিয়া ছেলেটাকে এনে বসিয়ে দিল অর্ধবৃত্তের এক প্রান্তে। নিজে এসে বসে পড়ল বৃত্তের মাঝখানে। একেবারে মাঝখানে বসে আছে দলের প্রকৃত নেতা, তার বাপ। এখনো ফিরিঙ্গিয়া নিজে একেবারে কেন্দ্রে বসার অনুমতি পায়নি। যতদিন সে পরোপুরি দলনেতা না হচ্ছে ততোদিন পাবেও না। ফিরিঙ্গিয়া বসে একবার ইশারা করতেই যজ্ঞের দ্বিতীয় ধাপ শুরু হয়ে গেল। তাদের অর্ধবৃত্তের সামনে চুন আর হলুদ দিয়ে একটা চৌকস ছক কেটে রাখা হয়েছিল আগেই। সবাই বসে যেতেই সেটার ওপরে মাপে মাপে সুন্দর পরিষ্কার একটা কাপড় বিছিয়ে সেটার ওপরে একটা নারকেল মালার প্রদীপ জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। প্রদীপটাতে দুটো সলতে দেওয়া হয়েছে তবে আগুন জ্বলছে চারটে শিখায়, কারণ প্রতিটি সলতের দুই দিকে ধরানো হয়েছে আগুন। আগুন জ্বালানোর পর শুরু হবে যজ্ঞের সবচেয়ে আকাঙ্খিত ব্যাপার।

তুপানির গুড় পরিবেশন।

ঠগীরা মনে করে এই তুপানির গুড় একবার যে খেয়েছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সে চিরকালের মতো ঠগী হয়ে গেছে। তুপানির গুড় পরিবেশনের পর ওরা ‘ঝিম’ দিবে। ঝিমের পর আলোচনা, তারপর ছাগলের মাংস আর সাদা ভাত দিয়ে ভোজ।

পরিষ্কার মাটির সানকিতে করে একজন তুপানির গুড় নিয়ে আসতেই ফিরিঙ্গিয়ার বাপ উঠে দাঁড়াল। সবসময় দলনেতাই দলের সবাইকে গুড় খাইয়ে দিবে, এটাই নিয়ম। এমনকি ফিরিঙ্গিয়াও চাইলে দলের দ্বিতীয় নেতা হিসেবে এটা করতে পারবে না।

ফিরিঙ্গিয়ার বাপ প্রথমেই শানকি থেকে এক টুকরো গুড় তুলে ফিরিঙ্গিয়ার হাতে দিল। এরপর শপথ গ্রহণকারীকে দিতে হবে। ফিরিঙ্গিয়া গুড়ের টুকরোটা মুখে পুরে দিয়ে কিছুক্ষণ ওটার মিষ্টি আবেশে আবেশিত হয়ে রইল। ছোট্ট নরম এক টুকরো খয়েরি রঙের বস্তু। মুখে পুরে দিতেই মুখের ভেতরে গলে গেল। হালকা তিতকুটে একটা মিষ্টি ভাব সরাসরি গিয়ে ধাক্কা মারলো তার মস্তিষ্ক আর নার্ভাসসিষ্টেমে। নেশাতুর বিভোরতায় হারিয়ে যাবার আগে একবার চোখ পড়ল নতুন ছেলেটার দিকে। চোখ বন্ধ করে বিভোর হয়ে সে তুপানির গুড়ের স্বাদ ভোগ করছে। সে নিজেও গুড়ের মিষ্টি রস আহরণ করতে করতে তিতকুটে মিষ্টি রসের জগতে হারিয়ে গেল। মনে পড়ে গেল নিজের ঠগী হবার অভিজ্ঞতা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *