প্রথম অংশ : ছন্দপতন
দ্বিতীয় অংশ : মৃত্যুহরণ

সপ্তরিপু – অধ্যায় ৮

অধ্যায় আট – সময় : ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ

বেগুনবাড়ি, মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ

ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়া কিংবা ভাগ্যকে দোষারোপ করার মতো মানুষ ম্যাকফি নয়, কিন্তু এই মুহূর্তে সে নিজের ভাগ্যকেই সবচেয়ে বেশি দোষারোপ করছে।

কাজ শুরুর আগেই যদি বারবার এভাবে বাধা আসতে থাকে তবে ভাগ্যকে দোষারোপ না করে উপায় কী সকাল থেকে এখন পর্যন্ত রাজার সঙ্গেই দেখা করতে পারল না। ওরা রাজার বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখতে পায় রাজার কয়েকজন সৈন্য রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ওদের জন্যে অপেক্ষা করছে। ওদের গাড়ি থামাতেই অপেক্ষারত সৈন্যরা জানায় রাজা তার নতুন নির্মিতব্য বাড়ি পরিদর্শন করতে গেছে। ম্যাকফিরা চাইলে রাজার বাড়িতে অতিথি হয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করতে পারে।

আগত সৈন্যের প্রশ্নের জবাবে ম্যাকফি জানতে চায় : রাজাসাহেব ফিরবেন কখন। তখন সৈন্যরা জানায় দুপুরের আগে নয়। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাকফি সিদ্ধান্ত নেয়, সে অপেক্ষা করবে না বরং রাজাসাহেব যেখানে গেছে সেখানেই গিয়ে দেখা করবে তার সঙ্গে। সৈন্যদের কাছ থেকে পথের নির্দেশনা জানতে চাইলে ওদের সঙ্গে একজনকে দূত হিসেবে দিয়ে দেওয়া হয় পথ দেখানোর জন্যে। এখন ওরা রাজাসাহেবের নতুন নির্মিতব্য প্রাসাদের দিকে চলেছে।

এই অযাচিত দেরির জন্যে ম্যাকফির মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। অকারণেই একটা বেলা নষ্ট। ম্যাকফির দুশ্চিন্তা অন্য জায়গায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যরা গায়েব হয়ে যাবার পর ইতিমধ্যেই অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। যত সময় অতিবাহিত হচ্ছে ঘটনাটার রহস্য উন্মোচন করার সুযোগ ওদের জন্যে ততোই কমে যাচ্ছে। ওদের জন্যে এই মুহূর্তে যত দেরি ততো বিপদ। ম্যাকফি বাইরের জঙ্গল দেখতে দেখতে আপন মনেই সে ফিরে তাকাল ওদের সঙ্গে বসে থাকা রাজাসাহেবের সৈন্যটার দিকে। বেশ বয়স্ক একজন মানুষ। মুখে হালকা খয়েরি রঙের দাড়ি। কপালের একপাশে একটা কাটা দাগ। এই বয়সেও সে এখনো সৈনিক পদেই রয়ে গেছে, তার মানে সৈনিক হিসেবে খুব একটা দক্ষতা দেখাতে পারেনি।

‘তোমার নাম কি?’ মুখ দিয়ে একগাদা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সে সৈন্যটার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল।

‘সমীর দাস, হুজুর,’ একেবারে স্থির দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষটা ম্যাকফি প্রশ্ন করাতে একেবারে মাথা নিচু করে ওর দিকে ফিরে জবাব দিল। এইসব সহজ-সরল লোকজন এখনো সাদা চামড়ার মানুষ আর রাজ- রাজরাদের ব্যাপারে কী ধরনের মনোভাব লালন করে-ব্যাপারটা চিন্তা করে ম্যাকফি অবাক না হয়ে পারল না।

‘সমীর দাস, তুমি এভাবে মেঝেতে না বসে ওপরে উঠে বসতে পারো, ম্যাকফি ইশারায় নিজের পাশের আসনটা দেখাল। বয়স্ক একজন মানুষ মাটিতে বসে আছে ব্যাপারটা ওর কাছে বিব্রতকর মনে হচ্ছিল এতক্ষণ।

‘ছিছি, হুজুর একী কইলেন আপনে। আমরা হলাম নিচু জাত ছিছি,’ লোকটা কথা বলতে বলতে মাথা নাড়তে লাগল প্রবল বেগে। ম্যাকফি লোকটার একটা হাত ধরে টান দিয়ে বসিয়ে দিল। ভারতবর্ষে এইসব জাত-ফাতের ব্যাপারে সে খুব

ভালো ধারণা রাখে। এক জাতের লোকজন আরেক জাতের লোকজনের সঙ্গে এক আসনে বসার চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করে।

‘শোন সমীর দাস, জাত-ফাত তোমরা মানতে পারো, আমি এসব ব্যাপারকে পরিত্যাজ্য মনে করি। ঠিক কি না?’ শেষ কথাটা সে বলেছে তার নিজের দুই সাগরেদ মহাবীর সিং আর জোনাথনের দিকে তাকিয়ে। দুজনেই সমস্বরে হেসে উঠল ওর প্রশ্ন শুনে।

‘আমরা জাতের বিষয়ে আমলে নেই শুধুমাত্র ন্যায়-অন্যায় দিয়ে,’ বলে নিজের তলোয়ারে হাত বুলাতে বুলাতে মহাবীর সিং আবারো গাড়ি কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। তার হাসি শুনে সমীর দাস আরো গুটিয়ে এলো। ম্যাকফি তার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘আচ্ছা সমীর দাস, তুমি তো জানো আমরা এই এলাকায় নতুন এসেছি। আমাদেরকে এই এলাকা, রাজাসাহেব আর তার শাসন নিয়ে একটু ধারণা দিতে পারবে? যদি পারো তবে আমাদের জন্যে উপকার হবে।’

ম্যাকফির পাশে বসার পর থেকেই মানুষটা একেবারে মাথা নিচু করে আছে। ওর শেষ কথাটা শুনে সে মাথা তুললো ওপরের দিকে। ওদের সবার মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে হাতের বর্শাটা একপাশে রেখে মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে দুইহাত মুখের সামনে তুলে অস্ফুট সুরে কথা বলে উঠল, ‘হুজুর, আমরা নিচু জাতের মানুষ। উঁচু জাতের কেউর লগে কথা কউনেরও চিন্তা করতে পারি না। পাশে বউন তো দূরে থাক। আইন্নেরা আমারে এমুন সম্মান দিছুইন এই সম্মানের মান কেমনে রাহি। হুজুর কী জানবার চাইন, কইন।’

‘রাজাসাহেব নতুন বাড়ি যেখানে বানাচ্ছেন, সেটা এখান থেকে কতদূরে?’ ম্যাকফি জানতে চাইল।

‘হুজুর, এইনতে আর চাইর-পাঁচ মাইল দূরে ওবো।’

তারমানে ঘোড়ার গাড়িতে করে ওখানে পৌঁছাতে ওদের আরো আধা ঘণ্টার ওপরে লাগবে। এই সময়টা যথাসম্ভব কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে ও। এখানে আসার আগে এখানকার লোকজন সম্পর্কে যতটা খোঁজ-খবর নিতে পেরেছে তাতে ওর মনে হয়েছে এই এলাকার লোকজন এমনিতেই একটু লাজুক প্রকৃতির। সহজে বাইরের মানুষের সঙ্গে মিশতে চায় না। আর সাদা চামড়ার লোকজন দেখলে তো কথাই নেই। তাই তাদের কাছ থেকে তথ্য বের করতে অনেক কষ্ট হবে। তবে এই লোকটাকে বেশ কাজের মনে হচ্ছে। ‘তুমি নিজের কথা বলো। তুমি কি এই এলাকার লোক নাকি তোমরাও স্থানীয় রাজাসাহেবের মতো বাইরে থেকেই এসেছো?’

‘হুজুর, আমরা এই এলাকার আদি বাসিন্দা। মধুপুর ওদিকে আমার পুবপুরুষের তালুক আছিল। জমি-জমাও খারাপ আছিল না। বাপ-দাদাগর কাছে হুনছি এই রাজাসাইবরা এনু আয়ুনের আগে এই এলাকার সবচেয়ে বড়ো পরিবারগুলার ভেতরে আমগোর পরিবার আছিল একটা। এরপর আসল হেই দুর্ভিক্ষ। পর পর কয়েক বছরের খরা আর দুর্ভিক্ষে পুরা এলাকা সাফা হইয়া গেল। তহন আমার জন্মই অয়নাই। আমার বাপে ছোটো। হেই ঘটনার পরপরই বগুড়া থেইক্কা এই রাজাসায়েবগর পরিবার এই এলাকায় আইসা বসতি স্থাপন করল। খরা আর দুর্ভিক্ষে এইহানকার পরিবারগুলার অবস্থা তহন খুবই খারাপ। জমিতে ফসল নাই, গরে খাউন নাই, অনেক পরিবার সব হারায়া নিঃস্ব। তহন এই জমিদারেরা আউনের পরে মানুষ খুব খুশি হইছিল। হেরা এনু আইয়া রাজবাড়ি বানাইলো। নদীর তীরে হাট-বাজার বানাইলো, কাঠের কল বসাইলো। মানুষে কাম পাইলো। মরা এলাকা আবারো জমজমাট হয়া গেল।

‘তয় মানুষরে এতকিছু দেওয়ার বিনিময়ে হেরা নিজেগর সুবিধা বুইজ্জা লইলো। মানুষের অভাবের সুযোগে পানির চাইয়াও কমদামে মাইনষের জমি নিজেগর নামে লেহায়া লইলো। এক অর্থে কইতে গেলে হেরা এই এলাকায় জীবন ফিরায়া আনছে, কিন্তু মানুষ জানে বাঁচতে পারলেও হেরা সব হারায়া জমিদারগো পুষা প্রাণি হইতে বাইধ্য হইছে। হেরা এক পুরুষ ধইরা এইহানে বসতি স্থাপন করে। এরপরে শুরু হয় হেগো শাসন। এই এলাকায় একটা কুত্তাও হেগো অনুমতি ছাড়া লেজ লড়াইতে পারে না। এইডা লইয়া তালুকদারগো লগে হেগর গন্ডগুলও কম না। আমাগো পরিবারও এই একিভাবে সব হারাইছে। এরপরে আমি নানা ঘাটে ধাক্কা খাইতে খাইতে জমিদার বাড়িতে কাম পাইছি।’

‘এটা কত বছর আগের ঘটনা?’

‘আইজ থাইক্কা পঁচিশ বছর আগের।’

‘তুমি কি তখন থেকেই সৈনিক হিসেবে কাজ করছো?’

ম্যাকফির প্রশ্নের জবাবে বৃদ্ধ সৈনিক বড়ো করে নিশ্বাস ছাড়ল। ‘নাহ, হুজুর। আমি আরো বড়ো পদে চাকরি করতাম। বাপের কাছ থাইক্কা বহুত ঝামেলা কইরা জমিদারি পাউনের পরে এহনকার রাজা হের নিজের মানুষরে উপরে তুইল্লা, হের বাপের-ভাইয়ের অধীনে যারা কাম করত হেগোরে নিচে নামায় দিছে। কারণ হেয় আমগরে বিশ্বাস করে না।’

‘বিশ্বাস করে না কেন?’ অন্যপাশের সিট থেকে জোনাথন আধা ইংরেজি-আধা হিন্দি আর অল্প কিছু বাংলা মিশিয়ে প্রশ্ন করল। ওরা তিনজনই এর আগে দীর্ঘদিন কোলকাতায় ডিউটি করার কারণে অল্পবিস্তর হলেও বাংলা আর হিন্দিটা জানে।

‘কারণ হেয় তো জমিদারি পাইছে জুর কইরা।

‘জোর করে মানে?’

লোকটা অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকাল। ‘আপনেরা জানুইন না?’ সে বেশ অবাক হয়েছে। ‘আমরা তো মনে করি সাদা চামড়ার মানুষেরা সব জানে। হেয় জমিদারি জুর কইরা দহল করছে কারণ হেয় তো রাজার দ্বিতীয় ঘরের ছোড় পোলা। জমিদারি তো ছিল হের বড়ো বাইয়ের।’

‘এরকম কেন হলো?’ ম্যাকফি বেশ কৌতূহল বোধ করছে। এখানে আসার আগে তাকে যে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে সেটাতে এরকম কিছু লেখা ছিল না।

‘হুজুর, এইহানে ধর্মীয় বিবাদ আছে। এই এলাকায় জমিদারেরা বহুত কিছু বদলাইয়া দিছে। হেরা যা যা বদলাইছে তার মদ্যে অন্যতম একটা ছিল পূজার ধরন। হেরা এই হানে কালী পূজা আমদানি করছিল। অহনকার রাজার বড়ো ভাই আর তার মায়ে করত কালী পূজা। তো এইডা লইয়া বাপ আর দুই পুলার ভেতরে বহুত গন্ডগোল অইছে। বাপে ক্ষমতা দিছিল হের বড়ো পুলারে। বাপ মরুনের পরে বড়ো ভাইরে সরায়া অহনকার রাজা ক্ষমতা দহল করছে। হেয় তার বড়ো ভাইরে খালি ক্ষমতা ছাড়াই করে নাই, দেশ ছাড়াও করছে…হুজুর আমরা আইসা পড়ছি,’ কথা শেষ না করেই সে বাইরে দেখাল।

ম্যাকফি জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেখল বিরাট এলাকা জুড়ে কর্মযজ্ঞ চলছে। কাজের ব্যাপ্তি দেখে ওর চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। এত বিরাট কিছু আশা করেনিও।

গাড়ির ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে ম্যাকফি জোনাথন আর মহাবীর সিংয়ের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে সমীর দাসকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘সমীর, তোমার সঙ্গে আরো কথা বলতে পারলে ভালো লাগত,’ এই মানুষটার সঙ্গে কথোপকথনটা পুরোপুরি শেষ হলো না দেখে একটু খারাপ লাগছে। কারণ বাপ-ছেলে-ভাইয়ের রাজনীতিটা ওর আরো পরিষ্কার ভাবে বোঝা দরকার ছিল।

‘হুজুর, আপনারা এতবড়ো মানুষ তারপরও যে সম্মান আমারে দিছুইন, আমি জীবনে ভুলতাম না। তয় আপনেগো একটা কথা কই, আপনেরা বিপদে আছেন। সাবধানে থাইকেন। এইহানে সবাই আপনেগো শত্রু,’ শেষ কথাটা সে খুব আস্তে বলল। ‘হুজুর, ছুডু মুহে বড়ো কথা কইলাম, মাফ কইরা দিয়েন।’

গাড়িটা ইতিমধ্যেই থেমে গেছে। সমীর দাস মাথা নিচু করে গাড়ি থেকে নেমে ওদেরকে পথ দেখিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। ওরা গাড়ি থেকে নেমে সামনের বিরাট কর্মযজ্ঞের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এরকম প্রায় জঙ্গুলে এলাকার ভেতরে এত বিরাট আয়োজন দেখতে পাবে ওদের কল্পনাতেও আসেনি। একপাশে বিরাট গর্ত খুঁড়ে চলছে কর্মযজ্ঞ। সেই গর্তের আকার কম করে হলেও একটা মাঠের সমান হবে। অন্যদিকে বিরাট এলাকা জুড়ে চলছে ইট বানানোর কাজ। ওখান থেকে সারি সারি চুল্লি দেখা যাচ্ছে। অন্যপাশে সারিসারি টিনের ঘর দেখতে পেল ওরা। ওখানে কী হয় কে জানে। তার ডান দিক থেকে একাধারে ছোটো ছোটো ঝুপড়ি ঘর চলে গেছে। এই মুহূর্তে অন্তত হাজারের কাছাকাছি মানুষ কাজ করছে। দূরে তাকিয়ে দেখতে পেল চোখের দৃষ্টির বাইরেও আরো অনেকগুলো ছোটো ছোটো ভবনের সারি দেখা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ওদের দৃষ্টির ভেতরে বিদ্যমান নাম না জানা অনেক ধরনের যন্ত্রপাতি। পুরো আয়োজন দেখে ম্যাকফির মনে হতে লাগল, এখানে বিরাট আকারের কোনো প্রাসাদ নির্মাণ করা হবে।

‘স্যার, আপনি ঠিকই ভাবছেন। এখানে আসলেই একটা প্রাসাদ নির্মাণ করা হবে।’

ম্যাকফি একটু চমকে উঠে পেছনে ফিরে তাকাল। তবে যাকে দেখতে পেল এরকম কাউকে আশা করেনি সে। রাজা ভাবতেই এতদিন ম্যাকফি দেখে এসেছে

ঝোলা জোব্বা ধরনের পোশাক, গলায় কানে, হাতে নানা ধরনের অলঙ্কার আর দামি রত্নের মালা। এই লোক মোটেই সেরকম কিছু পরে নেই। তার বদলে সে যা পরে আছে সেটা এরকম জায়গায় বেশ অবাক করার মতোই বটে। মানুষটার গায়ে ঘিয়ে রঙের থ্রি-পিস সামার স্যুট, ভেতরে আকাশি রঙের শার্ট আর পায়ে ডার্ক- ট্যান রঙের পাম্প সু, মাথায় স্যুটের রঙে একই রঙের হ্যাট। হঠাৎ দেখলে মনেই হয় না গ্রীষ্ম অঞ্চলের কোনো কনস্ট্রাকশন সাইটে দাঁড়িয়ে আছে সে, বরং মনে হয় ছুটি কাটানোর জন্যে কোনো সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে বেড়াতে এসেছে।

‘আমি এই বৃহত্তর মুক্তাগাছা-মধুপুর-বেগুনবাড়ি এলাকার রাজা, সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। আপনি নিশ্চয়ই ক্যাপ্টেন জেমস ম্যাকফি, ফ্রম ব্রিটিশ আর্মি। প্লেজার টু মিট ইউ,’ বলে সে একটা হাত বাড়িয়ে দিল ম্যাকফির দিকে। তার ইংরেজি যেকোনো ব্রিটিশের মতোই শুদ্ধ প্রায়।

‘প্লেজার,’ ম্যাকফি লোকটার সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে তাকে ভালোভাবে খেয়াল করল। পোশাকের ব্যাপারটা আগেই খেয়াল করেছে। মানুষটা সুদর্শন, তবে ছোটোখাটো। তার আয়োজনের কোনো কমতি নেই। মাথার ওপরে বিরাট একটা ছাতা ধরে আছে একজন। পাশেই বিশাল আকৃতির কালো মুশকো দেখতে এক লোক দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে বিরাট একটা তলোয়ার। নিশ্চিত রাজার বডিগার্ড। তাদের পেছনে অন্যান্য লোকজন তো আছেই। ‘আপনার ইংরেজি তো অসাধারণ,’ বলে ও রাজাসাহেবের পোশাকের দিকে তাকাল। ‘আর আপনার পোশাকও।’

‘হা-হা-হা, ম্যাকফির কথার জবাবে বেশ জোরেই হেসে উঠল সে। ‘আমি ছোটোবেলা থেকে আমার জীবনের একটা বড়োসময় আপনাদের দেশেই কাটিয়েছি। এমনকি আমার পড়ালেখাও ওখানে। তাই আমি নিজেকে ব্রিটিশ ভাবতেই পছন্দ করি। আর চলাফেরাও সেভাবেই করার চেষ্টা করি। বহু বছরের অভ্যাস।’

‘আর আমি নিজেকে ভারতীয় ভাবতেই পছন্দ করি। আমি এদেশেই জন্মেছি বড়ো-হয়েছি কি না,’ বলে ম্যাকফিও হাসল।

রাজা সূর্যকান্ত একটু অবাক হয়ে তাকাল ওর দিকে। কোনো সাদা চামড়ার মানুষের মুখ থেকে এরকম কথা শুনবে সে কোনোদিন ভাবতেও পারেনি মনে হয়। ম্যাকফির হাসির জবাবে সে-ও হেসে উঠল। তবে হাসির মাত্রাটা আগের চেয়ে একটু ম্লান হয়ে গেছে। ম্যাকফি রাজাসাহেবের সঙ্গে জোনাথন আর মহাবীর সিংয়ের পরিচয় করিয়ে দিল। রাজাও নিজের লোকদের পরিচয় জানিয়ে দিল একে একে।

‘আসুন, আগে আপনাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করি, বলে সে ওদেরকে পথ দেখিয়ে কাপড় টাঙিয়ে বানানো একটা ছাউনির মতো জায়গায় নিয়ে এলো। সেখানে কিছু পেতে রাখা চেয়ারে এসে বসল ওরা। বসার একটু পরেই লেবু দেওয়া পানি পরিবেশন করা হলো ওদেরকে। স্বচ্ছ কাচের গ্লাসে পরিবেশন করা বরফ দেওয়া পানীয়টা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে গেল ম্যাকফি। এমন একটা জায়গায় ওরা এসব আয়োজন করল কীভাবে? আর বরফই বা পেল কোথায়?

ম্যাকফির অবাক ভাবটা বেশ উপভোগ করল রাজা সূর্যকান্ত। জীবনটা এমনই, মিস্টার ম্যাকফি। উচ্চাশা বদঅভ্যাস তৈরি করে, আর বদঅভ্যাস ধীরে- ধীরে অভ্যাসে বদলে যায়। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তার ফল তো দেখতেই পাচ্ছেন,’ বলে সে সামনে দিগন্ত বিস্তৃত কর্মযজ্ঞের দিকে ইশারা করল। ‘এসবই আমার উচ্চাশা আর বিলাসিতার ফল,’ বলে সে হাসতে লাগল।

একটানে গ্লাসের পানীয়টা শেষ করে সেটা আরদালিকে ফিরিয়ে দিয়ে নিজের পাইপ বের করে ধরাতে ধরাতে ম্যাকফি জানতে চাইল, ‘আমরা কাজের কথা আসতে পারি। কী ঘটেছিল, বলুন তো। এভাবে আপনার এলাকা থেকে এতগুলো ব্রিটিশ সৈন্য হারিয়ে গেল কীভাবে?’

কথাটা শুনে একটু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রাজাসাহেব। ‘কী আর বলবো ক্যাপ্টেন, এরচেয়ে লজ্জার আর কিছু হতে পারে না। আমার দাওয়াত করে আনা মেহমানদের আমি নিরাপত্তা দিতে পারলাম না। সত্যি কথা হলো, আমার পরিবার এই এলাকাতে গোড়াপত্তনের পর থেকেই আমরা চেষ্টা করে আসছি এলাকার মানুষদের মঙ্গলের জন্যে। কিন্তু কোনো-না-কোনো কারণে আমাদের পরিবার এই ব্যাপারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিংবা ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতা করেনি। কিন্তু আমি রাজা হবার পর প্রথমই আপনাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। কারণ বহু বছর ইংল্যান্ডে পড়ালেখা করে আমি অনেক কিছু শিখেছি। তাই এই এলাকার শাসনভার নিয়েই আমি ইংরেজদের সঙ্গে বন্ধুত্বের প্রস্তাব পাঠাই।’

হয়েছিল কী আসলে?’ ম্যাকফি লোকটার বোলচাল মার্কা রাজনৈতিক কথাবার্তায় বেশ বিরক্ত। আর এসব বিষয়ে ওর কোনো আগ্রহও নেই। ওর দরকার হারিয়ে যাওয়া সৈন্যদের হদিস বের করা।

‘তো যেটা বলছিলাম। বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ প্রথমবারের মতো আমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যদেরকে নিজের এলাকায় নিমন্ত্রণ জানাই। দুইদিন তারা আমার এখানে অতিথি হিসেবে থাকে। আমরা নিজেদের ভেতরে উপহার বিনিময় করি, এমন কি আমাদের প্রাথমিক আলোচনাও বেশ সফলই ছিল। এরপর তারা বিদায় নেওয়ার সময়ে আমার লোকেরা তাদেরকে কিছুদূর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে। তবে আমি যে পথে তাদেরকে ফেরত যেতে বলেছিলাম তারা সেই পথে না গিয়ে সম্পূর্ণ অন্যপথে রওনা দেয়। শেষবার আমার জানামতে তারা নদীর তীরে পুরনো মন্দির এলাকাতে ক্যাম্প করেছিল। এরপর আর তাদের কোনো হদিস নেই।’

‘তারা শেষবারের মতো পুরনো মন্দির এলাকাতে ক্যাম্প করেছিল—এটা আপনারা জানলেন কীভাবে?’ ম্যাকফি নিজের কপালের পাশের কাটাদাগটাতে হাত বুলাচ্ছে।

‘এটা আমি লোক মারফত শুনেছি,’ রাজা অস্বস্তির সঙ্গে নড়েচড়ে বসল। সে এভাবে কথায় ধরা পড়ে যাবে বুঝতে পারেনি। তবে ম্যাকফি বুঝতে পেরেছে ঘটনাটা।

রাজার লোকেরা সৈন্যদেরকে এগিয়ে দিয়ে এলেও ওদের ওপরে নজর রাখা হচ্ছিল। প্রশ্ন হলো, তাদের কী হয়েছে এটা কি রাজার লোকেরা দেখেছিল? নাকি ওরা সৈন্যদের ক্যাম্প করতে দেখেই ফেরত চলে আসে? রাজা অস্বস্তিতে পড়ে গেছে বুঝতে পেরে ম্যাকফি প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল। কারণ প্রথম দিনই রাজার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ানোটা ঠিক হবে না। এই মুহূর্তে লোকটার সহায়তা খুব দরকার। ‘রাজাসাহেব, আমি বুঝতে পেরেছি আপনি এই ঘটনার ফলে খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন। আমি আপনাকে যথাসম্ভব সহায়তা করতেই এসেছি। তবে আপনাকে ও আমার সঙ্গে একাগ্রভাবে কাজ করতে হবে। আমাকে সব ধরনের সহায়তা করতে হবে।’

ম্যাকফির কথা শুনে হঠাৎ রাজা এমন একটা কাজ করে বসল যে অবাক হয়ে গেল ও। সে ইশারা করে তার সব লোকদেরকে ছাউনি থেকে বের করে দিল। এরপর আচমকাই ম্যাকফির একটা হাত চেপে ধরল।

‘আরে! আরে! করেন কী, রাজাসাহেব!’ ম্যাকফি রাজার এই অযাচিত আচরণে একেবারে চমকে গেছে।

‘ক্যাপ্টেন, আমি আপনাকে পূর্ণ সহায়তা দিবো। আপনি যা চান আমি দিবো। এমনকি আপনি আর আপনার দলের লোকদেরকে আমি এত সম্পদ দিবো আপনারা ভাবতেও পারবেন না, কিন্তু আমাকে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করুন। এটা আমার এলাকা, আর এখানে আমার মেহমানদের গায়ে কে বা কারা হাত দিয়েছে আমি বের করতে পারছি না-এর চেয়ে অপমানজনক আর কিছু হতে পারে না। তাও এমন এক সময়ে যে সময়ে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো কাজে হাত দিয়েছি। আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো স্বপ্ন সত্যি করতে চলেছি। আমার রাজত্ব আর আমার লোকদেরকে আমি ভালোবাসি, আর একারণেই আমি রাজত্ব ধরে রাখতে চাই। এটা ধরে রাখতে গেলে কোম্পানিকে আমার প্রয়োজন। আর কোম্পানির বন্ধুত্ব পেতে হলে আপনাদেরকে আমার প্রয়োজন।’

ম্যাকফি লোকটার হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। ‘রাজাসাহেব, আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে এসেছি। আপনার জন্যে আপনার মেহমানদের হদিস বের করাটা যতটা জরুরি আমার জন্যেও তাই। তবে আপনাকে কথা দিতে হবে। আপনি আমার কাছ থেকে কিছু লুকাবেন না। আর আমাকে সব ধরনের সহায়তা করবেন। তবেই আমি আমার সবটুকু দিয়ে আপনাকে সহায়তা করতে পারব। আশা করি আপনি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন।’

‘অব্যশই অবশ্যই,’ ম্যাকফির সঙ্গে সঙ্গে সে-ও উঠে দাঁড়িয়েছে।

‘আজ আমরা উঠবো, রাজাসাহেব। আমরা আজ থেকেই কাজ শুরু করে দিচ্ছি। দেখা যাক কী দাঁড়ায় পরিস্থিতি। তবে এই ঘোড়ার গাড়ির বদলে আমাদের তিনজনকে তিনটে ঘোড়া দিলে ভালো হয়। যাতায়াতে সুবিধে হবে। আর আমাদের একজন সার্বক্ষণিক লোক দরকার যে এই এলাকা খুব ভালোভাবে চেনে। অন্য যেকোনো প্রয়োজনে আমি আপনাকে জানাবো।’

‘অবশ্যই,’ বলে সে তার লোকদেরকে প্রয়োজন অনুযায়ী নির্দেশনা দিল। ‘আজকে এখানে তো আপনাদেরকে আপ্যায়ন করতে পারলাম না। আরেকদিন আমার নিজের বাড়িতে আসুন। বাঙাল মুলুকের আপ্যায়ন কী, আপনাদেরকে দেখিয়ে দিবো।’

একটু পরে ওরা তিনজনে তিনটে ঘোড়া নিয়ে ওখান থেকে রওনা দিল। ওদের সঙ্গে আছে শংকর নামে রাজার বিশ্বস্ত এক লোক। এই শংকরই হবে ওদের গাইড আর যোগাযোগকারী। আর ওদের থেকে একটু পেছন পেছনে আসছে ভীষণ চিকন আর লম্বা এক লোক। রাজার লোকদের ভেতরে এই লোকই নাকি অত্র এলাকা সবচেয়ে ভালোভাবে চেনে, সেই নাকি এই এলাকার সবচেয়ে দক্ষ শিকারি। আর

একারণে সে যেকোনো পায়ের ছাপও ভালোভাবে খুঁজে বের করতে পারবে। তাছাড়া এই লোক ভাঙা-ভাঙা ইংরেজি আর হিন্দিও বোঝে কাজেই সে ওদের সঙ্গে কথাও বলতে পারবে প্রয়োজন মতো। ওরা রওনা দেওয়ার একটু পরেই লোকটা ওদের পেছন পেছন আসতে শুরু করে। কিছুদূর এগিয়ে পাশাপাশি ঘোড়া চালাতে চালাতে জোনাথন ওর কাছে জানতে চাইল, ‘বস, কেমন দেখলে রাজাকে?’

‘হয় লোকটা অতি উচ্চমার্গের চালাক, আর না হয় বোকা। তবে কোনটা এখনো ধরতে পারিনি,’ ওকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। তবে ওর জবাব শুনে খিক খিক করে হেসে উঠল মহাবীর সিং। দুজনেই অবাক হয়ে তাকাল তার দিকে, এই কথায় হাসির কী আছে?

‘লোকটা যখন চট করে উঠে তোমার হাত ধরল না, তখন ব্যাটাকে একটা মুরগীর বাচ্চার মতো দেখাচ্ছিল। কোম্পানির সৈন্যদেরকে খুঁজে বের করতে না পারলে ওর খবর আছে,’ বলে সে আবারো খিক খিক করে হাসতে লাগল। তার সঙ্গে গলা মেলালো জোনাথন।

তবে ওদের হাসিতে যোগ দিতে পারল না ম্যাকফি। কারণ ও জানে কোম্পানির সৈন্যদের খুঁজে বের করতে না পারলে রাজার পরিণতি যতটা না করুণ হবে তারচেয়ে বেশি বাজে অবস্থা হবে নিজেদের। চিন্তিত মুখে কপালের পাশের কাটা দাগটা ঘষতে লাগল সে। হঠাৎ পেছন ফিরে সে শংকরকে সামনে আসার জন্যে ইশারা করল। ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনে পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেল একটা ধূসর রঙের ঘোড়া এগিয়ে এসে ওর পাশে থামলো। ঘোড়ার ওপরে বসা লোকটা কোনো মতে ঘোড়া সামলে প্রায় ঝুঁকে বসে ওকে কুর্নিশ করল।

ম্যাকফি ইশারায় তাকে সোজা হয়ে বসার নির্দেশ দিয়ে পেছনে ফিরে দেখল ভীষণ চিকন আর লম্বা লোকটাকে দেখে মনে হলো সে ঘোড়ার ওপরে বসে ঘুমাচ্ছে।

‘এই ব্যাটার নাম কী, শংকর?’

‘হুজুর, ওর নাম ডুম্বুর আলী। এই এলাকার সবচেয়ে ভালো সহিস আর হেয় খুব সহজে কাউরে খুঁইজা বাইর করতে পারে।’

‘হট হট,’ লোকটা এগিয়ে আসতেই নিজের ঘোড়াটাকে দাবড়ানি দিতে দিতে নিজের লোকদেরকেও তাড়া দিল সে। এই জলদি আগে বাড়ো। যেখানে কোম্পানির সৈন্যরা শেষবারের মতো ক্যাম্প করেছিল সেই জায়গাটা আমি দেখতে চাই,’ বলে ও ডুম্বুরের দিকে ফিরে তাকাল।

ডুম্বুর আলী, তুমি আমাদেরকে পথ দেখিয়ে ওখানে নিয়ে চলো।’ লোকটা যেন ঝিমুতে ঝিমুতেই একবার ওকে দেখল, কী বুঝল কে জানে ওদের থেকে খানিকটা এগিয়ে ওদেরকেও ইশারা করল সামনে এগোনোর জন্যে। লোকটার পিছু যেতে যেতে জোনাথনকে জিজ্ঞেস করল ম্যাকফি, ‘সময় কম আমাদের হাতে। ও ঠিক পথে যায় কি না, খেয়াল রেখো তুমি। জায়গামতো পৌঁছে আমাদেরকে বুঝতে হবে, ব্যপারটা কী।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *