প্রথম অংশ : ছন্দপতন
দ্বিতীয় অংশ : মৃত্যুহরণ

সপ্তরিপু – অধ্যায় ১২

অধ্যায় বারো – সময় : ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ

দুর্গা মন্দির, ব্রহ্মপুত্র নদীর তীর

কেউ ওদের পিছু নিয়েছে ব্যাপারটা অনুধাবন করার পর ম্যাকফিই সবচেয়ে বেশি মাথা ঠান্ডা রাখল। পরিস্থিতি বিবেচনা করে ম্যকফি অনুমান করল এভাবে দৌড়ে ধরা যাবে না লোকটাকে। সে নিজের ঘোড়াটার সবচেয়ে কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। হালকা এক লাফের সঙ্গে উঠে বসল ঘোড়ার ওপরে। লোকটাকে যেদিকে দেখা গেছে সেদিকে ঘোড়া ছোটানো সম্ভব নয় তারচেয়ে বরং একটু উলটো ঘুরে সেদিকের পথ ধরল ম্যাকফি।

খানিকটা এগিয়ে মূল রাস্তা থেকে বাঁয়ে কাটতেই প্রথমবারের মতো পরিষ্কার দেখতে পেল পলায়নরত লোকটাকে। পায়ে চলা পথটা ধরে প্রাণপণে দৌড়ে চলেছে সে। পরনে খাটো সাদা ধুতির মতো পোশাক। খালি উর্ধাঙ্গ আর মাথায় একটা সাদা পাগড়ি। পায়ে চলা পথ ধরে হরিণের বেগে দৌড়াচ্ছে মানুষটা। দৌড়াতে দৌড়াতেই একবার পেছন ফিরে তাকাল সে। ম্যাকফি দেখতে পেল লোকটার মাথার সাদা পাগড়ির একটা অংশ দিয়েই আড়াল করে রাখা হয়েছে চেহারাটা। মুহূর্তের ব্যাবধানে একজোড়া কালো চোখ দেখতে পেল ম্যাকফি। মানুষের চোখ এত গভীর কালো হতে পারে না। নিশ্চয়ই কোনো ধরনের কালি ব্যাবহার করে কালো করা হয়েছে চোখের চারপাশ। লোকটা প্রাণপণে দৌড়ালেও সে তো মানুষ, নিশ্চয়ই ঘোড়ার গতিবেগের সঙ্গে তার পেরে ওঠার কথা নয়।

ম্যাকফি দেখল আর মিনিটখানেক এভাবে দৌড়ালেই লোকটাকে ধরে ফেলতে পারবে ও। চিৎকার শুনে বুঝতে পারল অন্যপাশ থেকে ঝোপঝাড় ভেঙে ছুটে আসছে মহাবীর সিং আর শংকর। ঘোড়ার গতিবেগ বাড়িয়ে একেবারে লোকটার পেছনে চলে এলোও। আর একটু।

লোকটা জান দিয়ে দৌড়াচ্ছে। শত্রু এত কাছে চলে এসেছে তার কোনো বিকার নেই। ম্যাকফি আরেকধাপ এগিয়ে নিজের শরীরটাকে কাত করে একটা হাত বাড়িয়ে দিল লোকটাকে ধরার জন্যে। পেছনে না তাকিয়েই কীভাবে যেন বুঝে ফেলল লোকটা। শরীরটাকে একটা বাউলি দিয়ে এড়িয়ে গেল ম্যাকফির হাত। চট করে ঢুকে পড়ল ডান পাশের জঙ্গলে।

শরীরটাকে বাঁকা করে ফেলাতে আরেকটু হলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঘোড়া নিয়ে উলটে পড়তে যাচ্ছিল ম্যাকফি। কোনোমতে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে উঠে বসল। লোকটা ডান পাশের জঙ্গলে ঢুকে গেছে আর এদিকে মহাবীর সিং আর শংকর ও পায়ে চলা পথটাতে এসে থামলো। দুজনেই পাগলের মতো হাঁপাচ্ছে।

ওদের দিকে তাকিয়ে লোকটা কোন দিকে গেছে এক ঝলক ইশারা করে সে ঘোড়া নিয়ে ঢুকে পড়ল জঙ্গুলে জায়গাটার ভেতরে। কিন্তু ভেতরে ঢুকে একটু অবাক হয়ে গেল ও। এই জঙ্গলটা অন্য জঙ্গলগুলোর তুলনায় বেশ গভীর। ভেতরে ঘন ঝোপ-ঝাড়। ঘোড়া নিয়ে অল্প-অল্প করে এগোতে লাগল ও।

লোকটার ছায়াও দেখা যাচ্ছে না আশপাশে কোথাও। ওর পিছু পিছু মহাবীর সিং আর শংকর ও এসে প্রবেশ করেছে ছোটো ঘন জঙ্গলটায়। ওরা তিনজনই চুপ করে শোনার চেষ্টা করছে আশপাশে কোথাও কোনো শব্দ হচ্ছে কি না। কিন্তু কোনো শব্দ বা কিছুই নেই। শংকর হঠাৎ মহাবীর সিংয়ের একটা হাত খামচে ধরল, ইশারায় দেখাল একটা ঝোপের ভেতর থেকে সাদা ঝিলিক ভেসে আসছে। ওদের দৃষ্টি অনুসরণ করে ম্যাকফি ঘোড়া ছোটালো ওদিকে। এক হাতে লাগাম সামলে অন্য হাতে বের করে আনলো পিস্তল। ও ঝোপের কাছ পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই সাদা রঙের বকের মতো দেখতে একজোড়া পাখি উড়ে গেল ঝোপের ভেতরে থেকে। পাখি দুটো উড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই অন্যপাশে নড়ে উঠল আরেকটা ঝোপ। কাঠবিরালির মতো বাউলি কেটে ওটার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো মানুষটা। মুহূর্তের জন্যে ম্যাকফির চোখের দিকে তাকিয়ে রইল।

মুখের আবরণটা সরে গেছে তার। কিশোর বয়সের একটা ছেলে। ম্যাকফি তার দিকে পিস্তল তোলার আগেই ঘন, জঙ্গুলে ঝোপের আড়ালে লাফিয়ে সরে গেল সে। ঘন জঙ্গল হবার কারণে ম্যাকফি ঘোড়া নিয়ে খুব বেশি সুবিধে করে উঠতে পারছে না। ওর আগেই খালি পায়ে ছেলেটাকে অনুসরণ করল মহাবীর সিং আর শংকর। ওদেরকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখল ও গাছের ঘন পাতার আড়ালে। ঘোড়া নিয়ে ধীর গতিতে জায়গাটা পার হয়ে দেখতে পেল নদীর পাড়ের খোলা জায়গার রীতিমতো নাটক জমে উঠেছে

ছেলেটাকে একটা পায়ে চলা পথের কিনারায় একদিক থেকে আগলে আছে মহাবীর সিং আর শংকর। অন্যদিক থেকে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে আসছে জোনাথন আর ডুম্বুর। ছেলেটা কোনাকুনি জায়গার মাঝামাঝি আটকে আছে। জলদি ঘোড়া ছোটালো ও। কাছে এগিয়ে পিস্তল মাথার ওপরে তুলে ভয় দেখানোর জন্যে ফাঁকা ফায়ার করল শূন্যে। কিন্তু এতে উলটো ফল হলো। ছেলেটা চমকে গিয়ে কোনাকুনি রাস্তার ঢাল বরাবর গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল।

‘শিট, চিৎকার করে উঠল ম্যাকফি। বাকিদেরকে ঢাল বেয়ে নামার আদেশ দিয়ে ও আর জোনাথন ঘোড়া ছোটালো পথের শেষ প্রান্তের দিকে। ঘোড়া নিয়ে ওদিক দিয়ে নামা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ওরা ঘোড়া নিয়ে বেশ অনেকটা পথ ঘুরে এসে দেখতে পেল ছেলেটা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে নদীর পাড় ধরে, আর তার পেছনে দৌড়াচ্ছে মহাবীর সিং আর শংকর। ওরা পৌঁছানোর আগেই আবারো ছেলেটা নদীর পাড়ের ঘন ঝোপ-ঝাড়ময় জঙ্গুলা জায়গাটা পার হয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল।

ওরা সবাই মিলে অনুসরণ করল। ঝাড়ময় জায়গাটা পেরোতেই সামনে চোখে পড়ল একটা বটগাছ। আর সেই বটগাছের পেছনে বিরাট এক মন্দির। মন্দিরের প্রাঙ্গণে লোকজনে ভরপুর। কিছু একটা হচ্ছে এখানে। ঘোড়ার ওপরে বসেই সাদা পাগড়িকে খুঁজলো ও। ভিড়ের ভেতরেই দেখতে পেল সাদা পাগড়ি তাড়াহুড়ো করে মানুষজনের ভেতর দিয়ে চলে যাচ্ছে প্রাঙ্গণের পেছন দিকে।

ঘোড়া নিয়ে আর সামনে এগোনো সম্ভব নয়। লাফিয়ে ঘোড়া থেকে নামল সে। একে তো ঘোড়া নিয়ে মন্দিরের প্রাঙ্গণে ঢুকেছে, দ্বিতীয়ত সাদা চামড়ার লোকজন মনে হয় খুব বেশি নেই এদিকে; অনেকেই নিজেদের কাজকর্ম বাদ দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ম্যাকফির সঙ্গীরাও ইতিমধ্যে চলে এসেছে। পিস্তলটা হাতে ধরাই ছিল সেটা নিয়ে ম্যাকফি প্রাঙ্গণের দিকে এগোনোর চেষ্টা করতেই শংকর দৌড়ে এসে ওর একটা হাত ধরে ফেলল শক্ত করে।

‘হুজুর, ওইহানে যাবেন না।’

‘আরে, ওই সাদা পাগড়িকে আমি এখানেই ঢুকতে দেখেছি,’ ম্যাকফি একটু অবাক হয়ে গেছে শংকরের আচরণে। যে লোক মাথা সোজা করে কথাই বলে না সে কিনা ওর হাত জাপটে ধরেছে, তাও আবার একজন খ্রিস্টানের হাত! ঘটনা কী? ‘শংকর, আমাদেরকে ভেতরে যেতে হবে। ওই লোকটাকে ধরতে হবে। আমাকে জানতে হবে কেন সে আমাদের পিছু নিয়েছিল

‘হুজুর, সেটা কুনোভাবেই সম্ভব না।’

‘কেন?’ অবাক হয়ে শংকরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল ম্যাকফি। ‘কেন সম্ভব নয়?’

‘হুজুর, এইটা ডোংরু মহারাজের ডেরা। দেবী দুর্গার মন্দির। এনে আমরা কেউই প্রবেশ করতে পারতাম না। তার উপরে এখন এখানে যজ্ঞের আয়োজন চলতাছে। এহন কিছু করতে গেলে মহা অনর্থ হয়া যাবে।’

‘ডোংরু মহারাজটা আবার কে?’ ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে জোনাথন।

‘হুজুর, ডোংরু মহরাজের ডেরায় তার কথাই আইন। ওরা ইংরেজ সরকার কিংবা কোম্পানির আইন মানে না। আর লোকজনও হেগো কথা শুনে। ডোংরু মহারাজ হইলো এই অত্র এলাকার সবচেয়ে বড়ো কাপালিক ব্রাহ্মণ, ধর্ম গুরু। ওরা এই এলাকার আদি বাসিন্দাদের মতোন দেবী দুর্গার পূজা করে। তার ওপরে আমরা হলাম নিচু জাত, ও হইলো মুসলমান আর আপনারা হইলেন খ্রিস্টান। আমরা যদি মন্দিরে ঢুকি অনর্থ লাইগ্গা যাবে। আবার এখন চলছে যজ্ঞের আয়োজন। যজ্ঞ পণ্ড হইলেই অনর্থ। হুজুর, দয়া করেন।’

‘আমি এতসব বুঝি না। আমি একটা চোরকে পালিয়ে মন্দিরে ঢুকতে দেখেছি ওকে আমার চাই,’ বলে ম্যাকফি বীরদর্পে প্রবেশ করল মন্দিরের প্রাঙ্গণে। ওকে অনুসরণ করল জোনাথন আর মহাবীর সিং। শংকর আর ডুম্বুর বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। শংকরের প্রবেশ করার সাহস নেই, আর ডুম্বুরের নেই ইচ্ছে।

ওরা মন্দিরের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতেই মৃদু একটা গুঞ্জন করে উঠল কয়েকজন। ‘রাম’

‘রাম’ শব্দটাও শুনতে পেল ওরা। ভিড়ের দিকে এগোতেই সামনের ভিড়টা একরকম সরে গেল। কেউ নিজেদের গা বাঁচাতে চাইছে কেউ আবার ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। জোনাথন আর মহাবীর সিংকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।

‘ব্যস, আর আপ্পাইন না যে, হুজুর,’ ম্যাকফি দেখতে পেল পরনে মাটি রঙের পোশাক, কপালে তিলক আঁকা দুই ব্যক্তি সামনের দিকে হাত তুলে ওদেরকে থামতে বলছে। ‘এনু যজ্ঞ অইবো। বিধম্মী কেউর ভেতরে ঢুকা নিষেদ। ‘

‘কে ভেতরে যাবে না যাবে সেটা বলার তুমি কে?’ হাত তুলে রাখার পরও ম্যাকফি আরেক ধাপ সামনে এগিয়ে গেল। ‘আমরা আইনের লোক, আর এখানে একজন অপরাধী প্রবেশ করেছে। তাকে আমার খুঁজে বার করতে হবে। প্রয়োজনে আমি ভেতরে তো ঢুকবোই…’

‘খবরদার হুজুর, আইন্নেরা আইনের মানুষ অইতে পারেন আমরাও ধম্মের মানুষ। আর ধম্মের উপরে কিছু নাই। দেবী সব দেহে। কাজেই বাড়াবাড়ি কইরেন না। কেউর লাইগাই বালা অইতো না।’

ম্যাকফি আরেক ধাপ এগোতেই লোকটার সঙ্গী এগিয়ে এসে বুকে হাত দিয়ে ওকে দাঁড় করিয়ে দিল। আর এগোতে দিবে না। মুহূর্তের ভেতরে ম্যাকফি হাতে ধরা পিস্তলটা ওপরে তুলে শূন্যে গুলি ছুড়ে দিল।

চারপাশের প্রতিটা মানুষ চমকে উঠেছে। অনেকে ভয়ের চোটে শুয়েও পড়েছে মাটিতে। এদের মধ্যে হয়তো অনেকেই প্রথমবারের মতো পিস্তলের গুলির শব্দ শুনেছে। দুয়েকজনের অবস্থা হয়েছে অজ্ঞান হয়ে যাবার মতো। ম্যাকফির বুকে হাত দিয়েছিল যে লোকটা সে হাত তো নামিয়ে নিয়েছেই এই মুহূর্তে তার চেহারা হয়েছে দেখার মতো। মরা মাছের উলটো পিঠের মতো সাদা হয়ে গেছে তার মুখ।

‘এখনো বাধা দেবে আমাদেরকে ভেতরে ঢুকতে?’

‘এই, কী হচ্ছে এখানে?’ বেশ জলদ গম্ভীর কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল প্রায় সব গুঞ্জন। মন্দিরে উপস্থিত লোকদের প্রতিক্রিয়া দেখে ম্যাকফি অনুমান করার চেষ্টা করল তার প্রতি মানুষের ভক্তির মাত্রা কতটা গভীর হতে পারে। বেশিরভাগ হিন্দু ধর্মগুরুদেরকে ম্যাকফি হলুদ রঙের চেয়ে আরেকটু গাঢ় রঙের পোশাক পরতে দেখেছে। এই প্রথম একজনকে দেখতে পেল একেবারে সাদা পোশাক পরে আছে। সাদা ধুতির ওপরে সাদা চাদরের মতো কিছু একটা জড়ানো। কাপড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টকটকে ফর্সা চেহারা তার। নেটিভদের ভেতরে এত ফর্সা লোক খুব কমই দেখা যায়।

মানুষটা মন্দিরের সিঁড়ি থেকে প্রাঙ্গণে তাকাতেই দেখতে পেল ওকে। তাকে মন্দিরের সিঁড়িতে দেখামাত্রই শিষ্যদের বেশিরভাগ বলতে গেলে মাটিতে শুয়ে পড়ল। হঠাৎ করে বাতাসের ঝলক বয়ে গেলে যেরকম অনুভূতি হয় ঠিক রকমভাবে ‘গুরুজি’, ‘গুরুজি’ শব্দের একটা মৃদু হলকা বয়ে গেল জায়গাটার ওপর দিয়ে। ম্যাকফি তাকিয়ে দেখল ওরা কজন বাদে আর সবাই ভক্তি ভরে গুরুকে সম্মান করছে। এমনকি ওদের সঙ্গে থাকা শংকর পর্যন্ত মাথা একেবারে নুইয়ে ফেলেছে।

শ্রী শ্রী মহাদেভা। এ যে দেখছি একেবারে গরীবের বাড়িতে বাঘের পদক্ষেপ, বলে লোকটা যেন একটু মুখ টিপে হাসল। ‘আমি ডোংরু মহারাজ, হুজুরের সেবায় নিয়োজিত দাস, বলে সে দুই হাত তুলে নমস্কার করল। আর লোকটার শেষ কথাগুলো শুনে একেবারে চমকে উঠল ম্যাকফি। বিশুদ্ধ প্রাদেশিক উচ্চারণে বলা ইংরেজি কথাগুলো শুনলেই বোঝা যায় লোকটা উচ্চশিক্ষিত।

‘জি, হুজুর। আপনি যা ভাবছেন তা সত্যি,’ বলে সে আবারো অভিবাদন করল। এবার জোনাথনের দিকে তাকিয়ে। মহাবীর সিং আর অন্যদের দিকে এমনকি তাকালও না। ‘আমি কালা পানি পাড়ি দিয়েছি। আমি আপনাদের দেশ দেখেছি। তাই জানি কাকে সম্মান করতে হবে, আর কাকে হবে না। একই জিনিস আপনাদের কাছ থেকেও আশা করব।’

লোকটার কথা শুনে চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিলো ম্যাকফি। উচ্চশিক্ষিত একজন মানুষ এই অজ-পাড়াগাঁয়ে এসে ধর্মগুরু সেজে বসেছে। লোকটার অতি-বিনয়ী চেহারার সামনে নিজের হাতে ধরে থাকা পিস্তলটা একবার নেড়ে ও বলে উঠল, ‘এসব চালবাজি রাখো। তোমার এখানে একটা চোর প্রবেশ করেছে তাকে আমার দরকার।’

‘হুজুর, দেবতার ঘরে সবাই সমান। এখানে কে চোর আর কে রাজা সেটার প্রমাণ হয় দেবতার প্রতি ভক্তি দিয়ে, কর্ম কিংবা সামাজিক অবস্থানের কোনো গুরুত্ব নেই এখানে।’

‘তাই নাকি! এখানে সবাই সমান!’ মানুষটার তেলতেলে কথা শুনে মেজাজ একটু খারাপ হয়ে গেল ম্যাকফির। ‘তাহলে তোমার লোকেরা যজ্ঞ প্রত্যক্ষ করার জন্যে একাধিক সারি তৈরি করেছে কেন,’ বলে ও যজ্ঞের সামনে প্রস্তুত বাঁশ দিয়ে তৈরি লাইনগুলো দেখাল। যার যার সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী এখানে দাঁড়াতে হবে। কোনোভাবেই যেন এক বর্ণের লোকের সঙ্গে অন্য বর্ণের লোকের এমনকি স্পর্শও না লাগে তার জন্যেই এই ব্যবস্থা।

হুজুর, আপনারা জ্ঞানী মানুষ। জ্ঞানী মানুষের সঙ্গে তর্ক করতে নেই,’ বলে সে তার লোকদেরকে হাতের ইশারায় আগের অবস্থায় ফিরে যেতে বলল। সঙ্গে সঙ্গে এতক্ষণ মাথা নিচু করে থাকা লোকগুলো উঠে বসে যার যার কাজে ফিরে গেল। ‘জ্ঞানী মানুষেরা ইশারায়ই অনেক কিছু বুঝতে পারে,’ তার অঙুলি হেলানে যে এখানে সব হয় সেটার প্রতি ইঙ্গিত করল বলে মনে হলো ম্যাকফির কাছে। তার পেছনের চ্যালাদের সঙ্গে আরো কয়েকজন যোগ হয়েছে এখন। লোকটা কি ওদের কোনো ক্ষতি করতে চাচ্ছে-বোঝার চেষ্টা করল ম্যাকফি।

‘দেখো, ডোংরু মহারাজ কিংবা যাই হোক তোমার নাম। তুমি এদের কাছে দেবতার প্রতিনিধি হতে পারো কিন্তু আমার কাছে নও! আমার কাছে নিজের কাজ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তোমার মন্দিরে এমন একজন প্রবেশ করেছে যাকে আমার দরকার। কাজেই তাকে খুঁজে বের করার জন্যে আমি সব করতে রাজি আছি,’ বলে আরেক পা এগিয়ে গেল ও ডোংরু মহারাজের দিকে। ‘আমি ঝামেলা করতে চাই না কিন্তু তোমরা আমাকে সাহায্য না করলে আমি সেটাই করব।’

‘তোমরা সাদা চামড়ার মানুষেরা ভাবছো কী? যহন খুশি এখানে এসে যা খুশি করতে পারবা?’ এবার ডোংরু মহারাজ না তার পেছন থেকে আরেকজন চেঁচিয়ে উঠল। ‘ওই আচার্য জমিদার তোমগরে যতই চাটুক না ক্যান আমরা তা হইতে দিবো না,’ এমনকি ডোংরু মহারাজের সামনেই লোকটা মারমুখী হয়ে উঠেছে। তার সঙ্গের অন্যদের চেহারাও খুব বেশি ভালো দেখাচ্ছে না।

‘দেখো…’ ওকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আরেকজন চেঁচিয়ে উঠল। ‘আপনেরা শাসক হইতে পারেন, কিন্তু দেবতার মন্দির অপবিত্র করার অধিকার কেউর নাই…’

‘নাই’ ‘নাই’ ‘নাই’ ‘এগুলারে বাইর কইরা দেও’ ‘মহারাজরে অপমান করার চেষ্টা করছে! কতবড়ো সাহস’ ‘ওই জমিদার আমগো ধম্ম নষ্ট করার জন্যেই এগো পাঠাইছে’…

এধরনের কথাবার্তা ভেসে আসতে লাগল। ম্যাকফির আঙুল শক্ত হলো তলোয়ারের বাঁটে। ও দেখল জোনাথন আর মহাবীর সিং দুজনেই যার যার অস্ত্র আঁকড়ে ধরেছে। ম্যাকফি ডোংরু মহারাজের দিকে তাকিয়ে দেখল লোকটা মুখে মিটিমিটি হাসছে ঠিকই কিন্তু তার চোখের গভীরে দুঃশ্চিন্তার ছায়া।

‘ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে…’ ম্যাকফি কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল কিন্তু তার আগেই ডোংরু মহারাজ একটা হাত তুললো। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল সব গুঞ্জন।

‘তারা দেবতার মন্দিরে আর দাঁড়াবে না। আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, ডোংরু মহারাজ বলে উঠল

‘তোমার এতবড়ো সাহস…’ ম্যাকফি কথা শেষ করার আগেই পাশ থেকে শংকর বলে উঠল, হুজুর, মেনে নিন। তা না হলে…’

‘খামোশ, ইতরের বাচ্চা! নিচু জাত, বড়োদের কথার মাঝে কথা বলে,’ ডোংরু মহারাজ ভীষণভাবে ধমকে উঠল শংকরকে। বলে সে ম্যাকফির দিকে তাকিয়ে আবারো দুই হাত তুলে নমস্কারের ভঙ্গিতে জোড় করল।

‘হুজুর, আপনিও শিক্ষিত আর আমিও তাই। কিন্তু এইখানে সবকিছুর হিসেব হয় অন্যভাবে। হয়তো এতক্ষণে সেটা বুঝতে পেরেছেন। আমি নিজে আপনাকে বলছি আপনারা যার পিছু নিয়ে এখানে এসেছেন তার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আর যদি সেই মানুষটা মন্দিরে প্রবেশ করেও থাকে এতক্ষণে পেছনের পথ দিয়ে সে পালিয়েছে অথবা নদীপথে পালিয়েছে। কাজেই দেবতার মন্দিরে প্রবেশ করে তাকে অপবিত্র করে কোনো লাভ হবে না। এই পরিস্থিতিতে আমাদের উভয়ের জন্যেই সেটা হবে বিপর্যয়। আপনারা দেবতাকে সম্মান জানালে আমরাও আপনাদের সসম্মানে যেতে দিবো।

লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল ম্যাকফি। চালবাজ একটা লোক কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে সে যা বলেছে এটাই সেরা সমাধান। যে লোকটাকে মন্দিরে প্রবেশ করতে দেখেছিল সে নিশ্চয়ই এতক্ষণ ভেতরে বসে নেই। ডোংরুর দিকে একবার তাকিয়ে নিজের লোকদের ইশারা করল ম্যাকফি বেরিয়ে যাবার জন্যে। ও নিজেও পেছন ফিরে হাঁটতে লাগল।

‘ধন্যবাদ, হুজুর,’ ডোংরু মহারাজের বিদায় সম্ভাষণ শুনে ফিরে তাকাল ম্যাকফি। ‘দেবতাকে সম্মান করলে সে-ও অন্যদের সম্মান করে,’ লোকটার মুখে প্রথমের সেই চালবাজির হাসিটা ফিরে এসেছে। ‘হুজুর, মনে রাখবেন দেবতা যেমন তার সন্তানদের সঙ্গে বেইমানি করে না ঠিক তেমনি দেবতার বাহন তার অনেক কিছুরই পরিচায়ক। দেবতার বাহনও কখনো তার সঙ্গে বেইমানি করে না। যেখানে যায় পেছনে দাগ রেখেই যায়,’ বলে লোকটা হাসতে লাগল।

চিন্তিত মুখে নিজেদেরে ঘোড়ার কাছে ফিরে এলো ওরা।

‘এখন কী করা?’ জোনাথন প্রশ্ন করল ম্যাকফিকে। ‘অকারণে দৌড়াদৌড়িই সার। কাজের কাজ তো কিছুই হলো না। এভাবে ওখান থেকে চলে আসাটা কি ঠিক হলো?’

ম্যাকফি জবাব দেওয়ার আগেই শংকর বলে উঠল, ‘হুজুর, ডোংরু মহারাজের ডেরা থেকে জান নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছি এটাই বেশি। তার সঙ্গে উলটোপালটা করলে কেউই রক্ষা পায় না।’

‘নাহ, আমাদের এভাবে ছেড়ে দেওয়াটা উচিত হয়নি,’ মহাবীর সিংয়ের মতো গম্ভীর লোকও কথা বলে উঠল।

‘তাহলে এবার কী? আবার কোথা থেকে শুরু করব আমরা?’

সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ম্যাকফি কোনো জবাব দিল না। ‘এবার দুপুরের খাওয়া, খেতে খেতে ভাবা যাবে কোথা থেকে শুরু করব, ‘ নিজের ঘোড়াটার কাছে ফিরে এসে ওটার গায়ে হাত বুলাতে লাগল ম্যাকফি। ঘোড়াটার শরীরের একটা বিশেষ জায়গায় হাত পড়তেই চমকে উঠল ও। যেকোনো মালিক তার ঘোড়ার গায়ে নিজের একটা চিহ্ন একে রাখে। বিশেষ করে কোম্পানির লোকেরা এ ক্ষেত্রে কোম্পানির লোগো ব্যবহার করে। একটু আগে ডোংরু মহারাজের শেষ কথাটা মনে পড়ে গেল ওর।

‘দেবতার বাহন কখনো বেইমানি করে না। যেখানে যায় পেছনে দাগ রেখেই যায়’–এই কথাটার মানে কী? লোকটা কি স্রেফ মজা করছিল? নাকি মজার ছলে অথবা বিদায় সম্ভাষণের আদলে আসলে কিছু একটা বলতে চাইছিল ওকে? দেবতার বাহন, ঘোড়া। ও ঝট করে ফিরলো শংকরের দিকে।

‘আচ্ছা, অন্যান্য এলাকার মতো এই এলাকার লোকজনের প্রধান বাহন নিশ্চয়ই ঘোড়া?’

‘হ, হুজুর। ঘোড়া আর ঘোড়ার গাড়ি মানুষ বহনের লাইগ্গা আর মাল টানুনের জইন্যে গাধা আর খচ্চর। গরীবেরা চলাচলের জইন্যে ব্যবহার করে গরুর গাড়ি, আর না অয় পায়ে হাড়ে।

‘তারমানে এখানে নিশ্চয়ই। গরু, ঘোড়া, গাধা, খচ্চর-এগুলোর কোনো বাজার আছে?’

‘অবশ্যই আছে, হুজুর। অত্র এলাকার সবচেয়ে বড়ো গরু-ঘোড়ার হাট বসে এই এলাকাতেই। পনেরো দিন পর পর।

‘আবার কবে বসবে সেই হাট?’

‘হুজুর, আমি সঠিক বলতে পারব না। তবে হাট বসে প্রতি এক বুধবার পর পর।’

ম্যাকফি মনে মনে হিসেব করে দেখল আজ সোমবার। তারমানে যদি হাট বসে তবে পরশু বসবে। ‘কোথায় বসে এই হাট?’

‘এখান থেকে একেবারে কাছেই, হুজুর। খাগডহর নামে একটা বাজার আছে ওইখানের এক বড়ো মাঠেই বহে এই বিরাট হাট।’

জোনাথনের দিকে ফিরে ম্যাকফি উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, ‘এই হাটে যেতে হবে আমাদের। আমার বিশ্বাস ডোংরু মহারাজ লোকটা আমাদের সঙ্গে মজা করছিল না। সে একটা সূত্র দিয়েছে আমাকে ইশারায়। আমার ধারণা এই হাটে গেলে আমরা কিছু না কিছু বের করতে পারবই।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *