অধ্যায় দুই – সময় : ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ
নালুন্দি গ্রাম, সেইন্ট গ্রেগর দুর্গ এলাকা, মাদ্রাজ
স্বপ্ন নাকি দুঃস্বপ্ন?
প্রচণ্ড গরম নাকি ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন-ঠিক কোনটার কারণে ঘুম ভেঙে গেল ঠিক বুঝতে পারল না ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসার ক্যাপ্টেন জেমস ম্যাকফি।
তবে ঘুম ভেঙে যেতেই একেবারে ধড়মড় করে উঠে বসল সে। প্ৰথম কয়েক সেকেন্ড বুঝতেই পারল না জায়গাটা কোথায়, সময়টা কখন। স্রেফ হাপরের মতো হাঁপাল কিছুক্ষণ। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে কয়েকবার মাথা ঝাড়া দিল। খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে অনুভব করল, সব ঠিকই আছে। সে বাংলো বাড়িটাতেই আছে আর সময়টাও এখন দিনের বেলা। গরমে ঘেমে নেয়ে গেছে পুরো শরীর। হাত বাড়িয়ে খুলে দিল বিছানার পাশের জানালাটা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গোপসাগরের নোনা হাওয়ায় জুড়িয়ে গেল পুরো শরীর। বাইরে গাছপালার ফাঁক দিয়ে সমুদ্র চোখে পড়ছে।
উফ্, সবই স্বাভাবিক আছে। খামাখাই ঘাবড়ে গেছিল বিশ্রী স্বপ্নটা দেখে।
পায়ে চপ্পল গলিয়ে দেওয়ালে ঝোলানো বড়ো আয়নাটার সামনে এসে দাঁড়াল ও। ম্যাকফির গায়ের রং রোদে পুড়তে পুড়তে প্রায় ভারতীয়দের মতোই হয়ে গেছে। মাথায় লালচে সোনালি চুল আর নীল চোখ না থাকলে তাকে যে কেউ ভারতীয় বলেই মনে করত। আয়নার দিকে তাকিয়ে কথাটা মনে হতেই ম্যাকফির ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। তাকে ভারতীয় মনে করার কিছু নেই, সে আসলে ভারতীয়ই।
রোদে পোড়া শরীরটার জায়গায় জায়গায় শুকনো ক্ষতচিহ্ন বিভিন্ন যুদ্ধের স্মৃতি বহন করছে। ডান হাত তুলে বাঁ হাতের পেশির ওপরে তৈরি হওয়া সাম্প্রতিক ক্ষতচিহ্নটাতে হাত বুলাল সে। নতুন এই ছোট্ট চিহ্নটার জন্যে দায়ী তার নিজেরই গোত্রের মানুষ।
প্রায় শুকিয়ে আসা ক্ষতটা আয়নায় দেখতে দেখতে হঠাৎই তার চোখ পড়ল ওপরের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারল কেন এই তীব্র গরমে ঘুম ভেঙে গেছে। আয়নায় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে মাথার ওপরে টানা পাখাটা স্থির হয়ে আছে। তার মানে, ওটা যে টানছিল সে এখন আর টানছে না। আর একারণেই বাতাস বন্ধ হয়ে যাওয়াতে গরমে ঘুম ভেঙে গেছে তার। বেশ রাগের সঙ্গেই রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। মেজাজ চড়ে গেছে।
পাখাওয়ালাকে তীব্র একটা ঝাড়ি দেওয়ার উদ্দেশ্যে বাইরে বেরুলেও দরজার বাইরে এসে থেমে গেল ক্যাপ্টেন ম্যাকফি। এসেছিল ঝাড়ি দিতে কিন্তু তার বদলে যা দেখল তাতে উলটো আরো মায়া লাগল তার। পাখা টানার জন্যে নিয়োজিত বুড়ো মানুষটা একহাতে পাখা টানার দড়িটা ধরে মুখ হাঁ করে ঘুমাচ্ছে।
কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল ম্যাকফি। আহা বেচারা, বুড়ো মানুষ!
পাখাওয়ালাকে ওখানে রেখে সে বাংলোর টানা বারান্দার অন্যপাশে চলে এলো। এখানে বৈকালিক চা পানের জন্যে বেশ কয়েকটা বেতের তৈরি চেয়ার- টেবিল পাতা আছে। একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল সে। চপ্পলসহ পা তুলে দিল সামনের টেবিলের ওপরে। অফিসারদের জন্যে কাঠের বাক্সে সবসময় তামাক সাজানোই থাকে। তবে প্রায় কখনোই খায় না ম্যাকফি। আজ কী মনে করে তামাকের বাক্সটা টেনে নিলো কোলের ওপরে। ছুটিতে আছে বলেই কি না কে জানে, হঠাৎ তামাক খেতে ইচ্ছে হচ্ছে।
বাক্সটা খুলতেই চোখে পড়ল একটা সুন্দর পাইপ। ভেবেছিল ওটাতে তামাক সাজিয়ে নিতে হবে কিন্তু আনন্দের সঙ্গে খেয়াল করল তামাক সাজানোই আছে। মনে মনে সে বাংলোর বুড়ো তত্ত্বাবধায়কের প্রশংসা করল। সবদিকে নজর থাকে লোকটার। আজ তিনদিন যাবৎ সে আর তার দল অবস্থান করছে এখানে, এই তিনদিনে ছোটোখাটো কোনো ত্রুটিও তার চোখে পড়েনি।
পাইপটাতে আগুন দিয়ে কষে টান দিল কয়েকটা। প্রথম টানের দমকে বুকের ভেতর থেকে কাশি উঠে এলো। অনভ্যস্ততার ফল। বহুদিনের অব্যবহৃত তলোয়ারও ঠিকমতো যুদ্ধে সাফল্য দেখাতে পারে না,আর এটা তো তার অনাঘ্রাতা ফুসফুস। পর পর কয়েকবার পাইপে টান দিতেই অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এলো ভেতরটা। বেতের চেয়ারে হাত-পা ছড়িয়ে সমুদ্র দেখতে দেখতে নিজের মনের কোণে হারিয়ে গেল সে। একটু আগের দুঃস্বপ্নটার স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াতে লাগল।
ম্যাকফি মনে মনে ভাবতে লাগল, এর হাত থেকে কি কোনো মুক্তি নেই? একই দুঃসহ যাতনা, চিরকাল একই দুঃস্বপ্নের হাত ধরে ফিরে-ফিরে আসে। একইরূপে, একই যন্ত্রণা নিয়ে, একই তীব্রতা নিয়ে। এমনকি দুঃস্বপ্নের স্থান কাল পাত্র, পাত্রী—সবই একই।
মাটিতে পড়ে থাকা অসহায় মানুষটির করুণ আর্তনাদ, চেয়ার হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার বিকৃত কণ্ঠস্বর…
‘সাহিব,’ হঠাৎ ডাক শুনে চমকে উঠল ম্যাকফি। বাংলোর বুড়ো তত্ত্বাবধায়ক দাঁড়িয়ে আছে সামনে। মৃদু স্বরে ডাকছে তাকে। ‘সাহেব, আপনার জন্যে সন্দেশ এসেছে,’ বুড়ো তত্ত্বাবধায়কের ভাঙা ইংরেজি কেন জানি বেশ মিষ্টি লাগে ম্যাকফি কানে।
‘মকসুদ মিয়া, বলো,’ ম্যাকফি পাইপটাকে টেবিলের ওপরে রেখে সোজা হয়ে বসল। গায়ে কিছু না থাকায় একটু অস্বস্তি লাগছে। কেতাদুরস্থভাব বজায় রাখতে রাখতে অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। অন্যান্য সময় হলে ব্যাপারটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু ছুটির সময় বলে তেমন একটা গায়ে মাখলো না ম্যাকফি। ‘কীসের সন্দেশ?’
‘সাহিব, গেরগর সাহিবের দুর্গ থেকে লোক এসেছিল। সে এইটা দিয়ে গেছে। বলে গেছে সরাসরি আপনাকে দিতে। কর্নেল ক্রেয়াগ সাহিব আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। বলেছেন আপনাকে মোলাকাত করতে।’
ম্যাকফি হাত বাড়িয়ে কাগজের রোলটা নিয়ে নিলো। ওটার ওপরে কর্নেল ক্রেয়াগের সিলমোহর লাগানো।
‘ঠিক আছে, মকসুদ মিয়া, তুমি যাও,’ বলেই সে মত পরিবর্তন করল। ‘না দাঁড়াও,’ বলে সে সিলমোহর ভেঙে কাগজটা খুলে পড়ল। কর্নেল ক্রেয়াগ তাকে দেখা করতে বলেছেন। জরুরি ভিত্তিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সন্ধেকালীন পার্টি শুরু হবার আগেই যেন ক্যাপ্টেন ম্যাকফি তার দলবল নিয়ে দুর্গে পৌঁছে যায়। পার্টিতে যোগদানের আগে অবশ্যই যেন তার সঙ্গে মোলাকাত করে ম্যাকফি।
তুমি সবাইকে বলো প্রস্তুত হয়ে নিতে,’ বলে সে মনে মনে সময়ের হিসেব করল। দুর্গে পার্টি শুরু হবার কথা সন্ধের পর। এখন প্রায় বিকেল হতে শুরু করেছে। তার মানে তারা যদি পার্টি শুরুর আগে দুর্গে পৌছে কর্নেল ক্রেয়াগের সঙ্গে মিটিং করতে চায় তবে অবশ্যই কিছুক্ষণের ভেতরে রওনা দিতে হবে। কারণ পূর্ণ বেগে ঘোড়া ছোটালেও কমপক্ষে এক ঘণ্টা লাগবে দুর্গে পৌঁছাতে।
‘সবাইকে জানিয়ে দাও, ছুটি শেষ। আমরা কিছুক্ষণের ভেতরেই দুর্গের দিকে রওনা দিচ্ছি।’
মকসুদ মিয়া চলে যাবার পর ম্যাকফি চুপচাপ কিছুক্ষণ পাইপ টানল। সেই সঙ্গে ঠিক করে নিলো নিজের আপাত পরিকল্পনা। একটা ব্যাপার বুঝতে পারছে না, হঠাৎ কর্নেল এভাবে ডেকে পাঠানোর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে। সাম্প্রতিক ঘটনার প্রেক্ষিতে কথা বলার জন্যে ডেকে পাঠানোর সম্ভাবনাই বেশি। মনে মনে একটু হাসল ম্যাকফি। ঘটনাটাকে ঘটনা না বলে দুর্ঘটনাই বলা উচিত।
ক্যাপ্টেন ম্যাকফি যদিও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে কাজ করে তবুও সে আসলে ব্রিটিশ আর্মির লোক। তার দলটাও প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ আর্মির অধীনেই কর্মরত। ক্যাপ্টেন ম্যাকফি আর তার দলের নাম ব্রিটিশ আর্মি স্পেশালাইজড টিম’। ম্যাকফির দল ভারতবর্ষে কোম্পানির অধীনে কর্মরত সবচেয়ে স্বাধীন আর সফল দল। ব্রিটিশ আর্মির দক্ষ কিছু অফিসারের প্রচেষ্টায় বহু কাঠখড় পুড়িয়ে সৃষ্টি এই দলের। ক্যাপ্টেন ম্যাকফির দলের কাজই হলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসারদের ওপরে নজরদারি করা, সেই সঙ্গে যেকোনো সমস্যার সমাধানের জন্যে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া। এই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থার ভেতরে রয়েছে গ্রেপ্তার থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় যেকোনো ব্যবস্থা গ্রহণ। সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে ক্যাপ্টেনের দলের সুখ্যাতি ও কুখ্যাতি…দুটোই ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে।
বিশেষ করে কোম্পানির ভেতরে অনেকেই এই বিশেষ দলের ওপরে বেশ নাখোশ। এমনিতেই কোম্পানি আর ব্রিটিশ রাজ দরবারের ভেতরে নাখোশি দিন- দিন বেড়েই চলেছে। এই নাখোশিতে আরো যোগান হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে কোম্পানির সৈন্যদের সঙ্গে ম্যাকফির দলের একটা খণ্ডযুদ্ধ। এই খণ্ডযুদ্ধের পরে একরকম জোর করেই তাদেরকে ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। গত তিনদিন ধরে অলস সময় কাটানোর পর ডাক এসেছে এখন।
পাইপটা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়াল ম্যাকফি। ঘরের ভেতরে ঢুকে পরিচ্ছন্ন হয়ে তৈরি হয়ে নিতে লাগল আসন্ন মোলাকাতের জন্যে। যদিও আজকের পার্টিতে সে ও তার দল আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে স্যুট পরে যাবার কথা; কিন্তু অনিয়মিত মোলাকাতটা হঠাৎ দাপ্তরিক রূপ নেওয়াতে সে সিদ্ধান্ত নিলো সামরিক পোশাকেই যাবে। তাই স্যুটের পরিবর্তে ব্রিচেস পরে নিয়ে তার ওপরে তার লাল রঙের সামরিক পোশাক চাপিয়ে অস্ত্রসহ বেরিয়ে এলো।
বাইরে এসে দেখল তার ছোট্ট দলের সবাই পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দলের কমান্ডিং অফিসার, মহাবীর সিং সংক্ষিপ্ত সুরে জানাল : তারা যাত্রার জন্যে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। দেরি না করে ঘোড়ায় চড়ে বসল সবাই।
প্রায় এক ঘণ্টা টানা ঘোড়া চালিয়ে যখন তারা দুর্গের কাছাকাছি পৌঁছাল তখন সন্ধের রেশ নেমে এসেছে প্রকৃতিতে।
দূর থেকেই ম্যাকফি দেখতে পেল-সুন্দর করে সাজানো হয়েছে দুর্গ। ইংরেজদের বাৎসরিক উৎসবের সময় এখন। ছোটোখাটো সব কুঠিতে পর্যন্ত উৎসবের আমেজ, আর সেইন্ট গ্রেগর তো ভারতবর্ষে ইংরেজদের প্রধান তিনটে দুর্গের একটি।
সাদা রঙের চমৎকার স্থাপনাটা ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণের পর থেকেই ভারতবর্ষে ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তারের মূল কেন্দ্রগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। স্থাপনাটার সৌন্দর্য এমনিতেই অসাধারণ, সেই সঙ্গে উৎসবের ঝলমলে আলো আর চোখ ধাঁধানো রূপসজ্জায় আরো অসাধারণ লাগছে। দুর্গে পৌঁছে ঘোড়াগুলোকে আস্তাবলে রেখে ওরা রওনা দিল অফিসারদের কোয়ার্টারের দিকে। লোক মারফত খবর পাঠানো হলো কর্নেল ক্রেয়াগের কাছে। ওরা অফিসারদের কোয়ার্টারে অপেক্ষা করছে এমন সময় একজন আরদালি এসে জানাল : তাদেরকে পার্টিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। নিজের দলকে অন্যান্যদের সঙ্গে পান-ভোজনে অংশ গ্রহণ করতে বলে ম্যাকফি রওনা দিল অফিসারদের বলরুমের উদ্দেশ্যে। বলরুমে পৌঁছে আরদালিকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল ম্যাকফি।
বলরুমের ভেতরে পুরোমাত্রায় পার্টির আমেজ।
বিরাট কামরাটার এককোণা থেকে ভেসে আসছে পিয়ানোর মিষ্টি সুর। গ্লাসের সঙ্গে গ্লাসের বাড়ি খাবার মৃদু টুংটাং শব্দের সঙ্গে পুরুষদের অট্টহাসি আর মেয়েদের খিল-খিল হাসিতে মুখরিত চারপাশ। একদিকে জোড়ায় জোড়ায় বল ড্যান্সও চলছে। রুমের একপাশে সারি-সারি টেবিল পেতে সাজানো হয়েছে মুখরোচক খাবার। মাথায় লাল পাগড়ি আর গায়ে সাদা পোশাক পরা আরদালিরা রূপোর তৈরি ট্রেতে ওয়াইন আর অন্যান্য খাবার সার্ভ করছে।
ম্যাকফি ভেতরে প্রবেশ করতেই তারদিকে ফিরে তাকাল অনেকে। দুয়েকজনকে মৃদু ফিসফাসও করতে শুনল ও। অনেকেই তার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন ম্যাকফি ভুল করে চলে এসেছে এখানে। এদের অভিব্যক্তি দেখে ম্যাকফি পরিষ্কার বুঝতে পারল তার সাম্প্রতিক মারামারির ঘটনায় ইতিমধ্যেই রং চড়তে শুরু করেছে। ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কোনদিকে যায় সেটাই এখন দেখার বিষয়। কারো দিকে না তাকিয়ে সে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। অফিসারদের জটলায় পরিচিত দুয়েকটা মুখ দেখতে পেয়ে সেদিকে পা বাড়াল ও।
‘হেই, ম্যাকফি, মাই ব্রাদার,’ ওকে দেখতে পেয়ে হাসি মুখে সম্ভাষণ জানাল ওরই এক প্রাক্তন সহকর্মী। একটা সময় তারা দুজনেই বেঙ্গল ব্রিগেডের অধীনে কাজ করত।
‘স্কট,’ বলে ওকে জড়িয়ে ধরল ম্যাকফি। সাধারণ ব্রিটিশ কেতা কিংবা সামরিক নিয়ম অনুযায়ী এইভাবে সম্ভাষণ না জানালেও, এটা অনিয়মিত পার্টি; তাই পরষ্পরের প্রতি আন্তরিকতা প্রকাশে কোনো বাধা নেই। ‘তো, কী খবর তোমার? তুমি আর তোমার দল তো রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে গেছ,’ হাসতে হাসতেই বলে উঠল স্কট।
‘বিখ্যাত, নাকি কুখ্যাত?’ স্কটের পেছন থেকে আরেকজন বলে উঠল। ‘আমরা ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ শাসন করতে এসেছি। আর সেটা করতে গেলে ক্ষেত্রবিশেষে শক্ত হতেই হয়। এই ব্যাপারটাই অনেকে বুঝতে পারে না। পরিণতির কথা চিন্তা না করেই সদ্য পাওয়া ক্ষমতার দম্ভে দিশা হারিয়ে ফেলে অনেকে।’
ম্যাকফি মনোযোগ দিয়ে দেখল মানুষটাকে। সঙ্গে সঙ্গে চিনতে না পারলেও এটা বুঝতে পারল নিশ্চয়ই এমন কেউ যে কিনা ম্যাকফির বিশেষ অপারেশনের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। সাধারণ স্যুট পরে থাকায় তার র্যাঙ্কটাও বোঝার উপায় নেই। তবে ম্যাকফিও কথা ছেড়ে দেবার মতো লোক নয়। কথাগুলো মনে মনে গুছিয়ে যখন সে জবাব দিল সেটা যথেষ্টই কঠিন শোনালো।
‘কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ সেটার বিচার করার আমরা কেউ নই। সেটা কর্তৃপক্ষ দেখবে। আমাদের কাজ হলো নিজের কর্তব্য করে যাওয়া। আর বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্রতর ক্ষতি যারা মেনে নিতে পারে না তারা বোকা।’
ম্যাকফির বক্তব্যের শেষ শব্দটা শুনে ঝট করে মাথা ওপরের দিকে তুললো অফিসার। ঠাস করে মেঝেতে ছুড়ে মারলো হাতের গ্লাস। ‘অফিসার, আমি আপনাকে বক্তব্য সংশোধন করতে বলছি। তা না হলে…’ লোকটার কথার জবাবে ম্যাকফিও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই স্কট তাকে টেনে নিয়ে এলো এক পাশে।
‘বাদ দাও তো, ম্যাকফি।’
‘কে এই লোক?’ ম্যাকফি আসলেই রেগে গেছে। ‘এভাবে কথা বলার সাহস পায় কোত্থেকে?’
‘তুমি ওকে চিনতে পারোনি!’ স্কট একটু অবাক হয়েছে। ‘গেল হপ্তায় তোমার হাতে মার খেয়েছে যে অফিসার তার বড়ো ভাই এই লোক। ম্যাকফি, আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি। এই লোক খুব খারাপ। মাদ্রাজ শহর আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, দুই জায়গাতেই তার প্রভাব অনেক। বিশেষ করে ওপর মহলে তার সংযোগ খুব সাংঘাতিক। কাজেই সাবধান।’
ম্যাকফি হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করল।
‘আচ্ছা, আমাকে একটা ব্যাপার বলো তো, তহলিশপুরে আসলে হয়েছিল কী? একেকজনের কাছে একেক কথা শুনি। কেউই পরিষ্কার কিছু বলে না। শুধুই ঢাক গুড়-গুড় আর সবার কাছে শুধু তোমার আর তোমার দলের বদনাম। ব্যাপারটা খুলে বলো তো।’
ম্যাকফি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ‘আমি জানি না তুমি কী শুনেছো, কিন্তু সত্যিকথা হলো আমার আর আমার বিশেষ বাহিনীর কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন সময়ে যাদের স্বার্থে আঘাত লেগেছে তারাই এখন সুযোগ পেয়ে এসব ছড়াচ্ছে।’
‘তুমি কোম্পানির লোকজনকে মারতে গেলে কেন? ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না? হাজার মাইল দূর থেকে এসে আমরা যদি এখানে টিকে থাকতে চাই তবে তো আমাদের একত্রে থাকাটা সবচেয়ে বেশি জরুরি।’
‘শোনো, যা ঘটেছে সেটা অনাকাঙ্খিত ছিল কিন্তু এতে আমার দলের কোনো দোষ নেই। আমি পুরো ঘটনা তোমাকে খুলে বলছি। তুমি তো জানোই আমাদের বিশেষ বাহিনীর কাজই হলো সর্বক্ষণ নজরদারিতে থাকা ও বিশেষ পরিস্থিতিতে যেকোনো ব্যবস্থা নেওয়া। আমরা তখন বোম্বে থেকে রওনা দিয়ে মাদ্রাজের দিকে আসছি এমন সময় তহলিশপুরের কাছে এক স্থানীয় গ্রামের সর্দার আমাদের কাছে অনুরোধ করে তাদের ওদিকে নাকি কন্নরের কিছু দস্যু খুব উৎপাত করছে। তো সেটার সমাধান করতে আমরা তার এলাকায় চলে যাই। কন্নরের ডাকাতদের খোঁজে টহল দিতে দিতে এক পর্যায়ে আমরা তহলিশপুরের কাছে ছোট্ট একটা গ্রামে পৌছাই। সারাদিনের টহল শেষে ওখানে পৌছানোর পর খুবই ক্লান্ত ছিলাম আমরা।
‘গ্রামে পৌছে আমরা কুয়ো থেকে পানি খেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম এমন সময় দেখতে পাই-গ্রামে আগে থেকেই কোম্পানির একটা দল এসে খাজনা আদায় করছে। আমরা যে কুয়ো থেকে পানি খাচ্ছিলাম, সেই কুয়োর কাছেই এক বাড়িতে ঢুকে ওরা গৃহস্বামীকে মারতে মারতে বের করে আনে। স্থানীয় একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, এই লোকের নাকি অনেক খাজনা বাকি পড়েছে। তুমি তো জানোই, গেল বছর খরায় ফসলের কী অবস্থা হয়েছে। তো যাই হোক, তখন লোকটা বারবার হাত জোর করে মাফ চাইছে আর খাজনার জন্যে আরেকটু সময় চাইছে। কোম্পানির অফিসার কোনো কথা না শুনেই তাকে বেদম মারছে। লোকটাকে বাঁচাতে তার স্ত্রী আর ছোটো বাচ্চা এসে তার গায়ের ওপরে পড়লে ওরা তাকেও মারতে থাকে। মারের চোটে লোকটার ছোটো ছেলেটা একপাশে ছিটকে পড়লে কোম্পানির এক সৈন্য বাচ্চাটার ওপরে পা তুলে দেয়।
‘ঘটনা ঘটার সময়ে আমরা প্রথমে চুপচাপ দর্শকই ছিলাম। কারণ আমি জানতাম কোম্পানি এসব খাজনার ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর হয়ে থাকে। কিন্তু সৈনিকটা বাচ্চাটার ওপরে পা তুলে দিতেই আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে আমি রাজার নামে নির্দেশ করি তাকে থামতে। সঙ্গে সঙ্গে সেই অফিসার এসে আমাকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। ব্যস, দুয়েকটা কথা কাটাকাটি থেকে সেটা মারামারি পর্যন্ত গড়াতে সময় লাগেনি,’ এই পর্যন্ত বলে ম্যাকফি শ্লেষের হাসি হাসল। ‘কোনো সমস্যা হতো না যদি আমি আর আমার দল মার খেতাম। ওই অফিসার আর তার দল আমার সৈন্যদের কাছে মার খেয়ে আহত হওয়াতেই যত সমস্যার উদ্ভব, সেটাকি আমি বুঝি না? আর এথেকেই ব্যাপারটা ছড়িয়ে পড়ে যে আমি নাকি ক্ষমতা পেয়ে কোম্পানির সৈন্যদের পিটিয়ে বেড়াচ্ছি,’ একটানা কথা বলে ম্যাকফি দম নিতে লাগল।
ওর কথা শুনে আনমনে মাথা নাড়তে লাগল স্কট। ‘শোনো, ম্যাকফি। তোমার দলের কর্মকাণ্ডে আগে থেকেই অনেকে রেগে ছিল। এবার তারা সুযোগ পেয়ে গেছে তোমাকে দেখে নেওয়ার।’
‘আমি এখন কর্নেল ক্রেয়াগের ওপরে ভরসা করে আছি। আশা করি এই বাজে পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাবার ব্যাপারে উনি কোনো একটা উপায় বের করবেন।’
‘সাধারণ একটা ব্যাপার আচমকাই অনেক বেশি স্পর্শকাতর হয়ে গেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস কর্নেল তোমার পক্ষে থাকবেন, কিন্তু মনে রেখো তারও ওপরওয়ালা আছে। আর তারা সবাই এখন কোম্পানির লাভের গুড়ে ভাগ বসাচ্ছে। কাজেই তার কাছ থেকেও খুব বেশি আশা করো না। আমি তো এরকমও শুনতে পাচ্ছি…’
‘স্যার, ম্যাকফি,’ মৃদু ডাক শুনে ফিরে তাকাল দুজনেই। সাদা পোশাক আর লাল পাগড়ি পরা এক আরদালি দাঁড়িয়ে আছে। ‘কর্নেল ক্রেয়াগ স্যার, আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।’
ওয়াইনের গ্লাসটাতে বড়ো করে একটা চুমুক দিয়ে আরদালির পিছু-পিছু ম্যাকফি রওনা দিল কর্নেলের কক্ষের দিকে। যেতে যেতে শুনতে পেল কেউ একজন বলছে, ‘খুব নাচানাচি করেছে, এবার টের পাবে’।
উড়ো কথায় পাত্তা না দিয়ে দৃঢ় পায়ে কর্নেলের কক্ষে প্রবেশ করল ম্যাকফি। কর্নেলকে সবসময় সামরিক পোশাকে দেখলেও এই প্রথমবারের মতো তাকে স্যুটে দেখতে পাচ্ছে। রুমের ভেতরে প্রবেশ করে মৃদু কাশি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল ম্যাকফি। কারণ কর্নেল তার চেয়ারে নেই। বরং ওর দিকে পেছন ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের টাই ঠিক করতে ব্যস্ত সে।
ওর কাশির শব্দ শুনে হাসি মুখে ফিরে তাকালেন কর্নেল। ‘ওহু, ক্যাপ্টেন তুমি এসেছো,’ ব্রিটিশ আর্মির সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষ কর্নেল ক্রেয়াগ ম্যাকফিকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসেন। ‘দেখো তো ছাই, কী একটা অবস্থা! এই বয়সে এসেও টাই বাঁধতে পারছি না। এদিকে তোমাদের ম্যাডাম আগেই চলে গেছে পার্টিতে।’
‘স্যার, কিছু মনে না করলে আমি বেঁধে দিচ্ছি,’ বলে ক্যাপ্টেন ম্যাকফি তার ছড়ি আর হ্যাট টেবিলের ওপরে রেখে কর্নেলের দিকে এগিয়ে গেল। কর্নেল স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন। ক্যাপ্টেন মনোযোগ দিয়ে বাঁধতে লাগল টাই I
‘ক্যাপ্টেন, তুমি একটা দুষ্টু ছেলে, কর্নেল যখন কথাগুলো বললেন তখন ম্যাকফি থেকে কর্নেলের মুখের দূরত্ব মাত্র কয়েক ইঞ্চি। ‘আর ইদানিং তোমার দুষ্টুমি আমাকেও বিপদে ফেলে দিচ্ছে।’
‘আমার দুষ্টুমির জন্যেই তো আপনি আমাকে ভালোবাসেন, কর্নেল,’ বলে টাই বাঁধা শেষ করে কয়েক ধাপ পিছিয়ে এলো ম্যাকফি। ‘স্যার, আপনি যদি আমাকে সময় দেন তবে আমি সব ব্যাখ্যা করে…’
‘ক্যাপ্টেন, তোমার পাঠানো রিপোর্ট পড়েছি আমি,’ কর্নেলকে খানিকটা চিন্তিত দেখাচ্ছে। ‘কাজেই আমি জানি তহলিশপুরে কী ঘটেছিল। ওখানে যাই ঘটে থাকুক সেটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। কোথায় জানো?’ বলে তিনি ম্যাকফির দিকে চোখ তুলে তাকালেন। ‘প্রশ্নটা হলো দৃষ্টিভঙ্গির। তুমি কি জানো নিজেদের মাতৃভূমি থেকে এতদূরে এসে গুটি কয়েক মানুষ নিয়ে কীভাবে আমরা এই বিরাট ভারতবর্ষ শাসন করছি? আমরা ভারতবর্ষ শাসন করতে পারছি কারণ আমরা এক, আর ভারতবাসীরা বিভক্ত। এই বিভক্তি আর অবিভক্তির মাঝখানে একটা সূক্ষ্ম ফাটল তৈরি করেছে তোমার দলের কর্মকাণ্ড। ওপর মহল কখনোই এটা মেনে নেবে না।’
‘স্যার, যথাযথ সম্মানের সঙ্গে বলছি,’ ম্যাকফি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াল। ‘আমাদের বিশেষ বাহিনী যখন গঠন করা হয় তখন সেই প্রক্রিয়াটার সঙ্গে আপনিও ছিলেন, স্যার। আমাদেরকে একত্রিত করা হয়েছিল যাতে কড়া নজরদারি, সাহসী পদক্ষেপ আর সুবিচার দ্বারা আমরা ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন আরো সুদৃঢ় করতে পারি। আমি ও আমার দল গত একটা বছর ধরে এই চেষ্টাই করেছি। কিন্তু এখন যদি ক্ষমতার নামে ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রশ্ন ওঠে তবে শাসনের নামে শোষণের প্রশ্ন আমিও তুলতে পারি। তবে সে যোগ্যতা আমার নেই। একারণে আমার কিছু বলারও নেই। স্যার, আপনি আমার পিতৃসম, যে শাস্তি দেবেন আমি মাথা পেতে নেবো কিন্তু আমার দলের কারো যেন কিছু না হয়। সব দায়ভার আমার
কর্নেল এগিয়ে এসে একটা হাত রাখলেন ম্যাকফির কাঁধে। ‘ম্যাক, তুমি যেমন আমাকে নিজের পিতার মতো শ্রদ্ধা করো, আমিও তেমনি তোমাকে নিজের সন্তানের মতোই মনে করি। একটা ব্যাপার মনে রাখবে, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যেও কখনো কখনো কৌশলী হতে হয়, আগে বাড়ার জন্যে কখনো কখনো পেছনে হটতে হয়,’ ম্যাকফির কাঁধে একটা হাত রেখে হাঁটছিলেন কর্নেল, হঠাৎ তিনি একটু এগিয়ে থেমে গেলেন। ‘তহলিশপুরে যা হয়েছে এরপর হাই কমান্ড চাইছে তোমার দলটা ভেঙে দিয়ে তোমাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে।’
ম্যাকফি শক্ত মুখে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে থাকলেও ওর ভেতরটা কেঁপে উঠেছে। নিজের এই বিশেষ দায়িত্বই তার প্রাণ, আর নিজের বাহিনীই ওর পরিবার। তাকে যদি এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তবে বেঁচে থাকাটাই ওর জন্যে শাস্তি হয়ে যাবে। ‘আপনি, আপনি কী চাইছেন?’ ম্যাকফি শুষ্ক মুখে জানতে চাইল।
‘আমি চাইছি কোনোভাবেই যেন তোমার দল ভেঙে না যায়, তোমাকে যেন দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া না হয়। আর একারণেই আপাতত দৃশ্যপট থেকে তোমাকে সরিয়ে দিতে চাইছি।’
‘মানে, স্যার? ঠিক বুঝলাম না,’ কর্নেলের কথায় ম্যাকফি একটু দ্বিধান্বিত। কর্নেল আসলে চাইছেন কী?
‘তোমাকে আমি একটা বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে আপাতত এখান থেকে সরিয়ে দিবো,’ বলে কর্নেল টেবিলের সামনে গিয়ে একটা রোল করা কাগজ তুলে নিয়ে ম্যাকফিকে তুলে নিতে ইশারা করলেন। ‘তোমাকে আমি বাঙ্গাল প্রদেশে বদলি করে একটা বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্যে পাঠাচ্ছি।’
ম্যাকফি প্রবল আপত্তির সঙ্গে মাথা নেড়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই কর্নেল বলে উঠলেন। ‘আগে আমার কথা শোনো। তোমার কাজই হলো বিশেষ-বিশেষ ব্যাপারগুলো দেখা ও সেগুলোর সমাধান করা, তাই না? বাঙ্গাল প্রদেশের এক অঞ্চলে মধুপুর নামে একটা জায়গা আছে। চারপাশে জঙ্গল, একপাশে নদী আর মাঝখানে বসতি। সেখানে কিছুদিন যাবৎ উলটোপালটা ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি ইংরেজ সৈন্যদের একটা ছোটো দল বিশেষ কাজে ওখানকার রাজার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে হারিয়ে গেছে। কোনোভাবেই ওদেরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, একেবারে হাওয়া। আমি চাই, তুমি সেখানে গিয়ে খুঁজে বের করো ওদের ভাগ্যে কী ঘটেছে।’
ম্যাকফি বুঝে গেছে কথা বলে তেমন লাভ নেই। ‘স্যার, আপনি তাহলে এটাই চাইছেন?’
‘হ্যাঁ, ক্যাপ্টেন। সবাই তোমার মুণ্ডুটা চিবিয়ে খেতে চাইছে আর আমি তোমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। সেই সঙ্গে তোমার দলটাকেও। আর সেটা করতে হলে এই মুহূর্তে দৃশ্যপট থেকে সরে যাওয়াই তোমার জন্যে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ওখানে গিয়ে ভালো কিছু কাজ দেখাও, হারিয়ে যাওয়া সৈন্যদের খুঁজে বার করো, আমি আবার সুপারিশ করে তোমাকে ফিরিয়ে আনবো। আগের চেয়ে আরো বেশি শক্ত অবস্থানে বসাবো তোমাকে।’
স্যার, আমার দল সঙ্গে থাকবে তো?’
সবার ওখানে যাবার দরকার নেই। তুমি দুজনকে নিয়ে যাও। বাকিরা এখানে আমার অধীনে থাকবে আপাতত। ওখানে গেলে বেগুনবাড়ি ও মুক্তাগাছার স্থানীয় রাজা তোমাকে সব ধরনের সহায়তা করবে। কারণ এই ঘটনায় সে-ই সবচেয়ে বেশি বিব্রত হয়েছে।’
‘ঠিক আছে, স্যার,’ বলে ক্যাপ্টেন হাত বাড়িয়ে রোল করা কাগজটা নিয়ে নিলো। ওটা নিয়ে বেরিয়ে আসছিল হঠাৎ পেছন থেকে ডাক দিলেন কর্নেল।
ক্যাপ্টেন, তুমি জানো আমি তোমাকে ভালোবাসি। কাজেই ভালোভাবে ফিরে এসো, সব সমস্যার সমাধান হবে। আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে।’
কর্নেলের শেষ কথাটা ম্যাকফি শুনেও শুনল না। তার মাথায় ঘুরছে নিজের বদলি আর তার দল ভেঙে যাবার ব্যাপারটা। কর্নেলের রুম থেকে বেরিয়ে করিডরে দাঁড়িয়ে সে সিলটা ভেঙে কাগজটা পড়ল। ওটা পড়তে পড়তেই ভাবতে লাগল : কর্নেল কি ওকে বদলি করে ওকে রক্ষা করলেন নাকি নিজেকে রক্ষা করলেন?
ঠিক আছে বদলিই যদি হয় আপাত সমাধান তবে তাই হোক