প্রথম অংশ : ছন্দপতন
দ্বিতীয় অংশ : মৃত্যুহরণ

সপ্তরিপু – অধ্যায় ১৪

অধ্যায় চৌদ্দ – সময় : ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ

খাগডহর বাজার, ময়মনসিংহ

নির্মাণাধীন রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে সামনের পাক্ষিক হাটের দিকে তাকিয়ে আছে ম্যাকফি।

ঘোড়া প্রাণিটা ওর খুব পছন্দের হলেও এই মুহূর্তে কেন জানি খুব বিরক্ত লাগছে ঘোড়ার হাটে এসে। একদিন আগে শংকরের কাছে যখন শুনল এই এলাকাতে ঘোড়ার হাট বসে, সে ভেবেছিল এই দূরবর্তী এলাকার হাট আরকতই-বা বড়ো হবে? কিন্তু সেটা যে কতবড়ো ভুল ভাবনা ছিল সেটা ভেবে ও একটু অবাকই হচ্ছে এখন।

হাটের দিকে তাকিয়ে এই মুহূর্তে ওর মনে হচ্ছে এত রীতিমতো মহাযজ্ঞ। ‘বস, তুমি যা খুঁজে বের করতে চাইছ এখান থেকে সেটা খুঁজে বের করা তো রীতিমতো দুরূহ একটা ব্যাপার,’ ম্যাকফির পাশে দাঁড়ানো জোনাথন শিস দিয়ে উঠল হাটের আয়তন দেখে।

‘সেটাই তো মনে হচ্ছে,’ বলে ও দলের সবার দিকে ফিরে তাকাল। ‘বাজারটা এতবড়ো হবে আমি ভাবতেও পারিনি।’

‘হুজুর, এই হাট অত্র এলাকার সবচাইতে বড়ো হাটগুলার একটা। এই মুলুকের সবচেয়ে ভালা ঘোড়াগুলা পাওয়া যায় এইহানে। চট্টগ্রাম, মেঘালয় এমনকি রেঙ্গুন থাইকা ব্যাপারী আসে, ক্রেতা-বিক্রেতা আসে, এইখানে ঘোড়ার সদাই খরিদ করতে,’ শংকরের গলায় গর্বের সুর।

‘কারণ কী? দূরের শহর ফেলে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে কেন আসে লোকজন?’ জোনাথন জানতে চাইল।

‘হুজুর, কারণ আর কিছুই না, মেঘালয় আর আসামের চালান আসে এই বাজারে, যেইডা অন্য কোনোহানে পাইবেন না আপনে,’ জোনাথনের প্রশ্নের জবাবটা দিল ডুম্বুর। সে এখন ওদের সঙ্গে অনেকটাই সহজ হয়ে উঠেছে। ব্ৰহ্মপুত্র নদী দিয়া খুব সহজেই মেঘালয় আর আসাম থাইক্কা মাল আহে। মানে ঘুড়া আহে আরকি। আমি আসাম রাজার লগে কাম করনের সময় মাজে-মইদ্দে আমারেও দায়িত্ব দিত হের এলাকা থাইক্কা ঘুড়া আনুনের

‘সেটা তো বুঝলাম কিন্তু এখন কাজ করব কীভাবে?’ ম্যাকফির কাছে জানতে চাইল জোনাথন।

ম্যাকফি চিন্তিত মুখে বাজারের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর প্রাথমিক পরিকল্পনা পুরোপুরি মাঠে মারা যেতে বসেছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এখনো আশা আছে। দেখা যাক।

ওর পরিকল্পনাটা ছিল খুব সহজ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যদের ক্যাম্প থেকে সব জিনিসপত্র খোয়া যাবার সঙ্গে এমন একটা জিনিসও সম্ভাব্য খুনি বা অপহরণকারীরা নিয়ে গেছে যেটার ব্যাপারে একমাত্র হদিস বের করা সম্ভব এই বাজার থেকে। জিনিসটা আর কিছুই না, কোম্পানির সৈন্যদের ঘোড়া।

কোম্পানির সৈন্যদের অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে ওদের ক্যাম্প থেকে ঘোড়াগুলোও গায়েব হয়েছে। যে বা যারাই এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকুক না কেন নিশ্চিভাবেই বলা যায় নিয়ে যাওয়া ঘোড়াগুলো তাদের পক্ষে বেশিদিন লুকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। কারণ ঘোড়াগুলোর গায়ে কোম্পানির চিহ্ন আঁকা রয়েছে। একদিন আগে ডোংরু মহারাজের ডেরা থেকে ফেরার পর নিজের ঘোড়ায় ওঠার সময়ে এই ব্যাপারটাই ম্যাকফির মাথায় আসে ডোংরু মহারাজের কথার ইঙ্গিত থেকে। কোম্পানির প্রতিটি ঘোড়ার গায়ে বিশেষ একটা চিহ্ন-একটা গোল চাকতির ভেতরে দুপাশ থেকে ক্রশ করে থাকা দুটো চাবি পরস্পরকে ছুঁয়ে আছে—এরকম একটা লোগো লোহা গরম করে একেবারে গভীরভাবে চামড়ায় বসিয়ে দেওয়া থাকে। আগে হোক বা পরে, ঘোড়াগুলোকে তাদের বিক্রি করতেই হবে আর সেটা করতে হলে এই বাজারই সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা। ম্যাকফির ধারণা ছিল ছোটো এলাকা, এখানে এলে সহজেই বাজারে নতুন ওঠা ঘোড়াগুলোকে পরীক্ষা করে ওরা কিছু একটা বের করতে পারবে। কিন্তু এখন এখানে এসে বাজারের ব্যাপকতা দেখে একটু চুপ মেরে গেছে ও।

‘সবাই মন দিয়ে শোনো, যদিও আমরা প্রাথমিক পরিকল্পনা কাজে লাগাতে পারছি না কিন্তু পিছিয়ে যাবার কোনো কারণও আমি দেখতে পাচ্ছি না। আমরা সম্পূর্ণ বাজার খুঁজে দেখবো। এই মুহূর্তে আমরা দলে আছি পাঁচজন। জোনাথন আর ডুম্বুর থাকবে একদলে, মহাবীর সিং আর শংকর থাকবে আরেক দলে। আর আমি একাই বেরুবো। তিনদলে ভাগ হয়ে আমরা বাজারে ছড়িয়ে পড়বো। সম্পূর্ণ বাজার পরীক্ষা করে ফিরে আসবো আস্তাবলের কাছে।’

আর যদি আমরা কিছু খুঁজে পাই তবে কী করব?

‘ব্যবস্থা আছে,’ বলে মহাবীর সিংয়ের দিকে ফিরে ইশারা করল ম্যাকফি। ওর ইশারার সঙ্গে সঙ্গে মহাবীর সিং নিজের কোমরে ঝোলানো থলে খুলে ওটার মুখ হাতের তালুতে উপুড় করে ধরতেই ভেতর থেকে সবুজ রঙের কয়েকটা জিনিস বেরিয়ে এলো। প্রত্যেকের হাতে একটা করে দিল সে।

সবাই জিনিসটা নেড়ে চেড়ে দেখছে, ম্যাকফি আবারো বলতে শুরু করল ‘এটা নারকেল পাতা দিয়ে তৈরি বিশেষ বাঁশি। এটাতে জোরে ফুঁ দিলে এক ধরনের পাখির শিসের মতো আওয়াজ বেরিয়ে আসে। যেটা বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে,’ বলে সে ফুঁ দিয়ে দেখাল। ‘সবাই এটা সাবধানে রাখবে। কোনো বিপদ হলে বা গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেখলে সঙ্গে সঙ্গে ফুঁ দিবে এটাতে। আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন, সঙ্গে সঙ্গে শব্দের উৎসের কাছাকাছি পৌছানোর চেষ্টা করব। বোঝা গেছে?’

সবাই মাথা নাড়ল।

‘গুড, তবে আরেকটা ব্যাপার বলে নেই। কী খুঁজবে মনে আছে তো? কোম্পানির ছাপ দেওয়া আছে এরকম ঘোড়া, সেই সঙ্গে সন্দেহজনক যেকোনো কিছু। বিশেষ করে সবাই খেয়াল রাখবে, ওইদিন যে লোকটার পিছু নিয়েছিলাম তাকেও দেখা যেতে পারে। যদি কেউ তোমাদের পিছু নেয় সেই ব্যাপারেও সতর্ক থাকবে। এই বাজারে বিভিন্ন ধরনের লোক আছে কাজেই তাদের ভিড়ে মিশে গিয়ে কাজ উদ্ধার করতে খুব বেশি ঝামেলা হবার কথা নয়। চলো, সবাই এগোই।’

ওরা বাজারে প্রবেশ করে আস্তাবলের দিকে এগোল। নিজেদের ঘোড়াগুলো আস্তবলে রেখে আধা-আনি পয়সা পরিশোধ করল রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে। তারপর কথামতো তিনদলে ভাগ হয়ে গেল।

‘জোনাথন আর ডুম্বুর, তোমরা দুজনে ডান দিয়ে এগোবে। শংকর আর মহাবীর সিং তোমরা বামে দিয়ে। আর আমি বাজারের মাঝামাঝি এগোব। সবাই সাবধানে থাকবে। সন্দেহজনক কিছু দেখা মাত্রই বাঁশিতে ফুঁ দেবে, যাতে একজনের বিপদে অপরজন এগিয়ে আসতে পারি। ঠিক আছে, সবাই এগোও,’ ম্যাকফির কথা শেষ হতেই ওরা যার যার মতো সামনের দিকে এগিয়ে গেল।

ম্যাকফি তলোয়ারের হাতলে হাত রেখে বাজারের মাঝ বরাবর হাঁটতে লাগল। ছোটোবেলা থেকে ভ্রমণের ওপরে থাকার কারণে মানুষের পরে যে প্রাণিটার সঙ্গে ওর সবচেয়ে বেশি সখ্যতা সেটা হলো ঘোড়া। কে জানি বলেছিল : যুদ্ধের ময়দানে মানুষের সবচেয়ে বড়ো বন্ধু তার বাহন। সেটাও হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে সে যুদ্ধের সময়ে।

এখন পর্যন্ত নিজস্ব তিনটে ঘোড়ার মালিক ছিল সে। যারা ঘোড়া ব্যবহার করে তারা জানে, একটা ঘোড়ার সঙ্গে তার মালিকের সম্পর্ক কেমন হয়। কর্তব্যের সময়ে, যুদ্ধের ময়দানে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধুতে পরিণত হয় একটা ঘোড়া। নিজেকে এতদিন ভারতীয় ঘোড়ার বিশেষজ্ঞ মনে করলেও এই বাজারে ঘুরতে ঘুরতে ওর মনে হলো ঘোড়া বিষয়ে অজ্ঞ লোক সে।

চারপাশে এত ধরনের মাদী আর মদ্দা ঘোড়া দেখতে পাচ্ছে ও কোনটা কোন জাতের পুরোপুরি ওর পক্ষে তো বলা সম্ভব নয়ই। এমনকি ঘোড়াগুলোর রঙের আর আকারেরও বাহুল্যও প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করছে ওকে। বাজারে ঘুরতে ঘুরতে দেখতে পেল আসামের ঘোড়া, মেঘালয়ের ঘোড়া। ভারতের নানা প্রদেশের ঘোড়া থেকে শুরু করে আফগানিস্তানের আর ইরানের ঘোড়াও দেখতে পেল। সবকিছুরই দেখা পেল কিন্তু যা খুঁজছিল সেটার দেখা মিললো না।

ঘোড়া দেখতে দেখতে কোন দিক দিয়ে সময় পার হয়ে যেতে লাগল টেরও পেল না ও। হাঁটতে হাঁটতে বাজারের একেবারে শেষ প্রান্তে চলে এসেছে ও। ব্যাপার কী, অন্যরা কোথায়। সময়টা চমৎকার কাটলেও কাজের কাজ হয়নি। যা খুঁজছিল সেটা তো পায়নি, সেই সঙ্গে তীব্র গরমে অসহ্য লাগছে। বাজারের শেষ প্রান্তে এসে একটু থামলো ও। কাছেই একটা ছোটো পুকুরের মতো আছে। সেটার পাড়ে বিরাট একটা বটগাছ। বটগাছের নিচে সুন্দর গোল একটা ছায়াঘেরা জায়গা। সেই ছায়াঘেরা জায়গাটায় বেশ কিছু লোকজন জটলা করে আছে। ম্যাকফি সেদিকে এগিয়ে গেল।

এখানে বহু জায়গার বহু ধরনের লোক আসলেও সাদা চামড়ার মানুষ খুব বেশি আসে না বললেই চলে। তাই ম্যাকফিকে দেখে ভিড়ের ভেতরেও লোকজন সরে গিয়ে ওকে জায়গা করে দিল। ভিড় ঠেলে সামনে এগোতেই দেখতে পেল সামনে সাপ আর দড়ির খেলা চলছে। একজন বয়স্ক মানুষ আর তার সঙ্গে ছোটো ছোটো দুটো ছেলে। ছেলে দুটোর চেহারায় আশ্চর্য মিল। আসলে মিল বললে ভুল হবে, দুজনার চেহারা হুবুহু একইরকম। যমজ

দড়ির খেলা দেখানো মানুষটার চেহারাও দেখার মতো। হালকা-পাতলা মানুষটার মুখে প্রায় দেড় ফিট লম্বা দাড়ি। শীর্ণ মুখটাতে বিরাট একজোড়া গোঁফ। এরকম গোঁফ রাজস্থানের মরু এলাকার লোকজনকে রাখতে দেখেছে ও। লোকটার পোশাক-আশাকও খুবই জবরজং। পায়ে কোঁচানো ধুতি। ভারতীয়রা ধুতি পরে সাধারণত এক রঙের, এর ধুতিরং-বেরঙের। গায়ে কাফতানের মতো একটা পোশাক তাতে অসংখ্য পট্টি। মানুষটার গলায় বিভিন্ন ধরনের পুঁতির মালা আর হাতে হলুদ রঙের মোটা বালা। নড়াচড়ার সঙ্গে সঙ্গে গলার পুঁতি আর হাতের মোটা বালায় বাড়ি লেগে টুংটাং শব্দ করে উঠছে। টকটকে লাল দুই চোখের মাঝখানে ততোধিক লাল রঙের কিছু একটা দিয়ে টিকা লাগানো। তার এই জবরজং চেহারার তুলনায় তার ছেলেদের চেহারা অনেক সাদামাটা। দুটো ছেলেরই পায়ে সাদা ধুতি পরা। খালি গা, আর মাথায় পাগড়ি। বারো-তেরো বছর বয়সের ছেলে দুটোই বয়সের তুলনায় বেশ লম্বা, সেই সঙ্গে শরীরেও পাকানো দড়ির মতো পেশি।

বাপ আর ছেলেদের মানিকজোড়কে লক্ষ করতে করতেই ম্যাকফি চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এমন সময় সেই লোকটা উঠে দাঁড়াল।

‘এসাব খেল তো বহুত দেখলিয়া। সাপোকা খেল ভি বহত দেখলিয়া আব গায়েবিকা খেলা দেখনা হ্যায়। সাপকা বাপ,’ বলে সে হাততালি দিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে তার দুই ছেলের একজন মোটা মটকির মতো গোল একটা জিনিস মেলে ধরল। হাততালি দিয়ে উঠল লোকজন।

ম্যাকফি শুনতে পেল লোকজন ফিসফাস করছে ‘দড়ির খেলা দেখানো হবে দড়ির খেলা’। হঠাৎ ওর মনে পড়ে গেল কোনো একদিন তার এক ইংরেজ সহকর্মী আলোচনা করছিল সে নাকি ভারতবর্ষের কোথায় এক দুর্ধর্ষ এক ম্যাজিক ট্রিক দেখেছে। স্থানীয়রা নাকি এটাকে বলে ‘রাশি কা খেল’। ওর সহকর্মী খেলাটাকে যে নামে ডাকছিল সেটাও মনে পড়ে গেল ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান রোপ ট্রিক’। এটাকি সেই খেলা নাকি? সে মনে মনে কৌতূহল নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। একবার ভাবল আশপাশে কাউকে জিজ্ঞেস করে কিন্তু দড়ির খেলা দেখানো লোকটার কাছেই জবাব পেয়ে গেল।

‘হাজারো বরস ধরে আমারে পূর্বাজো নে ইয়ে খেল দিখাকে আ রা রাহে হ্যায়, জিছে দেখ কার ইংরেজ লোগভি হ্যায়রান হো গেয়ে। অউর ও লোগ ইস খেলকো বুলাতে হ্যায় ‘গেরেট ইন্ডিয়ার রোপ টিরিক’,’ সে এই পর্যন্ত বলতেই চারপাশে তালির বন্যা বয়ে গেল।

‘দেখিয়ে ইস মাটকিমে রাশি হ্যায় স্রেফ রাশি। চাইয়ে তো ছুঁকার দেখিয়ে, ‘ বলে সে মটকি হাতে ছেলেটার দিকে ইঙ্গিত করল। ছেলেটা দড়ি ভরতি মটকিটা নিয়ে সবার সামনে দিয়ে ঘুরতে লাগল। সবাই উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। ম্যাকফিও কৌতূহল দমন করতে না পেরে মটকির ভেতরে উঁকি দিল। ভেতরে বেশ মোটা অতি সাধারণ চেহারার পুরনো একটা দড়ি রাখা। ওর পাশেই দাঁড়ানো একজন মটকিতে হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল। ওদের আলোচনায় সে-ও বুঝল ভেতরে স্রেফ দড়ি ছাড়া আর কিছু নেই। আর দড়িটাও খুবই সাধারণ দড়ি। একটু মোটা এই যা।

উৎসুক দর্শকদের সামনে দিয়ে মটকি ঘোরানো শেষ হতেই সেটাকে নিয়ে রাখা হলো লোকটার সামনে। লোকটা কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে মন্ত্র বা এইজাতীয় কিছু একটা পড়ে মটকিটাকে কিছুক্ষণ ঢেকে রাখল নিজের শরীর দিয়ে, এরপর উঠে এসে নিজের কোমরে ঝোলানো থলের ভেতর থেকে বের করে আনলো বাঁশির মতো দেখতে একটা জিনিস। সাধারণ বাঁশির সঙ্গে ওটার একটা মূল পার্থক্য হলো জিনিসটার দুই পাশ সরু হলেও মাঝখানটা পেটমোটা। জিনিসটাকে বের করে এনে ওটার একটা পাশ মুখে লাগাল লোকটা। একটু পরেই চিকন সুর বেরিয়ে এলো ওটা থেকে। ম্যাকফি ভাবতে লাগল এই তামাশা বাদ দিয়ে আবারো কাজে নামবে কি না…

….হঠাৎই ব্যাপারটা ঘটতে শুরু করল।

মটকির ভেতরে থেকে দড়ির একটা মাথা ওপরের দিকে উঠতে লাগল। সাপ যেভাবে ওই বিশেষ বাঁশির সুরে সুরে মাথা নাড়িয়ে বাক্স কিংবা অন্যকিছুর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে, ঠিক সেভাবেই দড়ির একটা মাথা বেরিয়ে আসতে লাগল মটকির ভেতর থেকে। দড়ির মাথাটা দেখা যাওয়া মাত্রই উপস্থিত জনতার মুখ দিয়ে বিস্ময়ের মৃদু গুঞ্জন বেরিয়ে এলো। সঙ্গে সঙ্গে দুই ছেলের একজন ইশারায় চুপ থাকতে বলল সবাইকে।

ম্যাকফি অবাক হয়ে দেখল সেই একঘেয়ে চিকন সুরে বেজে চলেছে তীক্ষ্ণ বাঁশির মতো আর ঠিক যেন ওটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাথা দোলাতে দোলাতে মটকির ভেতর থেকে মাথা তুলে ধীরে-ধীরে ওপরে উঠে আসছে দড়ি। এই খেলা আগেও দেখেছে ম্যাকফি। তবে সেটা ছিল সাপের খেলা। কিন্তু এই খেলাতে সুরের তালে-তালে মাথা নাড়ছে এক টুকরো নিষ্প্রাণ দড়ি। দর্শকদের ভেতরে আরেক দফা গুঞ্জন বয়ে গেল। কারণ সুরের তালে নড়তে থাকা দড়িটা ধীরে-ধীরে ওপরে উঠে যাচ্ছে। ম্যাকফি মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল ওপর থেকে কোনো ধরনের সুতো দিয়ে বেঁধে টেনে তোলা হচ্ছে কি না ওটাকে, কিন্তু সেরকম কিছু চোখে পড়ল না।

হঠাৎ ম্যাকফির মনে হলো : এভাবে বোকার মতো বাজারে ঘুরে-ঘুরে ঘোড়ার সন্ধান না করে যেখানে হিসেব করে কোষাগারে টাকা জমা দিয়ে ঘোড়াগুলোকে বাজারে ঢোকানো হচ্ছে আগে সেখানে খোঁজ নিলেই তো সন্ধান পাওয়াটা আরো সহজ হতো। ও ঘুরে দাঁড়াতে যাবে, এমন সময় ভিড়ের অন্যপাশে একটা নড়াচড়া চোখে পড়ল।

বেশিরভাগ মানুষই একদৃষ্টিতে খেলার দিকে তাকিয়ে আছে। তেমন কেউই নড়ছে না বললেই চলে। তাই অন্যপাশের লোকটাকে খুবই সহজে চোখে পড়ে গেল ওর। ও তাকাতেই মানুষটাও থেমে গেল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ম্যাকফিও থেমে গেল। মুহূর্তের জন্যে দুজনেই তাকিয়ে রইল একে অপরের দিকে।

ব্যাপার কী, এই ব্যাটাকে চেনা চেনা লাগছে কেন। হঠাৎই ও বুঝতে পারল কোথায় দেখেছে ওকে। আর সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত জনতার করতালিতে চমকে উঠল ও। লোকটার দিক থেকে মনোযোগ হারিয়ে দড়ির খেলার দিকে ফিরে তাকাল ও। নড়তে থাকা দড়িটা এখন সবার মাথা ছাড়িয়ে প্রায় বিশ ফিটের মতো সটান উপরে উঠে গেছে। শক্ত লোহার একটা ডান্ডার মতো সোজা হয়ে থাকা দড়িটা বেয়ে দুই ছেলের একজন উঠতে শুরু করেছে। সেটা দেখেই করতালি আর উচ্ছাসে ফেটে পড়ছে জনতা। ক্ষণিকের জন্যে ওদিকে তাকিয়েই লোকটা যেখানে ছিল সেখানে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনলো ম্যাকফি। লোকটা নেই সেখানে। দৃষ্টি ঘুরিয়েই দেখতে পেল দ্রুতগতিতে পিছিয়ে যেতে শুরু করেছে লোকটা।

ভিড়ের একেবারে সামনে আছে ও। এই ভিড় ঠেলে পেছনে যাবার উপায় প্রায় নেই বললেই চলে। অন্যদিকে লোকটাও দ্রুত সটকে পড়ছে। একে ধরতেই হবে। তাই চট করে সিদ্ধান্ত নিয়েই ও পেছন থেকে সামনে চলে এলো। সামনে আর আশপাশে থাকা দু-চারজনকে ঠেলা ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়ল খেলা দেখানোর চক্রের ভেতরে। সঙ্গে সঙ্গে হই-হই করে উঠল লোকজন। দড়ির বুহ্যের ভেতরে ওর ঢুকে পড়া আর লোকজনে চেঁচামেচিতে খেলা দেখাতে থাকা সেই জোব্বা পরা লোকটার মনোযোগ সরে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই শূন্যে ভেসে থাকা দড়িটার নিয়ন্ত্রণ নষ্ট হয়ে গেল। চিৎকার করে মাটির দিকে পড়তে শুরু করল দড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকা ছেলেটা। ছেলেটা পড়তে শুরু করতেই থেমে গেল ম্যাকফি। মুহূর্তের জন্যে থেমে গিয়ে হাতে বেরিয়ে আসা পিস্তলটা মাটিতে ছুড়ে দিয়ে সামনে লাফ দিল ছেলেটাকে ধরার জন্যে। কিন্তু সামান্য গড়মিল হয়ে গেল ওর হিসেবে। লাফ দেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটাকে ধরে ফেলতে পারলেও নিজের শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুজনেই ছিটকে পড়ল মাটিতে।

যেভাবে মাটিতে পড়েছিল, তাতে দুইহাত আর কোমরের হাড় অন্তত কয়েক জায়গায় ভাঙা উচিত, কিন্তু বালুময় নরম মাটি বাঁচিয়ে দিল দুজনকেই। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে ম্যাকফির মনে হলো নড়তে পারছে না। দম নিয়ে কোনো মতে উঠে বসল ও। প্রথমেই খোঁজ করল পিছু নেওয়া লোকটার। কিন্তু হট্টগোলের ভেতরে প্রথমে খুঁজে পেল না মানুষটাকে। ও ভেবেছিল ঝামেলার সুযোগ নিয়ে পালিয়েছে ব্যাটা কিন্তু অবাক হয়ে দেখল লোকটাও হতভম্ভ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে তাকাতে দেখেই দৌড়াতে শুরু করল সে।

কোনো মতে মাটি থেকে উঠে পিস্তলটা খুঁজলো। আছে, ওর থেকে কয়েক ফিটের ব্যবধানে মাটিতে পড়ে আছে ওটা। যতটা দ্রুত সম্ভব ওটা তুলতে যাবে তার আগেই দৌড়াতে থাকা একজনের পায়ে লেগে সরে গেল খানিকটা তফাতে। আবারো এগিয়ে মাটি থেকে তুলে আনতে যাবে আবারো সরে গেল। অবশেষে ওটাকে মাটি থেকে তুলে ফিরে তাকাল দৌড়ে পালাতে থাকা লোকটার দিকে।

যদিও মাটিতে পড়ে ব্যথা পেয়েছে তবুও দ্রুতই লোকটার দিকে এগোনোর চেষ্টা করল ম্যাকফি। লোকটাও মানুষের দৌড়াদৌড়িতে বেশি দ্রুত এগোতে পারছে না। তবে এখনো লোকটার থেকে বেশ পিছিয়েই আছে ম্যাকফি। একে তো ওর পরনে ইউনিফর্ম, আবার ভারী অস্ত্র বহন করছে ও, তার ওপরে এই এলাকা তার খুব একটা চেনা নেই। সামনে পলায়মান লোকটা যেন উড়ে চলেছে। লোকটা এতটাই মনোযোগের সঙ্গে দৌড়াচ্ছে পেছনেও ফিরে দেখছে না একবারও। ম্যাকফি দৌড়াতে দৌড়াতেই পিস্তলটা গুলি করার জন্যে প্রস্তুত করে ফেলল। দৌড়ানো অবস্থাতেই লোকটা পেছনে তাক করল। লোকটার গায়ে গুলি করার ইচ্ছে নেই বরং একেবারে কান ঘেঁষে গুলি করতে পারলে ভয় পাবে সে। পিস্তল তাক করতে করতেই লোকটা একটা ছোটো টিলার অন্যপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ম্যাকফিও পিছু নিয়ে টিলার ওপরে উঠে থেমে গেল। হাঁটুর ওপরে ভর দিয়ে হাঁপাতে লাগল। বাপরে বাপ, দৌড়াতে জানে বটে, মনে মনে ভাবল সে। কিন্তু ব্যাটা গেল কই। টিলাটার ওপর থেকে আশপাশ পুরোটা দৃশ্যমান কিন্তু একটু আগেও দৌড়ে টিলার ওপরে ওঠা লোকটাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। টিলা থেকে বরাবর সামনে আর বাঁ দিকে খোলা প্রান্তর। সেখানে কারো টিকিও দেখা যাচ্ছে না। কাজেই বাকি রইল ডান দিকে। ডান দিকে একটু জংলা মতো জায়গা আর জংলা টুকুর পরেই টিনের চালা দেওয়া লম্বা একটা ঘরের মতো দেখা যাচ্ছে। লোকটা নিশ্চয়ই ওদিকেই গেছে।

ম্যাকফি একটু দম ফিরে পেতেই দ্রুত পায়ে ওদিকে এগোল। ছোটো একটা বাঁশের ঝাড় আর বাঁশ ঝাড়ের পরেই শুরু হয়েছে টিনের চালা দেওয়া লম্বা ঘর। বাঁশ ঝাড়টা পার হতেই স্কুল ঘরের মতো লম্বা ঘরের প্রান্তে চলে এলো। আওয়াজ শুনে আগেই বুঝতে পেরেছিল তবে ঘরের ভেতরে চোখ পড়তেই একেবারে নিশ্চিত হয়ে গেল, জায়গাটা আসলে আস্তাবল। দৌড়ে পালিয়ে আসা লোকটা আশপাশেই আছে। কারণ আশপাশে এই জায়গাটা ছাড়া লুকানোর মতো আর কোনো জায়গা চোখে পড়ছে না।

ম্যাকফি সাবধানে পিস্তল হাতে ভেতরে প্রবেশ করল। নিশ্চয়ই বাজারের জন্যে নিয়ে আসা ঘোড়াগুলোকে মজুদের জন্যে এখানেই রাখা হয়ে থাকে। কারণ চালার ভেতরে বাঁশ দিয়ে ছোটো ছোটো খোপের মতো বানানো হয়েছে। এক-একটা খোপের ভেতরে ঘোড়াদের থাকার ব্যবস্থা। তবে এই মুহূর্তে ভেতরে তেমন একটা ঘোড়া নেই কারণ বেশিরভাগ ঘোড়া হাটে নিয়ে তোলা হয়েছে। তবে ম্যাকফি একটু অবাক হয়ে খেয়াল করল আস্তাবলটার এক প্রান্তে কয়েকটা ঘোড়া রাখা। খানিকটা কৌতূহল নিয়েই সেদিকে এগিয়ে গেল ও।

ব্রিটিশ আর্মি সাধারণত ভারতের বিশেষ কয়েকটা এলাকার নির্দিষ্ট কিছু ব্যাপারীর কাছ থেকে বিশেষ প্রজাতির ঘোড়া কিনে থাকে। এদের ভেতরে বেশিরভাগ ঘোড়াই হয়ে থাকে মাদ্রাজের আর না হয় দক্ষিণ ভারতের। তাই দূর থেকেও খানিকটা অনুমান করা গেলেও কাছে এসে ও একেবারে নিশ্চিত হয়ে গেল এগুলো কোম্পানির সৈন্যদেরই ঘোড়া। কারণ এদের গায়েও পরিষ্কার কোম্পানির লোগো দেখতে পাচ্ছে। মালিক নিশ্চয়ই কোম্পানির লোগো এখনো নষ্ট করার সময় পায়নি।

ও এতই মনোযোগ দিয়ে ঘোড়া দেখছিল যে এখানে কেন আর কীভাবে এসেছে ভুলেই গেছিল তাই পেছন থেকে এগিয়ে আসা শব্দটাকে গ্রাহ্যের ভেতরে আনেনি। কিন্তু শব্দটা একেবারে কাছে চলে আসার পর যখন চমকে উঠে পেছন ফিরলো ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ও দেখতে পেল অদ্ভুত পোশাক পরা লম্বা এক লোক কিছু একটা ছুড়ে মারলো ওর দিকে। আর সেটা সরাসরি এসে ওর গলাতে পেঁচিয়ে গেল। লোকটা ছুড়ে মারা জিনিসটা ধরে বিশেষ একটা কায়দায় টান মারতেই মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারালো ম্যাকফি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *