প্রথম অংশ : ছন্দপতন
দ্বিতীয় অংশ : মৃত্যুহরণ

সপ্তরিপু – অধ্যায় ২৪

অধ্যায় চব্বিশ – সময় : ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ

তারাটি গ্রাম, মুক্তাগাছা

কামাল শেঠকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে একদল লোক, ব্যাপারটা অনুধাবন করার সঙ্গে সঙ্গে কিছুক্ষণ ম্যাকফির মাথা কাজ করল না। তবে ওর শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।

ম্যাকফি গাছের আড়াল থেকে মাথা সরিয়ে নিলো। দ্রুত ভাবার চেষ্টা করছে। লোকগুলো কারা সেটা ওরা জানে না। আর কামাল শেঠ মানুষটা ওদের শেষ একটা সূত্র হতে পারে। আর এই লোকটা অবশ্যই অনেক কিছু জানে। তা নাহলে তার পেছনে এভাবে সবাই লাগত না। কাজেই একে হাতছাড়া করা যাবে না। লোকগুলো যারাই হোক, প্রয়োজনে তাদের হাত থেকে কামাল শেঠকে উদ্ধার করে হলেও এর সঙ্গে কথা বলতে হবে। তবে সেটা করতে হলে আগে ওদের পিছু নেওয়া দরকার। ম্যাকফি দ্রুত পরিকল্পনা করে ফেলল।

মহাবীর সিং আর জোনাথনকে প্রয়োজন নেই, সবাই মিলে পিছু নিতে গেলে হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা যেমন থাকে ঠিক তেমনি অন্যপক্ষ টের পেয়ে যাবার সম্ভবনাও বেড়ে যায়। অন্যদিকে এদের পিছু নিতে গেলে নানা বিপদ হতে পারে। সেইসঙ্গে পানু ছেলেটাকে এই বিপদে টেনে নিয়ে লাভ নেই। তবে শংকরকে ওর দরকার। একে তো এই এলাকা ও চেনে না, অন্যদিকে বাংলা মোটামুটি পারলেও এই এলাকার স্থানীয় অনেকের ভাষাও বুঝতে পারবে না। কাজেই দ্রুত ও শংকরকে বলে দিল কী করতে হবে। পানুকে বলল মহাবীর সিং আর জোনাথনের কাছে গিয়ে সব জানিয়ে অপেক্ষা করতে। যেদিকে লোকগুলো গেছে সেদিকে শংকরকে নিয়ে রওনা দিল ও।

খেতের আইল ধরে দ্রুত পা চালালো ওরা। লোকগুলো এই সময়ের ভেতরে নিশ্চয়ই খানিকটা এগিয়ে গেছে তাই প্রায় দৌড়াতে লাগল ওরা।

সমস্যা হলো, ম্যাকফি পরে আছে লাল কোট আর সাদা ব্রিচেস। অন্যদিকে শংকরের পরনে কালো জামা আর সাদা ধুতি। মাথায় ছাই রঙের পাগড়ি। এই পোশাকে সহজেই অন্ধকারে চোখে পড়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু করার নেই। বরং ওরা আরো জোরে পা চালানোর চেষ্টা করতে লাগল। আরেকটু এগোতেই দেখতে পেল লোকগুলো একটা ছোটো বাঁশঝাড়ের মতো জায়গা পার হয়ে খালের পাড়ে গিয়ে নামল।

এবার চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল দলে ওরা পাঁচজন। দলনেতা বাদে প্রত্যেকের পরনে সাদা ধুতি, লাল পাগড়ি আর গায়ে হাতা কাটা জামা। প্রত্যেকের হাতেই লম্বা-লম্বা লাঠি। এই মুহূর্তে দুজনেই কামাল শেঠকে ধরে একরকম শূনে তুলে নিয়ে হাঁটছে। পুরো দলটার কারোরই অন্য কোনো দিকে নজর নেই। শক্তিশালী পায়ে দ্রুত হাঁটছে সামনের দিকে। দেখেই বোঝা যায় অন্ধকারে হাঁটতে তাদের বিন্দুমাত্র সমস্যা হচ্ছে না। তারমানে ওরা এই এলাকারই লোক। বাঁশঝাড় পার হয়ে ওরা খালপাড়ের দিকে এগোচ্ছে।

খালপাড়ে গিয়ে একটু থামলো ওরা। কারণ খালের ওপরে চিকন বাঁশের সাঁকো দেওয়া। একজন একজন করে পার হতে হবে। প্রথমেই দলনেতা চলে গেল অন্যপাড়ে। এরপর একজন সাদা ধুতি গেল, তারপর কামাল শেঠ, তারপর আরেকজন…এভাবে রওনা দিল ওরা।

ম্যাকফিরা বাঁশঝাড়ের ভেতরেই বসে রইল। দলের সামনের লোকরা পার হচ্ছে নেতাগোছের লোকটা পেছন ফিরে চাইল হঠাৎ করে। ম্যাকফি মটকা মেরে বাঁশ ঝাড়ের ভেতরেই বসে রইল। ব্যাপার কী? লোকটা দেখে ফেলল নাকি ওদেরকে। লোকটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে বাঁশঝাড়ের দিকে। হঠাৎ ঝপাৎ করে শব্দ ভেসে এলো সামনে থেকে। সেই সঙ্গে শোনা গেল চিৎকার। নেতা লোকটা তো বটেই ওরাও দূর থেকে দেখতে পেল কামাল শেঠ তার বিশাল দেহ নিয়ে পালানোর জন্যে সাঁকো থেকে পানিতে লাফ দিয়েছে। এটা দেখে দলের একজন দৌড়ে গিয়ে লাফিয়ে পড়ল পানিতে।

‘হুজুর, এরা তো মনে অয় তালুকদারগো লাঠিয়াল, শংকর হঠাৎ চাপা স্বরে বলে উঠল।

‘এরা আবার কারা?’ ম্যাকফি ফিসফিস করেই জানতে চাইল।

‘হুজুর, এরা…’ শংকর কথা শেষ করার আগেই দেখতে পেল কামাল শেঠকে ঘাড়ে ধরে পানি থেকে টেনে তুলছে নেতাগোছের সেই লম্বা লোকটা। কামাল শেঠকে টেনে তুলেই ওরা আবারো হাঁটতে লাগল। ম্যাকফি আর শংকর খাল পাড়ের কাছে এসে মাটিতে শুয়ে পড়ল। লোকগুলো দূরে সরেনা যাওয়া পর্যন্ত খাল পার হওয়া সম্ভব না। কারণ এটা পার হবার একমাত্র উপায় সাঁকোটা। আর সাঁকো দিয়ে পার হতে গেলে অনেক দূরে থেকে চোখে পড়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। ওরা খালপাড়ের কাদাযুক্ত মাটিতেই পড়ে রইল। লোকগুলো বেশ দূরে সরে গেলে উঠে পড়ল সাঁকোর ওপরে। সাঁকো পার হয়ে খালের অন্যপাড়ে এসে প্রায় দৌড়াতে লাগল দুজনে। লোকগুলোর ছায়াও দেখা যাচ্ছে না। বেশ অনেকটা পথ দৌড়ে প্রায় চলে এলো জঙ্গল মতো একটা জায়গার প্রান্তে।

হাঁপাতে হাঁপাতে ম্যাকফি শংকরকে প্রশ্ন করল, ‘হারিয়ে ফেললাম নাকি ওদের?’

শংকর কিছু না বলে আশপাশে দেখতে লাগল। ‘হুজুর, এই জঙ্গল ছাড়া তো আশপাশে আর কুথাও দেখতে বাকি রাহি নাই।’

‘এখানেই ঢুকতে হবে। আমার মনে হয় ওরা এদিক দিয়েই গেছে,’ ম্যাকফি এখনো হাপাচ্ছে।

‘সর্বনাশ! হুজুর, কী কন! এইহান থাইক্কা মধুপুরের গড় শুরু। রাইতের বেলা ঘরের ভেতরে ঢুকতে নাই। অমঙ্গল হয়,’ এই অন্ধকারে ভয় পাওয়ায় শংকরের চেহারা আরো সাদা দেখাচ্ছে।

‘এই লোকগুলোকে হারালে আমাদের আরো বেশি অমঙ্গল হবে। চলো,’ বলেই পিস্তলটা আবারো বের করে বনের ভেতরে ঢুকে পড়ল ম্যাকফি। ওকে বেশ দূরে রেখে অনুসরণ করছে শংকর। ওরা জঙ্গলে প্রবেশ করে বেশ অনেকটা এগিয়ে এসেছে কিন্তু এখনো লোকগুলোর ছায়াও দেখা যাচ্ছে না। আরেকটু এগোলেই জঙ্গলের ফাঁকে একটা জায়গায় আরো কিছু মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। রীতিমতো একটা জটলা দেখা যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে শংকরকে চেপে ধরে একটা ঝোপের ভেতরে ঢুকে পড়ল ম্যাকফি। খালপাড়ের কাদামাটিতে শুয়ে থেকে একটা উপকার হয়েছে কাদা লেগে ওদের পোশাক বেশ ময়লা হয়ে গেছে। এখন অন্ধকারে আর সহজে চোখ পড়বে না। এখান থেকে ফাঁকা জায়গাটা চোখে পড়ছে।

ঝোপের ফাঁকে সেখানে আরো বেশ কয়েকজন লাঠিয়ালকে দেখতে পেল ওরা। সেই সঙ্গে কামাল শেঠকে বয়ে আনা সেই কজন। ওদের ঠিক সামনেই মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে আছে শেঠ।

‘তালুকদাররাই, আমি ঠিকি কইছিলাম। হুজুর এগোরে পুরা এলাকার সবাই লাল পাগড়ি বাহিনী নামে চেনে।’

‘ওরা কারো জন্যে অপেক্ষা করছে,’ ম্যাকফি আনমনেই বলে উঠল।

একটু পরেই চারজন শক্তিশালী মানুষ একটা পালকি বহন করে নিয়ে নামিয়ে রাখল ফাঁকা জায়গাটায়। পালকির ভেতর থেকে নেমে এলো মুখ ঢাকা হালকা- পাতলা একটা অবয়ব। মানুষটা নেমে এসে কামাল শেঠের সামনে দাঁড়াতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল শেঠ। কিন্তু মানুষটার তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে একটা হাত তুলে কী জানি বলল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শান্ত হয়ে এলো শেঠ।

মুখ থেকে আবরণ সরালো মানুষটা।

সঙ্গে সঙ্গে পাশ থেকে বিস্ময়ধ্বনি শুনতে পেল ম্যাকফি।

‘বেগম সাহেবা!’ শংকর ফিসফিস করে বলে উঠল। ম্যাকফি মুখ ফিরিয়ে সেদিকে তাকিয়ে প্রথমেই দেখতে পেল কপালে বড়ো একটা তিলক। তিলকের দুইপাশে অনিন্দ্য সুন্দর বড়ো বড়ো দুটো চোখ। ‘একজন মহিলা!’ আপন মনেই বলে উঠল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *