প্রথম অংশ : ছন্দপতন
দ্বিতীয় অংশ : মৃত্যুহরণ

সপ্তরিপু – অধ্যায় ২৬

অধ্যায় ছাব্বিশ – বর্তমান সময়

বাউন্ডারি রোড, ময়মনসিংহ

পরিস্থিতি হঠাৎ বিপজ্জনকরূপ নিলেও বাশার মাথা ঠান্ডা রাখল। রিফাত মজুমদার একজন মহিলা এটা জানার সঙ্গে সঙ্গে এতক্ষণের অস্বস্তিটা ধরতে পারল বাশার। লোকটার দেরি করে দরজা খোলা, হাঁপাতে থাকা, জুতো পায়ে কার্পেটের ওপরে হাঁটা, সোফার ওপরে ভাজ করে রাখা জিন্সের শার্ট…শিট এই তো সেই লোক আজ সকালে যার সঙ্গে ওর হোটেলের গেটে ধাক্কা লেগেছিল, একারণেই চেনা চেনা লাগছিল। সেই জিন্সের শার্টটাই ভাঁজ করে রাখা ছিল সোফার হাতলে। চট করে এক হাতে ও নিজের পিস্তলটা বের করে আনলো।

তবে তার আগেই ভেতরের রুম থেকে ভেসে এলো তীব্র আর্তনাদ।

ভেতরের কামরা থেকে আর্তনাদ ভেসে আসতেই জয়া সেদিকে দৌড় দিতে চাইলেও চট করে আঙুলের ইশারায় তাকে থামতে বলল বাশার। পিস্তলটা তুলে ধরল সামনের দিকে। জয়াকে ওর পেছনে থাকতে বলে পিস্তল বাগিয়ে ধরে সামনের দিকে এগোল। অন্যপাশের কামরা থেকে এখনো হুটোপুটির শব্দ ভেসে আসছে। ড্রইং রুম পার হয়ে চলে এলো পাশের লাগোয়া ডাইনিং রুমে। এখানে এটা-ওটা উলটে আছে কিন্তু কেউ নেই। ধস্তাধস্তির শব্দ এখন আরো বেড়েছে।

‘কী ব্যাপার, কেউ তো…’ জয়া কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই বাশার কড়া চোখে তার দিকে তাকিয়ে চুপ থাকতে বলল। ডাইনিং রুমের সঙ্গেই একটা ছোটো দরজা দেখতে পাচ্ছে। ওটা সম্ভবত রান্নাঘরের, ওদিকে না এগিয়ে অন্যপাশে এগোল ওরা। বড়ো একটা দরজা আছে ওখানে। ওদিক থেকেই ভেসে আসছে আওয়াজ। পিস্তলটা আরেকটু ওপরে তুলে ধরে ওদিকেই এগোল। কাছাকাছি পৌঁছে গেছে এমন সময় ঝড়ের বেগে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো কেউ একজন। পিস্তলের ট্রিগারে বাশারের আঙুল চেপে বসেছিল, কোনোমতে নিজেকে সামলে নিলো। কারণ দরজা দিয়ে যে বেরিয়ে এসেছে সে একজন মহিলা। আলুথালু বেশের মহিলা একেবারে উড়ে এসে পড়ল বাশারের ওপরে। কোনোমতো তাকে ধরতেই জয়া এসে সাহায্য করল। মহিলার মুখ বাঁধা, দুই হাত পেছনে বাঁধা। চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেছে ভয়ে। জয়া তাকে ধরে প্রথমেই মুখের বাঁধনটা আলগা করে দিল।

‘ওদিকে, ওই রুমে লোকটা…’ মহিলা কথা শেষ করার আগেই ধাম করে একটা শব্দ হলো তারপর কিছু একটা ভেঙে পড়ার শব্দ পাওয়া গেল। ‘একে সামলাও,’ বলে ও মহিলাকে জয়ার জিম্মায় রেখে পিস্তল তুলে প্রবেশ করল রুমের ভেতরে। অবশ্যই এটা একটা বেডরুম। আগে সম্ভবত বেশ শৌখিনভাবে সাজানো ছিল কিন্তু এই মুহূর্তে একেবারে যা-তা অবস্থা। তবে রুমের ভেতরে কাউকেই দেখতে পেল না ও।

অন্যপাশের পর্দার পেছনেই একটা দরজা দেখে সেদিকে এগোল। দরজাটার একটা পাল্লা আলগা হয়ে আছে। পিস্তলটা এক হাতে ধরে দরজার আলগা পালটা ঠেলে পেছনের লনে বেরিয়ে এলো সে। বাইরে এসে একরকম বোকা বনে গেল।

কেউ নেই।

পিস্তলটাকে সামনের দিকে ধরে রেখেই শরীরটা একশ আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে পুরো লনটাতে কাউকেই দেখতে পেল না ও। মনে মনে হিসেব কষে দেখল দরজা ভাঙার যে শব্দ ও শুনেছে সেই সময়ে কেউ বেরিয়ে এলে এত দ্রুত পালাতে পারার কথা নয়। মনে মনে শিউরে উঠল ও তার মানে দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসা লোকটা এখানেই আছে এখনো।

ভাবনা শেষ করতে পারার আগেই ও আরেক পা এগিয়ে এসেছিল, দেওয়ালের সঙ্গে ঝুলন্ত আইভি লতার ঝাড়ের আড়াল থেকে একটা হাত বেরিয়ে এসে জাপটে ধরল ওকে। অন্য হাতে থাবা মেরে ফেলে দিল ওর হাতের পিস্তলটা। নিজেকে সামলানোর আগেই ওকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে পড়ে গেল লোকটা। পেছন থেকে আইভি লতা দিয়ে ওর গলা পেঁচিয়ে ধরেছে। প্রচণ্ড টানে বাশারের মনে হল ওর গলা ছিঁড়েই যাবে। মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থাতেই লোকটাকে হাঁটুতে মারার চেষ্টা করল ও কিন্তু জোর হলো না বরং আরো জোরে চেপে বসল আইভি লতার দঙ্গল। বাশার বুঝতে পারছে এভাবে কাজ হবে না।

ওর থেকে দুই হাত দূরে পড়ে থাকতে দেখল নিজের পিস্তলটা। ওটার জন্যে হাত বাড়াতেই লোকটা ওকে ছেড়ে দিয়ে মাটিতে একটা গড়ান দিয়ে পিস্তলটার দিকে এগিয়ে গেল। মরিয়া হয়ে উঠল বাশার, ইতিমধ্যেই লোকটা বাশারের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে গেছে পিস্তলটার দিকে। লোকটা আরেক গড়ান দিয়েই পিস্তলটা ধরে উঠে দাঁড়াল। ও মাটিতে আধা বসা অবস্থাতেই লাফ দিল লোকটার হাঁটু লক্ষ্য করে। পিস্তল হাতে ঠিকমতো সোজা হবার আগেই বাশারের কাঁধ গিয়ে বাড়ি মারলো লোকটার হাঁটুতে। তীব্র ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে সটান উলটো হয়ে মাটিতে পড়ে গেল সে। পিস্তলটা উড়ে গিয়ে পড়ল অন্যপাশে। লোকটাকে না ধরে পিস্তলটার দিকে ডাইভ দিল বাশার। ওটা হাতে ধরার আগেই ভেসে এলো গুলির শব্দ।

বাশার অনুভব করল গুলিটা ওর কানের পাশ দিয়ে হুঁশ করে বেরিয়ে গেল। সর্বনাশ, লোকটার কাছেও পিস্তল আছে! সোজা না হয়ে আবারো মাটিতে গড়িয়ে পড়ে গেল ও। আরো দুটো গড়ান দিয়ে চলে এলো একটা ওয়ার্ক বেঞ্চের আড়ালে। ওটার ওপরে নানা ধরনের বাগান করার যন্ত্রপাতি সাজানো। বেঞ্চটা নিয়ে অন্যদিকে উলটে পড়ল ও। আর কোনো গুলির শব্দ ভেসে আসছে না দেখে আড়াল থেকে উঁকি দিল। গুলি করবে কী, লোকটা চড়ে বসেছে দেওয়ালের ওপরে। বাশার বসা থেকে সোজা হয়ে নিজের পিস্তল তুললো। লোকটা দেওয়ালের ওপরে চড়ে বসেছে। গুলি করবে কী করবে না সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই লোকটা দেওয়ালের অন্যপাশে আড়াল হয়ে গেল।

প্রাণপণে দৌড় দিল বাশার। ও নিজেও একই পথে নেমে এলো অন্যপাশের রাস্তায়। লোকটা এখন প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। বাশার রাস্তায় নেমে দেখতে পেল বাঁক ঘুরে দেওয়ালের আড়ালে চলে গেল সে। বাশারও সেদিকেই দৌড় দিল। একহাতে পিস্তল সামলে অন্যহাতে বের করে আনলো ওয়াকিটকিটা। আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগাকে সাবধান করে দিয়ে দৌড়ে চলে এলো বাঁকের অন্যপাশে। মূল রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে। আবদুল্লাহ আর ও রমিজ দারোগাকেও দেখতে পেল, কিন্তু লোকটা নেই।

দুজনের উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে করতে দৌড়ে এগোল ও। জিপের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে এমন সময় ওকে ছুটে আসতে দেখে উলটোদিক থেকে আবদুল্লাহও দৌড়ে এলো। ‘এখান দিয়ে কাউকে দৌড়ে পালাতে দেখেছো?’ হাঁপাতে হাঁপাতে প্রশ্ন করল বাশার। আবদুল্লাহ কাছাকাছি এসে থেমে গেছিল হঠাৎ সে চট করে বাশারকে জড়িয়ে ধরে রাস্তার একপাশে টেনে নিয়ে এলো। দুজনেই পড়ে গেল মাটিতে। ওদের পাশ করে হুঁশ করে বেরিয়ে গেল একটা সাদা গাড়ি। ওরা উঠে দাঁড়ানোর আগেই বাঁক ঘুরে গায়েব হয়ে গেল ওটা।

‘স্যার স্যার,’ রমিজ দারোগা তার বিশাল ভুঁড়ি নিয়ে দৌড়ে আসছে। দুজনকেই ধরে দাঁড় করিয়ে দিল সে। গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে গাল বকে উঠল বাশার, ‘ধুর, বাল।’ মাটিতে পড়ে কনুই ছিলে গেছে। কপালের একপাশ দপদপ করছে ব্যথায়।

‘স্যার, ঘটনা কী?’ আবদুল্লাহ ঠিক-ঠাক হয়ে এখন সাহায্য করছে বাশারকে। ‘থাক, ঠিক আছে,’ বলে ও টকিতে সাদা গাড়ির ব্যাপারটা ইনফর্ম করে অ্যালার্ট জারি করে দিতে বলল। ‘কী হয়েছে পরে বলছি। তোমরা বাড়ির সামনে পাহারায় থাকো। আমি দেখি ভেতরের পরিস্থিতি কী,’ বলেই ও আর অপেক্ষা না করে বাড়ির ভেতরের দিকে রওনা দিল। ড্রইং রুম এখনো ফাঁকা, কেউ নেই। ও ভেতরের রুমে চলে এলো। জয়া আর ওই মহিলা ডায়নিং রুমে বসে আছে।

এই বিপজ্জনক আর বিরক্তিকর পরিস্থিতিও না চাইতেও বাশারের চোখ আনমনেই চলে গেল মহিলার দিকে। জোর করে চোখ সরিয়ে নেওয়ার আগে মুহূর্তের জন্যে ওর পুরুষ দৃষ্টি আটকে রইল ওদিকে। এরকম পরিস্থিতিতেও মনে মনে মহিলার সৌষ্ঠবের প্রশংসা না করে পারল না ও। বিধ্বস্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে মনের ভেতরের প্রশংসার পারদটা আরেক ডিগ্রি চড়ে গেল।

‘কী ব্যাপার, কী হলো? লোকটাকে ধরতে পেরেছো?’ জয়া একবার কাঁধ ঝাকিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে জানতে চাইল।

‘পালিয়েছে,’ একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল বাশার।

‘আপনারা?’ বলে মহিলা হাতে ধরা গ্লাসটা নামিয়ে রাখল। বাশার লক্ষ্য করল তার হাত কাঁপছে। ‘আপনারা কারা? এসব কী হচ্ছে? ওই লোকটা ওই লোকটা আরেকটু হলে মনে হয় আমাকে মেরেই ফেলতো!’ আতঙ্কে শিউরে উঠল সে।

‘শান্ত হোন প্লিজ, সব ঠিক হয়ে যাবে,’ কথাটা বলে বাশার নিজেকে মনে মনে গালি দিল। এরকম সিনেমার ডায়লগের মতো কথা শুনতেও কেমন জানি হাস্যকর শোনায়।

ঠিক তো পরে হবে, আগে আমাকে বুঝতে হবে হচ্ছেটা কী? একটা ব্যক্তিগত কারণে আজ অফিস যাইনি। বাসায় বসে কাজ করছিলাম। কথা নেই, বার্তা নেই একজন লোক এসে আমাকে বন্দি করতে চাইল। এরপরে আপনারা আবার এসে উদ্ধার করলেন। কিন্তু কেন হচ্ছে এসব?’ আতঙ্কে মনে হচ্ছে মহিলার দুই চোখ বেরিয়ে আসবে। বাশার জানে জীবনে যারা মৃত্যু আতঙ্ক প্রত্যক্ষ করেছে। একমাত্র তারাই এই অভিজ্ঞতার তিক্ততা অনুধাবন করতে পারবে।

‘প্লিজ, শান্ত হোন। বাইরে আমার দুজন ডেপুটি আছে। আর তাছাড়া কিছুক্ষণের ভেতরেই আমাদের ফোর্স চলে আসবে। কাজেই যা হবার হয়েছে আর কোনো ভয় নেই,’ বাশার জয়ার দিকে তাকিয়ে ইশারা করল কিছু বলতে। ‘তুমি বলো।’

কিন্তু জয়া কিছু বলার আগেই মহিলা ঝামটে উঠল, ‘টু হেল উইথ পুলিশ! হচ্ছেটা কী আমাকে সেইটা বলেন আগে।’ বাশারের রাগ না হয়ে বরং ও স্বস্তি বোধ করল যাক তাহলে মহিলা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে।

‘আপনিই কি রিফাত মজুমদার? জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালার উপ- পরিচালক?’

‘জি, আবশ্যই। আমিই রিফাত,’ মহিলার জবাব শুনে বাশারের দিকে তাকিয়ে জয়া মাথা নাড়ল।

‘আজ থেকে এগারো বছর আগে আপনি ময়মনসিংহ মিউজিয়ামের কেয়ারটেকার ছিলেন?’ এবারের প্রশ্নটা বাশারের।

‘অহ, প্লিজ বলবেন না এই ঘটনার সঙ্গে বিশ্রী ঘটনাটার সম্পৃক্ততা আছে,’ মহিলাকে দেখে মনে হচ্ছে তার মাথা ব্যথা করছে। আঙুল দিয়ে চেপে ধরেছে কপালের দুই পাশ। ‘আমি ওই বাজে ব্যাপারটা স্বপ্নেও আর মনে করতে চাই না।’

‘কিন্তু আপনাকে মনে করতে হবে। কারণ ইতিমধ্যে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। আর বলতে গেলে আপনার ওপরে হামলা হবার কারণও ওই ঘটনা। মূলত ওই ঘটনার সূত্র ধরেই আমরা আপনার কাছে এসেছিলাম কথা বলতে। আসার পর তো এই ব্যাপারটা ঘটে গেল।’

‘বলেন কী! এতবছর পরে আবার এসব কী শুরু হয়েছে? আমি আমি, ধুর। এই শহরে আবার ফেরত আসাটাই আমার উচিত হয়নি,’ মহিলা হাতের উলটো পিঠ দিয়ে কপালের ওপর থেকে একগোছা এলোমেলো চুল সরালো। আর বাশার তার ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। কিছুকিছু সৌন্দর্য আছে হঠাৎ সহ্য করা যায় না। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হয় চোখ জ্বালা করে, মাথার ভেতরে নেশা নেশা লাগে। মহিলার ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জয়ার দিকে তাকাল ও। সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করল প্রকৃতির কী বিচিত্র বৈষম্য তার সৃষ্টির প্রতি!

‘শুনুন, এখন এসব বলে কোনো লাভ নেই। আগে আপনি বলুন এখানে কী ঘটেছিল, এরপর আমরা বলছি এত পুরনো ঘটনা নিয়ে কেন আমরা এখানে এসেছি,’ বলে জয়া বাশারের দিকে তাকাল। ওর উদ্দেশ্যে একবার সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বাশার দুজনার দিকে থেকেই চোখ সরিয়ে টকিতে কথা বলতে লাগল।

‘এক মিনিট, আসছি,’ বলে মহিলা চলে গেল শোবার ঘরের দিকে।

টকিতে বাশারের কথা শেষ করে ও জয়ার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘কি মনে হয়, রিফাত নামের এই মহিলা কিছু বলতে পারবে?’ ওর দিকে না তাকিয়েই জয়া জবাব দিল। ‘আমার ধারণা ওর কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে তা না হলে তার ওপরে আক্রমণ হতো না। যদিও আসলে মহিলার ওপরে এভাবে আক্রমণ নিয়ে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। তবে…’

জয়ার কথা শেষ হবার আগেই মহিলা চলে এলো। গায়ে একটা ওড়না পেঁচিয়ে, মুখ মুছে পরিচ্ছন্ন হয়ে এসেছে। বাশারের মনে হলো পরিচ্ছন্ন না হলেই ভালো ছিল। এবার চাইলেও আর চোখ সরাতে পারছে না ও।

‘আপনি কি এখানে একাই থাকেন?’ জয়া জানতে চাইল

‘না, আমার মা আর ছোটো ভাই ঢাকা গেছে একটা কাজে। আর ছুটা বুয়া আছে। সে তো আজকের মতো কাজ সেরে চলে গেছে তবে কল দিলে আবারো আসবে। আচ্ছা ঘরদোর এভাবে…আর শোবার ঘরের দরজাটা?’

রিফাত প্রশ্ন করার আগেই আবার জবাব দিল বাশার, ‘প্লিজ, কিছুই করতে হবে না। আমি থানায় খবর পাঠিয়েছি ওখান থেকে লোক আসছে ওরা আসার আগে কিছুই করা যাবে না। পরে আমি ব্যবস্থা করব,’ ওর শেষ কথাটা শুনে জয়া চোখ তুলে তাকাল ওর দিকে। কড়া দৃষ্টি ফিরিয়ে দিল বাশার।

‘আমরা কি বাইরে বসতে পারি? বাসার পেছনে বসার জায়গা আছে।’

‘চলুন প্লিজ।’

ওরা তিনজনে মিলে বাড়ির পেছনের লনের মতো জায়গাটায় চলে এলো। সেখানে একপাশে ছোটো বাগানের মাঝখানে একটা টেবিলকে ঘিরে কয়েকটা চেয়ার পাতা। ওখানে এসে বসল ওরা। আবারো টকিতে আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগাকে অ্যালার্ট থাকতে বলে চেয়ারে বসতে বসতে একটু আগে যেখানে ধস্তাধস্তি হয়েছিল সেদিকে দৃষ্টি চলে গেল বাশারের। লোকটা কি সত্যিই গুলিটা মিস করেছিল? নাকি ইচ্ছে করেই সতর্ক করার জন্যে কানের পাশ দিয়ে গুলি করেছে? তবে লোকটা ওকে মারতে চায়নি এটা নিশ্চিত। কারণ তাহলে প্রথমেই আইভি লতা দিয়ে পেঁচিয়ে না ধরে সোজা গুলি করত। আনমনেই শিউরে উঠল ও।

‘এবার বলুন, কী ঘটেছিল এখানে। লোকটা ভেতরে ঢুকলো কীভাবে?’ বাশার প্রশ্ন করার আগেই জয়া বলে উঠল। ‘বাই দ্য ওয়ে, আমি জয়া সরকার, ফ্রিল্যান্স রিপোর্টার। আর ইনি ইন্সপেক্টর বাশার। ইনিই সেই পুরনো ডাকাতির কেসটা তদন্ত করছেন। সেটা কী ও কেন পরে বলছি। আগে বলুন এখানে কী ঘটেছে?’

‘আমি সম্প্রতি একটা আন্তর্জাতিক একাডেমিক কনফারেন্সে যাবার জন্যে আবেদন করেছি। সেটার পেপার জমা দেওয়ার আজকেই শেষ তারিখ। তাই পরিবারের সবাই ঢাকা যাবার পরেও আমি যাইনি। অফিস থেকে ছুটিও নিয়েছি একারণেই। আমি কাজ করছিলাম হঠাৎ বাইরে কলিংবেলের আওয়াজ। দেখি এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। সে জানাল অফিস থেকে জরুরি কী ফাইল নিয়ে এসেছে, ওটাতে সই করতে হবে। এখানেই আমি ভুল করি। ক্রস চেক না করেই দরজা খুলে দিতেই সে আমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মনে হয় আসার আগেই সে খেয়াল করেছে বাড়িতে কেউ নেই। দরজা খুলতেই সে আমার মুখের ওপরে একটা শার্ট ছুঁড়ে মারে। সেটা সরাতেই দেখি আমার মাথার পাশে চেপে ধরে পিস্তল। আমি চুপ হয়ে যাই।

‘ভেতরের রুমে নিয়ে প্রথমেই আমার হাত আর মুখ বেঁধে ফেলে আমার কাছে জানতে চায় পেছনের দরজাটা কোনদিকে। আমি এমন ভয় পেয়েছি কিছুই না বুঝে ইশারায় দেখিয়ে দেই। সেটা তালা মারা দেখে চাবি কোথায় জানতে চায় আমি আলমারি দেখিয়ে দেই। এমন সময় কলিংবেলের শব্দ হয় লোকটা দৌড়ে বেরিয়ে যায় বেডরুম থেকে। একটু পরেই আমি অন্য রুমে মানুষের গলার আওয়াজ পাই সঙ্গে সঙ্গে জোরাজুরি শুরু করি। করতে করতে চেয়ারটা উলটে হাতল ভেঙে অনেকটাই মুক্ত হয়ে যাই। জোরাজুরি করে প্রায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছি এমন সময় লোকটা রুমে প্রবেশ করে। আমি কিছু না ভেবেই জোরে এক লাথি মারি তার কোমরে, কিন্তু ঠিকমতো লাগেনি সেটা। সে জাপটে ধরতে চায় আমাকে। কোনোমতে পেছনে ঠেলে দিয়েই দৌড় দেই অন্য রুমের দিকে। তারপর তো আপনারা জানেনই।’

বুঝতে পেরেছি। লোকটা মনে হয় আপনাকে নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বেরুনোর পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু আমরা চলে আসাতে সে হঠাৎ ঘাবড়ে গিয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে আপনারই নাম নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়ে যায়,’ জয়া বলে উঠল বাশারের দিকে তাকিয়ে। বাশার একটু অবাক হলো তার বিশ্লেষণের ক্ষমতা দেখে। ও মনে মনে ভাবল মেয়েটা দেখতে খারাপ হতে পারে কিন্তু গুণ আছে।

‘কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম না, লোকটা ঠিক আমরা আসার আগেই কেন এখানে এলো।’ আর…জয়ার কথার পিঠে বাশার বলে উঠল। হ্যাঁ, আরো একটা ব্যাপার আমার কাছে পরিষ্কার না…

‘হ্যালো, আপনারা কি এভাবেই ইশারায় কথা বলবেন আমাকে ধোঁয়াশার মধ্যে রেখে নাকি এখন বলবেন আসলে কী ঘটেছিল, আর কেনই বা আপনারা এখানে। আর ওই লোকটাই বা কীভাবে আমার এখানে এসে হাজির হলো?’ রিফাতের চোখে কৌতূহলের পাশাপাশি বিরক্তি।

বাশারের টকি খরখর করে উঠল। ‘মনে হয় টিম এসে গেছে। জয়া, তুমি ওনাকে সব বলো। আমি ওদেরকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আসছি,’ বলে ও উঠে গিয়ে দেখল ক্রাইম সিন ইউনিট চলে এসেছে। ওদেরকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে ফিরে এসে দেখল জয়া কাহিনি বলে চলেছে। ওর বলা শেষ হলে রিফাত কিছুক্ষণ ঝিম মেরে রইল।

‘সর্বনাশ! আমি পুকুরের নিচ থেকে গাড়ি ওঠানোর খবরটা দেখেছিলাম। কিন্তু সেটা যে ওই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ভুলেও ভাবতে পারিনি। তারচেয়ে বড়ো কথা এই গাড়ি উদ্ধারের ব্যাপারটা তো এতদিনের সব থিয়োরি উলটে দিল। আমি তো জানতাম বিজয় আচার্য আর ডেভিড মিলে এই ডাকাতিটা করেছে। ফেঁসেছিলাম আমি, আর শেষ পর্যন্ত বিজয় তো মারা গেল; আর ডেভিড মূর্তিটা নিয়ে পালাল। কিন্তু এখন তো দেখছি ঘটনা পুরো উলটে গেছে। বিজয় মরলো গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে, ডেভিড মরলো পানিতে পড়ে,’ বলে ও চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইল। ‘তবে…তবে চুরি হওয়া মূর্তিটা গেল কোথায়?’

‘রিফাত, আমি কি আপনাকে রিফাত ডাকতে পারি?’ প্রশ্নটা করলেও জবাবের অপেক্ষা করল না বাশার। বরং রিফাতের দিকে একটু এগিয়ে বলে উঠল, ‘আসলেও ওই সময়ে কী ঘটেছিল সেটা আপনি আমাদেরকে জানাতে পারবেন। আর আমরা আশা করছি আপনি আমাদেরকে এই ব্যাপারে সহায়তা করতে পারবেন,’ বলে মুখ কুঁচকে ফেলল পেটের ব্যথায়। সকাল থেকে না খাওয়া পাকস্থলী এবার তীব্র প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছে। ‘যদি আমরা একসঙ্গে কাজ করি একমাত্র তবেই ব্যাপারটার সুরাহা করা সম্ভব।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *