প্রথম অংশ : ছন্দপতন
দ্বিতীয় অংশ : মৃত্যুহরণ

সপ্তরিপু – অধ্যায় ২৯

অধ্যায় উনত্রিশ – সময় : ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ

কালন্তি বিল এলাকা, মধুপুর

তালুকদার পরিবারের আবাসস্থলের দিকে যেতে যেতে ম্যাকফি আর জোহরাকে নিজের গল্প বলল হেনরি স্লিম্যান। সেই সঙ্গে ঠগীদের সঙ্গে তার সংঘর্ষের গল্পও।

ইংল্যান্ডের ব্র্যাডফোর্ডশায়ারের বিখ্যাত মিলিটারি পরিবারগুলোর একটিতে জন্ম উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যানের। বাবা ফিলিপ স্লিম্যান ছিলেন সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন। আট ভাইবোনের ভেতরে হেনরি ছিল ফিলিপ স্লিম্যানের পঞ্চম সন্তান। হেনরির সব ভাই-ই ছিল মিলিটারিতে। তিনজন সেনাবাহিনী আর একজন নৌবাহিনীতে। তাই ছোট্ট হেনরি শৈশবেই মনে মনে স্থির করে ফেলে সে একদিন সৈনিক হবে। তবে এই উদ্দেশ্যের পেছনে আরো বেশি মদদ যোগান হেনরির বাবা।

অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারি বাপের মুখে বিচিত্র সব জায়গার বর্ণনা শুনে ছোট্ট হেনরির মনের গহিনে জেগে ওঠে মানুষকে দেখবার জানবার আর ঘুরে বেড়াবার এক অদ্ভুত শখ। সদ্য শৈশব থেকে কৈশোরে পা রাখা হেনরি সেই কিশোর বয়সেই ঠিক করে ফেলে সে সৈনিক হবে। আর সে তার সৈনিক জীবন কাটাবে স্বপ্নের দেশ ভারতবর্ষে।

তখনকার দিনে যেকোনো উচ্চাবিলাসী ইংরেজ তরুণের পক্ষে এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কারণ ইংরেজদের জন্যে ভারতবর্ষ তখন সত্যিই স্বপ্নের দেশ। হেনরি যখন ভারতবর্ষে যাবার পরিকল্পনা আঁটছে মনে মনে তার কিছুদিন আগেই শীরঙ্গপত্তমের যুদ্ধ হয়ে গেছে। ফলে ভারতবর্ষে কোম্পানি শাসন তখন সবেমাত্র স্থায়ী চেহারা নিতে শুরু করেছে। ধন-সম্পদ, সম্মান-খ্যাতি-রোমাঞ্চ-ভারতবর্ষ তখন যেকোনো অভিযাত্রীর জন্যে স্বর্গরাজ্য। যেকোনো অভিযান প্রিয়, উচ্চাবিলাসী ইংরেজ যুবক তখন ভারতবর্ষ বলতে অজ্ঞান।

তবে এদের ভেতরে হেনরি ছিল একটু ব্যতিক্রম। কারণ সে অন্য ইংরেজ তরুণদের মতো শুধু অর্থবিত্তের জন্যে ভারতবর্ষে ছুটে যাবার জন্যে আগ্রহী ছিল না বরং বিত্ত-খ্যাতির চাইতে তার ভেতরের অভিযান প্রিয় মন তাকে অধিক তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। একারণেই একেবারে সঠিক অর্থে জীবনের লক্ষ্য স্থির করা হেনরি ইল্যান্ডের মাটিতে বসেই শিখে নিচ্ছিল ভারতবর্ষের ভাষা, সংস্কৃতি ইতিহাস। আর তাই যেদিন সে প্রথমবারের মতো ভারতবর্ষের ফোর্ট উইলিয়ামে পা রাখে তার গড়গড় করে বলা স্থানীয় ভাষা শুনে সবাই ভেবেছিল তার জন্ম বুঝি এই ভারতের মাটিতেই। মন্তব্যটা শুনে মনের গহিনে সন্তুষ্টির মুচকি হাসি ফুটে উঠেছিল ইংরেজ সন্তান হেনরি স্লিম্যানের।

ভারতবর্ষে এসে বারাসাতে নিজের শিক্ষানবিশ সময় পার করে পনেরো নম্বর ইনফ্যান্ট্রির সৈনিক হিসেবে যোগ দেয় সে। এই ইনফ্যান্ট্রির সৈনিক হিসেবেই ভারতবর্ষকে আরো ভালোভাবে জানার সুযোগ এসে যায় তার হাতের মুঠোয়। এই ইনফ্যান্ট্রির সঙ্গেই সে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে উত্তর আর পূর্ব ভারতের বেশ কিছু অঞ্চল। পথ চলতে চলতে সে একটু একটু করে আবিস্কার করতে থাকে তার পুস্তকে পড়া ভারতবর্ষকে। সেই সঙ্গে অবাক হয়ে ভাবতে থাকে পুস্তকের সঙ্গে বাস্তবের কতই না পার্থক্য। কত বৈচিত্র্য আর কত রং মিশে আছে এখানকার মানুষের জীবনের প্রতিটি ভাঁজে-ভাঁজে।

উত্তর আর দক্ষিণ ভারত ঘুরতে ঘুরতে হেনরির স্থানীয় ভাষার ভান্ডারে আরো অনেকগুলো ভাষা যুক্ত হয়ে যায়। হেনরি আর তার ইনফ্যান্ট্রি উত্তর ভারতে ভালোই সময় কাটাচ্ছিল এমন সময় তাদেরকে ব্যারাকপুরে ডেকে পাঠানো হয়।

হেনরির মনটা খারাপ হয়ে যায়। কারণ ভারতের পথে-প্রান্তরে লুকিয়ে থাকা অভিযানের মজা সে দুহাত ভরে গ্রহণ করছিল। তাই ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের আরামের বিছানার চেয়ে নেপাল সীমান্তের কর্কশ ঠান্ডা ক্যাম্প তার জন্যে অধিক আনন্দের। তবে ব্যারাকপুরে ফিরে এলেও সময়টা সে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়। নিয়মিত যাতায়াত করতে শুরু করে ফোর্ট উইলিয়ামের লাইব্রেরিতে। সেই সঙ্গে ভর্তি হয়ে যায় বাংলা ভাষা শেখার কোর্সে। সঙ্গে আরবি আর ফার্সিও শিখতে থাকে অল্প করে। হেনরি জানত না এই ফোর্ট উইলিয়ামের লাইব্রেরির একটা বই বদলে দিতে যাচ্ছে তার জীবন। সেই সঙ্গে ভারতবর্ষের ইতিহাসেরও খানিকটা অংশ।

হেনরির ভাষা শেখা ভালোই চলছিল। সময় পেলেই সে লাইব্রেরিতে ভারত বিষয়ক বই পড়ার চেষ্টা করত। সেদিনও আর দশটা দিনের মতোই লাইব্রেরিতে বই খুলে বসেছিল, এমন সময় একটা জায়গায় চোখ আটকে যায় তার।

এম. থিভেনট নামে ফরাসি এক লেখকের লেখা ভ্রমণ কাহিনির বই। লেখক সপ্তদশ শতকে এসেছিল ভারতবর্ষে। বইটা তখনকার সময়ে থিভেনটের দেখা ভারতবর্ষের বর্ণনা। বর্ণনার এক পর্যায়ে সে লিখেছে দিল্লি থেকে রাজস্থান যাবার পথে তার গাইড তাকে জানায় এই পথে কারো সঙ্গে না মিশতে, কথা না বলতে। কারণ এই এলাকাতে নাকি ভারতবর্ষের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ডাকাত দলের বসবাস। লেখক প্রথমে একটু অবাক হয়,কারণ ডাকাতদের সঙ্গে মেশার কী আছে? ওরা কি আর এসে কথা বলবে? ওরা করবে ডাকাতি।

তখন তার গাইড নাকি জানায় এরা ভিন্ন ধরনের ডাকাত, এরা ভয়ংকর। এরা প্রথমে এসে মিশবে তারপর নিখুঁত লক্ষ্যে ফাঁস ছুড়ে দিয়ে খুন করবে। চোখের নিমিষে সব শেষ। এরা নাকি দল বেঁধে থাকে সবসময়, আর পুরো ভারতবর্ষ জুড়েই নাকি ছড়িয়ে আছে এরা।

থিভেনটের বর্ণনা পড়ে হেনরি একটু অবাক হয়। ব্যাপার কী? এতদিন যাবৎ ভারতে আছে অথচ সে এরকম কিছু তো শোনেনি। মনে মনে সে ভাবে এই খুনির দল কি এখনো টিকে আছে? এরা কি এখনো নিজেদের মতোই খুন করে বেড়ায় নিখুঁত লক্ষ্যে মানুষকে ফাঁস পরিয়ে? হেনরির মনের মধ্যে একটা জিজ্ঞাসা পেয়ে বসে। যেখানেই যায় সে এদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর করার চেষ্টা করে। কিন্তু হেনরির যা জানার ছিল, সেটা সে খুঁজে পায় আরেকটা বইয়ের ভাঁজে। তবে সেটা আরো অনেক পরে।

ভারতবর্ষে পদার্পণের পর বেশ অনেক বছর কেটে গেছে। হেনরি তখন নিয়মিত সৈনিক। গোরখপুর, উত্তর দিনাজপুর, মীর্জাপুরে নিয়মিত ডিউটি করছে ইতিমধ্যে তার ইনফ্যান্ট্রি গর্বের সঙ্গে গোর্খা যুদ্ধে অংশ নিয়ে বেশ সুনামও কামিয়েছে। তবে একটার পর একটা ছোটো ছোটো যুদ্ধে জয়ী হয়ে ইংরেজরা তখন ধীরে ধীরে পুরো ভারতকে নিজেদের পতাকা তলে নিয়ে আসছে। তাই সৈনিকদের কোনো ছুটি নেই। নেই কোনো স্থিরতা। আজ এখানে তো কাল ওখানে।

হেনরির কাছে এই জীবন ভালোই লাগে। এটাই তো সে চেয়েছিল। এটাই তার স্বপ্নের জীবন। তবে এই অস্থির আর ঝঞ্ছাবিক্ষুব্ধ জীবনেও দুটো ব্যাপার তার নিয়মিত সঙ্গী। একটা হলো বই; যেখানই যাক আর যাই করুক, নিয়মিত বই পড়ায় তার কোনো বিরতি নেই। আর অন্যটা হলো থিভেনটের লেখা সেই ডাকাত দলের সন্ধান করা। থিভেনটের লেখাটা পড়ার পর বেশ কয়েক বছর কেটে গেলেও একটা দিনের জন্যে ব্যাপারটা হেনরির মন থেকে মোছেনি। যেখানেই যাক যাই করুক ভিড়ের ভেতরে সে ওদেরকে খুঁজে বেড়ায়।

হেনরির ডিউটি তখন এলাহাবাদে। কয়েকদিন হলো তার দল এখানে এসেছে। দলের প্রধানের দায়িত্বে আছে; একদিন নিয়মিত মিলিটারি টহলের সময়ে অন্যান্য সব সময়য়ের মতোই হেনরি কাঁচা রাস্তা দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাবার সময়ে অভিযাত্রীদের একটা দলের ওপরে আপন মনেই নজর বোলাচ্ছিল এমন সময় তার সহকর্মী দলীয় প্রধান কর্নেল জানতে চায় এত মনোযোগ দিয়ে সে কী দেখছে। জবাবে একটু লজ্জার হাসি হেসে হেনরি তাকে জানায়, সে আসলে কী দেখছে? প্রতিবারের মতো এবারও সে ভেবেছিল আর সবার মতো কর্নেলও তার কথা হেসে উড়িয়ে দিবে কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে কর্নেল আনমনে মাথা নাড়তে নাড়তে জানায় এরকম সে-ও কোথায় নাকি শুনেছিল।

কর্নেলের জবাব শুনে হেনরির গায়ের রোম খাড়া হয়ে যায়। এই প্রথমবারের মতো বইয়ের বাইরে কারো কাছে এই ব্যাপারে কিছু একটা শুনতে পেল সে। সঙ্গে সঙ্গে জানতে চায় কোথায় শুনেছে এদের কথা। জবাবে কর্নেল কিছুক্ষণ চিন্তা করে জানায় এই এলাহাবাদের স্থানীয় কালেক্টরের অফিসে এক ইংরেজ অফিসার আছে, পেশায় কালেক্টর হলেও ভারত নিয়ে গবেষণা করা তার নেশা। সম্ভবত তার কাছেই এরকম কিছু একটা শুনে থাকবে সে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কর্নেলের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে সেখানে ছুটল হেনরি।

সময়টা দুপুর। হেনরি যখন সেখানে পৌঁছাল কালেক্টর সাহেব তখন দুপুরের খাবার নিয়ে বসতে যাচ্ছিলেন। হেনরিকে নিয়েই বসে গেলেন খেতে। এটা-ওটা

আলাপ হয় তবে মূল প্রসঙ্গে আর আসতে পারে না সে। অবশেষে যখন সে মূল বা্যপারটা জানতে চাইল কালেক্টর সাহেব মৃদু হেসে জানালেন, এই ব্যাপারে উনি নিজে কিছু জানেন না তবে সম্ভবত কোথাও পড়েছিলেন। কোথায়? খেতে খেতেই উনি পাশের একটা ছোটো কামরার দিকে ইশারা করে জানালেন, কালেক্টরের অফিসে ছোটো একটা লাইব্রেরি আছে ওখানে সে ভারতের ওপরে নানা ধরনের গবেষণাপত্র সংগ্রহ করেছে। সম্ভবত ওখানেই কোনো একটা বইতে এই ব্যাপারে কিছু একটা পড়েছিলেন। হেনরি পারে তো খাওয়া রেখেই উঠে যায়। তবে ব্রিটিশ কেতা বলে কথা।

কোনোমতে খাওয়া সেরে সে গিয়ে ঢোকে লাইব্রেরিতে। জায়গাটা এলোমেলো কাগজপত্রের স্তূপ। সেই স্তূপের ভেতরে শত-শত কাগজ ঘেঁটে অবশেষে সে খুঁজে বের করতে পারল সেই মহা মূল্যবান সম্পদ। বই নয় একটা পাণ্ডুলিপি। সাম্প্রতিক সময়ে একজন ইংরেজ ডাক্তারের লেখা একটা গবেষণাপত্র।

পাণ্ডুলিপিতে লেখা আছে ডাক্তারের নাম ড. রিচার্ড শেরউড। উনি ফোর্ট সেন্ট জর্জের সার্জন ছিলেন। তার লেখা পাণ্ডুলিপিটা আসলে গবেষণাপত্রও নয়, একটা রিপোর্ট। উনি রিপোর্টে লিখেছেন শ্রীরঙ্গপত্তমের যুদ্ধের সময় উনি সেখানে ডিউটি করছিলেন। শ্রীরঙ্গপত্তমের পতনের পর ব্যাঙ্গালোরের পথে অন্যান্য কয়েদিদের সঙ্গে একটা বিশেষ ডাকাত দল ধরা পড়ে। সংখ্যায় প্রায় একশর কাছাকাছি এই ডাকাতদের দলটা নাকি অন্যদের থেকে একেবারেই আলাদা ছিল। স্থানীয় ভাষায় এদেরকে বেশ কয়েকটি নামে ডাকা হয় তবে সেসব নামের ভেতরে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো ‘ফাঁসিগীর’ বা ‘ফাঁসুড়ে’।

এদেরকে এই নামে ডাকার পেছনে মূল কারণ হলো, এরা নাকি গলায় ফাঁস পরিয়ে মানুষ খুন করে। এই পর্যন্ত পড়ে হেনরির মনে হতে লাগল, আনন্দে তার হাত-পা কাঁপছে। গত কয়েকটা বছর ধরে এক ফরাসি লেখকের লেখা পড়ে যে মাতলামিতে সে ভুগছিল সেটার প্রত্যক্ষ প্রমাণ এবার পাওয়া গেল। দলটাকে নিয়ে খুব বেশি কিছু লেখা না থাকলেও শেরউডের রিপোর্টে আরো বেশ কয়েকটা এধরনের ছোটো ছোটো দলের গ্রেপ্তারের খবর লেখা আছে, সেই সঙ্গে ওদের কথা- বার্তার টুকরো টুকরো কিছু অংশও দেওয়া আছে। আনন্দে কাঁপতে কাঁপতেই কালেক্টরের কাছ থেকে হেনরি পাণ্ডুলিপিটা ধার নিয়ে গেল। মনের ভেতরে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, প্রত্যক্ষ প্রমাণ যেহেতু পেয়েছে কাজেই খুঁজে বের করতে হবে এদেরকে। হেনরি জানত না সে সুযোগ তার আসবে তবে সেটা করতে তাকে আরো বেশ কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে।

এলাহাবাদ থেকে সেই রিপোর্ট উদ্ধারের পর পার হয়ে যায় বেশ কয়েক বছর। ইতিমধ্যে স্লিম্যানের জীবনে বেশ অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। সৈনিকের পেশা ত্যাগ করে সে গায়ে চড়িয়েছে সিভিল সার্জনের কোট। চেয়েছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে অধ্যাপনা করবে কিন্তু সেটা হয়েওঠেনি। ইংরেজ সরকার তার মতো করিৎকর্মা অফিসারকে এত সহজে ছেড়ে দিতে চায়নি। তাই তার অবসরের আবেদন ফিরিয়ে দিয়ে তাকে সিভিল সার্জনের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছে নর্মদা এলাকায়।

প্রাথমিক ভাবে তাকে নর্মদা এলাকার ম্যাজিস্ট্রেটকে সাহায্য করতে হবে। কোম্পানির এধরনের সিদ্ধান্তে প্রথমে মনে মনে হেনরি আঁতকে উঠেছিল। কারণ ইতেমধ্যেই একের পর এক যুদ্ধে জড়িয়ে সৈনিক জীবনের প্রতি তার কেমন যেন এক ধরনের বিরক্তি তৈরি হয়েছে। তার ওপরে যোগ হয়েছে পড়ালেখা করার ইচ্ছে। তাই তার আগ্রহ ছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে অধ্যাপনা করবে, আর সেই সঙ্গে খুঁজে বেড়াবে ফাঁসিগীরদের। কিন্তু সবকিছু তো আর নিজের মতো চলে না। কখনো কখনো রাষ্ট্রযন্ত্রের চাকার সঙ্গে গতিময় জীবনকে মানিয়ে নিতে হয়।

হেনরিরও তখন সেই অবস্থা। একরকম নাখোশি নিয়েই সে রওনা দিল নর্মদার দিকে। তবে সে জানত না যার খোঁজে সে চষে বেড়াচ্ছে পুরো ভারত সেটার সন্ধান সে নর্মদাতেই খুঁজে পাবে।

নর্মদাতে গিয়ে সে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সঙ্গে কাজ করে, আর অবসর সময় কাটায় ফাঁসিগীরদের নিয়ে গবেষণা করে। ইতিমধ্যে সে কিছু জিনিস সংগ্রহ করেছে। আবার কিছু ব্যাপারে হতাশও হয়েছে। হতাশার প্রথম কারণ ড. শেরউডের রিপোর্টটা লেখা হয়েছে কয়েকবছর আগে, কিন্তু তথ্যগুলো ছিল তারচেয়েও বেশি পুরনো তাই সেগুলো নিয়ে অনুসন্ধান করে কিছুই বের করা যায়নি। অন্যদিকে ড. শেরউড নিজে অবসর নিয়ে চলে গেছে ইংল্যান্ডে, তাই তার কাছ থেকেও কিছু পাবার আশা বাতুলতা। অন্যদিকে সংগ্রহ করা তথ্যগুলোর ভেতরে শক্ত কিছু নেই যা দিয়ে নতুন কিছু বের করা যাবে বা এদের অস্তিত্বের শক্ত প্রমাণ পাওয়া যাবে। এখানেই নর্মদায় দুবছর কেটে যায় হেনরির। নিজের কাজের পাশাপাশি ফাঁসুড়েদের নিয়ে গবেষণা করা রীতিমতো তার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এমন সময় ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের অবসরে যাবার সময় চলে আসে। এলাকার নতুন ম্যাজিস্ট্রেট হবার কথা হেনরিরই, কিন্তু তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় কয়েকটা ব্যাপার। হেনরিকে তার পূর্ববর্তী কাজের ভালো রেকর্ড দেখে এই এলাকাতে অনেকটা জোর করেই পাঠিয়েছিল কোম্পানি কিন্তু সেই রেকর্ডের সঙ্গে গত কয়েক বছরের রেকর্ড একেবারেই মেলে না। এর ওপরে তার এই আজব গবেষণা আর অনুসন্ধানের খবর ঠিকই ওপরওয়ালাদের কানে পৌঁছেছে। তাও তেমন সমস্যা হতো না কিন্তু হঠাৎ করে নিজের অধীনে কিছু কিছু এলাকা থেকে অতিরিক্ত খাজনা আদায় বন্ধ রাখায় তার ওপরে নাখোশ হয় কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে টোলঘরের কর্মচারীদের সঙ্গে স্থানীয়দের ঝামেলার জবাবদিহি করতে ডাক পড়ে কোলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে।

ফোর্ট উইলিয়ামে বাজে অভিজ্ঞতার পর হেনরি নর্মদায় ফিরে আসে আরো দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে। ফোর্ট উইলিয়ামের অভিজ্ঞতার পর হেনরি একটা ব্যাপার পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে; তার স্বজাতিরা ভারতবর্ষ শাসন করতে গিয়ে নিজেদের মূলনীতি থেকে বহুদূর সরে গেছে। তাদের কারোরই এখানকার মানুষ নিয়ে-তাদের উন্নয়ন নিয়ে মাথাব্যথা নেই। সবাই যার যার গদি আর নিজের লাভ সামলানোর তালে আছে। নীতিকথা এখানে বাতুলতা মাত্র। কিন্তু হেনরি নিজের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা থেকে সরলো না। নিজের কাজ চালিয়ে গেল, সেই সঙ্গে গোপন অনুসন্ধানও। এমন সময় তার হাতে ধরা দিল এক শক্তিশালী সূত্র।

আর দশটা দিনের মতো নিজের অফিসে বসে কাজের ফাঁকে অলস সময় কাটাচ্ছিল ও। সাধারণত দুপুরের খাবার পরে এই সময়টাতে সে একটু বিশ্রাম নেয়। এমন অলস সময়ে তার চোখ পড়ে জানালা দিয়ে বাইরে। সেখানে নারী-পুরুষের প্রায় একশজনের একটা দল বসে আছে। এই দলটাকে দেখে হেনরির মন আনচান করে ওঠে।

ইতিমধ্যে পড়ালেখা আর টুকরো-টুকরো অনুসন্ধান করে সে যা জানতে পেরেছে তা অনেকটা এরকম; এই ফাঁসিগীররা সবসময় দলে থাকে, কখনোই একা থাকে না, এরা সমসময় খুবই সাধারণ পরিচ্ছদে চলাফেরা করে, এরা সবসময়ই বন্ধুবেশে নিজের শিকারের সঙ্গে মিশে গিয়ে সুযোগ বুঝে শিকার করে। তাই সাধারণ চেহারার এই দলটাকে দেখে হেনরির মনটা আনচান করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সে এক আরদালিকে ডেকে জানতে চাইল এরা কারা?

বুড়ো আরদালি হেনরির প্রশ্নের জবাবে জানাল এরা একটা অভিযাত্রী দল। ধর্মীয় কারণে বাড়ি থেকে তীর্থ দর্শনে চলেছে। আসলে এখানে কয়েকটা দল আছে; একদল হয়তো তীর্থযাত্রী, একদল ব্যবসায়ী, অন্যদল হয়তো ভিন্ন কারণে চলেছে। পথে চলার সুবিধার্থে আর নিরাপত্তার স্বার্থে তারা একসঙ্গে পথ চলছে। এই পর্যন্ত জানিয়ে বুড়ো আরদালি একটু থামলো। হেনরির মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে জানাল, সাহেব কী খুঁজছে সে জানে। একটু অবাক হয়ে বুড়ো লোকটার দিকে ফিরে তাকালও। মনের ভাব গোপন না করেই বুড়োর কাছে জানতে চাইল, ‘কী জানো তোমরা?’

‘হুজুর,আপনি ঠগীদেরকে খুঁজছেন,’ বুড়োর মুখে তখনো মৃদু হাসি। শুধু আমি না, এই তল্লাটে সরকারি আফিসের বেবাকেই জানে

‘ঠগী’,’ঠগী’ বুড়ো আরদালির মুখে উচ্চারিত শব্দটা যেন হেনরির মাথায় গিয়ে আঘাত করল। এই শব্দ তো সে এর আগে শোনেনি। এতদিন যাদের ‘ফাঁসুড়ে’ কিংবা ‘ফাঁসীগীর’ নামে জেনে এসেছে এদের প্রকৃত নাম তাহলে ঠগী। অদ্ভুত ব্যাপার! এতদিন ধরে এদেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে অথচ এদের নামটাও ঠিকমতো জানত না সে। তার চোখে ভেসে উঠল থিভেনট আর ডক্টর রিচার্ড শেরউডের নাম। এমনকি ওরাও জানত না এই নাম। এই প্রথমবারের মতো হেনরি উপলব্ধি করল আসলে একই মাটিতে বাস করলেও এখনো ইংরেজ আর ভারতীয়দের ভেতরে কতটা দূরত্ব রয়ে গেছে।

ঠগী! ঠগী কারা? কী জানো তুমি ওদের ব্যাপারে?’ প্রশ্নটা যেন আনমনেই হেনরির মুখ দিয়ে বেড়িয়ে গেল।

বুড়ো আবারো হেসে উঠল। যেন সাহেবের কথায় খুব মজা পাচ্ছে সে। ‘সায়েব, আমি ক্যান ওগো ব্যাপারে কেউই জানে না। খালি এইডা জানি ওরা ঠগী আর ওরা কালী মায়ের সন্তান। তবে সায়েব ওগো ব্যাপারে না জানলেও আপনেরে একটা কতা কইবার চাই,’ বলে সে একটু থেমে গেল। মনে হচ্ছে সে একটু দ্বিধা করছে। ‘হুজুর, আড়ালে আবডালে সবাই আপনেরে নিয়া মজা করে। আপনেরে সবাই ‘ঠগী সিলিম্যান’ নামে ডাহে। হুজুর গোস্তাখি নিয়েন না, আপনের ভালা চাই দেইখাই কইলাম,’ বলেই সে মাথাটা একবার ঝুঁকিয়ে চলে গেল।

কিছুক্ষণ স্থাণুর মতো বসে রইল হেনরি। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি আর জানা-অজানার এক অদ্ভুত দোদুল্যমান অবস্থায় পড়ে গেছে সে। একদিকে হয়তো সে এই ডাকাতদের আসল নামের সন্ধান পেয়েছে অন্যদিকে তার আগে মনে হয় না অন্য কোনো ইংরেজকে, বিশেষ করে ভারপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে এধরনের হাসাহাসি করার সাহস কেউ পেয়েছে। কথাটা মনে হতেই ঝট করে উঠে দাঁড়াল সে। টান দিয়ে নিজের পোশাক ঠিক করে মাথায় হ্যাট পরে হাতে চাবুক নিয়ে টানটান হয়ে বেরিয়ে এলো নিজের কামরা থেকে। অদ্ভুত এক রাগ আর ক্ষোভ অনুভব করছে নিজের ভেতরে। সেই সঙ্গে সমপরিমাণ জেদ। ঠিক আছে, তার ডাকনাম যদি ‘ঠগী স্লিম্যানই হয়ে থাকে তবে এই নামের সার্থকতা প্রমাণ করে ছাড়বে সে।

নিজের কামরা থেকে বেরিয়ে অ্যাডজ্যুটেন্টের কামরায় প্রবেশ করল। পদমর্যাদায় সে অ্যাডজ্যুটেন্টের ওপরে, তাই তাকে দেখে উঠে দাঁড়াল অ্যাডজ্যুটেন্ট আর কাস্টমস অফিসার। দুজনে মিলে সদ্য দুপুরের খাবার নিয়ে বসেছিল। হেনরি জানতে চাইল : সামনে অফিসের প্রাঙ্গণে যে দলটা বসে আছে ওরা কারা? জবাবে কাস্টমস অফিসার জানাল ওরা একটা তীর্থযাত্রী দল, সঙ্গে কিছু ব্যবসায়ীও আছে। ওরা দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে চলেছে। তাহলে ওদেরকে বসিয়ে রাখা হয়েছে কেন, জানতে চাইল সে। জবাবে জানতে পারল ওদের অনুমতিপত্রে নাকি কী সব ঝামেলা আছে তাই আগের চৌকিতে খবর পাঠানো হয়েছে সেই চৌকি থেকে ছাড়পত্র ঠিকমতো দেওয়া হয়েছিল কেন। ওখান থেকে জবাব আসার অপেক্ষায় আছে এখন ওরা। যে পর্যন্ত ওখান থেকে জবাব না আসছে সেপর্যন্ত ওদেরকে ছাড়া যাবে না।

হেনরি খানিক চিন্তা করে জবাব দিল, যদি ছাড়পত্র চলেও আসে তবুও তার অনুমতি না নিয়ে যেন ওদেরকে ছাড়া না হয়। জবাবে দুজনেই একটু অবাক হলো, তবে এই কর্তার কিছু পাগলামো আছে দুজনেই জানত, তাই আর কিছু না বলে নীরবে সম্মতি জানাল উভয়েই।

ওখান থেকে বেরিয়ে নিজের কামরায় প্রবেশ করল হেনরি। কামরার ভেতরে কিছুক্ষণ পায়চারি করে জানালার ধারে এসে দাঁড়াল। এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে আঙ্গিনায় বসে থাকা দলটাকে। পুরুষেরা তাদের মালাসামান সামলে সেগুলোর ওপরে বসে তামাক টানছে আর কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ছে একে অপরের ওপরে, মেয়েরা অনেকে বাচ্চা সামলাচ্ছে, গল্প-গুজবে মেতে আছে সবাই। অনেকে আবার বিষণ্ন-বিরক্ত মুখে বসে আছে। ভারতবর্ষের পথে-প্রান্তরে নিজের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় হেনরি জানে, এরা খুবই সাধারণ আর স্বাভাবিক আর দশটা ভারতীয় অভিযাত্রী দলের মতোই। তবে সে কী খুঁজছে এদের মাঝে, কী দেখে সন্দেহ হলো এদেরকে, হয়তো নিজেও জানে না। এমন সময় ভিড়ের ভেতরে একটা পরিচিত মুখ দেখতে পেয়ে একটু আশাবাদী হয়ে উঠল সে। আরদালিকে দিয়ে ডেকে পাঠাল লোকটাকে।

একটু পরেই ভেতরে প্রবেশ করল সাদা দাড়িওয়ালা ভীষণ শুকনো লম্বা এক লোক। আরদালি তাকে নিয়ে প্রবেশ করতেই সে এক মুহূর্ত স্লিম্যানকে দেখল, চিনতে পেরেই মাটিতে প্রায় শুয়ে সালাম করল। ‘সালাম, হুজুর, সালাম। আপনি এইখানে!’ তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে স্লিম্যানকে দেখে খুবই অবাক।

‘ওঠো, মতলব ঠাকুর, আমি এখানকার ভারপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট, তুমি জানতে না?’ হেনরির মুখেও ফুটে উঠেছে মৃদু হাসি।

‘না হুজুর, সেই চুরির ঘটনার পর যে এলাকা ছাইড়েছিলাম এই কদিন আগে এলাম,’ বলে সে একটু থামলো।

‘হ্যাঁ, সরকারি আস্তাবল থেকে ঘোড়ার খাবার চুরির দায়ে তিন মাসের জেল দিয়েছিলাম আমি তোমাকে,’ হেনরি এটুকু বলে হেসে উঠল।

মতলব ঠাকুর সঙ্গেসঙ্গে আবারো মাথা নিচু করে ফেলল। ‘হুজুর, আপনি দেবতা। সাদা চামড়ার মানুষেরা যেহানে খালি চাবুক মারে, সেইহানে আমি জেলে যাবার পর আপনে আমার বউ বাচ্চাদের থাকা-খাওয়া-কাজের ব্যবস্থা না করে দিলে ওরা মারাই যেত, হুজুর। আপনে দেবতা।’

লোকটাকে দেখল হেনরি। একে কি কাজে লাগানো যায়? সে একবার মতলব ঠাকুরকে দেখল আরেকবার বাইরে বসে থাকা দলটাকে দেখল। তার জন্যে আর কোনো উপায় নেই। ঝুঁকি তাকে নিতেই হবে।

‘সবই ঠিক আছে মতলব, কিন্তু আমি তোমাকে সাহায্য করেছিলাম দুটো কারণে। যাতে তোমার পাপের শাস্তি তোমার পরিবারকে পেতে না হয় আর তুমি ভালো হয়ে যেতে পারো।’ কিন্তু আমি ভুল করেছিলাম, এই পর্যন্ত বলে সে ইচ্ছে করেই থেমে গেল।

মতলব ঠাকুর পাণ্ডুর মুখে হেনরির চোখের দিকে তাকাল। ‘কেন হুজুর?’

‘কারণ,’ খুব শক্ত গলায় বলল হেনরি। ‘আবারো তুমি খারাপ লোকের সঙ্গে পড়েছো,’ বলে সে একটু ঝুঁকে এলো মতলব ঠাকুরের দিকে। বাইরে বসে থাকা দলটার দিকে ইশারা করে বলল। ‘আবারো তুমি খারাপ কাজ করছো, মতলব। এবার কিন্তু তুমি ফাঁসির দড়ি কিছুতেই এড়াতে পারবে না।’ সঙ্গে সঙ্গে চেহারা সাদা হয়ে গেল মতলব ঠাকুরের। দুবার কথা বলার জন্যে মুখ খুলল কিন্তু আওয়াজ বেরুল না।

হুজুর, হুজুর ওরা খারাপ লোক আপনি জানলেন কীভাবে?’ সে এখনো হতভম্ভ। ‘এই কথা তো কাক-পক্ষিতেও জানে না,’ মতলব ঠাকুর এখনো কিছুতেই যেন ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছে না।

মতলব ঠাকুরের কথা শুনে মনে মনে আশাবাদী হয়ে উঠল হেনরি। অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়েছিল সে, কিন্তু মনে হচ্ছে সেই ঢিল জায়গামতো লাগতে যাচ্ছে। টেবিলের এককোণে শরীরটাকে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল হেনরি। সেখান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মতলব ঠাকুরের একেবারে মুখের কাছে চলে এলো। সরাসরি তাকাল ঠাকুরের চোখের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল একটু।

ঠাকুরের চোখে ভয়, অপরিসীম ভয়ের এমন অন্ধকার গহ্বর সে জীবনে খুব কমই দেখেছে। এই মুহূর্তে ঠাকুরের চোখ সেরকম একটা অন্ধকার গহ্বরের মতো মনে হচ্ছে। কেন জানি ঠাকুরের ভয় সেই চোখ থেকে প্রবাহিত হয়ে তার নিজের ভেতরেও প্রবেশ করল খানিকটা। শীতের আগমনি বাতাসের ঝটকা হঠাৎ যেভাবে শরীরটাকে কাঁপিয়ে দেয় হেনরির মনের ভেতরটা যেন সেভাবে একটুখানি কেঁপে উঠল। নিজেকে সামলে নিয়ে সে ঠাকুরের চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘আমি জানি তুমি কাদের সঙ্গে মিশেছ। ওরা খুনি, ওরা ডাকাত,’ বলে সে একটু থেমে যোগ করল, ‘আর, তুমিও ওদেরই একজন।

একটু আগে হেনরির মনের ভেতরটা যেভাবে কেঁপে উঠেছিল ঠিক সেভাবেই ঠাকুরের শরীরটা কেঁপে উঠল। মুহূর্তের জন্যে হেনরির মনে হলো ঠাকুর জ্ঞান হারাবে। তবে জ্ঞান হারিয়ে না হলেও আক্ষরিক অর্থেই ঠাকুর কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়ল। হেনরির দুই পা জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে উঠল সে।

‘হুজুর, অপনি মা বাপ, খুদা গাওয়া আমি ওদের একজন না। ওরা ভয়ংকর। ওরা আমারে মেরে ফেলাইবে, হুজুর।

হেনরির মনের ভেতরেটা একটু মোচড় দিয়ে উঠল ঠাকুরের অবস্থা দেখে। কিন্তু যে চাল সে দিয়েছে এথেকে পেছানোর আর কোনো উপায় নেই। পা ছাড়িয়ে নিয়ে এক কদম পিছিয়ে গেল সে। ‘ঠাকুর, আমি তোমাকে একবার সুযোগ দিয়েছিলাম কিন্তু এবার আর উপায় নেই। এবার তোমার ফাঁসি হবে। আর আমি নিজে সেই ফাঁসির নির্দেশে সই করব। তোমার পরিবার রাস্তায় না খেয়ে মরবে

সঙ্গে সঙ্গে যেন বিজলি বয়ে গেল ঠাকুরের শরীরে। সে বসা অবস্থাতেই ঝট করে সোজা হয়ে বলল। ‘হুজুর, পরিবারের কসম; আমি ওদের কেউই না, তয়ে আমি ওগো খবরি। বিশ্বাস করেন হুজুর টাকার লোভে না নিজের পরিবারকে বাঁচানির লাইগাই আমি এই পথে পা বাড়ায়েছি,’ বলে সে কাঁদতে লাগল।

‘পরিবারের জন্যে তুমি যে পথে পা বাড়িয়েছো, সেই পথই তোমাকে আর তোমার পরিবারকে গিলে খাবে যদি না…’ বলে সে ইচ্ছে করেই থেমে গেল।

হেনরি আর কিছু বলার আগেই ঠাকুর বলে উঠল, ‘হুজুর, আমি আপনাকে সব জানাবো, সব। আপনি যা যা জানতে চাইবেন সব তয়…’ দরজায় খটখট শব্দ শোনা গেল।

বুড়ো আরদালি জানিয়ে গেল অন্য কাস্টমস চৌকি থেকে অনুমতিপত্র এসে গেছে। হুজুর নির্দেশ করলেই এখন দলটাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। হেনরি তাকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলল। আরদালি চলে যেতেই হেনরি ফিরে তাকাল ঠাকুরের দিকে। ‘তুমি আমাকে এক্ষুণি সব জানাবে। না হলে তুমি তোমাদের পুরো দলটাকে আমি কয়েদ করব। ‘

‘হুজুর, আপনে মা-বাপ আমি আগেই বলেছি। তয় এইটা করিয়েন না। আমি আপনাকে সব জানাবো। তয় এখন না। একটু ধৈর্য ধরেন। আমি নিজে আইসে সব জানিয়ে যাবো আপনেরে। এখন সব কইতে গেলে ফিরিঙ্গিয়া সন্দেহ করবে আমারে। ফিরিঙ্গিয়া আমাগো দলের নেতা। খুব ভয়ংকর লোক। একটু সন্দেহ হইলেই আমারে মাইরা ফেলাইবে। আর এখন ওগোরে ধরলেও কিছু পাইবেন না। কাজেই হুজুর যদি বিশ্বাস রাহেন তয় আমারে দুইটা দিন সময় দেন।

হেনরি কিছু না বলে তাকিয়ে রইল, মনের ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। যে কূল- কিনারাবিহীন কাজ সে হাতে নিয়েছে না চাইতেই তার একটা কূল দেখা দিয়েছে। তবে সে আসলেই ঝুঝতে পারছে না এই লোকটার ওপরে ভরসা রাখবে কি না। কারণ যে ভয় এই লোকের চোখে দেখেছে তাতে…প্রায় কিছু না ভেবেই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো।

খেলাটা সে খেলবে।

ঠাকুর, আমি তোমাকে দুদিন সময় দিলাম। মনে রেখো, ঠিক দুই দিন। এর মধ্যে তুমি আমার সঙ্গে দেখা করে সব জানাবে। না হলে মনে রেখো তোমার পরিবার কোথায় থাকে আমি জানি। আর এই নর্মদা এলাকায় গাছের পাতাও আমার নির্দেশে নড়া-চড়া করে।’ কাজেই তুমি যাও, বলে ইশারা করতেই ঠাকুর এসে একবার তার পা ছুঁয়ে একরকম ছুটে বেরিয়ে গেল।

আরদালিকে ডেকে বলল দলটাকে ছাড়পত্র দিয়ে ছেড়ে দিতে। হেনরির বুকের ভেতরে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কাজটা কি ঠিক হলো? তবে বৃহত্তর স্বার্থে এইটুক ঝুঁকি নিতেই হতো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে হেনরি দেখতে পেল, ঠাকুর বাইরে যেতেই দলের পুরুষেরা তাকে ছেঁকে ধরল। কথা শেষ করে তারা যে যার যার মতো বোঁচকা-কুঁচকি কাঁধে তুলে রওনা দিল বাইরের দিকে। তবে একটু অবাক হয়ে দেখল দলের পুরুষদের ভেতরে একজন তাকিয়ে আছে ঠিক তারই দিকে।

লোকটার পরনে ধুতি, গায়ের ফতুয়া ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে সুঠাম পেশিবহুল শরীর। মুখের পাকানো গোঁফে আভিজাত্যের ছোঁয়া। হেনরি তখনো জানে না সেই অলস দুপরে সরকারি দপ্তরের সেই আঙ্গিনাতে ভিন্ন জগতের দুই পুরুষের ভেতরে কত বড়ো শত্রুতার বীজ রচিত হলো। হেনরির পক্ষে তখন জানা সম্ভব ছিল না এই শত্রুতার বীজ তাদের দুজনকেই দাপিয়ে বেড়াবে বাঙ্গাল মুল্লুক পর্যন্ত—বদলে দেবে ভারতবর্ষের ইতিহাসের ছোট্ট একটু অংশ।

দলটা ধীরে ধীরে চলে গেল। হেনরি একবার ভাবল নিজের লোকদের কাউকে পাঠিয়ে দেয়, ওদের ওপরে নজর রাখার জন্যে; তবে সেটা খুব বুদ্ধিমানের মতো হবে না ভেবে ক্ষান্ত দিল। এখন মতলব ঠাকুরই তার ভরসা।

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরের ওপরে ভরসা কমতে লাগল তার। একদিন গেল, দুইদিন গেল, তিনদিন পার হয়ে যাবার পরও যখন ঠাকুরের কাছ থেকে কোনো খবর এলো না তখন আবারো চিন্তিত হয়ে উঠল হেনরি। ব্যাপার কী? ঠাকুর কি আসলেই পালাল ওদের সঙ্গে?

কিন্তু ঠাকুর পালায়নি। সেদিন রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে হেনরি ঘুমাতে গেল বেশ অনিশ্চয়তা নিয়ে। মনে মনে একরকম সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে সকালে উঠেই সে ঠাকুরের বাড়িতে হানা দিবে ফৌজ নিয়ে। বিছানায় এদিক-সেদিক করতে করতে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে এমন সময় বাংলোর বাইরে চিল্লাচিল্লি শুনে সে বেরিয়ে এলো। তার পাহারাদারেরা মুখ ঢাকা এক লোককে ধরে রেখেছে। ‘কী ব্যাপার?’ শোবার পোশাক পরা এক হাতে হ্যারিকেন ধরা হেনরি চেঁচিয়ে জানতে চাইল।

‘কই চোরা হোগা, ছায়েব। হামাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলোয় ঢুকতে চাইছিল। হামনে পাকার লিয়া,’ বলে একটানে পাহারাদার লোকটার মুখের কাপড় সরিয়ে দিতেই হেনরি অবাক হয়ে খেয়াল করল লোকটা আর কেউ না মতলব ঠাকুর।

‘হুজুর,আমি আমি’, ঠাকুর, চিঁ চিঁ করে চেঁচিয়ে উঠল ঠাকুর।

‘ওকে ভেতরে আসতে দাও,’ বলে হেনরি বাংলোর ভেতরে প্রবেশ করতে উদ্যত হতেই ঠাকুর দৌড়ে এসে ওর একটা হাত ধরে ফেলল। ‘হুজুর, মেরা মানিয়ে। দয়া করে বাংলোর বাত্তি নিবিয়ে দেবেন। কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

ঠাকুরের এই বাড়াবাড়িতে বিরক্ত হলেও কী মনে করে পাহারাদারকে ইশারা করল চুপ থাকতে আর অতিরিক্ত বাতি নিভিয়ে ফেলতে।

ভেতরে ঢুকতেই ঠাকুর পানি চাইল। কাজের লোক পানি নিয়ে আসতেই ঢকঢক করে সেটা পান করল ঠাকুর।

তাকে একটু স্থির হতে ইশারা করে জানতে চাইল, ‘কী ব্যাপার, ঠাকুর? হয়েছে কী? এমন পাগলামো করছো কেন? আর বাইরের বাতি নিভিয়ে দিতে বললে কেন?’

‘হুজুর, আপনি ঠিকই অনুমান কইরেছেন,’ ঠাকুর এখনো পুরোপুরি স্থির হতে পারেনি। ‘ওইদিনের দলটা আসলেই ঠগীদের একটা দল আছিল। ওরা বেবাকতে মা ভবানীর সাধক। ওই দলের বেশিরভাগই ছিল ঠগী।’

ঠাকুরের কথা শুনে তার দিকে স্থির তাকিয়ে রইল হেনরি। বুকের ভেতরে স্বস্তির পরশ। এতদিন ধরে সে স্রেফ নিজের বিচার বুদ্ধির ওপরে আস্থা করে ছায়ার পেছনে ছুটে চলছিল এবার মনে হয় শক্তিশালী কিছু একটা পাওয়া যাবে।

‘সেটা তো আমি তোমাকে সেদিনই বলেছিলাম। আর তুমিও আসলে ওদেরই একজন। তুমিও ভবানীর সাধক। তুমিও ঠগী তাইনা?’ হেনরি নিজেকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। সে-ও পাত্র থেকে খানিকটা পানি পান করে নিলো।

‘না হুজুর, আমি যদি সত্যিই ঠগী হইতাম ভবানীর পূজক হইতাম তয় আমি এহন যা বলতাছি সেইটা জীবনেও আপনার সামনে উচ্চারণ করতাম না। আমি স্রেফ ওগো একজন খবরি মাত্র। আমার কাজই হইলো ওদেরকে খবর সংগ্রহ কইরে দেওয়া। তাও পেটের দায়ে আমি ওদের খবরি হইতে বাধ্য হইয়েছি।’

‘মানে তুমি নিজে সরাসরি ওদের দলের লোক নও?’

‘না, হুজুর। কবে কোথায় কোনো ব্যবসায়ী টাকা নিয়ে পথে নামবে। কার কাছে কত মূল্যবান গহনা আছে এসব খবর বের করাই আমাদের মতো খবরিদের কাজ,’ ঠাকুরের কথা শুনে হেনরি একটু অবাক হলো। আচ্ছা একারণেই তাহলে এরা এতটা শক্ত দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। সে যা ভেবেছিল এরা আসলে তা নয়। কিন্তু হেনরি জানত না সে স্রেফ ওদের ওপরের তল দেখতে পেয়েছে। এরপরে সে যা জানবে সেটা এর থেকে আরো অনেক অনেক বেশি গভীর আর ভয়ংকর।

‘আমাকে এদের ব্যাপারে বলো, একেবারে বিস্তারিত বলতে হবে, ঠাকুর। আমি এদের ব্যাপারে সব জানতে চাই,’ হেনরি এবার আশাবাদি। ঠাকুর যেহেতু নিজ থেকেই ফিরে এসেছে কাজেই এবার কাজের কাজ কিছু হতে পারে।

‘কী বলেন, হুজুর। আপনি এদের ব্যাপারে জানেন না!’ ঠাকুরকে মনে হলো সে খুবই অবাক হয়েছে হেনরির কথা শুনে। ‘আমি তো ভাবছিলাম আপনে সবই জানেন। হের লাইগ্‌গাই তো…’ ঠাকুরকে দেখে মনে হচ্ছে যেন দ্বিধায় পড়ে গেছে সে।

‘আমি জানি ওরা ডাকাতি করে বেড়ায়…’ হেনরি বলার আগেই ঠাকুর তাকে থামিয়ে দিল।

‘হুজুর,কন কী! খালি ডাকাইতি, খালি ডাকাইতি করলে তো ভালাই আছিল, বলে সে একটু থামলো। আরেকটু পানি খেয়ে নিয়ে বলল, ‘হেরা ডাকাইতের চাইতেও বেশি কিছু।’

‘ওরা কী, সেটাই তো জানতে চাচ্ছি তোমার কাছ থেকে,’ বলে সে একটা হাত রাখল মাটিতে বসে থাকা ঠাকুরের কাঁধে। ‘দেখো, ঠাকুর, আমি যা করতে চাচ্ছি সেটা তোমাদের ভালোর জন্যেই করতে চাচ্ছি। আর আমি যা করতে চাচ্ছি সেটা করতে হলে তোমার মতো স্থানীয় মানুষের সাহায্য লাগবে। যদি সেটা না করো তবে আমার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হবে না। এখন বলো কী কী জানো তুমি।

‘হুজুর, আমি আপনাকে আগেও কইয়েছি আমি ওদের লোক না। ওরা নিজেগোর বাইরে কাউরেই কিছুই কয় না। আর ওগো ব্যাপারে সব জানতে পাইরবেন। তয় আইজ রাইতে ওগোরে নাঙ্গা হাতে পাকরানোর বিরাট সুযোগ আছে।’

‘তাই নাকি?’ হেনরি আবারো পানি খাবার জন্যে গ্লাস তুলে নিয়েছিল সেটা মুখের সামনেই থেমে গেল।

‘হ, হুজুর আপনে ফৌজ খবর দেন। নাইলে দেরি অই যাইতে পারে।

‘আগে আমাকে শুনতে হবে, হয়েছে কী? না শুনে আমি ফৌজে খবর দিতে পারব না,’ হেনরির গলা একটু শুকনো শোনালো। ও আসলে বুঝতে চাইছে ঠাকুর কী বলছে। না বুঝে ফৌজে খবর দিলে পরে বোকা বনতে হবে। এরকম বোকা বনার অভিজ্ঞতা তার একেবারে কম না।

ঠাকুর একটু ভাবল। ‘ঠিক আছে। হুজুর আগে শোনেন, হইতেছে কী। ওইদিন আপনে ছাইড়া দেওনের পরে আমি বাইরে যাইতেই হেরা আমারে সব ঘিইরা ধরে। আমারে ক্যান ডাকছিলেন, কী জিগাইছেনসব শুনে। বিশেষ কইরা ফিরিঙ্গিয়া। হেয় আমারে এক ঘণ্টা ধইরা এইটা-ওইটা জিগাইছে,’ বলে একটু থামলো সে। তার চোখে মুখে আবারো সেই ভয় খেলা করছে। সেই দিনের দেখা সেই ভয়। ‘হুজুর, আপনেরে কই, ওগো দলের নেতা ফিরিঙ্গিয়া-যারে আমি ফিরিঙ্গি ডাকি। হুজুর, ও বড়ো ভয়ংকর। কতায় কতায় এরে-ওরে মাইরা ফেলায়। যদি বুঝে দলের ক্ষতির কারণ অইতে পারে তাইলে নিজের ভাইরেও মারতে সময় লাগে না ওর। আমার সামনেই একদিন তুপানির গুড় খাওনের সময় একজনরে মাইরা ফেলাইছে সন্দেহ অওয়াতে।’

‘তুপানির গুড়…সে আবার কী?’ হেনরি মাঝখানে জানতে চাইল।

‘হুজুর, বলতাছি। তো ফিরিঙ্গিয়ারে ওর দলের লোকজনই বাগের মতো ডরায় আর আমি তো কুন ছাড়। তো হেয় যখন আমারে জেরা করল আমি তো ভয়ে শেষ তাই আমি সব হাছা কতা কইয়া দিছি,’ বলে ঠাকুর একটু হেসে উঠল।

‘মানে কী? তুমি বলে দিয়েছো যে আমি ওদের পিছু নিয়ে বেড়াচ্ছি?’ হেনরির হাতে পাইপ ছিল সেটা আরেকটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল।

হুজুর, পাগল নাকি! ওরে এইডা বললে আমার লাশ পইড়া যাইতো তহনি। আমি বলছি আমি আপনেরে চিনি। আপনে আমার পরিবাররে থাকতে খাইতে দিছিলেন। তাই আমারে ডাকছিলেন কতা বলার জন্যে। ফিরিঙ্গিয়া হুনলো আমার কথা। তারপর আমারে যাইতে বলল। তয় ও অইলো শাদুর্লের মতোন চালাক। আমারে কিছু না কইলেও আমি বুঝতে পারলাম আমার উপরে গোপনে নজর রাখতাছে। দুইদিন পার অইলো আমি কিছুই করতেও পারলাম না। আপনের লগে দেহাও করতে পারলাম না। তয় সুযোগ ঠিকই আইলো। আইজ রাইতে হেরা একটা ডাকাতির পরিকল্পনা করতাছিল আমি কাইল সইন্ধা থাইক্কা বুজতেছিলাম। কাইল সইন্ধাবেলা হেরা জোড়া-দেবীর পূজা দিছে। এই পূজা হেরা তহনি দেয় যখন মা ভবানীর কাছ থাইক্কা হেগো বিশেষ সাহাইয্য দরকার অয়। পূজার পরেই হেরা বলাবলি করতাছিল মা ভবানীর নির্দেশ নাকি চইল্লা আসছে। আমিও তক্কেতক্কে রইলাম। কুন জায়গায় ডাকাতি দিবো হেইডা শুইন্না আমি মটকা মাইরা পইরা রইলাম। হেরা বাইর ওয়ুনের এট্টু পরেই আমি জোড়া-দেবীর ঘরে ঢুকার চেষ্টা করি কিন্তু দেহি হেইডা আটকানি,’ বলে ঠাকুর একটু থামলো।

হেনরির মনের ভেতরে অনেক প্রশ্ন কিন্তু জানতে চাইল না। কারণ এখন লোকটাকে থামিয়ে প্রশ্ন করতে গেলে সে খেই হারিয়ে ফেলতে পারে। কাজেই আগে শুনে নিক, পরে প্রশ্ন করবে।

‘তো হেইহানে ঢুকতে তো পারলাম না কিন্তু বাড়ি খুইজ্জা আরেকটা মূল্যবান জিনিস পাইয়া গেলাম,’ বলে সে একটু থেমে নিজের পোশাকের বুকের কাছ থেকে একটা চামড়ায় মোড়ানো বটুয়ার মতো বের করে আনলো। ওটা হেনরির হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘হুজুর, আপনে যা যা জানতে চাইতে ছিলেন সব এইহানে আছে। এইডা ঠগীগো ইতিহাস। হেরা ক্যামনে কি করে। ক্যামনে মা ভবানীর পূজা করে। কেমনে ছোটো বাচ্চাগো ঠগী বানায়। কী করে ক্যামনে থাকে সব এইখানে আছে। এইরকম ছোটো ছোটো বটুয়ার মতো ওরা বানায়া রাহে ওগো ভবিষ্যত প্রজন্ম যারা নতুন ঠগী অয় ওগোরে নিজেগোর ইতিহাস জানানোর জইন্যে।’

ঠাকুর এই পর্যন্ত বলতেই হেনরি বটুয়াটা টেনে নিলো নিজের দিকে। চামজার ভাঁজ খুলতেই বেরিয়ে এলো হলদে রঙের কাগজের একটা বান্ডিলের মতো। বিজাতীয় এক ভাষায় লেখা হরফগুলো। সেগুলো বুঝতে না পারলেও ছবিগুলো দেখে চমকে উঠল হেনরি। অক্ষরের ফাঁকেফাঁকে হাতে আঁকা ছবি। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে একদল লোক গোল হয়ে বসে পুজো করছে। তাদের সামনে রাখা দুটো ভয়ংকর দর্শন দেবী মূর্তি। আরেকটা ছবিতে একজন মানুষকে ধরে আছে দুজনে অন্য একজন তার ওপরে চড়ে বসে গলায় ফাঁস পরাচ্ছে।

‘সর্বনাশ, এটা তো সোনার খনির চেয়েও দামি। এরপর কী হলো?’

হুজুর, এইডা পাওনের পরে আমি আর কিছু দেহি নাই দিগ্‌বদিক ছাড়ায়া দৌড় দিছি। একেবারে থামছি আপনের বাংলোর বাইরে আইসা,’ সে যেন আবারো হাঁপাতে শুরু করবে। ‘হুজুর, ওরা এহন কই আছে আমি জানি। অনেক দেরি হইয়া গেছে কিন্তু এহনো আপনে চাইলে ফৌজ নিয়া গেলে ওগোরে নাঙ্গা হাতে মালামাল সমেত ধরতে পারবেন।’

হেনরি অনুভব করল ঠাকুরের শেষ কথাটা শুনে তার সর্বশরীরে এক ধরনের শিহরণ বয়ে গেল। এক মতলব ঠাকুরের কাছ থেকে সে এতটা আশা করেনি। একদিকে ওদের ব্যাপারে সব জানার মতো জিনিস তার হাতে চলে এসেছে, অন্যদিকে এইরকম একটা দলকে হাতে-নাতে ধরার সুযোগও এসেছে।

‘হুজুর, হুজুর, শুনেন হেরা আইজ কই ডাকাতি করবে,’ বলে সে বর্ণনা করে জানিয়ে দিল কোথায় পাওয়া যাবে ওদেরকে। জায়গাটা হেনরি খুব ভালোভাবেই চেনে। এখান থেকে মাইল তিনেক উত্তরের দিকে হবে। সে ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে আরদালিকে ডেকে পাঠিয়ে এখুনি সৈনিকদেরকে ডেকে তুলতে বলল। তার আগে একজনকে পাঠাতে বলল অ্যাডজ্যুটেন্টের অফিসে। নিজে দৌড়ে এসে ঢুকলো শোবার ঘরে। পোশাক ছেড়ে যতটা সম্ভব দ্রুত পরে নিলো ইউনিফর্ম। বেল্ট আটকাতে আটকাতে ঠাকুরের দেওয়া বটুয়াটা তুলে নিয়ে আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখতে গিয়েও কী মনে করে সেটা ঢুকিয়ে রাখল ইউনিফর্মের বুক পকেটে। বাইরের কক্ষে এসে দেখল ঠাকুর এখনো সেখানেই থম মেরে বসে আছে।

ঠাকুরকে দেখে প্রথমেই যে কথাটা মনে এলো সেটাই বলল হেনরি, ‘ঠাকুর, তোমার পরিবার কোথায়?

‘হুজুর, ওরা তো খণ্ডেলপুরে চইলা গেছে। আমার বউয়ের বাপের বাড়ি ওইখানে,’ ঠাকুরের জবাব শুনে হেনরি মনে মনে হিসেব করে দেখল জায়গাটা এখান থেকে বেশ দূরে। আর মনে হয় ওখানে তার পরিবার নিরাপদেই থাকবে।

ঠাকুর, এই মুহূর্তে আমি তোমার পরিবারের চেয়ে বেশি চিন্তা করছি তোমাকে নিয়ে। আমার মনে হয় তোমার আমাদের সঙ্গে না যাওয়াই ভালো। তার চেয়ে তুমি এখানেই থাক। সেটাই তোমার জন্যে নিরাপদ হবে,’ বলে হেনরি একটা হাত রাখল ঠাকুরের কাঁধে। ‘তুমি আমাকে যে সাহায্য করলে এর প্রতিদান আমি দিতে পারব না, ঠাকুর।’

‘হুজুর, আপনে কী যে বলেন, আমি তো কিছুই করি নাই। এহন জলদি যান নাইলে হেরা পলাইতে পারে।’

ঠাকুরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পুরোদুস্তুর প্রস্তুত হেনরি বাইরে এসে দেখল ওর অধীনে থাকা সৈন্যরা একেবারে প্রস্তুত হয়ে দাড়িয়ে আছে। সংখ্যায় গুনে দেখল মোটে বারো জন। এই সৈন্য নিয়ে ওদেরকে ধরা সম্ভব নয়। কেউ একজন হেনরির হাতে ওর পিস্তল আর বন্দুক ধরিয়ে দিল। পিস্তলটা কোমরে নিয়ে বন্দুকটাকে পিঠে গলিয়ে ঘোড়ায় উঠে বসল। এখন আর অন্য কাউকে পাঠানোর সময় নেই। নিজেকেই যেতে হবে কর্নেলের বাড়িতে। নিজের গুটিকয় সৈন্য নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে এলো কর্নেলের বাংলোয়। তার অধীনে ছোটোখাটো একটা প্লাটুন আছে। যেকোনো সময় জরুরি প্রয়োজনে ওদেরকে কাজে লাগানো যেতে পারে।

বাংলোর সামনে এসে দেখল বারান্দায় বাতি জ্বলছে আর সেখানে ওর পাঠানো আরদালির সঙ্গে তর্ক করছে শোবার পোশাক পরা কর্নেল। ঘোড়া থেকে নেমে দৌড়ে এসে বাংলোর দরজায় উঠল সে। ওকে দেখতে পেয়ে রাগান্বিত কর্নেল চিৎকার করে বলে উঠল, ‘হেনরি, এসব কী হচ্ছে? তোমার আরদালি মাঝরাতে এসে আমাকে বলছে তুমি নাকি সৈন্য পাঠাতে বলছ। তুমি জানো না এভাবে হুটহাট করে চাইলেই সৈন্যদেরকে কাজে লাগানো যায় না। তাদের একটা নিয়মিত ড্রিল আছে। ওরা সারাদিন কাজ করে এখন ঘুমাচ্ছে। শুধুমাত্র জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া…’

‘স্যার, এটা জরুরি অবস্থা, খুবই জরুরি অবস্থা। আমি এতদিন ধরে যাদের পিছু নিচ্ছি তাদের একটা দলকে হাতে নাতে ধরার সুযোগ এসেছে, মরিয়া হেনরি হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠল।

এক মুহূর্তের জন্যে থমকে রইল কর্নেল। ‘ওহ, হেনরি তুমি আর তোমার পাগলামো। তুমি তোমার কল্পনা নিয়ে থাকতে পারো, আমি পারি না।’

‘প্লিজ, কর্নেল। একটাবার আমার কথা বিশ্বাস করে দেখুন। এইবার আমাকে সাহায্য করুন প্লিজ। আজ যদি আমি কিছু প্রমাণ করতে না পারি, ডাকাতদের ধরতে না পারি, তবে এর দায়ভার আমার নিজের। সেই সঙ্গে আমার সৈন্যদের কোনো ক্ষতি হলেও।

‘দেখো, হেনরি…’ কর্নেল কথা শেষ করার আগেই হেনরি আবারো বলে উঠল। ‘স্যার, প্লিজ।’

কর্নেল একটু চুপ থেকে আরদালি ডেকে সৈন্যদেরকে প্রস্তুত হবার নির্দেশ দিল। আরো প্রায় আধা ঘণ্টা পর পঞ্চাশজনের মতো ক্লান্ত-বিরক্ত-অর্ধজাগ্রত সৈন্যদেরকে নিয়ে জোড় পুকুরের দিকে চলল হেনরি। ঠাকুরের কথামতো ওখানেই আজ অভিযান চালানোর কথা ঠগীদের। জোড় পুকুর এলাকাটা হলো পাশাপাশি বিরাট দুটো দিঘীর সমন্বয়ে একটা ফাঁকা মাঠের মতো জায়গা। ভোপাল আর নর্মদাকে সংযোগকারী মূল রাস্তা থেকে বেশ কাছেই সুন্দর আর ফাঁকা হওয়ায় জায়গাটা দূরের অভিযাত্রীদের বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে বেশ প্রিয় জায়গা এটা।

জায়গাটার কাছাকাছি এসে সৈন্যদেরকে থামতে ইশারা করল হেনরি। আশপাশে কোনো বাতি বা আগুন চোখে পড়ছে না। এখানে ক্যাম্প বা তাঁবু থাকলে দূর থেকেই বাতি চোখে পড়ার কথা। সে নিজের সৈন্যদেরকে দুইভাগে ভাগ হবার নির্দেশ দিয়ে পুরো জায়গাটাকে দুইদিক থেকে কভার করে এগোনোর নির্দেশ দিল। সব সৈন্যরা প্রায় নিঃশব্দে নিজেদের হাতিয়ার বের করে দুইভাগে ভাগ হয়ে পুরো এলাকাটাকে যতটা সম্ভব বেস্টন করে সামনে এগোল। একদিক থেকে হেনরি অন্যদিক থেকে বাকিরা। পুরো জায়গাটাকে ঘিরে দুইদিক থেকে সাবধানে এগোতে এগোতে আবার দুই দল মুখোমুখি হয়ে গেল।

‘হুজুর, কাউকেই তো পেলাম না,’ অপর পক্ষের সৈন্যদের প্রধান জানাল।

একহাতে পিস্তল নিয়ে অন্যহাতে ঘোড়া সামলে দ্রুত কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করছে হেনরি কিন্তু তার মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না। ব্যাপার কি, এরকম তো হবার কথা নয়। ডাকাতরা কি তবে চলে গেল নিজেদের কাজ সেরে? কিন্তু এখানকার পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে তো সেরকম মনে হচ্ছে না। এখানে আজ কেউ আসেইনি মনে হচ্ছে।

‘হুজুর?’ সৈন্যদের প্রধান আবার চিৎকার করে উঠল।

‘ভালোভাবে দেখেছো?’

‘জি, হুজুর, আজ এখানে এই এলাকাতে কেউ আসেইনি। আমি নিশ্চিত, ‘ সৈন্যদের প্রধান জবাব দিল।

তবুও আরেকবার পুরো এলাকা পরীক্ষা করে দেখো,’ বলে ও একটু ভেবে জবাব দিল। ‘আমি কয়েকজনকে নিয়ে এখানেই দাঁড়াচ্ছি তোমরা ঘোড়া নিয়ে একটা চক্কর দিয়ে এসো।’ হেনরি ওখানেই দাড়িয়ে রইল। আধাঘণ্টার ভেতরেই সৈন্যদের প্রধান ফিরে এলো তার বাহিনী নিয়ে। মানুষ তো দূরে থাক একটা শেয়াল পর্যন্ত দেখতে পায়নি কেউ।

‘কই আ রাহা হ্যায়,’ সৈন্যদের দলের পেছন থেকে কেউ একজন চিৎকার করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সবাই ঘুরে দাঁড়াল। একটা ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কোমরে গোঁজা পিস্তলটা চট করে বের করে আনলো হেনরি। ওর দেখাদেখি আরো কয়েকজন বের করে আনলো নিজেদের অস্ত্র।

‘থামো থামো,’ চিৎকারটা নিজেদের সৈন্যদের উদ্দেশ্যে করেছে হেনরি। কারণ এগিয়ে আসতে থাকা মানুষটা আর কেউ না কর্নেলের বাংলোর আরদালি। ‘হুজুর, আমাকে কর্নেল সাহেব পাঠিয়েছেন, আপনার বাংলোয় আগুন দেখা যাচ্ছে।’

‘কী?’ চমকে উঠল হেনরি।

‘জি, হুজুর আমাদের ওখান থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখে কর্নেল সাহেব আমাকে পাঠালেন আপনাদের কাছে খবর পাঠাতে।’

হঠাৎ একটা অসুস্থ চিন্তা চিড়-বিড় করে উঠল হেনরির মাথায়। এরকমটা ঘটতে পারে সে ভাবতেও পারেনি কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আসলে সে ওদের পিছু ধাওয়া করছিল না বরং ওরাই তাকে নিয়ে খেলছিল। ঘোড়া ঘুড়িয়ে যতটা সম্ভব দ্রুত ঘোড়া ছোটালো হেনরি আর তার দল। এক ঘণ্টারও বেশি পথের দূরত্ব পার হয়ে এলো আধাঘণ্টারও কম সময়ে। নিজের বাংলো, অ্যাডজ্যুটেন্টের অফিস, কাস্টমস চৌকিসহ পুরো জায়গাটা ঘিরে আগুনের নৃত্য দূর থেকেই দেখতে পেল ওরা। আরো জোরে ঘোড়া ছোটালো হেনরি। আঙ্গিনার কাছে এসে দেখল দুচারজন স্থানীয় প্রতিবেশী এদিক-সেদিক দৌড়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে। ঘোড়া থেকে নামতেই ওর চোখ আটকে গেল পুড়ন্ত বাংলোর দেউড়িতে।

বীভৎস দৃশ্যটা দেখে আরেকটু হলে বমিই করে ফেলতো ও। দেউড়ির চৌকাঠ থেকে কড়িকাঠের সঙ্গে ঝুলছে একজন মানুষের দেহ। গলায় তীব্র টানে মুখ দিয়ে তার জিভ বেরিয়ে এসেছে আধ-হাত, টক-টকে লাল অক্ষিগোলক দুটো মনে হচ্ছে টুপটুপ করে যেকোনো সময় কোঠর থেকে ঝরে পড়বে। তবে এর চেয়ে বীভৎস ব্যাপার; লোকটাকে স্রেফ ঝুলিয়েই ক্ষান্ত হয়নি খুনিরা, তার পেট কেটে দিয়েছে। যার ফলে তার নাড়িভুঁড়ি সব কাটা পেট থেকে বেরিয়ে কিছু নিচে পড়ে আছে কিছু ঝুলছে কাটা তলপেট থেকে। যে মানুষটাকে একটু আগেও মতলব ঠাকুর নামে চিনত পৃথিবীর মানুষ তাকে দেখে কোনোভাবেই আর পরিপূর্ণ মানুষ বলার উপায় নেই। অপার্থিব একটা জীব মনে হচ্ছে।

নিজেকে সামলে ধীরে ধীরে বাংলোর সামনে এসে দাঁড়াল হেনরি। তার সৈনিকেরা ছুটোছুটি করে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে। চিৎকার চেঁচামেচি করছে। এসবের কিছুই কানে ঢুকছে না হেনরির। ঠাকুরকে সে নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। একমাত্র তার কারণে এরকম বীভৎস মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে মানুষটাকে।

মতলব ঠাকুরের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো কান্নায় ভেঙে পড়ল উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *