অধ্যায় পনেরো – বর্তমান সময়,
বড়বাজার এলাকা, ময়মনসিংহ
‘কিছুই বের করা গেল না, এ কেমন কথা?’ রাগের চোটে বাশারের মনে হচ্ছে ও আবারো অজ্ঞান হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে সে দাঁড়িয়ে আছে ময়মনসিংহ শহরের সবচেয়ে বড়ো পাবলিক লাইব্রেরির রিডিং রুমে। তার সামনে বসে আছে লাইব্রেরির অ্যাসিসটেন্ট এক ছেলে। মেঝেতে ছড়ানো বেশ কিছু পুরনো পত্রিকা বাশার একটু রাগের সঙ্গেই ছেলেটাকে ধমক দিয়ে বলল, ‘আরেকবার দেখতে সমস্যা কোথায়?’
ছেলেটা একটু অসহায় দৃষ্টিতেই ওর দিকে মুখ তুলে তাকাল। পুলিশের লোক কিছু বলতেও পারছে না, আবার কাজটাও করতে ইচ্ছে করছে না। ‘স্যার, দুইবার দেখলাম। যেইডা নাই তো নাই। আরেকবার দেখলে ক্যামনে পামু, কইন।’
বাশার আবারো ধমকের সুরে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু নিজেকে সামলে নিলো। নিজের অসহায়ত্বের দায়ভার এই ছেলেটার ওপরে চাপানোর কোনো মানে হয় না। নিজেকে সংযত করে বরং ছেলেটাকে ইশারা করল আরেকবার পরীক্ষা করে দেখার জন্যে। ও নিজেও জানে ফলাফল শূন্য হবে।
আগের দিন থানার রেকর্ড রুমে ঢুকে নির্দিষ্ট সময়ের কোনো রেকর্ড না পেয়ে তাজ্জব হয় যায় ওরা। সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষকে জানানো হয় ব্যাপারটা, কিন্তু কেউই সঠিকভাবে কলতে পারছে না কীভাবে থানার ভেতর থেকে রেকর্ড হারিয়ে গেছে। ওপর মহলে যোগাযোগ করে খুব একটা সুবিধে করতে না পেরে, আবদুল্লাহ আর রমিজকে নিয়ে সকাল থেকে কাজে নেমে যায় ও।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে বাশার কিছুদিন পত্রিকায় সাংবাদিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। সেই সূত্রে ও জানে প্রায় প্রতিটা পত্রিকা অফিসেই পুরনো কাগজের রেকর্ড থাকে। প্রশ্ন হলো এত পুরনো কাগজেরটা থাকবে কি না। প্রথমেই ওরা যায় স্থানীয় একটা পত্রিকার অফিসে। সেখানে গিয়ে পুরনো কপি খুঁজে বার করতে পারেনি। এরপর আরেকটা পত্রিকার অফিসে গিয়ে সেখানেও খুব বেশি লাভ হয়নি। কারণ ওদের কাছে পুরনো পত্রিকার রেকর্ড থাকলেও স্টোর রুমে ঢুকে দেখা যায় সেখানে পুরনো পত্রিকা সব পোকায় কেটে শেষ করে ফেলেছে। পুরনো পত্রিকা কারো প্রয়োজন না হওয়াতে কয়েক বছরের ভেতরে পুরনো স্টোর রুম খোলা হয়নি আর ব্যাপারটাও কেউ টের পায়নি। ওখান থেকেও ব্যর্থ মনোরথে বের হয়ে ওরা থানার দিকে যাচ্ছিল এমন সময় বাশারের মনে হয় আরেকটা জায়গাতে পত্রিকা রাখা হয়ে থাকে।
সেটা হলো লাইব্রেরি।
লাইব্রেরিতে গেলে পুরনো পত্রিকা পাওয়া যেতে পারে। সেই হিসেবে ওরা জিপ ঘুরিয়ে চলে আসে বড়ো বাজারে অবস্থিত পাবলিক লাইব্রেরিতে। এখানে এসে আবদুল্লাহ আর রমিজকে জিপে অপেক্ষা করতে বলে ও চলে যায় ভেতরে। ভেতরে এসে পুরনো পত্রিকার রেকর্ড দেখতে চাইলে লাইব্রেরির এই অ্যাসিসটেন্ট ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে পুরনো রেকর্ড রুমে চলে আসে ওরা। সেখানে এসে নির্দিষ্ট বছরের পত্রিকা খুঁজে বের করে একে একে দেখতে শুরু করে। নির্দিষ্ট মাসের কপির কাছে আসতেই বাশার-আর সঙ্গে আসা ছেলেটাও অবাক হয়ে আবিস্কার করে সব পত্রিকা থাকলেও, বাঁধাই করা রেকর্ডের ভেতরে বাশার যে সময়ের পত্রিকা খুঁজছে সেই সময়ের কোনো কাগজ নেই।
ব্যাপারটা দেখে যতটা না তাজ্জব হয় তার চেয়ে বেশি বোকা বনে যায় বাশার। এর মানে কী? এটা কীভাবে সম্ভব? ছেলেটাকে নিয়ে আবারো চেক করতে বসে ও। এবার নিজেও হাত লাগায় বাশার। অবাক হয়ে আবিস্কার করে পুরো মাসের পত্রিকা আছে শুধুমাত্র যে সময়টা সে খুঁজছে সেই সময়ের দু সপ্তাহের পত্রিকা গায়েব। সঙ্গে সঙ্গে গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যায় ওর। থানার রেকর্ড খুঁজে না পেয়ে ওর মনের ভেতরে একবারের জন্যে খটকা লাগছিল। মনে হচ্ছিল হয়তো ব্যাপারটা অ্যাক্সিডেন্ট। হয়তো রেকর্ড রুম সরানোর সময়ে বা অন্য কোনোভাবে রেকর্ডটা হারিয়ে গেছে কিন্তু এখন যা দেখল তাতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে : কেউ একজন ইচ্ছে করেই ওই সময়ের সমস্ত রেকর্ড সরিয়ে ফেলেছে। তার মানে ও যা ভাবছে ব্যাপারটা তাই।
ওরা পুকুরের পানির নিচে যে গাড়িটা খুঁজে পেয়েছে সেটা আসলে বড়ো কোনো ঘটনার বিচ্ছিন্ন অংশ। মূল ঘটনা আসলে ভিন্ন কিছু। ওই সময়ে নিশ্চয়ই এমন কিছু ঘটেছিল। যেটা কেউ বা কারা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
‘স্যার, নাইকা।’
‘হুম?’ নিজের ভাবনার জগতে হারিয়ে গিয়ে ও ভুলতে বসেছিল যে ছেলেটাকে আবারো পত্রিকাগুলো চেক করে দেখতে বলেছে। ‘নেই না?’
‘হ, স্যার। আমি তো আপনেরে আগেই কইছিলাম,’ বলে ছেলেটা গজ-গজ করতে করতে পত্রিকার বান্ডিল গুছিয়ে রাখতে শুরু করল।
‘সেইটাই,’ বলে ও পকেট থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে ছেলেটার দিকে বাড়িয়ে ধরল। ছেলেটা একবার ওর দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার তাকাচ্ছে বাড়িয়ে দেওয়া নোটটার দিকে। নিবে কিনা বুঝতে পারছে না।
‘কী হলো? নে।’
বাশার ধমক দিতেই ছেলেটা খপ করে নিয়ে নিলো সেটা। এখনো অবিশ্বাসের দৃষ্টিতেই তাকিয়ে আছে। নোটটা হাতে নিয়েও দেখতে লাগল। ‘স্যার, আপনে আসলেও পুলিশ তো?’
ঘুরে দাঁড়াতে গিয়েও ছেলেটার মন্তব্য শুনে হেসে ফেলল বাশার। একগাল হেসে নিজেকেই শুনিয়ে বলল, ‘পুরোপুরি আর হতে পারলাম কই?’ লাইব্রেরির গেট দিয়ে বের হবার সময়ে মোবাইলটা বের করে আনলো পকেট থেকে।
এদিকে কোনো অগ্রগতি তো হলো না, দেখা যাক টমি পোদ্দারের কাছ থেকে কোনো খবর পাওয়া যায় কিনা। মোবাইলে নম্বর বের করতে করতে নিচে নেমে এসেছে এমন সময় একজনের সঙ্গে ধাক্কা লাগল। আরেকটু হলেই ওর হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে যাচ্ছিল। একটু বিরক্ত হয়েই ফিরে তাকাল লোকটার দিকে।
রাগের সঙ্গে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগে লোকটাই কথা বলে উঠল। ‘এই যে ভাই, পুলিশ হইছেন দেখে কী….?’
নীল শার্ট পরা লোকটা কথা শেষ না করেই থেমে গেল। বাশারও একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ও কিছু বলার আগে লোকটাই বলে উঠল, ‘আরে,বাশু না? তুই এতদিন পরে?’
মুহূর্তের জন্যে বাশারের স্মৃতি ঝলসে উঠল মনের ভেতরে। চকিতে মনে পড়ে গেল চেহারাটা। ‘জামিল, তুই!’
‘বন্ধু, কতদিন পর,’ বলে ওকে জড়িয়ে ধরল ছোটোবেলার জামিলের মোটা ভার্সন। ‘তুই মমিসিং আইছোস আমি শুনছি। আজব কাণ্ড, কারো সঙ্গে যোগাযোগ না, কারো সঙ্গে দেখা করলি না। শালা মস্তবড়ো অফিসার হয়া গেছ!
নিজেকে জামিলের আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সোজা হলো বাশার, ‘আরে না, ওরকম কিছু না। হঠাৎ এমনভাবে চলে এলাম আসলে কারো সঙ্গেই যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি। তুই এরকম মোটা হয়েছিস কীভাবে! আজব কাণ্ড।’ বাশারের মনে পড়ে গেল ও আর জামিল একই এলাকায় থাকত, ওরা একসঙ্গে স্কুলে যেত। ও ছিল ভীষণ মোটা আর জামিল ছিল ভীষণ শুকনো। এই নিয়ে ওদের দুজনকেই ছোটোবেলা বহুত দুষ্টামির শিকার হতে হয়েছে।
‘হা-হা, তুই ছিলি মোডা, আমি ছিলাম হুগনা। এহন তুই হুগায়া গেছস। আর আমি বাগুনের মতোন মোডা অয়া গেছি। হা-হা। চল-চল এই বিল্ডিঙের তিনতালায় আমার ছোটোখাটো একটা অফিস আছে, চল। রেন্ট-এ-কারের ব্যবসা করি আমি।’
‘আজ না বন্ধু, আজ খুব ঝামেলায় আছি। আরেকদিন আসবো। তোদের বাসায়ও যাবো। ডলি আপা কেমন আছে?’ জামিলের বড়ো বোন ডলি আপা ওকে খুব আদর করত।
‘ডলি আপা তো কানাডা চলে গেছে পরিবারসহ। আসে, তিন-চার বছর পরে- পরে একবার আসে। চল, অফিসে না গেলেও বাইরে চা খাই। তুই কি বিড়ি খাস?’
মৃদু হেসে মাথা নাড়ল বাশার।
‘শালা, কলেজে থাকতে নিজে তো বিড়ি খাইতাই না আমরা ধরাইলে তেজ দেখাইতা। এখন কেমন লাগে?’ দুজনেই হেসে উঠল ওরা। লাইব্রেরি ভবনটার বাইরেই চায়ের দোকানে এসে দাঁড়াল দুজনে। একহাতে চা নিয়ে অন্যহাতে সিগারেট ধরিয়ে কথা বলতে লাগল।
‘অন্তু, উজ্জ্বল-ওরা সবাই ভালো আছে?’ বাশার পুরনো বন্ধুদের কথা জানতে চাইল।
‘হ্যাঁ, সবাই ভালো আছে। তুই তো কারো খবরই রাখস নাই?’ বলে চায়ে চুমুক দিল জামিল, ‘আচ্ছা তোরে একটা কথা জিগাই। তোর হঠাৎ হইলো কী যে তুই সবার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ কইরা দিলি? আমার মনে আছে তুই যখন বিদেশ ছিলি তখনো আমগো সবাইরে নিয়মিত কল দিতি। এরপর তোর হইলো কী?’
বাশার কিছু না বলে সিগারেটে টান দিল। কী বলবে, কথা হাতড়ে বেড়াচ্ছে এমন সময় আবারো জামিলই প্রশ্ন করে উঠল। ‘আচ্ছা রাজু নাকি মারা গেছে?’
বাশার মনে মনে খাবি খেল। ও জানত এই প্রসঙ্গটা আসবে। চায়ের কাপ থেকে মুখ উঠিয়ে জামিলের দিকে তাকিয়ে শুধু মাথা নাড়ল।
আন্টি মারা যাবার সময়ে তুই নাকি ছিলি না, এরপর আবার রাজু মারা গেছে শুনলাম। আরো অনেক কথাই হুনছি। আসলে ব্যাপারটা কী, বল দেখি?’ জামিলের চোখে মুখে কৌতূহল।
বাশার কিছু না বলে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল। কী বলবে আসলে বুঝতে পারছে না। ও ভেবেছিল গত কয়েক বছরে যা-যা ঘটে গেছে সেগুলো খুব বেশি ছড়ায়নি কিন্তু জামিলের কথা শুনে পরিষ্কার বুঝতে পারল সবাই সব জানে। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে সেটা দোকানিকে ফিরিয়ে দিয়ে জামিলের কাঁধে একটা হাত রাখল ও। ‘দোস্ত আসলে অনেক কিছুই ঘটে গেছে…’ কথা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই চোখে পড়ল ব্যাপারটা।
একটা গাড়ি।
আর দশটা সাধারণ গাড়ি থেকে আলাদা করে লক্ষ্য করার কোনো কারণই ছিল না কিন্তু তারপরও ওর চোখে পড়ল গাড়িটা। কারণ আর কিছুই না গাড়ির ভেতরে বসে থাকা মানুষটা।
বাংলাদেশে সাধারণত সাদা চামড়ার লোকজন কমই দেখা যায়। আর একারণেই পথে-ঘাটে হাজারো মানুষের ভিড়ে দু-চারটা সাদা চামড়ার মানুষ দেখলে সহজেই চোখে পড়ে সেটা। এখানেও ব্যতিক্রম কিছু নয়। বাশার গাড়িটার দিকে তাকাতেই দেখতে পেল ভেতরে একজন বিদেশি বসে আছে। মানুষটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। বাশার ফিরে তাকানোর পরও লোকটা দৃষ্টি সরালো না। মধ্যবয়স্ক মানুষটার নীল চোখের দৃষ্টি কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইল ওর ওপরে, তারপর সাঁই সাঁই করে উঠে গেল জানালার কাচ, সেই সঙ্গে পিছিয়ে যেতে শুরু করল গাড়িটা।
জামিলের দিকে তাকিয়ে বাশার বলে উঠল, ‘দোস্ত, অনেক কথা আছে। এখন বলতে পারব না। আমি সব জানাবো তোদের। একটু সময় দে আমাকে,’ বলে ও বিল দিতে চাইতেই হা-হা করে উঠল জামিল। বাশার দৌড়ে চলে এলো গাড়িটা যেখান থেকে পেছন দিকে গেছে সেখানে। ওটা এখন মূল রাস্তায় উঠে যাচ্ছে। গাড়িটা দেখার পর বুঝতে না পারলেও হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে ও। কারণ এই গাড়িটাই গত কয়েকদিন যাবৎ ওর পিছু নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে ওর কাছে। সরাসরি কিছু না দেখলেও পথে আসতে যেতে থানার সামনে বারবার একটা সাদা গাড়িকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে ও। সাদা রঙের গাড়ি পথে-ঘাটে প্রচুর আছে কিন্তু এর আগেও দিনও একটা সাদা গাড়িকে ও জিপের পেছনে আসতে দেখেছে যেটার সামনের একটা লাইট ভাঙা ছিল।
এই গাড়িটারও একটা লাইট ভাঙা।
বাশার খানিকটা দৌড়ে এসে থেমে গেল। গাড়িটা গলি থেকে মূল রাস্তায় উঠে গেছে। ও কী করবে ভেবে ঠিক করার আগেই আবদুল্লাহ জিপ নিয়ে এসে ওর পাশে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক করল। ‘স্যার, স্যার আহেন।’ এক লাফে উঠে বসল ড্রাইভারের পাশের সিটে।
‘ওই রাস্তায়,’ কোনদিকে যেতে হবে বাশার দেখাতেই আবদুল্লাহ জিপ ছেড়ে দিল। গলি থেকে মূল রাস্তা বেশি দূরে না। তবে ওদের কপাল খারাপ একটু এগোতেই গলির মুখে দুটো রিকশা একটা আরেকটাকে ক্রশ করতে গিয়ে দুই চাকায় লাগিয়ে বসল। একটার স্পোকের সঙ্গে আরেকটার কোনা লেগে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। ওটা ঠিক করে দুই রিকশা সরিয়ে মূল রাস্তায় উঠে দেখল লাইট ভাঙা সাদা গাড়িটার কোনো অস্তিত্বই নেই।
‘ধুর,’ বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠল বাশার।
‘স্যার কি কেউরে ধরবার চাইছিলাইন নাকি?’ রমিজ দারোগা জানতে চাইল।
‘আর সেটা বলে কী লাভ?’ বাশার মনে মনে ভাবছে কে এই বিদেশি? আর সে কি আসলেই ওদেরকে ফলো করছে, নাকি পুরো ব্যাপারটাই ওর মনের ভুল? এখন আর বোঝার উপায় নেই।
আবদুল্লাহ জিপটাকে মূল রাস্তায় তুললেও এখন ওটাকে সাইড করে রেখেছে। ‘স্যার, কোনদিকে যাবো?’
‘দাঁড়াও বুঝে নেই,’ বাশার আসলে বুঝতে পারছে না ওর কী করা উচিত।
‘লাইবেরির ভিরে কিছু পাইলেন, স্যার?’ আবদুল্লাহ জানতে চাইল।
‘নাহ, সেখানেও পেলাম না,’ বাশার আফসোসের সুরে বলল। ও মোবাইল বের করে টমির নম্বর খুঁজছে।
মানে কী? এত আগের পত্রিকা নাই?’
‘সব পত্রিকা আছে, শুধু আমাদের যে সময়ের দরকার সে-সময়েরটা নেই,’ বলে ও রমিজ দারোগার দিকে ফিরে বলল। ‘থানায় যেমন কেউ রেকর্ড নষ্ট করেছে ঠিক তেমনি এখানেও একই কাজ করেছে কেউ একজন। ওই সময়ের রেকর্ড নষ্ট করেছে।
‘সর্বনাশ! এইডা তো…’
‘আচ্ছা ময়মনসিংহ শহরে আর কোথায় পুরনো পত্রিকা পাওয়া যেতে পারে?’ ও রমিজ দারোগার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল।
‘স্যার, মুসলিম ইন্সটিটিউটে গেলে পাইতে পারেন। ওইহানে দেখছি এইরকম পত্রিকা-টত্রিকা রাহে।’
বাশার মোবাইলটা নামিয়ে নিলো। ভালো একটা জায়গার কথা বলেছে রমিজ দারোগা। মুসলিম ইন্সটিটিউটের কথা ওর আগেই মনে আসা উচিত ছিল। ‘গাড়ি ঘোরাও। নতুন বাজারের দিকে চলো।’
ও মনে মনে ঠিক করে ফেলল, টমিকে কল দিয়ে লাভ নেই, তারচেয়ে মুসলিম ইন্সটিটিউটে যেতে চাইলে নতুন বাজার হয়েই যেতে হবে। কাজেই ওখানে একবারে গেলেই হবে। ‘নতুন বাজারে ওইদিন গেছিলাম যে ওই অফিসে চলো।’
আবদুল্লাহ জিপ ঘুরিয়ে রওনা দিল নতুন বাজারের দিকে। আর বাশার ডুবে গেল নিজ ভাবনায়। পরিস্থিতি শুধু জটিল থেকে জটিলতরই হয়ে চলেছে। মুসলিম ইন্সটিটিউটে গিয়েও কিছু না পায় তবে ঢাকাতে যোগাযোগ করবে ও। পুরনো সাংবাদিক বন্ধুদের কাউকে ধরতে হবে ওই সময়ে কী ঘটেছিল সেটা জানার জন্যে। কেউ না কেউ তো জানবেই আসলে কী ঘটেছিল সেই সময়ে। তবে তার আগে কল দিতে হবে টমি পোদ্দারকে। ইতিমধ্যে সে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু বের করেছে।
কিন্তু কল করে তাকে পাওয়া গেল না। মোবাইল বন্ধ। বাশারও আর ডায়াল করল না। কারণ ওরা নতুন বাজারের কাছাকাছি চলে এসেছে।
ল্যাবের কাছাকাছি এসে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক করল জিপ। আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগাকে রিসিপশনে বসিয়ে ল্যাবে প্রবেশ করল বাশার।
সেই একই সিকিউরিটি, একই রকম নতুন রং আর অ্যান্টিসেপ্টিকের গন্ধ পার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করে কাউকে দেখতে পেল না ও। আগের দিনের মতোই পুরো টেবিলের ওপরে জিনিসপত্র ছড়ানো। একপাশে গ্যারেজের মতো জায়গায় রাখা গাড়িটা। ওটাকে আরো খুলে টুকরো টুকরো করা হয়েছে। অন্যপাশে কম্পিউটার খুলে রাখা কিন্তু টমির ছায়াও দেখা যাচ্ছে না। বাশার কম্পিউটার টেবিলটার সামনে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। পকেট থেকে বের করল ডায়েরিটা। এর আগের দিন ল্যাবে এসে কী কী দেখেছে সেগুলোর ওপরে একবার চোখ বুলানোর জন্যে নির্দিষ্ট পাতায় আসার আগেই পেছন থেকে অকৃত্রিম গলা ভেসে এলো টমির। ‘আরে ভাই, কী অবস্থা? গতকাল থেকে আপনাকে খুঁজে পাচ্ছি না!’ ঠিক অভিযোগ নয় অনেকটা অনুযোগের সুরে বলে উঠল সে।
তাজ্জব হয়ে তার দিকে ফিরে তাকাল বাশার। হাতের ডায়েরিটাও বন্ধ করতে ভুলে গেছে। ‘আশ্চর্য কাণ্ড! আমি আপনাকে কল করে পেলাম না আর আপনি আমাকে দোষারোপ করছেন। একটা কল দিলেই তো পারতেন। গতদিনই তো আপনাকে আমার নম্বর দিয়েছিলাম।’
‘ওহ হো, আপনাকে কল দিলেই তো হতো,’ বলে সে একটু মাথা চুলকালো। ‘এটা মাথায়ই আসেনি।’
আবারো বোকার মতো তাকিয়ে রইল তার দিকে বাশার। লোকটা ওর সঙ্গে মজা করছে নাকি বুঝতে পারল না।
নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ল টমি।
‘তা বলেন কাজের অগ্রগতি কী? নতুন কিছু পেলেন?
‘কাজের অগ্রগতি তো অবশ্যই হয়েছে। বরং বেশ ভালো অগ্রগতিই হয়েছে বলা চলে। একটা একটা করে বলছি, বলে সে টেবিলের ওপরে কাগজপত্র ঘাঁটতে লাগল। ‘কী কী ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আলোচনা করব সেটা কোথায় জানি লিখে রেখেছিলাম,’ সে কাগজপত্র এদিক-সেদিক করছে কিন্তু নির্দিষ্ট কাগজটা পাচ্ছে না। ‘কী যন্ত্রণা! গেল কোথায়। আমার তো আবার কিছুই মনে নেই,’ বলে সে কাগজ ঘাঁটা বাদ দিয়ে আবারো মাথা চুলকাতে লাগল। ‘আরে! ওগুলো তো লিখেছিলাম ট্যাবে, কাগজ পাবো কোথা থেকে!’ বলে সে বাশারের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে ডেস্কটপের টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ট্যাব বের করে আনলো। হুম, এই যে। প্রথমত, মনিকা ম্যাডাম গলায় ফাঁস দিয়ে ভিক্টিমের মৃত্যুর ব্যাপারটা কনফার্ম করেছেন।
ডক্টর মনিকার চেহারাটা মনে পড়তেই বাশারের রক্তে অ্যাড্রেনালিনের প্রবাহ একটু বেড়ে গেল। মনে পড়ে গেল তার লাস্যময়ী হাসি। জোর করে মন থেকে সেটা দূর করে ও জানতে চাইল, ‘সেটা তো উনি সেদিনই বলেছিলেন।’
‘সেদিনের ব্যাপারটা অনুমান ছিল। এখন অফিসিয়াল প্রমাণ পাওয়া গেছে, ‘ বলে সে ড্রয়ার থেকে কাগজটা বের করে বাড়িয়ে দিল বাশারের দিকে। বাশার ওটা হাতে নিয়ে দেখল ওটাতে জায়গামতো পরিষ্কার লেখা আছে ব্যাপারটা। রিপোটর্টা নামিয়ে আবারো চোখ তুলে তাকাল টমির দিকে।
‘দ্বিতীয়ত, ঢাকায় আরেকটা জিনিস পাঠিয়েছি আমি খবর নেওয়ার জন্যে। যদিও এটার পেছনেও মূল কৃতিত্ব ডক্টর মনিকার। এদিকে দেখুন,’ বলে সে মনিটরটা বাশারের দিকে ঘুরিয়ে দিল। ‘এটাকে আসলে কী নামে ডাকা হয় আমি জানি না, তবে আমরা এটাকে বলি ‘ফেস রিকভারি’। এই বিশেষ সফটওয়্যারটা দিয়ে যেকোনো ধরনের মানুষের চেহারা আবিস্কার করা হয়ে থাকে।’
‘চেহারা আবিস্কার করা হয়ে থাকে মানে কী?’ বাশার একটু অবাক যেমন হয়েছে তেমনি আগ্রহও বোধ করছে। ‘চেহারা কি আবিস্কার করার জিনিস?’
‘কখনো-কখনো চেহারাও আবিস্কার করার জিনিস,’ বলে বাশারের দিকে তাকিয়ে একটু রহস্যময় হেসে টমি পোদ্দার কি-বোর্ড আর মাউজ নিয়ে নড়াচড়া শুরু করে দিল। ‘এই দেখুন,’ বলে সে মনিটরের দিকে ইশারা করল। ‘এটা হলো যে মানুষটার কঙ্কাল, যেটা আমরা পেয়েছি পানির নিচে গাড়ির ভেতরে। আর এটা হলো তার খুলির হলো গ্রাফিক চিত্র। এটাকে ইনপুট দিয়ে তার শারীরিক গঠন থেকে শুরু করে সম্ভাব্য সমস্ত তথ্য এন্ট্রি দেওয়ার পর এই সফটওয়্যার মোটামুটি আনুমানিক একটা চেহারা দাঁড় করিয়ে দিতে পারে।’
‘তাই নাকি? দেখি তো এই লোকের চেহারা কেমন ছিল,’ এতক্ষণে বাশার পুরোপুরি আগ্রহ বোধ করতে শুরু করেছে।
ডিটেইলিং আসলে ডক্টর মণিকার করা। আর উনি যেহেতু এই লাইনেরই অভিজ্ঞ মানুষ কাজেই বলা চলে যে চেহারাটা পাওয়া গেছে সেটা আসলের প্রায় কাছাকাছিই হবে,’ বলে সে মাউজে ক্লিক করে একটা ইমেজ ফাইল ওপেন করল। ‘সব প্রস্তুত করে ইনপুট দেওয়ার প্রায় তিন ঘণ্টা পর সফটওয়্যার এই চেহারাটা উপহার দিয়েছে আমাদেরকে,’ বলে সে মনিটরটাকে পুরোপুরি ঘুরিয়ে দিল বাশারের দিকে।
বাশার তাজ্জব হয়ে চেহারাটার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। মুহূর্তের জন্যে ওর মনে হলো বাকশক্তি হারিয়েছে। একটু স্থির হয়ে সে ছবিটার দিকে তাকিয়েই কথা বলে উঠল, ‘চোখদুটো ঠিক হয়নি,’ বলে সে ফিরে তাকাল টমির দিকে। আপনারা সম্ভবত ইউরোপিয়ান মনে করে নীল চোখ বসিয়েছেন। কিন্তু মানুষটার চোখ আসলে নীল না। পিঙ্গল রঙের।
এবার টমির তাজ্জব হবার পালা। ‘আপনি জানলেন কীভাবে? এই লোককে চিনতে পেরেছেন নাকি?’
‘চিনতে পারিনি, আবার পেরেছিও। তার পরিচয় না জানলেও আজ সকালেই এই লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার পাবলিক লাইব্রেরির সামনে। একটা সাদা রঙের গাড়িতে করে আমাকে অনুসরণ করছিল সে,’ টমি পোদ্দারের হাঁ হয়ে থাকা মুখের সামনে দাঁত বের করে একটা তিক্ত হাসি দিল বাশার।