অধ্যায় বত্রিশ – বর্তমান সময়
শশীলজ, কাচারি রোড, ময়মনসিংহ
সবাই একসঙ্গে এসেই বা লাভটা হলো কী?’ কড়া রোদে ঝলসাতে থাকা শশীলজের দিকে তাকিয়ে জয়া আনমনেই বলে উঠল।
সূর্য তার শেষ বিকেলের উত্তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে শশীলজের পুরনো ভবনগুলোর ওপরে। কড়া রোদের ভেতরে দাঁড়িয়ে মাথা থেকে টুপিটা খুলে নিতেই কপাল থেকে টুপ করে এক ফোঁটা ঘাম গড়িয়ে পড়ল বাশারের। কীভাবে যেন ঘামের ফোঁটাটা কপাল থেকে নেমে সানগ্লাস আর ভ্রুর মাঝখানের ফাঁক দিয়ে ঢুকে সরাসরি চলে গেলে চোখের ভেতরে। চোখ জ্বালা করে উঠতেই পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখটা মুছতে যাবে তার আগেই জিপের হুডের ওপরে বসে সিগারেট টানতে থাকা জয়া আবারো কথা বলে উঠল।
‘এভাবে হবে না,’ বলে সে একরাশ ধোঁয়া ছুড়ে দিয়ে যোগ করল। ‘আমরা ভুল করছি। এভাবে খুঁজতে গেলে মাসের পর মাসপার হয়ে গেলেও কিছুই পাওয়া যাবে না।’
জয়ার দিকে তাকিয়ে প্রথমেই বাশারের মনে হয় এই মেয়ে বিড়ি খেতেও পারে। তার কথায় চূড়ান্ত বিরক্তি বোধ করলেও বাশার মনে মনে ভাবল সে ঠিকই বলছে। ‘কিন্তু এছাড়া আর করারই বা আছে কী?’
‘ওই দেখো, তোমার সুন্দরী বান্ধবী আর তার সার্চ পার্টি ফিরে আসছে। আমি নিশ্চিত এবারও ওরা কিছুই পায়নি,’ জয়া সিগারেটটা অর্ধেক টেনে সেটা বাড়িয়ে দিল বাশারের দিকে। নিবে না ভেবেও সিগারেটটা নিয়ে টান দিল ওতে। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ও সম্ভাব্য পরিকল্পনা ঠিক করার চেষ্টা করতে লাগল।
ওরা এই মুহূর্তে অবস্থান করছে শশীলজ মানে ময়মনসিংহ মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ভেতরে আম গাছতলা নামে একটা জায়গা আছে সেখানে। গতকাল রাতে ডেভিডের মূর্তি লুকানোর ব্যাপারটা খুঁজে পাবার পর রাতের বেলা কিছুই করার ছিল না। বাশার ফিরে যায় নিজের বাড়িতে, পথে জয়াকে নামিয়ে দিয়ে যায় তার হোটেলে। রিফাত নিজের বাসাতেই ছিল, তার বাড়ির বাইরে পুলিশ পাহারা ছিল।
পর দিন সকাল হতেই বাশার কাজ শুরু করে দেয়। কিন্তু সময় লাগে শশীলজে সার্চ করার জন্যে অনুমতি বের করতে। ওটা করতে করতেই আধাবেলা পার হয়ে যায়। এরপরে বাশারের সময় লাগে আরো কিছু সাপোর্টিং হ্যান্ড জোগাড় করতে গিয়ে। অনুমতিপত্র সংগ্রহ করে নিজের টিম নিয়ে শশীলজে এসে কাজ শুরু করতে করতেই বেলা তিনটে বেজে যায়।
সার্চ পার্টির নেতৃত্ব দেয় রিফাত। কারণ শশীলজের ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো জানে একমাত্র সে-ই। পুরো রাজবাড়িটা এক কথায় বিশাল, তাই ওরা কয়েকটা অংশে ভাগ করে কাজ শুরু করে। কিন্তু দুই ঘণ্টার ওপরে টানা কাজ করার পরেও কোনো ফলাফল নেই। বাশার মনে মনে ভাবল, জয়ার কথা ঠিকই আছে। এই বিরাট রাজবাড়িতে এভাবে অভিযান চালিয়ে একটা তিনফুটি ছোটো মূর্তি খুঁজে বের করা খুবই অসম্ভব একটা কাজ। এটা অনেকটা খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার মতোই, যেখানে সেই সূচটা আদৌ এই গাদায় আছে কি না তার নিশ্চয়তা নেই।
বাশার জিপের দরজা থেকে সামনের দিকে এগিয়ে ফিরে আসতে থাকা সার্চ পার্টির দিকে তাকাল। তারপর তার দৃষ্টি ঘুরে গেল রাজবাড়ির দিকে। ছোটোবেলা থেকে ময়মনসিংহ শহরে বড়ো হবার কারণে এই রাজবাড়ি নিয়ে এমন কোনো গল্প নেই ও শোনেনি। বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে ও মনে মনে ভাবল, এই বাড়ি গল্প করার মতোই। এতশত বছর চলে যাবার পরেও এর সৌন্দর্য এখনো এতটুক মলিন হয়নি। লাল ইটের তৈরি বাড়ি, মেঝেতে মার্বেল, কাচের দরজা, প্রতি রুমে বিরাটবিরাট ঝাড় বাতি। ওর মনে পড়ে গেল ছোটোবেলা ওর খালা এখানে এমএড করার সময়ে প্রায়ই ও এখানে আসত। রুমে রুমে ঘুরে বেড়াত ও। কিন্তু এই মুহূর্তে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে সে কোনো সৌন্দর্য দেখতে পাচ্ছে না। বরং এর সৌন্দর্য আর ব্যাপকতা কেমন যেন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাকে।
‘ফুউফফ,’ বলে রিফাত এসে বসে গেল জিপের একপাশের সিটে। ‘মাই গড! এতবড়ো বাড়ি এভাবে একটা জিনিসের জন্যে সার্চ করা, রীতিমতো অসম্ভব,’ বলে সে বোতল থেকে পানি খেতে লাগল। বাশার দেখল তার পরনের জিন্স আর ফতুয়াতে ময়লা লেগে আছে।
‘কিছুই পাওয়া গেল না?’ ও জানতে চাইল যদিও আসলে উত্তর কী হবে সেটা জানাই আছে।
রিফাত স্রেফ মাথা নাড়ল। ‘কিছুই না। এভাবে সম্ভব, বলো? তবে এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যেতে পারে খোলা জায়গা আর বাড়িগুলোর ভেতরের সাধারণ জায়গা যা আছে আমরা সব খুঁজে দেখেছি। কিছুই পাইনি। পাবার কথাও না। তবে এখনো অনেকগুলো রুম আছে যেগুলো তালা দেওয়া। সেগুলোর ব্যাপারে বলতে পারব না। সেগুলো ঘেঁটে দেখতে চাইলে অনেক ওপরের মহলের অনুমতি লাগবে।’
‘সেগুলোতে কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। কারণ সেগুলো বহু আগে থেকেই বন্ধ। এমনকি ডেভিডের পক্ষেও সেগুলোতে ঢোকা সম্ভব ছিল না। আর তাছাড়া…’ জয়া আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই আবদুল্লাহ ডাক দিল বাশারকে। সে জানাল সার্চপার্টির জন্যে নিয়ে আসা কনস্টেবল দুজনকে থানায় ফেরত পাঠাতে হবে। তাদেরকে বিদায় দিয়ে আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগাকে কিছু একটা খেয়ে আসতে বলল। এসে বাশার আবারো আলোচনায় যোগ দিল।
‘জয়া, একটা কথা বলেছে, কথাটা আমার মনে ধরেছে,’ রিফাত বলে উঠল। তাকে দারুণ উত্তেজিত দেখাচ্ছে। সে পকেট থেকে মোবাইল বের করে আনলো। ‘আমরা আসলে ভুল পন্থায় কাজ করেছি। আরো আগেই এভাবে চিন্তা করা উচিত ছিল। এখানে দেখো,’ বলে সে মোবাইলে একটা ভিডিয়ো প্লে করে দুজনকেই দেখতে বলল। ভিডিয়োটা দেখার জন্যে কাছে যেতেই রিফাতের চুল থেকে মিষ্টি একটা সুগন্ধ মাথায় ঝিম ধরিয়ে দিল বাশারের। মুহূর্তের জন্যে তাল হারিয়ে ফেলেছিল সে, যেই দেখল জয়া তার দিকে তাকিয়ে মিচকি হাসি দিচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে ভিডিয়োতে মনোযোগ দিল। ‘এই দেখ। ওই ভিডিয়োটা আমি সিডি থেকে মোবাইলে ঢুকিয়ে নিয়েছি। এখানে একটা ব্যাপার খেয়াল করো। ডাকাতটা ডেভিডকে মূর্তিটা ধরিয়ে দিল। এর একটু পরেই ডেভিড চলে গেল ভেতরের দিকে। ফিরে এলো পাঁচ-ছয় মিনিটেরও কম সময়ে। ঠিক?
ওরা দুজনেই মাথা নাড়ল। ‘আমার সঙ্গে এসো।’ বলে সে শশীলজের মূল ভবনটার দিকে রওনা দিল। বাশার একবার জয়ার দিকে তাকিয়ে অসহাভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ওর পিছু হাঁটতে লাগল। কিন্তু রিফাত মূল ভবনটার দিকে এগোল না। সে মূল ভবনটা পার হয়ে চলে এলো মূল ভবন আর পুকুর পাড়ের মাঝামাঝি একটা জায়গায়। এখান থেকে বাঁয়ে খানিকটা এগোলে আধুনিক প্রসাশনিক ভবনটা চোখে পড়ে। অন্যদিকে শশীলজের মূল ভবনটা আর সেটার পেছনে বিরাট পুকুরের অনেকটা অংশও পরিষ্কার দেখা যায়।
‘এখানে,’ রিফাত জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ওদেরকে দেখাল। ‘এই জায়গাটাতেই সেদিন প্রদর্শনী হচ্ছিল। এখান থেকে সম্ভবত ওদিক দিয়ে ডেভিড সবার চোখ এড়িয়ে সরে পড়েছিল। আমার প্রশ্ন হলো এখান থেকে পাঁচ বা ছয় মিনিটের ব্যবধানে কোনো জায়গাতে গিয়ে জিনিসটা নিরাপদে রেখে আর এই পাঁচ-ছয় মিনিটের ব্যবধানে ফিরে আসা সম্ভব? এখানে একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে ডেভিড এমন কোনো জায়গায় জিনিসটা রাখবে না যাতে কারো চোখে পড়ে যায়। কারণ সে ভালোভাবেই জানত ডাকাতি হতেই পুলিশ আসবে আর ওরা এলে প্রথমে এখানেই সার্চ করবে। আর পুলিশ সেটা করেছিলও কিন্তু কিছু পায়নি কাজেই জিনিসটা যদি থেকে থাকে তবে ওটা এখানেই কোথাও আছে। আমার অনুমান জিনিসটা আছে হয় ওই মূল ভবনটার কোথাও, আর না হয় পুকুরের ঘাটের আশপাশে কোনোদিকে আর না হয় ওই ওটাতে,’ বলে পুকুর পাড়ের বিরাট স্নানাগারটা দেখাল। আমরা এই কয়টা জায়গাতেই দেখবো। জয়া, তুমি যাবে ওই স্নানাগারে, আমি আবারো দেখবো মূল ভবনটা আর বাশার, তুমি দেখবে পুকুরের আশপাশটা আর পুকুরের বিরাট বাঁধানো ঘাঁট।
রিফাতের কথামতো ওরা ছড়িয়ে পড়ে খুঁজতে শুরু করল। ওরা দুজনে দুদিকে চলে যেতেই বাশার এসে দাঁড়াল পুকুর পাড়ে। ওর মনে পড়ল ছোটোবেলা এই পুকুরপাড়ে ওরা খেলতো। বিশেষ করে এই পুকুর পাড়ে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভট ফলের গাছ ছিল যেগুলো অন্য কোথাও দেখেনি ও। আশপাশে তাকিয়ে গাছ- গাছড়ার জঙ্গলের ভেতরে এখনো দুয়েকটা গাছে অন্যরকম ফল চোখে পড়ল। গাছ খুঁজতে তো আসেনি, যা খুঁজতে এসেছে সেটাই করার চেষ্টা করল কিছুক্ষণ। সুন্দর বাঁধানো পুকুর ঘাটের আশপাশে খুঁজে বেড়াল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো নিচের দিকে।
পুকুরের বাঁধানো ঘাট থেকে দুইপাশে দুইটা পাথওয়ের মতো এগিয়ে গেছে। দূর থেকে দেখতে জিনিসটা অনেকটা লাগে ইংরেজি আক্ষর ‘U’ এর মতো। দুইপাশে দেখতে দেখতে ইউয়ের দুই মাথার একটার একেবারে কিনারায় চলে এলো ও। ইউয়ের মাথা দুটো আবার অষ্টভুজ আকৃতির। ওর মন বলছে এই পুকুর পাড়ে কিছুই পাওয়া যাবে না। ইউয়ের মাথায় এসে বসে পড়ল ও। পকেট থেকে সিগারেট প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগল। রোমন্থন করতে লাগল ছোটোবেলার স্মৃতি।
ছোটো খালা ওকে ভীষণ আদর করত। বলতে গেলে কখনো কখনো ওর মায়ের চেয়েও বেশি। ওরা গ্রামে থাকত, ওকে নিয়ে মাঝে মাঝে শহরে আসত। এটা-ওটা কিনে দিত। আর বিশেষ করে এখানে পড়ার সময়ে প্রায়ই ওকে নিয়ে আসত রাজবাড়িতে। খালা ক্লাস করত আর ও বসে থাকত বাইরে কিংবা এই পুকুর পাড়ে। ওর মনে পড়ল, এখানে একটা বুড়ো দারোয়ান ছিল, সে ওকে এই রাজবাড়ি নিয়ে নানা গল্প শোনাতো। বিশেষ করে এই পুকুর নিয়ে। এই পুকুরের তলায় নাকি সিন্দুক আছে। সেগুলো নাকি জিন পাহারা দিয়ে রাখে। এই রাজবাড়ির কোথায় নাকি একটা সুড়ঙ্গ পথ আছে যেটার ভেতর দিয়ে নাকি মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ি পর্যন্ত যাওয়া যায়।
হঠাৎ ওর ওই বুড়ো দারোয়ানের একটা কথা মনে পড়ল। সে বলত এই পুকুর পাড়েই নাকি এই ইউয়ের নিচে একটা বড়ো লোহার আংটা আছে সেটা ধরে টান দিলে নাকি এই সুড়ঙ্গের মুখ খুলে যায়। মনে মনে বাশার হাসল, ছোটোবেলায় এসব গালগল্প গোগ্রাসে গিলতো ও। সিগারেটের মোথাটা পানিতে ছুড়ে দিয়ে হঠাৎ ছোটোবেলার সেই কৌতূহল জেগে উঠল ওর মনে।
আছে নাকি ইউয়ের শেষ মাথার সেই আংটা?
ইউয়ের একেবারে কিনারায় বসে নিচের দিকে উঁকি দিল ও। হালকা সবুজ রঙের পরিষ্কার পানি। প্রায় স্থিরই বলতে গেলে। সবজে রঙের সেই স্থির পানির ভেতরে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে কালচে রঙের লোহার ডান্ডাটা পরিষ্কার দেখতে পেল ও। ইউয়ের শেষ মাথাটা ঠিক যেরকম অষ্টভুজ আকৃতির। লোহার ডান্ডাটার শেষ মাথাটাও ঠিক সেরকমই অষ্টভুজ আকৃতির। মাথা উঁচু করে খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল ও নিজের এই আবিস্কারে। এবার হেঁটে চলে এলো ইউয়ের অন্য মাথায়। এবারও মাটিতে একেবারে শুয়ে পড়ে উঁকি দিল নিচের দিকে। এবার একটু হতাশ হয়ে আবিস্কার করল এটাতে ওরকম কিছু নেই। একটু হতাশ হয়েই উঠে বসতে যাচ্ছিল হঠাৎ ওর গা শিউরে উঠল একটা কথা মনে করে।
‘কী ব্যাপার? কী করছো তুমি?’ হঠাৎ পুকুরের অন্য পাড় থেকে জয়ার ডাক শুনে চমকে উঠল ও। ‘এদিকে এসো একটা জিনিস দেখাই,’ জয়াকে ডাক দিল ও। ‘আমি তো কিছুই পেলাম না, এভাবে খুঁজে আসলে…’ জয়ার কথা শেষ করতে না দিয়ে বাশার বলে উঠল। ‘রিফাত কোথায়? ওকেও ডাকো, একটা জিনিস দেখাতে চাই।’ জয়ার কল পেয়ে ঘেমে নেয়ে একাকার রিফাত একটু পরেই এসে হাজির হলো। ‘কী ব্যাপার, কিছু পেয়েছো নাকি? আমি তো এতবড়ো বাড়ি খুঁজে- খুঁজে হয়রান।
কিছু পেয়েছি কি না জানি না, তবে একটা জিনিস দেখাতে চাই। তার আগে একটা মিথ শুনে নাও,’ বলে ও ছোটোবেলার ঘটনাটা খুলে বলল। ‘এখন এদিকে এসো।’ ও প্রথম ইউয়ের মাথায় এসে আংটাটাকে যেখানে দেখেছিল সেদিকে নির্দেশ করে দেখতে বলল দুজনকেই। ‘কই আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না…’ বলেই জয়া থেমে গেল। ‘শিট, ওই তো।’
‘হ্যাঁ, আছে। কিন্তু এটা দিয়ে তো কিছু প্রমাণ…’ রিফাতের কথার আগেই বাশার ওদেরকে অন্য ইউটার শেষ মাথায় আসতে বলল। ‘এবার এখানে দেখো,’’ বলে একই দিকে নির্দেশ করল।
অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে দুজনেই প্রায় একই সঙ্গে জানাল তারা কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। ‘কিছুই নেই, তাই না?’ বাশার তাকিয়ে আছে দুজনার দিকে।
‘না নেই, বাশার তুমি কি বলতে চাচ্ছো পরিষ্কার করে বলো।’
‘প্রথম ইউয়ের নিচে যে অষ্টভুজের আংটাটা দেখছো হিসেব অনুযায়ী দ্বিতীয় ইউয়ের নিচেও ওরকম একটা আংটা থাকার কথা কিন্তু নেই। কিন্তু এরকম একটা আংটা আমি দেখেছি সম্প্রতি। কোথায় জানো। পুকুরের নিচ থেকে উদ্ধার করা ডেভিডের গাড়ির অন্যন্য জিনিসপত্রের সঙ্গে। আমি নিশ্চিত ওই আংটার সঙ্গে এটার কোনো-না-কোনো সংযোগ আছে।’
দুজনেই চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইল ওর দিকে।
***
‘ব্যাপারটা খেয়াল করো, ডেভিড ফিরে গেল ব্যাগটা হাতে নিয়ে। সে ফিরে এলো স্যুটের গায়ে ডান হাতটা মুছতে মুছতে। তারমানে হতে পারে সে এমন কোনো জায়গায় জিনিসটা রেখেছে বা রাখার জন্যে কিছু একটা করতে হয়েছে যাতে তার হাত ভিজেছে। তো এই জায়গা হতেই পারে,’ বাশার রিফাতের মোবাইলের ভিডিয়োটা আবারো অ্যানালাইসিস করে সবাইকে দেখাল। ওরা এখনো সেই পুকুরপাড়েই বসে আছে।
সন্ধে আসন্ন। আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগাকে পাঠানো হয়েছে নতুন বাজার ল্যাবে। সেখান থেকে জিনিসটা এনে পরীক্ষা করে দেখা হবে। তবে তার আগে অবসর সময়ে ওরা ভিডিয়োটা আবারো অ্যানালাইসিস করার চেষ্টা করছে। বারবার দেখতে দেখতে যদি আরো কিছু বেরিয়ে আসে। একটা জিনিস ওরা যদিও বের করতে পেরেছে।
‘এটাতে আমরা যা দেখতে পাচ্ছি সেটা শুধুই একটা হাইপোথিসিস, একটা মানুষ তার কোটের গায়ে একশ একটা কারণে হাত ঘষতে পারে। সেটা পানি মোছার জন্যেই হবে এমন নাও হতে পারে,’ কথাটা বলে জয়া বাশারের দিকে তাকিয়ে একটা ইশারা করল। ‘তুমি যা বলছ সেটার প্রমাণ হয়ে যাবে আবদুল্লাহরা ফিরে এলেই। দেখা যাক। তবে আমার একটা প্রশ্ন আছে, সেক্ষেত্রে ওই আংটাটা সে বাইরে নিলো কীভাবে?’
‘আশ্চর্য কথা বলো, খুব সহজেই সেটা কোটের ভেতরে ভরে নেওয়া সম্ভব।’
বাশার কড়া গলায় কিছু একটা কথা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগা। আবদুল্লাহর হাতে পত্রিকায় মোড়ানো কিছু একটা। সেটা সে বাড়িয়ে দিল বাশারের দিকে। বাশার জিনিসটা নিয়ে হাতে ধরে একটু ওজন করল। পেপারে মোড়ানো হলেও জিনিসটা লম্বায় দেড় ফিটের বেশি হবে না কিন্তু সে অনুযায়ী এটার ওজন একটু বেশিই পত্রিকার ভাঁজ খুলে পুকুর পাড়ের মার্বেল বেঞ্চের ওপরে রাখল ও। লোহার তৈরি জিনিসটা একটা রডের মতো দেখতে কিন্তু পার্থক্য আছে। রডটার আকৃতি অষ্টভুজের মতো আবার লম্বা মোটা রডের মাথায় অষ্টভুজ আকৃতির একটা গোলক। ‘দেখা যাক,’ কথাটা জয়ার দিকে তাকিয়ে বলে ও পুকুর পাড়ের ইউয়ের শেষ মাথায় গিয়ে টুপি খুলে পাশে রাখল। একেবারে শুয়ে পড়ে দুই হাত লম্বা করে ঘাটের নিচের দিকে ঠেলে দিল রডটাকে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ হাতড়েও কিছুই পেল না। বরং আরেকটু হলেই পড়ে যেতে বসেছিল পানিতে।
‘এভাবে হবে না,’ বলে ও পরনের শার্টটা খুলে ফেলে আবদুল্লাহকে ডাক দিল। ‘আমি শরীরটাকে পানির নিচের দিকে নিয়ে যাবো, তুমি শক্ত করে আমার দুই পা আর কোমর ধরে রাখবে যাতে আমি পড়ে না যাই। আবদুল্লাহ মাথা নাড়ল। তার সঙ্গে রমিজ দারোগাও এসে যোগ দিল। বাশার শক্ত করে দুইহাতে জিনিসটাকে ধরে মাথা নামিয়ে দিল পানিতে। প্রায় কোমর পর্যন্ত ডুবে গেল সবুজ রঙের শীতল পানিতে। পানির নিচে কয়েকবার চোখ পিট পিট করে দৃষ্টি স্বাভাবিক করার ব্যর্থ চেষ্টা করল। তারপর মনোযোগ দিল ঘাটের নিচের দিকে। ইউ আকৃতির মার্বেলের পালিশিং যেখানে শেষ হয়েছে সেটানে একটা লোহার তৈরি কিছু দেখা যাচ্ছে। ওটার ঠিক মাঝখানে গোলচে টাইপের শ্যাওলা ধরা একটা ছিদ্র। জিনিসটা খুঁজে বের করতে করতেই দম ফুরিয়ে গেল ওর। পা ছুঁড়তেই ওকে টেনে তুলে ফেলল ওপরে।
‘কিছু পেলে?’ রিফাত জানতে চাইল। জবাব না দিয়ে আবারো পানিতে ডুব দিল ও। এবা দুই হাতে ধরে শরীরটাকে যতটা সম্ভব নিচের দিকে নামিয়ে লোহার তৈরি জিনিসটার রডের মতো অংশটা ঠেলে দিল সেই শ্যাওলা ধরা গহ্বরের ভেতরে। প্রথমে ঢুকতে না চাইলেও ঠেলাঠেলি করে শ্যাওলা কমে যেতেই একেবারে খাপে-খাপে ঢুকে গেল জিনিসটা। হাঁপাতে হাঁপাতে ওপরে উঠে এলো বাশার। ‘একেবারে…একেবারে খাপে খাপে বসে গেছে জিনিসটা,’ হাঁপাতে হাঁপাতেই বলতে লাগল সে।
‘কই দেখি,’ বলে রিফাত এগিয়ে গেল ইউয়ের শেষ প্রান্তে, সঙ্গে জয়াও আছে। প্রথমে ওদের দুজনের কেউই দেখতে পেল না কিছুক্ষণ পরে অবশ্য চোখ পড়ল সেদিকে। ‘কিন্তু এটাতো বাঁকা হয়ে আছে, মানে অন্যপাশের অষ্টভুজটা যেরকম ওরকম না মোটেই,’ ওদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল রিফাত।
‘হ্যাঁ, সোজা করতে হবে। আর সেটাই হবে আমাদের কাজ। আবদুল্লাহ,’ বলে আবারো পানির নিচে হাত ঢুকিয়ে দিল। এবার আর শরীর ঢোকাতে হলো না। অষ্টভুজের দুইপ্রান্ত শক্ত করে ধরে সর্বশক্তিতে মোচড় দিল। আরো জোরে…আরো জোরে। প্রাণপণ ঠেলেই একবিন্দু নাড়াতে পারল না অষ্টভুজের রিংটা। সোজা করা তো দূরেই থাক।
‘ওরে বাপরে,’ দম ফুরিয়ে হাঁপাতে লাগল বাশার। একটু নড়লোও না।’
‘স্যার, আমি হাত লাগাই,’ বলে এগিয়ে এলো রমিজ দারোগা। এই লোক নিজ থেকে কাজ করতে চাইছে। বাশার অবাক হলেও তাকে এগোতে বলল। এবার বাশার আর সে দুজনে মিলে পানিতে হাত ডুবিয়ে অষ্টভুজের রিংটা দুদিক থেকে ধরে সর্বশক্তিতে মোচড় দিল। প্রথমে মনে হলো এবার বুঝি জিনিসটা দুজনেরই শক্তিতে পরাজিত করবে কিন্তু ধীরে ধীরে চাপ বাড়াতে বাড়াতে একটু নড়ে উঠল রিংটা, তারপর ধীরে ধীরে মাটিতে লাঙল চলে যে গতিতে, সে গতিতে ঘুরতে শুরু করল। ওরা আরো চাপ বাড়াল। ঘুরতে ঘুরতে সোজা হয়ে এলো মাবেলের সঙ্গে সমান্তরালে চলে এলো অষ্টভুজের রিং। একেবারে স্থির হয়ে গেল একসঙ্গে।
দুজনেই হাপরের মতো হাঁপাতে লাগল ঘাটের ওপরে সোজা হয়ে। ‘বাবারে বাবা, পানির পাম্পে ইস্টার্ট দিতেও এমুন শক্তি লাগে না,’ কিছু না বলে নীরবে মাথা নেড়ে রমিজ দারোগার কথার সঙ্গে সম্মতি জানাল বাশার। জবাব দেওয়ার শক্তি নেই।
‘কিন্তু ওটা বসালেই বা লাভটা হলো কী? কিছুই তো টের পাচ্ছি না…’ জয়ার কথা শেষ হবার আগেই পুকুরের পানিতে মৃদু তরঙ্গ খেলা করে গেল। ধীরে ধীরে পুকুরের ঠিক মাঝ বরাবর তৈরি হচ্ছে ছোট্ট একটা পাক।
‘ও…ওটা কী?’
পুকুরের পাক ধীরে ধীরে ঘুরতে ঘুরতে একটু থেকে আরেকটু বড়ো হলো তারপর প্রায় একটানে পুকুরের পানির উচ্চতা কমে গেল যেন কয়েক ইঞ্চি। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসতে লাগল পানি। আর সেই সঙ্গে আশপাশের কোথা থেকে যেন ঘড়ঘড় শব্দ ভেসে আসতে লাগল।
‘ওদিকে,’ বলে পুকুরের পাশেই বিরাট স্নানঘরটা দেখাল রিফাত। ঘড়ঘড় শব্দটা ভেসে আসছে ওদিক থেকেই। আরো কিছুক্ষণ ঘড়ঘড় শব্দ করে থেমে গেল। প্রথমে জয়া আর রিফাত রওনা দিল ওদিকে। ওদেরকে অনুসরণ করল আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগা, সবশেষে বাশার। যখন স্নানাগারের ভেতরে পৌছাল ওটার ভেতরে ঢুকে দেখল সবাই দাঁড়িয়ে আছে। স্নানাগারের একটা অংশের মেঝের বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁক হয়ে গেছে। সেখান দিয়ে একটা ছোট্ট করিডরের মতো চোখে পড়ছে মাটির নিচের দিকে। সর্বনাশ। একটা গোপন প্যানেল,’ কথাটা আনমনেই বেরিয়ে গেল বাশারের মুখ দিয়ে।
***
বাশারের মুখ দিয়ে কথাটা উচ্চারিত হতেই মৃদু হাসি ফুটে উঠল কানে হেডফোন লাগানো গাড়িতে বসা একজন মানুষের মুখে। যাক, মনে হয় কাজ হতে যাচ্ছে অবশেষে। এই গাধাগুলো কিছু একটা বের করতে পেরেছে। অবশ্য যেভাবে ওরা জিনিসটা বের করতে যাচ্ছে সেটা জানার পর সবাইকে সাধুবাদ দেওয়া যেতেই পারে। মনে মনে সে ভাবল কতগুলো বছর সে অপেক্ষা করেছে এরকম কিছুর জন্যে। একরকম বলতে গেলে তার সারাজীবন সে ঢেলে দিয়েছে এরকম কিছুর আশায়। অবশেষে সেটা ঘটতে যাচ্ছে। মোবাইলটা আনলক করে সে কল দিল একটা নির্দিষ্ট নম্বরে। তারপর নিজের লোকদের উদ্দেশ্যে নির্দেশের ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘সবাই প্রস্তুত হও। এবার আমরা কাজে নামবো।’