প্রথম অংশ : ছন্দপতন
দ্বিতীয় অংশ : মৃত্যুহরণ

সপ্তরিপু – অধ্যায় ৯

অধ্যায় নয় – বর্তমান সময়

নতুন বাজার, ময়মনসিংহ

জায়গা মতো পৌঁছে গেছে কিন্তু সঠিক ভবনটা বের করতে পারছে না কনস্টেবল আবদুল্লাহ। ‘পথ তো ঠিকই আছে মনে আছে, তাইলে বিল্ডিংটা গেল কই?’ আপনমনেই নিজেকে প্রশ্ন করল কনস্টেবল ছেলেটা। স্থানীয় উচ্চারণের সঙ্গে শুদ্ধ বাংলা মিলিয়ে খুব অদ্ভুত এক ভাষায় কথা বলে সে।

চরম বিরক্তির সঙ্গে তার দিকে ফিরে তাকাল বাশার। ‘এই ছেলে, তুমি না আসার সময়ে বললে জায়গাটা তুমি চেনো। তাহলে এখন চিনতে পারছ না কেন?’

‘এইদিগেই তো আছিল,’ ছেলেটা জানালা দিয়ে মাথা বের করে অস্থির হয়ে ইতি-উতি তাকাতে তাকাতে বলতে লাগল।

‘এই ছেমড়া, তুই না নাসিরাবাদ কলেজে পড়ালেহা করছোস, তুই নতুন বাজার এলাকা চিনস না?’ গজ-গজ করতে করতে বলতে লাগল রমিজ দারোগা।

‘আপনি তো মনে হয় ওর জন্মের আগে থেকে এই এলাকায় আছেন,’ এই রমিজ দারোগা লোকটার কথা-বার্তা আচার-আচরণ সবকিছুই বিরক্তিকর লাগছে বাশারের কাছে। ‘আপনি চেনেন না কেন?’

বাশারের কথার জবাবে একটু হকচকিয়ে গেল সে। জিপের পেছনের খোলা অংশ দিয়ে বাইরে মাথা বের করে আশপাশে তাকাতে তাকাতে বলতে লাগল, ‘এনুই আছে।’

বিরক্তির সঙ্গে একবার মাথা নেড়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে গুগল ম্যাপ ঘাঁটতে লাগল বাশার। ‘এই আবদুল্লাহ, জিপটা একদিকে সাইড করো,’ থানার কনস্টেবল ছেলেটা যেভাবে বর্ণনা করেছিল সেভাবেই অবস্থানটা দেখে নিয়ে আবারো নির্দেশ দিতে লাগল ও। ‘আমরা বেশি সামনে চলে এসেছি জিপটা ঘুরিয়ে উলটো দিকে যেতে হবে।’

আবদুল্লাহ ছেলেটা ওর নির্দেশ মতো আবারো জিপটাকে পেছনে নিয়ে নতুনবাজার মোড়ের ডানদিকে চলে এলো।

‘ওই তো, সামনের কনফেকশনারিটা পার হয়ে বামদিক দিয়ে ঢুকতে হবে।’

ম্যাপ অনুযায়ী কনফেকশনারিটা পার হয়ে সামনে এগোতেই ছোট্ট একটা সাইনবোর্ডে লেখা দেখতে পেল ওরা; ‘পিবিআই’। ‘হ্যাঁ, এদিক দিয়েই।’ সাইনবোর্ডটা দেখেই মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেছে ও, এখানেই হবে। ওদের জিপ বাঁ দিক দিয়ে ঢুকে কয়েকটা বাড়ি আর দুটো গ্যারাজ পার হতেই সামনে চোখে পড়ল পুরনো দিনের একটা বেশ বড়ো ভবনে রেনোভেশনের কাজ চলছে। বাইরে বড়ো একটা সাইনবোর্ড লাগানো। তাতে লেখা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন। শুধু এই কথা তিনটেই লেখা আর কিছু লেখা নেই। সাইনবোর্ডটাও সামান্য বাঁকা হয়ে ঝুলে আছে।

ব্যাপার কী? শুনলাম এখানে বিশাল আয়োজন চলছে। পুলিশ, সিআইডি আর পুলিশ ব্যুরো অবইনভেস্টিগেশন তিনটে ফোর্সের ব্যবহারের জন্যেই কমন ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট খোলা হচ্ছে, এই তার নমুনা।

গেটের সামনে জিপটা থেমে যেতেই বাশার বেরিয়ে এলো ওটার ভেতর থেকে। আবদুল্লাহকে জিপটা পার্ক করতে বলে রমিজ দারোগাকে নিয়ে ভেতরের দিকে এগোল ও। গেটের কাছে যেতেই দুজন দারোয়ানের একজন জানতে চাইল ওরা কারা, কার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। বাশার নিজের পরিচয় দিয়ে জানাল কার রেফারেন্সে এসেছে। একটা ভিজিটর বইতে সই করার পর ওদেরকে গেটের সঙ্গেই লাগোয়া রিসিপশনে বসানো হলো।

রিসিপশন কক্ষটা ছোটো হলেও চমৎকার দেখতে। রুমের ইন্টেরিয়োর খুবই সুন্দর। ওরা ভেতরে বসার সঙ্গে সঙ্গে রমিজ দারোগা ওকে কিছু একটা বলতে চাইছিল তাকে এক কথাতেই চুপ করিয়ে দিয়ে সোফা থেকে উঠে এলো বাশার।

পুরো রিসিপশন রুমটাই কাচের তৈরি। রিসিপশন রুমের কাচের দেওয়ালের ভেতর থেকে ও সম্পূর্ণ বাড়িটা দেখতে লাগল। বাড়িটা পুরনো আমলের কোনো সন্দেহ নেই। বিশাল এলাকা নিয়ে অবস্থিত বাড়িটার বাউন্ডারিটাও উঁচু করা হচ্ছে।

সামনের অংশের কাজ শেষ হয়ে গেলেও এখনো পেছনের অংশের কাজ চলছে। একারণেই সামনের সাইনবোর্ডের এ অবস্থা। বাউন্ডারিটার ভেতরে বাড়িটার অবস্থান একপাশে। অন্যপাশটা পুরোটাই ফুলের বাগান। পুরনো দিনের বাড়িটা লাল ইটের তৈরি।

‘স্যার, আমার নাম মিলন। আপনি কি বাশার স্যার?’ পেছন থেকে ভেসে আসা পরিমিত কণ্ঠস্বরটা শুনে ফিরে তাকাল ও। রিসিপশন রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে এক সুদর্শন যুবক। তার পরনে কালো প্যান্ট আর ঘিয়ে রঙের শার্ট, সুন্দর পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল, চোখে বেমানান রকম মোটা কাচের চশমা।

‘হ্যাঁ, আমিই বাশার,’ সামনে এগিয়ে ছেলেটার বাড়িয়ে ধরা হাতটা ধরে মৃদু ঝাঁকি দিল। আর উনি মিস্টার রমিজ,’ বলে সে রমিজ দারোগার দিকে দেখাল ও।

‘এই পোলা, তুমার চশমার যে পাওয়ার দেকতাছি তুমারে তো পরায় কানাই কউন যায়। তুমি পুলিশে চাকরি পাইলা কেমনে?’ বলে সে হাসতে লাগল।

হঠাৎ রমিজ দারোগার এমন কথা শুনে মিলন নামের ছেলেটা বেআক্কেল হয়ে গেল। হতভম্ভ হয়ে একবার রমিজ দারোগার দিকে তাকাল, তারপর ফিরে তাকাল বাশারের দিকে।

‘মিস্টার মিলন, আপনি হয়তো জানেন আমরা একটা বিশেষ কেসের কাজ নিয়ে এসেছিলাম,’ প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্যে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল বাশার।

‘জি, স্যার। অবশ্যই। আপনারা আসুন আমার সঙ্গে,’ বলে ছেলেটা ওদেরকে পথ দেখিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে লাগল। রমিজ দারোগার দিকে একবার চোখ রাঙিয়ে ছেলেটার পিছু-পিছু হাঁটতে লাগল বাশার।

সরি স্যার, আপনাদেরকে অপেক্ষা করিয়ে রাখলাম। আসলে আমরা প্রচণ্ড চাপের ভেতরে আছি। একদিকে ভবনটার রেনোভেশনের কাজ চলছে, অন্যদিকে আবার ল্যাব বসানো থেকে শুরু করে অন্যান্য কাজ শেষ করার জন্যে ওপর মহল থেকে চাপ। সব মিলিয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা।’

‘আপনাদের এই কমন ফরেনসিকের ব্যাপারটা আসলে কী? আমি বেশি কিছু জানি না এখনো,’ বাশার খুব আগ্রহ নিয়ে বাড়িটা দেখছে। ওরা ইতিমধ্যেই বাগান পার হয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেছে। একসময় বাড়িটা নিশ্চিত কারো বাসভবন থাকলেও এখন সেটাকে পূর্ণাঙ্গ একটা অফিসে রূপ দেওয়ার কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়ে এসেছে।

মিলন ছেলেটা পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে মৃদু হাসল। ‘স্যার, আপনি জানেন হয়তো শুধুমাত্র মার্ডার কেস নিয়ে ডিল করার জন্যে দেশে একটা ডিপার্টমেন্ট আছে, হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কেসে হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের ব্যাপক সাফল্যে ওপর মহল থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে হোমিসাইডের শাখা বৃদ্ধি করা যায় কি না। সেটা অনেক সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা তবে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে হোমিসাইড আর পিবিআইয়ের তত্ত্বাবধানে একটি করে কমন ফরেনসিক ল্যাব বসানো হবে। যেখানে পোস্টমর্টেম থেকে শুরু করে যেকোনো ধরনের ফরেনসিকের কাজ করার ব্যবস্থা থাকবে। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর যেমন চট্টগ্রাম, সিলেট, বগুড়া এসব জায়গার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ময়মনসিংহেও বসানো হচ্ছে এই অত্যাধুনিক ল্যাব। যদিও কাজ পুরোপুরি শেষ হতে আরো সময় লাগবে। তবে প্রাথমিকভাবে কাজ চালানোর মতো সেটআপ হয়ে গেছে।’

বাশার আর রমিজ দারোগাকে পাশে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভেতরের দিকে চলে এলো সে।

‘স্যার আমরা চলে এসেছি। এখানেই আপনাদের উদ্ধার করে আনা সেই গাড়িটা আছে। আর ভেতরে আমাদের নিয়মিত কর্মকর্তা আশরাফ স্যার তো আছেনই। আর ঢাকা থেকে আসা একজন এক্সপার্টও আছেন। গুড লাক, স্যার।’ বলে ছেলেটা দরজাটা মেলে ধরল ওদের জন্যে।

রমিজ দারোগাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে একবার তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস-ফিস করে তাকে ধামকি দিয়ে দিল বাশার। ‘আপনার মুখটাকে একটু সাবধানে চালাবেন। উলটাপালটা কিছু বলবেন না দয়া করে।’

কীসের হুমকি, কীসের কী, বাশারের কথা শুনে তার মুখে ফুটে উঠল এক ধরনের তৈলাক্ত হাসি, ‘আরে কী যে …’

‘হ্যালো, আপনি নিশ্চয় ইন্সপেক্টর বাশার? আমি মুহাম্মদ আশরাফ। সিনিয়র ল্যাব অ্যাসিসটেন্ট,’ ফরেনসিকের ল্যাব অ্যাসিসটেন্ট একটা চেহারা ভেসে ওঠে এই লোক সেরকম কিছু না। পরনে ফরমাল শার্ট প্যান্ট। মাথায় পাতলা হয়ে আসতে থাকা চুল, তাতে রূপালি ঝিলিক। চোখে অদ্ভুত একটা চশমা।

‘জি, আমিই বাশার। ওই শেষ মোড়ে পুকুরের তলা থেকে যে গাড়ি আর কঙ্কাল পাওয়া গেছে সেই কেসের তদন্তকারী অফিসার,’ বলে সে লোকটার সঙ্গে হাত মেলালো। ‘আর ইনি আমার সঙ্গে কাজ করছেন। মিস্টার রমিজ,’ সে রমিজের দিকে দেখাল। আশরাফ তার দিকে হাত মেলানোর সময় সে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ঘাড় নেড়ে আমুদে ভঙ্গিতে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল বাশারের কড়া দৃষ্টি দেখে থেমে গেল।

‘ওহ্,আপনার কেসটা সত্যি ইন্টারেস্টিং। আমাদের এই ল্যাব বসানোর পর থেকে প্রায় কোনো কেসই এখনো আসেনি, এরকম ইন্টারেস্টিং কেসতো দূরে থাক।’

‘এইডা ক্যামুন ল্যাব? আমার কাছে তো গ্যারেজ মনে অইতাছে,’ আনমনেই বলে উঠল রমিজ দারোগা। বলেই সে বাশারের চোখ রাঙানির ভয়ে অন্যদিকে ফিরে তাকাল।

তবে রমিজ দারোগার কথার সঙ্গে বাশারও খুব বেশি দ্বিমত নয়। এই ল্যাবটা অনেকটা গ্যারেজের ওয়ার্কশপের মতোই লাগছে দেখতে। একপাশে কম্পিউটার আর মাইক্রোস্কোপিক ইক্যুইপমেন্টগুলো বাদ দিলে পুরো ল্যাবটাই অনেকটা ওয়ার্কশপের মতো।

‘হা-হা, উনি ভুল বলেননি,’ বলে আশরাফ হাসতে লাগল। ‘আমরা এই ওয়ার্কশপগুলোকে গ্যারাজ-ল্যাব বলেও ডাকি মাঝে মাঝে। যা বলছিলাম। এভাবে পুকুরের তলা থেকে আস্ত একটা গাড়ি তাও আবার লাশসহ উঠে আসার কথা আমি এই ময়মনসিংহ শহরে কখনো শুনিনি। তবে অবাক করা ব্যাপার হলো, এতদিন যাবৎ এই গাড়িটা পুকুরের তলায় পড়ে আছে কেউ টেরও পায়নি এটা কেমন কথা।’

‘এর পেছনে একটা কারণ হলো এই পুকুরটা নিয়ে অনেকদিন ধরে বিবাদ চলছিল। যেকারণে কেউই এটা ব্যবহার করত না। স্থানীয় কিছু লোকজন গোসল করা আর মাঝে-মাঝে ছিপ দিয়ে মাছ ধরা ছাড়া অনেকদিন ধরেই এই পুকুরের আর কোনো ব্যবহার ছিল না। যেকারণে কেউ এর নিচে নামেনি আর টেরও পায়নি ওখানে এরকম কিছু একটা পড়ে আছে।’

‘হুম, সেটা হতে পারে। আপনাদের কেসটা আমরা ল্যাব ওয়ার্কের হিসেবে দুই ভাগে ভাগ করে নিয়েছি। আপনার গাড়ি-সংক্রান্ত ব্যাপারটা আমরা দেখছি। আর গাড়ির ভেতরে পাওয়া ডেডবডির ব্যাপারটা নিয়ে আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন আমাদের গেস্ট, ডক্টর মনিকা। আসুন আপনাদের গাড়িটার কাছে নিয়ে যাই,’ বলে সে ওদেরকে নিয়ে ল্যাব কাম ওয়ার্কশপটার এক কোনায় নিয়ে এলো।

সেখানে একটা অদ্ভুত দর্শন চারকোণা স্ট্যান্ডের ওপরে গাড়িটাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আগে যেরকম শ্যাওলায় ঢেকে ছিল এখন সে-অবস্থায় নেই, তবে এখনো ওটার অবস্থা খুবই খারাপ। মাছ কাটার সময়ে যেভাবে মাছের পেটের ভেতর থেকে নাড়ি-ভুঁড়ি সব বের করে আনা হয় ঠিক সেইভাবে গাড়ির ভেতর থেকে সিট, স্টিয়ারিং, ইঞ্জিনসহ সবকিছু বের করে আনা হয়েছে। সেগুলোও সাজিয়ে রাখা হয়েছে গাড়ির পাশেই একটা ওয়ার্কবেঞ্চের ওপরে।

বাশার মনোযোগ দিয়ে গাড়িটার দিকে তাকাল। শ্যাওলা আর কাদায় ঢেকে থাকার কারণে প্রথমবার দেখার পর ও ভেবেছিল গাড়িটা বোধহয় সাদা রঙের কিন্তু এখন দেখে মনে হচ্ছে একসময় গাড়িটার রং কালো ছিল।

‘গাড়িটাকে যতটা পারা গেছে ঠিক-ঠাক মানে পরিষ্কার করা হয়েছে, ভেতরে যা-কিছু ছিল সবই বের করে ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে রাখা হয়েছে,’ ওদেরকে ওয়ার্কবেঞ্চের সামনে নিয়ে এলো আশরাফ।

‘আচ্ছা গাড়িটার ব্যাপারে কী কী জানা গেছে?’ বাশার প্রশ্ন করল। আশরাফকে প্রশ্নটা করে ও রমিজ দারোগাকে নির্দেশ দিল, ‘রমিজসাহেব, আমাদের ভেতরের যা-যা কথা হবে নোট করে নিন।

রমিজ দারোগা ধীরে-সুস্থে পকেট থেকে একটা ছোটো সরকারি সিল দেওয়া নোট বই বের করাতে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল বাশার। ও ভয় পাচ্ছিল লোকটার কাছে আদৌ নোটবই বলে কিছু আছে কি না। যাক লোকটাকে যতটা খারাপ ভাবছিলও অতোটা অকর্মা মনে হয় সে না।

‘গাড়িটা আবিষ্কার হবার পর গতকাল আমরা সেটা স্পট থেকে উদ্ধার করে আনি। আনতে আনতে অবশ্য বিকেল হয়ে যায়। উদ্ধার করে আনার সময়ে আমাদের একটা দল পুকুরসহ সমস্ত জায়গাটা জরিপ করে আসে। ওখান থেকে প্রায় কিছুই পাওয়া যায়নি। তবে যা-যা ওখানে আছে সেসবের একটা তালিকা করা হয়েছে। যাবার সময়ে একটু মনে করবেন আপনাকে একটা কপি দিয়ে দিবো। গাড়িটা নিয়ে আমাদের মেকানিকেরা কাজ শুরু করে কাল রাত থেকে। পরিষ্কার ও শুকোনোর কাজ চলে প্রাথমিকভাবে। আর ভেতরটা ক্লিয়ার করা হয়েছে আজ। একটা ব্যাপার আমরা বুঝতে পেরেছি গাড়িটা অনেক দিন এই পুকুরের তলায় পড়ে ছিল। একেবারে সূক্ষ্ম অ্যানালাইসিস না করলেও এটা পরিষ্কার যে অন্তত দশ-বারো বছর ধরে ওটা পানির তলায়ই ছিল।’

‘এই, মেশিন ওঠাও মেশিনও ওঠাও, যা খুঁজছিলাম পেয়ে গেছি,’ হঠাৎ কোনো একজন মানুষের ভোঁতা গলা ভেসে এলো খুব কাছে থেকে।

আশপাশে তাকিয়েই কাউকে দেখতে না পেয়ে একটু অবাক হলো বাশার। পাশ থেকে রমিজ দারোগাকে বিড়বিড় করে বলতে শুনল, —আরে, বুতে কতা কয়নি?’

‘আহ্, যা ভাবছিলাম, আমাকে আর বলতে হবে না, ঢাকা থেকে এভিডেন্স টিমের এক্সপার্ট এসেছিলেন ল্যাব সেট-আপের কাজ করতে। উনিই আপনাদের বাকিটা বলতে পারবেন,’ কথা বলতে বলতে আশারাফ গাড়ি রাখা সেই অদ্ভুত দেখতে স্ট্যান্ডটার পাশে গিয়ে একটা সুইচ টিপে দিতেই দিতেই গাড়িসহ সেটা ওপরের দিকে উঠতে লাগল। কিছুদূর উঠে থেমে গেল মেশিনটা। ওটার নিচ থেকে বেরিয়ে এলো অদ্ভুত দেখতে একজন মানুষ।

‘আরে! আপনি কি আমাকে মেশিনের নিচে ফেলে মারতে চাচ্ছিলেন নাকি?’ মানুষটা এক গড়ান দিয়ে মেশিনের নিচ থেকে বেরিয়ে এসে হাতের ময়লা মুছতে মুছতে বলতে লাগল। ‘উফ্, একেবারে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তবে যা পেয়েছি তার তুলনায় কষ্টটা কিছুই না,’ নিজের মনেই হাত মুছতে মুছতে কথাগুলো বলছিল, হঠাৎ আশরাফের সঙ্গে আরো দুজনকে দেখে থেমে গেল সে। ‘ওহ্, সরি। আমি ভেবেছিলাম এখানে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই।’

‘আমি, ইন্সপেক্টর আহমেদ বাশার,’ বলে ও মানুষটার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল। ছোটোখাটো গোলগাল মানুষটার পরনে একটা খাকি হাফপ্যান্ট-যেটা এই মুহূর্তে ময়লা হয়ে আছে—ওপরে সবুজ রঙের টি-শার্ট-হাফপ্যান্টকে যদি ময়লা বলা হয় তবে টি-শার্টটার কোনো বর্ণনার দরকার নেই। ছোটোখাটো মানুষটার শরীরের মাঝামাঝি বেশ সুন্দর গোলচে একটা ভুঁড়ি আর মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। টকটকে লাল দুচোখ দেখে বাশার অনুমান করল মনে হয় সারারাত ঠিকমতো ঘুমায়নি সে। ‘আমি এই কেসের তদন্তকারী অফিসার।’

‘আমি টমি, টমি পোদ্দার,’ নিজের নাম বলে সে তার কালিঝুলি মাখা হাতটা বাশারের দিকে বাড়িয়ে দিয়েও সরিয়ে নিলো। ‘আমি আসলে হাত মেলানোর মতো অবস্থায় নেই। দেখতেই পাচ্ছেন।’

টমি পোদ্দার, এ কেমন নাম! মনে মনে ভাবলেও মুখে কিছু বলল না বাশার।

‘কীয়ের ‘দার’?’ রমিজ দারোগার খিক খিক হাসি আর প্রশ্ন শুনে বোকা বনে গেল বাশার। কঠিন দৃষ্টিতে ফিরে তাকাল তার দিকে।

প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্যে আশরাফ ওদেরকে টমির পরিচয় জানাল। ‘টমি স্যার এভিডেন্স আর সাইবার ম্যাটেরিয়ালের ব্যাপারে এক্সপার্ট। উনি ঢাকা থেকে এসেছিলেন মূলত আমাদেরকে ল্যাব কাম ওয়ার্কশপটা সেট-আপ করতে,

কিন্তু এর মধ্যেই আপনাদের কেসটা চলে আসাতে স্যারই কেসটা নতুন ল্যাবে ইন্সটল করতে বলেন। আর একারণেই গাড়িটা প্রথমে থানায় নিলেও এখানে নিয়ে আসা হয়। একইভাবে গাড়িতে পাওয়া ডেড বডিটাও প্রথমে চরপাড়া মেডিকেলে নেওয়া হলেও পরে এখানে নিয়ে আসা হয়।’

‘বুঝতে পেরেছি,’ বাশার রমিজ দারোগার দিকে তাকিয়ে দেখল সে নোট নেবার বদলে পকেট থেকে মোবাইল বের করে টেপাটেপি করছে। আনমনেই একবার মাথা নেড়ে নিজের মোবাইল বের করে রেকর্ডার অন করে সেটটা বুক পকেটে রেখে দিল ও।

‘আপনাদের টাইমিংটা ভালো হয়েছে। আমি কাজ অনেকটাই গুছিয়ে এনেছি। যদিও কাল রাত থেকে প্রায় ঘুমুতেই পারিনি এজন্যে,’ বলে টমি তার দুই হাত ওপরে তুলে শরীরটাকে টান-টান করে দিল একবার। ‘আসুন আগে আপনাদেরকে গাড়িটার ব্যাপারে বলি,’ ওরা আবার গাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল। একটা লম্বা তারের সঙ্গে লাগানো রিমোটের মতো দেখতে একটা জিনিসে সুইচ টিপতেই স্ট্যান্ডসহ গাড়িটা একটু ওপরে উঠে গেল।

‘গাড়িটা লম্বা সময় ধরে পানির নিচে ছিল—সেটা তো আপনারা জানেনই। অতিরিক্ত সময় ধরে ওটা পানির নিচে পড়ে থাকার ফলে অনেক কিছুই নষ্ট হয়ে গেছে। গাড়িটা একটা শেভ্রোলে সেডান গাড়ি ‘

‘কতদিন এটা পানির নিচে পড়ে ছিল…?’ টমির কথার মাঝখানে প্রশ্ন করল বাশার আর তাকে কথা শেষ করতে দিল না রমিজ দারোগা।

‘কয়দিন আর ওবো…দেইখা তো মনে অয়…’ রমিজ দারোগা কথা শেষ করার আগেই তার দিকে কড়া দৃষ্টিতে ফিরে তাকাল বাশার, আর ওদের দুজনার দিকে কড়া দৃষ্টিতে ফিরে তাকাল টমি।

‘বলছি, ভাই,’ তার মৃদু ধমক শুনে দুজনেই চুপ মেরে গেল। ‘এত অস্থির হলে চলে। সারারাত ধরে কাজ করেছি। একটু সময় নিয়ে তো বলতে দিবেন, নাকি?’

‘সরি, ভাই। প্লিজ, ক্যারি অন,’ বাশার একটা হাত তুলে এই বেমক্কা আচরণের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করল।

‘তো যা বলছিলাম,’ টমি এবার তার হাফপ্যান্টের কোমরে গুঁজে রাখা একটা ডায়েরি বের করে সেটা দেখে বলতে শুরু করল। ‘গাড়িটা একটা কালো রঙের শেভ্রোলে সেডান। এই মডেলগুলো ‘জার্মানিতে ম্যানুফ্যাকচার করা হয়েছে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। এই গাড়ি বাংলাদেশে খুব কমনও না আবার একেবারে পাওয়া যায় না এমনও নয়। গাড়িটার ইঞ্জিন বের করে ওটার নম্বর মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু মরিচা পড়ে ওটার ইঞ্জিনের নম্বর গেছে মুছে। ফলে ওখান থেকে খুব বেশি সুবিধে পাওয়া যায়নি। এরপর আমরা অ্যানালাইসিস শুরু করি গাড়ির ভেতরে যা-যা পাওয়া গেছে সেগুলো নিয়ে,’ বলে সে ওদেরকে নিয়ে গাড়িটার পাশেই একটা ওয়ার্ক বেঞ্চের দিকে চলে এলো।

‘একটা ডেডবডি পাওয়া গেছে সে তো আপনারা জানেন। সত্যি কথা হলো ডেডবডি বলতে শুধু একটা কঙ্কাল বাদে আর তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই ওটাতে। আর সঙ্গে যা যা জিনিসপত্র ছিল সবই অতিরিক্ত সময় ধরে পানিতে থাকার ফলে নষ্ট হয়ে গেছে। তাই এখান থেকেও তেমন কিছু বের করা যায়নি,’ বলে সে হাতে গ্লাভস পরে নিয়ে একটা একেবারেই পড়ে যাওয়া জিনিস তুলে দেখাল। আকৃতি দেখে বোঝা যাচ্ছে একসময় ওটা মানিব্যাগ ছিল কিন্তু এখন একতাল শুকনো কাদার মতো দেখাচ্ছে।

‘আরেকটা বাতিল জিনিস হলো এটা,’ বলে সে নাটকীয় ভঙ্গিতে বেঞ্চের ওপর রাখা একটা পাতলা মতো জিনিস উপুড় করে দেখাল।

‘নম্বর প্লেট,’ চরম স্বস্তির সঙ্গে শব্দগুলো বাশারের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

‘হ্যাঁ, নম্বর প্লেট,’ বলেই সে জিনিসটা ঘুরিয়ে দেখাতেই বাশার গুঙিয়ে উঠল। প্রায় সব নম্বরই মুছে গেছে। দুয়েকটা বোঝা গেলে যেতেও পারে। তবে সেটাতে কতটা কাজ হবে বলা মুশকিল।

টমি পোদ্দারের হাতে নম্বর প্লেট দেখে বাশার খুশি হয়ে গেছিল এরপর সে আবার হতাশ হয়ে শেষ কথাটা শুনে আবার উৎফুল্ল হয়ে উঠল।

‘যদি দুটো নম্বর মিসিং থাকত প্লেটে তবুও হয়তো আমি সফটওয়্যারে এন্ট্রি দিলে ঘণ্টাখানেকের ভেতরে নম্বরটা বের করে ফেলতে পারতাম; কিন্তু দেখতেই পাচ্ছেন প্লেটের বেশিরভাগ নম্বরই মুছে গেছে, কাজেই এটা থেকে কোনো সাহায্যই পাওয়া যাবে না,’ বলে সে প্লেটটা ওয়ার্ক বেঞ্চের ওপরে ছুড়ে দিল।

বাশার একটু হতাশ হয়েই ওয়ার্ক বেঞ্চের কাছে এসে একটা জিনিস হাতে তুলে নিলো সে। লোহার তৈরি জিনিসটাতে লম্বা ডান্ডার মাথায় অষ্টভুজাকৃতির একটা প্রায় গোল বৃত্ত বসানো। জিনিসটা নেড়ে চেড়ে দেখে সে টমির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘এটা কী?’

বুঝতে পারছি না। গাড়ির কোনো পার্টস কিংবা মেরামতের জিনিস হতে পারে।’

‘হুম, বুঝতে পেরেছি,’ বলে বাশার জিনিসটা বেঞ্চের ওপরে নামিয়ে রাখল। ‘আরেকটা জিনিস ছিল গাড়ির ভেতরে, কিন্তু ওটার অবস্থাও খুবই খারাপ, বলে বেঞ্চের ওপর থেকে কাপড়ে মোড়ানো ধাতব কিছু একটা বের করে তুলে ধরল টমি পোদ্দার।

‘একটা পিস্তল,’ বাশার আগ্রহী হয়ে এগিয়ে গেল। কিন্তু মরিচা পড়ে ওটার অবস্থা খুবই খারাপ। ‘এটা কোন মডেলের পিস্তল সেটাই বোঝা যাচ্ছে না, হতাশ সুরে বলে উঠল বাশার।

‘হ্যাঁ, তবুও এটা ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে যদি অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা কিছু বের করতে পারে।’

‘আচ্ছা গাড়িটা পানির নিচে থাকার একেবারে সঠিক সময়টা কি বের করা সম্ভব?’

‘সব হতাশার মাঝে এইখানে একটু আশার আলো আছে। আপনাদেরকে আরেকটা জিনিস দেখাই,’ বলে সে ওদেরকে নিয়ে এলো ল্যাবের মতো দেখতে জায়গাটার সামনে। ‘এই ব্যাপারটা নিয়েই সবচেয়ে বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। তবে আশার কথা হলো কাজটা শেষ পর্যন্ত করা গেছে। মানে গাড়িটা কতদিন যাবৎ পানির নিচে ছিল, সেটা বের করতে পেরেছি।’

টমি পোদ্দার আবার বয়ান শুরু করবে বুঝতে পেরে বাশার তাকে থামিয়ে প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই রমিজ দারোগা জানতে চাইল, ‘ক্যামনে বাইর করলেন এইডা?’

সঙ্গে সঙ্গে টমি খুশি হয়ে উঠল। তার মুখের ভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এতক্ষণে রমিজ দারোগার কথাটা তার পছন্দ হয়েছে। ‘প্রক্রিয়াটা খুবই কঠিন কিন্তু মজা আছে। বলছি,’ বলে সে একটা চেয়ারে বসে ল্যাব মেশিনের সঙ্গে লাগানো কম্পিউটারের কি-বোর্ডে কিছু একটা লিখতে শুরু করল।

‘মানে আমি সংক্ষেপে জানতে চাচ্ছিলাম—’ বাশারকে ওর কথা শেষ করতে না দিয়ে টমি স্রেফ একটা হাত নাড়ল। ‘আরে, পুরোটা শোনেন। মজা পাবেন।’

বাশার চাচ্ছিল যতটা পারা যায় সংক্ষিপ্ত সময়ের ভেতরে এখানকার কাজ সেরে মূল কাজে নামতে কিন্তু এই লোক যেভাবে লেকচার দেওয়া শুরু করেছে তাতে মনে হচ্ছে না খুব সহজে সে ওদেরেকে ছেড়ে দেবে। বাশার অসহায়ভাবে একবার আশরাফের দিকে তাকাল। আশরাফ স্রেফ একবার কাঁধ নাড়ল।

‘এই ব্যাপারটা একেবারে কাটিং এজ টেকনোলজি। সত্যি কথা হলো,

এটা আসলে আমাদের দেশে কাটিং এজ হলেও বিশ্বব্যাপী অনেকদিন ধরেই চলছে। এটাকে বলা হয়ে থাকে ন্যানো টেকনোলজি,’ বলে সে মনিটর ঘুরিয়ে ওদেরকে কীসব দেখাল।

‘তো এটা দেখে কীভাবে বুঝতে পারলেন যে গাড়িটা কতদিন ধরে পানির নিচে ছিল?’ টমির ব্যাখ্যা শুনতে শুনতে বাশারও একটু আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

‘এইখানেই তো মজা। আপনাকে বললাম না কাল রাত থেকে কাজ করছি এটা নিয়ে। ব্যাপারটা হলো এটাতে গাড়িটার গায়ে জন্মানো জলজ উদ্ভিদ থেকে শুরু করে গাড়ির বিভিন্ন পার্টের অবস্থাসহ সমস্ত ভিজ্যুয়াল ডেটাসহ সবকিছু ইনপুট আকারে দিতে হয়। ডেটা ইনপুট ঠিকমতো দিলে পরে সিস্টেম সেই ডেটা নিয়ে অ্যানালাইসিস শুরু করে। প্রথম সমস্যা হলো ডেটার ইনপুট। কোন জায়গার ডেটা কীভাবে দিতে হবে কিংবা কোনটা একটু উলটোপালটা হলেই সর্বনাশ। সিস্টেম সেটার এন্ট্রি নিবে না। আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। তো এভাবে টানা কয়েকবার চেষ্টা করার পর গতকাল প্রায় মাঝরাতের দিকে ঠিকভাবে ডেটা ইনপুট দিতে সমর্থ হই আমরা। তো এরপর থেকে সিস্টেম সেটা অ্যানালাইসিস শুরু করে। এটাও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।’

‘তাহলে কখন পাওয়া যাবে এই অ্যানালাইসিসের আউটপুট?’ বাশার একটু অধৈর্য হয়েই জানতে চাইল।

‘এখুনি। কারণ টানা কয়েক ঘণ্টা ধরে অ্যানালাইসিস করার পর আপনারা আসার একটু আগেই আমি আউটপুট বের করে রেখেছি,’ বলেই টমি তার বত্রিশ দন্ত প্রদর্শন করল ওদেরকে।

বাশার রাগের সঙ্গে তাকিয়ে রইল তার দিকে। এই লোকটা এতক্ষণ ধরে অকারণেই পাকাচ্ছিল ওদের সঙ্গে। তবে টমি এবার বেশি ঝামেলা করল না। কম্পিউটার কি-বোর্ডের নিচ থেকে একটা স্বচ্ছ ফাইল, বের করে বাশারের হাতে ধরিয়ে দিল।

বাশার ফাইলটা খুলে দেখল তাতে টানা কয়েক পৃষ্ঠা ধরে বিভিন্ন ধরনের অ্যানালাইসিস লেখা। ‘কই, এখানে তো সব দেখতে পাচ্ছি সায়েন্টিফিক ডেটা,’ পৃষ্ঠা ওলটাতে ওলটাতে বাশার অবাক হয়ে বলল। ‘কোনো সময় তো দেখতে পাচ্ছি না। ওহ আচ্ছা, বাশার শেষ পৃষ্ঠায় চলে এসেছে। এখানে সমস্ত হিসেব- নিকেশ শেষ করার পর ফলাফল দেখাচ্ছে। ‘এগারো বছর? মানে এগারো বছর ধরে এই গাড়িটা পুকুরের তলায় পড়ে ছিল?’ বাশার অবাক হয়ে জানতে চাইল।

‘এগারো বছর। দিন তারিখ কিংবা সময়ের ব্যাপারটা বলা সম্ভব নয় তবে এটা একেবারেই ঠিক যে গাড়িটা এগারো বছর ধরে পানির নিচে পড়ে ছিল,’ টমির মুখে মিটিমিটি হাসি।

***

‘মনিকা ম্যাডাম, মানে উনি কি এই লাইনের এক্সপার্ট?’ বাশার জানতে চাইল।

ওয়ার্কশপ ল্যাবের কাজ শেষ করার পর রমিজ দারোগাকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে বাশার আর টমি এখন চলেছে মেডিকেল ল্যাবে। ওখানেই ডেডবডিটা রাখা আছে। মিলন ছেলেটা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে টমিই বাশারকে এগিয়ে দিতে এসেছে।

বাশারের প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলল টমি। ‘উনি এক্সপার্টদেরও এক্সপার্ট। মনিকা ম্যাডাম এই লাইনে বিশ্বসেরাদের একজন। উনি আসলে আমাদের নিয়মিত মানুষও নন। উনি ইয়েলে নিজের পোস্ট ডকের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এমন সময় পারিবারিক কাজে দেশে এলে তার এক বন্ধুর অনুরোধে আমাদেরকে কিছু ব্যপারে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেন। আপনি এক অর্থে খুবই লাকি, কারণ এই কেসে মনিকা ম্যাডামের মতো সাপোর্ট আর কেউই দিতে পারবেন না,’ ওরা একটা করিডরের শেষ প্রান্তে চলে এসেছে। ‘আপনি এটা ধরে সামনে চলে গেলেই শেষ মাথায় দেখতে পাবেন একটা স্টিলের দরজা। ওটাই মনিকা ম্যাডামের অফিস। আপনি তার সঙ্গে কাজ শেষ করে যাবার সময়ে আমার কাছ থেকে গাড়িটার ব্যাপারে বিস্তারিত ও ফাইনাল রিপোর্ট নিয়ে যাবেন।’

বাশার আপাতত তাকে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। করিডরের শেষ মাথায় এসে স্টিলের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একবার টোকা দিয়ে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে আবারো হাত ওঠাতে যাচ্ছিল তার আগেই ভেতর থেকে সুরেলা কণ্ঠে ডাক ভেসে এলো, ‘কাম ইন, প্লিজ।’

স্টিলের দরজাটা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল বাশার। এই ল্যাবের ভেতরটা অনেকটা হাসপাতালের মতো। তবে হাসপাতালের ওয়ার্ডের চাইতে বরং এর সঙ্গে হাসপাতালের অপারেশান থিয়েটারের বেশি মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। কক্ষটার অন্য প্রান্তে কয়েক সারি স্টিলের ক্যাবিনেট। বাশার অনুমান করল সম্ভবত ওগুলোর ভেতরেই লাশ রাখা হয়। কেবিনেটগুলোর সামনে প্লাস্টিকের শিট দিয়ে মোড়ানো খালি দুটো বেড। আর রুমের ঠিক মাঝখানে অপারেশান থিয়েটারের মতো দেখতে একটা টেবিল। ওপরে বিরাট আকারের গোল একটা লাইট একেবারে নিচে নামানো।

বেডটার ওপরে প্লাস্টিক দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে কিছু।

পুরো রুমে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বাশার ফিরে তাকাল রুমের প্রবেশপথের কাছেই বসানো সুন্দর গোছানো টেবিলটার দিকে। এই মুহূর্তে ওটার ওপরে রাখা একটা ল্যাপটপের ওপরে ঝুঁকে আছে একজন মানুষ। ওর সাড়া পেয়ে উঠে দাঁড়াল সে। তারপর এগিয়ে আসতে লাগল ওর দিকে।

মুহূর্তের ভেতরে বাশারের মনে হলো সে এই কড়া অ্যান্টিসেপ্টিকের গন্ধেভরা কোনো মর্গে দাঁড়িয়ে নেই। সে দাঁড়িয়ে আছে বসন্তের শেষ বিকেলে পড়ন্ত রোদ এসে পড়া কোনো পার্কের সবুজ ঘাসের ওপরে। ওর মনের কোনে বেজে উঠল কোনো গান। আর সামনে এগিয়ে আসতে থাকা মানুষটাকে মনে হলো ‘নটিং হিল’ সিনেমার জুলিয়া রবার্টস কিংবা ‘টার্মিনাল’ সিনেমার ক্যাথরিন জেটা জোন্সের মতো কেউ।

‘হ্যালো, আমি মনিকা। আপনি নিশ্চয়ই ইন্সপেক্টর বাশার?’ খানিকটা হেসে সে নিজের হাত বাড়িয়ে দিল বাশারের দিকে

সঙ্গে সঙ্গে বাশারের মনে হলো নিজেকে একটা চড় লাগায়। বেহায়ার মতো এতক্ষণ মানুষটার দিকে তাকিয়ে ছিল ও।

‘জি…জি আমি বাশার। আপনি ডক্টর মনিকা?’ প্রশ্নটা করে আবারো নিজেকে মনে মনে গালি দিল ও। কারণ ভদ্রমহিলা ইতিমধ্যেই নিজের পরিচয় দিয়েছে।

‘জি,’ ধূসর চোখের সুন্দরী কপালের ওপরে চলে আসা এক গাছি মধুরঙা চুল কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসল। মহিলার চোখ দেখেই বাশার বুঝল তাকে প্রথমবার দেখার পর পুরুষ মানুষের এই অভিব্যক্তির সঙ্গে মহিলা মোটেই অপরিচিত নয়। ‘আপনার কেসটা খুবই ইন্টারেস্টিং। আসুন দেখাচ্ছি। তবে আগে এগুলো পরে নিলে ভালো হবে। আর এই বিশেষ মাস্কটাও পরে নিন প্লিজ।’

বাশার দ্রুত গতিতে মুখে মাস্ক আর হাতে প্লাস্টিকের গ্লাভস পরে নিলো। ডক্টর মনিকা ওকে নিয়ে রুমের মাঝখানের বড়ো টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেল। টেবিলের ওপরে থেকে প্লাস্টিকের শিটটা সরিয়ে ফেলতেই দেখা গেল ওটার ওপরে কুৎসিত দেখতে একটা কঙ্কাল রাখা। এই কঙ্কালটাই ওরা পুকুরের নিচের সেই গাড়ি থেকে উদ্ধার করেছিল। কঙ্কালের ওপরের স্তর থেকে চামড়া আর মাংস তে গায়েব হয়েছেই সেই সঙ্গে হাড়ও ক্ষয় হয়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। পুরো কঙ্কাল জুড়ে হালকা সবুজ ধরনের জলজ উদ্ভিদের মতো স্তর। পলিথিনের শিটটা সরাতেই বিশ্রী একটা গন্ধ ভক করে এসে বাড়ি মারলো নাকে। মুখে উন্নত মানের মাস্ক পরে থাকার পরও উদ্ভট পচা গন্ধটা যেন মগজের ভেতরে গেঁথে যেতে লাগল বাশারের।

অন্যদিকে ডক্টর মনিকা গ্লাভস পরা হাতে খুবই অভ্যস্ত আর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ওকে দেখাতে লাগল কঙ্কালটার বিভিন্ন অংশ।

‘মিস্টার বাশার, আমি আজ সকাল থেকে এটা নিয়ে কাজ করছি। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে খুব বেশি কিছু উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কারণ এত লম্বা সময় ধরে পানির নিচে থাকলে আসলে তেমন কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। তবে প্রাথমিক কিছু জিনিস পাওয়া গেছে যেগুলো হয়তো আপনার কাজে লাগতে পারে। আপনার হাতের ডানপাশে টেবিলের ওপরে একটা ক্লিপবোর্ডের সঙ্গে লাগানো এক পাতার একটা রিপোর্ট আছে। ওটাতে চোখ বুলাতে পারেন, সঙ্গে আমি ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছি।’

বাশার টেবিলের ওপর থেকে ক্লিপবোর্ডটা তুলে নিলো। বোর্ডের ওপরে ক্লিপ দিয়ে একটা কাগজ আটকানো। সেটাতে বুলেট পয়েন্টের আকারে কিছু কিছু তথ্য লেখা আছে। খুব বেশি কিছু নেই অবশ্য।

‘প্রাথমিক মেডিকেল পরীক্ষায় যা যা পাওয়া গেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো : সাবজেক্ট একজন পুরুষ। উচ্চতা অনুমানিত পাঁচ ফিট নয় বা দশ ইঞ্চি। বেঁচে থাকাকালীন সময়ে বেশ চওড়া একজন মানুষ ছিল। হাড়ের গঠন থেকে শুরু করে অন্যন্য আরো কিছু বিষয় পরীক্ষা করে আমি মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছি সাবজেক্ট এই দেশের মানুষ না। সম্ভবত সে একজন ককেশিয়ান।’

‘মানে, সাদা চামড়ার মানুষ?’ বাশার অবাক হয়ে রিপোর্ট থেকে মুখ তুলে প্ৰশ্ন করল।

‘সঠিকভাবে বলতে গেলে সম্ভবত ইউরোপের অরিজিন। মানে সে যে দেশেরই নাগরিক হোকনা কেন তার পূর্ব পুরুষ উত্তর ইউরোপের। হাড়ের গঠন অন্তত তাই বলে।’

‘লোকটা কতদিন আগে মারা গেছে?’

মৃতদেহের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে আমার কাছে মনে হয়েছে দশ বছরের বেশি সময় আগে,’ বলে সে বাশারের দিকে তাকাল। ‘হ্যাঁ, এখানে টমির সঙ্গে আমার মতামত অনেকটাই মিলে যাচ্ছে।’

‘তারমানে এটাধরেই নিতেই পারি গাড়ি ও সঙ্গে এই মৃতদেহ এগারো বছর ধরেই পানির নিচে পড়ে ছিল?’

‘হুম, তা বলা যেতে পারে।’

‘এই মানুষটার ব্যাপারে আর কিছু কী বের করা সম্ভব?’ বাশারের মনের ভেতরে খেলা চলছে। একজন বিদেশি এগারো বছর ধরে ময়মনসিংহ শহরের এক পুকুরের তলায় পড়ে আছে, ব্যাপারটা ওর কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। আবার এটা নিয়ে কোনো আলোড়ন হয়নি এটাও অদ্ভুত একটা ব্যাপার।

‘হ্যাঁ, সম্ভব,’ মনিকা একটু হেসে জবাব দিল। মাস্কের আড়ালে তার হাসিটা না দেখা দিলেও চোখের উজ্জ্বলতাটুকু ঠিকই নজরে পড়ল। এই বদ্ধ ঘরে এরকম অবস্থাতেও যেকোনো পুরুষ মানুষের বুকের ভেতরে ধুকপুকানি সৃষ্টির জন্যে এই চাহনি যথেষ্ট। বাশার মুগ্ধ হয়ে মুহূর্তের জন্যে হারিয়ে যেতে বসেও নিজেকে শক্ত করে একটা ঢোক গিললো।

‘সম্ভব, কারণ আমরা নতুন অনেক কিছুই আমাদের দেশের ফরেনসিক মেডিসিনে পরিচিত করার চেষ্টা করছি,’ বাশার বিমোহিত সৌন্দর্যের সামনে নিজেকে সামলানোর জন্যে সংগ্রাম করছে তবে মনিকার সে-ব্যাপারে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তার মতো যান্ত্রিক সুরে বলে চলেছে। ‘তবে ব্যাপারগুলো এখনো খুবই প্রাথমিক লেভেলে আছে। আর তাছাড়া ব্যাপারগুলো উদ্ধার করাটা একটু সময়সাপেক্ষও বটে।’

‘এই মানুষটার ব্যাপারে আর কী কী বের করা সম্ভব?’

‘প্রথমত তার চেহারা। একেবারে হুবুহ না হলেও ফরেনসিক সিজিআইয়ের মাধ্যমে তার চেহারার একটা ইমেজ তৈরি করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত তার পরিচয়। তার ডিএনএ স্যাম্পল এরই মধ্যে সংগ্রহ করে ফেলেছি। সেটাকে এখন ঢাকায় আমাদের সেন্ট্রাল ডাটাবেইজে এন্ট্রি দিয়ে খোঁজ করে দেখতে হবে। এ ক্ষেত্রে তার পরিচয় বের করার একটা সম্ভাবনা আছে।’

‘কেমন সময় লাগতে পারে এতে?’ মনিকার পিছু নিয়ে বাশার ওর অফিসরুমে চলে এসেছে। মনিকা বাশারের হাত থেকে নিয়ে ক্লিপবোর্ডের ওপরের রিপোর্টটাতে কিছু একটা লিখছে।

‘ভালোই সময় লাগবে এতে, ইন্সপেক্টর। কারণ ফেসিয়াল সিজিআইয়ের সমস্ত ইনপুট আর ডিএনএ স্যাম্পল আমাকে ঢাকায় পাঠাতে হবে। সেখানে নিয়ে ইনপুট দেওয়ার পর সঠিকভাবে বলা সম্ভব কতক্ষণ লাগতে পারে। আপাতত আপনাকে এই রিপোর্টটার একটা কপি দিচ্ছি।’

‘ধন্যবাদ, ডক্টর।’

‘ইউ আর ওয়েলকাম,’ বলে সে একটা চশমা পরে নিয়ে রিপোর্টটাতে আরেকবার চোখ বুলাতে লাগল। ‘কী জানি একটা বলবো ভেবেছিলাম আপনাকে। ও আচ্ছা, লোকটার মৃত্যুর কারণটা কিন্তু আমি বের করতে পেরেছি।

‘কেন, সে পানিতে ডুবে মারা যায়নি? যেহেতু গাড়িটা পানিতে ডুবে ছিল আমি তো ভেবেছিলাম তার পানিতে ডুবেই মরার কথা,’ বাশার একটু অবাক হয়েছে মনিকার কথা শুনে। কারণ এই ব্যাপারটা ওর মাথাতেই আসেনি।

আবারো মৃদু হাসল মনিকা। আগের মতোই বাশারের বুকে আরেক দফা আলোড়ন বয়ে গেল। ‘আমিও প্রথমে তাই ভেবেছিলাম কিন্তু পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে আবিষ্কার করি অন্য ব্যাপার। মানুষটা পানিতে ডুবে থাকলেও তার মৃত্যু পানিতে ডুবে হয়নি। তাকে মারা হয়েছিল ঘাড় ভেঙে।’

সঙ্গে সঙ্গে বাশারের শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। এটা একটা বোমা ফাটানো তথ্য। মানে কী? আপনি বলতে চাইছেন লোকটাকে মেরে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল?’

‘সেটা একেবারেই সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে খুব জোর সম্ভাবনা সেটাই।’

‘কিন্তু এমনও তো হতে পারে গাড়িটা অ্যাক্সিডেন্ট করে পানিতে পড়ার আগেই লোকটার ঘাড় ভেঙে গেছিল। তারপর হয়তো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটা পানিতে পড়ে যায়।’

‘গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়েছে না অ্যাক্সিডেন্ট করে পড়েছে সেটা তো আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়, তবে লোকটার ঘাড় অ্যাক্সিডেন্টে ভাঙেনি। এটা আমি নিশ্চিত। কারণ অ্যাক্সিডেন্টে ঘাড় ভাঙা সাবজেক্ট এর আগেও আমি দেখেছি। ওটার ধরন এমন নয়। এই লোকটাকে খুন করা হয়েছিল,’ বলে ডক্টর মনিকা একটু থামলো।

‘…তাকে খুন করা হয়েছিল গলায় ফাঁস দিয়ে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *