প্রথম অংশ : ছন্দপতন
দ্বিতীয় অংশ : মৃত্যুহরণ

সপ্তরিপু – অধ্যায় ১০

অধ্যায় দশ – সময় : ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ

ব্রহ্মপুত্র নদীর তীর, ময়মনসিংহ

‘এটাই তো সেই জায়গা নাকি?’ প্রশ্নটা ম্যাকফির।

ওরা এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে সেই ক্যাম্প সাইটে যেখান থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যরা গায়েব হয়েছে। জমিদারের ওখান থেকে রওনা দিয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক চলার পর এখানে এসে পৌঁছায় ওরা। কিন্তু এখানে এসে একটু হতাশ হয়ে পড়েছে ম্যাকফি। কারণ জায়গাটাতে বিশেষ কিছুই নেই। সাবধানে মূল জায়গাটা এড়িয়ে ঘোড়াগুলোকে রেখে নেমে আসতে বলল ও সবাইকে।

নিজের ঘোড়াটাকে একটা ছোটো গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে সে নিজে এসে দাঁড়াল জায়গাটার কাছে। বড়ো করে নিশ্বাস নিলো একবার। বাতাসে ভেজা গন্ধ। তারমানে নদী এখান থেকে একেবারেই কাছে। ‘এখান থেকে নদী কাছেই নাকি?’ সে প্রশ্ন করল জোনাথনের উদ্দেশ্যে।

‘ওই যে,’ বলে জোনাথন হাত তুলে একদিকে দেখাল।

জোনাথনের নির্দেশিত জায়গায় তাকিয়ে নিজেকে বোকা মনে হলো ম্যাকফির। আরে ওইতো গাছপালার ফাঁক দিয়ে পানির রূপালি ঝিলিক চোখে পড়ছে। নদী এত কাছে! আরো আগেই চোখে পড়া উচিত ছিল ওর। ম্যাকফি পুরো জায়গাটার একটা আকৃতি দাঁড় করানোর চেষ্টা করল। মূল রাস্তা থেকে একটু দূরে। নদীর খুব কাছেই জঙ্গুলে এলাকার শুরুতেই জায়গাটা। ক্যাম্প করার জন্যে একেবারেই আদর্শ।

‘ক্যাম্প করার জন্যে জায়গাটা দারুণ তাই না, বস?’

‘হুম,’ জোনাথনের প্রশ্নের জবাবে ম্যাকফি সামান্য মাথা নাড়ল। ‘একারণেই ওরা এখানে ক্যাম্প করেছিল। একদিকে রাতের গরমে নদীর ঠান্ডা হাওয়া আসবে। অন্যদিকে মূল রাস্তা আর নদীপথের মাঝ বরাবর। কারো চলাচলের পথেও পড়বে না আবার ওরা নিজেরাও যেকোনো সময়ে ক্যাম্প গুটিয়ে মূল রাস্তায় চলে যেতে পারবে।’ কিন্তু, কী জানি একটা ব্যাপার ম্যাকফির মাথায় আসি-আসি করেও আসছে না।

‘কিন্তু কী?’ জোনাথন জানতে চাইল।

বুঝতে পারছি না। একটা ব্যাপারে কোথায় যেন সামান্য গোলমাল আছে। চলো ক্যাম্পটা আমাদেরকে খুব ভালোভাবে নিরীক্ষণ করতে হবে। জোনাথন, তুমি সবকিছু খুব ভালোভাবে দেখবে আর ওই ব্যাটা গেল কোথায়?’ বলেই সে রাজার পাঠানো সহিসটার খোঁজ করল।

ভীষণ চিকন আর লম্বা লোকটার কি জানি নাম বলেছিল রাজা মশাই কে জানে। ও, ডুম্বুর। এ কেমন নাম! ভারতবর্ষে এতবছরের অভিজ্ঞতায় বহু ধরনের আজব নাম ম্যাকফি শুনেছে কিন্তু এরকম অদ্ভুত নাম এর আগে শুনেছে বলে মনে পড়ল না। লোকটার দিকে ফিরে তাকাল ম্যাকফি। এই শুকনো হাড়ের দোকানকে দিয়ে কতটুকু কাজ হবে কে জানে।

‘জোনাথন, রাজা মশাই কী একটা লোক ধরিয়ে দিল আমাদেরকে!’ ম্যাকফির গলায় চরম বিরক্তি। ‘শোনো, আমি মোটেও এর ওপরে ভরসা করতে পারব না। তুমি কাজ করো, আর একে পাশে রাখো।’

‘ঠিক আছে,’ বলে জোনাথন মহাবীর সিংয়ের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল ডুম্বুরকে নিয়ে আসতে। সবাই মিলে ওরা ক্যাম্পের ভেতরের দিকে এগোল।

ঝোপ-ঝাঁড় কেটে বেশ অনেকখানি জায়গা পরিষ্কার করা হয়েছিল তাঁবু বসানোর জন্যে। তাই গোল একটা আকৃতি পেয়েছে ক্যাম্পটা। এখানে ওখানে টুকিটাকি কিছু জিনিসপত্র ছড়ানো ছিটানো থাকলেও তাঁবু থেকে শুরু করে মূল্যবান কোনো জিনিসই অবশিষ্ট নেই।

‘এখানে কি কিছুই অবশিষ্ট ছিল না?’ জানতে চাইল ম্যাকফি।

‘না থাহুনের মতোনই,’ ওদের সঙ্গে আসা শংকর বলল। ‘যা আছিল ওইগুলা খুবই সামাইন্য জিনিস। দামি কিছুই না।’

তারপরও যা আছে সেগুলো আমাকে দেখতে হবে। হয়তো ওখান থেকে কিছু না কিছু পাওয়া যেতে পারে,’ ম্যাকফি অনেকটা আনমনেই বলে উঠল। কিন্তু ওর দিকে খেয়াল নেই জোনাথনের, সে তার পিঠ থেকে নামিয়ে বিরাট বন্দুকটা ধরিয়ে দিয়েছে মহাবীর সিংয়ের হাতে। পুরো জায়গাটা তিনশ ষাট ডিগ্রি ঘুরে একবার দেখে নিয়ে বলতে শুরু করল, ‘এই জায়গাটায় রাখা ছিল ওদের ঘোড়াগুলো।’

‘কয়টা হতে পারে?’ ম্যাকফি জানতে চাইল কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাকে থামতে বলল জোনাথন।

‘সংখ্যায় পরে আসছি। আগে মোটা দাগে বলে নেই,’ বলেই সে আবারো আঙুল তুললো। ‘এখানে সারি দিয়ে বসানো হয়েছিল পরপর তিনটে তাঁবু। সম্ভবত দুটোতে সৈন্যরা ছিল আর একটাতে ওদের সহিস আর রান্নার লোকেরা,’ বলে সে ঘোড়াগুলো রাখার জায়গাটায় চলে গিয়ে কিছুক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করল। ‘সম্ভবত সাত বা আটটা ঘোড়া ছিল। আমি ঠিক নিশ্চিত হতে পারছি না।’

‘আর মানুষ? কতজন মানুষ ছিল, সেটা কি আর বলা সম্ভব?’

তাঁবুগুলোর কাছে এসে জোনাথন অনেকক্ষণ ঘাঁটাঘাটি করে দেখেও কিছু বুঝতে পারল না। ‘আমার পক্ষে তো সম্ভব না-ই, কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব কিনা সন্দেহ আছে। কারণ এই জায়গাটার ওপর দিয়ে এত বেশি ঝড়ঝাপটা বয়ে গেছে এখন আর সঠিকভাবে কিছুই বলা সম্ভব না।’

‘কিছুই না?’ একটু হাতাশায় গুঙিয়ে উঠল ম্যাকফি। ও আশা করেছিল এখান থেকে অন্তত বিশেষ কিছু না কিছু তো পাওয়া যাবেই। অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকালো জোনাথন। ঝাঁকিয়েই সে অবাক হয়ে ফিরে তাকাল উলটো দিকে। ‘আরে, এই ব্যাটা আবার কী করে?’

ডুম্বুর হঠাৎ যেন একটা ঝটকা দিয়ে জেগে উঠেছে। হাতে একটা মোটা সুতোর মতো দেখতে কী জানি নিয়ে মাটিতে বসে পড়েছে। কুকুর যেভাবে মাটি শুঁকে-শুঁকে শিকারের অনুসন্ধান করে ঠিক সেভাবেই মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে হাতে ধরা সুতোটো ধরে টান দিচ্ছে। একবার লম্বা করে ধরছে ওটাকে আরেকবার ছোটো করছে মাটিতে টান-টান করে দিচ্ছে কিন্তু মাটিতে লাগাচ্ছে না সুতোটা। এরকম প্রায় ফুট বিশেক জায়গা ঠিক একইভাবে মাপতে মাপতে যেখানে ক্যাম্পের লোকজন ঘোড়া রেখেছিল বলে জানিয়ে ছিল জোনাথন ঠিক সেই জায়গাটায় গিয়ে থামলো। সেখানে কিছুক্ষণ এটা-সেটা করে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল ঝটকা দিয়ে।

শেয়াল গোত্রের প্রাণি যেভাবে মুখ উঁচু করে ডাক ছাড়ে সে-ও নিজের সরু চিকন মুখটাকে উঁচু করে বাতাস টেনে নিলো নাকের ফুটো দিয়ে। তারপর খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে এসে ম্যাকফি আর জোনাথনের সামনে দাঁড়িয়ে বোকার মতো হাসি দিল একটা। দুবার মুখ নাড়ল কিন্তু কিন্তু কথা বেরুল না।

‘এই ব্যাটা, কথা বলিস না ক্যান?’ খেকিয়ে উঠল ওদের সঙ্গে আসা শংকর। ‘কী কী দেখলি?’

শংকরের ধমক খেয়ে তার হাসি একটু ম্লান হয়ে গেল। অভিযোগের ভঙ্গিতে একবার হাত নেড়ে সে আবারো মুখ খুলল। এবার তার সরু গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো অস্বাভাবিক ভারী আওয়াজ। ‘হুজুর, দেহুইন নেংটিডা কিরম করে?’ বলে সে শংকরের দিকে তাকিয়ে একবার মারের ভঙ্গি করল। ডুম্বুরের মুখে ‘নেংটি’ শব্দটা শুনে সঙ্গে সঙ্গে কালো হয়ে গেল শংকরের মুখ। ম্যাকফি অনুমান করল এটা নিশ্চয়ই স্থানীয় ভাষায় কোনো গালি হবে। ডুম্বুরের এদিকে কোনো খেয়াল নেই, সে বলে চলল তার আবিষ্কার।

‘হজুর, আইন্নের অনুমান ঠিকই আছিল তয় পুরাডা না। অইহানে ঘুড়া আছিল মোড নয়ডা। ছয়ডা ছিল সাহেবগর ঘুড়া। আর অন্য তিনডা এইহানের মাইনসের।’

‘তুমি কি নিশ্চিত?’ ডুম্বুর একেবারে স্থানীয় ভাষায় বললেও ম্যাকফির বুঝতে সমস্যা হয়নি। অন্যদিকে ম্যাকফির ভাঙা বাংলাও ডম্বুর মোটামুটি বুঝে নিলো।

নিজের ময়লা নখ খুঁটতে খুঁটতে বলতে লাগল। আমি ঠিকয় বুচ্ছি। সাহেবগর ঘুড়ার খুরের নাল অন্যরহম আর এনুর মাইনষের নাল অন্যরহম। তয় হেই তিনটা ঘুড়ার নালই আছিল না। আর সেই তিনডা ঘুড়া আইছিলও পরে।’

‘মানে ও বলতে চাইছে, কোম্পানির সৈন্যদের ঘোড়াগুলো আগে থেকেই ছিল এরপরে ওদের সঙ্গে আরো তিনটে নাল ছাড়া স্থানীয় ঘোড়া এসে যোগ দেয়,’ এই পর্যন্ত বলে ম্যাকফি থেমে যায়। পুরনো অস্বস্তিটা এসে ভর করেছে; কী জানি একটা বুঝেও বুঝতে পারছে না, ধরা দিয়েও দিচ্ছে না। কপালের পাশের কাটা দাগটা ঘষতে লাগল হাত দিয়ে। এই ডুম্বুর লোকটা তো বেশ কাজের, মনে মনে ভাবল সে। একে আবারো কাজে লাগাতে হবে দেখা যাক কী বের করতে পারে সে।

‘ডুম্বুর?’ ম্যাকফি ডাক দিয়ে দেখল সে আর আগের জায়গাতে নেই। সে আবারো কাজে নেমে গেছে। এবার জোনাথন আর ডুম্বুর দুজনে মিলে যেখানে তাঁবুগুলো ছিল সেখানে বসে মাপ-জোখ শুরু করেছে। এদিকে সেদিকে কিছুক্ষণ ছুটোছুটি করল দুজনে। ম্যাকফি, মহাবীর সিং আর শংকর ছায়ায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। ছায়ার ভেতরে বেশ ঠান্ডা-ঠান্ডা একটা ভাব কিন্তু অন্যান্য জায়গায় রোদের তেজ মাথা খারাপ করে দেবার মতো। তারপর বেশ কিছুক্ষণ পর ঘর্মাক্ত কলেবরে ফিরে এলো জোনাথন।

‘কী খবর? কিছু বুঝতে পারলে?’ ম্যাকফি জানতে চাইল।

‘অসম্ভব একটা ব্যাপার। কারণ একে তো ঘটনা ঘটার পর এখানে বহু লোকের সমাগম ঘটেছে, তারপর আবার কেন জানি আমার কাছে মনে হলো—যারাই এখানে ছিল তারা নিজেদের সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। তবে এই লোকটা অসাধারণ। আমি ওর তুলনায় ট্র্যাকিংয়ে নস্যি। ও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমার সাধ্যে এরচেয়ে বেশি আর কিছু সম্ভব না।

‘হুজুর, ছোটো মুখে বড়ো কতা কই,’ শংকর ছেলেটা কি মাথা সোজা করে কথা বলতেই পারে না? মনে প্রশ্ন জাগলো ম্যাকফির। আবারো ওদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে শংকরের মাথা নিচু হয়ে গেছে।

‘হুজুর, এইহান থাইকা যদি কেউ কিছু বাইর করতে পারে তয় সেইটা ডুম্বুরই পাইরবো। হেয় কিন্তু কাবেল লোক। পাগল অইতে পারে তয় কাবেল। হের নাম আছিল দেলোয়ার আলী। দেলোয়ার থাইক্কা ডুম্বুর। একসময় হেয় আছিল এই এলাকার সেরা সহিস, সৈনিক আর শিকারি। আসাম রাজার সেনাবাহিনীতি আছিল। হেইহানেই ভুপালের যুদ্ধের সময় হের বউ আর বাচ্চাডারে হের চোখের সামনে খুন করার পরে পাগল অইয়া যায়। এহন রাজাসাইবের বাড়িতেই থাহে, ঘুইরা বেড়ায় আর পাগলামি করে। তয় এহনো হেরে ছাড়া রাজাসাইব শিকারে যায় না। লোকে কয় হের নাকি দিব্য আছে। হেয় নাহি অনেক কিছু দেখতে পারে। হেয় নাকি একবার…’

হঠাৎ মাটিতে প্রায় শুয়ে শুয়ে মাপ-জোখ করতে থাকা ডুম্বুর শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে উঠল। সবাই চমকে উঠে ফিরে তাকাল ওর দিকে। ম্যাকফি এগিয়ে গেল ওর দিকে। বাকি সবাইও অনুসরণ করল। ডুম্বুর লোকটা মাটিতে ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখছে। দেখতে দেখতেই রীতিমতো আর্তনাদ করে উঠল, ‘খারাপ! খুব খারাপ!’

‘কী ব্যাপার? কিছু পেলে?’ ম্যাকফি চিন্তিত মুখে জানতে চাইল। লোকটার এই অদ্ভুত আচরণের কোনো মানে বের করতে পারছে না।

‘এনু খুব খারাপ কিছু অইছে। বুঝতাছি না। অনেক মানুষ আসছিল কিন্তুক সব মুইচ্ছা গেছে, এই পর্যন্ত বলে সে হঠাৎ মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে লাগল। ম্যাকফি একবার জোনাথনের দিকে তাকাল এরপর ফিরে তাকাল শংকরের দিকে।

‘হুজুর, ও পাগল অইতে পারে কিন্তু ওর কামে গলদ নাই। মনে অয় কিছু বুজাইতে চাইতাছে। বুজলে আইন্নেগরই লাভ,’ শংকর এখন অনেকটা স্বচ্ছন্দ হয়ে আসছে। প্রতিবার আর আগের মতো মাথা নিচু করে কথা বলে না।

ম্যাকফি মহাবীর সিংয়ের দিকে তাকিয়ে সতর্ক থাকার ইশারা করে জোনাথনকে নিয়ে পিছু নিলো ডুমুরের।

কারো দিকে খেয়াল নেই তার। একমনে মাটিতে দেখছে একবার, একটু পর পর একটা পাতা, একটা কাঁটাঝোপ উলটে দেখছে। শিকারি কুকুর যেভাবে ছোটো ছোটো ইঁদুর কিংবা খোরগোসের পিছু নেয় ঠিক সেভাবেই যেন একটা শিকারি কুকুরের মতোই ছুটে চলেছে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে। ম্যাকফির পক্ষে তো সম্ভবই না, জোনাথন দুয়েকবার চেষ্টা করে দেখল কিছু বোঝা যায় কিনা। কিছুই বুঝতে পারল না, মানুষটা আসলে কী দেখে কীসের পিছু নিচ্ছে।

ওরা এই মুহূর্তে জঙ্গুলে এলাকা থেকে বের হয়ে অনেকটা বন্ধ একটা টিলার মতো জায়গায় এসে পৌঁছেছে। এখান থেকে জায়গাটা একটা ঢালের মতো নেমে গেছে নিচের দিকে। ঢালের নিচের অংশে নদীর একটা পাশ দিয়ে প্রবেশ করা পানি ছোটো একটা নালার মতো সৃষ্টি করেছে। নালাটা পার হলেই অন্যপাশে ছোটো একটা ঢাল। ঢালের ওপাশ থেকে নেমে গেছে বিস্তৃত বালুচর। বালিময় চরটাকে দেখতে লাগছে সমুদ্র সৈকতের মতো। বালিময় জায়গাটা পার হলেই শুরু হয়েছে বিপুলা ব্রহ্মপুত্র। ম্যাকফি জঙ্গুলে জায়গাটা পার হয়ে একবার বিস্তৃত বারিধারার দিকে দেখে নিয়ে আবারো ফিরে তাকাল ডুম্বুরের দিকে।

মাটির দিকে তাকিয়ে অস্থির হয়ে ছটফট করছে লোকটা। ছোটো একটা কাঠি দিয়ে বার বার মাটিতে খোঁচা দিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে সে। জোনাথনও বোঝার চেষ্টা করছে। দুজনে ফিসফিস করে কথাও বলছে, কিন্তু ধীরে ধীরে ডুম্বুরের অস্থিরতা বাড়তে লাগল। জোনাথনের দিকে তাকিয়ে ম্যাকফি ইশারায় জানতে চাইল লোকটা কী করছে।

জোনাথন ওর দিকে তাকিয়ে একবার অসহায়ভাবে কাঁধ নেড়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই আবারো ডুম্বুর মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠল। হাতের ছোটো কাঠিটা ফেলে দিয়ে দু-হাতে নিজের মাথা চেপে ধরেছে এখন।

লোকটার এই অবিরাম পাগলামিতে একটু বিরক্ত ম্যাকফি একটা ধমক দিতে যাচ্ছিল তার আগেই সে আবারো কথা বলে উঠল। ‘হুজুর, খারাপ, খুব খারাপ। ওই লোকগুলো…’

‘লোক মানে কারা?’ জোনাথন বলে উঠল ।

‘অনেকগুলো মানুষ…সাহেবরা না, রাজারাও না, অন্য কেউ,’ ডুম্বুরের চোখ বড়ো বড়ো হয়ে উঠেছে। ‘ওরা খালি পায়ে আসছিল…আসছিল….

‘তারপর?’

‘অনেক খারাপ, খারাপ,’ সে আবারো ছট-ফট করতে শুরু করল। কিন্তুক কিন্তুক ওরা এই পজ্যন্ত আইছিল। কিন্তুক এরপরে গেল কই…? কই গেল?’ বলে সে কেমন জানি বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওদের দিকে। একবার ম্যাকফিকে

দেখছে আরেকবার জোনাথনকে দেখতে লাগল।

ম্যাকফির একাধারে রাগ হতে লাগল আরেকদিকে লোকটার অবস্থা দেখে একটু মায়াও হলো। রাগ লাগছে কারণ এখানে এসে প্রায় তেমন কোনো কাজই হয়নি। অন্যদিকে এই লোকটার জন্যে মায়াও লাগছে কারণ সে তার সাধ্যের চেয়ে বেশি চেষ্টা করেছে। না পারলে এখন কিছুই করার নেই। ম্যাকফি বড়ো করে একবার নিশ্বাস নিয়ে জোনাথনের দিকে তাকিয়ে ওকে উঠতে বলল। শেষবারের মতো একবার জায়গাটাকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে ওরা রওনা দিল যেখান থেকে এসেছে সেদিকে।

ডুম্বুর কেমন জানি গম্ভীর হয়ে গেছে। আর থেকে থেকে বিড়বিড় করছে, ‘কেডা এরুম আইতে পারে। এরুম তো অয় নাই…’

‘তারমানে ব্যাপারটা হলো, যে বা যারাই এখানে এসে থাকুক এরা খুবই বিপজ্জনক। নিজেদের ট্র্যাক এরা এমনভাবে মুছেছে যে এর মতো লোকও সেটা বের করতে পারছে না, জোনাথন আনমনেই বলে উঠল। সে একহাতে ডুম্বুরকে ধরে রেখেছে।

‘হুম,’ ম্যাকফি ডান হাতের একটা আঙুল কপালের পাশে ঘষছে। ওর ভেতরে আবারো পুরনো অস্বস্তিটা ফিরে এসেছে। কী জানি একটা ধরা পড়ি-পড়ি করে ও ধরতে পারছে না। ‘কিন্তু সমস্যা হলো আমি ভেবেছিলাম এখানে এসে কিছু না কিছু পাওয়া যাবেই কিন্তু কিছুই তো পাওয়া গেল না। এবার কোনো দিক দিয়ে কাজ এগোবে বুঝতে পারছি না।

‘স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আরো বিশদভাবে কথা বলে দেখা যেতে পারে।’

‘তোর কি মনে হয়, রাজার লোকেরা সেটা করেনি? ওতে খুব বেশি কাজ হবে না। তারচেয়ে আরেক কাজ করা যেতে পারে। এই ক্যাম্প থেকে যা যা পাওয়া গেছে সেগুলো ঘেঁটে দেখা যেতে পারে। ওখান থেকে কিছু একটা পাওয়া গেলে যেতেও পারে।

‘এটা একটা কাজের কথা।’

ওরা প্রায় চলে এসেছে ক্যাম্পের কাছে। দূর থেকেই দেখতে পেল মহাবীর সিং আর শংকর দাঁড়িয়ে আছে। জোনাথন এগিয়ে গিয়ে ঝিমিয়ে থাকা ডুম্বুরকে নিয়ে এগিয়ে গেল ওদের দিকে

‘হুজুর, কুছ মিলা?’ শংকর দূর থেকেই ওদেরকে দেখে জানতে চাইল।

‘নাহ, ডুম্বুর তো কিছুই বের করতে পারল না।’

ম্যাকফির কথা শুনে শংকরের চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। ডুম্বুরও কিছু কইতে পারল না। তাইলে দুশমন বহুত চালাক।

‘হুম, তুমি একে ধরো। বেচারা একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। ও অনেক চেষ্টা করেছে, না পারলে কিছু করার নেই।’ অর্ধ-চেতন ডুম্বুরের মাথা ঝুলে আছে নিচের দিকে। থেকে থেকে বিড়বিড় করছে।

জোনাথনের কথা শুনেই শংকর এক পা পিছিয়ে গেল, ‘হুজুর, আমি ওরে ধইরতে পারব না।’

ম্যাকফি জোনাথন দুজনেই অবাক হয়ে গেছে ওর কথা শুনে। এমনকি মহাবীর সিংও একটু অবাক হয়ে তাকাল ওদের দিকে।

‘হুজুর, আমি কায়স্থ। শুদ্র কোনো হিন্দুরে ধরলেও আমার জাত যাবে আর ও তো মুসলমান,’ বলেই সে দুই হাত তুলে নিজের কান ধরে অপারগতা প্রকাশ করল।

সঙ্গে সঙ্গে মুখ বাঁকা হয়ে গেল ম্যাকফির। আবারো সেই প্রকট বৈষম্য।

‘হোয়াট?’ তীব্র রাগের সঙ্গে জোনাথন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ম্যাকফি তাকে থামিয়ে দিল।

‘এই নিরীহ লোকটার ওপরে রাগ দেখিয়ে লাভ কী? শংকর যদি ডুম্বুরকে ধরে তাহলে ওর জাত যাবে, শংকরের পরিবারকে একঘরে করা হবে, কাজ হারাবে। জীবন নরকময় হয়ে উঠবে শংকরের, কাজেই ঝামেলা করে লাভ নেই। মহাবীর সিং, তুমি ডুম্বুরকে ঘোড়ায় তোল। চলো আমাদেরকে যেতে হবে।

শেষবারের মতো জায়গাটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলো ম্যাকফি। তেমন কোনো কাজ হলো না এখানে এসে। তবে যা-যা পাওয়া গেছে এখানে এসে সেগুলো মনে মনে গুছিয়ে নিয়ে কাজে নামতে হবে। তবে সেটা আরো দুরূহ হবে। সবাই ইতিমধ্যেই ঘোড়ায় উঠে বসেছে। সে ঘোড়ার কাছে এসে ঘোড়াটার বাঁধন খুলতে লাগল। ঘোড়ায় উঠে ওরা রওনা দিল জঙ্গুলে পথ ধরে। ম্যাকফির মনের ভেতরে ঝড় চলছে। কী, জানি একটা ব্যাপার মনের কোনে ধরা পড়ি-পড়ি করেও পড়ছে না। ওরা ক্যাম্পের এলাকা ছেড়ে পায়ে চলা পথে প্রবেশ করেছে।

সময়টা দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে চলেছে এখন। জঙ্গুলে পথে সুন্দর ঝিরি-ঝিরি হাওয়া বইছে। কিছু খাবার সঙ্গে করে আনা হলেও সেটা গ্রহণ করা হয়নি। পেটের ভেতরে ক্ষুধার পরিষ্কার ডাক টের পাওয়া যাচ্ছে। আরো কিছুদূর এগিয়ে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে ঘোড়া থামালো জোনাথন।

‘বস, আমরা এখানে থামতে পারি। বিশ্রামও নেওয়া হলো সেই সঙ্গে দুপুরের খাওয়াটাও সেরে নেওয়া যাবে।

ম্যাকফি ওর কথা না শুনেই সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। ওর মাথায় একটা জট খুলতে শুরু করেছে। যে ব্যাপারটা ধরা পড়ি পড়ি করেও পড়ছিল না, সেটা পরিষ্কার হয়ে আসছে এখন।

‘বস,’ আবারো ডাক দিল জোনাথন।

‘হ্যাঁ,’ ঘোড়া থামিয়ে দিল ম্যাকফি। ‘এই জায়গাটাই ভালো হবে,’ বলে ও ঘোড়াটাকে একপাশে থামিয়ে নামতে লাগল। অন্যরাও একে একে নেমে আসতে লাগল। ঘোড়াটাকে একটা পাতলা গাছের সঙ্গে বাঁধতে যাবে হঠাৎ একটু আগে ডুম্বুরের কথা মনে পড়ে গেল ওর। যেখানে কোম্পানির সৈন্যদের ক্যাম্পের কাছে ঘোড়া বেঁধে রাখা ছিল সেখানে প্রথমে কিছু ঘোড়া ছিল তারপর সেগুলোর সঙ্গে আরো ঘোড়া এনে রাখা হয়। এই জায়গাটাতেই ওর খটকা লাগছিল প্রথম। সেই সঙ্গে এটা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনের ভেতরে দলা পাকিয়ে থাকা আরেকটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল।

কোম্পানির সৈন্যরা রাজার ওখান থেকে রওনা দিয়ে যেখানে ক্যাম্প করার কথা ছিল, রিপোর্ট অনুযায়ী সেখানে ওদের অবস্থান করার কথা ছিল যতক্ষণ, তারচেয়েও প্রায় একদিন বেশি সময় ধরে অবস্থান করছিল। তারমানে অবশ্যই ওরা অপেক্ষায় ছিল কারো সঙ্গে দেখা করার জন্যে। কোম্পানির সৈন্যদের অধিক সময় অবস্থান আর ডুম্বুরের ঘোড়া কাহিনি দুটো মিলিয়ে তারমানে ব্যাপারটা এমন দাঁড়াচ্ছে, কোম্পানির সৈন্যরা কারো সঙ্গে দেখা করেছিল। আর ওদের গায়েব হবার পেছনে নিশ্চয়ই ওদের কোনো-না-কোনো ভূমিকা আছে।

সে ঘোড়া থেকে নেমে এখনো ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। অন্যরা যার যার মতো নিজেদের কাজে লেগে গেছে। ব্যাপারটা পরিষ্কার হতেই ও জোনাথনের দিকে ফিরে তাকাল, কথাটা এখুনি ওর সঙ্গে শেয়ার করতে হবে। ও জোনাথনকে ডাক দিতে যাবে তার আগেই চিৎকার করে উঠল ডুম্বুর। অন্যরা ঘোড়া থেকে নেমে গেলেও ঘোড়ার ওপরে মাথা নিচু করে বসে ছিল সে।

হঠাৎ ঝট করে সোজা হয়ে তারস্বরে চেঁচিয়ে কিছু একটা বলে উঠল। কথাটা সে স্থানীয় বাংলায় বলেছে ফলে একেবারে পরিষ্কার বুঝতে পারল না ম্যাকফি। কিন্তু ও বোঝার আগেই পাশ থেকে ওদের ফেলে আসা জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল শংকর। ‘হুজুর, কই হামারা পিছা কার রাহে হ্যায়।’

সঙ্গে সঙ্গে শংকরের নির্দেশিত দিকে ফিরে তাকাল ম্যাকফি আর জোনাথন। সবুজ গাছপালার ফাঁক দিয়ে অপসৃয়মান মানব আকৃতিটাকে না দেখতে পাবার কোনোই কারণ নেই।

‘এই, থাম থাম,’ বলে তীব্র এক চিৎকারের সঙ্গে ওদিকে দৌড় দিল মহাবীর সিং, আর তার পেছন পেছন শংকর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *