প্রথম অংশ : ছন্দপতন
দ্বিতীয় অংশ : মৃত্যুহরণ

সপ্তরিপু – অধ্যায় ২২

অধ্যায় বাইশ – সময় : ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ

তারাটি গ্রাম, মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ

‘ওকে আবারো জিজ্ঞেস করো এই জায়গাই কি না?’ ম্যাকফিরা এই মুহূর্তে অবস্থান করছে মুক্তাগাছা আর বেগুনবাড়ি এলাকার মাঝামাঝি তারাটি নামক এক গ্রামের খালপাড়ে। জায়গাটা জমিদার বাড়ির বেশ কাছেই। সন্ধ্যার রেশ কাটিয়ে রাত গভীর হতে শুরু করেছে মাত্র। ওদেরকে এই জায়গায় পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে পানু নামের সেই বাজিকর ছেলেটা।

সন্ধেবেলা ওরা কথোপকথনের প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে এমন সময় হুড়মুড় করে ওদের কাচারি বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে একটা ঘোড়ার গাড়ি। স্বয়ং রাজা সূর্যকান্ত আচার্য বন্দি তিনজনের খবর পেয়ে চলে এসেছে।

রাজাকে আসতে দেখে তাকে কাচারির উঠানেই চেয়ার পেতে বসতে দেওয়ার ব্যবস্থা করে ওরা। সূর্যকান্ত প্রথমে এসে মিষ্টি মিষ্টি কথা বললেও একটু পরেই সে রেগে ওঠে, কেন ম্যাকফিরা বন্দিদেরকে ওদের কাছে হস্তান্তর করছে না? কেন জানি লোকটার কথা শুনে রেগে না উঠে বন্দিদেরকে নিয়ে আসার হুকুম দেয় ম্যাকফি। বাপ আর ছোটো ছেলেকে জমিদারের কাছে দিয়ে সে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, অন্য বন্দির সঙ্গে ওর কাজ আছে। তাকে চাইলেও এই মুহূর্তে হস্তান্তর করা সম্ভব নয়। আরো একটা কথা পরিষ্কার জানিয়ে দেয়। বন্দিদের সঙ্গে যেন কোনো ধরনের

খারাপ ব্যবহার করা না হয়। তাদেরকে কোনো ধরনের তথ্যের জন্যে চাপ দেওয়া না হয়। ওরা তার অধীনে থাকলেও মূলত ব্রিটিশ রাজের বন্দি, কাজেই ওদের সঙ্গে কোনোরকম বাড়াবাড়ি করা যাবে না। সময় হলে তাদেরকে ব্রিটিশ রাজের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।

রাজা তেমন কিছু না বলে বন্দিদেরকে পাঠিয়ে দিয়ে ওদের সঙ্গে আরো টুকিটাকি কিছু বিষয়ে কথা বলে বিদায় নেয়। আর ম্যাকফিও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। কারণ ও বেশি বাড়াবাড়ি করলে সূর্যকান্ত বিগড়ে গেলে কাজ করতে সমস্যা হতো। তারচেয়ে একে হাতে রাখতে পারলে সুবিধে হবে। আর এই মুহূর্তে ওদের রাতের অভিযানের ব্যাপারটা সে আড়াল করে রাখতে চাইছে রাজার কাছ থেকে। যদিও নিয়ে যওয়া বন্দিদের কাছ থেকে সে জেনে নিতে পারে। তবে এত দ্রুত সে বন্দিদের কাছ থেকে তথ্য বের করতে পারবে বলে মনে হয় না।

সূর্যকান্তকে বিদায় করে দিয়েই ওরা কাজে নেমে পড়ে। প্রস্তুতি নিতে শুরু করে রাতের অভিযানের। কারণ এখনো জানা নেই ছেলেটা ওদেরকে নিয়ে কতদূরে যাবে, আর কখন দেখা করতে আসবে সেই লোক। ওরা দ্রুতই হালকা খাবার খেয়ে বেরুবে এমন সময় শুরু হয় বৃষ্টি। বৃষ্টি থামার পর ওরা যখন বের হয় রাত তখন সন্ধের কোঠা শেষ করে সবেমাত্র গভীরতার দিকে রওনা দিয়েছে। ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ে।

ছেলেটার কাছ থেকে বর্ণনা শুনে শংকর ওদেরকে জানায় ও সম্ভবত বেগুনবাড়ি আর মুক্তাগাছার মাঝামাঝি তারাটি নামক একটা জায়গায় খালপাড়ের বটগাছতলার কথা বলছে। ওখানেই সম্ভবত দেখা করার কথা ওদের। শংকর জায়গাটার আরো বর্ণনা দিতেই ছেলেটা মাথা নেড়ে জানায় ওখানেই দেখা করার কথা। জায়গাটার কাছাকাছি পৌছে ওরা জোনাথন আর মহাবীর সিংকে একটা পুকুর পাড়ে ঘোড়াগুলোর তদারকির জন্যে রেখে ম্যাকফি, শংকর আর পানু মিলে রওনা দেয় নির্দিষ্ট জায়গাটার দিকে। প্রায় ঘণ্টাখানেকের মতো হয়েছে ওরা এখানে এসে খালপাড়ের অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে আছে।

রাতের সময় হলেও আকাশে মস্ত থালার মতো চাঁদ ওঠাতে একেবারে পরিষ্কার দেখাচ্ছে সামনের দিকটা। ওরা এখন বসে আছে খেতের আইলের পাশে। এখান থেকে আর একটা ছোটো মতো জায়গা পার হলেই খালপাড়। খালের ওপরে একটা বাঁশের সাঁকো দেখা যাচ্ছে। ছেলেটা হঠাৎ হাত তুলে সেদিকে দেখাল। ম্যাকফি তাকিয়ে প্রথমে কিছুই দেখতে পেল না মনোযোগ দিয়ে দেখতেই চোখ পড়ল ব্যাপারটা। একজন মানুষ হেঁটে আসছে সেদিক থেকে।

মানুষটা কিছুক্ষণ খালের পাড় ধরে এগিয়ে এসে সাঁকোতে উঠে পড়ল। বেশ দ্রুত হেঁটে সে পেরিয়ে এলো সাঁকোটা। চালচলন দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই এলাকারই মানুষ। সাঁকো পার হয়ে এদিকেই এগিয়ে আসতে লাগল। ম্যাকফি দুজনকেই হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বলে ওরা খেতের আইলের পাশে নিচু হয়ে রইল যাতে মানুষটার চোখে পড়ে না যায়।

লোকটার কোনো দিকে হুঁশ নেই, সে এক নাগাড়ে হেঁটে চলে গেল ওদের সামনে দিয়ে। মনের সুখে শিস বাজাতে বাজাতে চলেছে। ওদের সামনে দিয়ে যাবার সময়ে দেখতে পেল ভীষণ মোটা লোকটার পরনে পাঞ্জাবি আর সাদা ধুতি। মাথায় সাদা পাগড়ির মতো টুপি আর হাতে একটা ছড়ি।

‘আরে, এ তো কামাল শেঠ,’ আনমনেই বলে উঠল শংকর।

লোকটা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থেমে গেল। ম্যাকফি শংকরকে চেপে ধরে নিচে নামিয়ে দিল। এখুনি লোকটার চোখে ধরা পড়ার কোনোই আগ্রহ নেই ওর। লোকটা থেমে গিয়ে আশপাশে একবার দেখে নিয়ে আবারো হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে সে গিয়ে খালপাড়ের বড়োবট গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে গেল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কারো জন্যে অপেক্ষা করছে।

‘হুজুর, এহি আদমি হ্যায়, এর কাছ থাইক্কাই ঘোড়া নিছিল বাপু, এই লোকের কাছেই ঘুড়া বেইচ্চা টেহা দেউনের কতা।’

ম্যাকফি শংকরের দিকে দেখল একবার। দ্রুত ভাবনা চলছে ওর মাথায়। এই লোককে যদি এখন হঠাৎ ধরে ওরা জিজ্ঞেস করে ঘোড়াগুলো সে কোথায় পেয়েছে তবে সে সরাসরি নিষেধ করে দিলেও ওদের কিছু করার থাকবে না। তারচেয়ে আরেক কাজ করা যেতে পারে, এই লোকের ওপরে নজর রেখে কোনো একটা প্রমাণ পেলে ওকে সরাসরি ধরা যেতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও ঝামেলা আছে। এই ব্যাপারটা আগে মাথায় আসেনি দেখে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল ওর। ম্যাকফি কী করবে ঠিক করার আগেই লোকটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে ছোটো একটা আলোর রেখা দেখা গেল।

‘কামাল শেঠ, তামুক খাইতে আছে। ব্যাটা তামুক ছাড়া থাকতেই পারে না,’ শংকর বলে উঠল।

‘চলো,’ হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ম্যাকফি। লোকটাকে সরাসরিই ধরবে। কারণ ওভাবে নজর রাখতে গেলে এই সুযোগও হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। ‘ওকে এখানেই ধরতে হবে,’ বলে ও শংকর আর পানুকে ওর পেছন পেছন আসতে ইশারা করে গাছটার দিকে এগিয়ে গেল। খেতের আইল ধরে এগিয়ে গাছটার যেদিকে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে তার অন্যপাশে এসে থেমে গেল ওরা।

গাছের অন্যপাশে দাঁড়িয়ে ব্রিচেসের বেল্টের সঙ্গে গুঁজে রাখা পিস্তলের বাঁটে হাত রেখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল ম্যাকফির মুখে। বহুদিন পর আবারো নিজের ভেতরে যুদ্ধের উত্তেজনা টের পাচ্ছে ও। আরেকবার শংকর আর পানুর দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। ওর নিয়ত হলো হঠাৎ গাছের অন্যপাশে বেরিয়ে লোকটার সামনে গিয়ে হাজির হয়ে চমকে দিবে। আর সে যদি ঘোড়ার ব্যাপারটা অস্বীকার করে তবে পানুকে প্রমাণ হিসেবে প্রদর্শন করবে।

কিন্তু ওর ভাবনা মনের ভেতরেই রয়ে গেল। লোকটাকে চমকে দেবার বদলে নিজেই চমকে উঠল অন্য কারো গলা শুনে। বাংলা ভাষাটা খুব ভালো বুঝতে না পারলেও ম্যাকফি এটা বুঝতে পারল কেউ একজন কামাল শেঠের নাম ধরে ডাক দিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ধুপধাপ দৌড়ানোর শব্দ এলো। একটু পরেই ভেসে এলো আর্তনাদ আর ধস্তাধস্তির শব্দ। গাছের পেছনে মটকা মেরে পড়ে আছে ওরা। অন্যদিকে কী হচ্ছে ঠিকমতো কিছুই বুঝতেও পারছে না। আবার গাছের আড়াল থেকে উঁকি দেওয়ারও সাহস পাচ্ছে না।

ম্যাকফি একবার ভাবল ওর ব্রিচেসের পকেটে রাখা বাঁশিটা বের করে ফুঁকে দিবে কিনা। ওটা ফুঁকে দিলেই জোনাথন আর মহাবীর সিং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘোড়া নিয়ে পৌঁছে যাবে সাহায্য করার জন্যে। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাতিল করে দিল ভাবনাটা। কারণ অন্যপাশে কী হচ্ছে, কয়জন আছে না জেনে ওদেরকে ডেকে আনলে আরো বিপদ বাড়তে পারে। তার চেয়ে অপেক্ষা করাই শ্রেয় মনে হলো ওর কাছে। ধস্তাধস্তি আর চিৎকারের শব্দ এখন অনেকটাই কমে এসেছে। বেশ কয়েকজন মানুষের গলার শব্দও পাওয়া গেল। শংকর আর পানুর দিকে তাকিয়ে ম্যাকফি দেখল ভয়ে ওদেরও মুখ শুকিয়ে গেছে। ওদেরকে স্থির থাকতে বলে হাতের পিস্তলের বাঁটটা আরেকটু শক্ত হাতে চেপে ধরে গাছের একপাশ থেকে উঁকি দিল ম্যাকফি।

চাঁদ আবারো মেঘের আড়ালে চলে গেছে, তাই প্রথমেই চট করে কিছু চোখে পড়ল না। তবে মনোযোগ দিয়ে দেখেই বুঝতে পারল কামাল শেঠকে ঘিরে আছে বেশ কয়েকজন মানুষ। এই অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে তাদের পরনে সাদা ধুতি আর কালো পাগড়ি। প্রত্যেকের হাতের মজবুত তেল মাখানো লাঠি এই স্বল্প আলোতেও চকচক করছে। ম্যাকফি গাছের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে পেল কামাল শেঠের একটু আগের সেই তেজি ভাব আর নেই। তার মাথার পাগড়ি খুলে মাটিতে লুটাচ্ছে। ধুতির অবস্থাও তথৈবচ। লাঠি হাতে মানুষগুলোর মাঝখানে হাঁটু গেড়ে বসে হাত জোর করে কথা বলছে সে একজন নেতা গোছের মানুষের সঙ্গে। অন্ধকারের ভেতরে পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও ম্যাকফি এটা বুঝতে পারল : নেতাগোছের মানুষটা কিছু একটা নির্দেশ দিল অন্যদের। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একরকম চ্যাঙদোলা করে তুলে ফেলা হলো মোটাসোটা কামাল শেঠকে। তারপর টেনে নিয়ে ওরা রওনা দিল অন্যদিকে।

হতভম্ভের মতো স্থির হয়ে রইল ম্যাকফি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *