প্রথম অংশ : ছন্দপতন
দ্বিতীয় অংশ : মৃত্যুহরণ

সপ্তরিপু – অধ্যায় ২৮

অধ্যায় আটাশ – বর্তমান সময়

বাউন্ডারি রোড, ময়মনসিংহ

‘এই রহস্য উন্মোচন করতে হলে আপনাদেরকে আগের ঘটনা পুরোটা বুঝতে হবে। আর ওই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব এখানে আছে,’ বলে রিফাত ধপ করে জুতোর বাক্সের মতো দেখতে সুন্দর একটা বাক্স কাচের টি-টেবিলের ওপরে রাখল।

ওরা এখন বসে আছে রিফাতের বাসার ড্রইং রুমে। সময়টা বিকেল গড়িয়ে সন্ধে। ইতিমধ্যেই ক্রাইম সিন ইউনিট রিফাতের বাসা থেকে তাদের কাজ সেরে যাবার পর মিস্ত্রি আর বুয়াকে ডেকে সব ঠিকঠাক করা হয়েছে। রিফাতের বাসার সামনে বসানো হয়েছে পুলিশ পাহারা। বাশার অফিসে ফিরে লাঞ্চ করে রিপোর্ট জমা দিয়ে এসেছে। যদিও যা ঘটেছে তার অনেক কিছুই এড়িয়ে গেছে ও রিপোর্টে। ওসি মল্লিক দেখা করতে বলেছে সেটাও করেনি। বরং কাজে মন দিতে চাইছেও। আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগাকে আজকের মতো ছুটি দিয়ে ফিরে গেছে নিজের ঘরে। ওখানে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে জয়াকে নিয়ে ফিরে এসেছে রিফাতের বাসায়।

রিফাত বাক্সটা রাখতেই জয়া ওটাকে উঠিয়ে দেখল। ‘আপনি এতদিন ধরে এগুলোকে এত যত্নে রেখে দিয়েছেন?’

রিফাত কাঁধ ঝাঁকিয়ে অসহায় একটা ভঙ্গি করল। ‘সত্যি কথা হলো, আমার নিজেরও কখনো না কখনো ব্যাপারটাকে খতিয়ে দেখার ইচ্ছে ছিল। এই ঘটনায় যে অপমান আমার হয়েছিলাম সেটা জীবনেও ভুলবো না। আমার পরিবার যদি প্রভাবশালী না হতো, তবে হয়তো এখনো জেলে থাকতে হতো আমাকে, ‘ রিফাতের চোখ ঘোলাটে হয়ে গেছে। তার কষ্টটা বাশার পুরোপুরি অনুভব করতে পারছে। কারণ একই অভিজ্ঞতা তার নিজেরও হয়েছে। বাঁ হাতের আংটিটা আনমনেই চেপে ধরল ও।

‘ওই সময়ে আসলে হয়েছিল কী?’ জানতে চাইল বাশার। জয়া অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। তার মনে হলো না খুব বেশি একটা আগ্রহ আছে জানার। তবুও বাশারের সঙ্গে সহমত পোষণ করে মাথা নাড়াল সেই সঙ্গে রিফাতের অনুমতি নিয়ে সিগারেট ধরালো।

‘কী আর বলবো,’ বলে রিফাত তার চায়ের কাপে চুমুক দিল। ‘তখন আমি সবেমাত্র আর্কিওলজিতে অনার্স করে বেরিয়েছি। ভাবছিলাম চাকরি করব নাকি হায়ার স্টাডিজের দিকে যাবো, এমন সময় আমার মেঝ খালা আমাকে একটা প্রস্তাব দেন। উনি ছিলেন ময়মনসিংহ জাদুঘরের কিউরেটর। তখন তার অবসরে যাবার সময় চলে এসেছে। তার ছেলে-মেয়েরা সব থাকে কানাডায়, সেখানে চলে যাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছেন উনি। তাই ভাবলেন এত বছর চাকরি করেছেন, মিউজিয়ামটাতে পরিচিত কাউকে বসিয়ে যেতে পারলে শান্তি পেতেন। তো ওই মুহূর্তে এই কাজের জন্যে আমার চেয়ে ভালো আর কেউ ছিল না। একে তো প্রত্নতত্ত্বের ছাত্রী তার ওপরে সদ্য পাস করে বেড়িয়েছি, কাজেই খালার পরামর্শে ঢুকে গেলাম। ছোটো জাদুঘর, কাজ নেই তেমন। আমি ঢুকেছিলাম চরম অ্যাডভেঞ্চারের লোভে। সেখানে ক্ল্যারিকেল জব করতে করতে বিরক্ত হয়ে পড়লাম এক বছরের মাথায়। ওখানে বসেই আন্তর্জাতিক কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো এক্সপিডিশন টিম আনানো যায় কিনা ভাবছি ঠিক সেই সময়ে আমার সঙ্গে দেখা হয় বিজয় আচার্যের।

‘সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে এই ম্যারমেরে চাকরি করে আমি যখন বেশ বিরক্ত তখন বিজয় আচার্য আমার সঙ্গে এসে দেখা করে। হালকা-পাতলা সুদর্শন এক তরুণ। তার মনের ভেতরে অনেক ছটফটানি আর অ্যাডভেঞ্চারের নেশা, ‘ বলে রিফাত টেবিলের ওপরে রাখা বাক্স থেকে একটা ছবি বের করে দেখাল। বাশার দেখল ছবির ভেতর থেকে ফর্সা এক যুবক তাকিয়ে আছে, হালকা লাল চুল পাট করে আঁচড়ানো। ও মনে মনে ভাবল ছেলে হিসেবে একটু বেশিই সুন্দর। প্রশ্নটা ও না করে পারল না, ‘যদি কিছু মনে না করেন। আপনার সঙ্গে কি তার প্রেম বা ওরকম কিছু হয়েছিল?’

রিফাত বেশ অবাক হয়ে তাকাল প্রথমে তারপর হেসে ফেলল। হাসিতে যেন একটু দুঃখ। ‘তার সঙ্গে প্রেম হওয়া সম্ভব ছিল না।

‘কেন,’ বাশারও একটু অবাক হয়ে গেছে রিফাতের উত্তর শুনে।

‘কারণ তার শরীরিক ত্রুটি ছিল। একারণেই ওই ঘটনা বলার আগে বিজয়ের ব্যাপারটা বলতে হবে। ময়মনসিংহের জমিদার পরিবারের দুটো শাখা। একটা ওদের মূল শাখা। অন্য শাখাটা অনেকটা পরিবারের পার্শ্ব অংশের মতো। শশীকান্ত আচার্যের বাবা সূর্যকান্ত যখন শশীলজ নির্মাণ করে, তখন সেটা ঘিরে নাকি অনেক জটিলতা দেখা দিয়েছিল। সেই সময়েই আচার্য পরিবারের একটা অংশ আলাদা হয়ে যায়। মূল অংশ থেকে আলাদা হওয়া অংশটার আসলে কী হয়েছিল সেটার প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে সাম্প্রতিক সময়ের ব্যাপারটা বলে নেই। উনিশশো শতকের শুরুর দিকে এই জমিদার পরিবার ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে। ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে তারা এক রকম বিলুপ্ত হয়ে যায়। একাত্তরের পরে তাদের যে বংশধর ছিল তারা পরিবারের বেশিরভাগ সম্পত্তিই সরকারকে দিয়ে দেয়। আশির দশকে আসামে বড়ো মাপের ভূমিকম্পে ময়মনসিংহের অনেক কিছুই নষ্ট হয়ে যায়। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় জমিদার পরিবারের সম্পদ। জমিদার পরিবারের অবস্থা তখন খুব খারাপ নিজেদের বেশিরভাগ সম্পদই মেরামত করার মতো সামর্থ্য তখন তাদের নেই। তাই বেশিরভাগ সম্পদ তারা সরকারকে দিয়ে দেয়, সরকার সেগুলোকে মেরামত করে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ বানায়, সরকারি অফিস বানায়। তো যাই হোক, এরকমই এক বাজে সময়ে বিজয়ের জন্ম। বিজয় ছিল আনবর্ন বেবি।’

‘আনবর্ন মানে?’ বাশার আবারো জানতে চাইল। সে জয়ার দিকে তাকিয়ে দেখল জয়া মোবাইলে কার সঙ্গে যেন চ্যাট করছে। তার এই ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ আছে বলে মনে হচ্ছে না।

‘বিজয়ের জন্মের আগেই তার মা মারা যায়। ডাক্তার মা আর বাচ্চা দুজনকেই মৃত ঘোষণা করে, কিন্তু আসলে মৃত মায়ের পেটের ভেতরে বাচ্চা তখনো বেঁচে ছিল। তার মাকে মৃত ঘোষণা করার পরেও কীভাবে যেন এক নার্স অনুমান করে বাচ্চা আসলে বেঁচে আছে। এরকম কেস খুব রেয়ার হলেও কখনো কখনো ঘটে। এরপরে বিচিত্র এক জটিলতার মধ্যে দিয়ে জন্ম হয় বিজয়ের। জন্মের আগেই মাকে হারায় সে। জন্মের পর দেখা যায় সে আসলে পুরোপুরি পরিণত হয়ে উঠতে পারেনি। অপরিণত বাচ্চাদের যেসব সমস্যা থাকে তারও তেমনই ছিল। বিজয়ের বাবার অবস্থা তখন খুবই খারাপ। কিছুদিন আগেই তার পরিবার একরকম শেষ হয়ে গেছে, তারপর তার স্ত্রী মারা গেছে অন্যদিকে যে বাচ্চার জন্ম হয়েছে সে আসলে ছেলে না মেয়ে সেটা পরিষ্কার না, বিজয়ের বাবা বুঝে উঠতে পারছিল না কী করবে।

‘এমন সময় হিজরারা এসে তাকে নিয়ে যায়। বিজয়ের বাবা একরকম স্বস্তির সঙ্গেই তাকে বিদায় করে। এই ছেলের ব্যাপারে সে কাউকেই কখনো কিছু বলেনি। এমনকি তার বড়ো ছেলে, মানে বিজয়ের বড়ো ভাইকেও না। তো বিজয় জন্মের পর থেকে বড়ো হতে থাকে হিজরাদের মাঝে। সে নিজের বংশ পরিচয় জানত না। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সে বুঝতে পারে সে যাদের সঙ্গে বসবাস করছে সে পুরোপুরি তাদের মতো না। একটা সময় সে হিজরাদের থেকে সরে যায়। সে স্বাভাবিক জীবনযাপনের চেষ্টা করতে থাকে ততোদিনে পরিণত যুবক হয়ে উঠেছে। কলেজে ভর্তিও হয়েছে। তখনো সে জানে না সে আসলে কে।

‘এমন সময় তার বাবা মারা যায়। মারা যাবার আগে নিজের বড়ো ছেলের কাছে বিজয়ের ব্যাপারে বলে যায়। বাপের মৃত্যুর পরে বড়ো ভাই তাকে খুঁজে বের করে। বিজয়ের বড়ো ভাই ছোটোবেলা থেকেই বিদেশ থাকত। সে তার ভাইকেও বিদেশ নিয়ে যেতে চায়, কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে বিজয় যেতে রাজি হয়নি সে তার পারিবারিক পরিচয় পেয়ে বেশ অবাক হয়ে গেছে, সে তার পরিবারকে জানার আগ্রহ প্রকাশ করে। তখন বড়ো ভাই তাকে স্থানীয় কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়ে দেশে তাদের পারিবারিক সম্পত্তি যা ছিল সেগুলো সব বিক্রি করে গোলকিবাড়িতে বিজয়কে একটা বাড়ি বানিয়ে দেয়। এই বাড়িতেই পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে সে মারা যায়, রিফাত এই পর্যন্ত বলতেই জয়া হঠাৎ চোখ তুলে তাকাল।

একটু কড়া সুরেই সে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পারছি না, বিজয়ের ইতিহাস এত বিস্তারিত জানার প্রয়োজনীয়তা কী? এরচেয়ে বরং সেই সময়ে কি ঘটেছিল সেটা জানাটা আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে।’

‘সেটা বোঝাতে হলে বিজয়ের ইতিহাস জানাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পুরো ব্যাপারটার শুরু ওখান থেকেই। তো যাই হোক বিজয় তখন আনন্দমোহন কলেজে ইতিহাসে পড়ত আর তার পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করত। এই গবেষণা করতে গিয়েই সে জানতে পারে ময়মনসিংহ শহরে সত্তরের দশকে একটা ঘটনা ঘটেছিল।’

‘সেই সিন্দুকের ব্যাপারটা তো?’ জয়া প্রশ্ন করতেই রিফাত মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ‘ওটা আমি বাশারকে বলেছি।

‘অহ্, আপনারা তাহলে ওটার ব্যাপারে জানেন। ওটার ব্যাপারে ক্লেইম করে বিজয় তার পারিবারিক ইতিহাসের বেশ অন্ধকার কিছু দিক সম্পর্কে জানতে পারে। সে এ-ও জানতে পারে তার পরিবারের একটা অংশের বেশ কালো অধ্যায় আছে। এবার সে এই অংশটা নিয়ে গবেষণা শুরু করে। গবেষণায় সে আবিস্কার করে তার পরিবারের একটা অংশ ব্রিটিশ ভারতের সময়ে ঠগী ছিল।’

‘কী ছিল, ঠগী?’ বাশার বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল। ‘সেটা আবার কী?’

‘ওহ ডিয়ার! ঠগী কী, সেটা বলতে হলে বেশ লম্বা ইতিহাস বলতে হবে। তবে তারচেয়ে বেশি বলতে হবে উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান নামে একজন বিখ্যাত ইংরেজের কথা। ঠগীদের ইতিহাস জানার আগে তার ব্যাপারে জানতে হবে। আর তার ব্যাপারে বলতে গেলেই ঠগীদের ইতিহাস চলে আসবে।

‘ঠিক আছে, শুনি তাহলে কে এই স্লিম্যান?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *