অধ্যায় উনিশ – বর্তমান সময়,
গাঙ্গিনাপাড়, ময়মনসিংহ
সামনে বসে থাকা মহিলার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাশার। ওর রাগ হওয়া উচিত নাকি কৌতূহলী, ঠিক বুঝতে পারছে না। সে মহিলার দিকে তাকিয়ে আছে, মহিলাও কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মহিলার কঠিন দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে বাশার চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকাল।
বহু পুরনো এই প্রেসক্লাব ক্যান্টিন। একটা সময় ময়মনসিংহ শহরের সবচেয়ে সেরা বিরিয়ানি বিক্রি হতো এই ক্যান্টিনে। সেই সময় বিরিয়ানি আর ক্যান্টিন দুটোরই শান-শওকত ছিল দেখার মতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন রেস্তোরাঁয় ভরে উঠছে শহর। পুরনো সেই জৌলুস হারিয়েছে রেস্তোরাঁ। তবে এদের চা আর কাটলেট এখনো যথেষ্ট ভালো।
‘এই, এই দিকে আয়,’ ওয়েটার ছেলেটাকে ডাক দিল বাশারের সামনে বসে থাকা মহিলা। বাশার মনে মনে ভাবছে-একে কি মহিলা বলা উচিত, নাকি মেয়ে?
‘তোরে কখন চা দিতে বলছি! মায়ের বিয়া খাইতে গেছিলি?’ মহিলা এমন কর্কশ সুরে ওয়েটারকে ধমকে উঠল, ওয়েটার তো বটেই বাশারসহ চমকে উঠল আশপাশের টেবিল থেকে দুয়েকজন ফিরে তাকাল ওদের দিকে। ‘কী হইছে? মজমা লাগছে?’ অতি উৎসাহী লোকজন মহিলার কর্কশ ধমক শুনে যার যার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো, ওয়েটার ছেলেটা পালিয়ে বাঁচলো, আর বাশার সিদ্ধান্তে এলো তার সামনে বসে থাকা মানুষটাকে কোনোভাবেই মেয়ে বলা চলে না। একে মহিলাই বলতে হবে।
‘এবার বলেন, আপনার সমস্যাটা কী?’ মহিলার তীক্ষ্ণ চোখজোড়া বাশারের ওপরে নিবদ্ধ। বাশার মনে মনে ভাবল মানুষের চোখের মণি এতটা গভীর কালো আর রহস্যময় হয় কীভাবে। তবে মহিলার গায়ের রং মনে হয় তার চোখের চেয়ে কোনো অংশে কম কালো হবে না।
‘সমস্যা আমার না,’ বাশার তার গভীর চোখের দিকেই তাকিয়ে জবাব দিল। ছোটোবেলায় সাঁতার শিখতে গিয়ে একবার পুকুরে ডুবতে বসেছিল ও। শরীরটা যখন নিকষ কালো পানির গভীর থেকে গভীরে চলে যাচ্ছিল ঠিক যেরকম অনুভূতি হয়েছিল, মহিলার চোখের দিকে তাকিয়ে অনেকটা একই অনুভূতি হচ্ছে ওর। দৃষ্টি সরিয়ে নিলো ও।
হাতে ধরা মহিলার কার্ডের দিকে তাকিয়ে দেখল, ফ্রিল্যান্স ক্রাইম রিপোর্টার সে। ক্রাইম রিপোর্টার, তাও আবার একজন মহিলা! তবে একে মানায়, মনে মনে ভাবল বাশার। দেখতে যেমন কালো, তেমনি পুরুষালি। এরকম কালো মহিলা এর আগে জীবনে দেখেছে বলে মনে পড়ল না ওর।
‘সমস্যাটা আমার না, সমস্যাটা আপনার, আপনি…’
বাশার বাক্যটা শেষ করার আগেই মহিলা বলে উঠল, ‘মোটেই না। আপনি দৌড়ে এসে আমার গাড়ির সামনে পড়েছিলেন। আর আপনি না এলে…’ ওয়েটার ছেলেটা দু কাপ চা দিয়ে গেল।
‘ঠিক আছে, বুঝলাম আমার সমস্যা,’ মহিলা কথায় কথায় উত্তেজিত হয়ে উঠলেও বাশার মাথা ঠান্ডা রাখল। ‘তাহলে আপনি তখন কেন একথা বললেন, ‘আমি জানি আপনি কী খুঁজছেন’? আপনি যদি আমাকে না-ই চিনতেন আমার ব্যাপারে না-ই জানতেন তবে একথা কোনো দিনই বলতেন না।’
আধাঘণ্টা আগে টমির অফিস থেকে বেরিয়ে আসার পর বাশার যখন দেখতে পায় একটা সাদা গাড়ি ওদেরকে অনুসরণ করছে ও গাড়িটাকে ফাঁদে ফেলে সেটাকে আটকে দেবার পর ভেতরে আবিস্কার করে কোনো সাদা চামড়ার লোক নয়, বরং জিন্স আর ফতুয়া পরা ভীষণ কালো দেখতে একজন মহিলা বসে আছে সেখানে। একটা পুলিশের জিপকে কেন অনুসরণ করছিল, জানতে চাইবার পর মহিলা জবাব দেয় ‘আমি জানি আপনি কী খুঁজছেন।
রমিজ দারোগা আর আবদুল্লাহ সঙ্গে সঙ্গে মহিলাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যাবার পক্ষে থাকলেও বাশার মহিলাকে থানায় নেওয়ার আগে তার সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করে। সেজন্যেই মাহিলাকে নিয়ে প্রেস ক্লাবের ক্যান্টিনে এসে বসেছে।
বাশারের শেষ কথাটা শুনে মহিলা বড়ো করে একটা নিশ্বাস ছাড়ল। চোখ তুলে তাকাল বাশারের দিকে। বাশার মনে মনে ভাবল এরকম কালো আর পুরুষালি দেখতে একজন মহিলার চোখ এত গভীর আর রহস্যময় হওয়া উচিত না। আবারো সেই পানিতে ডুবে যাবার অনুভূতি ফিরে আসতেই চোখ ফিরিয়ে নিলো বাশার।
‘আপনি ঠিকই বলেছেন। অকারণে ঝগড়া করে লাভ নেই। তারচেয়ে বরং আমরা পরস্পরকে সাহায্য করতে পারি,’এতক্ষণে মহিলা চায়ের কাপটা তুলে নিলো।
‘দেখুন, মিস সরকার,’ এই নামটাই লেখা ছিল তার কার্ডে।
‘জয়া, আমাকে জয়া বলে ডাকতে পারেন। সরকার-ফরকার বলতে হবে না,’ মহিলার কথা শুনে বাশারের মনে হলো এই মহিলা স্বাভাবিক কথাও এমনভাবে বলে মনে হয় ঝগড়া করছে।
‘ঠিক আছে, মিস জয়া সরকার, আপনার কেন মনে হলো আপনার সাহায্য আমার প্রয়োজন?’ বাশার চা শেষ করে কাপ নামিয়ে রাখল। আশপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ সিগারেট খাচ্ছে কি না। তাহলে ও নিজেও একটা ধরাত।
‘সিগারেট ধরাতে চাইলে ধরাতে পারেন, এখানে সিগারেট খেতে কোনো নিষেধ নেই বাশার একটা সিগারেট ধরিয়ে প্যাকেটটা টেবিলের ওপরে রাখতেই মহিলা সেটা টেনে নিলো নিজের দিকে। বাশার অবাক হয়ে খেয়াল করল এই মহিলা এতটাই স্বাভাবিক আর স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিতে সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগল যেন এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। বাশার একটু অবাক হয়েই খেয়াল করল মহিলার কালো ঠোঁটে সিগারেটটা কেমন জানি মানিয়ে গেছে। বেশিরভাগ মেয়ের লিপস্টিক লাগানো ঠোঁটে যেটা বেমানান লাগে, এই মহিলার ক্ষেত্রে মোটেই অস্বাভাবিক লাগছে না সেটা।
‘মিস্টার পুলিশ, এভাবে বোকার মতো আমার সিগারেট খাওয়া না দেখে বলুন যেটা বলছিলেন,’ মহিলা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলতে লাগল। ‘আর নাটক না করে শুনুন আমাকে আপনার কেন দরকার। আমি জানি আপনি আজ থেকে এগারো বছর আগে ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটা ব্যাপার খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন না।’
‘আপনি এসব কোথা থেকে জানলেন?’ বাশার একটু অবাক হয়েছে।
‘আপনারা যারা পুলিশ তারা একটা ব্যাপার ভুলে যান, ইনফরমার শুধু আপনাদেরই থাকে না। আমাদের মতো সাংবাদিকদেরও থাকে। আমি জানি সে সময়ে আসলে কী ঘটেছিল,’ বলে সে তার বহু পকেটওয়ালা সবুজ রঙের ব্যাগটা ঘাঁটতে লাগল।
‘তাই নাকি? কী ঘটেছিল?’
কিছু না বলে মহিলা তার ব্যাগের ভেতর থেকে একটা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ফাইল বের করে আনলো। সেটার ভেতরে থাকা বেশকিছু কাগজ থেকে বাছাই করে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিল ওর দিকে। ‘পড়ুন এটা।’
বাশার হাতে নিয়ে দেখল একটা পত্রিকার কাটিং। হেডলাইনটা পড়ে আনমনেই বলে উঠল ও। ‘ডাকাতি!’
জয়া সরকার ওর দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালো। ‘হ্যাঁ, মিউজিয়াম ডাকাতি।’ বাশার মনোযোগ দিয়ে পত্রিকার কাটিংয়ের লেখাটা পড়তে লাগল। প্রথম অংশটুকু পড়ে পাতা উলটে দেখল বাকিটুকু নেই।
‘বাকিটা এখানে আছে,’ বলে জয়া সরকার সেই ফাইলটা দেখাল। ‘আপনার যেসব খবর পত্রিকা অফিসে কিংবা লাইব্রেরিতে থাকার কথা সে-সবই আমার কাছে আছে। বলতে গেলে শুধুমাত্র আমার কাছেই আছে। বাকি সব নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।
‘নষ্ট করে ফেলা হয়েছে, মানে কী? কারা করেছে?’ বাশার বেশ অবাক হচ্ছে মহিলার কথাবার্তা শুনে।
‘সেটা পরে জানতে পারবেন, তার আগে আপনার কাছে আমার প্রশ্ন, লেখাটা পড়ে কী বুঝলেন?’ জয়া সরকার তার চোখের চেয়েও গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাশারের দিকে।
‘ব্যাপারটা অদ্ভুত আর একটু রহস্যময়,’ বাশার আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে ওয়েটারকে ডাকল। আরেক কাপ চা দরকার। ‘এগারো বছর আগে একটা মিউজিয়াম ডাকাতি নিয়ে ব্যাপারটা। ঠিক মিউজিয়ামে ডাকাতি নয়, বরং মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের আয়োজন করা একটা বিশেষ এক্সিবিশনে হওয়া ডাকাতি নিয়ে খবরটা।’
‘হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন,’ বলে সে চায়ের কাপটা তুলে নিলো। বাশার একটু অবাক হয়ে খেয়াল করল এবার ছেলেটা চা দিয়ে যেতে এক সেকেন্ড দেরি করেনি। চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে জয়া নামের মানুষটা একটা মুচকি হাসি দিল ওয়েটার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে। ‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম। আমি আপনাকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলছি।’
‘তার আগে আমার দুটো প্রশ্ন আছে,’ বাশার বাধা দিল মহিলার কথার মাঝখানে। ‘এই মিউজিয়াম ডাকাতির ঘটনার সঙ্গে আপনি কীভাবে সম্পৃক্ত? আর এই মিউজিয়াম ডাকাতির সঙ্গে আমার বর্তমান কেসের সংশ্লিষ্টতা কী?’
বাশারের প্রশ্ন শুনে জয়া হেসে উঠল। বাশার একটু অবাক হয়ে একটা ব্যাপার খেয়াল করল মহিলা হাসার সঙ্গে সঙ্গে কালো মুখটা যেন আরো অন্ধকার হয়ে গেল। সাধারণত একজন মানুষ হেসে উঠলে তার চেহারা যেমনই হোক তাকে ভালো দেখায়। কিন্তু মহিলা এমনিতেই দেখতে খারাপ তার ওপরে হেসে উঠলে তাকে আরো কুৎসিত দেখাচ্ছে।
‘আরে, আগে আমাকে বলতে দিন, তারপর আমি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিবো,’ হাসতে হাসতেই জবাব দিল জয়া। ‘তার আগে আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই। আপনি কখনো ময়মনসিংহ জাদুঘরে গেছেন? কিংবা ময়মনসিংহ শহরের ইতিহাস সম্পর্কে আপনার ধারণা কেমন?’
‘জাদুঘরে?’ বাশার মনে করার চেষ্টা করছে মিউজিয়ামটা কোথায়। তারপর মনে পড়াতে জবাব দিল। ‘ময়মনসিংহ জাদুঘরে আমি একবার গেছিলাম। আমি তখন বেশ ছোটো, পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। যতটুকু মনে পড়ে খুবই ছোটো একটা মিউজিয়াম আর খুব বেশি জিনিসপত্রও ছিল না।’
‘আর ময়মনসিংহ শহরের ইতিহাস, এই ভূখণ্ডের ইতিহাস?’ একেবারে সরাসরি তাকিয়ে আছে জয়া ওর চোখের দিকে।
বাশার এবার দৃষ্টি সরিয়ে না নিয়ে বরং আরো প্রখর দৃষ্টিতে তাকানোর চেষ্টা করল। ‘আমি খুব বেশি জানি না। ইতিহাস নিয়ে আমার খুব বেশি আগ্রহও ছিল না কখনো, কাজেই খুব বেশি জানার প্রয়োজনও পড়েনি,’ বাশার এই পর্যন্ত বলে আর চোখের দৃষ্টি ধরে রাখতে পারল না। কাপের দিকে চোখ নামিয়ে নিলো আবারো।
‘সেটাই স্বাভাবিক,’ বলে সে চায়ের কাপে চুমুক দিল। ‘আমি আপনাকে পুরো ব্যাপারটাই খুলে বলছি তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন,’বলে সে চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বাশারের সিগারেটের প্যাকেটটা টেনে নিলো। আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে বলতে শুরু করল। ‘ঘটনার শুরু সম্ভবত সত্তুরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। তখন দেশের অবস্থা উত্তাল। তবে সেটার ছায়া মফস্বল শহরগুলোতে তখনো খুব একটা পড়েনি। সেই সময়ে ময়মনসিংহ শহরের মুক্তাগাছা অঞ্চলে একটা ঘটনা ঘটে।’
‘কী ঘটনা?’ বাশার জানতে চাইল।
‘বলছি,’ একরাশ ধোঁয়া ছাড়ল মহিলা নাক-মুখ দিয়ে। কোনো মেয়ে মানুষ এরকম স্বতঃস্ফূর্তভাবে সিগারেট খেতে পারে দেখা তো দূরে থাক বাশার কোনোদিন ভাবতেও পারেনি। ‘আপনি কি মুক্তাগাছার জমিদার পরিবারের ব্যাপারে কিছু জানেন?’
‘তেমন কিছু জানি না। আমার নানাবাড়ি মুক্তাগাছা যাবার পথেই পড়ে, তাই ছোটোবেলায় দুয়েকবার জমিদার বাড়িতে বেড়াতে গেছি, এই যা। কেন, ওদের সঙ্গে এই ঘটনার সম্পর্ক কী?
সম্পর্কে পরে আসবো। আগে ঘটনাটা বলে নেই,’ বলে সে ছাই ঝাড়লো। ঝেড়ে নিয়ে আবারো বলতে লাগল। ‘মুক্তাগাছার জমিদারদের অনেক সম্পত্তি ছিল। তবে তার অনেকটাই সরকার তার দখলে নিয়ে নিয়েছে। এরকমই একটা সম্পত্তির ভেতরে ছিল মধুপুরের এক কাচারি বাড়ি। একাত্তর পরবর্তী সময়ে সরকার জমিদারদের সেই কাচারি বাড়ির দখল নিয়ে নেয়। দখল নেওয়ার পরে কয়েক বছর পর্যন্ত ওটা ওভাবেই পড়ে ছিল। তৎকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নেয় এই বাড়িটাকে সংস্কার করে ফরেস্টারের অফিস বা বাংলো কিছু একটা বানাবে। বাড়িটাকে খালি করতে গিয়ে সেখানকার পাতাল ঘরে পুরনো দিনের একটা বড়ো সিন্দুক আবিস্কার করে তারা।
‘আগের দিনে পাড়া-মহল্লার মসজিদে নামাজ পড়ার চট কিংবা ম্যাট্রেস রাখার জন্যে বড়ো বড়ো ট্রাঙ্ক থাকত, বিরাট আকারের সিন্দুকটা দেখতে অনেকটা ওরকম ছিল। তবে আকারে অনেক বড়ো। আমি নিজে তো আর দেখিনি, পত্রিকার কাটিং আর লোকমুখে যা শুনেছি, সেই বর্ণনা অনুযায়ী প্রায় পাঁচ ফিট উঁচু লোহার তৈরি সিন্দুকের মতো দেখতে জিনিসটা আকারে যেমন বড়ো ঠিক তেমন ভারীও ছিল। জিনিসটা জমিদারদের কাচারি বাড়ির মাটির নিচ থেকে বের করে এনে অনেকদিন বাইরেই ফেলে রাখা হয়েছিল। কারণ কেউ ওটা খুলতে পারেনি। খুলতে না পেরে এতবড়ো আর ভারী জিনিসটা নিয়ে কী করবে সেটাও কেউ ভেবে বের করতে পারেনি। বেশ লম্বা সময় ধরে জমিদারদের কাচারি বাড়ির প্রাঙ্গণেই পড়ে ছিল ওটা। এমন সময় একজন ফরেস্ট অফিসার মধুপুর জঙ্গল ভিজিট করতে এলে তার নজড়ে পড়ে জিনিসটা।’
‘ইতিহাসের ছাত্র সেই ফরেস্ট অফিসার জিনিসটা দেখে বেশ কৌতূহল বোধ করে। কামার ডেকে এনে সে খোলার চেষ্টা করে ওটা। কিন্তু খুলতে না পেরে ওটাকে বহন করে নিয়ে যায় মুক্তাগাছা শহরে। তার ইচ্ছে ছিল, সেখানে নিয়ে জিনিসটা খোলার চেষ্টা করবে,’ এই পর্যন্ত বলে জয়া একটু থামলো। এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার শুরু করল।
‘ফরেস্ট অফিসারের তার সেই ইচ্ছে আর পূরণ করতে পারেনি। জিনিসটা নিয়ে আসার কয়েকদিন পরেই পচাত্তরের আগস্টের ঘটনা ঘটে। পুরো দেশ থমথমে হয়ে ওঠে। ফরেস্ট অফিসারের ভাগ্যে কী ঘটেছিল আমি জানি না। তবে সেই সিন্দুক ওভাবেই পড়ে ছিল ফরেস্ট অফিসারের কোয়ার্টারের সামনে। এরও বছরখানেক পরে স্থানীয় মুক্তাগাছার এক মসজিদের ইমাম কোনো এক কাজে একদিন সরকারি কোয়ার্টারে এলে ফেরার সময় প্রাঙ্গণের একপাশে পড়ে থাকা সিন্দুকটা দেখে কৌতূহলী হয়ে ওঠে। খোঁজ-খবর করে সে জানতে পারে এই জিনিসটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েআছে বেশ কিছুদিন যাবৎ। সে ওটাকে নিয়ে মসজিদের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করে। আমি আগেই বলেছি আগের দিনে মসজিদে নামাজ পড়ার চট-ম্যাট্রেস, এসব রাখার জন্যে যে ধরনের বড়ো সিন্দুকের মতো রাখা হতো, জিনিসটা দেখতে ছিল অনেকটা সেরকম। তাই সেই ইমাম সাহেব মনে করেন মসজিদ সংস্কারের পর এই জিনিসটা মসজিদে নিয়ে রাখলে এটাকে বিভিন্নকাজে লাগানো যাবে। তো যাই হোক, উনি সরকারি দপ্তরে যোগাযোগ করার পর তারা খুশি হয়েই ইমাম সাহেবকে জিনিসটা দিয়ে দেয়। বলা যায় তারা একরকম হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
‘তো ইমাম সাহেব সেটাকে একটা ঠেলাগাড়িতে করে সোজা নিয়ে যায় স্থানীয় একটা লোহার কাজের ওয়ার্কশপে। কারণ এর আগেই উনি এর ইতিহাস জেনে নিয়েছেন। এটাও জানতে পেরেছেন এই জিনিসটাকে খোলা যায়নি বলেই এরকম পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। তাই উনি জিনিসটাকে মসজিদে না নিয়ে সোজা ওয়ার্কশপে নিয়ে যান, যাতে ওটাকে ঠিক করে তারপর মসজিদে নিয়ে কাজে লাগাতে পারেন। যাই হোক, ওয়ার্কশপের লোকেরা জিনিসটাকে পরখ করে জানায়, এটা খুলতে হলে ওপরের ডালার একটা অংশ কাটতে হবে। এছাড়া এটা খোলার আর কোনো উপায় নেই। সেটা করতে হলে সময়ও লাগবে সেই সঙ্গে টাকাও খরচ হবে। টাকার পরিমাণ শুনে ইমাম সাহেব আঁতকে ওঠেন। উনি পরবর্তীতে জানাবেন বলে সেখান থেকে প্রস্থান করার পর আর আসেননি।
‘এবার জিনিসটার স্থান হয় সেই ওয়ার্কশপের প্রাঙ্গণে একটা পুকুরের পাড়ে। ওখানেই ওটা পড়ে থাকে মাস তিনেক। এর মধ্যে তৎকালীন মালিক ওয়ার্কশপটা বিক্রি করে দেয় আরেকজনের কাছে। নতুন মালিক সব জিনিসপত্র বুঝে নেওয়ার সময়ে এই জিনিসটাও তার হস্তগত হয়। নতুন মালিক প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি জিনিসটা নিয়ে কী করবে, পরে সে সিদ্ধান্ত নেয় যেহেতু জিনিসটা লোহার তৈরি, কাজেই এটাকে টুকরো টুকরো করলে অনেক লোহা পাওয়া যাবে। তাই সে এটাকে ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয় তার লোকজনকে। ওরা অক্সিএসিটিলিন টর্চ নিয়ে কাজ শুরু করে। প্রায় দুইদিন টানা কাজ করার পরে ওরা যখন জিনিসটার ওপরের ডালার একটা অংশ প্রায় আলগা করে ফেলেছে ঠিক তখুনি,’ বলে মহিলা একটু উত্তেজনা আনার জন্যে থামলো।
কিন্তু জয়ার উত্তেজনা বাশারকে স্পর্শ করল না। জয়া আবারো শুরু করার আগেই বাশার বলে উঠল, ‘আচ্ছা, আপনি তখন থেকেই কি এক সিন্দুকের গল্প করে চলেছেন। এর সঙ্গে আমার পুকুরের নিচে পাওয়া গাড়ি আর বর্তমান কেসের সম্পর্ক কী, এর ধারে কাছেও যাচ্ছেন না। ব্যাপারটা কী, বলুন তো?’
‘শুনুন আপনার কোনো ধারণাও নেই আপনি কীসের ভেতরে জড়িয়ে পড়েছেন। ব্যাপারটা কতটা বড়ো আমিও সেটা পুরোপুরি জানি না। কিন্তু এর একটা অংশ বুঝতে হলে আপনাকে অন্য অংশটা শুনতে হবে। আচ্ছা আমাকে বলুন তো,’ জয়া এবার সরাসরি বাশারের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। বাশার আবারো দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ‘আপনার কি এই সিন্দুকের ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। এরপরে কীহলো সেটা জানার জন্যে কৌতূহল হচ্ছে না?’
বাশার একবার কাঁধ ঝাকালো। ‘অস্বীকার করব না, হচ্ছে। আচ্ছা বলুন এর পরে কি হলো। সিন্দুক থেকে দৈত্য দানব বেরিয়ে এলো?’
জয়া হেসে উঠল। ‘না, সেরকম কিছু হয়নি। কিন্তু যেটা ঘটেছিল সেটাও কম আশ্চর্যজনক নয়। সিন্দুকের ডালাটা প্রায় খুলে এসেছে এমন সময় তীব্র বিস্ফোরণে ছিটকে পড়ে আশপাশের সবাই। বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে মুক্তাগাছা শহরের একাংশ। আমি একজন প্রত্যক্ষ্যদর্শীর কাছে শুনেছি সেই শব্দের প্রকটতা এতই বেশি ছিল যে আশপাশের অনেক বাড়ির জানালার কাচ পর্যন্ত ভেঙে গেছিল
‘তাই নাকি? তা ভেতর থেকে কি বের হলো?’ বাশার এতক্ষণে কৌতূহল বোধ করতে শুরু করেছে।
‘সাত রাজার সম্পদ। বিশ্বাস করুন আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না। কী ছিল না সেই সিন্দুকের ভেতরে! সোনা-রূপার মোহর, অসংখ্য দামি জুয়েলারি, হীরে বসানো হাতির দাঁতের দাবার সেট, সোনার তৈরি ডিনার সেট, কাঁচা সোনার তৈরি নানা ধরনের দেব-দেবীর মূর্তি। আরো কী কী ছিল কে জানে। সবটা কখনোই জানা যায়নি। সিন্দুক খুলতেই আশপাশে যারা ছিল তারা প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। যে যা পেয়েছে লুটে নিয়েছে। তখন সময়টা এমনিতেই উত্তাল…তার ওপরে এরকম গণিমতের মাল কে ছাড়ে। অবশেষে যখন পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পৌছায় তখন সিন্দুকের তলায় পুরনো কিছু দলিল-পত্র আর কাগজ ছাড়া তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই। ও ছিল, কিছু দামি জিনিসও ছিল যেগুলোকে ওজনের কারণে লোকজন খালি হাতে বহন করেনিতে পারেনি। তবে তৎকালীন পুলিশরা একটা ভালো কাজ করে। সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে আরো বেশ কিছু জিনিস উদ্ধার করে সরকারের কাছে হস্তগত করে। সেই জিনিসগুলোর কিছু চলে যায় ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে, কিছু রয়ে যায় ময়মনসিংহের জাদুঘরে।’
‘এগুলোর জন্যেই কি ডাকাতি হয়?’
‘নাহ। এই ঘটনার পরে কেটে যায় বহু বছর। অনেক কিছুই বদলে গেছে এর মধ্যে। তবে একটা বড়ো পরিবর্তন ঘটে গেছে মুক্তাগাছার জমিদার পরিবারে। তাদের শেষ বংশধরদের অস্তিত্বও তখন প্রায় শেষের দিকে। এমন সময় মুক্তাগাছার জমিদার পরিবারের শেষ বংশধর বিজয় আচার্য নামে একজন সেই সিন্দুকে পাওয়া জিনিসগুলো দাবি করে বসে। সরকারের সঙ্গে লড়াই করে সে শেষ পর্যন্ত সেগুলোর কিছু অংশ সে নিজের দখলে নিয়ে আসতে পারে। বেশিরভাগ দামি জিনিসই প্রত্নতাত্ত্বিক ডিপার্টমেন্টের অধীনে রয়ে যায়। শুধুমাত্র পুরনো কিছু দলিল আর কাগজপত্র সে নিজের অধীনে নিতে সক্ষম হয়। এই কাগজপত্রের ভেতরেই সম্ভবত ছিল একটা ডায়েরি। এই ডায়েরি থেকে সে জানতে পারে তার পরিবারের বহু পুরনো একটা কালী মূর্তি লন্ডনের এক মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। সে বহু সাধ্য সাধনা করে এই মূর্তিটাকে দেশে আনার চেষ্টা করে কিন্তু লাভ হয়নি। পুরোপুরি নিয়ে আসতে না পারলেও সে এটাকে অন্তত একবারের জন্যে হলেও দেশে এক্সিবিশনের জন্যে নিয়ে আসার অনুমতি পায়।
‘এই এক্সিবিশনের সময়েই সেই ডাকাতির ঘটনাটা ঘটে, ঠিক?’ বাশার প্রশ্ন করল।
‘ঠিক। ব্যাপারটা ঘটে খুব সহজেই। এক্সিবিশনের দায়িত্ব ছিল ময়মনসিংহ মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের হাতে। ওদের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল ইংল্যান্ড থেকে আসা প্রতিনিধি। ওরা জমিদারদের রাজবাড়ি শশীলজ-মানে যেটা এখন টিচার্স ট্রেনিং কলেজ-সেটার প্রাঙ্গণে আয়োজন করে প্রদর্শনীর। তো যেদিন প্রদর্শনী হবার কথা সেদিনই এক্সিবিশনের জন্যে সব সাজানোর পরে তৎকালীন অস্থায়ী সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা এসে উদ্বোধন করার কথা। সবাই অপেক্ষা করছে, এমন সময় জমিদার বাড়ির চত্বরে দুটো গাড়ি এসে থামে। কিছু অস্ত্রধারী বেরিয়ে এসেই গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে তারা প্রদর্শনীর চত্বরে প্রবেশ করে। সিউকিউরিটির কয়েকজনকে আহত করে শুধুমাত্র একটা জিনিস নিয়ে চলে যায় তারা।’
‘নিশ্চয়ই সেই কালী মূর্তি?’ বাশার মনে মনে ভাবল এরকম টুইস্ট ছাড়া ডাকাতির ঘটনা সে এর আগে পড়েছে বলে মনে পড়ল না।
‘হ্যাঁ, সেই কালী মূর্তি।’
‘এই ঘটনা তো মনে হয় সেই জমিদারদের বংশধরই করিয়েছে।’
‘হতে পারে, আবার নাও পারে।’
‘মানে?’ বাশার একটু অবাক হয়েছে।
মানে ঘটনা যখন ঘটে জমিদারদের সেই একমাত্র বংশধর নাকি জাদুঘর প্রাঙ্গণেই ছিল। এরপর পুলিশ এসে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে তাকে খুঁজতে গেলে আবিস্কার হয় সে নেই। নেই যে নেই। সঙ্গে সঙ্গে তার খোঁজ লাগানো হয়, তার বাড়িতে বসানো হয় পুলিশ পাহারা।
‘অদ্ভুত!’ জয়াকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল বাশার। ‘কী এমন মূর্তি! ওটা খুব বেশি দামি ছিল নাকি? তবে যাই হোক, এখন বলেন এই ঘটনার সঙ্গে আপনার সম্পৃক্ততা কী, আর আমাদের বর্তমান ঘটনারই বা সম্পৃক্ততা কি?’
‘প্রথমত, এই ঘটনা যখন ঘটে তখন আমি ছিলাম একটা জাতীয় দৈনিকের স্থানীয় প্রতিনিধি। এই ডাকাতির ঘটনার পরে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় এই ব্যাপারটা সরেজমিনে দেখতে। আমি কাজ শুরু করার দুদিন পরেই হঠাৎ আমাকে ডেকে নিষেধ করে দেওয়া হয়। আমি জানতে পারি ওপর মহল থেকে এই কেসের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখতে পাই সব জায়গা থেকে এই ব্যাপারে সমস্ত নিউজ সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। দেখতে দেখতে চোখের সামনে পুরো ব্যাপারটা স্রেফ ধামাচাপা পড়ে যায়। এর কয়েকদিনের ভেতরেই তৎকালীন অস্থায়ী সরকারের বিশেষ বাহিনীর সঙ্গে তৎকালীন ছাত্রদের গণ্ডগোলে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো দেশ, ধামাচাপা পড়ে যায় ব্যাপারটা। এনিয়ে আর কেউই উচ্চবাচ্য করেনি। আমি আজো জানতে পারিনি ওই সময়ে আসলে কী ঘটেছিল। চোখের সামনে থেকে একটা পরিবার, তাদের ইতিহাস হারিয়ে গেল কীভাবে? হয়েছিল কী আসলে?’
‘কিন্তু সেই ঘটনার সঙ্গে আমাদের বর্তমান ঘটনার সম্পৃক্ততা কোথায়?’ বাশার প্রায় একই প্রশ্ন রিপিট করল।
বলছি। তবে তার আগে মূর্তিটার কথা বলে নেই। ওইদিনের পর এক্সিবিশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইংরেজ সরকারের প্রতিনিধিকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর ওই এক্সিবিশন থেকে চুরি হওয়া মূর্তিটাকেও কখনো পাওয়া যায়নি। মূর্তিটা খুবই দুর্লভ ছিল। বেশ দামি কষ্টি পাথরের তৈরি কালো রঙের একটা কালী মূৰ্তি। তবে মূর্তিটা অমূল্য,’ বলে সে বাশারের দিকে ফিরে তাকাল। ‘কারণ এটা একটা ঐতিহাসিক মূর্তি। এই মূর্তি নিয়ে অনেক মিথ প্রচলিত আছে। ‘
বাশার হেসে উঠল। ‘হ্যাঁ, এসব পুরনো দিনের মূর্তি মানেই নানা মিথ-রহস্য- জিনের আসর আর বিশেষ ক্ষমতা, তাইনা?’
জয়া হাসল না। হতেও পারে আবার নাও পারে। কোনোটা ঠিক-বেঠিক কে জানে, তবে এসব পুরনো জিনিসের সঙ্গে এসব মিথ যোগ হওয়া মানেই এসবের অ্যান্টিক ভ্যালু বৃদ্ধি পাওয়া। আর দাম বৃদ্ধি মানেই,’ বলে সে কাঁধ নাড়ল। ‘বুঝতেই পারছেন যেকোনো জিনিসের দাম অতিরিক্ত বৃদ্ধি মানেই ঝামেলা। এর পেছনে লোক লাগবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তার ওপরে এই মূর্তি নিয়ে প্রচলিত আছে এটা নাকি মৃত মানুষকে জীবিত করতে পারে,’ বলেই জয়া হেসে উঠল।
বাশারও তার সঙ্গে হেসে উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বাশারের চোখে ভেসে উঠল সাদা চামড়ার সেই লোকটার চেহারা, যাকে টমি বলছে মৃত আর তাকে আজ সকালেই জীবিত অবস্থায় দেখেছে ও নিজের চোখে। মৃত মানুষ কি আসলেই ফিরে আসতে পারে? মনে মনে ভাবলেও ও মুখে কিছু বলল না এব্যাপারে। ‘এসব ফালতু কথা বিশ্বাস করতে বলেন আমাকে।’
‘আসলে আমি এসব ব্যাপারে খুব বেশি জানি না। তবে এটা জানি, এই মূর্তি খুবই বিখ্যাত। বিশেষ করে ব্রিটিশ ভারতের পুরনো যতগুলো বিখ্যাত আর্টিফ্যাক্ট আছে সেগুলোর মধ্যে এটাও একটা। এই মূর্তিটা বিখ্যাত হবার পেছনে আরো একটা কারণ হলো এই মূর্তি নাকি একটা জোড়া মূর্তি। জোড়ার একটা মূর্তি হারিয়ে গেছে, অন্যটা ছিল ইংল্যান্ডের এক মিউজিয়ামে। সেই ইংল্যান্ডের মূর্তিটাই ময়মনসিংহে এনে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল যখন ওটা চুরি হয়ে যায়।’
‘ঘটনাটা আরেকটু বিস্তারিত বলেন, প্লিজ।’
‘বিজয় আচার্য-মানে জমিদার পরিবারের শেষ বংশধর সিন্দুকের ভেতরে থেকে পাওয়া নথি থেকে জানতে পারে তার পূর্ব পুরুষদের একটা এরকম জিনিস ইংল্যন্ডের কোনো একটা মিউজিয়ামে আছে। ময়মনসিংহ মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে অনুরোধ করে সে প্রথমে জিনিসটা আনানোর চেষ্টা করে দেশে। সেটা করতে না পেরে সবশেষে সে একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এই প্রদর্শনীতে মূলত তিনজন মানুষ ছিল। প্রথমত জমিদারদের সেই শেষ বংশধর-বিজয়, তার সঙ্গে ময়মনসিংহ মিউজিয়ামের তৎকালীর কিউরেটর, আর ইংল্যান্ডের সেই মিউজিয়ামের প্রতিনিধি। এই তিনজন মিলেই মূলত আয়োজনটা করেছিল।’
‘আচ্ছা,’ বলে বাশার মুখ কুঁচকে উঠল। ‘আপনারা ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেন কখন? প্রদর্শনীর আগেই না পরে?’
‘প্রদর্শনীর কয়েকদিন আগে আমাকে ওটা কভার করার অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয় আমার পত্রিকা অফিস থেকে। প্রদর্শনীর আয়োজন তো করা হলো। কিন্তু প্রদর্শনীর উদ্বোধন করার আগেই হয়ে গেল ডাকাতি। প্রদর্শনী উদ্বোধনের কথা ছিল রাত আটটায়। আমার যতটুক মনে পড়ে সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা আসতে একটু দেরি হওয়াতে প্রদর্শনীর সময়টা শেষ মুহূর্তে একটু পেছানো হয়। এরপরে তো হয়ে গেল ডাকাতি। ডাকাতির ঘটনাটা ঘটার কিছু পরেই কয়েকটা ঘটনা ঘটে। ওইদিনের ডাকাতির ঘটনার পর বিজয় আচার্যের ভাগ্যে কী ঘটেছিল সেটা পরে বলছি। ঘটনার পরেই সবাই ধরে নেয় ইংরেজ সেই প্রতিনিধির সঙ্গে মিলে জমিদারদের সেই বংশধর বিজয়ই ডাকাতিটা ঘটিয়েছে। আর ডাকাতির পর সেই তারা মূর্তিটা নিয়ে পালিয়ে গেছে। এই ঘটনাতে আরো মদদ যোগায় একটা ব্যাপার। সেটা হলো ডাকাতির ঘটনার পর খোঁজ-খবর করতে গিয়ে বের হয়-ইংরেজ যে প্রতিনিধি মূর্তিটার দলের সঙ্গে এসেছিল সে আসলে এশিয়া থেকে ইউরোপে অ্যান্টিক চোরাচালানের সবচেয়ে বড়ো ডিলারদের একজন, সে একটা আর্কিওলজিক্যাল রিসার্চ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির পরিচয়ের আড়ালে এই কু- কাজগুলো করে বেড়াত। আরো জানা যায় সেই মূলত লবিং করে এই মূর্তিটা বাংলাদেশে আনিয়েছিল। তো মোটিভ ওয়াজ ভেরি ক্লিয়ার। আনটিল নাউ।’
‘তার মানে আপনি বলছেন পুরো ব্যাপারটা জমিদারদের সেই বংশধর আর এই অ্যান্টিক ডিলার মিলেই করে। তারপর তারা মূর্তিটা ডাকাতি করিয়ে স্রেফ হাওয়া হয়ে যায়?’
‘একটা সময় পর্যন্ত ব্যাপারটা তাই ছিল,’ জয়া সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলতে লাগল।
‘তবে এটার সঙ্গে আমার এই পুকুরের তলার গাড়িটার সংযোগ কোথায়? আর এই ঘটনার সব নথিপত্র রেকর্ড গায়েব করে দেওয়া হয় কেন?’ বাশার এখনো চিন্তায় আছে একটা সিগারেট ধরাবে কি না।
‘বলছি। নথিপত্র গায়েব করে দেওয়ার ব্যাপারটা আগে বলছি। যে মূর্তিটা ডাকাতি হয় সেটা ছিল হিন্দু দেবী কালীর মূর্তি, যেটা অনেক হিন্দু কমিউনিটির জন্যে খুবই স্পর্শকাতর একটা ব্যাপার। তাই মূর্তি চুরি নিয়ে যখন জল ঘোলা হতে থাকে তখন স্থানীয় হিন্দু কমিউনিটি থেকে ব্যাপারটা নিয়ে চাপ আসতে থাকে। সেইসঙ্গে সরকার দেখতে পায় ব্যাপারটাতে তাদেরও অনেক গাফিলতি ছিল, কাজেই তারা ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দিয়ে দেয়। আমরা যারাই এই কেসে কাজ করছিলাম সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হয় এই নিয়ে আর কোনো বাড়াবাড়ি চলবে না। তখন চলছিল কেয়ারটেকার সরকারের আমল, এমনিতেই দেশে ইস্যুর কোনো অভাব নেই। কাজেই এটার কথা লোকে মনেও রাখেনি খুব বেশিদিন। তাই সরকারের একটা মহলের এটা ধামাচাপা দিতে কোনোই কষ্ট হয়নি। এবার দ্বিতীয় কথায় আসছি। এই ডাকাতির সঙ্গে আপনার পুকুরের তলার ঘটনার সংযোগ হলো যে অ্যান্টিক ডিলার ভুয়া প্রতিনিধি সেজে ডাকাতির ঘটনাটা ঘটিয়েছিল বলে মনে করা হয় সেই লোকটা একটা কালো শেভ্রোলে সেডান চালাত। আমার ধারণা এই গাড়িটাই আপনি আর আপনার লোকরা ওই পুকুরের নিচ থেকে উদ্ধার করে এনেছেন। আর গাড়ির ভেতরে পাওয়া সেই দেহাবশেষও মনে হয় সেই লোকটারই,’ জয়া এই পর্যন্ত বলতেই ও মোবাইলটা বের করে সিজিআই দিয়ে বানানো টমির দেওয়া সেই ছবিটা জয়াকে দেখাল। ‘এই লোকটাই কী?’
জয়া মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখল। ‘হ্যাঁ, এই লোকই সেই অ্যান্টিক ডিলার। কী জানি নাম, মনে নেই। তবে আপনাদের পুকুরের তলা থেকে উদ্ধার করা গাড়িটা আর এই লোকটার দেহাবশেষ উদ্ধারের সবচেয়ে বড়ো গুরুত্ব কী জানেন?’
বাশার চুপ করে রইল চোখে প্রশ্ন।
‘গুরুত্ব হলো : আপনাদের এই গাড়ি উদ্ধারের আগ পর্যন্ত ধরে নেওয়া হয়েছিল এই ব্যাটা মূর্তিটা ডাকাতি করিয়ে সে জমিদারদের বংশধর বিজয়কে ধোঁকা দিয়ে মূর্তিটা নিয়ে পালিয়েছে। আপনার এই গাড়িটা আর লোকটাকে উদ্ধারের আগ পর্যন্ত এটাই প্রতিষ্ঠিত ছিল, কিন্তু আপনার এই গাড়িটাকে খুঁজে পাওয়া প্রমাণ করে লোকটা মূর্তি নিয়ে পালায়নি বরং তার স্থান হয়েছিল ময়মনসিংহের অখ্যাত এক পুকুরের তলায়। তবে প্রশ্ন হলো ডাকাতি হওয়া মূর্তিটা গেল কোথায়। গাড়িতে তো কিছুই পাওয়া যায়নি!
‘পুরো পুকুর চষে দেখা হয়েছে সেখানেও কিছু পাওয়া যায়নি। তবে আপনি যেভাবে ভাবছেন ব্যাপারটা অতোটা জটিল না। কারণ এত বোঝাই যাচ্ছে জমিদারদের সেই বংশধরই এখানে বাজিমাত করেছে। কারণ তারা দুজনে মিলেই যদি ডাকাতিটা ঘটিয়ে থাকে তবে সেই নিজের পার্টনারকে মেরে পুকুরের তলায় ফেলে দিয়ে ওই মূর্তিটা নিয়ে পালিয়েছিল। সহজ ব্যাপার,’ বলে বাশার বলে ও কাপের অবশিষ্ট চাটুকু পেটে চালান করে দিল।
‘ব্যাপারটা অতো সহজ না মিস্টার বাশার। অতো সহজ হলে তো ভালোই ছিল…’
‘ম্যাডাম, হোটেল বন্ধ হইবে,’ ওয়েটার ছেলেটা এসে জানিয়ে গেল ওদেরকে।
‘ক্যান আবার তোর বাপের বিয়া লাগছেনি?’ বলে সে আরো কড়া কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই বাশার তাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।
এই মহিলার আচার আচরণে একটু বিরক্ত বাশার। জয়া কিছু বলার আগেই সে মোবাইল বের করে আবদুল্লাহকে কল করে কাছাকাছি আসতে বলল।
‘কেস কিন্তু প্রায় শেষ।’
‘মানে?’ জয়া আরেকটা সিগারেট ধরাচ্ছে হাঁটতে হাঁটতে।
‘মানে খুব সহজ। তিনজন মানুষ মিলে একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করল। সেই প্রদর্শনীতে ডাকাতি হলো। ডাকাতির পরে দেখা গেল সেই তিনজনের দুজন গায়েব। ধরে নেওয়া হলো এই দুজনে মিলেই ডাকাতিটা করেছে। তো কেস পরিষ্কার, এই ভুয়া প্রতিনিধি আর জমিদারদের বংশধর মিলে ডাকাতি করা মূর্তি নিয়ে পালিয়েছে। কিন্তু এর এগারো বছর পর সেই ভুয়া প্রতিনিধির লাশসহ তার গাড়ি পাওয়া গেল একটা পুকুরের তলায়। এটাতো পরিষ্কার সেই জমিদারদের বংশধর বিজয় তার ভুয়া পার্টনারকে মেরে পুকুরের তলায় দাফন করে দামি মূর্তিটা নিয়ে পালিয়েছে।’
‘ব্যাপারটা আসলে এতটাও সহজ নয় কারণ জমিদারদের সেই বংশধরের পক্ষে এত সহজে পালানো সম্ভব ছিল না…কারণ যেদিন সেই প্রদর্শনীতে ডাকাতি হয় সেদিনই ডাকাতির ঘটনার স্পট থেকে গায়েব হয়ে যায় জমিদার পরিবারের শেষ বংশধর।’
‘বিজয়,’ বলে উঠল বাশার। ‘বিজয় আচার্য।’
‘হ্যাঁ, সে স্পট থেকে গায়েব হয়ে যাবার পরে সবাই ভাবে সে আর সেই প্রতিনিধি মিলে ডাকাতি করিয়ে মূর্তিটা নিয়ে পালিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তার বাড়িতে পুলিশ পাহারা বসানো হয় যাতে সে এলেই ধরা পড়ে…এবং সে এসেছিল। ভোরের দিকে পাহারারত পুলিশেরা যখন প্রায় ঘুমে সে চুপি চুপি বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে পুলিশের চোখে ধরা পড়ে যায়। পুলিশ তাকে থামতে বললেও সে কোনো মতে বাড়িতে ঢুকে পড়ে। পুলিশেরা বাড়িতে ঢুকতে গেলে ভেতর থেকে সে গুলি চালায়। তখন আরো পুলিশ এসে বাড়ি ঘিরে ফেলে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে ওরা বিজয়কে যখন প্রায় কব্জা করে ফেলেছে এমন সময় রান্নাঘরে গিয়ে লুকায় সে। সেখানে গোলাগুলির এক পর্যায়ে রান্না করার এলপি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দুই পুলিশ সদস্যসহ সে পুড়ে মারা যায়। বাকি তিন পুলিশ আহত হলেও তারা প্রাণে বেঁচে যায়। তাদের জবানিতেই বাকিটা জানা যায়। সবাই ধরেই নেয় বিজয় আচার্য আর ভুয়া প্রতিনিধি মিলে ডাকাতিটা ঘটিয়েছে। সবশেষে বিজয়কে ঠকিয়ে সেই বিদেশি প্রতিনিধি মূর্তিটা নিয়ে পালিয়েছে। কেস এখানেই শেষ হয়ে গেছিল
‘যদি না…’
‘যদি না সেই ঘটনার এগারো বছর পরে আপনি শেষ মোড়ের অখ্যাত এক পুকুরের তলা থেকে সেই গাড়ি আর সেই ভুয়া প্রতিনিধির লাশটা খুঁজে না পেতেন, ‘ বাশারের কথাটা শেষ করে দিল জয়া। ‘তবে এখানে একটাই প্রশ্ন রয়ে গেছে। সবাই এতদিন ধরে যা ভেবে এসছিল সেটা ভুল প্রমাণ হয়ে গেছে। এতদিন সবাই ধরেই নিয়েছিল সেই বিদেশি প্রতিনিধি কালীমূর্তিটা নিয়ে পালিয়েছে। কিন্তু সেটা ভুল প্রমাণ হয়ে গেছে আপনি সেই বিদেশির লাশসহ গাড়িটা উদ্ধারের পরে। এরমানে সেদিন রাতে ডাকাতির পরে সে-ও পালাতে পারেনি, আর মূর্তিটাও পাওয়া যায়নি। তারমানে ওই মূর্তি এখনো এখানেই কোথাও না কোথাও রয়ে গেছে।
‘আর এই কেস সলভ করতে হলে সেটাই খুঁজে বের করতে হবে আমাদের।’