প্রথম অংশ : ছন্দপতন
দ্বিতীয় অংশ : মৃত্যুহরণ

সপ্তরিপু – অধ্যায় ২০

অধ্যায় বিশ – সময় : ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ

মুক্তাগাছা জমিদারের কাচারি বাড়ি, মধুপুর

‘আমাদেরকে বোকা বানানোর চেষ্টা করে লাভ নেই, কথাটা বুঝিয়ে বলো ওদেরকে,’ কথাটা বলে শংকরের দিকে ফিরে সেটাকে অনুবাদ করে শোনাতে বলল ম্যাকফি।

ম্যাকফি যা বলেছে সেটাকে অনুবাদ করে শোনাতেই লোকটা জোরে জোরে মাথা নেড়ে আপত্তি জানাল। অচেনা ভাষায় তড়বড় করে কী কী জানি বলতে লাগল।

‘কী বলছে ও?’ শংকরের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল ম্যাকফি।

‘ও বলছে, ওরা কিছুই জানে না। খেটে খাওয়া মানুষ ওরা, ওদেরকে এভাবে হেনস্তা করলে খোদার অভিশাপ লাগবে,’ শংকরের মুখে শেষ কথাটা শুনে ফট করে হেসে উঠল জোনাথন।

ওরা এইমুহূর্তে বসে আছে মুক্তাগাছার জমিদারের কাচারি বাড়ির বৈঠকখানায়। ঘোড়ার হাটে বাজিকরদের সঙ্গে মারামারির পর প্রায় দুঘণ্টা অতিবাহিত হয়েছে। ওদের তিনজনকে বন্দি করার পর ইংরেজ সৈন্যদের চুরি যাওয়া ঘোড়াগুলোসহ ওদেরকে এখানে নিয়ে আসা হয়। ইতিমধ্যে ওরা জানতে পেরেছে বয়স্ক লোকটা বাবা আর কিশোর দুজন তার ছেলে। আর পালিয়ে যাওয়া দুজন ওদেরই দলের লোক ছিল কিন্তু তাদের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।

এতক্ষণ ম্যাকফির পাশেই বসে ছিল জোনাথন। বসে বসে বন্দুকটা পরীক্ষা করছিল। হেসে উঠেই সে বলে উঠল, ‘ব্যাটা বলে কী, একে তো ইংরেজ সৈন্যদের ঘোড়া চুরি করেছে, তার ওপরে আরেকটু হলে আমাদেরকে মেরেই ফেলেছিল, আর এখন সে সাধু সাজার চেষ্টা করছে!’ বলে সে বন্দুকটা লোড করে ম্যাকফির দিকে তাকিয়ে ছ্যাঁত করে বলে উঠল, ‘নরম পন্থায় কাজ হবে না।’

ম্যাকফি ওকে হাতের ইশারায় থামতে বলে পাইপটা উঠিয়ে নিলো। কীভাবে কী করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। এদেরকে চাপ দিলে বা অত্যাচার করলে স্থানীয় লোকজন কিংবা রাজার লোকেরা বিদ্রোহ করে বসতে পারে। আবার একে চাপ না দিলে কিছুই জানা সম্ভব নয়। এর কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে হবে। ওরা ঘোড়াগুলো কীভাবে পেয়েছে, এই প্রশ্নের উত্তরের ওপরে নির্ভর করছে অনেক কিছু। যেভাবেই হোক এই প্রশ্নের উত্তর ওকে বের করতে হবে। আর সেটা করতে হবে খুব সাবধানে, আর দ্রুত। কারণ এতক্ষণে নিশ্চয়ই জমিদার বাড়িতে খবর পৌছে গেছে। কাজেই জমিদারের লোকেরা এখানে পৌছানোর আগেই কথা আদায় করতে হবে এর পেট থেকে।

ম্যাকফি পাইপে কষে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বিরাট পাগড়ি পরা বয়স্ক লোকটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘তুমি করো কী? মানে পেশা কী তোমার? আর এরা কি তোমার ছেলে?’

শংকর তর্জমা করে শোনালো ওর প্রশ্ন। লোকটা কিছুক্ষণ চুপ থেকে পটপট করে বিজাতীয় ভাষায় কথা বলে উঠল। ম্যাকফি তাকিয়ে রইল শংকরের দিকে।

‘স্যার, সে কইতেছে ওরা হলো বিহারের গোধ সম্প্রদায়ের লোক। পরিবার লয়া পুরা ভারতবর্ষে ঘুইরা দড়ির খেলা দেখিয়ে বেড়ায়। এই দুজন ওর ছেলে। ও বড়ো আর ও ছোটো,’ বলে শংকর ছেলে দুজনার দিকে একে একে নির্দেশ করে দেখাল। এর মধ্যে যাকে বড়ো ছেলে হিসেবে দেখাল এই ছেলেটাই বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে মা্যকফির পাঁ বাঁধতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। এখন জুলজুল করে কাতল মাছের মতো তাকিয়ে আছে ওর দিকে। অন্যটা ছোটো ছেলে। দেখলেই বোঝা যায় এই ছেলেটা বেশ ঘাড়ত্যাড়া। একটু পর পর বেঁধে রাখা দড়ি টানাটানি করছে আর রাগের সঙ্গে ওদেরকে দেখছে।

ম্যাকফি মনে মনে ভাবল এবার শক্ত হতে হবে। মহাবীর সিং,’ ও ডাক দিতেই একপাশে পাহাড়ের মতো দাড়িয়ে থাকা মহাবীর সিং নড়ে উঠল। সব সময়ের মতোই সে নিঃশব্দে ঘুরে তাকাল ম্যাকফির দিকে। নির্দেশের অপেক্ষা করছে।

‘এই ছেলেটাকে দড়ির বাঁধন খুলে আলাদা করে ফেলো, ছোটো ছেলেটাকে দেখাল ম্যাকফি। মহাবীর সিং ওর দিকে এগিয়ে যেতেই রাগের সঙ্গে গজরাতে লাগল ছেলেটা। মহাবীর সিং তার হাত চেপে ধরতেই রাগের সঙ্গে মহাবীর সিংয়েও মুখে লাথি মারলো। ধীর-স্থির মহাবীর সিংয়ের কোনো বিকার নেই সে ছেলেটার দড়ির বাঁধন খুলে তাকে শূন্যে তুলে ফেলল। ইতিমধ্যেই হাত-পা ছুড়ে লাথি মেরে কোনো ফল না পেয়ে ছেলেটা তার স্বরে চিৎকার জুড়েছে। তার চিৎকারে কান পাতা দায়।

ম্যাকফি আবারো মহাবীর সিংয়ের দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই সে ছেলেটাকে শূন্যে তুলে ধরতেই বসে থাকা শান্ত ছেলেটা চিৎকার করে উঠল। পরিষ্কার বাংলায় সে বলে উঠল, ‘থামুন। আমি বলতাছি। ওরে ছাইড়ে দেন।’

ছেলেটার বাংলা শুনে সবাই কম-বেশি অবাক হয়ে গেছে। তবে ওদের অবাক হবার পালা আরো বাকি ছিল। ছেলেটার কথা শুনে পাশ থেকে বুড়োটাও পরিষ্কার বাংলায় চেঁচিয়ে উঠল। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে সে পরিষ্কার বাংলায় চিৎকার করে শাঁসাতে লাগল যদি সে কিছু বলে তবে ওকে খুন করবে।

‘বাহ্, এরা তো দেখি সব বাংলা জানে। তাহলে এতক্ষণ ধরে ভং ধরে ছিল কেন?’ জোনাথন আনমনেই বলে উঠল। বিগত কয়দিন শুনে শুনে স্থানীয় বাংলার অনেকটা তার দখলে চলে এসেছে।

‘এই চুপ, সবাই চুপ,’ ম্যাকফি ধমকে ওঠার পরেও বুড়োটা চেঁচাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়াল ম্যাকফি। বুড়োটার দিকে হাতের পিস্তল তাক করে বলল, ‘আর একটা কথা বললে মাথা গুঁড়িয়ে দিবো।’

ম্যাকফির আধা বাংলা আধা ইংরেজি পুরোপুরি না বুঝলেও লোকটা চুপ হয়ে গেল। কারণ মুখের ভাষা বুঝতে না পারলেও বন্দুকের ভাষা দুনিয়ার প্রায় সবাই কম-বেশি বুঝতে পারে। লোকটাকে থামিয়ে দিয়ে ও মহাবীর সিংয়ের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল ছেলেটাকে মাটিতে নামিয়ে রাখতে। বলার সঙ্গে সঙ্গে আস্তে করে ছেলেটাকে মাটিতে নামিয়ে রাখল মহাবীর সিং।

‘এই তুমি, এদিকে আসো,’ অন্য ছেলেটাকে পিস্তলের ইশারায় কাছে ডাকল ও। ‘বলো, কী বলতে চাও। তোমরা তো সবাই বাংলা জানো তাহলে এতক্ষণ অভিনয় করছিলে কেন?’

ওর কথার জবাবে ছেলেটা দুই হাত জোর করে কথা বলতে লাগল। ‘হুজুর, আমগর বাপুর নির্দেশ,’ সে একটা হাত তুলে তার বাবার দিকে দেখাল। ‘সে এই এলাকায় খেলা দেহানোর সময়ে আমগরে কথা কইতে নিষেধ করে। আমগর কুনো দোষ নাই, হুজুর।’

ম্যাকফি ছেলেটার জোর করে ধরে রাখা হাত দুটোকে নামিয়ে দিল। ‘নাম কী তোমার?’

‘হুজুর, আমার নাম পানু,’ ছেলেটাকে এখন অনেকটাই স্বাভাবিক দেখাচ্ছে।

‘শোনো, পানু, তোমাকে যা-যা জিজ্ঞেস করব ঠিক-ঠিক উত্তর দিবে, না হলে ভীষণ বিপদে পড়বে তোমরা। আর যদি ঠিক-ঠিক উত্তর দাও তবে কোনো ক্ষতি হবে না তোমাদের।’

‘হুজুর, আপনি আজ আমাকে প্রাণে না বাঁচাইলে আমি এতক্ষণে মইরে ভূত হয়া যাইতাম। আপনার কথার উত্তর দিতে পাইরলে আমার মনে অনেক শান্তি আসবে।’

ছেলেটার কথা শুনে ম্যাকফি একটু চমকে উঠল। আচ্ছা তাহলে এই ছেলেটাকেই বট গাছ তলায় ও শূন্য থেকে পতিত অবস্থায় ধরেছিল। ‘ঠিক আছে, সত্যিই যদি আমার প্রতি তোমার কোনো কৃতজ্ঞতা থেকে থাকে তবে ঠিকঠিক উত্তর দিবে। প্রথম প্রশ্ন, তোমাদের বাবা তোমাদেরকে কথা বলতে মানা করে কেন? তোমরা তো দড়ির খেলা দেখানোর বাজিকর তবে কথা বলতে সমস্যা কোথায়?’

ম্যাকফির প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে ছেলেটা একবার তার বাপের দিকে তাকাল। বাপ তড়বড় করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই মহাবীর সিং কুঠার হাতে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে চুপ মেরে গেল।

‘তুমি বলো।’

‘হুজুর, আমরা আসলে বাজিকর নই। আমরা হলাম তুসুমবাজ।’

‘তুসুমবাজ! সেটা আবার কী?’ এরকম কোনো শব্দ এর আগে ম্যাকফি শোনেনি। সে একটু অবাক হয়েই শংকরের দিকে তাকাল। শংকরকে দেখে মনে হলো এই ব্যাপারে সে ভালোই অবগত আছে। ‘শংকর, তুসুমবাজ কী?

‘ওর কাছ থেকেই শুনেন, হুজুর। এই, বল।’

‘হুজুর, আমরা ডাকাইত।’

‘ডাকাত।’

‘সরাসরি ডাকাইত না এরা,’ ছেলেটা জবাব দেওয়ার আগেই শংকর বলে উঠল। ‘আমি এগো কথা অনেক শুনছি। কিন্তু এমনে সরাসরি দেখতে পারব সেইটা ভাবিনাই। এরা বিভিন্ন জায়গায় দড়ির খেলা দেখায়ে বেড়ায় আর সুযোগ পাইলে অন্ধকারে পথের ধারে রাইতের বেলা মানুষরে দড়ির ফাঁস দিয়া নাইলে মাথা ফাডায়া খুন করে।

‘বলো কী! তোমার বাবা আর তোমরা আমাদের ওপরে আক্রমণ করলে কেন? আর যে দুজন পালিয়ে গেল ওরা কারা ছিল?’ ম্যাকফি আবারো পাইপ টানতে শুরু করেছে। ও বেশ বুঝতে পারছে আবারো পুরোপুরি তামাকের নেশার জালে জড়িয়ে গেছে ও। এরকম পরিস্থিতিতে তামাক ছাড়া কিছুতেই চলছে না।

‘হুজুর, যে দুইজন পলায়ে গেল হেরা আমাগো দলেরই মানুষ?’

‘তোদের দলে আর কে কে আছে?’ এবারের প্রশ্নটা শংকরের।

‘আর কেউ নাই, আমরা ছুডো দল। পাঁচজনে খেলা দেহাই আর সইন্ধার পরে রাস্তার সাইডে একলা মানুষ পাইলে মাতা ফাডায়া জিনিসপত্র লইয়া পলাই,’ ছেলেটার একেবারেই নির্বিকার জবাব।

বুঝতে পেরেছি, তোমরা আমাদের ওপরে আক্রমণ করলে কেন?’ ম্যাকফি আবারো আগের প্রশ্নটাই জিজ্ঞেস করল।

হঠাৎ বাইরের দরজায় ধামধাম করে শব্দ হলো। ম্যাকফি মহাবীর সিংকে ইশারা করল দেখতে কে এসেছে। মহাবীর সিং দরজা খুলে বাইরে চলে গেল। দিনের আলো শেষ হয়ে বাইরে সন্ধ্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। বিকেল থেকে টানা বৃষ্টি হচ্ছে।

মহাবীর সিং ফিরে এসে জানাল রাজার লোকেরা বন্দিদের ব্যাপারে ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। ম্যাকফি একটু ভেবে ওদেরকে বাইরেই অপেক্ষা করতে বলার জন্যে মহাবীর সিংকে বাইরে পাঠিয়ে আবারো শুরু করল।

‘কারণ আইন্নেরা, ঘুড়া দেইখ্যা ফালাইছেন?’

‘ঘোড়া দেখে ফেলেছি মানে কী?’ ম্যাকফি আড়চোখে একবার শংকরের দিকে তাকাল।

‘এইগুলা চুরির ঘুড়া,’ ছেলেটা এটুকু বলতেই ওদের মধ্যে একবার চোখাচোখি হয়ে গেল। ‘কাইল রাইতেই এইগুলা একজনে আমগরে দিছে বেইচ্চা দেউনের লেইগ্গা। আমরা এইরহম চুরির ঘুড়াও কেনাবেচা করি।’

‘ঘোড়াগুলো যদি বিক্রির জন্যেই নিয়ে থাকো তবে এগুলো বাজারে তোলোনি কেন?’

‘কারণ এডিত্তে অহনো ছাপ তুলা অয়নাই। কাইল রাইতেই এডি পাউনের পরে ছাপ তুলুনের সময় পাইনাই,’ ছেলেটা এবারো একেবারে নির্বিকার বলে যাচ্ছে।

‘একারণেই ওগুলো বাজারে তোলোনি এখনো তোমরা। আর এটা আমরা দেখে ফেলাতেই আমাদের ওপরে আক্রমণ।’

‘হুজুর, আপনে আমারে বাঁচাইছেন আপনের লগে মিছা কমুনা। আমি হেগোরে নিষেদ করছিলাম। হেরা আমার কথা শুনে নাই। আমি এরুমও কইছিলাম সাদা চামড়ার মানুষগো মারলে বিপদে পড়ুন লাগবো। হেরা হুনে নাই।’

ম্যাকফি ছেলেটার বাপের দিকে তাকাল। ‘তোমার ছেলেরা যা বলছে তা কি সত্যি?’

লোকটা কিছুই না বলে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। ‘কী হলো? কথা বলছ না কেন?’ বলে ম্যাকফি তার দিকে দু-পা এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল লোকটার সামনে। পাইপে কষে টান দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে দিল লোকটার মুখ বরাবর।

‘তুমি আমাকে জানাবে ঘোড়াগুলো কার কাছ থেকে পেয়েছো। যদি সেটা না করো, তবে তোমাকে আমি কিছুই করব না। স্রেফ জমিদারের লোকদের হাতে তুলে দিবো। আমি শুনেছি এই এলাকায় নাকি চোর আর খুনিদেরকে শূলে চড়ানো হয়। কীভাবে চড়ানো হয় জানো? বড়ো একটা কাঠের পাটাতনের ওপরে চোখা একটা ডান্ডা বসানো থাকে। সেটাতে তেল মাখিয়ে পিচ্ছিল করে ওপর থেকে অপরাধীকে বসিয়ে দেওয়া হয় ওটার ওপরে,’ এই পর্যন্ত বলে ম্যাকফি থামলো। লোকটাকে ওর বলা কথাগুলো অনুধাবন করার সময় দিল। তারপর আবারো বলতে লাগল। শরীরের পিছন দিয়ে ঢুকে মুখ-মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে যায় চোখা ডান্ডা। এবার বলো, তুমি আর তোমার ছেলে জমিদারের হাতে পড়বে, নাকি আমার সঙ্গে কথা বলে মুক্তি পাবে?’

লোকটা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ম্যাকফির দিকে। দুজনার কারোরই চোখের পলক পড়ছে না। হঠাৎ লোকটা মুখ ফাঁক করতেই কাঁচা-পাকা দাড়ির ফাটলের ভেতরে দুইসারি পানের দাগওয়ালা দাঁত দেখা গেলো। ম্যাকফিকে দন্ত প্রদর্শন করে করেই খিক খিক করে বিশ্রীভাবে হেসে উঠল লোকটা। তারপর হো হো করে হাসতে লাগল। খুব গম্ভীর আর রাগি ভাব নিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে ছিল ম্যাকফি। লোকটা এভাবে হেসে ওঠাতে বোকা বনে গেল ও। একবার শংকরের দিকে আরেকবার জোনাথনের দিকে দেখল। লোকটা এখনো বিকারগ্রস্তের মতো হেসেই চলেছে।

মহাবীর সিং খপ করে খাপ থেকে তলোয়ার বের করে আনলো। শান্তশিষ্ট মানুষটাকে রাগে লাল দেখাচ্ছে। তবে সে কিছু করার আগেই লোকটা কথা বলে উঠল, ‘ছায়েব, বারো বছর বয়সে পরথম মানুষ মারি আমি। এরপরে এই পঞ্চাশ বছরের চুরি-ডাকাইতির জীবনে অন্তত একশ মানুষ মারছি, আর তুমি আমারে মরার ভয় দেহাও। আমি কিছুই কমু না। তুমরা কেউই,’ বলে সে একে একে সবার দিকে দেখল। ‘আমারে দিয়া কিছুই বলাইতে পারবা না,’ বলে সে মাটিতে একদলা থুতু ফেলল।

‘তাহলে তোমাকে তো বটেই, তোমার এই দুই ছেলেকেও জমিদারের লোকের হাতে তুলে দেওয়া হবে। ওরা বাইরেই বসে আছে। আমি স্রেফ একবার ডাক দিলেই ভর্তা করে ফেলবে তোমাদের।’

লোকটা কিছুই না বলে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।

‘হুজুর, আমি বলবো তোমরা যা জানতে চাও,’ ছেলেটা কথা বলে উঠল ‘তবে আমারে আর আমার ভাইরে ছাইড়া দিতে হবে,’ ম্যাকফি একবার জোনাথনের দিকে তাকাল। জোনাথন সম্মতিসূচক ইশারা করতেই ম্যাকফি বলতে শুরু করল। ‘তোমাদেরকে নিয়ে কী করা হবে সেটা আমি এখনো বলতে পারছি না। এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে জমিদার আচার্য। কারণ এটা তাদের এলাকা। তবে তুমি যদি আমাকে ঠিকমতো সাহায্য করতে পারো সেক্ষেত্রে তোমাদের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেটা আমি দেখবো। তবে সবই নির্ভর করছে তুমি আসলে কী জানো আর আমাদের কতটুক সহায়তা করতে পারবে সেটার ওপরে।’

ওর কথা শেষ হতেই ছেলেটা একবার তার ভাইয়ের দিকে ইশারা করল। অন্য ছেলেটা নেতিয়ে পড়া অবস্থা থেকে এখন সোজা হয়ে বসেছে। ওদের কথাবার্তাও শুনে এটাও বুঝতে পেরেছে বাপের কথা শুনলে এখন মরতে হবে। তারচেয়ে ভাই যা বলছে সেটাই ভালো। সে-ও তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে একটা ইশারা করল।

‘হুজুর, আমাদের বাপু ঘোড়াগুলো কোথা থেকে কার কাছ থাইকে পাইছে সেইটা আমি বলতে পাইরবো না। তয় যে লোকটার কাছ থেকে বাপু এগুলা নিছে সেই লোকের সঙ্গে আজ রাতে তার দেখা করার কথা টাকার ভাগ নিয়ে হিসেব করার জইন্যে। ওরা কুথায়, কুন সময়ে দেহা করবে হেইডা আমি জানি। আমি আপনেগো দেহায়া দিতে পারব।

ম্যাকফি সঙ্গে সঙ্গে জোনাথনের দিকে ফিরে তাকাল। ওরা এইবার একটা সরাসরি রাস্তা পেয়েছে যেখান থেকে কোম্পানির সৈন্যদের ভাগ্যে আসলে কী ঘটেছিল সেটা বের করতে পারবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *