প্রথম অংশ : ছন্দপতন
দ্বিতীয় অংশ : মৃত্যুহরণ

সপ্তরিপু – অধ্যায় ৭

অধ্যায় সাত – বর্তমান সময়

কোতয়ালি মডেল থানা, ময়মনসিংহ

অপেক্ষা করতে করতে আরেকবার ঘড়ি দেখল বাশার। আধাঘণ্টার ওপরে ওসির রুমের সামনে বসে আছে ও। হাতে কিছু কাগজপত্র। এগুলোতে সই করাতে হবে। কাগজগুলো পাশে রেখে ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতে পরা আংটিটা মোচড়াতে লাগল। এই জিনিসটা সবসময় ওকে মনে করিয়ে দেয়—ওকে স্থির থাকতে হবে, ধীরে ধীরে নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। জীবনে যত পিছিয়েই পড়ুক না কেন, সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

আলস্যভরে সোফায় হেলান দিয়ে আশপাশে ফিরে তাকাল। আজ সকাল- সকাল থানায় বেশ ব্যস্ততা। অন্যান্য দিন এই সময়ে থানার দিনই শুরু হয় না কিন্তু আজ ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে আরো ঘণ্টাখানেক আগে থেকেই। কারণ থানায় আজ এসপিসাহেব এসেছেন। একদিকে তার নিয়মিত ভিজিটের সময় এগিয়ে আসছিল, অন্যদিকে গতকাল ওই পুকুরের মাঝখানে গাড়িটা আর ডেডবডিটা খুঁজে পাবার পর প্রচুর জলঘোলা হয়েছে। সে-কারণেও এসপিসাহেব এসে থাকতে পারেন বলে মনে হচ্ছে বাশারের কাছে। গতকাল শানকিপাড়া শেষ মোড়ে পুকুরের মাঝখান থেকে টেনে তোলা গাড়িটাতে মৃতদেহটা খুঁজে পাবার পর ঘটে গেছে অনেক কিছুই।

গাড়ির ভেতরে মৃতদেহটা আবিষ্কার করার পর বাশার প্রথমেই সাঈদ আলী আর তার লোকদেরকে চার্জ করে বসে-কেন তারা এই ব্যাপারটা লুকানোর চেষ্টা করছিল? সাঈদ আলী সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা অস্বীকার করে, সে জানায় সে আর তার লোকদের কোনো ধারণাই ছিল না গাড়ির ভেতরে কোনো মৃতদেহ আছে। সাঈদ আলীর জবাব শুনে বাশার হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারে না। কারণ এরচেয়ে যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা কোনো পাঁচ বছরের বাচ্চাও দিতে পারবে। মৃতদেহটা আবিষ্কার করার সঙ্গে সঙ্গে বাশার ওর ফোর্স নিয়ে পুরো এলাকা সিল করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

কন্ট্রাকটার সাঈদ আলী প্রথমে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, তারপর তাকে একপাশে ডেকে নিয়ে বড়ো অঙ্কের ঘুস অফার করে, তাতেও বাশার রাজি না হলে এক পর্যায়ে সে রেগে ওঠে। রেগে গিয়ে সে প্রথমে তার চাকরি খেয়ে ফেলবে, তাকে বদলি করিয়ে দিবে, এসব হুমকি দিতে থাকে। তারপরও কাজ না হবার কারণে সে তাকে জানে মেরে ফেলবে এরকম হুমকিও দিতে শুরু করে।

এক পর্যায়ে বাশার রেগে ওঠে। সে কনস্ট্রাকশনের সমস্ত জিনিসপত্র ভেতরে রেখেই পুরো পুকুর এলাকা সিল করে দেয়। সাঈদ আলীর দলের লোকজন কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয় গন্ডগোল পাকানোর অভিযোগে। বাশার অবশ্য একজন পুলিশকে জনসম্মুখে হুমকি দেওয়ার অপরাধে সাঈদ আলীকেও গ্রেপ্তার করতে যাচ্ছিল, কিন্তু ততোক্ষণে আরো জলঘোলা হয়ে যায়। খবর পেয়ে জায়গা মতো পৌঁছে গেছে সাংবাদিকসহ আরো অনেকেই। আর গন্ডগোলের সুযোগে লোকজনও জমা হয়ে গেছে অনেক বেশি। সাঈদ আলীর থেকে নজর সরিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন হবার আগেই বাশার জায়গাটা সিল করে পুলিশের টো-ট্রাক আনিয়ে গাড়ি আর লাশ সরিয়ে ফেলে ওখান থেকে।

ওর কাছে তখন মনে হয়েছে সাঈদ আলীকে গ্রেপ্তার করার চেয়ে পরিস্থিতি সামলানোটা বেশি জরুরি ছিল। আর তাছাড়া সাঈদ আলীকে গ্রেপ্তার করতে গেলে মূল ব্যাপারটা ভণ্ডুল হবার একটা সম্ভাবনা দেখা দিতে পারতো। তাই পরিস্থিতি যেভাবে সামলানো যায় সে-ব্যবস্থাই নিয়েছে ও।

ওখানকার কাজ শেষ করে খুঁজে পাওয়া গাড়ি আর লাশ জায়গা মতো পৌঁছে দিয়ে থানায় ফিরে রিপোর্ট লিখতেই সন্ধে পার হয়ে যায়। ডিউটি টাইম শেষে ক্লান্ত-অভুক্ত শরীরে নিজের কোয়ার্টারে ফিরে গোসল সেরে কোনো মতে খেয়ে একটু দ্রুতই শুয়ে পড়ে ও। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পায় ওসি মল্লিক রাতের বেলা চার-পাঁচবার কল করেছিল। গভীর ঘুমের ভেতরে সে টেরই পায়নি। ও কলগুলো দেখতে পেলেও সকালবেলা আর কলব্যাক করেনি বরং জলদি ফ্রেশ হয়ে ইউনিফর্ম পরে চলে আসে থানায়। ওর নিয়ত ছিল কল না করে সরাসরি ওসির সঙ্গে দেখা করবে। যদিও এত সকালে ওসির থানায় আসার কোনোই সম্ভাবনা নেই।

তবে ও থানায় পৌঁছে বেশ অবাক হয়ে যায়। কারণ সকালবেলাই থানা বেশ সরগরম। এমনকি ওসিও উপস্থিত। ব্যাপার কিছুই না, থানায় এসপিসাহেব আসছেন। শুনতে পেয়েও না শোনার ভান করে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে পড়ে ও। গতকালের কিছু ঘটনাসহ অন্যান্য আরো কিছু জরুরি কাগজ গুছিয়ে ওসির সঙ্গে দেখা করতে যায়। ওসির অ্যাসিসট্যান্ট তাকে জানায় যেকোনো মুহূর্তে এসপিসাহেব চলে আসতে পারেন তাই ওসি ব্যস্ত আছে। তাকে পরে ডাকা হবে।

নিজের ডেস্কে ফিরে গিয়ে সকালের নাস্তা সেরে পত্রিকা পড়তে শুরু করে ও। প্রায় সবকটা স্থানীয় পত্রিকাসহ কয়েকটা জাতীয় দৈনিকে বেশ ফলাও করে খবরটা প্রচার হয়েছে। দুয়েকটাতে আবার ছাপা হয়েছে ছবিসহ।

পুকুরের নিচ থেকে কঙ্কালসহ গাড়ি উদ্ধার তো আর রোজকার ঘটনা নয়। ওকে আইটি সেকশনের জুনিয়র এক অফিসার জানায় খবরটা নাকি অনলাইন পোর্টালসহ ফেসবুকেও বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। জুনিয়র অফিসারের কথা শুনে বড়ো করে একটা হাই ছেড়েছে সে। মনে মনে ভেবেছে, খবর আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তো আমার কী? আমার কাজ আমি করেছি। থানার মেসেঞ্জারকে ডেকে চা আনতে বলে ও। চা খেতে খেতে ব্যাপারটা ভাবতে শুরু করে।

বাশার আগে মোটেও এরকম ছিল না। মানুষ কখন কীভাবে বদলে যায় সে নিজেই জানে না। মায়ের মৃত্যু তাকে বদলে দিয়েছিল আর কর্মক্ষেত্রে এত বড়ো একটা ধাক্কা তাকে করে তুলেছে নিরাসক্ত। যেখানে তার এখন হওয়া উচিত সদা সতর্ক, সদা সচেতন, নিজের হারানো অবস্থান ফিরে পাবার জন্যে সোচ্চার; সেটা না হয়ে কেমন জানি ভাবলেশহীন হয়ে গেছে ও।

সকালবেলা চা পানের সময়টা হচ্ছে মনের ভেতরের ফিলোসফি কপচানোর সবচেয়ে উত্তম সময়। সে মনে মনে জীবনের ফিলোসফি কপচাচ্ছিল এমন সময় এক মেসেঞ্জার এসে জানায় ওসি ডাকছে। ও কাগজগুলো গুছিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জানতে চায়, এসপিসাহেব চলে গেছেন কি না। মেসেঞ্জার ছেলেটা জানায়, এসপি স্যারও আছেন ভেতরে। অগ্নি পরীক্ষার সময় উপস্থিত বুঝতে পারে বাশার। সে টুপিটা পরে নিয়ে রওনা দেয় ওদিকে।

এরপর ওসিসাহেবের রুমের সামনে আসার পর আধাঘণ্টা হয়ে গেছে, সে বসেই আছে। এখনো ভেতর থেকে কোনো খবর আসেনি। বসে থেকে-থেকে বিরক্ত হয়ে কেসটা নিয়ে ভাবতে লাগল ও। সাঈদ আলীকে সে ভয় পায়না। কেয়ারও করে না। তার কাজ বন্ধ হয়েছে তো ওর কী? বাশার স্রেফ নিজের দায়িত্ব পালন করেছে। তবে প্রশ্ন হলো, এই গাড়িটা পুকুরের মাঝখানে এলো কীভাবে আর এই গাড়ির ভেতরের মানুষটাই বা কে। কত আগের ঘটনা, কে জানে। এসব খুঁজে বের করতে জান বেরিয়ে যাবে। এই জায়গাটাতেই একটু দ্বিধান্বিত বোধ করছে। ওর ক্যারিয়ারের যে বাজে অবস্থা তাতে এই কেস ওর ওপরে আসাতে পরিণতি আরো খারাপ হবে কিনা কে জানে। তবে উলটোও হতে পারে।

‘স্যার, আপনাকে ভেতরে ডেকেছে।’

সোফা থেকে ফাইলটা তুলে নিয়ে ভেতরের দিকে রওনা দিল ও। ওসির রুমের দরজাটা পার হয়ে ভেতরের দিকে ঢুকতে গিয়ে আরেকটু হলে পাতলা-লম্বা মানুষটার সঙ্গে ধাক্কা খেতে যাচ্ছিল বাশার। মানুষটাকে সরি বলতে গিয়েও থেমে গেল ও। সঙ্গে সঙ্গে এক পা পিছিয়ে এসে স্যালুট ঠুকলো, ‘স্যার।’

‘আরে বাশার তুমি,’ ওকে দেখতে পেয়ে একটু অবাক হয়েছেন এসপি আমজাদ আনোয়ার। ‘ওহহো, তাহলে ওই ঘটনার পর তোমাকে এখানে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। আশ্চর্য কাণ্ড, আমি তোমার লেটার ইস্যু করেছি অথচ ব্যাপারটা খেয়ালই ছিল না আমার। তা কেমন আছো তুমি?’

‘জি, স্যার। ভালো,’ আমজাদ আনোয়ার ওর প্রথম বস ছিলেন। তার অধীনে কাজ করেই সে আজ থেকে তিন বছর আগে প্রমোশন পেয়েছিল। সে নিজে যেমন মানুষটাকে পছন্দ করে তেমনি উনিও তাকে অত্যন্ত ভালোবাসেন।

‘কী ব্যাপার, মল্লিক,’ এসপি আমজাদ ওসির দিকে ফিরে জানতে চাইলেন। ‘তুমি তো আমাকে জানাওনি বাশার তোমার অধীনে কাজ করছে।’

ওসি কাঁচুমাচু হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই বাশারের দিকে তাকিয়ে এসপি আমজাদ বলে উঠলেন, ‘শোনো, আমি এই মুহূর্তে ব্যস্ততার ভেতরে আছি। পরে তোমার সঙ্গে আমি বিস্তারিত কথা বলবো। ওই সাঈদ আলীর কেসটার দায়িত্ব তোমাকে দেওয়া হয়েছে। ওটা যে গোলমেলে কেস দেখলাম, মনে হয় ওটার সমাধান করার জন্যে তুমিই সেরা লোক,’ বলে উনি যাবার জন্যে রওনা দিয়ে আবার ফিরে তাকালেন। ‘মাই বয়, যা হয়েছে হয়েছে সেসব ভুলে গিয়ে নতুন করে শুরু করো। আর যেকোনো ব্যাপারে সরাসরি আমার সঙ্গে কথা বলবে,’ শেষ কথাটা স্নেহের সুরে বলে গটগট করে বেরিয়ে গেলেন এসপি আমজাদ।

উনি বেরিয়ে যেতেই ওসি মল্লিক কথা বলে উঠল, ‘বাশারসাহেব, কেসটার ব্যাপারে কথা বলতে হবে।’ বাশার সামনে এগিয়ে একটা চেয়ার টেনে দাঁড়িয়ে রইল। ওসি না বলা পর্যন্ত সে বসতে পারে না। দাঁড়িয়ে থেকেই সে গতকাল লেখা রিপোর্টটা এগিয়ে দিল ওসির দিকে। ‘স্যার, এখানে সব বিস্তারিত বলা আছে।’

রিপোর্টটা নিয়ে চোখ বুলাতে লাগল ওসি। ‘শুনলাম আপনি সাঈদআলীর কনস্ট্রাকশন সাইটের কাজ বন্ধ করে পুরো এলাকা সিল করে দিয়েছেন,’ ওসি এখনো বসতেও বলেনি ওকে, রিপোর্ট থেকে চোখও ওঠায়নি। সে রিপোর্টে চোখ বুলাতে বুলাতে অনেকটা আনমনেই বলে উঠল কথাটা। ঠিক প্রশ্নও না আবার মন্তব্যও না।

‘জি, স্যার। ওটা একটা ক্রাইম সিন। আর তাছাড়া ওই সাইটের লোকজন, বিশেষ করে সাঈদ আলী আর তার লোকেরা, তথ্য লুকানোর চেষ্টা করেছে। এমনকি সে আমাকে প্রকাশ্যে ঘুস দেওয়ার চেষ্টা করেছে, পরে হুমকিও দিয়েছে আমি তাকে আর তার আরো লোকজনকেও গ্রেপ্তার করতে চেয়েছিলাম কিন্তু পরিস্থিতির কারণে পারিনি। তবে স্যার, আপনি চাইলে আমি এব্যাপারে এখনো একটা চেষ্টা করে দেখতে পারি, শুধু আপনার অনুমতি লাগবে।’

ওসি মল্লিক এতক্ষণ রিপোর্টে মনোযোগ দিয়ে চোখ বুলাচ্ছিল, বাশারের শেষ কথাটা শুনে সে ঝট করে চোখ তুলে ওর দিকে তাকাল। ‘আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন নাকি? আপনি সাঈদ আলীকে গ্রেপ্তার করতে চান। এর পরিণতি কী হবে জানেন?’ সাঈদ আলীর সঙ্গে ওসির যে বেশ ভালো একটা সম্পর্ক আছে বাশার সেটা ভালোভাবেই জানে আর সে জন্যেই খোঁচা দেওয়ার উদ্দেশ্যই কথাটা বলেছে ও। জানত এই কথাটা শুনলেই ওসি নিজেকে সামলাতে পারবে না।

‘স্যার, আমি তো… মুখে কৈফিয়ত দেওয়ার চেষ্টা করলেও মনে মনে হাসছে সে।

‘বাদ দিন, সাঈদ আলীকে নিয়ে আপনার মাথা ঘামাতে হবে না। তার ব্যাপারটা আমি দেখবো। আপনি কেসের দিকে মনোযোগ দিন। ব্যাপারটা এমনিতেই যথেষ্ট গোলমেলে তার ওপরে আবার সব মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার হচ্ছে। ওপরওয়ালারা কাল থেকে আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে। আপনি অফিসিয়ালি এই কেসের দায়িত্বে থাকবেন। তবে এখানে অনেক ব্যাপার আছে যেগুলো পুরোপুরি আমাদের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব হবে না। কাজেই আমরা সিআইডি আর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন মানে পিবিআইয়ের সাহায্য নিবো। পুলিশ, সিআইডি আর পিবিআইয়ের যৌথ ব্যবহারের জন্যে নতুন বাজারে একটা বড়ো ফরেনসিক ল্যাব বসানো হয়েছে। যদিও ওটা পিবিআইয়ের দায়িত্বে আছে তবুও আমাদের যেকোনো প্রয়োজনে আমরাও ওটা ব্যবহার করতে পারব। ল্যাবটা বসানোর কাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। এই মুহূর্তে ঢাকা থেকে আসা কয়েকজন এক্সপার্ট আছে ওখানে।

‘জি স্যার, আমি জানি। পুকুরের নিচ থেকে উদ্ধার করে গাড়িটা ওখানেই পাঠানো হয়েছে।’

‘হ্যাঁ, ওখানে একটা চমৎকার মেডিক্যাল ল্যাবও বসানো হয়েছে। গাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া ডেডবডি প্রথমে চরপাড়া মেডিকেলে পাঠানো হলেও ওখান থেকে ফরেনসিকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ওখানে এখনো কোনো নিয়মিত ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তবে ভিজিটিং ডাক্তার পোস্টমর্টেম করে কাগজপত্র সব ঠিক করে রাখার কথা,’ বলে ওসি একটু থামলো। ‘আপনাকে তো জানালামই এই কেসের অফিসিয়াল দায়িত্বে থাকবেন আপনি। আপনার সঙ্গে থাকবে রমিজ দারোগা আর কনস্টেবল আবদুল্লাহ। আপনাকে সার্বিক সহায়তা করবে ওরা। আর ফরেনসিক ল্যাবের অফিসে আমি বলে দিচ্ছি। আপনি রমিজ দারোগাকে নিয়ে ওখানে চলে যান, এই পর্যন্ত বলে সে একটু থেমে যোগ করল। ‘প্রত্যেকটা ব্যাপারে আমাকে আপডেট জানাবেন।’

‘অব্যশই, স্যার। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকেও আপডেট জানাবো, সেইসঙ্গে এসপি স্যার যেহেতু নির্দেশনা দিয়ে গেলেন ওনাকেও আমি আপডেট জানাবো আপনার পক্ষ হয়ে। ধন্যবাদ, স্যার,’ বলে ও পা ঠুকে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। রুমের বাইরে বেরিয়ে ও হাসি চেপে নিজের ডেস্কের দিকে এগোল। শেষ কথাটা বলে ও আর ওসির মুখের দিকে তাকায়নি।

তাকালে অবশ্যই দেখতে পেতো হয় তার মুখের রং রাগে লালচে হয়ে গেছে আর না হয় ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আপন মনে হাসতে হাসতেই সে নিজের ডেস্কে বসে ম্যাসেঞ্জারকে দিয়ে ডেকে পাঠাল রমিজ দারোগাকে। বাশার তখনো আপন মনেই হাসছিল যখন রমিজ দারোগা তার ডেস্কের সামনে এসে সালাম ঠুকে জানাল সে রমিজ দারোগা। মানুষটার পরিচয় পাবার সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ হয়ে গেল বাশারের মুখের হাসি।

ও যখন একেবারে ছোটো, তখন ওর বাবা মারা গেছিল। কিছু আবছা-আবছা স্মৃতি বাদ দিলে বাবার প্রায় কোনো স্মৃতিই ওর মনে নেই। তবে ও নিশ্চিত ওর বাবা যদি বেঁচে থাকতেন তবে তার বয়স হতো সামনে দাঁড়ানো মোটাসোটা বিশালদেহী এই মানুষটার সমান। এত বয়স্ক একজন মানুষকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখের হাসি বন্ধ হয়ে গেছে। ওর এই মুহূর্তে দরকার, একজন চটপটে পরিশ্রমী মানুষ। আর তাকে কিনা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে এরকম এক বৃদ্ধকে। লোকটা কাছাকাছি আসার পর বাশার নিশ্চিত হলো এই লোক মোটেই তার বাবার বয়সি নয়। ওর বাবা বেঁচে থাকলে নিশ্চিত এই লোকের চেয়ে কয়েক বছরের ছোটোই হতেন।

পান চিবুতে চিবুতে মানুষটা এসে ওর সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে গেল। অনুমতিরও তোয়াক্কা করল না। বাশার এতটাই অবাক হয়েছে কিছুই বলল না ও।

‘বুচ্ছুইন স্যার, আমি কিন্তু ইট্টু অন্যরহমভাবে কাম করি। আমি এই থানার বেহের চেয়ে বড়ো কি না, তাই সবাই আমারে মাইন্য করে। আর করতনা কেইল্লেইগ্‌গা কইন। আমি বেহেইরে সব কামে সাহাইয্যই করি। আর এইমুলুকে ইরম কেউই নাই যে আমারে চিনে না। ধইরালাইন, আমি কেউর লগে থাহুন মানে হের কাম অর্দেক হইয়া গেছে। হে হে হে,’ খুবই সদালাপী ভঙ্গিতে যেন চায়ের দোকানে বসে গল্প করছে এমন ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে সে হাসতে লাগল।

‘আপনিই রমিজ দারোগা? আপনি…’

‘জি, স্যার। আমি এই থানার সবচেয়ে পুরান মানুষ। ওসি স্যার কইন, এসপি স্যার কইন হেরাও তো আমার জুনিয়র। আর হেরাও আমারে অনেক মাইন্য করে। ওসি স্যার তো আমার কথা ছাড়া কুনো কামই করবার চায় না। হে হে হে।’

লোকটা কথা বলে যেতে লাগল আর বাশারের মনের ভেতরে আতঙ্ক প্রতিনিয়ত বাড়তে লাগল। ‘জি, এই থানায় আসার পর থেকেই আপনার কথা শুনেছি,’ ও আসলে লোকটার সামনে কথা খুঁজে পাচ্ছে না। পুলিশি জীবনে বহু মানুষের সঙ্গে মিশেছে কিন্তু এরকম কোনো মানুষ সে পায়নি যে তার সিনিয়রের সঙ্গে অবলীলায় জুনিয়রের মতো আচরণ করে যাচ্ছে। তবে একথা সত্য সে এই থানায় আসার পর থেকে কারো না কারো কাছে রমিজ দারোগার কথা শুনেছে। তার মতো অলস, ফাঁকিবাজ আর চাপাবাজ লোক নাকি অত্র মুল্লুকে আর নেই।

‘…স্যার আমার কতা তো হুনবাইনি। বিশেষ কইরা আমার ভাতিজা গফরগাঁওয়ের এমপি ওউনের পর থেইক্কা তো…ও আইন্নেরে তো কওয়াই অয় নাই আমার বাড়ি ওইলো গফরগাঁও। গফরগাঁওয়ের…’

‘মি. রমিজ,’ যেকোনো মূল্যে এই লোকটাকে থামাকে হবে। এই লোককে এভাবে কথা বলা চালিয়ে যেতে দিলে ওর খবর আছে। ‘যে কেসটাতে আমরা একসঙ্গে কাজ করব কেসটা কিন্তু বেশ সিরিয়াস। আর এই কেসে অনেক…. ‘

লোকটা আবারো ওকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আগেই বলতে শুরু করল। ‘আরে স্যার, এইডা মমিসিং টাউন। এনু কুনো কেইসে আমি আছি মাইনে এইডা কুনো বিষয়ই না, সে কথাগুলো বলে একটা হাত তুলে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করল।’

‘ঠিক আছে, সেটা সময় হলে দেখা যাবে,’ লোকটার হামবড়া কথাবার্তায় প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছে ওর। আলসের ধারি এই লোকটাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে নিতে পারলে সবদিক থেকেই ভালো হতো কিন্তু সে উপায় নেই। ওসির কাছে এই মুহূর্তে কিছু বলতে গেলেই ঝামেলায় পড়তে হবে। পারলে ওর ব্যাপারে আবারো কোনো- না-কোনো বিচার দিয়ে দিবে এসপি স্যারের কাছে। তারচেয়ে এই লোকটাকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে হবে। আর না হলে নিজেই করতে হবে সব। ‘আচ্ছা রমিজসাহেব, আমাদেরকে এখন বেরুতে হবে। জিপ বের করতে বলেন। আপনি ড্রাইভ করতে পারেন।

‘আরে না, স্যার। কী যে কন, আমি গাড়ি চালামু ক্যান! আবদুল্লাহ আছে। ওই পিচ্চি পোলাও তো আছে আমাগো দলে। ওরে ডাইক্কা পাডাইতাছি,’ বলে ওরা বাইরে বেরুতে বেরুতে রমিজ দারোগা চিৎকার করে আবদুল্লাহকে ডাকতে লাগল। ওরা থানার দরজার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে এমন সময় কনস্টেবলের পোশাক পরা এক ছেলে দৌড়ে এলো।

রমিজ দারোগাকে দেখে একবার বাকরুদ্ধ হয়েছিল বাশার। কনস্টেবল আবদুল্লাকে দেখে একেবারেই বাকশক্তি লোপ পেল ওর। রমিজ দারোগা যতই প্যাচাল পারুক একটা কথা ভালো বলেছে সে। এই ছেলে আসলেই পিচ্চি। একেবারেই ফর্সা গোলগাল চেহারার লম্বা পাতলা এক যুবক। মুখে দাড়ি-গোঁফের ঘনত্ব খুবই কম। তার ওপরে আবার সম্ভবত নিজেকে একটু বড়ো দেখানোর জন্যে সে গোঁফ রাখার একটা প্রচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা পুরোপুরিই ব্যর্থ হয়েছে। ফর্সা গোল মুখে নাকের নিচের সরু গোঁফটা তার চেহারাকে ভারিক্কি করে না তুলে বরং চেহারাটাকে করে তুলেছে আরো বাচ্চা-বাচ্চা। বাশারের সামনে এসে সে সালাম জানাল। বাশার ছেলেটাকে দেখে আপন মনে মাথা নাড়ল একবার। মনে হচ্ছে ময়মনসিংহ সদর কোতোয়ালি থানার সব বাতিল জিনিসগুলো ওর সঙ্গে গছিয়ে দিয়েছে মল্লিক।

‘স্যার, আমি আবদুল্লাহ। আমিও এই কেসে আপনার সঙ্গে আছি,’ স্যালুট ধরা হাতটা সে এখনো কপালের পাশেই ধরে রেখেছে।

‘হ্যাঁ, সে তো বুঝতেই পারছি। হাত নামাও,’ বলে বাশার জানতে চাইল। ‘কতদিন হলো ফোর্সে জয়েন করেছ?’

‘স্যার, এক বছর।’

তারমানে দেখতে যতটা বাচ্চা লাগে অতোটা বাচ্চা সে আসলে নয়। ‘গাড়ি চালাতে পারো?’

‘স্যার, সব পারব। আপনি নির্দেশ দিবেন। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব,’ নাহ ছেলেটা দেখতে একেবারে শিশু শিশু হলেও গলায় জোর আছে। মনে হচ্ছে একেবারে খারাপ হবে না সে। অন্তত রমিজ দারোগার চেয়ে ভালো হবে বলেই মনে হলো বাশারের কাছে। ‘ঠিক আছে, গাড়ি বের করো। আমি আসছি।’

অফিসিয়াল কিছু কাজ শেষ করে রমিজ দারোগাকে নিয়ে জিপে উঠল বাশার। সামনে বসা পিচ্চি কনস্টেবল আর পাশে বসা বৃদ্ধ দারোগাকে নিয়ে ফরেনসিকের দিকে রওনা দিল ও।

খারাপ পরিস্থিতি থেকেই নাকি ভালো কিছুর উত্থান ঘটে। দেখা যাক ভাগ্য সামনে কী রেখেছে ওদের জন্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *