প্রথম অংশ : ছন্দপতন
দ্বিতীয় অংশ : মৃত্যুহরণ

সপ্তরিপু – অধ্যায় ৩১

অধ্যায় একত্রিশ – সময় : ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ

তালুকদার পরিবারের আবাসস্থল, ময়মনসিংহ

‘সর্বনাশ! তারমানে ঠাকুরকে ওরা কখনোই সন্দেহের বাইরে রাখেনি, ‘ হেনরি স্লিম্যানের ঠগীদের সঙ্গে সংঘর্ষের বর্ণনা শেষ হতেই ম্যাকফি বলে উঠল I

‘না, ওকে দিয়ে ওরা একটা ফাঁদ পেতেছিল মাত্র,’ কথাটা বলল চেয়ারে বসে পাইপ টানতে থাকা হেনরি।

ওরা এই মুহূর্তে বসে আছে তালুকদার পরিবারের বসার ঘরে। কালন্তি বিলের কাছে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর হেনরি ওদের দুজনকে উদ্ধার করার পর বেশ কিছুক্ষণ নদীর পাড়েই লুকিয়ে থাকে ওরা। ভোরের আলো একটু-একটু ফুটে ওঠার পর পায়ে হেঁটে ওরা রওনা দিয়ে কিছুদূর এগোনোর পর ওদের দেখা হয়ে যায় লাল পাগড়ি বাহিনীর সঙ্গে। ওরাই পাহারা দিয়ে সবাইকে নিয়ে আসে তালুকদার বাড়িতে। এখানে বসেই গত এক ঘণ্টা ধরে হেনরি বলে চলেছে ঠগীদের সঙ্গে তার ভয়াল অভিজ্ঞতার কথা।

‘হ্যাঁ, ওরা ফাঁদ পেতেছিল। টোপ ছিল ঠাকুর নিজে। আর সেই ফাঁদে বোকার মতো ধরা দিয়েছি আমি। এই বোকামির মাশুলও গুনতে হয়েছে। ঠাকুর মাশুল গুনেছে নিজের জীবন দিয়ে। আর আমি মাশুল গুনেছি নিজের লোকেদের মৃত্যুর দায়ভার নিজের কাঁধে নিয়ে।

‘ওদের মানে?’ অনেকক্ষণ পর কথা বলল জোহরা। প্রথমে স্বামী, নায়েব মুন্সি, এরপরে আজরাতে লাল পাগড়িদের প্রধান আর মানিকের মৃত্যুশোক তাকে কাবু করে ফেলেছে সেই সঙ্গে নিজেও মৃত্যুর দুয়ার থেকে একটুর জন্যে ফিরে এসেছে এটা ভাবতেই বারবার গা শিউরে উঠছে তার। ‘ঠাকুরের সঙ্গে আর কাউকে খুন করেছিল নাকি ওরা?’

হেনরি চোখ তুলে তাকাল তার দিকে। টকটকে লাল দুই চোখে পানি টলটল করছে। ‘শুধু ঠাকুর না। ওইদিন আমার বাংলো, কাস্টমস হাউজ, কোম্পানির অফিসের পাহারাদার, বাবুর্চি, জনাকয়েক ঘুমন্ত সৈনিক-কাউকেই ওরা বাদ দেয়নি। প্রায় সবাইকেই ফাঁস পরিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। ঠাকুরকেও ওভাবেই মারলেও বেইমানির শাস্তি স্বরূপ ওকে মেরে ঝুলিয়ে দিয়েছিল, কেটে দিয়েছিল পেট।

আরেকবার শিউরে উঠল জোহরা। ম্যাকফিও গম্ভীর হয়ে আছে। ও মহাবীর সিং আর জোনাথনকে খবর পাঠিয়েছে। ওরা না আসা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছে না। ‘এরপর আপনি কী করলেন?’

‘ওইদিন ওখানে দাঁড়িয়ে আমি প্রতিজ্ঞা করি, আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো। কিন্তু পরিস্থিতি তখন আমার অনুকূলে ছিল না। একে তো বেখেয়ালিপনার দায়ে আমাকে এমনিই সমন দেওয়া হয়েছিল। তার ওপরে এতগুলো মানুষের মৃত্যুর জন্যে আর কোম্পানির সম্পদ ক্ষতিগ্রস্থ করার জন্যে সবাই আমাকেই দায়ী করবে। সাসপেন্ড তো করা হবেই সেই সঙ্গে গ্রেপ্তারও করতে পারে। তাই আমি পালাই ওখান থেকে।

‘পালিয়ে গেলেন?’ ম্যাকফি একটু অবাক হয়েছে।

‘হ্যাঁ, আসলে ঠগীদেরকে খুঁজে বের করার জন্যে আমার আর কোনো উপায় ছিল না। কোম্পানি আমার কথা বিশ্বাস করত না। অন্য কেউই আমাকে বিশ্বাস করত না। আমাকে আরো প্রমাণ সংগ্রহ করতে হতো। তাই আমি টুকিটাকি কিছু জিনিস যা ছিল আমার কাছে সেগুলো নিয়ে পালালাম। বিশ্বস্ত লোকজন যারা ছিল ওখানে তাদের বললাম আমার অন্তর্ধানের ব্যাপারে যেন কাউকে কিছু না জানায়। তবে আমি জানতাম কর্নেলের সৈন্যরা গিয়ে ঠিকই রিপোর্ট করবে। তাই পালালাম। তবে আমার পালানোর পেছনে আরেকটা কারণ ছিল। আমার হাতে এমন একটা জিনিস ছিল যেটা দিয়ে আমি ওদের পিছু ধাওয়া করতে পারতাম।’

‘সেই বটুয়াটা, তাই না?’ জোহরা জানতে চাইল।

‘হ্যাঁ, সেই বটুয়াটা, আমার পালাবার পেছনে ওটাও একটা বড়ো কারণ ছিল।’

‘কিন্তু আপনি তো চাইলে ওটাকেই প্রমাণ হিসেবে দাখিল করতে পারতেন,’ ম্যাকফি বলল।

‘না, পারতাম না। এতবড়ো একটা ঘটনা ঘটে গেল সেটার পেছনে প্রমাণ হিসেবে কয়টা কাগজ-তাও আবার অজানা এক ভাষায় লেখা যথেষ্ট ছিল না। তাই আমি পালালাম। সোজা চলে এলাম কোলকাতা। সেখানে আমার পরিচিত এক ভাষাবিদ ছিল, তাকে নিয়ে জিনিসটা দেখালাম সে বলল এটা বহু পুরনো ফার্সি ভাষার কোনো একটা রূপ। সে চেষ্টা করলে ওটাকে ভাঙতে পারবে। তার কাছে ওটা দিয়ে আমি বাইরে খোঁজ-খবর করতে লাগলাম। প্রথমত, লোক মারফত খবর লাগালাম আমার নিজের এলাকাতেই। সেখান থেকে যা জানতে পারলাম তা খুবই অবিশ্বাস্য।

‘ঠগীরা নাকি বছরের বেশিরভাগ সময় চলার ওপরেই থাকে। এরকমই একটা দল নাকি নর্মদাতে এসে আস্তানা গেড়েছিল। যাদের সঙ্গে আমার টক্কর লেগেছিল। ওদের এই দলটা নাকি পুরো ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রভাবশালী দলগুলোর ভেতরে একটা। কারণ ওদের কাছে নাকি জোড়া কালী নামে মা ভবানীর মূর্তি আছে যা ঠগীদের অন্যতম প্রভাবশালী প্রতীকগুলোর ভেতরে একটা। এই দলের নেতার নাম ফিরিঙ্গিয়া। এই ফিরিঙ্গিয়া নাকি মাদ্রাজ এলাকার সবচেয়ে কুখ্যাত ঠগী। সেদিনের সেই ঘটনার পর ওরা নর্মদা এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে সেটার খোঁজ করতে গিয়ে আমি জানতে পারি ওরা গেছে ইলোরাতে। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে গেলাম ইলোরাতে, ইলোরা থেকে এলাহাবাদে। এলাহাবাদে পৌঁছে আমি জানতে পারি তারা বাঙ্গাল মুলুকের দিকে গেছে। এলাহাবাদ থেকে কোলকাতায় ফিরে যাই আমি। সেই বইটার অনুবাদ সংগ্রহ করি ভাষাবিদের কাছ থেকে। ওটা নিয়ে চলে আসি ঢাকায়। ঢাকায় এসে জানতে পারি বাঙ্গাল মুলুকে ঠগীদের সবচেয়ে বড়ো আস্তানা নাকি কুমিল্লায়। সেখানে গিয়ে খোঁজ-খবর করব ভাবছিলাম, এমন সময় এই মুক্তাগাছা অঞ্চলে ইংরেজ অফিসারদের হারিয়ে যাবার খবর জানতে পারি। ওদের গায়েব হবার ধরন জানতে পেরে আমার সন্দেহ লাগে এটা ওদের কাজ হতে পারে।’

‘আপনি এত সহজে কীভাবে নিশ্চিত হলেন?’ ম্যাকফি জানতে চাইল।

‘আমি নিশ্চিত হই, কারণ কুমিল্লা এলাকায় পৌঁছে আমি একটা গুজব শুনতে পাই। সেখানে গিয়ে আমি জানতে পারি মধুপুর এলাকায় নাকি ইদানিং ঠগীদের উৎপাত বেড়ে গেছে, কারণ স্থানীয় কোনো এক রাজা নাকি ঠগীদেরকে সহায়তা করছে। এরকম একটা গুজব আমি এলাহাবাদেও শুনেছিলাম। নর্মদাতে আমার সঙ্গে টক্কর লাগার পর ওরা ইলোরাতে বাৎসরিক ঠগী জমায়েতে গিয়ে এই এলাকার সেই রাজার সঙ্গে মোলাকাত হবার পর ওরা বাঙাল মুলুকে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। তাই এই এলাকাতে ইংরেজ অফিসারদের গায়েবের খবর শুনে এখানে চলে আসি।’

‘স্থানীয় রাজা মানে কী? সূর্যকান্ত কি তবে ঠগীদের সহায়তা করছে?’ ম্যাকফি প্রশ্ন করল।

‘অসম্ভব, সে সহায়তা চাইছিল ইংরেজদের কাছে আর ইংরেজদেরকেই মেরেছে ঠগীরা। কাজেই সে হতেই পারে না,’ জোহরা বলে উঠল।

‘আমারও তাই মনে হয়। তবে কে হতে পারে?’ বলে ম্যাকফি ফোড়ন কাটলো। ‘গতরাতে আপনি ওখানে কীভাবে একেবারে সময়মতো পৌঁছালেন সেটা কিন্তু বলেননি।’

‘এখানে পৌঁছে প্রথমে আমি একটু থমকে যাই। কাউকে চিনি না। তবে এখানে আসার আগে পুরনো এক ইংরেজ বন্ধুর কাছে জানতে পেরেছিলাম এই এলাকাতে ইংরেজদেরকে খবর পাচার করে কামাল শেঠ নামে একজন ব্যবসায়ী। তো এখানে এসে এক সরাইখানায় উঠলাম। কামাল শেঠকে খুঁজে বার করে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম, কিন্তু বেটা বহুত ধুরন্ধর। আমি তাকে বের করার আগে সে-ই জানতে পারে আমি তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমি তাকে খুঁজে বেড়াই আর সে আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ায়। তো যাই হোক গতকাল খাগডহরের হাটে দড়ির খেলা দেখানোর সময়ে তারে ধরি কিন্তু গণ্ডগোলের সুযোগে আমার মনোযোগ সরে যাওয়াতে সে পালায়। এরপরেও লোক পাঠিয়ে খবর লাগাই। এবার সে নিজেই দেখা করতে আসে আমার সঙ্গে,’ বলে হেনরি ফিরে তাকাল সবার দিকে।

ম্যাকফি একটা হেলানো চেয়ারের মতো চেয়ারে বসে পাইপ হাতে ধরে বসে আছে। আগুন নিভে যাওয়াতে সরু ধোঁয়া বেরুচ্ছে ওটা থেকে। ওদের থেকে বিপরীত দিকে বসে আছে জোহরা। দুই চোখ ছলছলে তারপরও কিন্তু বেশ সচেতনভাবে বেশ শক্ত একটা ভাব ধরে রেখেছে মুখে। ‘ঘণ্টাখানেক এটা-ওটা বলে কিন্তু কাজের কথা কিছুই বলে না। আমি বুঝতে পারি এই লোককে দিয়ে কিছুই হবে না। তাই সে যখন বেরিয়ে আসে তখন তার পিছু নিতে শুরু করি। পিছু নিতে নিতে শেষ পর্যন্ত…বাকিটা আপনারা জানেন,’ বলে হেনরি মাথা নাড়ল।

‘এখন কী করতে চান?’ প্রশ্নটা করেছে ম্যাকফি।

ওর প্রশ্ন শুনে সবাই নড়েচড়ে বসল। সবাই তাকিয়ে আছে হেনরির দিকে। সবার দৃষ্টি নিজের ওপরে অনুভব করে মৃদু হেসে উঠল হেনরি। ‘আপাতত আমি সকালের ব্রেকফাস্ট করতে চাই, বেশ ক্ষুধা লেগেছে। এরপরে আমার কিছু মানুষ লাগবে,’ বলে সে ম্যাকফির দিকে ফিরে তাকাল। ‘আপনার দলটাকে লাগবে, সেই সঙ্গে লাগবে রাজা সূর্যকান্ত আচার্যকে আর ডোংরু মহারাজ নামের সেই ব্রাহ্মণ পুরোহিতকে,’ শেষ কথাটা সে জোহরাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে। কারণ এরা জোহরার শত্রু।

সে ভেবেছিল এদের কথা শুনলে জোহরা প্রতিক্রিয়া দেখাবে কিন্তু সেটা না করে বরং সে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল হেনরির দিকে।

জোহরার প্রশ্নটা করে বসল ম্যাকফি, ‘এদেরকে দিয়ে আপনি কী করবেন? ‘ওয়েল,’ বলে মৃদু কাঁধ ঝাঁকালো হেনরি। ‘প্রথমত, সূর্যকান্তের কাছ থেকে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে,’ বলে সে একটু থেমে যোগ করল। ‘দ্বিতীয়ত, আমি একটা ফাঁদ পাততে চাই। এজন্যেই এদের সবাইকে দরকার আমার। সঙ্গে আপনাদেরকেও।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *