প্রথম অংশ : ছন্দপতন
দ্বিতীয় অংশ : মৃত্যুহরণ

সপ্তরিপু – অধ্যায় ৫

অধ্যায় পাঁচ – বর্তমান সময়

গাঙ্গিনাপাড়, ময়মনসিংহ

শেষ মোড়ের দিকে যাবার পথে স্মৃতিকাতর একটা অনুভূতি আচ্ছন্ন করে রাখল বাশারকে। সত্যি কথা হলো, ফিরে আসতে যতই খারাপ লাগুক, ময়মনসিংহ ওর নিজের শহর। এখানকার রাস্তা-ঘাট আর অলি-গলিতেই বেড়ে উঠেছে ও। তাই পথে চলতে গেলেই কেন জানি নস্টালজিক লাগে বাশারের। যদিও শহরটা বদলে গেছে অনেক, তবে তারচেয়ে বেশি বদলে গেছে ও নিজে।

‘স্যার, একটা কথা আছিল,’ বাশারের পেছন থেকে বুড়ো এক কনস্টেবল বলে উঠল। জিপের সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে আছে ও। পেছনে পুলিশের কয়েকজন কনস্টেবল। ওদের পেছনে একটা পুলিশের বড়ো ভ্যানও আসছে। বাশার ইচ্ছে করেই ওটাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। কারণ ওখানে গিয়ে কী ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে কে জানে। কাজেই ব্যাক-আপ নিয়ে যাওয়াই ভালো।

বাশার কিছু না বলে চোখের সানগ্লাসটা খুলে কথা বলার জন্যে ইশারা করল। ‘স্যার, মনে অয় ওসিসাইব আপনারে সব বলেন নাই। ওইহানে আরো কুনো ব্যাপার আছে। আমরাও আপনারে সব বলতে পারতাছি না,’ কনস্টেবল কথা বলছে খুব আস্তে-আস্তে। শেষ কথাটা আরো আস্তে বলে তার সঙ্গে বসে থাকা অন্য কনস্টেবলদের দিকে ইশারা করল।

‘স্যার, আমার পরামর্শ থাকবো আপনে খুব সাবধানে থাকবেন। আর সবকিছু খুব সাবধানে সামলানির চেষ্টা করবেন,’ অপর কনস্টেবল বলে উঠল। ‘আমরা যদিও সব জানি না কিন্তু এইটা বুঝতে পারতাছি ওইহানে কুনো ঝামেলা বাঁধছে আর ওসিসাইব নিজেও ওই ঝামেলা সামলাইতে পারতাইন না। কারণ হেয় নিজে আগেই সাঈদ মিয়ার কাছ থাইক্কা টাকা খায়া বইসা আছে। তাই হে নিজে ব্যাপারটার সঙ্গে জড়াইতে চাইতাছে না,’ বলে সে দম নিলো।

‘স্যার,’ পাশ থেকে অন্যজন বলে উঠল। ‘এই কেইসডা আপনেরে দেওনের আগে ওসিসাইব আরো দুইজনরে যাইতে কইছিল, কেউই রাজি অয়নাই। তাই আপনের ঘাড়ে নামায়া দিছে। কারণ আপনে অহন সহজ শিকার। কাজেই সাবধান।’

কনস্টেবলরা কথা শেষ করতেই বাশার আবার সামনে তাকিয়ে সানগ্লাসটা চোখে পরে নিলো। ওদের জিপ সিকে ঘোষ রোডের মুখের জ্যাম ছাড়িয়ে নতুন বাজারের মোড় পার হয়েছে। জিলা স্কুলের মোড় দিয়ে বাঁয়ে ঢুকে গেল জিপ। ও নিজে জিলা স্কুলের ছাত্র। স্কুলের গেটের দিকে তাকিয়ে শত-শত স্মৃতি মনে পড়ে গেল ওর। কত আনন্দ-বেদনা, ভালোবাসা-ভালোলাগা, ভয়-ভীতি, স্যারদের বকুনি-চোখ রাঙানি এড়িয়ে স্কুল পালানো। মানুষ ছোটোবেলা ভাবে : ইস্, কবে যে বড়ো হবো, বড়ো হয়ে এটা হবো, ওটা হবো। আর বড়ো হয়ে ভাবে : ইস্, আবার যদি ছোটো হতে পারতাম। মনের গহিন থেকে উঠে আসা হাজারো স্মৃতির ভিড়কে ঠেলে দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে মনস্থির করার চেষ্টা করল ও। একটু আগে কনস্টেবলের বলা কথাগুলো গভীরভাবে অনুধাবন করার চেষ্টা করছে।

বাশার এটা বুঝতে পারছে, শানকিপাড়া শেষ মোড়ে কিছু একটা হয়েছে যেটা নিয়ে ওসি মল্লিক কোনো-না-কোনো গ্যাড়াকলে পড়েছে। যে গ্যাড়াকল সামনা- সামনি মোকাবেলা করার মতো পরিস্থিতি সম্ভবত সে রাখেনি। যে কারণে এখন ওকে পাঠিয়েছে পুরো ব্যাপারটার মোকাবেলা করতে। ঠিক আছে, দেখা যাক কী অপেক্ষা করছে সামনে। ভালো কিংবা খারাপ যাই থাকুক না কেন, ওর জন্যে একই। কারণ ওর সঙ্গে যা ঘটে গেছে এর চেয়ে খারাপ এই মুহূর্তে আর কিছু হতে পারে না।

ওদের জিপ এই মুহূর্তে শানকিপাড়া রেলক্রশিং পার হয়ে শেষ মোড়ের দিকে চলেছে। আর কিছুক্ষণের ভেতরেই জায়গামতো পৌঁছে যাবে ওরা। বাশার ঘড়ি দেখল। একটা বেজে বিশ।

একেবারেই মধ্যদুপুর। পেটের ভেতরে ক্ষুধার মৃদু গুড়গুঁড়ানি টের পাচ্ছে ও। গতকাল পর্যন্ত সকালে নাস্তা খাবার পরে দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল দুপুরে খাওয়া। আর আজ দুপুরে খাবার সুযোগ পাবে কি না, কে জানে। শেষ মোড়ে এসে গাড়ি ডানে মোড় নিলো। ওয়াকিটকিতে রিপোর্ট শেষ করতে করতেই ওদের জিপ বেশ খানিকটা এগিয়ে মূল রাস্তার পাশেই একটা পুকুর পাড়ে এসে থেমে গেল।

জায়গাটা বাশারের বেশ পরিচিত। ক্যান্টনমেন্ট কলেজে পড়ার সময়ে ও প্রতিদিন এই রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যেতো। এই এলাকাতে ওর বেশকিছু বন্ধু ছিল। ওরা মিলে এই পুকুরের অন্যপাড়ে শীতের সময়ে কোর্ট কেটে ব্যাডমিন্টন

খেলতো প্রতি বছর। কোনো এক অজানা কারণে এই পুকুরটাকে ওরা ডাকত ‘পাগলার পুকুর’। এই পাগলার পুকুর নিয়ে বেশ কিছু স্মৃতিও আছে ওর। এই পাগলার পুকুরের পাড়ে ব্যাডমিন্টন খেলতে এসেই কোনো এক ‘শুভক্ষণে প্রথমবারের মতো সিগারেটে টান দিয়েছিল। কলেজে পড়ার সময়ে মাঝেমাঝেই ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে এই পাগলার পুকুরের পাড়ে এসে বসে থাকত ও।

জিপ থেকে নেমেই চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো ও। শেষবার এখানে এসেছিল বহুবছর আগে। চারপাশের বাড়ি-ঘরের ভেতরে শুধুমাত্র পাগলার পুকুরটারই অস্তিত্ব আজো বিদ্যমান। বাকি সবই বদলে গেছে। পাগলার পুকুরের চারপাশের খালি জায়গাগুলো সব অদৃশ্য হয়ে সেখানে এখন বড়ো বড়ো ভবন দৃশ্যমান। পুকুরপাড়ের আশপাশের স্থাপনা থেকে শুরু করে রাস্তার একাংশ পর্যন্ত পালটে গেছে। ডেভলপারদের জাদুর ছোঁয়ায় পালটে গেছে প্রায় পুরো ময়মনসিংহ শহর। মুক্তি নেই পাগলার পুকুরেরও।

মাকড়শার জালের ভেতরে মাছি আটকে পড়লে মাকড়শা যেভাবে ধীরে-ধীরে তার প্রাণশক্তি চুষে ছোবড়া বানিয়ে ফেলে, ঠিক তেমনি মাকড়শার পায়ের মতোই অসংখ্য পাইপ গিয়ে ঢুকেছে পাগলার পুকুরের ভেতরে। এই পাইপগুলোই পুকুরের পানি টেনে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ফেলেছে তাকে। প্রায় পানিহীন পুকরের কাদাযুক্ত তলা দেখা যাচ্ছে এখন। পুকুরের পাড়ে অসংখ্য মানুষের ভিড়।

যখন কাজে নামে তখন বাশারের কাছে মনে হয় যেন রক্তের ভেতরে জোয়ার চলে আসে ওর। শরীরের ভেতরের শিরা-উপশিরা দিয়ে বানের স্রোতের মতো ছুটতে থাকে টগবগে রক্ত। বিগত কয়েকমাসের ব্যবধানে ওর নিজের ভেতরে এই অনুভূতিটা প্রায় লোপ পেতে বসেছিল। বহুদিন পর কাজে নেমে পুরনো সেই অনুভূতি যেন চাঙ্গা হয়ে উঠল। প্রতিবার কোনো মিশনে নামার আগে, কোনো কেস সলভ করার প্রাক-মুহূর্তে সেই একই উত্তেজনা, সেই একই অনুভূতি তাড়া করে ফেরে ওকে। চোখের ওপরে সানগ্লাসটাকে ঠিক করে কনস্টেবলদের নিয়ে ভিড় ঠেলে সামনে এগোল সে। আর ঠিক তখুনি চোখে পড়ল অদ্ভুত দৃশ্যটা।

পাগলার পুকুর ড্রেজিং করে প্রায় শুকিয়ে ফেলা হয়েছে। তলার কাদা দেখা যাচ্ছে। পুকুরের পাড়ে এক জায়গায় চালা তুলে কনস্ট্রাকশন কোম্পানির জিনিসপত্র রাখা হয়েছে। সেটার সামনেই বিরাট একটা ক্রেন-ট্রলি বসানো পুকুরপাড়ে। ক্রেনের সঙ্গে আটকানো একটা গাড়ি। গাড়িটাকে সম্ভবত পুকুরের তলা থেকে টেনে তোলা হয়েছে ক্রেন দিয়ে। কারণ ওটার সারাগায়ে কাদা লেগে একেবারে সাদাটে দেখাচ্ছে। দূর থেকে দেখে বোঝা গেল না গাড়িটার রং কালো নাকি সাদা। আধঝুলন্ত গাড়িটার একটা অংশ ক্রেনের সঙ্গে আটকানো, আর অন্য অংশটা পুকুর পাড়ের মাটি ছুঁয়ে আছে। গাড়িটার সামনের উইন্ডশিল্ড ফেটে মাকড়শার জালের মতো হয়ে আছে। কাদা আর শ্যাওলায় ছেয়ে আছে সম্পূর্ণ গাড়ি।

কনস্টেবলদের সঙ্গে বাশারকে দেখতে পেয়ে ওদের দিকে এগিয়ে এলো একজন, তার পেছনে আরো কয়েকজন। সবার সামনের দিকে থাকা লোকটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই লোকটাই এখানকার অবিসংবাদিত নেতা। লোকটাকে দেখা মাত্রই হাতের ছোট্ট পুলিশি লাঠির ডগা দিয়ে দিয়ে বাঁ হাতের আংটিটাতে একবার টোকা দিল বাশার।

যে মানুষটা এগিয়ে আসছে তার পরনে সাদা পাজামা, ধূসর রঙের পাঞ্জাবি। মাথায় এলোমেলো কাঁচা-পাকা চুল, চোখে গোল সিলভার রিমের চশমার আড়াল থেকে চোখজোড়া যেন ঘোলাটে আলোর টর্চ লাইটের মতো জ্বলছে। কানে একটা চ্যাপ্টা সোনার রিং চক-চক করছে। ছোটোবেলা থেকে নাম শুনলেও সাঈদ আলীকে কখনো দেখেনি বাশার। ও অনুমান করল, এই লোকটাই সাঈদ কন্ট্রাকটার। মানুষটা শুকনো হলেও ভুঁড়িটা তার বিরাট।

মানুষটা এই মুহূর্তে মুখে একটা কৃত্রিম হাসি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, হ্যান্ডশেইক করার ভঙ্গিতে বাড়িয়ে দিয়েছে একটা হাত। লোকটা কিছু বলার আগেই তার হাতটা ধরে জোরে একটা ঝাঁকি দিল বাশার।

‘আপনি নিশ্চয়ই কন্ট্রাকটার সাঈদ আলী?’ বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে জোরে একটা চাপ দিল ও।

‘জি, জি, ইন্সপেকটর সাহেব,’ বলে সে হাতটা বাশারের কবল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তার লোকদের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই কি করিস তোরা! ইন্সপেক্টর সাহেবের বসার জন্যে চেয়ার আন। এই, তুই যা ঠান্ডা নিয়ে আয়। ইন্সপেক্টর সাহেব, আপনারা এদিক দিয়া আসেন।’

ক্রেনের সঙ্গে লাগানো গাড়িটা এখন পুকুর পাড়ে নামিয়ে আনা হয়েছে। ওদেরকে পথ দেখিয়ে সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। গাড়িটার পাশ দিয়ে যেতে যেতে একবার ওটার দিকে তাকাল বাশার। ঘোলাটে কাদা আর সবুজ শ্যাওলায় ঢেকে আছে পুরো গাড়ি।

ওদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে যেতে ক্রমাগত কথা বলে চলেছে সাঈদ কন্ট্রাকটার। তার কথার তোড়ে গাড়িটার দিকে খুব একটা খেয়াল করতে পারল না বাশার। ওরা গাড়িটা পার হয়ে সামনে এগিয়ে গেল।

কনস্ট্রাকশনের কাজে ব্যবহারের জন্যে টিনের চালা দিয়ে ছোটো একটা ছাউনির মতো ফেলা হয়েছে। সেখানে পেতে রাখা হয়েছে কয়েকটা চেয়ার আর একটা টেবিল। ওদেরকে নিয়ে সেখানে বসানো হলো। বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পরিবেশন করা হলো কোল্ড ড্রিঙ্ক।

‘ইন্সপেক্টর সাহেব, নেন,’ সাঈদ আলী একটা গ্লাস এগিয়ে দিল ওর দিকে। ‘এই সামান্য ব্যাপারে আপনেরা না আসলেও চলত। আমি তো ওসিসাহেব মানে মল্লিক স্যাররে কল দিয়া না করতে চাইছিলাম। আসলে ব্যাপার হইছে কি, এইখানে অনেক রাজনীতি আছে। আমি এই জায়গাটার উন্নতি সাধন করতে চাইতেছি এইডা অনেকেরই ভালা লাগতাছে না। তাই ক্যামনে কাম বন্ধ করব সেই উছিলা খুঁজতাছে। আর বোঝেনই তো সব লাইনেই কম্পিটিশিন এহন বাইড়া গেছে। স্যার, নেন না। ঠান্ডা ছাইড়া দিবে তো।’

এদের অতিরিক্ত আদর-যত্ন ভালো লাগছে না বাশারের। ময়মনসিংহ শহরে সাঈদ কন্ট্রাকটার মানে একটা বিরাট ব্যাপার। সেই লোক তার মতো একজন ইন্সপেক্টরকে তেল মারছে কেন, সেটাও ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না ওর। কোল্ড ড্রিঙ্কসের গ্লাসে চুমুক না দিয়ে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো ও। সাঈদ কন্ট্রাকটার তড়-বড় করে কী জানি বলছিল সিগারেট ধরাতে ধরাতে, হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল বাশার।

‘সাঈদসাহেব, আপনি আগে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলুন তো।’

‘স্যার, পুরা ব্যাপারটা মানে?’

‘এই যে গাড়ির ব্যাপারটা। এটা কীভাবে খুঁজে পেলেন আপনারা? আর এটা এখানেই বা এলো কীভাবে? কার গাড়ি হতে পারে আপনার কোনো ধারণা আছে?’ বাশার ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে জানতে চাইল।

‘কার গাড়ি, এইনে কেমনে আইলো, সেইটা তো কইতে পারছি না; তবে আমরা এইডারে খুঁজে পাইলাম সেইটা বিস্তারিত কইতে পারি। আসলে বিস্তারিত কওনেরও দরকার নাই। ঘটনা সামান্যই। এই জায়গাডাতে কাজ করার জন্যে বহুদিন যাবৎ আমার কোম্পানি চেষ্টা করতেছিল কিন্তু সেইটা সম্ভব হইতেছিল না। অবশেষে আমরা যহন কাম শুরু করুনের প্রস্তুতি নিতাছি, তহনি ওই খাদেমের লোকেরা আমগো পিছে লাগল। কাম আর শুরু করতে পারতেছিলাম না।’

খাদেম ছলিমুল্লাহ নামে আরেকজন ডেভলপার আছে এই শহরে। সে-ও সাঈদ কন্ট্রাকটারদের মতোই প্রভাবশালী। দুই কোম্পানির ভেতরে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা, এটা বাশার জানে। ‘সাঈদসাহেব, এতকিছু শুনে আমার কাজ নেই। গাড়িটা কীভাবে পেলেন সেটা বলেন,’ বাশার সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পিষে দিল।

‘যাই হোক, হঠাৎ করে বাশার থামিয়ে দেওয়াতে সে কথার তাল হারিয়ে ফেলেছে। ‘মানে ঘটনাগুলা বলতেছিলাম যাতে আপনার বুঝতে সুবিধা হয়।’

লোকটা কি একটু নার্ভাস, মনে মনে ভাবল বাশার। এর মতো পোড় খাওয়া লোকের তো এরকম হবার কথা নয়।

‘তো কাইল রাইতে সব ঠিকঠাক কইরা আইজ সকাল থেইক্কা কাম শুরু করনের পরে পুকুরের পানি যখন কমতে শুরু করে প্রথমে আমার এক কর্মচারী দেহে পুকুরের তলায় কী জানি দেহা যাইতেছে। পানি আরেকটু নামার পরে দেহা গেল ওইটা একটা গাড়ি। আমি তখনো এইখানে আসি নাই। ফোনে কইলাম কেরেন দিয়া গাড়িটা টাইনা উড়ানির লাইগা। কেরেন দিয়া উড়াইতে গিয়া খবর ছড়ায়া গেল। কে জানি ওসিসাবরেও খবর পাঠায়া দিল। তো আমি এইহানে আইসা পৌছানির লগে-লগেই আপনেরা হাজির। কার গাড়ি, কে জানে। কেমনে আইয়া পড়ল সেইডাও তো বাইর করা সম্ভব না। গাড়ির অবস্থা দেইখা মনে হইতেছে অনেক আগে থাইক্কাই পইড়া ছিল এইহানে।

সাঈদ আলীর শেষ কথাটার সঙ্গে একমত হলো বাশার। এতক্ষণ যাবৎ সাঈদ কন্ট্রাক্টার কেন এরকম অসংলগ্ন আচরণ করছিল সেটার ব্যাপারেও খানিকটা ধারণা পেল ও।

এই ব্যাটা বহু কষ্টে এইরকম একটা দামি জায়গা বাগাতে পেরেছে। এখন কাজ শুরু করার পর একটা সামান্য ঘটনার কারণে পুরো ব্যাপারটা ভেস্তে যেতে পারে বলে ভয় পাচ্ছে সে। বাশারের কাছে মনে হলো ঘটনা আসলে খুব সামান্যই কিন্তু সাঈদ কন্ট্রাকটারের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো গ্রুপ এটাকেই বড়ো আকারে প্রচার করেছে। ওরাই সম্ভবত খবরটা থানায় পাঠিয়েছে। কারণ শুধু ওসি আর সাঈদ কন্ট্রাকটারের মাঝে থাকলে ব্যাপারটা তদারকি করার জন্যে ওসি ওকে পাঠাতো না। ও যখন এখানে এসেছিল তখন ভেবেছিল সাঈদ কন্ট্রাকটারের সঙ্গে একচোট ঝামেলা করবে, কিন্তু পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে তেমনটা করার আসলেই কোনো দরকার নেই।

‘সাঈদসাহেব, একটা ঘটনা যেহেতু ঘটে গেছে কাজেই ব্যাপারটা আমাদের তদন্ত করে দেখতেই হবে। তবে আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা তেমন কিছু না। আপনারা কাজ চালিয়ে যান। আমরা গাড়িটা সিজ করে নিয়ে যাচ্ছি। কার গাড়ি, কোত্থেকে এসেছে, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে।’

কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গে সাঈদের চেহারা অভিব্যক্তি মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করছিল বাশার। একইসঙ্গে দু-ধরনের অভিব্যক্তি খেলে গেল তার চেহারায়। বাশারের প্রথম কথাটা শুনে স্বস্তির আর দ্বিতীয় কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারায় ফুটে উঠল অস্বস্তি। ‘আরে স্যার, আপনেগো এত ঝামেলা করার দরকার কি? আর গাড়িটার যে অবস্থা তাতে এইডারে থানায় নিতে বহুত হাঙ্গামা পোহাইতে হইবে। তারচেয়ে যদি অনুমতি দেন তবে আমার লোকেরাই এইটারে পরিষ্কার কইরা বিকালের আগেই থানায় দিয়া আইবো।’

কন্ট্রাকটারের প্রস্তাব খারাপ না, তবে এই লোকটার কাছ থেকে কোনো অনুগ্রহ নিতে ইচ্ছে করছে না বাশারের। ও মানা করতে যাচ্ছিল, পাশ থেকে সেই বয়স্ক কনস্টেবল মৃদু স্বরে বলে উঠল, ‘স্যার, এইটুক কাম তারেই করতে দেন। সে আরো বড়ো কিছু করতেও রাজি ছিল। আপনি তো তার কাছ থেকে কোনো সুবিধাই আদায় করতে পারলেন না। আর আমগোর লগে এহন টো-ট্রেরাকও নাই। গাড়িটা ওরাই পৌঁছায়া দিয়া আসুক।’

কনস্টেবলের যুক্তি খারাপ না। ‘ঠিক আছে, সাঈদসাহেব। আপনারা কাজ চালিয়ে যান। আমরা যাই। তাহলে আপনিই ওটাকে পরিষ্কার করে বিকেলের ভেতরে থানায় পাঠিয়ে দিয়েন।’

‘অবশ্যই, স্যার।’

বাশার পুরো ব্যাপারটা টকিতে রিপোর্ট করতে করতে হাঁটতে লাগল। গাড়িটার কাছে এসে মুহূর্তের জন্যে থামলো ও। ওটার ওপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে রওনা দিল জিপের দিকে। ওর সঙ্গে সঙ্গে আসছে কনস্টেবলরা আর ওদের পেছনে সাঈদ কন্ট্রাকটার আর তার লোকেরা। রিপোর্ট শেষ করে টকিটা রেখে জিপে উঠতে গিয়ে নিজের ভেতরে অস্বস্তির একটা খোঁচা অনুভব করল বাশার। কী জানি একটা মিলছে না। কী জানি একটা দেখতে পেয়েছে সে যেটা ঠিক স্বাভাবিক মনে হয়নি ওর কাছে। জিপে উঠতে গিয়েও থেমে গিয়ে আবারো গাড়িটার দিকে এগোল ও।

গাড়ির সামনের উইন্ডশিল্ড শ্যাওলায় প্রায় ঢেকে আছে কিন্তু এর ফাঁক দিয়ে আবছাভাবে ভেতরে দেখা যাচ্ছে ভেতরটা। ভেতরে অস্বাভাবিক কী জানি একটা আছে। বাশার কাচের ওপরে হাতের ছড়িটার ডগা দিয়ে ডলা দিতে ওটা আরেকটু পরিষ্কার দেখতে পেলো। হলদে-সাদাটে কিছু একটা আছে ভেতরে।

‘অ্যাই, কেউ একজন গাড়ির দরজা খোলো,’ বাশার উপস্থিত লোকদের উদ্দেশ্যে নির্দেশ দিল। কেউ কোনো জবাব দিল না। .

কী হলো দরজা খুলতে বললাম না,’ সাঈদ কন্ট্রাকটারের লোকেরা সবাই চুপ। কন্ট্রাকটার নিজে এগিয়ে এসে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই ধমকে উঠল বাশার। ‘আপনি চুপ,’ বলে ও গাড়িটার দরজার একেবারে কাছে গিয়ে হাতের ছড়িটা দরজার সামান্য ফাঁক হয়ে থাকা ডালার ভেতরে ঢুকিয়ে চাপ দিল। দুই- তিনবার শক্ত চাপ দিতেই হেলে পড়ল ওটার দরজা।

দরজা খুলে যেতেই ভেতরে পরিষ্কার দেখা গেল একজন মানুষের কঙ্কাল। বাশার মাথা নিচু করে উঁকি দিল ভেতরে। শ্যাওলা-কাদায় অনেক জায়গা ঢেকে থাকলেও ওটা যে একজন মানুষের দেহাবশেষ এব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *