অধ্যায় এগারো – বর্তমান সময়
শানকিপাড়া শেষমোড়, ময়মনসিংহ
‘আবদুল্লাহ, গাড়ি থামাও,’ হঠাৎই বলে উঠল বাশার। রাস্তার এই জায়গাটা আশ্চর্যজনকভাবে বেশ ফাঁকাই ছিল। তাই প্রায় অক্লেশেই জিপটাকে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে ফেলল আবদুল্লাহ।
বেলা এখন পড়তির দিকে। মধ্য দুপুরের ঝাঁঝালো ভাবটা একটু কমে গিয়ে সূর্য একটু পরেই বিকেলের দিকে গড়াতে শুরু করবে। এই সময়টা হলো দিনের এমন একটা সময় যখন সবকিছু স্থবির হয়ে যায়। কোনো কাজ করতে ইচ্ছে করে না। বরং দুপুরের খাবার পর বেশ ঘুম-ঘুম একটা অলস ভাব বিরাজমান থাকে চারপাশে। তাই মনে হয় এই সময়টাকে বলা হয়ে থাকে ভাত ঘুমের সময়।
বাশারদের জিপটা নতুন বাজার থেকে কোতয়ালি থানার দিকে রওনা দিয়েছে একটু আগে। গাঙ্গিনাপাড়ের কাছাকাছি এসে জ্যামে বসে আছে। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে অস্থির হয়ে বারবার হাতের ছোটো লাঠিটা দিয়ে বাঁ হাতের আংটিটাতে মৃদু বাড়ি মারছে বাশার। লাঠিটার ডগায় লাগানো সামান্য স্টিলের পাতের সঙ্গে আংটির ধাতব শরীরের সংঘর্ষে নির্দিষ্ট একটা বিরতি দিয়ে টুঙ-টুঙ- টুঙ করে শব্দ হচ্ছে একটু পর পর।
বাশারের অবশ্য এসবে খেয়াল নেই। সে ডুবে আছে নিজের ভাবনার জগতে। ডক্টর মনিকার কাছে পুরো ব্যাপারটা শোনার পর থেকে কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছে ওর ভেতরে।
প্রথমে মনে হচ্ছিল গাড়ির ভেতরে থাকা লোকটা অ্যাক্সিডেন্ট করে হয়তো গাড়ি নিয়ে পড়ে গেছিল পুকুরের ভেতরে। কিন্তু ডক্টর মনিকার কথা শুনে মনে হচ্ছে এমনও হতে পারে লোকটাকে মেরে গাড়িসহ তাকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল পুকুরের তলায়। কিন্তু এত জায়গা থাকতে এই পুকুরের তলা কেন? তারমানে কি কোনোভাবে এই ঘটনার সঙ্গে এই পুকুরের মালিক পক্ষ জড়িত? কিন্তু এই ব্যাপারটাও মেলে না। কারণ একটু আগে ডক্টর মনিকার সঙ্গে কথা শেষ করে সে আবারো ফিরে যায় টমি আর আশরাফের সঙ্গে কথা বলতে। যে ব্যাপারটা ও জানতে চাচ্ছিল সেটা হলো, গাড়িটাতে কোনো ধরনের বড়ো আঘাতের চিহ্ন আছে কিনা। ও আসলে বুঝতে চাইছিল গাড়িটা কীভাবে পানিতে পড়েছে, অ্যাক্সিডেন্ট করে নাকি কোনোভাবে ওটাকে জোর করে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
দুজনেই একবাক্যে একই জবাব দেয়, ওটার সামনের ডানপাশের দরজার একটু সামনে ইঞ্জিনের ঠিক পাশে দিয়েই গাড়ির বডি অনেকখানি তুবড়ে যাবার একটা আলামত আছে। টমি ওকে নিশ্চিত করে বলেছে গাড়িটা অ্যাক্সিডেন্ট করেই পানিতে পড়েছিল।
বাশার ভাবছে যদি টমির কথা ঠিক হয় তবে গাড়িটা অ্যাক্সিডেন্ট করে পানিতে পড়েছে। অন্যদিকে যদি ডক্টর মনিকার কথা ঠিক হয় তবে লোকটাকে গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে পানিতে ফেলা হয়েছে। দুটো ব্যাপার ঠিক মিলছে না। কারণ তাকে কেউ মেরে ফেলে থাকলে সেটা অ্যাক্সিডেন্ট হবার কথা নয়। অন্যদিকে তাকে মেরে পানিতে ফেলা হলে সেক্ষেত্রে যে মেরেছে তারও সঙ্গে সঙ্গে পানিতে পড়ে যাবার কথা, কিন্তু সেটাও হয়নি। তবে সবকিছুর ওপরে প্রশ্ন হলো, একজন সাদা চামড়ার মানুষ আজ থেকে এত বছর আগে ময়মনসিংহ শহরে এসে কী এমন করল যে শেষ পর্যন্ত তার স্থান হলো পুকুরের তলায়? ব্যাপারটা যথেষ্ট ঘোলাটে। যদি ডক্টর মনিকা তার ডাটাবেজ থেকে লোকটার চেহারা আর পরিচয় উদ্ধার করতে পারে তবে অনেক কিছু বোঝা যেতে পারে। তবে ডক্টর মণিকার কাছ থেকে কিছু পেতে সময় লাগবে। এর মধ্যে ওর অন্যকাজ করতে হবে।
‘স্যার, গাড়ি তো থামাইলাম, কিছু বলতেছেন না যে, আবদুল্লাহ একবার রমিজ দারোগার দিকে তাকিয়ে দ্বিধার সঙ্গে বলে উঠল
‘গাড়ি ঘোরাও। শানকি পাড়া শেষ মোড়ে চলো।
ওর দিকে তাকিয়ে একবার মাথা ঝাঁকিয়ে গাড়ি ঘোরানোর উদ্যোগ নিতে লাগল আবদুল্লাহ।
‘স্যার, অহন আবার হেনু যাবাইন। ওসি স্যারে তো…’ রমিজ দারোগাকে কথা শেষ করতে দিল না বাশার। একটা আঙুল তুলে তাকে থামিয়ে দিল। ও খারাপ অবস্থানে থাকতে পারে তবে ওসির চাকর না। ওকে ওর মতো কাজ করতে হবে। কারণ মাথায় একটা পরিকল্পনা এসেছে। ওকে ঘটনাস্থলটা আরেকবার দেখতে হবে। এর আগের অভিজ্ঞতা থেকে ও জানে জায়গামতো গেলে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যায় অনেক সময়।
***
‘কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না,’ কথাটা আনমনেই বলে উঠল বাশার। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলো। শেষ বিকেলের দিকে রোদ অনেকসময় খুব কড়া হয়ে ওঠে, ওরকমই কড়া রোদের ভেতরে দাঁড়িয়ে সামনের পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছে ও। একসময়ের চমৎকার গভীর রূপালি পানির পুকুরটা এখন মড়া লাশের মতো পড়ে আছে।
ছোটোবেলা থেকে দেখে আসা আগের সেই সুন্দর রূপালি পানিতে ভরা পুকুরটা আর আজকের এই আধা শুকনো কাদায় ভরা নোংরা পুকুরটার ভেতরে কত পার্থক্য। মানুষ আসলে এমন এক প্রাণি যে সবকিছুকেই ধ্বংস করতে চায়। এর বিনিময়ে সে যে আসলে কী চায় নিজেও জানে না।
বাশার এখানে এসেছিল একটা পরিকল্পনা নিয়ে কিন্তু এসে তেমন একটা লাভ হয়নি। এখানে আসার আগে একবার ভেবেছিল সাঈদ আলীর লোকদের নিয়ে কোনো ভয় আছে কি না, কিন্তু পুকুর পাড়ে এসে ওদের কাউকে সে দেখতেই পায়নি। প্রাণহীন অর্ধ-শুকনো কাদাটে পুকুরটা পড়ে আছে মরা লাশের মতো। ওটার কিনারায় ড্রেজিং মেশিন থেকে শুরু করে কনস্ট্রাকশনের অনেক জিনিসপত্র ছড়িয়ে আছে। ওগুলো সহই পুলিশ সিল করা হয়েছিল পুরো এলাকা। তদন্ত সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এই সিল খোলা হবে না। গাড়িটা রাস্তার পাশে পার্ক করে আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগাকে ওখানেই অপেক্ষা করতে বলে ও চলে আসে পুকুর পাড়ে। চোখের দৃষ্টিতে একবার রাস্তাটা দেখে আরেকবার মাপ-জোখ করতে শুরু করে ও।
পুকুরের ঠিক কোন জায়গা থেকে গাড়িটা উদ্ধার করা হয়েছে ও জানে না। তবে ও দুটো ব্যাপার আন্দাজ করার চেষ্টা করল। অবশ্যই গাড়িটা মূল রাস্তা ধরে এসেছিল, তারপর যেকোনোভাবেই হোক সেটা পুকুরে পড়ে যায়। তারমানে গাড়িটা সম্ভাব্য দুটো দিক থেকে আসতে পারে। ও যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে হয় ডান দিক থেকে, অথবা বাঁ দিক থেকে। যদি ডান দিক থেকে এসে থাকে তবে সেটা বাঁয়ে ঘুরে পানিতে পড়েছে আর যদি বাঁ দিক থেকে এসে থাকে তবে সেটা ডানে ঘুরে পড়েছে।
তবে বাশার অনুমান করল গাড়িটা বাঁ দিক থেকে আসার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ বাঁয়ে এলে শহর থেকে এসে মূল হাইওয়েতে বেরিয়ে যাবার জন্যে সুবিধে হবে। মনে হয় গাড়িটা মূল হাইওয়েতে উঠতে চাচ্ছিল। প্রশ্ন হলো, ওটা পানিতে পড়ল কীভাবে। আর গাড়ির আরোহীকে যদি খুন করে ফেলা হয়ে থাকে তবে হয় কেউ সেটাকে ইচ্ছে করেই ফেলেছে আর না হয় সে নিজেও ওটার সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যাবার কথা।
কিন্তু এখানে মাপ-জোখ করে অবশ্য খুব বেশি কিছু বোঝা সম্ভব নয়। জিপের দিকে এগিয়ে গেল ও।
‘স্যার, কিছু পাইলেন?’ ওকে ঘর্মাক্ত অবস্থায় ফিরে আসতে দেখে আবদুল্লাহ জানতে চাইল।
‘না রে, হুদাহুদি কষ্ট,’ ওর জবাব শুনে কিছু না বলে খিক করে হেসে উঠল রমিজ দারোগা। তার ভাবটা অনেকটা এরকম : আমি তো আগেই কইছিলাম।
তাকে কড়া ভাষায় কিছু একটা বলার জন্যে মাথা ঘোরালো বাশার, কিন্তু তাকে কিছু বলার আগেই রাস্তার অন্যপাশের একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ওপরে দৃষ্টি আটকে গেল ওর। আচ্ছা এই দোকানটা তো বেশ পুরনো। দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে দেখা যেতে পারে কিছু পাওয়া যায় কিনা। ও আবারো রাস্তাপার হয়ে চলে এলো অন্যপাশে। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মনে পড়ল ছোটোবেলায় জিলা স্কুলে পড়ার সময়ে এই দোকানটা ছিল ওর অন্যতম প্রিয় একটা দোকান। কারণ এখানে বিভিন্ন ধরনের স্টিকার পাওয়া যেতো। ছোটোবেলায় ওর প্রিয় শখ ছিল স্টিকার সংগ্রহ করা আর এই দোকানটাতে রবিন হুড, সিন্দাবাদ, হারকিউলিস থেকে শুরু করে মোগলি পর্যন্ত এমন কোনো স্টিকার নেই যা পাওয়া যেতো না।
পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতে করতেই ভেতরে প্রবেশ করল ও। আগে দোকান ছিল অনেক ছোটো। আর আগের তুলনায় এখন অনেক বড়ো হয়েছে। দোকানটাকে এখন মুদি দোকান বলা যাবে না বরং অনেকটা ছোটো আকারের সুপারশপের মতো দেখাচ্ছে। ভেতরে ঢুকে ও মনে মনে আগের চেহারাগুলো খুঁজলেও সেরকম কাউকে পেল না। ওকে দেখে একটা ছোটো ছেলে এগিয়ে এসে জানতে চাইলকী দরকার ওর। ও জানাল মালিকের সঙ্গে কথা বলতে চায়। ছেলেটা ওকে কাউন্টারে নিয়ে গেল।
কালো শার্ট গায়ে মোটাসোটা এক লোক বসে আছে কাউন্টারে। একটা ছেলে ক্রেট থেকে মাল নামিয়ে গুছিয়ে রাখছিল তাকে নির্দেশনা দিচ্ছিল মোটু, ওকে দেখে সেটা থামিয়ে তাকিয়ে রইল। চোখে প্রশ্ন। বাশার এগিয়ে গেল তার দিকে।
‘আমি দোকানের মালিকের সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।’
‘বলেন, আমিই মালিক,’ বলে সে আবারো ছেলেটাকে নির্দেশনা দিতে লাগল।
‘না মানে, এখানে একজন চাচা বসতেন উনি নেই?’
কথাটা শুনে ওকে আরেকবার ভালো করে দেখল সে। ‘না, উনি মারা গেছে আইজ পাঁচ বছরের উপরে।’
‘ওহ তো, আচ্ছা চাচার একজন ছেলে ছিল, চিকন করে লম্বা। রুবেল নাম। উনিও নেই?’
মোটু একটু অবাক হয়ে ফিরে তাকাল বাশারের দিকে। ‘আপনে কেডা, কইনছেন দেহি। এত কতা জিগান কে? দরকার কী, হেউডা বলেন। আমিই রুবেল।
‘কী?’ এবার চমকানোর পালা বাশারের। সেই চিকন লম্বা সিল্কি চুলের হাসিখুশি ছেলেটাকে কোনোভাবে গোমড়া মুখের এই মোটুর সঙ্গে মেলাতে পারল না ও।
সময় মানুষকে কীভাবে বদলে দেয় মানুষ নিজে যদি সেটা টের পেত!
‘রুবেল, আমি বাশার। কলেজ রোডে থাকতাম, জামিলদের বন্ধু। নীল রঙের একটা সাইকেলে আসতাম, স্টিকার কিনতাম তোমার কাছ থেকে। মাঝে মাঝে তোমার আব্বারে না বইলা বাকি দিতা আমারে, মনে নাই?’
এবার মোটু হাঁ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। সম্ভবত পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করার চেষ্টা করছে সে। ‘আরে তুমি তুমি, হ হ চিনছি। এইহানে আইসা মাঝে মধ্যে ব্যাডমিন্টন খেলতা। মিল্লাতগর লগে বিরাট মারামারি হইছিল একবার তুমগর। ঠিক?’
স্বস্তির হাসি হাসল বাশার। ‘হুম, এই তো চিনতে পারছ।’
‘সর্বনাশ, কত বছর পরে, এই পিচ্চি চেয়ার দে। আর একটা ঠান্ডা আইন্না দে। হায় হায় কতদিন পরে। তুমি সেই যে মমিসিং ছাড়লা আর দেখলামই না। তুমি তো দেহি পুরা বদলাইয়া গেছ। হা হা।’
মোটুর অবয়বের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে হাসছে বাশার। সম্ভবত ওর মনের ভাবনা বুঝতে পেরে মোটুও হেসে উঠল। ‘হ, অনেক মুডা অই গেছি। একসময় মনে করতাম কেমনে মুডা অমু কেমনে মুডা অমু। আর যহন মুডা অউন শুরু অইলো। আর কি কমু। তা তুমার খবর কি কউ। তুমি কি পুলিশে আছোনি?
‘হ্যাঁ, এখানে একটা কাজে এসেছিলাম, একটু আগে দেখা দুই পিচ্চির একজন ওর হাতে একটা কোকের বোতল ধরিয়ে দিল। স্ট্রটা সরিয়ে বোতলে চুমুক দিল ও। ‘ওই পুকুরটা যে ভরাট করতে যাচ্ছিল সাঈদ কন্ট্রাকটারের লোকেরা।’
‘ভরাট আর করতে পারল কই। অইডা লইয়া তো মহা কেলেঙ্কারি। পুস্কুনির ভেতরে নাকি একটা গাড়ি পাইছে, হেই গাড়ির ভেতরে নাকি লাশ আছিল। এক পুলিশে নাহি কাম বন্ধ কইরা দিছে সাঈদ কন্ট্রাকটার তো মহা খাপ্পা। এই জমি হের বহুদিনের স্বপ্নের জমি। এত কষ্ট কইরা পাউনের পরে এইরম অবো হেয় তো ভাবতেও পারে নাই। হেয় নাকি ঠিক করছে যারা এইডা বন্ধ করছে হেই পুলিশরে দেইখা লবো।’
‘হা-হা, সেই পুলিশটা আমিই।’
‘কউকি, তুমি এট্টু সাবধানে থাইক্কো। হেই ব্যাডার কিন্তু সবখানে নিজের লুক আছে। পুলিশের ভেতরেও,’ বলে সে কাউন্টারের নিচ থেকে একটা বেনসন সিগারেটের প্যাকেট বের করল। চোরের মতো আশপাশে একবার দেখে নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘খাও নাকি? তুমি তো কলেজে থাকতে সিগারেট খোরগো দুই চক্ষে দেখতে পারতা না।’
‘এখন খাই,’ বলে খুলে ধরা প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগাল বাশার।
আবারো একবার দুইপাশে দেখে নিলো রুবেল। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলল, ‘গেল বছর হার্টে একটা ব্লক ধরা পড়ছিল, হের পর থাইক্কা চুমকির মায়ে কঠিন নিষেধ কইরা দিছে। এহন খাইতে দেখলে খবর আছে,’ বলে ঠোঁটে ধরা সিগারেটে আগুন লাগিয়ে আগুনটা বাড়িয়ে দিল ওর দিকে।
ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মনে মনে বাশার ভাবল চুমকি নিশ্চয়ই রুবেলের মেয়ে। ওর বন্ধু-বান্ধব সবাই বিয়ে করে বাচ্চা-কাচ্চার বাপ হয়ে বেশিরভাগই সুখী, আর ও কিনা এখনো সব থাকার পরও বাউন্ডুলের মতো জীবন-যাপন করছে। আনমনেই নিজের হাত চলে গেল বাঁ হাতের আংটিটায়। ওটা ধরে মৃদু নাড়া দিয়ে কাজের কথায় ফিরে আসার চেষ্টা করল ও। ‘আচ্ছা রুবেল, আমাকে একটা ব্যাপারে তথ্য দিতে পারবে?’
‘কী বিষয়ে? কউ দেহি,’ সে এমনভাবে ধোঁয়া ছাড়ছে দেখে মনে হচ্ছে অনেকদিন অভুক্ত থাকার পর হঠাৎ করে চরম সুস্বাদু কোনো খাবার তুলে দেওয়া হয়েছে তার মুখে।
তুমি তো বহুবছর ধরে এখানেই আছো?’
‘বহু বছর না, জন্মের পর থেইক্কা আমি এইহানেই আছি। মনে হয় বাকি জীবনও এইহানেই থাকা লাগবো,’ বলে সে হো হো করে হেসে উঠল।
‘তাহলে হয়তো তুমি কোনো-না-কোনোভাবে আমাকে সাহায্য করতে পারতে পারবা। এই পুকুরটা তো একেবারে তোমার দোকানের সামনেই। যে গাড়িটা এটার নিচে পাওয়া গেছে এইটার ব্যাপারে কখনো কিছু শুনছিলা বা তোমার নজরে আসছিল নাকি?’
রুবেল একটু ভেবে বলল, ‘নাহ, কুনো সময়ই তো এই বিষয়ে কিছু শুনি নাই। বা কিছু দেহিও নাই। সাঈদ কন্ট্রাকটার যার কাছ থেইকা এই জায়গা কিনছে, সেই ছেলের বাপে আছিল এর আসল মালিক। হেই চাচা বদমেজাজি লুক আছিল। আমার সঙ্গে সম্পর্ক ভালা আছিল না। তয় সে লুক খারাপ ছিল না। হেয় এইরকম কিছু করার কথা না।’
‘আমাদের অ্যানালাইসিস থেকে একটা ধারণা পেয়েছি আজ থেকে প্রায় এগারো বছর আগে এই ঘটনাটা ঘটেছিল। ওই সময়ে এই এলাকায় কিংবা এই পুকুরের আশপাশে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছিল বলে তোমার মনে পড়ে?’
রুবেল প্রায় শেষ হয়ে আসা সিগারেটের মোথাটা ছুড়ে ফেলে দিল বাইরে। ‘আইজ থাইক্কা এগারো বছর আগে। এগারো বছর আগে ওই সময়ে আব্বা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়াতে আমাদের ভাইদের ভেতরে জমি-জমা ভাগ করে দেয়। আমার ভাগে পড়ে এই দোকান। ওই বছরই আমি এই দোকানে নিজের ব্যবসা শুরু করি। আমি তখন সবেমাত্র দোকানের ভার নিজে নিলাম। বইনের বিয়া…নাহ তেমন কিছু মনে পড়তাছে না।’
রুবেলের জবাবে একটু হতাশ হয়ে পড়েছে বাশার। এমন সময় আবারো বলে উঠল রুবেল। ‘আমি না পারলেও কলিম চাচা পারতে পারে। হেয় বহু বছর এই এলাকার পাহারাদার আছিল। এহন বুড়া অইয়া যাওয়াতে আর কাম-কাইজ করে না। একটা ছেলে বিদেশ থাকে, হেয় টেহা পাড়ায়, হের টেহায় চলে।’
‘লোকটা থাকে কোথায়?’
‘এইহানেই থাকে। তুমি বও। আমি তারে ডাকায়া আনানোর ব্যবস্থা করতাছি। এই আকবর, আকবর, এদিকে আয়,’ বলে সে দোকানের একটা ছেলেকে ডেকে বুঝিয়ে দিল কাকে ডেকে আনতে হবে।’
‘বেশি দেরি হবে?’ বাশার জানতে চাইল।
‘আরে নাহ। এই দুই বাড়ি পরেই থাকে হেয়। কাম-কাইজ নাই, কতা কউনের সুযোগ পাইলে খুশিই অইবো।’
মুখে যতই বলুক বাশারের ধারণা ছিল অন্তত এক ঘণ্টা না হলেও চল্লিশ- পঁয়তাল্লিশ মিনিটের আগে লোকটা আসবে বলে মনে হয় না। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে মাত্র পনেরো মিনিটের মাথায় নীল রঙের লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্জাবি পরা বয়স্ক এক লোক এসে হাজির হলো আকবরের সঙ্গে। এধরনের পেশার লোকজন-যেমন রিকশাওয়ালা, ভ্যান চালক, নাইট গার্ড—যখন আর কাজ করতে পারে না তখন এদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। ছেলেমেয়েরা দেখাশোনা করে না, কাজও করতে পারে না। তবে এই লোককে দেখে সেরকম মনে হচ্ছে না। তার পরিষ্কার পলেস্টারের পাঞ্জাবি আর মাথার তেল দেওয়া চুল দেখেই বোঝা যাচ্ছে বিদেশ থেকে ছেলে তাকে ভালো টাকাই পাঠায়। ওদেরকে দেখতে পেয়ে সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল মানুষটা।
কলিম চাচা, ও আমার বন্ধু। আপনারে কিছু জিজ্ঞাস করব। আপনি জানলে উত্তর দিবাইন,’ রুবেল বুড়ো মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল
‘কুনো সমইস্যা অইছে নি, বাবা? আমি বুড়া মানুষ …’
‘না চাচা, কোনো সমস্যা হয়নি। আপনার কাছে একটা ব্যাপারে একটু জানতে চাচ্ছিলাম। বসেন না,’ বলে ও রুবেলের দিকে তাকাতেই রুবেল দোকানের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে একটা হাঁক ছাড়ল।
‘এই চাচারে একটা টুল আইন্না দে, ওর হাঁক শুনে নুরু আকবর দৌড়ি গিয়ে একটা টুল এনে দিল বুড়ো দারোয়ানকে।
‘আচ্ছা আপনি তো দীর্ঘদিন এই এলাকাতে পাহারাদার ছিলেন। কতদিন হতে পারে?’
‘তা পরায় চল্লিশ বছরের উপরে তো অইবোই,’ লোকটা একটু ভেবে বলল। ‘সংগ্রামের কয়েক বছর পর থাইক্কাই আমি এই হানে আছি।’
‘ওরে বাপরে! আমাদের এত বছর দরকার নেই। আমি আপনার কাছে মোটামুটি এগারো বছর আগের একটা ঘটনা জানতে চাইবো। ঠিক ঘটনা বললে ভুল হবে। আপনি একটু ভেবে বলেন তো আজ থেকে এগারো বছর আগে এই এলাকায় কিংবা এই রাস্তায় অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা ঘটেছিল কিনা। কোনো তাড়াহুড়া নেই। ভাবেন, ভেবে বলেন।’
‘বাপজান, কীরকম ঘটনা ঠিক বুজতে পারলাম না।‘
‘আসলে আমি আপনাকে কী বোঝাবো, নিজেই তো বুঝতে পারছি না ঠিক কী জানতে চাইবো আপনার কাছে। আসলে আমি যেটা জানতে চাচ্ছি এগারো বছর আগে আপনি তো নিয়মিত ডিউটি করতেন ঠিক কিনা?’
‘হ।’
‘আপনার ডিউটিকালীন সময়ে এই রাস্তায় কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছিল বলে আপনার মনে পড়ে? আপনাকে খুলেই বলি। আপনি তো জানেন কয়েকদিন আগে এই পুকুরের নিচে একটা গাড়ি খুঁজে পাওয়া গেছে যেটার ভেতরে আবার একটা লাশও ছিল। আমরা ধারণা করছি এই গাড়িটা আজ থেকে এগারো বছর আগে কোনো এক সময় এই পুকুরের নিচে, এই পর্যন্ত বলে ও একটু থেমে গেল। কী বলবে পুকুরের নিচে গাড়িটা কীভাবে গেছে, সেটা তো জানে না। ‘মানে পুকুরের তলায় পাওয়া গেছে। তাই আমি জানতে চাচ্ছি ওই সময়ে কোনোদিন রাতে বা দিনে এই এলাকায় বা রাস্তায় বা পুকুরের আশপাশে আপনার কোনো অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েছিল কি না?’
‘এগারো বছর, এগারো বছর,’ লোকটা ভাবছে আর তার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাশার।
‘বাপজান এই বয়সে কাইল রাইতের গটনা মনে থাহে না। এত আগের কতা কেমনে কমু,’ বুড়োর মুখে অসহায়ত্বের হাসি।
‘হুম,’ এটাই স্বাভাবিক, মনে মনে ভাবল বাশার। আচ্ছা কি আর করা, তাও চেষ্টা করে দেখেন যদি মনে পড়ে।
‘আমি আপনেরে সাহাইয্য করি,’ এতক্ষণ ধরে মোবাইল টিপছিল রুবেল হঠাৎ সে মোবাইল থেকে চোখ তুলে বলে উঠল। বাশার ওর মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল ওতে ক্যালেন্ডার ওপেন করে রাখা। ও অনুমান করল রুবেল সম্ভবত এতক্ষণ মোবাইলে ক্যালেন্ডার দেখছিল। ‘ওই বছরই আমি নিজে এই দুকান শুরু করি। মানে আব্বা আমগো ব্যবসা বুঝায়া দিল। এইটা অবশ্য আপনের জানার কতা না। আরে, ওই বছরই তো মিলি আপার বিয়া অইলো। আপনের উপরে খাবারের দায়িত্ব আছিল। মনে নাই আপনের?’
‘হ হ, বিয়ার কতা মনে পড়ছে। লাইট-মাইট সব লাগানের পরে কারেন্ট গেল গা। হেউডা লইয়া তুমার আব্বা কী খেপা।’
‘হ, কারেন্টের খাম্বা ভাইঙ্গা ট্রান্সমিটার নষ্ট অইয়া তিনদিন কারেন্ট নাই। বিয়া বাড়িত কারেন্ট নাই, কী এক বিপদ! আপনেরে দিয়াই তো জেনারেটর ভাড়া কইরা আনাঅইলো।’
কিন্তু রুবেলের শেষ কথাটা লোকটা শোনেনি, সে মনোযোগ দিয়ে কী জানি একটা ভাবছিল, হঠাৎ বাশারের দিকে মুখ তুলে বলে উঠল, ‘বাবা, ওর বড়ো বইনের বিয়ার কথায় একটা ব্যাপার মনে অইলো। ওর বইনের বিয়ারে লাইগা লাইট-মাইট দিয়া বাড়ি সাজানি অইছিল। কিন্তু ওইদিন রাইতেই একটা কারেন্টের খাম্বা ভাইঙ্গা ট্রান্সমিটার নিচে পইরা যায়। এরপরে তিনদিন কারেন্ট আছিল না।’
‘হ্যাঁ, সেটা তো শুনলাম,’ লোকটা একইকথা রিপিট করায় বাশার একটু বিরক্ত।
‘যেদিন রাইতে খাম্বা ভাঙে ওইদিন অন্যরহম একটা ব্যাপার ঘটছিল। আমিতো এমনে রাস্তায় ডিউটি করি। ওইদিন রুবেলের বইনের বিয়ার লাইগা ওর আব্বা কইছিল বাড়ির উপরেও নজর রাখতে। কারণ বিয়া বাড়ি চুর-মুর আইলে তো বিপদ। তো রাস্তাত ডিউটি দিয়া ওগোর বাড়ির গলির ভেতরে ডুকছি সব ঠিক আছে কি না দেহুনের লাইগা, হঠাৎ শুনি বিকট শব্দ। দৌড়ায়া গলি থাইক্কা বাইর অইতাছি এমন সময় মনে অইলো পানিত কী জানি পরুনের শব্দ পাইলাম। দৌড়ায়া গলি থাইক্কা বাইর ওয়ুনের আগেই পুরা এলাকা আন্ধার অইয়া গেল। লাইট জ্বালায়া বাইর অইয়া দেহি ওইহানে আগে একটা খাম্বা আছিল,’ সে রাস্তায় একটা জায়গা নির্দেশ করল।
‘অনেক পুরান, জং ধরা খাম্বা। আমি বাইর অইয়া দেহি হেই খাম্বা পুরা কাইত অইয়া রাস্তার ওপরে পইরা আছে। হেইডার উপরের ছুডো একটা ট্রান্সমিটার মাডিত পইরা ভাইঙ্গা গুড়া-গুড়া। হেইডাতে আগুন জ্বলতাছে। তহন তো ওইডা লইয়া ব্যস্ত অইয়া গেলাম। লুকজনের দৌড়াদৌড়িতে খেয়াল করতে পারি নাই তয় একবার পুস্কুনির দিকে লাইট মারছিলাম দেহি পানিত বড়ো ঢিল মারলে যেরম লড়াচড়া অয় ওইরম কিছু একটা। এরপরে আমি কয়েকজনরে কইছি এই পানির কতা, কেউ বিশ্বাস করে নাই। পরে আমিও বুইল্লা গেছিলাম, অহন মনে পড়ল।’
পুরো ব্যাপারটা মনোযোগ দিয়ে শুনল বাশার। লোকটার কথা শেষ হতেই মনে মনে হিসেব করতে শুরু করল ও।
তারমানে ডিভিশনের অ্যানালাইসিস আর এই দারোয়ানের কথা যদি ও একসঙ্গে করে তবে ব্যাপারটা দাঁড়ায় আজ থেকে এগারো বছর আগে কোনো এক সময় রাতের বেলা এখানে একটা গাড়ি রাস্তার পাশের ইলেকট্রিক পোলের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে পোলটাকে ভেঙে দিয়ে পানিতে পড়ে যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, তবে গাড়ির লোকটাকে খুন করল কে। তাও আবার গলায় ফাঁস দিয়ে। নাকি ওই লোকটাই আহত অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে পোলের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে পুকুরের পানিতে পড়ে গেছিল। দ্বিতীয়টা হবার সম্ভবনাই বেশি। এখন খোঁজ লাগাতে হবে এগারো বছর আগে ওই সময় কী ঘটেছিল। তবে তার আগে তারিখটা বের করতে হবে।
‘রুবেল তুমি কি আমাকে ওই ঘটনার তারিখটা বের করে দিতে পারবে?’
‘কী কও, পাইতাম না ক্যা? খারাউ মিলি আপারে একটা কল দিয়া হের বিয়ার তারিখটা জানলেই অইবো,’ বলে সে হাতে ধরা মোবাইলটা নিয়ে ডায়াল করতে লাগল।
একটু পরে হাতে একটা চিরকুটে তারিখটা লিখে, সে রুবেল আর কলিম চাচা দুজনকেই ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলো দোকানের ভেতর থেকে। এটা একটা বিরাট অগ্রগতি। ও ঘটনার তারিখ ও সম্ভাব্য সময়টা বের করতে পেরেছে। এবার দেখতে হবে কী ঘটেছিল ওই সময়ে। সেইসঙ্গে ওই সময়ে ময়মনসিংহ শহরে অবস্থানরত সমস্ত বিদেশি লোকজনের ব্যাপারেও খোঁজ নিতে হবে।
সময়টা বিকেলের শেষ ভাগ হলেও গ্রীষ্মের সূর্য তার শেষ দাপট দেখাচ্ছে। রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে কোমর থেকে টকিটা বের করে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হতে লাগল ও। কথা নেই বার্তা নেই আরেকটু হলেই বাঁ দিক থেকে ধেয়ে আসা ট্রাকটা পিষে দিত ওকে, চালক হর্ন না বাজালে সম্ভবত তাই হতো।
চমকে উঠে একটু পিছিয়ে এলো বাশার। ট্রাকটা চলে গেল তবে অপসৃয়মান ট্রাকটার দিকে দৃষ্টি পড়তেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল বাশারের। সেই একই স্মৃতি সেই একই দৃশ্য যেন উঠে এলো স্মৃতির অতল থেকে। এইরকমই একটা ট্রাক ছিল ওটা। তীব্র যন্ত্রণার সঙ্গে ও অনুভব করল চারপাশের রোদেলা আবহাওয়া বদলে গিয়ে যেন ঢল বৃষ্টি নেমে এসেছে। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল সবকিছু। শরীরটা আর নিজের নিয়ন্ত্রণের ভেতরে নেই। হঠাৎ করেই যেন পাকা রাস্তাটা উঠে এলো উপরে।
আসলে বাশারই জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ল রাস্তার ওপরে।