০৬.
বাড়ি ফিরে আসতেই যোয়ানা বলল, মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ এতক্ষণ বকবক করে গেলেন। মহিলাকে আমার পাগল বলেই মনে হয়, জানিস?
–কেন, কি বলে গেলেন তিনি? আমি জানতে চাইলাম।
–বলতে চাইলেন, মিসেস সিমিংটন স্বার্থপর আর বকাটে ধরনের মহিলা ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ ভয় পাওয়ার মতো মোটেই ছিলেন না। তার ধারণা এখানে এমন কেউ একজন রয়েছে, যে ভয়ঙ্কর রকমের অসুখী। সেই এসব চিঠির মাধ্যমে মনের বিষ ছড়িয়ে চলেছে। আর সেই বিষেই ঘায়েল হয়েছেন মিসেস সিমিংটন।
যোয়ানা আমাদের জিজ্ঞেস করল, তোর কি মনে হয় জেরি, সত্যিই কোন অসুখী ঈর্ষাকাতর লোক এসব চিঠি লিখছে?
–আমি ওসব নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না যো। আমার শুধু দুঃখ হয়, যারা ওই শয়তানের শিকার হচ্ছে।
.
পরদিন সকালে প্রাতরাশ শেষ করার পর পরই এলেন এমি গ্রিফিথ। মেগান ড্রইংরুমে চলে গিয়েছিল।
রেডক্রশ থেকে মেইন রোডে একটা স্টল তৈরি হয়েছে। সেই খবর জানিয়ে এমি গ্রিফিথ বললেন, কিছু তরিতরকারী তুলে রাখতে, ওয়েন গ্রিফিথ ফেরার পথে নিয়ে যাবেন।
যোয়ানা বলল, সবজির ব্যাপারটা আমি একেবারেই কিছু বুঝি না। ঠিক আছে, যা পারি কিছু তুলে রাখব।
এমি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই টেলিফোন বেজে উঠল। এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুলে নিলাম।
-হ্যাল্লো, বলুন।
ওপাশ থেকে মেয়েলীকণ্ঠ ভেসে এল–এটা কি লিটল ফার্জ?
–হ্যাঁ, বলুন, কাকে চাই?
–ওহ, মিস পারট্রিজের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
–নিশ্চয়ই। কি নাম বলব? আমি বললাম।
দয়া করে বলুন, অ্যাগনেস ওডেল কথা বলতে চায়।
–বেশ, ধরুন, ডেকে দিচ্ছি।
রিসিভার রেখে সিঁড়ির কাছে গিয়ে পারট্রিজকে ডেকে টেলিফোনের কথা বললাম।
–অ্যাগনেস ওডেল এসময় আবার কি চায়? বলতে বলতে পারট্রিজ এসে রিসিভার তুলে নিল। আমি ডাইনিংরুমে চলে এলাম। মেগান টেবিলে বসে মাংস খাচ্ছিল।
আমি একটা চেয়ারে বসে পাইপে তামাক ভরতে শুরু করলাম। একটু পরেই যোয়ানা ঢুকল ঘরে।
–কি জঘন্য সব সেকেলে রীতিনীতি। সেখানে মানুষের দাম এত কম ছিল ভাবা যায় না।–
-কেন কি হল? জানতে চাইলাম আমি।
-আগে নাকি এবাড়িতে ঝি চারকদের টেলিফোনে কথা বলা বা ছুটির দিনে কোন বন্ধুকে চা খেতে বলার নিয়ম ছিল না। চিন্তা কর একবার–ওরা কি মানুষ নয়?
ব্যাপারটা খুলে না বললে বুঝি কি করে? বিরক্তির সঙ্গে বললাম?
–পারট্রিজ ক্ষমা চাইছিল, অ্যাগনেস বলে কে একজন তাকে টেলিফোন করেছে বলে। আগে এসব নাকি এ বাড়িতে চলত না। অ্যাগনেস মেয়েটি আগে এ বাড়িতেই নাকি কাজ করত। বয়স ষোল-সতেরো হবে–একেবারেই বাচ্চা। নিজের আত্মীয়স্বজন কেউ নেই বলে দরকার হলে পারট্রিজের কাছেই আসত। আজ বিকেলে সে আসতে চেয়েছে, সেকথাই টেলিফোনে জানিয়েছিল। তাকে আসার কথা বলবে কিনা, সেকথা জানতে চাইছিল পারট্রিজ।
–তা তুই কি বলেছিস?
–আমি বললাম, সে কাউকে চা খেতে আসতে বলবে এতে আমাদের আপত্তি করার কি আছে। মানুষ মানুষের সঙ্গে কি অমানবিক ব্যবহার করতো, চিন্তা করে দেখ একবার জেরি।
–ওসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। বললাম আমি।
মেগানের খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। সে এগিয়ে এসে বলল, আমি আজই বাড়ি চলে যাব ভাবছি।
-সেকি, কেন? আমি হতাশ স্বরে বলে উঠলাম।
-আপনাদের এখানে আমি খুব ভাল থাকলাম। আপনারা সত্যিই খুব ভাল। কিন্তু আমাকে এখন ফিরে যেতে হবে। ওটাই যে আমার বাড়ি।
–তা বলে আজই চলে যাবে? বলল যোয়ানা।
মেগানকে আমরা দুজনেই অনেক বোঝালাম তার মত বদল করার জন্য। কিন্তু ও একেবারে গোঁ ধরে রইল।
অগত্যা বোয়ানা কিছুক্ষণের মধ্যেই ওকে গাড়ি করে নিয়ে রওনা হয়ে গেল।
যোয়ানা যখন ফিরে এলো আমি তখন বাগানে ঘাসে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার কাছে এসে প্রশ্ন করল, সূর্যঘড়ি হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
.
মধ্যাহ্নভোজের কিছু আগেই ওয়েন গ্রিফিথ তাঁর গাড়ি নিয়ে এলেন। মালী কিছু সবজি তুলে রেখেছিল। গাড়িতে তুলে দিল।
আমি ওয়েন গ্রিফিথকে ভেতরে নিয়ে এসে কিছু পানীয় দিয়ে অভ্যর্থনা করলাম। মধ্যাহ্নভোজের জন্য অনুরোধ করলাম, কিন্তু রাজি হলেন না।
যোয়ানা হেসে বলল, মন বদলে ফেলুন ডঃ গ্রিফিথ। আমাদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে থেকে যান।
–কিন্তু এমি যে অপেক্ষা করে থাকবে। কথা বলতে গিয়ে কেমন লাল হয়ে উঠলেন ওয়েন।
-আমি তাকে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি। বলে যোয়ানা ফোন করতে উঠে গেল।
ওয়েন গ্রিফিথ এরপর মধ্যাহ্নভোজে থেকে গেলেন। বেশ জমিয়েই আড্ডা দিলাম আমরা। সাহিত্য, নাটক, রাজনীতি কোন কিছুই আলোচনা করতে বাকি রাখলাম না।
কিন্তু লিমণ্টকের বেনামী চিঠি বা মিসেস সিমিংটনের আত্মহত্যার বিষয় নিয়ে একবারও কথা বললাম না কেউ।
আমার মনে হলো আমাদের সঙ্গ বিশেষ করে যোয়ানার, বেশ উপভোগ করলেন ওয়েন। উৎফুল্ল মনেই বাড়ি ফিরে গেলেন।
.
ওইদিন বিকেলেই এমিলি বার্টনের বাড়িতে আমাদের চা পানের নিমন্ত্রণ ছিল। আমরা পায়ে হেঁটে গেলেও একটু আগেই পৌঁছে গেলাম।
এমিলি বার্টনের বিশ্বস্ত পরিচারিকা ফ্লোরেন্স দরজা খুলে আমাদের ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসাল।
মিস বার্টন বাইরে গিয়েছিলেন। কয়েক মিনিট পরেই তিনি দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন।
–সকালের কেকগুলো ভাল ছিল না, তাই কয়েকটা টাটকা কেক আনতে গিয়েছিলাম। বলে নিজের অনুপস্থিতির জন্য ক্ষমা চাইলেন তিনি।
–আমরা আগেই এসে পড়েছি মিস বার্টন। বলল যোয়ানা।
–আপনাদের পেয়ে কত যে আনন্দ হচ্ছে। মনের মতো কাউকে তো এখানে পাওয়া যায় না।
কথা বলতে বলতেই প্রায় হুটোপুটি করেই তিনি ছোট ছোট টেবিলের ব্যবস্থা করে ফেললেন আমাদের জন্য।
কয়েক মিনিট পরে ফ্লোরেন্স কয়েকটা ক্রাউন ডার্বি কাপ আর চায়ের পট নিয়ে হাজির হল।
চীনা চায়ের সঙ্গে স্যাণ্ডউইচ রুটি, মাখন আর ছোট আকারের কিছু কেকের আয়োজন ছিল। বেশ জমে গেল।
আমাদের কথাবার্তা স্বাভাবিক পথ ধরে চলছিল। এমিলি বার্টন ডাঃ গ্রিফিথের চিকিৎসার প্রশংসা করলেন।
সিমিংটন যে একজন অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ তা-ও বারবার জানালেন। বললেন, তার চেষ্টাতেই এমিলি তার কিছু টাকা আয়কর দপ্তরের কাছ থেকে আদায় করে নিতে পেরেছেন।
কথাপ্রসঙ্গে মিসেস সিমিংটনের কথা উঠে পড়ল। এমিলি বার্টন দুঃখপ্রকাশ করে বললেন, বেচারি মারা যাওয়ায় বাচ্চারা অকালে মাতৃহারা হল। কী যে হয়ে গেল। আচমকা নিশ্চয় মাথার গোলমাল হয়ে গিয়েছিল, নইলে বাচ্চাদের কথা তার মনে পড়ত।
–ওই বেনামী চিঠি তাকে প্রচণ্ড আঘাত দিয়েছিল। বলল যোয়ানা।
–কিন্তু ওসব বিষয় নিয়ে আমার আলোচনা করতে ভাল লাগে না। ভারি নোংরা বিষয়। এসব অগ্রাহ্য করাই উচিত আমার মনে হয়।
আমিও স্বীকার করলাম। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে এমি গ্রিফিথের কথা তুললাম। এমিলি তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। বললেন, উনি খুবই বাস্তবঘেঁষা আধুনিক মনের মানুষ। ভাইয়ের জন্য যথেষ্ট স্বার্থ ত্যাগ করেছেন।
যোয়ানা আমার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসছিল। আমি প্রসঙ্গ বদল করে মিঃ পাইয়ের কথায় এলাম।
এমিলি বার্টন এবারে অতটা উচ্ছ্বসিত হতে পারলেন না। বললেন, এমনিতে বেশ সদাশয় মানুষ। পয়সা আছে তবে অহঙ্কার নেই। মাঝে মাঝে তার কাছে অনেক অচেনা লোক আসে। বাইরে অনেক ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি, তাই অনেকের সঙ্গেই আলাপ পরিচয় আছে।
যোয়ানা বলল, ভ্রমণ মানুষের মনকে উদার করে। অচেনা মানুষের সঙ্গেও আলাপ পরিচয়ের সুযোগ পাওয়া যায়।
–বেড়াতে যাওয়ার কথা কাগজে পড়ি। কিন্তু যেতে ভরসা হয় না। মালপত্র সামলানো–বিদেশের বন্দরে মুদ্রা বিনিময়–এসব ভাবলেই আমার গায়ে জ্বর আসে।
এরপর একসময় মিসেস ডেন ক্যালগ্রুপের প্রসঙ্গ উঠল।
–ভদ্রমহিলাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, বললেন এমিলি, মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলেন
–কীসব কথা? জানতে চাইলাম আমি।
-আশা করা যায় না এমন সব কথা। তাছাড়া এমন ভাবে তাকান যে বড় অস্বস্তি হয়। ভাইকারের স্ত্রী হিসেবে অনেক বিষয়ে তার মানুষকে পরামর্শ দেওয়া উচিত, কিন্তু উনি কারো কোন ব্যাপারেই মাথা গলাতে চান না। লোকে কেমন যেন ভয় পায় ওকে।
–আশ্চর্য ব্যাপার। যোয়ানা বলে উঠল।
–অথচ উনি ভাল বংশের মেয়ে। খুবই প্রাচীন বংশ। ভদ্রমহিলার স্বামী খুবই বিদ্বান, আর অনুগতও।
এরপরেই মিস এমিলি আচমকা এখানকার স্কুলের শিক্ষিকার প্রসঙ্গে চলে এলেন।
–খুবই অপ্রিয় ধরনের এক তরুণী এই শিক্ষিকা। বললেন তিনি, অদ্ভুত রকমের লাল সে।
লক্ষ্য করলাম লাল কথটার ওপরে বেশ জোর দিলেন এমিলি বার্টন।
ফিরে আসার পথে যোয় না মন্তব্য করল, মহিলা খুবই ভাল।
.
রাতে নৈশ ভোজের সময় যোয়ানা পারট্রিজকে বলল, তোমাদের চায়ের আসর কেমন হল?
-ধন্যবাদ মিস, পারট্রিজ বলল, কিন্তু অ্যাগনেস আসেনি।
–সে কি! এলো না কেন? দুঃখপ্রকাশ করল যোয়ানা।
–কি জানি কি হল। ও নিজেই জানিয়েছিল, কিন্তু কথা ছিল, তাই আসতে চেয়েছিল। কেন এল না, কিছু জানালোও না। এই মেয়েগুলো যেন কেমন
–হয়তো শরীর খারাপ হয়েছিল। ফোন করে খবর তো নিতে পারতে। যোয়ানা বলল।
–ওহ, মিস, তা করেনি।
বেশ রাগতস্বরে বলে পারট্রিজ রান্নাঘরে চলে গেল।
–আসলে কি ব্যাপার হয়েছে আমি বলতে পারি, আমি বললাম যোয়ানাকে, ছেলেবন্ধুর সঙ্গে মিটমাট হয়ে গেছে অ্যাগনেসের, তাই সে আসতে দেয়নি।
-তাই হবে হয়তো। হেসে বলল যোয়ানা।
একটু থেমে হঠাৎ বলে উঠল, আজ ঠিক এক সপ্তাহ হল, মিসেস সিমিংটন আত্মহত্যা করেছেন। পুলিস এতদিনে নিশ্চয় কোন সূত্র পেয়ে থাকবে।
অন্যমনস্কভাবে যোয়ানার কথায় সায় দিলাম। আমার মনে কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করছিলাম। কেমন একটা সন্দেহের অনুভূতি যেন। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না অবচেতন মনে কি হচ্ছিল।
-কি ব্যাপার জেরি, চুপ করে আছিস কেন?
–আমার অন্যমনস্কতা যোয়ানা ঠিক লক্ষ্য করল। সপ্তাহ হয়ে গেল…মিসেস সিমিংটন আত্মহত্যা করেছেন…ওই দিন বিকেলে তিনি বাড়িতে একাই ছিলেন…বাড়ির কাজের লোকেরা সেদিন তাদের সাপ্তাহিক ছুটিতে ছিল..
আমি আচমকা বলে উঠলাম, আচ্ছা যো, পরিচারিকারা সপ্তাহে একদিন ছুটি পায় তাই না?
–হ্যাঁ, এটাই নিয়ম। বলল যোয়ানা।
সহসা আমি এগিয়ে গিয়ে ঘন্টা বাজালাম। শব্দ শুনে পারট্রিজ এসে দাঁড়াল।
–একটা কথা জিজ্ঞেস করব তোমাকে পারট্রিজ। অ্যাগনেস উড কি এখনও কাজ করে?
–হ্যাঁ স্যর, সিমিংটনদের বাড়িতে কাজ করে।
আমার চিন্তাধারা কোন দিকে বইছিল আমি নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। নিজের অজ্ঞাতেই ঘড়ির দিকে চোখ গেল। দেখতে পেলাম রাত দশটা বাজে।
-এখন তাকে মনে হয় বাড়িতে পাওয়া যাবে।
–দশটার মধ্যে তো ফিরে আসা উচিত।
–আমি একবার টেলিফোন করে দেখি।
আমি হলঘরে এলাম। যোয়ানা আর পারট্রিজ আমাকে অনুসরণ করল।
–টেলিফোন করার কথা ভাবছিস কেন জেরি? যোয়ানা অবাক হয়ে জানতে চাইল।
ততক্ষণে আমি রিসিভার তুলে নিয়েছি। বললাম, মেয়েটার আজ ছুটির দিন। ঠিকমতো বাড়ি ফিরল কিনা, নিশ্চিত হতে চাইছি।
টেলিফোনে ওপ্রান্ত থেকে সাড়া দিল এলসি হল্যাণ্ড। পরিচয় জানিয়ে বললাম, আপনাদের বিরক্ত করছি বলে দুঃখিত। আপনাদের কাজের লোক অ্যাগনেস ফিরেছে?
নার্সারি গভর্নের্সকে অনুরোধ করলাম মেয়েটার খোঁজ নেবার জন্য।
মিনিট দুই পরে ওপ্রান্ত থেকে মিঃ সিমিংটনের গলা শোনা গেল।
–হ্যাল্লো বার্টন, কি ব্যাপার?
–আপনার পরিচারিকা অ্যাগনেস ফিরেছে কিনা জানতে চাইছিলাম।
–মিস হল্যাণ্ড এই মাত্র খবর নিয়ে এলেন ও এখনো ফেরেনি। কোন দুর্ঘটনা বা ওরকম কিছু ভাবছেন নাকি?
-না, কোন দুর্ঘটনা নয়, তবে হলে অবাক হব না।
.
০৭.
সকালে ঘুম ভাঙ্গল সাতটায়। রাতে ভাল ঘুম হয়নি। নানান চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে। বেনামী চিঠিগুলো কে লিখেছে তা জানার একটা সূত্র যেন মনে পড়ে পড়েও পড়ছিল না।
সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছি, হলঘরে টেলিফোন বেজে উঠল। তাড়াতাড়ি এসে রিসিভার তুলে নিলাম।
–হ্যাল্লো–
-ওহ্, তুমি উঠেছ, মেগানের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, কেমন ভয় মাখানো, কী সাংঘাতিক, শিগগির, এসো
–আসছি। এখনই আসছি।
সাংঘাতিক কিছু একটা যে ঘটেছে বুঝতে অসুবিধা হল না। কিন্তু কি ঘটতে পারে?
যোয়ানাকে ডেকে বললাম, আমি সিমিংটনদের ওখানে যাচ্ছি। মেগান ফোন করেছিল—
যোয়ানা বলল, কি হয়েছে ভাবছিস?
–মনে হয় পরিচারিকা অ্যাগনেসকে নিয়ে কিছু হয়েছে।
আধঘণ্টার মধ্যে দাড়ি কামিয়ে, স্নান করে পোশাক পরে গাড়ি বের করে সিমিংটনের বাড়ির দিকে রওনা হলাম।
মেগান আমার জন্যই হয়তো অধীর হয়ে পথের দিকে তাকিয়েছিল। গাড়ি থেকে নামতেই দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
-ওহ, জেরি তুমি এসেছে।
–শান্ত হও মেগান, আমি এসে গেছি। কি হয়েছে আমাকে খুলে বল।
–মেগান কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। থরথর করে কাঁপছে।
–আমি ওকে খুঁজে পেয়েছি।
–অ্যাগনেসকে?
–সিঁড়ির নিচে। একটা দেয়াল আলমারি আছে ওখানে, তার মধ্যে মাছ ধরার ছিপ, গলফের ক্যাপ আর টুকিটাকি জিনিস থাকে।
–অ্যাগনেস কোথায় ছিল? আমি জানতে চাইলাম।
–ওই আলমারির মধ্যে দলা পাকিয়ে ছিল–ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা–মরে কাঠ হয়ে গিয়েছিল।
–তুমি আলমারিতে কি দেখতে গিয়েছিলে?
–কিছু না। তুমি কাল রাতে টেলিফোন করেছিলে–আমরা সবাই ভাবছিলাম অ্যাগনেস কোথায় গেল। রাতে ওর জন্য আমরা অনেকক্ষণ বসেছিলাম।
রাতে একদম ঘুম হয়নি আমার। খুব সকালে উঠে পড়েছিলাম। তখন আমাদের রাঁধুনী রোজ কেবল উঠেছিল। রাতে অ্যাগনেস ফিরে আসেনি বলে রোজ খুব রেগে গিয়েছিল। আমি রান্নাঘরে বসেই একটু দুধ আর রুটি খেয়েছিলাম। রোজ তখন এসে বলে, অ্যাগনেসের বাইরে যাওয়ার জামা জুতো সবকিছু ওর ঘরেই রয়েছে। আমার কেমন মনে হল, ও বাড়ির ভেতরেই কোথাও আছে–বাইরে যায়নি। তখন সব জায়গায় খুঁজতে শুরু করি। আর–ওই আলমারিটা খুলতেই–তার ভেতরে ওকে দেখতে পেলাম
–পুলিসে কেউ খবর দিয়েছে? বললাম আমি।
-হ্যাঁ। আমার সৎবাবা ফোন করেছিলেন। তারা এসে গেছে। ওদের দেখে আমার কেমন মনে হল। তখনই তোমাকে ফোন করলাম। তুমি কিছু মনে করোনি তো?
-না, মনে করব কেন। তুমি…ওকে খুঁজে পাওয়ার পর তোমাকে কেউ ব্রাণ্ডি বা কফি দেয়নি?
মেগান আমার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল।
ওইটুকু মেয়ে, অমন একটা মৃতদেহ আবিষ্কার করার পর তার স্নায়ুর অবস্থা কেমন হতে পারে, সিমিংটন পরিবারের কেউ একবার ভেবে দেখেনি।
পুলিসে খবর দিয়েই তারা কর্তব্য শেষ করেছে। মনে মনে সিমিংটনদের মুণ্ডুপাত না করে পারলাম না।
মেগানকে নিয়ে তখনই রান্নাঘরে গেলাম। মোটাসোটা গোলগাল চেহারার রোজ আগুনের পাশে বসে চা পান করছিল। আমাকে দেখেই সে কথা বলতে শুরু করল। রোজ খুবই ঘাবড়ে গিয়েছিল।
-রোজ, মেগান ওই মৃতদেহটা খুঁজে পেয়েছে। ওর মনে দারুণ চোট লেগেছে। কড়া করে এককাপ চা ওকে দাও।
পটেই চা ছিল। রোজ কাপে ঢেলে মেগানকে দিল। কয়েক ফোঁটা ব্রাণ্ডিও চায়ের কাপে ঢেলে দিল।
এরপর মেগানকে রোজের হেফাজতে রেখে আমি বাড়ির মধ্যে ঢুকলাম।
মিস এলসি হল্যাণ্ডের সঙ্গেই মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল প্রথমে।
–ওহ, মিঃ বার্টন, কি ভয়ানক ব্যাপার। কে এরকম কাণ্ড করল?
–অ্যাগনেস তাহলে খুন হল? বললাম আমি।
-কেউ ওর মাথার পেছনে আঘাত করেছিল। ওহ কি ভয়ঙ্কর। তারপর দলা পাকিয়ে আলমারিতে ঢুকিয়ে রেখেছিল। বেচারা অ্যাগনেস-ও তো কারো ক্ষতি করেনি–এমন বীভৎসভাবে কে ওকে মারল?
এলসি হল্যাণ্ড তেমন ঘাবড়ায় নি। স্নায়ুর বেশ জোর আছে।
–মিঃ বার্টন, আমি বাচ্চাদের কাছে যাচ্ছি। মিঃ সিমিংটন বলেছেন ওদের আড়ালে রাখবার জন্য, ওদের মনে যাতে আঘাত লাগতে না পারে।
-মেগান শুনেছি মৃতদেহটা আবিষ্কার করেছে। ওরও দেখাশোনা করা দরকার। রোজের কাছে বসিয়ে রেখে এসেছি ওকে–দেখবেন।
-ওহ্ নিশ্চয়ই। ওর কথা একদম ভুলে গিয়েছিলাম। বেচারা মেয়েটার নিশ্চয়ই দারুণ লেগেছে। আমি এখনই গিয়ে দেখছি।
আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে এলসি হল্যাণ্ড দ্রুত ওপরে চলে গেল।
ঠিক তখনই হলঘরে ঢুকলেন সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট ন্যাস। তার পেছনে সিমিংটন।
আমাকে দেখে ন্যাস খুশি হলেন। বললেন, এখুনি আপনাকে টেলিফোন করতে যাচ্ছিলাম।
আমি কেন এসেছি সেকথা উনি জানতে চাইলেন না।
সিমিংটনকে ন্যাস বললেন, সামনের ঘরটা একটু ব্যবহার করতে চাই মিঃ সিমিংটন।
–নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। বললেন সিমিংটন। তাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল।
–আপনি কিছু এখনো মুখে দেননি মিঃ সিমিংটন। খালিপেটে খুনের মতো বিশ্রী ব্যাপারের মুখোমুখি হওয়া ঠিক নয়। আপনি, মিস হল্যাণ্ড আর মেগান সামান্য কফি মাংস খেয়ে নিন।
ন্যাস একজন পারিবারিক চিকিৎসকের মতোই কথাগুলো বললেন।
–ধন্যবাদ, সুপারিন্টেন্টে। আপনার কথাই মেনে নিচ্ছি। সামান্য হাসবার চেষ্টা করলেন সিমিংটন।
ন্যাস আমাকে নিয়ে ছোট ঘরটায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। বাড়ির সামনের দিকে একটা মাত্র জানালা এঘরে।
-কিভাবে আপনি খবরটা পেলেন মিঃ বার্টন? খুবই তাড়াতাড়ি এসে গেছেন। ন্যাস বললেন।
আমি তাকে মেগানোর টেলিফোনের কথা জানালাম।
–শুনলাম, গতকাল রাতে আপনি এখানে ফোন করেন? মেয়েটার ফেরার কথা জানতে চেয়েছিলেন?
আমি ন্যাসকে জানালাম অ্যাগনেস ফোন করেও পারট্রিজের কাছে যায়নি।
বুঝতে পেরেছি, চিন্তিতভাবে বললেন ন্যাস, সরাসরি খুন করা হয়েছে মেয়েটিকে। মনে হয় এমন কিছু ও জেনেছিল যা পারট্রিজকে জানাতে চেয়েছিল। কিছু কি জানিয়েছিল মনে। করেন?
-মনে হয় না, তাহলে পারট্রিজ জানাতে। আপনি ওকে প্রশ্ন করে দেখতে পারেন।
–তাই করব। আগে এখানের কাজ শেষ করে নিই।
–সব জানতে পেরেছেন?
–মোটামুটি। ওদের আজ ছুটির দিন ছিল। দুই বোন এবাড়িতে কাজ করতো। ওদের একসঙ্গে ছুটির ব্যবস্থা মিসেস সিমিংটনই করেছিলেন।
-তারপর? জানতে চাইলাম আমি।
রাঁধুনী রোজ আসে মিটফোর্ড থেকে। ছুটির দিনে আড়াইঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ে। অ্যাগনেসকেই মধ্যাহ্নভোজের বাসনপত্র গুছিয়ে রাখতে হতো। গতকালও রাঁধুনী দুটো পঁচিশে বেরিয়ে যায়। সিমিংটন অফিসে বেরিয়ে যান দশ মিনিট পরেই। পৌনে তিনটে নাগাদ এলসি হল্যাণ্ড বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়ে যান। পাঁচ মিনিট পরেই মেগান হান্টার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যায়। একমাত্র অ্যাগনেসেরই বাড়িতে থাকার কথা। সে সাধারণত তিনটে থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে বেরিয়ে যায়।
-তাহলে বাড়ি কি খালি থাকে?
–ওসব নিয়ে এখানে তেমন কেউ ভাবে না। তিনটে বাজার দশ মিনিট আগে পর্যন্ত অ্যাগনেস বাড়িতে একাই ছিল। তার বাইরে বেরুবার কোন তোড়জোড় ছিল না। অ্যাপ্রন আর মাথায় টুপি অবস্থায়ই ওকে আবিষ্কার করি।
-কিছু আন্দাজ করতে পেরেছেন–ঠিক কখন সে মারা যায়?
–সরকারি ডাক্তারের বক্তব্য হল দুটো থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে।
–কিভাবে মারা হয়, আমি জানতে চাই।
-প্রথমে অজ্ঞান করে ফেলা হয়–মাথার পেছনে ভারি কিছু দিয়ে আঘাত করে। পরে ছুঁচলো কোন জিনিস দিয়ে মাথার নিচে গেঁথে দেওয়া হয়। ফলে সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু হয়।
-এতো রীতিমত ঠাণ্ডা মাথায় খুন।
–আমারও তাই মনে হয়।
–কিন্তু এমন নৃশংসভাবে খুন করার উদ্দেশ্য কি?
–সঠিক কারণ জানার উপায় নেই। তবে আন্দাজ করতে পারি।
–কিছু একটা জানতে পেরেছিল বলে মনে করেন?
–হ্যাঁ, আমিও তাই মনে করি।
–এখানে কাউকে কিছু আভাস দিয়েছিল?
-সকলকেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। কাউকে কিছু জানায়নি। রাঁধুনী জানিয়েছে মিসেস সিমিংটনের মৃত্যুর পর থেকেই ও কেমন ভেঙ্গে পড়েছিল। সে নাকি বারবারই বলতো, কি করবে বুঝতে পারছে না।
একটু থেমে বিষণ্ণ হাসলেন ন্যাস। পরে আবার বললেন, মেয়েটি যদি আমাদের কাছে আসত তাহলে হয়তো আজ তাকে এভাবে মরতে হত না।
সবসময় এরকমই ঘটে। মানুষ পুলিসকে এড়িয়ে চলতে চায়।
তবে ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারছি মিঃ বার্টন। সেদিন বিকেলে মিসেস সিমিংটন আত্মহত্যা করেন, সেদিন দুজন পরিচারিকারই ছুটিতে যাওয়ার কথা ছিল। দুজনেরই সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল। কিন্তু অ্যাগনেস বাড়ি ফিরে এসেছিল।
–কথাটা আপনি জেনেছেন?
-হ্যাঁ। ফ্রেড রেণ্ডেল নামে অ্যাগনেসের একজন ছেলেবন্ধু ছিল। সে মাছের দোকানে কাজ করে। বুধবারে দোকান বন্ধের পর সে অ্যাগনেসের সঙ্গে দেখা করত। পরে দুজনে একসঙ্গে বেড়াতে যেত।
ওই বুধবারে দুজনের মধ্যে ঝগড়া হয়। রেণ্ডাল একটা বেনামী চিঠি পেয়েছিল। তাতে জানানো হয়েছিল অ্যাগনেস অন্য কারও সঙ্গে মেলামেশা করছে। এই নিয়েই দুজনের মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়। তাই অ্যাগনেস রেগে গিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। ও বলেছিল, ফ্রেড এসে ক্ষমা না চাইলে ও আর তার কাছে যাবে না।
-তারপর?
-এবাড়ির রান্নাঘরটা বাড়ির পেছন দিকে। বাড়িতে ঢুকতে হয় সামনের গেট দিয়ে। রান্নাঘরের পাশ দিয়ে পেছনে একটা দরজা আছে ঢোকার।
এবারে অন্য একটা বিষয় লক্ষ্য করুন। ওই দিন বিকেলে মিসেস সিমিংটনের কাছে যে চিঠিখানা এসেছিল, তার খামের ওপরে একটা ব্যবহার করা ডাকটিকিট লাগানো ছিল। ডাকঘরের সিলের বদলে ওরকমই দেখতে একটা কালির ছাপ ছিল। চিঠিটা যে ডাকে আসেনি এটাই তার প্রমাণ। চিঠিটা কেউ হাতে করে বাক্সে ফেলে গিয়েছিল বলেই আমার বিশ্বাস।
-হ্যাঁ, তাই তো প্রমাণ হয়। বললাম আমি।
-সাধারণত পৌনে চারটে নাগাদ বিকেলের চিঠি বিলি হয়। মেয়েটি রান্নাঘরের উল্টোদিকে ভাড়ার ঘরে ছিল। সেখান থেকেই জানালা দিয়ে সে একজনকে চিঠি ডাকবাক্সে ফেলে যেতে দেখে থাকবে।
–তারপর এই যুক্তি যদি মেনে নেওয়া হয় তাহলে দেখা যাচ্ছে, অ্যাগনেস জানতো, বেনামী চিঠির লেখক কে? কিন্তু তাহলে সে জানাল না কেন?
ন্যাস বললেন, হ্যাঁ, সে কোন আভাস কাউকে কেন দিল না, সেটাই প্রশ্ন। আমার ধারণা, এমন একজনকে সে চিঠিটা বাক্সে ফেলতে দেখেছিল, যাকে সে বেনামী চিঠির লেখক হিসেবে কল্পনাও করতে পারেনি। সেই লোকটি সব সন্দেহের বাইরে ছিল। বুঝতেই পারছেন, ব্যাপারটা তার কাছে খুবই অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল। কথাটা কাউকে বলবে কিনা বুঝে উঠতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত ঠিক করেছিল পারট্রিজকেই জানাবে। তার পরামর্শ চাইবে।
–আপনার যুক্তি আমি স্বীকার করছি। বললাম আমি। এর পর ওই বেনামী চিঠির লেখক যেভাবেই হোক, ব্যাপারটা জেনে গিয়েছিল। কিন্তু কিভাবে এই জানাটা সম্ভব হয়েছিল বলে আপনি মনে করেন, সুপারিন্টেন্টে?
–যেমন ধরুন টেলিফোনের কথাটা। আপনি যখন ফোন করেন, তখন কে শুনে থাকতে পারে বলে মনে করেন?
আমি একটু চিন্তা করলাম। পরে বললাম, টেলিফোন আমিই প্রথমে ধরি। তারপর সিঁড়ির কাছে গিয়ে পারট্রিজকে ডাকি।
–নিশ্চয় মেয়েটির নাম করে ডেকেছিলেন?
–হ্যাঁ। নাম ধরেই ডেকেছিলাম।
–আপনার কথা কেউ শুনেছিল?
–হ্যাঁ। আমার বোন আর মিস গ্রিফিথ শুনে থাকতে পারে।
–মিস গ্রিফিথ? উনি ওখানে তখন ছিলেন?
আমি তখন সব খুলে বললাম–রেডক্রশের স্টলের কথা–সবজি তুলে রাখার কথা–যোয়ানার সঙ্গে তার আলোচনার বিষয় সবকিছু।
–এরপর উনি কি গ্রামের দিকে যাচ্ছিলেন?
–বলেছিলেন মিঃ পাইয়ের কাছে যাবেন।
–তাহলে, এটা পরিষ্কার এই দুটি পথেই কথাটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল। এখানে গ্রামে এভাবেই সব কথা জানাজানি হয়ে থাকে।
কিন্তু কথাটা আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সামান্য একটা অর্থহীন টেলিফোনের কথা–এটার মধ্যে প্রচার করবার কি থাকতে পারে যে মিস গ্রিফিথ বা মিঃ পাই তা প্রচার করতে পারেন? আমার অবিশ্বাসের কথা জানালাম ন্যাসকে।
তিনি মৃদু হেসে বললেন, শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এটা সত্যিই মিঃ বার্টন যে এখানে যে কোন কিছুই খবর হয়ে উঠতে পারে। তারপর ওদিকের কথাটাও ভাবুন। মিস হল্যাণ্ড, রোজ-অ্যাগনেস কি বলেছিল তারাও শুনে থাকতে পারে।
তাছাড়া, অ্যাগনেস ওই দিন বিকেলে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল এই কথাটা তার কাছ থেকেও প্রচার হওয়া সম্ভব।
যাই হোক, এটা আশার কথা যে এভাবে গণ্ডীটা বেশ ছোট হয়ে এসেছে। এবার একটু ধৈর্য ধরে ঝাড়াই-বাছাই করে আমরা ঠিক অপরাধীকে খুঁজে বের করতে পারব।
-কাদের বাদ দেবার কথা ভাবছেন আপনি? জানতে চাইলাম আমি।
–যেমন ধরুন, স্কুলের শিক্ষিকারা। আর বিকেলে যেসকল মহিলা কেরানী কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ হতে পারে, তা আমি ভাবি না।
আর একটা ব্যাপার মিঃ বার্টন, সময় নিয়ে দুটো সূত্র আমাদের সামনে রয়েছে যা পরীক্ষা করে দেখা দরকার। গতকাল বিকেল আর একসপ্তাহ আগে মিসেস সিমিংটনের মৃত্যুর দিন। গতকালের সময়টা ধরুন, সওয়া তিনটে, যখন রেণ্ডেলের সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার পর অ্যাগনেস বাড়ি ফিরে আসে। আর একসপ্তাহ আগে চিঠিটা যখন আসে তার সময় চারটের মধ্যে।
গতকালের ব্যাপারটা নিয়ে কি ভাবছেন? বললাম আমি।
-কি ভাবছি? ন্যাস একটু থামলেন, পরে বললেন, আমার মনে হয় কোন মহিলা সদর। দরজায় ঘণ্টা বাজায়। বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গীই ছিল মহিলার। সে মিস হল্যাণ্ড বা মিস মেগানের খোঁজ করে। সে হাতে পার্শেল জাতীয় কিছুও নিয়ে আসতে পারে। সেই সময়েই কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে আগন্তুক ভারি কিছু দিয়ে অ্যাগনেসের মাথার পেছনে আঘাত করে। তারপর ওকে ঘাড়ের পেছনে ছুরি দিয়ে আঘাত করে দলামোচা করে দেয়াল আলমারির মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে।
-কিন্তু কোন স্ত্রীলোকের পক্ষে এই কাজটা বেশ শক্ত মনে হয় না কি? বললাম আমি।
ন্যাস তাকালেন আমার দিকে। ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন।
–দেখুন মিঃ বার্টন এসব বেনামী চিঠির পেছনে যে স্ত্রীলোকটি থাকতে পারে, সে মানসিকভাবে সুস্থ মানুষ হতে পারে না। আর মানসিক ভারসাম্য যাদের থাকে না, তাদের দেহের শক্তি অন্যরকম হওয়াই সম্ভব। তাছাড়া অ্যাগনেসও তেমন একটা বড়সড় চেহারার ছিল না।
-অ্যাগনেসের দেহটা আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারা যাচ্ছে না। বললাম আমি।
-কাজটা পাকা বুদ্ধির বলতে হবে। দেহটা আবিষ্কারে দেরি হলে মৃত্যুর সময়ও সঠিক নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। ধরুন মিস হল্যাণ্ড যদি বাড়ি ফেরার পর মৃতদেহের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতেন কিংবা পড়ে আছে দেখতে পেতেন তাহলে ডাক্তার পরীক্ষা করে বলতে পারতেন দশ মিনিটের মধ্যে অ্যাগনেসের মৃত্যু হয়েছে কি না।
–অ্যাগনেসের মনে ওই মহিলা সম্পর্কে কোন সন্দেহ জেগেছিল বলে মনে করেন? চিন্তিতভাবে জানতে চাইলাম আমি।
অ্যাগনেসের মনে নির্দিষ্টভাবে কোন সন্দেহ জেগেছিল বলে মনে হয় না, বললেন ন্যাস, তবে অস্পষ্টভাবে কোন জিজ্ঞাসা জেগে থাকতে পারে।
খানিকটা কৌতূহলও হয়তো ছিল। ও ভাবতেই পারেনি, যে মহিলার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলছে, সে তাকে খুন করতে পারে।
–আপনি এরকমই সন্দেহ করছেন? বললাম আমি।
–একটা ব্যাপার আমার বুঝতে ভুল হয়ে গিয়েছিল, বললেন ন্যাস, এসব বেনামী চিঠির লেখিকার মনে ভয়ের সঞ্চায় হয়েছিল।
হ্যাঁ, আমারও তাই সন্দেহ, ভয় থেকেই খুনটা করতে বাধ্য হয়েছিল সে। বিকৃত মানসিকতার মানুষের মনের ভয় বড় ভয়াবহ।
তবে এটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন–এসব ঘটনার পেছনে রয়েছে এমন একজন লোক, সমাজে যে গণ্যমান্য বলে স্বীকৃত, বেশ সম্মানের অধিকারী। তার বিরুদ্ধেই লড়াইতে নামতে হয়েছে আমাদের।
কয়েক মিনিট চুপ করে থাকলেন সুপারিন্টেন্টে ন্যাস। মুখ দেখে মনে হল, মনের তলায় কিছু হাতড়ে চলেছে।
-একবার রোজের সঙ্গে কথা বলা দরকার। আপনিও সঙ্গে থাকলে খুশি হব।
আমি অবাক হলাম। বললাম, আসব বলছেন? অবশ্য বলতে বাধা নেই, এরকম একটা ইচ্ছা আমার মনে ছিল। দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারিনি, ন্যাস কিভাবে নেবেন ভেবে।
একটু ইতস্তত করেই বললাম, বইতে দেখা যায়, গোয়েন্দারা যাকে সাহায্যের জন্য ডাকেন, সাধারণত তারাই অপরাধী প্রমাণিত হয়।
আপনার আহ্বানের পেছনেও কি–
উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলেন ন্যাস। পরে বললেন, আপনার কথা শুনে না হেসে পারছি না। মিঃ বার্টন। বেনামী চিঠির লেখক হিসেবে আপনাকে ভাবা চলে না। আপনার কাছ থেকে যথেষ্ট সাহায্যই পেতে পারি আমরা।
–শুনে খুশি হলাম। আপনি তা কিভাবে আসা করছেন জানতে পারি কি?
-আপনি এখানে সম্পূর্ণ নবাগত বলেই এখানকার লোকজন সম্পর্কে ভোলা মনে ধারণা করতে পারবেন। সকলের সঙ্গে সামাজিক ভাবে মেলামেশারও ভাল সুযোগ আপনার রয়েছে, যা থেকে অনেক কিছু জেনে যাবার সম্ভাবনা আপনার রয়েছে।
–অর্থাৎ আপনি বলতে চাইছেন সমাজের উঁচু মহলের সম্ভাব্য খুনীকে সন্ধান করবার জন্য আমাকে একজন গুপ্তচরের ভূমিকা নিতে হবে। বললাম আমি।
–বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে, আপনি নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন না, মিঃ বার্টন?
একদম না। এখানকার নিরীহ মহিলাদের যে লোক মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চাইছে, আর হতভাগ্য পরিচারিকাদের পরিকল্পিতভাবে খুন করছে, সেই ভয়ঙ্কর চরিত্রের কোন অপরাধীকে শাস্তি দেবার কাজে সাহায্যে জন্য যে কোন কাজ করতেই আমি রাজি আছি।
একজন দায়িত্বশীল সামাজিক মানুষের মতোই বলেছেন আপনি স্যর। আপনাকে কেবল এটুকু মনে করিয়ে দিতে চাই, আমরা এমন একজন সাঙ্ঘাতিক চরিত্রের স্ত্রীলোকের সন্ধানে নেমেছি, যে সাপের মতোই ভয়ঙ্কর আর বিপজ্জনক।
আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম। মনে মনে আতঙ্কিত না হয়েও পারলাম না। বললাম, তবে নতুন কোন ঘটনা ঘটবার আগেই আমাদের কাজ শেষ করতে হবে-যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে আমাদের।
–বলেছেন ঠিক। তবে এটা জানবেন আমরা পুলিসরা বিভিন্ন দিকে কাজ করে চলেছি।
রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে ন্যাস জানালেন ইতিমধ্যে রোজ পুলিসকে দুবারে দুরকম কথা বলেছে। আরো একবার জেরা করার সময় সে যদি নতুন কোন কথা বলে তাহলে তা থেকে আসল সত্য প্রকাশ হয়ে পড়তে পারে এই আশাতেই রোজের সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। কথাটা অযৌক্তিক মনে হল না আমার।
রান্নাঘরে এসে দেখলাম, রোজ প্রাতরাশের বাসনকোসন পরিষ্কার করছে। আমাদের দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকালো।
তোমাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলাম রোজ। আশা করি ঠিক ঠিক জবাব দেবে।
খানিকটা কড়া স্বরেই বললেন ন্যাস।
-আমি তো বলেছি স্যর, অ্যাগনেসকে খুবই ভয় পেয়েছে বলে মনে হয়েছিল আমার। কিছু একটা নিয়ে খুব ভাবছিল।
-কেন ও ভয় পেয়েছিল এ নিয়ে কিছু ও বলেনি তোমাকে? জানতে চাইলেন ন্যাস।
–না। আমি জানতে চাইলে ভয়ে কেঁপে উঠে বলেছিল, একথা বললে সে প্রাণে বাঁচবে না।
ন্যাস মাথা নাড়লেন চিন্তিতভাবে।
–গতকাল বিকেলে তুমি কি করেছিলে মনে করে নিশ্চয় বলতে পারবে?
-হ্যাঁ স্যর। এখান থেকে বেরিয়ে আড়াইটার বাস ধরে বাড়ি ফিরে গেছি। বিকেলটা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কাটিয়েছি। তারপর রাত ৮-৪০ মিঃ বাস ধরে নেদার মিডফোর্ড থেকে ফিরে আসি। তবে স্যর, একমুহুতের জন্যও মনে স্বস্তি ছিল না। খুবই খারাপ লাগছিল। ভাল করে খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত করতে পারিনি।
রোজকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করার ছিল না। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আমরা এলসি হল্যাণ্ডের কাছে এলাম।
সে তখন বাচ্চাদের পড়ানোর কাজে ব্যস্ত ছিল। আমাদের দেখতে পেয়ে ওদের লেখার কাজ দিয়ে উঠে এলো।
বাচ্চাদের পড়াশোনার বিঘ্ন যাতে না হয় সেজন্য আলাদা একটা ঘরে বসালো আমাদের।
তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ন্যাস বললেন, মিস হল্যাণ্ড, একটা কথা শুধু আমাকে বলুন। মিসেস সিমিংটনের মৃত্যুর পর থেকে অ্যাগনেস কেন খুব মুষড়ে পড়েছিল, এ সম্পর্কে সে কি কিছুই জানায়নি?
-না স্যর, সে কিছুই জানায়নি। ও এমনিতে খুবই সরল প্রকৃতির মেয়ে ছিল। কথাও কম বলত।
-রোজের মতো ছিল না বলছেন। বললেন ন্যাস।
–হ্যাঁ। রোজ বড় বেশি বকে।
–গতকাল ঠিক কি ঘটেছিল যদি এবার দয়া করে বলেন
–যতটা মনে আছে বলছি শুনুন। গতকাল মধ্যাহ্নভোজ অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু আগেই হয়। তখন একটা বেজেছে। এরপর মিঃ সিমিংটন অফিসে ফিরে যান। অ্যাগনেস টেবিল গুছিয়ে রাখছিল। সেই সময় বাচ্চারা বাগানে খেলা করছিল। একটু পরে ওদের নিয়ে আমি বেড়াতে বেরোই।
ওদের কোথায় নিয়ে যান?
-মাঠের মধ্য দিয়ে কুম্বত্রকারে। ওরা ওখানে মাছ ধরতে চাইছিল। ছিপ নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম বলে, ওগুলো নিয়ে যাবার জন্য আবার ফিরে আসতে হয়েছিল।
–তখন কটা বেজেছিল?
–কটা বেজেছে–মনে হয়–তিনটে বাজতে খুব বেশি বাকি ছিল না। হ্যাঁ, মনে পড়েছে, বিশ মিনিট বাকি ছিল। মেগান তার সাইকেল নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিল।
–আপনি ছিপের জন্য কখন বাড়ি ফিরে আসেন তাই জানতে চাইছিলাম।
–আপনি বাড়ি ফিরে এসে মেগান বা অ্যাগনেসকে দেখেছিলেন?
–মেগান ছিল না। অ্যাগনেসও বাড়ি চলে গিয়েছিল।
–তারপর আবার মাছ ধরতে চলে যান?
–হ্যাঁ। নদীর পাড় দিয়েই গিয়েছিলাম আমরা। তবে কিছুই ধরতে পারিনি। শূন্যহাতেই ফিরে এসেছিলাম আমরা।
বুধবারে আপনি চায়ের আসরে থাকেন?
-হ্যাঁ। মিঃ সিমিংটন ফিরে আসার পর আমি তাকে চা তৈরি করে দিয়েছিলাম। পরে বাচ্চাদের নিয়ে আমি পড়ার ঘরে যাই। মেগানও আমাদের সঙ্গে ছিল।
–আপনারা কটায় বাড়ি ফিরে এসেছিলেন?
-পাঁচটা বাজতে দশ মিনিট বাকি ছিল। মিঃ সিমিংটন ফিরে এসেছিলেন পাঁচটার সময়। তিনি সকলের সঙ্গে বসে পড়ার ঘরেই চা পান করেন। বাচ্চারা তাতে খুব খুশি হয়েছিল। চা পর্বের পর বাচ্চাদের নিয়ে খানিকক্ষণ খেলাধূলা করি। বেচারি মেয়েটার কথা ভাবলে বড় কষ্ট হয়–সারাটা সময় ও দেয়াল আলমারিতেই পড়েছিল।
–ওই আলমারির কাছে সাধারণত কেউ যায়?
-না, ওদিকে কেউ যায় না। দরকারী কোন জিনিস তো ওটার মধ্যে থাকে না। ক্কচিৎ কখনো যাওয়া পড়ত ওদিকে।
–তা, বাড়ি ফিরে আসার পরে অস্বাভাবিক কিছু কি আপনার চোখে পড়েছিল?
–ওহ না, স্যর, কিছুই তেমন চোখে পড়েনি।
–আচ্ছা, আগের সপ্তাহে
–যেই সপ্তাহে মিসেস সিমিংটন
–হ্যাঁ।
–ওহ, সেসব কথা মনে পড়লে এখনও শরীর অবশ হয়ে আসতে চায়।
–হ্যাঁ, সত্যিই ভয়ঙ্কর। সেদিন আপনারা সবাই বিকেলে বাইরে ছিলেন?
-হ্যাঁ। এ সময়টায় ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমি সাধারণত বাইরেই থাকি। মনে আছে, সেদিন আমরা অনেক দূর–জলার দিকে গিয়েছিলাম।
আমরা ফিরে আসার সময় দেখতে পাই, রাস্তার অন্য ধার দিয়ে মিঃ সিমিংটন অফিস থেকে ফিরে আসছেন। ফিরে এসে চায়ের জল বসাই।
–আপনি মিসেস সিমিংটনের কাছে যাননি?
-না, যাইনি। ডাঃ গ্রিফিথ তাকে কিছু ওষুধ দিয়েছিলেন। সেটা খাওয়ার পরেই তার ঝিমুনি দেখা দিত। তাই ওই সময়টা তিনি বিছানাতেই থাকতেন।
বিকেলের ডাকে আসা চিঠি তাঁর কাছে কেউ নিয়ে যেত না?
–বিকেলের ডাক সাধারণত আমিই ফেরার পথে বাক্স থেকে বের করে টেবিলের ওপর রাখতাম। অনেক সময় মিসেস সিমিংটন বাক্স থেকে চিঠি বের করে নিতেন।
–সেদিন বিকেলে বিছানা থেকে না ওঠায় অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি?
-কিছুই না। এরকম কিছু তো কল্পনা করাও যায় না। আমি রান্নাঘরে কেতলিতে জল ফুটছে দেখে আসার পর চোখে পড়ল মিঃ সিমিংটন হলঘরে কোট খুলছেন।
শুনতে পেলাম তিনি মোনা মোনা বলে ডাকলেন। সাড়া না পেয়ে তিনি দোতলায় উঠে মিসেস সিমিংটনের শোবার ঘরে যান। তারপরই তিনি অস্বাভাবিক কণ্ঠে আমাকে ডাকতে থাকেন। আমি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যাই।
তিনি বলেন, বাচ্চাদের যেন আমি সরিয়ে রাখি যাতে এ ঘরে না আসে। তারপরেই তিনি ডাঃ গ্রিফিথকে টেলিফোন করেন।
এরপর আর চায়ের কথা আমাদের কারু মনে ছিল না। সেই সাংঘাতিক ঘটনা, বাড়ির সমস্ত প্রাণচাঞ্চল্য যেন স্তব্ধ করে ফেলেছিল। উঃ, কী ভয়ংকর–দুপুরে খাওয়ার সময়ও মিসেস সিমিংটন এত হাসিখুশি ছিলেন।
ন্যাস এরপর প্রশ্নের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। বললেন, মিসেস সিমিংটন যে চিঠিটা পেয়েছিলেন, সে সম্পর্কে আপনার ধারণা কিরকম মিস হল্যাণ্ড?
চকিতে মুখ তুলে তাকালেন মিস এলসি হল্যাণ্ড, দৃঢ়স্বরে বললেন, অত্যন্ত জঘন্য। আমি ওসব একদম বিশ্বাস করি না। মিসেস সিমিংটন, কখনও এমন নীতিহীন কাজ করতে পারেন না। এজন্যই তিনি প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন।
ন্যাস নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকালেন। পরে বললেন, একটা কথা, মিস হল্যাণ্ড, আপনি কি এরকম চিঠি কখনো পেয়েছেন?
যেন চমকে উঠলেন এলসি। তার মুখ লাল হয়ে উঠলো।
-না-না, এরকম চিঠি আমি কখনও পাইনি।
–আপনি একটু ভেবে বলুন, মিস হল্যাণ্ড, বললেন ন্যাস, অবশ্য এটা ঠিক এরকম চিঠি পাওয়া খুবই মর্মান্তিক। লোকে তাই এরকম চিঠি পাওয়ার কথা চেপে যেতেই চায়। এসব চিঠিতে যা থাকে, আমরা জানি, সেসব মিথ্যা ছাড়া কিছু নয়। তাই বলছি, আপনার বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। ব্যাপারটা জানা আমাদের খুবই দরকার।
–কিন্তু সুপারিন্টেন্ডেন্ট, আমি সত্যিই পাইনি। আপনি বিশ্বাস করুন।
এলসি হল্যাণ্ডের মুখভাব কাঁদোকাঁদো হয়ে এলো। তিনি যে মিথ্যা বলছেন না, তা বিশ্বাসযোগ্যই মনে হলো।
এলসি হল্যাণ্ডকে বিদায় জানানো হলো। তিনি বাচ্চাদের কাছে চলে গেলেন। সুপারিন্টেন্টে কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন।
কয়েক মিনিট পরে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, মনে হয় তিনি সত্য কথাই বলছেন, কোন চিঠি পাননি।
-আমারও তাই মনে হয়। বললাম আমি।
–কিন্তু, আশ্চর্য যা, তা হল, তিনি কোন চিঠি পেলেন না কেন? অথচ…অথচ মহিলা সুন্দরী।
-একটু বেশি রকম সুন্দরীই বলা চলে। আমি সায় দিলাম।
-সুন্দরী এবং তরুণী। বেনামী চিঠির লেখকদের চোখ এমন একজনকে এড়িয়ে গেল কেন? প্রশ্নটা ভেবে দেখার মতো, কি বলেন?
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
–গ্রেভস বলেছিলেন, যারা চিঠি পায়নি তাদের কথাও তাকে জানাতে।
–আরও একজন এমন আছেন। মিস এমিলি বার্টনও কোন চিঠি পাননি।
–একথাটা আমার বিশ্বাস হয় না, বললেন ন্যাস; আমার ধারণা তিনি অবশ্যই চিঠি পেয়েছিলেন। একটা নয়, বেশ কয়েকটাও হতে পারে।
–আপনার এমন ধারণার কারণ কি?
-তার আগেকার পার্লারমেড ফ্লোরেন্স এলফোর্ডই আমাকে কথাটা বলেছে। ওই লেখকের ওপর খুবই রেগে আছে ফ্লোরেন্স।
–তাহলে এমিলি একেবারেই অস্বীকার করে গেলেন কেন কথাটা, বিশেষ করে পুলিস যখন তদন্তে নেমেছে?
-মিস বার্টন বরাবরই একটু অন্য ধরনের মহিলা। নোংরা অরুচিকর জিনিস এড়িয়ে চলতেই অভ্যস্ত তিনি। তাই ওরকম জঘন্য ভাষার চিঠির কথা বলতে স্বভাবতই সঙ্কোচ বোধ করছেন তিনি।
–ওর চিঠিতে কি লেখা ছিল, তা কি জানতে পেরেছেন?
–এসব মারাত্মক কথা যে লিখতে পারে সে বদ্ধ উম্মাদ ছাড়া আর কি। আশ্চর্য হচ্ছি এই লোকটিকে আপনারা খুঁজে বের করতে পারছেন না?
এবারে আমরা ঠিক খুঁজে বার করব অকে, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন ন্যাস, এখানেই সে থামবে না, আরও চিঠি তাকে লিখতে হবে।
আমি ন্যাসের কথাটা মেনে নিতে পারলাম না। বললাম, যা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, মনে হয় এইমুহূর্তে সে আর চিঠি লিখছে না।
লিখবে, না লিখে উপায় নেই তার। এ একধরনের রোগ। কেউ না কেউ চিঠি ঠিক পেতে থাকবে।
বাগানে মেগানের দেখা পেয়ে গেলাম। আগের মতোই আমাকে দেখে হাসিমুখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।
-হাই, বার্টন
আমি মেগানকে বললাম, আমাদের ওখানে গিয়ে তো কদিন থেকে আসতে পার।
-তুমি বললে বলে আমার খুব ভাল লাগছে। কিন্তু এখন এখানেই থাকব ভাবছি। বাচ্চাগুলোকেও একটু দেখাশোনা করতে পারছি।
-ভাল কথা, যেভাবে ভাল থাকবে মনে করো তাই করবে।
–কিন্তু কিন্তু এরকম সাংঘাতিক কিছু ঘটলে তোমাকে ফোন করতে পারব তো?
–অবশ্যই। কিন্তু এরকম ভাবছ কেন তুমি?
–যা সব ঘটে চলেছে, কখন কি হয়
–যাই হোক, ওরকম ভয়াবহ কিছু আর আবিষ্কার করতে যেও না।
উঃ! বড় ভয়ানক সত্যি। আমার খুবই খারাপ লেগেছিল।
মেগানের সঙ্গে কথা শেষ করে ন্যাসকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। যোয়ানাকে সব কথা শোনাতে বসলাম। সেই ফাঁকে ন্যাস গেলেন পারট্রিজের সঙ্গে কথা বলতে।
কয়েক মিনিট পরেই ফিরে এলেন ন্যাস। জানালেন, নতুন কিছু তার কাছ থেকে পাওয়া গেল না।
–অ্যাগনেসের কথাটা ও কি কাউকে জানিয়েছিল? জানতে চাইল যোয়ানা।
–হ্যাঁ, বলেছিল, গম্ভীরভাবে বললেন ন্যাস, আপনাদের কাজের লোক মিসেস এমোরিকে। কোন সমস্যায় পড়ে তার পরামর্শ নিতে চায়–এই ভাবেই সে কথাটা জানিয়েছিল।
-তাহলে মিসেস এমোরির মুখ থেকেই কথাটা বাইরে ছড়িয়ে থাকতে পারে। বলল যোয়ানা।
–আমারও তাই ধারণা মিস বার্টন। বললেন ন্যাস।
–একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝতে পারছি না, বললাম আমি, আমাকে আর আমার বোনকে নিয়ে ওই বেনামী চিঠি কেন লেখা হল? আমরা এখানে সম্পূর্ণ নতুন মানুষ। আমাদের ওপর কারোর তো রাগ থাকার কথা নয়।
-নবাগত তো কি, বললেন ন্যাস, বেনামী চিঠিলেখকের বিদ্বেষ যে কোন সুখী মানবিক মানুষের ওপরেই
-হ্যাঁ, মিসেস ডেন ক্যালQপও এরকমই বলতে চেয়েছিলেন। বলল যোয়ানা।
ন্যাস বললেন, মিস বার্টন, আমার একটা সন্দেহ, আপনার চিঠিটা আসলে মিস বার্টনকেই লেখা হয়েছিল। যদি চিঠির খামখানা ভাল করে লক্ষ্য করতেন, তাহলে ঠিক বুঝতে পারতেন।
–মিস বার্টনকে লেখা? এরকম কেন হতে যাবে? আশ্চর্য হল যোয়ানা।
–নামের ছোট্ট এ অক্ষরটা কৌশলে ইউ করে দেওয়া হয়েছিল, আমার সন্দেহ।
কথাটা শুনে আমিও ভাবিত হলাম। আগে এভাবে কখনো ভেবে দেখিনি।
ন্যাস চলে যাবার পরে যোয়ানাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, হারে, সত্যিই তোর মনে হয়, চিঠিটা মিস বার্টনকে লেখা হয়েছিল?
-না, না, কখনোই না। সুপারিন্টেন্টে বললেই তো হবে না। তাহলে ওরকম কথা লেখা থাকত না।
পরে যোয়ানা বলল, তুই একবার শহর থেকে ঘুরে আয়। সকলে কি বলাবলি করছে তা শোনা দরকার।
–পুলিসের ধারণা বেনামী চিঠির লেখক কোন স্ত্রীলোক। লোকেরাও হয়তো সেরকমই ধারণা করে নিয়ে থাকতে পারে। বললাম আমি।
–পুরুষ হওয়াও বিচিত্র নয়। তবে বিশেষ ধরনের পুরুষদেরই এরকম মানসিকতা থাকে…অবদমিত কামোন্মাদনা। আমার একজনকে সন্দেহ হয়। বলল যোয়ানা।
–কার কথা বলছিস? জানতে চাইলাম আমি।
–মিঃ পাইকেই আমার সন্দেহ হয়। একাকীত্বের বিষণ্ণতায় মোড়া একজন অসুখী মানুষ। মানুষের বিরুদ্ধে ক্ষোভও প্রকাশ করেন। নিশ্চয় লক্ষ্য করে থাকবি, এখানকার সব সুখী মানুষের প্রতিই তার ঘৃণা আর অবজ্ঞা রয়েছে। আর করেন কেমন বেয়ারা ধরনের সব কাজ-লোকে এ নিয়ে আড়ালে হাসিঠাট্টা করে।
-কিন্তু বেনামী চিঠি বিশেষজ্ঞ গ্রেভস বলেছেন, কোন মধ্যবয়স্কা অবিবাহিতা স্ত্রীলোক এসব বেনামী চিঠি লিখছে।
–মিঃ পাইও তাই, অবিবাহিত মধ্যবয়স্ক পুরুষ।
–কিন্তু যো, যতদূর দেখেছি, ওকে ঠিক মানাচ্ছে না।
–বাইরে থেকে এরকম মনে হওয়া স্বাভাবিক। পয়সাওয়ালা ধনী মানুষ। কিন্তু টাকাই তো মানুষের পরিপূর্ণতার পক্ষে যথেষ্ট নয়।
-উনি নিজেও কিন্তু ওরকম চিঠি পেয়েছেন।
প্রতিবাদ জানিয়ে যোয়ানা বলল, এসব কথা আমরা কেউই সঠিক জানি না। তার কাছে। শোনা, তার পক্ষে বানিয়ে বলা অসম্ভব কিছু না।
–আমাদের সুবিধে করে দেবার জন্য, বলছিস?
-হ্যাঁ। কোন রকম বাড়াবাড়ি করেন নি। বেশ বুদ্ধির সঙ্গেই কাজটা করেছেন, বলতে হবে।
–তাহলে তো বলতে হয়, উনি একজন পাকা অভিনেতা।
তাছাড়া আর কি। অভিনেতা না হলে এরকম কাজ করে চলা সম্ভব হয় কখনো?
যোয়ানার অভিনব আবিষ্কার আমার বিরক্তিরই সৃষ্টি করল। বললাম, এমন ভাব দেখাচ্ছিস, যেন তুই সব জেনে ফেলেছিস। বেনামী চিঠির লেখকের মানসিকতা বোঝা অত সহজ কাজ নয়, এটা মনে রাখিস।
তুই বলতে পারিস। কিন্তু, জেরি, আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি। আমার কথাই ধর না, যদি আমি তরুণী আর মোটামুটি সুন্দরী হাসিখুশি সুখী মানুষ না হয়ে জেলে থাকতাম আর সকলকে জীবন উপভোগ করতে দেখতাম, তাহলে আমার মনে এমন এক শয়তানীর জম্ম হত, যে সকল সুখী মানুষকে আঘাত করতে চাইত, কষ্ট দিয়ে আনন্দ উপভোগ করতে চাইত।
একটু থামল যোয়ানা। আমার দিকে তাকিয়ে পরে বলল, পুলিস যদি এমনি দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটাকে দেখার চেষ্টা করত, তাহলে মনে হয়, রহস্য ভেদ করা তাদের পক্ষে সহজ হত, ওই লোকটা, তুই যদি তার মানসিকতা অনুভব করবার চেষ্টা করিস, তাহলে সহজেই বুঝতে পারবি। এরপর এসব লোক কি করতে চাইবে তা অনুভব করাও তোর পক্ষে অসম্ভব হবে না।
অত সব ছাইপাঁশ ভাববার জন্য আমি এখানে এসেছিলাম, নাকি, বিরক্তির সঙ্গে বললাম আমি। ওসব অশ্লীল চিঠি আর খুনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকলে কোনদিনই স্বাস্থ্য উদ্ধার হবে না।
.
যোয়ানার কথামতো হাইস্ক্রীটে এসে দেখলাম, এখানে ওখানে লোকের জটলা। কি নিয়ে তারা আলোচনা করছে অনুমান করতে কষ্ট হল না।
প্রথমেই চোখ পড়ল গ্রিফিথের ওপর। কেমন রুগ্ন আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে।
–দেখে মনে হচ্ছে খুবই ভেঙ্গে পড়েছেন। বললাম আমি।
হতে পারে। বেশ ঝামেলার কিছু কেস নিয়ে পড়েছি। বললেন গ্রিফিথ।
–বেনামী চিঠির লেখকও এরমধ্যে রয়েছে?
–অস্বীকার করি কি করে? এধরনের মানসিক অত্যাচার
–লোকটা কে হতে পারে, আপনার কোন ধারণা আছে?
–একদম না। তবে ধারণা করতে পারলে বোধহয় বেঁচে যেতাম।
কথা বলার ফাঁকেই দেখতে পেলাম ডাক্তারের বোন এমি আসছে। তার সঙ্গে কথা বলার উদ্দেশ্যে গ্রিফিথকে বিদায় দিলাম।
-শুনলাম, আপনি বেশ তাড়াতাড়িই ওখানে হাজির হয়েছিলেন?
প্রায় চিৎকার করে বলতে বলতে এগিয়ে এলো এমি।
-আসলে গতকাল রাতে মেয়েটার আমাদের বাড়িতে চা খেতে আসার কথা ছিল। আসেনি বলে অস্বস্তি বোধ করেছিলাম।
বললাম আমি, মেগান যে আমাকে ফোন করেছিল সে কথাটা ইচ্ছে করেই চেপে গেলাম।
–এলো না বলে, আশ্চর্য বলতে হবে, আপনি সবচেয়ে খারাপটাই ভেবে নিতে পেরেছেন। আর আপনার ভাবনাটাই সত্যি হল শেষ পর্যন্ত।
আমি অর্থহীন ভঙ্গীতে হাসলাম। কোন জবাব দিলাম না।
–লিমণ্টকে খুনের ঘটনা এই প্রথম ঘটল। তাই উত্তেজনা সকলের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিস এসব কি করে সামাল দেয় দেখা যাক।
-পুলিস সম্পর্কে আমি আশাবাদী, বললাম আমি, তাদের মধ্যে অনেক লক্ষ্য লোক রয়েছে।
-ওয়েলের কাছে শুনলাম, প্রথমে মাথায় মেরে ওকে অজ্ঞান করে ফেলা হয়, পরে মাথার পেছনে ছোরা বিধিয়ে মারে। মেয়েটার ছেলেবন্ধুই একাজ করেছে বলে আমার ধারণা। আপনার কি মনে হয়?
–এরকমই সম্ভব বলছেন? আমি প্রশ্ন করলাম।
–অসম্ভব কেন? ওদের নাকি খুব ঝগড়া হয়েছিল। শুনলাম মেগান হান্টার নাকি প্রথমে মৃতদেহটা দেখতে পেয়েছিল। বেচারি নিশ্চয় খুব শক পেয়েছে।
সত্যিই মেয়েটা মনে বড় চোট পেয়েছে। বললাম আমি।
সেই মুহূর্তে একটা কথা মনে পড়ে গেল আমার। ব্যাপারটা যাচাই করে নিতে চাইলাম এই সুযোগে।
–একটা কথা, মিস গ্রিফিথ, মেগানকে বাড়ি ফিরে যাবার কথা গতকাল আপনিই কি বলেছিলেন?
–তেমন জোর দিয়ে কিছু বলিনি অবশ্য।
–তাই বলুন, আমি বললাম, আমিও তাই অনুমান করেছিলাম।
এমি গ্রিফিথ আমার চোখের দিকে তাকালেন। পরে সতর্কতার সঙ্গে বললেন, মেয়েটার তো বয়স অল্প, সব ব্যাপারটা বুঝতে পারে না। তাই ওকে একটু সতর্ক করেই দিতে চেয়েছিলাম। কখন কি কথা ছাড়াবে–এখানে কেউ বলতে পারে না।
–কি কথা ছড়াবে?
আমি স্পষ্ট বিরক্তি প্রকাশ না করে পারলাম না।
–লোকে কি বলে সে সম্পর্কে মনে হয় আপনার কোন ধারণা নেই। আমার কানে অনেক কথাই আসে, তাই আমি জানি।
লোকেরা খারাপটাই বলে–আর যে মেয়েকে কাজ করে তার জীবিকা অর্জন করতে হয়, সহজেই সে অন্যের আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে।
–আপনি কি বলতে চাইছেন, ঠিক ধরতে পারছি না।
আমি সত্যিই ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে আবার জীবিকার প্রশ্ন আসছে কি করে?
-আমি এলসি হল্যাণ্ডের কথা বলছি, বুঝতে পারছেন না, বললেন এমি, লোকে যাই বলুক, আমার ধারণা ও সত্যিকার ভাল মেয়ে। লোকের কথায় কান দিয়ে বাচ্চাগুলোর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে চাকরিতে জবাব না দিয়ে ও যথার্থ কর্তব্যই করেছে।
–লোকে কি বলছে?
এমির মুখে হাসি মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। খারাপ ইঙ্গিতপূর্ণ বলেই আমার মনে হল।
লোকে বলাবলি করছে, ও দুই নম্বর মিসেস সিমিংটন হওয়ার চেষ্টা করছে। যে ভাবে সদ্য স্ত্রীহারা মানুষের সেবাযত্ন করে চলেছে
আমি বেশ ধাক্কা খেলাম। বললাম, এসব কী? মিসেস সিমিংটন মারা গেছেন সবে এক সপ্তাহ হল–
-আমিও তাই অসম্ভব বলেই ভাবছি, কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাসলেন মিস গ্রিফিথ, মানুষের মন যে কি বস্তু তা তো জানেন। মেয়েটা তরুণী, তার ওপর বেশ সুন্দরী–লোকেরা যা চায় তার সবই রয়েছে। তবে যদি সত্যি সত্যি এমন কিছু ঘটনা থেকে থাকে, মেয়েটাকে আমি দোষ দিতে পারব না। সবমেয়েই ঘর আর বর চাইবে–এতে বিচিত্র কি?
আমার মুখ দিয়ে কথা সরছিল না। হাঁ করে তাকিয়ে মিস গ্রিফিথের কথা শুনে যেতে লাগলাম।
তবে এটা ঠিক, মিঃ সিমিংটন মেয়েটার মনের কথা কিছুই জানেন না। স্ত্রীর এমন মৃত্যুর পরে তার এখন দিশাহারা অবস্থা। মেয়েটা যেভাবে ভদ্রলোকের দেখাশোনার ভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছে, তাতে তার নির্ভরশীল না হয়ে উপায় কি?
–তাহলে বলছেন, এলসি হল্যাণ্ড মেয়েটার অবস্থা বুঝেই সুযোগটা নিয়েছে?
–ঠিক সেকথা বলছি না, ইতস্তত করে বললেন মিস গ্রিফিথ, মেয়েটার জন্য আমার দুঃখ হয়। আসলে লোকের এসব কুৎসিত কথা ভেবেই মেগানকে আমি বলেছিলাম, ওর বাড়িতে যাওয়া উচিত। মিঃ সিমিংটন আর ওই মেয়েটা শুধু এই দুজন বাড়িতে থাকা ভাল দেখায় না।
আসল রহস্যটা এতক্ষণে ঝরঝরে হল আমার কাছে। আমি নির্বিকার দৃষ্টি ফেললাম মুখরা স্ত্রীলোকটির মুখের ওপর।
–আমাদের এই ছোট্ট শহরের মানুষজন খুব সুবিধার নয় মিঃ বার্টন। এরা সবকিছুর মধ্যেই কু খুঁজে বেড়ায়।
কথা শেষ করে হেসে বিদায় নিলেন মিস গ্রিফিথ।
.
গীর্জার কাছে এসে মিঃ পাইয়ের সঙ্গে দেখা হল। তিনি মিস এমিলি বার্টনের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
-সুপ্রভাত মিঃ বাৰ্টন, উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন মিঃ পাই, এমন একটা খবর যে আমাদের এই গ্রামে সৃষ্টি হবে, কল্পনা করতে পারিনি। এসব খবর রবিবারের খবরের কাগজে পেয়ে এসেছি এতকাল।
-সত্যিই বড় শোচনীয়। মিস বার্টন প্রতিধ্বনি তুললেন।
-আপনি এর মধ্যে নিশ্চয় উত্তেজনার খোরাকও পেয়েছেন মিস বার্টন, বলুন ঠিক বলছি কিনা। বেশ উপভোগ করছেন যে আপনার কথা শুনেই বুঝতে পারছি।
–মেয়েটা আমার কাছে কাজ করতে এসেছিল সরাসরি একটা অনাথ আশ্রম থেকে। সরল গ্রাম্য মেয়ে। তবে চমৎকার কাজের ছিল। পারট্রিজ ওকে খুব পছন্দ করত। বললেন মিস বার্টন।
গতকাল বিকেলে পারট্রিজের কাছে চা খেতে আসবে বলেও জানিয়েছিল, আমি বললাম। পরক্ষণে মিঃ পাইয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, সম্ভবত কথাটা মিস গ্রিফিথ আপনাকে জানিয়ে থাকবে।
মিঃ পাইয়ের মনে যাতে সন্দেহ না হয় সেই উদ্দেশ্যেই আমি প্রসঙ্গক্রমে কথাটা উত্থাপন করলাম।
-হ্যাঁ, বলেছিলেন, বললেন মিঃ পাই, তার কথায় অবশ্য শ্লেষ ছিল। বলেছিলেন, আজকাল কাজের লোকেরাও বাড়িতে ফোন করে কথা বলে।
–কথাটা আমারও আশ্চর্য লাগছে, আমার বাড়িতে কাজ করা অ্যাগনেস একাজ কেন করল? পারট্রিজ নিশ্চয়ই অবাক হয়েছিল।
–আপনার সেকেলে মনোভাব এখনো পাল্টায়নি মিস বার্টন, বললেন মিঃ পাই, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়েই সমাজে পরিবর্তনগুলো হয়। আজকাল বাড়ির কাজের লোকেরা একটু বেশি স্বাধীনতা পেয়ে থাকে, এ নিয়ে বকাঝকা করা চলে না।
আলোচনার মোড় ঘোরাবার উদ্দেশ্যে আমি বললাম, খুনের কথাটা খুব তাড়াতাড়িই দেখছি ছড়িয়ে পড়েছে।
-কেবল কি তাই–সঙ্গে গুজবও রয়েছে। বললেন মিঃ পাই, প্রথমে ছিল বেনামী চিঠি, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে খুন, লিমন্টকের মানুষ এরপর চনমনে না হয়ে পারে?
–এই দুটো ঘটনার মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে লোকেরা নিশ্চয় এরকম কিছু ভাবে না। বললেন এমিলি বার্টন।
–আপনি একেবারে খাপে খাপে মিলিয়ে দিয়েছেন, দারুণ, বলে উঠলেন মিঃ পাই, নিশ্চয় মেয়েটা কিছু জানত, তাই তাকে খুন করা হয়েছে। আপনার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়।
–সারাক্ষণই এসব শুনে চলেছি। আর ভাল লাগছে না।
বলে মিস এমিলি তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে হাঁটতে শুরু করলেন।
আমি মিঃ পাইয়ের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম, এসমস্ত ঘটনা মানে বেনামী চিঠি..খুন..এসব দেখেশুনে আপনার কি মনে হচ্ছে?
মাথা নিচু করে একমিনিট কি ভাবলেন মিঃ পাই। পরে গম্ভীরভাবে বললেন, দেখুন, পুলিস যা সাধারণত করে থাকে–হাতের ছাপ, হাতের লেখা এসব বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখা–আমার ধারণা এভাবে বেশিদূর তারা এগুতে পারবে না। চরিত্র অনুধাবন করার পদ্ধতি অনুসরণ করাই এক্ষেত্রে সঠিক পথ। মানুষের কাজ, তাদের ভাবভঙ্গী, ভাবনাচিন্তার ধারা–এসব থেকেই প্রকৃত রহস্যের সন্ধান পাওয়া সম্ভব বলে আমি মনে করি।
এভাবে সম্ভব বলছেন? বললাম আমি।
–এ না হলে পুলিস কোনদিনই তার সন্ধান পাবে না।
–আপনি কার কথা বলতে চাইছেন? আমি অনুসন্ধিৎসু হলাম।
–ওসব কথা জিজ্ঞেস করবেন না মিঃ বার্টন, আমি দুর্নাম রটনার অপবাদ নিতে পারি না। কথাটা বলে তাড়াতাড়ি সরে পড়লেন মিঃ পাই।
.
আরও কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ ঘোরাঘুরি করে বাড়ির পথ ধরলাম আমি।
গতকালকের খুন সম্পর্কে অনেককেই মন্তব্য করতে শোনা গেল, কোন জঘন্য ভবঘুরের কাজ বলে।
লিটলফার্জে পৌঁছে দেখলাম ড্রইংরুমে জানালার ধরে বসে যোয়ানা একটা ছবি দেখছে।
–কি দেখছিস অমন মনোযোগ দিয়ে কোন নতুন বন্ধুর ছবি মনে হচ্ছে।
ওর পাশে বসতে বসতে বললাম।
-কাছাকাছি পৌঁছেছিস, হেসে ছবিটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল, দেখতো চিনতে পারিস কিনা?
ছবিটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম। কিন্তু কিছু বোধগম্য হল না।
–কি এটা? জানতে চাইলাম আমি।
–মনে হয় প্লীহা বা ওই জাতীয় কিছুর ছবি। ডাঃ গ্রিফিথের মনে হয়েছে এটা দেখলে, আমি খুশি হব, তাই দিয়ে গেছেন।
আমি আগ্রহের সঙ্গে ফটোটার দিকে তাকালাম। কিন্তু মোটেই ভাল লাগল না। যোয়ানাকে সে কথা বললাম।
–জিনিসটা খুব খারাপ দেখতে। আমার সঙ্গেও গ্রিফিথের দেখা হয়েছিল হাইস্ক্রিটে। তোর কিরকম মনে হল ওকে?
–ওকে কেমন ক্লান্ত লাগছিল। মনে হল কোন বিষয় নিয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে আছে।
-তোর কথাই হয়তো তার মন জুড়ে বসেছে। তাই অমন বিদঘুঁটে একটা প্লীহার ছবি তোকে দিয়ে গেছে।
বাজে বকিস না তো।
–বলে বিরক্তির সঙ্গে উঠে দাঁড়াল যোয়ানা। তারপর ঘর ছেড়ে ভেতরে চলে গেল।
প্লীহার ফটোটা রোদের তাতে পাকিয়ে যাচ্ছিল। আমি সেটা তুলে নিলাম। যোয়ানা বা আমার জিনিসটা পছন্দ না হলেও গ্রিফিথের কাজে লাগতে পারে। ওটাকে এভাবে নষ্ট হতে দেওয়া ঠিক হবে না।
বইয়ের সেলফ থেকে একটা মোটা বই টেনে বার করলাম। ওর মধ্যে চাপে রেখে পাকিয়ে যাওয়া ছবিটা ঠিক করা যাবে।
কিন্তু বইটা হাতে নিতেই অদ্ভুতভাবে সেটা খুলে গেল। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, বইয়ের মাঝখান থেকে বেশ কিছু পৃষ্ঠা নিখুঁতভাবে কেটে নেওয়া হয়েছে।
হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম বইটার দিকে। পরে গোড়ার পৃষ্ঠাটা খুলে দেখে নিলাম–বইটার ছাপা হওয়ার তারিখ লেখা হয়েছে ১৮৪০ খ্রিঃ।
চকিতে মাথায় খেলে গেল একটা কথা। এই বইয়ের কাটা পৃষ্ঠাগুলো থেকে অক্ষর কেটেই বেনামী চিঠিগুলো লেখা হয়েছিল।
কিন্তু কে এমন কাজ করতে পারে? কার পক্ষে এটা সম্ভব?
মিস এমিলি বার্টনের কথাই প্রথমে মনে পড়ল। পারট্রিজের হওয়াও অসম্ভব নয়। বাইরের কোন লোকও হতে পারে। হয়তো সে এমিলির জন্য অপেক্ষা করে কিছু সময় এঘরে ছিল।
কোন অতিথি যদি হয়ে থাকে, তবে কে সে? সমাজের অতি সম্মানিত একজন বলেছেন গ্রেভস। তাহলে কি মিঃ পাই? এমি গ্রিফিথ? না মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ?