১১.
–শুনলাম রাদারফোর্ড হলে আপনি চায়ের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন?
-হ্যাঁ, সকলকে একপলক দেখার ইচ্ছে হয়েছিল। প্রিয় লুসিই ব্যবস্থাটা করে দিয়েছিল। বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি।
সেই সময় লুসি মিস মারপলের ঘরেই উপস্থিত ছিল। কাজের অবসরে সে তাকে সাহচর্য দিতে এসেছিল।
বর্তমান খুনের সম্ভাব্য কারণ হাতড়ে আমি তল পাচ্ছি না। বুঝলেন মিস আইলেসব্যারো
লুসির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন ক্রাডক, আমার ধর্মপিতা বলেছিলেন, ঈশ্বরের সৃষ্ট সমস্ত অপরাধসন্ধানী গোয়েন্দার মধ্যে মিস মারপল হলেন সবার সেরা। সহজাত প্রতিভা অনুকূল পরিবেশে বিকাশলাভ করেছে।
-বুঝলে লুসি, তোমাকে তো বলেছিলাম, ক্রাডকের ধর্মপিতা স্যার হেনরি ক্লিারিং আমার অনেক কালের পুরনো বন্ধু। বড় সহৃদয় মানুষ তিনি।
–আমি বুঝতে পারছি তিনি আপনার সম্পর্কে মিথ্যা প্রশস্তি করেননি। বলল লুসি।
-আসলে কি জান, আমার যেটুকু বিচক্ষণতা তাহল, মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে সামান্য কিছু ধারণা। অজ পাড়াগাঁয়ে থেকে বিদ্যেবুদ্ধি আর কি হবে বল। তা তোমার অগ্রগতি কতদূর বল।
–আমি একটা ঢিল ছুঁড়েছি। ২০ ডিসেম্বর শুক্রবার দিন কে কি করছিল, হারল্ড আর আলফ্রেডকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আচ্ছা, মিস আইলেসব্যারো, বাড়িতে এখন কে কে আছে?
–কেড্রিক এখনো আছে। উইক এন্ডের ছুটি কাটাতে ব্রায়ান এসেছে। আজ সকালেই ফোন করে জানিয়েছে, হারল্ড আর আলফ্রেড কাল আসবে। ইনসপেক্টর ক্রাডক এবার তাহলে তো বেশ একটা আলোড়ন উঠবে বুঝতে পারছি।
ক্রাডক হাসলেন। বললেন, কেড্রিকের সঙ্গে কথা বলতে হবে। একটু পরেই রাদারফোর্ড হলে যাচ্ছি আমি।
–তারা তোমাকে জবাব দিতে পেরেছে? জানতে চাইলেন মিস মারপল।
-হ্যারল্ড দিয়েছে। তবে আলফ্রেড ধরা দিতে চায়নি। অ্যালিবি তদন্ত করে দেখতে হবে। ভালো কথা, কোনো সময় গেলে ডাঃ কুইম্পারকে ধরা যাবে?
–ডাঃ তার রোগী দেখতে আসেন ছটায়। সাড়ে ছটা অবধি থাকেন। ওহ্, আমাকে এখনি উঠতে হবে। ডিনারের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যস্ত হল লুসি।
মিস আইলেসব্যারো, একটা ব্যাপার আপনার কাছ থেকে জানতে চাই। ওই মার্টিন নামের মেয়েটির সম্পর্কে ওদের মনোভাব কি রকম?
–বেচারী এমা তো আপনার কাছে গিয়েছিল বলে সবারই মুখে শুনেছি। ডাক্তার এমাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন বলে তার ওপরেও সবাই খাপ্পা। মার্টিনের ব্যাপারটাকে ওরা তিন ভাইই ধাপ্পা আর দুরভিসন্ধিমূলক বলেই মনে করে। এব্যাপারে ব্রায়ানই ব্যতিক্রম। মানুষটিও সাদামাটা, মনে প্যাঁচগোজ নেই। তার বিশ্বাস, মেয়েটি সত্যিই এডমান্ডের বিধবা স্ত্রী। বিশেষ কোনো কারণে ফ্রান্সে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে, তবে তার খবর আবার পাওয়া যাবে।
এমার মনে কিছুটা অনিশ্চয়তা রয়েছে।
–তোমার সম্পর্কে সকলেরই বেশ আগ্রহ লক্ষ্য করলাম। বললেন মিস মারপল।
এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লুসি হাসতে হাসতে বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্পের বিবাহপ্রস্তাব সহ তার দুই ছেলের বিশেষ দুই প্রস্তাবের কথা বিস্তারিত ভাবে বলল।
সবশেষে বলল, আসলে, আমি বুঝতে পারি, ওদের আগ্রহের কারণটা হল, সকলেই ভাবছে আমি অনেক কিছু জানি।
-বুঝতে পারছি, খুব বিপজ্জনক পরিস্থিতি। সতর্ক থাকবেন। লোভনীয় প্রস্তাবই শেষ কথা নয়, খুনও হয়ে যেতে পারেন।
লুসি শিউরে উঠল। বলল, কথাটা মনে করিয়ে দিয়ে ভালো করেছেন।
-বাচ্চা দুটি এখনো আছে? জিজ্ঞেস করলেন মিস মারপল।
–কাল ওরা জেমস স্টডার্ডের বাড়ি যাচ্ছে। ছুটির শেষ কটা দিন ওখানেই ওরা কাটাবে।
-ভালো খবর। ওদের উপস্থিতিতে গুরুতর কিছু না ঘটলেই মঙ্গল। তাছাড়া ওদের ওপরও আক্রমণ হতে পারে।
–কি বলছেন, ছেলেদের ওপর? অবাক হল লুসি।
–হ্যাঁ, আলেকজান্ডারের ওপর।
-ওই বয়সী ছেলেরা অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় হয়ে থাকে। একটা খুনের রহস্যের সন্ধান করে বেড়ানো খুবই রোমাঞ্চকর। কিন্তু কাজটা বিপদ ডেকে আনতে পারে।
–মিস মারপল, ক্রাডক বললেন, বর্তমান ঘটনাটাকে রাদারফোর্ড হলের পারিবারিক ব্যাপার বলেই মনে করছেন?
–দ্বিতীয় ঘটনা হল একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি কর্তৃক অপরিচিত স্ত্রীলোক হত্যা-এই দুয়ের মধ্যে নিশ্চিত সম্পর্ক রয়েছে।
খুনী বলে একজন লম্বা কালো লোকের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। আমি ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখেছি ওরকম লম্বা কালো লোক রাদারফোর্ড হলে তিনজন আছে। তবে তিন ভাইই লম্বা আর কালো হলেও তিনজনের চেহারাই স্বতন্ত্র। আসল লোককে খুঁজে বার করা এ কারণেই কঠিন হয়ে উঠেছে।
–আমার কিন্তু ধারণা কাজটা অতটা জটিল আর কষ্টসাধ্য নয়।
–মার্টিনের কাহিনী আপনি সত্যি বলে মনে করেন? বললেন ক্রাডক।
–এডমান্ড ক্রাকেনথর্প যে মার্টিন নামের একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিল কিংবা বিয়ে করতে চেয়েছিল–এমার কাছে লেখা এডমান্ডের চিঠিতে তা পরিষ্কার। চিঠিটা নিশ্চয় তুমি দেখে থাকবে। কোনো মিথ্যা কাহিনী শুনিয়ে এমার কি লাভ?
–মার্টিন, এডমান্ডের পুত্রসন্তান, পরিবারের সম্পত্তির উত্তরাধিকার-খুন, এদিকে সবকটি ভাইয়ের আর্থিক অবস্থার সঙ্কট, একেবারে জটপাকানো অবস্থা। খুনটাকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারের সঙ্গে জড়িয়ে দেখতে গেলে একমাত্র লুথার ক্রাকেনথর্পের মৃত্যুতেই সকলের লাভবান হবার সম্ভাবনা।
মার্টিনের হত্যা, সম্পত্তির উত্তরাধিকারের পরিমাণে খুব সামান্যই হেরফের ঘটাবে।
–তাহলে খুনটাকে তুমি নিরর্থক বলতে চাইছ? বললেন মিস মারপল।
–কিন্তু বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প এখনো অনেক বছর বাঁচবেন। বলল লুসি।
–ডাক্তারেরও তাই অভিমত। বললেন ক্রাডক।
–অবশ্য ক্রিসমাসের সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তখন ডাক্তার এমন ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছিলেন যেন বৃদ্ধকে কেউ বিষ প্রয়োগ করেছে। বলল লুসি।
-আমি ঠিক এই ব্যাপারটা নিয়েই ডাঃ কুইম্পারের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
–এই সর্বনাশ, অনেক দেরি হয়ে গেছে
লুসি তাড়াহুড়ো করে উঠে পড়ল।
মিস মারপলের কোলের ওপরে টাইমস পত্রিকাখানা ধরা ছিল। তিনি শব্দ-সমাধান মেলাতে বসেছিলেন। এখন পত্রিকার দিকে চোখ ফেলে বলে উঠলেন, টিনটিন আর টোকে–কোনোটি যে হাঙ্গেরীয় মদের নাম খেয়াল রাখতে পারি না।
–টোকে হল হাঙ্গেরীয় মদের নাম, বলল লুসি, সাত অক্ষর আর পাঁচ অক্ষরের শব্দ, সংকেত কি আছে?
-ক্ৰশওয়ার্ড পাজল নয় মেয়ে, মনে হল হঠাৎ কথাটা
ইনসপেক্টর মুখের দিকে তাকিয়ে মিস মারপলের মনের ভাব বুঝবার চেষ্টা করলেন।
.
১২.
–ডাঃ কুইম্পার, একটা ব্যাপারে একটু খোলাখুলি কথা বলতে চাই আপনার সঙ্গে, তবে অবশ্যই ঘরোয়া ভাবে।
–আপনাদের ওই ঘটনার সঙ্গে আমার তো কোনো সম্পর্ক নেই, ইনসপেক্টর।
-না, সেসব বিষয় নয়। জানতে পারলাম ক্রিসমাসের সময় বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প একটু বাড়াবাড়ি রকমের অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন?
–হ্যাঁ, সত্যি কথা।
–হজমের গোলমাল বলে আপনি সন্দেহ করেছিলেন
–ঠিকই বলেছেন।
ডাক্তার কুইম্পারের মুখভাব সহসা কঠিন হয়ে উঠল। ক্রাডক লক্ষ্য করলেন।
-আমি আরও জেনেছি, বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্পের খাদ্য ও পানীয় সম্পর্কে আপনি এমন খুঁটিনাটি প্রশ্ন সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন যাতে মনে হতে পারে, আপনি খাদ্যে বিষ প্রয়োগের সম্ভাবনা আঁচ করেছিলেন। আমার জিজ্ঞাসা হল, আপনি সত্যিই কি সে ধরনের কিছু সন্দেহ করেছিলেন?
–আপনি যখন ঘরোয়া ভাবেই জানতে চাইছেন, ইনসপেক্টর আমি খোলাখুলিই বলতে পছন্দ করব, সেদিন বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্পের মধ্যে যে লক্ষণগুলো প্রকাশ পেয়েছিল, তাতে গ্যাস্ট্রো এন্টারাইটিসের চেয়ে আর্সেনিক প্রয়োগের চিহ্নই বেশি প্রকট ছিল।
–ডাক্তার আপনার জানা থাকতে পারে, পরিবারের ছেলেমেয়েরা সকলেই আর্থিক সঙ্কটে ভুগছে। বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্পের মৃত্যুতে তাদের সকলেরই লাভবান হবার সম্ভাবনা।
–আপনি কি বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি। তবে এমাকে আপনার সন্দেহের বাইরে রাখবেন। সকলে যখন একসঙ্গে হয়, তখনই বৃদ্ধের ওপর এধরনের আক্রমণ হয়। আগেও দু-একবার এমন হয়েছে। কিন্তু এমা আর বৃদ্ধ একা যখন থাকে তখন কিছু হয় না।
-খুবই লক্ষণীয়। যদি ধরে নেওয়া যায় যে আর্সেনিক প্রয়োগ হয়েছিল, তাহলে ক্রাকেনথর্প যে বেঁচে গেলেন তার কারণ কি?
–সূক্ষ্মমাত্রার প্রয়োগ। বললেন ডাক্তার, আমি অনেক ভেবেছি, কিন্তু বিষপ্রয়োগকারী প্রতিবারেই মাত্রাটা কেন চেপে রাখছে বুঝতে পারছি না। অবশ্য যদি সত্যি সত্যি একজন বিষপ্রয়োগকারী থেকে থাকে। এমনও হতে পারে সবটাই আমার চিন্তার বাড়াবাড়ি।
-খুবই ভাবনার ব্যাপার হল। বললেন ক্রাডক।
.
-স্যার, আমরা একটা সূত্র খুঁজে পেয়েছি।
ক্রাডক সবে দরজায় বেল বাজাতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় আলেকজান্ডার আর স্টডার্ড ওয়েস্ট সামনে এসে দাঁড়াল।
ক্রাডক একটু কৌতুক বোধ করলেন। বললেন, খুব ভালো কথা। চল বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখব।
–ভেতরে নয় স্যার, অলেকজান্ডার বলল, সবার সামনে বলা ঠিক হবে না, চলুন একটা গোপন জায়গায় গিয়ে আপনাকে বলব।
ক্রাডক কৌতুক বোধ করলেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি ছেলেদুটির সঙ্গে চললেন।
আস্তাবলের উঠোনের প্রান্তে ঘোড়ার সাজসরঞ্জাম রাখার একটা ছোট ঘর। ভারি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল আলেকজান্ডার। হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে আলো জ্বালল। ক্রাডক ঘরে ঢুকে দেখলেন, বাগান করার মরচে ধরা যন্ত্রপাতি, ঘেঁড়াখোঁড়া, স্প্রীংয়ের গদি, ছেঁড়া টেনিস নেট, এমনি নানা পরিত্যক্ত জিনিসে ঘর বোঝাই। তার মধ্যেই একপাশে খানিকটা ফাঁকা জায়গা–সদ্য সাফ করা হয়েছে বোঝা যায়। পরিত্যক্ত গাছগুলো পেতে বসার ভালো জায়গা করে নেয়া হয়েছে।
-স্যার, আমরা আঁতিপাতি করে, সব জায়গায় খুঁজেছি–বলল আলেকজান্ডার, পরে এমন একটা জিনিস পেয়েছি, ঠিক বলছি একটা মোক্ষম সূত্র
-আজ সন্ধ্যাবেলায়ই এটা পেয়েছি আমরা। বলল স্টডার্ড।
-বয়লার হাউসে হিলম্যান একটা মস্ত গামলা রেখেছে, বাজে কাগজে ভর্তি–সেই কাগজের স্কুপে
আলেকজান্ডার একটা ফটো রাখার ফোল্ডারের ভেতর থেকে সাবধানে তুলে ধরল একটা দোমড়ানো ধূলি মলিন খাম।
ক্রাডক বেশ মজা অনুভব করছিলেন। তার মনে কি কোনো সম্ভাবনার প্রত্যাশার ইশারাও ছিল না?
খামটা হাতে নিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, খামটা ফাঁকা, তবে ডাক মারফত এসেছে। ওপরের ঠিকানাটা দেখে চমকে উঠলেন, মিসেস মার্টিন ক্রাকেনথর্প, ১২৬, এলভার্স ক্রেসেন্ট, এন-১০।
-নামটা চিনতে পারছেন, এডমান্ড কাকার ফরাসি স্ত্রী, তাকে নিয়েই তো সবাই হৈ চৈ করছে। এটা থেকে বোঝা যায় তিনি এখানে এসেছিলেন। চিঠিখানা হয়তো কোথাও পড়ে গেছে
–পাথরের কফিনে এরই মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে, তাই মনে হচ্ছে না স্যার? বলল স্টডার্ড।
-চলে যাওয়ার আগে আমরা একটা দারুণ কাজ করলাম বলুন? আলেকজান্ডার বলল।
–তোমরা চলে যাচ্ছ?
–হ্যাঁ, কালই চলে যাচ্ছি স্টডার্ডের বাড়ি। ছুটি শেষ হলে ওখান থেকেই স্কুলে চলে যাব।
ক্রাডক ক্রমেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। খামের ওপর ডাকঘরের সিল যথাযথ আছে। ছেলেদের খুশি করার জন্য লুসি যে গোপনে কোনো কারচুপি করেনি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবু নিঃসন্দেহ হতে পারছিলেন না তিনি। চিঠিটা যদি সত্যি সত্যি ছেলে-ঠকানো কিছু না হয় তাহলে ঘটনার ওপরে নিঃসন্দেহ একটা নতুন আলোকপাত হবে।
-সত্যি, দারুণ কাজ করেছ তোমরা। অনেক উপকার হবে। চলো এবারে বাড়ি যাওয়া যাক।
দুই বন্ধুর পিঠ চাপড়ে দিলেন ক্রাডক।
.
১৩.
সার্জেন্ট ওয়েদারবলের তদন্তের রিপোর্টের ওপর চোখ বোলাচ্ছিলেন ক্রাডক।
হ্যারল্ড ক্রাকেনথর্পের ২০ ডিসেম্বর তারিখের অ্যালিবি হল সেদিন বিকেলে তাকে সোথবিতে দেখা গিয়েছিল। সেখানে অল্পসময় ছিলেন। রাসেলের সেই চায়ের দোকানের তিনি নিয়মিত খদ্দের নন। তাই ফটোগ্রাফ কেউ চিনতে পারেনি। ডিনারের পোশাক পরার জন্য কার্ডিগান গার্ডেনসের বাড়িতে এসেছিলেন পৌনে সাতটায়। বাড়ির ভৃত্যের সমর্থন পাওয়া গেছে। সে অবশ্য বলতে পারেনি রাতে তার মনিব কখন ফিরে এসেছিল। গাড়ি রাখার গ্যারেজে এমন কেউ ছিল না যার কাছ থেকে গাড়ির মালিক সম্পর্কে কিছু জানা যায়। ক্যাটারার্স ডিনারেও উপস্থিত ছিলেন হারল্ড। তবে নির্ধারিত সময়ের আগেই চলে গিয়েছিলেন।
–সবই দেখছি ঠিকঠাক বলছে। রেলস্টেশনগুলোতে খবর নিয়েছিলে? জিজ্ঞেস করলেন ক্রাডক।
–হ্যাঁ স্যার। চার সপ্তাহ আগের ঘটনা কার কি মনে থাকবে বলুন।
এর পর কেড্রিক সম্পর্কে রিপোর্টও হারল্ডের মতই না-সূচক।
হতাশ ভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ক্রাডক।
–আলফ্রেডের রিপোর্টও কি তাই?
–আলফ্রেডের শেষ অনুচ্ছেদটা দেখুন স্যার।
সেখানে চমকপ্রদ বিবরণই পাওয়া গেল। রীতিমত চনমনে হয়ে উঠলেন ক্রাডক।
লরি থেকে চুরির একটা ঘটনার তদন্তের জন্য ২০ ডিসেম্বর রাত সাড়ে নটায় সার্জেন্ট লাকি মোতায়েন ছিলেন ওয়ার্ডিংটন-ব্র্যাকহ্যাম্পটন রাস্তার মোড়ে একটা ইটভাটার কাছে। সেই সময় পাশের একটা টেবিলে সে দেখতে পায় চিফ ইভান্স ডিকি রজার্সের দলের একজনকে। তার সঙ্গী আলফ্রেড ক্রাকেনথর্পকে সে চিনতে পারে। ডিকি রজার্সের মামলায় তাকে সে সাক্ষী দিতে দেখেছিল। একারণে সে তার ওপর নজর রাখতে থাকে।
কয়েক মিনিট পরে আলফ্রেড বাসে উঠে ব্র্যাকহ্যাম্পটনের দিকে চলে যায়।
ব্র্যাকহ্যাম্পটন স্টেশনের টিকিট কালেক্টর উইলিয়ম বেকার টিকিট ক্লিপ করার সময় আলফ্রেডকে চিনতে পারেন।
ব্র্যাকহ্যাম্পটন স্টেশনে আলফ্রেডকে যখন দেখা যায়, সেইসময় রাত এগারোটা পঞ্চান্নর প্যাডিংটনগামী ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষায় ছিল। সেই দিনই এক পাগলাটে বৃদ্ধা ট্রেনের মধ্যে খুন হতে দেখেছিল বলে রটনা হয়েছিল।
–তাহলে আলফ্রেড, রিপোর্টটা সরিয়ে রেখে বলে উঠলেন ক্রাডক, আলফ্রেডই সেই লোক! আশ্চর্য!
-ঘড়ির হিসেব ধরে একেবারে ঘটনাস্থলেই তাকে পাওয়া যাচ্ছে।
-তাই তো দেখছি, বললেন ক্রাডক। বোঝা যাচ্ছে, চারটে ত্রিশের গাড়িতে সে ব্র্যাকহ্যাম্পটন স্টেশনে পৌঁছেছিল। সেই গাড়িতেই খুনের কাজটা চুকিয়ে ফেলে। তারপর বাসে করে সে ইটভাটায় গিয়েছিল। সাড়ে নটা অবধি সেখানে থাকে। তারপর বাসে করে রাদারফোর্ড হলে ফিরে রেলবাঁধের তলা থেকে মৃতদেহটা পাথরের কফিনের ভেতরে ফেলে। এরপরে ব্র্যাকহ্যাম্পটন থেকে এগারটা পঞ্চান্নয় লন্ডনগামী ট্রেন ধরতে তার কোনোই অসুবিধা হবার কথা নয়। এটা কি সম্ভব যে ডিকি রজার্সের দলের কেউ তাকে মৃতদেহ স্থানান্তরের কাজে সাহায্য করেছিল?
রজার্সের দল এন্তার বেআইনী কাজ করলেও খুনখারাপির ত্রিসীমানায় থাকে না। যাইহোক, আমাদের পরিশ্রম সফল হল এটাই আনন্দের ব্যাপার। আলফ্রেড—
.
ক্রাডককে সঙ্গে নিয়ে ছেলেরা পেছনের দরজা দিয়ে বাড়িতে নিয়ে গেল।
রান্নাঘরে লুসি প্যাস্ট্রি পাকাচ্ছিল। ব্রায়ান ইস্টলি পাশে দাঁড়িয়ে বকবক করছে।
ক্রাডক বললেন, মিঃ কেড্রিকের সঙ্গে একটু কথা বলতে এলাম।
–ভেতরে থাকার তো কথা, আমি দেখছি। ব্রায়ান ভেতরে চলে গেল।
–আলেকজান্ডার, খাবার আলমারীতে জিঞ্জার কেক খানিকটা রয়েছে, তোমরা খেয়ে নাও গে। বলল লুসি। ছেলেরা অমনি দাপাদাপি করে ছুটল।
ক্রাডক খামখানা পকেট থেকে বার করে লুসিকে দেখালেন। সন্দেহ মুক্ত হলেন, ছেলেদের সঙ্গে মজা করার জন্য সে এই নকল সূত্রের অবতারণা করেনি।
ব্রায়ান এসে খবর দিল, কেড্রিক লাইব্রেরি ঘরে তার জন্য অপেক্ষা করছে। ক্রাডকের প্রশ্নে: উত্তরে কেড্রিক বলল, দু-এক দিনের মধ্যেই আমি ইডিজাতে ফিরে যাচ্ছি।
–তাহলে সময় মতোই আপনাকে ধরা গেছে, বললেন ক্রাডক, আমি জানতে এসেছি ডিসেম্বর ২০ তারিখ শুক্রবার আপনি কোথায় ছিলেন, কি করছিলেন?
চকিতে ক্রাডকের মুখে তাকিয়ে নিল কেড্রিক। পরে বলল, আমি তো বলেছি আগেই
-হ্যাঁ, ২১শে ডিসেম্বর আপনি ইডিজা ছেড়েছিলেন আর সেই দিনই ইংলন্ডে পৌঁছেছিলেন।
এইসময় পাশের ছোটঘর থেকে এমা বেরিয়ে এল।
–এমাই তো ঠিক ঠিক বলতে পারবে, বলল কেড্রিক, এমা বল তো আমি তো ক্রিস্টমাসের আগের দিন শনিবার এখানে পৌঁছেছিলাম, তাই না?
এমা বিস্মিত হয় বলল, হ্যাঁ, লাঞ্চের সময় এখানে পৌঁছেছিলে।
-ইনসপেক্টর, আপনার ধন্দ ঘুচল?
–কিন্তু আমাদের কাছে যে খবর আছে তা আপনার বক্তব্য সমর্থন করে না। আপনার পাসপোর্টটা একবার দেখি–
-ওই জিনিসটাই তো সকাল থেকে খুঁজে পাচ্ছি না। অথচ কুকসের অফিসে পাঠানো দরকার।
–পেয়ে যাবেন নিশ্চয়ই, বললেন ক্রাডক, নথিপত্রে দেখতে পাচ্ছি, আপনি এদেশে প্রবেশ করেছেন ১৯ তারিখ সন্ধ্যাবেলা। আমি আশা করব সেই সময় থেকে ২১ ডিসেম্বর লাঞ্চের সময় পর্যন্ত আপনার গতিবিধির ঠিক ঠিক বিবরণ জানাবেন।
–হাজারো ফর্ম পূরণের এই হলো গেরো, ক্রুদ্ধস্বরে বলল কেড্রিক, বুঝলাম, তা ২০ ডিসেম্বর নিয়ে আপনি এত মেতে উঠলেন কেন?
-হত্যাকাণ্ডটা সেই দিনই ঘটেছিল। বললেন ক্রাডক।
–কেড্রিক, বিষয়টা গুরুতর, বলল এমা, ইনসপেক্টরের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেওয়া তোমার উচিত। আপনারা কথা বলুন, আমি যাচ্ছি।
এমা ঘর ছেড়ে গেলে কেড্রিক বলল, ইনসপেক্টর, আপনি ঠিকই বলেছেন, ১৯ তারিখে এক বান্ধবীর সঙ্গে ইডিজা ছেড়ে সেইদিনই আমরা লন্ডনে পৌঁছেছিলাম। আমরা উঠেছিলাম কিংসওয়ে প্যালেসে। সন্ধান নিলেই আপনার লোকেরা সত্যাসত্য জানতে পারবে।
–কুড়ি তারিখের বিবরণটা আমাকে বলুন।
সকালবেলাটা গড়াগড়ি করে হোটেলেই কেটে যায়। বিকেলে জাতীয় চিত্রশালায় গিয়েছি, একটা ওয়েস্টার্ন ছবি দেখেছি, পরে বার ঘুরে হোটেলে ফিরে আসি। রাত দশটার পর বান্ধবীকে নিয়ে জাম্পিং ফ্রগ নামের একটা প্রমোদউদ্যানে গিয়েছিলাম। ইনসপেক্টর, কুড়ি তারিখে এর চেয়ে বেশি কিছু বলার নেই
মিঃ ক্রাকেনথর্প, বিকেল তিনটে থেকে সাতটা পর্যন্ত আপনার গতিবিধির সমর্থন কিভাবে পাওয়া যেতে পারে।
জাতীয় চিত্রশালা বা সিনেমা হাউসে–আমাকে কেউ চেনে না–কাজেই প্রমাণের সম্ভাবনা তত দেখতে পাচ্ছি না।
-ধন্যবাদ মিঃ ক্রাকেনথর্প।
এমা আবার ফিরে এলো ঘরে। উপযাচক হয়েই সে ক্রাডককে তার কুড়ি তারিখের কাজের ফিরিস্তি শোনাল। পরে জানতে চাইল, নতুন কোনো ঘটনা ঘটেছে কিনা।
ক্রাডক পকেট থেকে সেই খামখানা বার করে দেখালেন।
–মিস ক্রাকেনথর্প, লক্ষ্য করে দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা।
-এটা…এটা তো আমরাই হাতের লেখা। এই চিঠিটাই তো আমি মার্টিনকে লিখেছিলাম। …কিন্তু..আপনি…তার খোঁজ কি পাওয়া গেছে?
-হ্যাঁ, এখন আপনি সেরকম বলতে পারেন। এই খামখানা এই বাড়িতে পাওয়া গেছে–তবে ভেতরে চিঠি ছিল না–
–আমাদের বাড়িতে? সে তাহলে সত্যিই এসেছিল এখানে?
–সেটাই প্রমাণিত হচ্ছে।
–ওই পাথরের কফিনে…মার্টিনই ছিল
–সম্ভবপর বলেই মনে হচ্ছে।
.
অফিসে ফিরে এসেই আমান্ড ডেসিনের পাঠানো একটা তারবার্তা পেলেন ক্রাডক।
আন্না ট্রাভিনস্কির এক বান্ধবীর কাছে তার একটা চিঠি পাওয়া গেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে সে এক পুরুষবন্ধুর সঙ্গে বর্তমানে জ্যামাইকায় আমোদ উপভোগ করছে।
.
উইক এন্ডের ছুটি কাটাতে রাদারফোর্ড হলে সকলের সঙ্গে মিলিত হল হ্যান্ড ও আলফ্রেড।
ছেলেদুটি চলে গেছে। ছত্রাকের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে তাদের কথাই ভাবছিল লুসি।
ওদিকে তুমুল বাদানুবাদে লাইব্রেরি ঘরের হাওয়া গরম হয়ে উঠেছে। অভিযোগের ঝড় বইছে এমাকে নিয়ে। সে নির্বোধের মতো চিঠিখানা নিয়ে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে গিয়েছিল বলেই সকলকে এখন ঝামেলা পোয়াতে হচ্ছে। পুলিস নিশ্চয় কিছু সন্দেহ করছে, নইলে ২০ তারিখটাই তাদের তদন্তের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে কেন?
কেড্রিক এমার সমর্থনে মন্তব্য করতে গেলে ভাইদের মধ্যেও পারস্পরিক ব্যক্তিগত আক্রমণ শুরু হয়ে গেল।
বেচারী এমা চেষ্টা করেও ঘরের উত্তপ্ত আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিল না।
ডাঃ কুইম্পার এসেছিলেন বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্পকে পরীক্ষা করতে। কাজ শেষ করে তিনি এসে ঢুকলেন লাইব্রেরি ঘরে। অমনি তিনিও পড়ে গেলেন আক্রমণের মুখে।
-এমাকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন আপনি, উত্তেজিত ক্ষুব্ধ কণ্ঠে চিৎকার করে বলে উঠল হারল্ড, এসবের মানে কি?
ডাঃ কুইম্পার আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার কথায় কেউ কর্ণপাত করল না। কৈফিয়তের মুখে পড়ে গেলেন তিনি। প্রচণ্ড বিরক্তি চেপে তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে নিজের গাড়িতে উঠে পড়লেন।
গাড়ির শব্দ শুনে লুসি জানালা দিয়ে তাকিয়ে কেবল ক্ষিপ্ত ক্রুদ্ধ ডাক্তারের মুখ দেখতে পেল।
বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প আগেই লুসিকে ফরমাস করেছিলেন, তিনি আজ সুস্বাদু কারি খেতে ইচ্ছুক। লুসি তার জন্যই কারি তৈরির সমস্ত উপাদান সংগ্রহ করে নিয়ে বসেছিল। তার ইচ্ছে, আজ সে পরিবারের সকলকে ভালো ডিনার পরিবেশন করবে।
.
মিস জোস সিম্পকিনসের দুটি সবল সুস্থ যমজ শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখাবার ধকল সামলে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত ডাঃ কুইম্পার যখন তাঁর বিছানায় এলেন, তখন রাত তিনটে।
অবসন্ন দেহটাকে বিছানায় এলিয়ে দিতে পারলে এবারে স্বস্তি। তিনি হাই তুললেন।
এমনি সময়ে টেলিফোন বেজে উঠল। নিজের ভাগ্যের উদ্দেশ্যে একটু কটু মন্তব্য করে তিনি রিসিভার তুলে নিলেন।
–ডাঃ কুইম্পার? হ্যাঁ…আমি লুসি আইলেসব্যারো বলছি। বাড়ির সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
ডাঃ কুইম্পার অসুস্থতার লক্ষণগুলো জিজ্ঞেস করে জেনে নিলেন। প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে কিছু উপদেশ দিলেন।
-তুমি এগুলোর ব্যবস্থা নাও…আমি এখুনি রওনা হচ্ছি।
দ্রুত বাইরে বেরুবার পোশাক পরে নিয়ে, আপকালীন ব্যবস্থা হিসেবে কয়েকটি ওষুধ ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলেন। তারপর দ্রুত নিচে নেমে এসে গাড়ি বার করলেন।
.
ঘণ্টাতিনেক অমানুষিক পরিশ্রম করে অবস্থা আয়ত্তে আনলেন ডাঃ কুইম্পার। তাকে সমানে সহযোগিতা যুগিয়ে গেছে লুসি।
–আশা করছি, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সকলে সুস্থ হয়ে উঠবে। এবারে একটু কফি…
লুসি প্রস্তুতই ছিল। অল্পসময়ের মধ্যেই রান্নাঘরের টেবিলে সে কুইম্পারকে কফি পরিবেশন করল।
কফির শেষ তলানিটুকু পর্যন্ত নিঃশেষে কাপ থেকে টেনে নিয়ে আরামসূচক শব্দ করলেন তিনি। জড়তা আর ক্লান্তি অনেকটাই দূর হল।
–কিন্তু লুসি ভয়ানক এই ব্যাপারটা কি করে ঘটতে পারে আমি বুঝতে পারছি না। ডিনার কে রান্না করেছিল?
–আমিই করেছিলাম। বিমর্ষ কণ্ঠে জবাব দিল লুসি–
–কি কি পদ প্রস্তুত করেছিলে?
-মুরগী সংযোগে ভাত, ছত্রাকের সুপ, মুরগীর লিভার দিয়ে সিলাবাবস (দুধ মেশানো আঙুরের রস), চিকেন কারি ও সস।
–ওহ্ ছত্রাক! সুপ কি টিন থেকে ঢেলে নিয়েছিলে?
–আমিই তৈরি করেছিলাম। এর মধ্যে তো কোনো গোলমাল থাকতে পারে না। আমি নিজে খানিকটা সুপ খেয়েছি–আমি অসুস্থ হইনি।
-হ্যাঁ, তা দেখতেই পাচ্ছি।
–আপনি কি মনে করছেন–
-লুসি, তেমন হলে তুমিও রোগের ভান করে সকলের সঙ্গে ছটফট করতে। তোমার সম্পর্কে আমি জানি–অত্যন্ত সৎ তরুণী তুমি। তাছাড়া ক্রাকেনথর্প পরিবারের সঙ্গে কাজে আসার আগে তোমার কোনো যোগাযোগ ছিল না। আচ্ছা চিকেন কারি কি তুমি খেয়ে দেখেছিলে?
–না।
কুইম্পার মাথা ঝাঁকালেন।
অবশিষ্ট খাবার কি কি আছে?
–খানিকটা কারি রয়েছে, ছত্রাকের সুপও বেঁচেছে আর চাটনি।
–সবকটাই খানিকটা করে আমি নিয়ে যাব।
এরপর কুইম্পার আবার রোগীদের পরীক্ষা করলেন। লুসিকে কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন।
–ব্যাপারটা খাদ্যের বিষক্রিয়া না বিষপ্রয়োগের চেষ্টা খাবারের নমুনাগুলো পরীক্ষা করলে নিশ্চিত বলা যাবে। আপাততঃ তুমি বিশেষ করে দুজনের ওপর নজর রাখবে। আর এমাকে দেখবে অবশ্যই। আমি আটটা নাগাদ একজন নার্সকে পাঠিয়ে দেব। আমি ফিরে যাচ্ছি।
.
–আর্সেনিক বলেই আমি সন্দেহ করেছি ইনসপেক্টর বেবন। কারিটা সঙ্গে নিয়ে এসেছি, আপনি আপনার লোকেদের দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিন। বললেন ডাঃ কুইম্পার।
–বলছেন কি? বিষপ্রয়োগের ঘটনা? বেকনের কথায় অস্থিরতার ভাব প্রকাশ পেল।
–আমার তাই মনে হচ্ছে।
–কিন্তু মিস আইলেসব্যারো বলছেন একমাত্র সুস্থ রয়েছেন
–হ্যাঁ।
–তার দিক থেকে ব্যাপারটা সন্দেহজনক…
–কিন্তু তার কি উদ্দেশ্য হতে পারে? তাছাড়া সে আর্সেনিক প্রয়োগ করলে নিজেকে সন্দেহ মুক্ত রাখার জন্য কিছুটা কারি খেত এবং অসুস্থতার লক্ষণগুলোকে বাড়িতে দেখাবার চেষ্টা করত।
-হ্যাঁ, যুক্তিসঙ্গত কথাই বলেছেন। তাহলে পরিবারের অসুস্থদের মধ্যেই এমন কেউ রয়েছে যে নিজেকে সন্দেহের বাইরে রাখবার চেষ্টা করছে।
-এই ব্যাপারটা পরিষ্কার করবার জন্যই আপনাকে বিষয়টা জানাতে এসেছি। তবে আমার মনে হয়, কেউ এমন পরিমাণ খায়নি যাতে মারা যেতে পারে। যাইহোক, আমি একজন নার্সকে আপাততঃ ওখানে পাঠিয়ে দিয়েছি।
-মারা যাবে না বলছেন, তাহলে বিষপ্রয়োগের উদ্দেশ্যটা কি ছিল?
–আমার ধারণা, সামান্য পরিমাণ আর্সেনিক কারিতে মেশানোর উদ্দেশ্য ছিল যাতে বিষক্রিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায় আর ছত্রাকের ওপরে সকলের দৃষ্টি পড়ে। কেননা, সাধারণতঃ ছত্রাক থেকেই বিষক্রিয়া ঘটতে দেখা যায়। আর এই সুযোগে একজনের ওপরেই মাত্রার পরিমাণটা বাড়ানো যাতে শেষ পর্যন্ত সে মারা যায়।
ইনসপেক্টর মাথা নেড়ে ডাক্তারের বক্তব্য সমর্থন করলেন।
এইসময়ে টেবিলের ওপর টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলে নিয়ে বেকন বললেন, ডাঃ আপনার নার্স ফোন করেছে।
ডাক্তার ফোন ধরলেন। তাঁকে জানানো হল, আলফ্রেড মারা গেছে।
রিসিভার নামিয়ে রেখে দুঃসংবাদটা তিনি বেকনকে জানালেন।
.
রিসিভার কানে তুলেই চমকে উঠলেন ক্রাডক।
–কিন্তু আমি যে আলফ্রেডকেই হত্যাকারী সাব্যস্ত করেছিলাম। তদন্তের সব রিপোর্টই তার বিরুদ্ধে ছিল। এখন বুঝতে পারছি আমাদের কোথাও হিসেবে ভুল হয়েছিল।
একমুহূর্ত নীরব থেকে টেলিফোনের অপর প্রান্তের বক্তব্য শুনলেন।
–আশ্চর্য হচ্ছি, একজন অভিজ্ঞ নার্স বুঝতে ভুল করল?
–তার কিছু করার ছিল না স্যার। পাঁচজন রোগীকে তাকে একা সামলাতে হচ্ছিল। বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্পকে দেখে এসে সে আলফ্রেডকে গ্লুকোজ মেশানো চা দিয়েছিল। সেটা পান করার সঙ্গে সঙ্গেই সে মারা পড়ে।
তার মানে দ্বিতীয়বার আর্সেনিক প্রয়োগ করা হয়েছিল।
–ডাঃ কুইম্পার সেরকমই মনে করছেন। সার্জেন জনস্টনও তাঁর সঙ্গে একমত।
–কিন্তু আলফ্রেড কেন, তার মৃত্যুতে কারোর লাভবান হবার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই।
-আপনি কি বলতে চাইছেন, খুনীর আসল লক্ষ্য আলফ্রেড ছিল না? চা-টা বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্পের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল–আর কেউ ভুল করে
-হ্যাঁ, কেন না, বৃদ্ধের মৃত্যুতে সকলেই লাভবান হত। আচ্ছা, চায়ের মধ্য দিয়েই বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল বলে ডাক্তাররা নিশ্চিত হয়েছেন?
–হ্যাঁ, কেন না আনুষঙ্গিক জিনিসগুলো নার্স ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে নিয়েছিল।
-তার মানে, বেকন, রোগীদের মধ্যেই কেউ এমন রয়েছে যে অন্যদের মতো অসুস্থ নয়। সেই সুযোগ বুঝে বিষপ্রয়োগের কাজটা সেরেছে।
–আমরা এখন আরও সতর্ক হয়েছি। আরও দুজন নার্সকে আমি রেখেছি। মিস আইলেসব্যারো তো রয়েইছেন। আপনি কি একবার এখানে আসছেন?
–কিছুক্ষণের মধ্যেই যাচ্ছি।
.
ইনসপেক্টর ক্রাডকের ডাক পেয়ে লুসি হলঘর ছেড়ে এল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার মুখ শুকিয়ে অতটুকু হয়ে গেছে।
–ভাবতে পারছি না ইনসপেক্টর বেকন, বড় ভয় ধরে গেছে।
শুষ্ক কণ্ঠে বলল লুসি।
–ওই কারিটা যত বিপত্তির কারণ।
–আর্সেনিক যদি কারির মধ্যেই পাওয়া গিয়ে থাকে, তাহলে এ কাজ পরিবারেরই কেউ করেছে।
বাইরের কারুর পক্ষে সম্ভব ছিল না বলছেন?
-বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প কারি খেতে চেয়েছিলেন। আমার অন্যরকম প্রস্তুতি ছিল। তাই অনেক দেরিতে সেটা তৈরি করতে হয়েছিল। এজন্য নতুন কারি পাউডারের টিন খুলতে হয়েছিল। তার মধ্যে কোনো কারচুপি করা সম্ভব ছিল না।
-রান্না করার সময়ে
-হ্যাঁ, আমি যখন ডাইনিং রুমে টেবিল সাজাচ্ছিলাম, তখন যদি কেউ রান্না ঘরে চুপি চুপি ঢুকে থাকে
-বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প আর এমা ছাড়া বাড়িতে আর কে কে ছিল?
-কেড্রিক ছিলেন। লন্ডন থেকে বিকেলে আসেন হারল্ড ও আলফ্রেড। ব্রায়ান ছিল, তবে সে ডিনারের আগেই কার সঙ্গে দেখা করবে বলে চলে গিয়েছিল।
কুইম্পারের ধারণা, ক্রিসমাসের সময়ে বৃদ্ধ আর্সেনিক ঘটিত কারণেই অসুস্থ হয়েছিলেন, কাল রাতে সবাইকে কি সমান অসুস্থ মনে হয়েছিল?
–বেশি অসুস্থ হয়েছিলেন বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প। তবে বেশি অস্থিরতা ছিল কেড্রিকের মধ্যে।
–কিন্তু আলফ্রেড খুন হওয়ার কারণটা ভেবে পাচ্ছি না।
চিন্তিতভাবে বললেন ক্রাডক।
–আলফ্রেডই খুনীর লক্ষ্য ছিল বলে আপনি ভাবছেন?
-হ্যাঁ, সেই ব্যাপারটা ভাবছি। কিন্তু সব ঘটনার পেছনেই যে একটা উপলক্ষ কাজ করেছে তেমন সূত্র পাওয়া যাচ্ছে না। দেখুন, এতদিনে মোটামুটি মেনে নেওয়া হয়েছে পাথরের কফিনের মৃতদেহটি এডমান্ডের বিধবা পত্নী মার্টিনের ছিল।
সেই ঘটনার সঙ্গে আলফ্রেডের হত্যার যোগাযোগ রয়েছে যদি ভাবতে হয় তাহলে বলতে হয়, সমস্ত বিপত্তির মূলে হল পরিবার।
–আমি কিছু ধরতে পারছি না।
যাইহোক, ওপরতলার রোগীদের মধ্যেই একজন বিষপ্রয়োগকারী রয়েছে, একথা মনে রেখো। তুমি নিজের সম্পর্কে সতর্ক থাকবে।
.
–ডাঃ কুইম্পার বলেছেন বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প আগে আপনারই রোগী ছিলেন। অনেকদিন থেকেই ওই পরিবারকে আপনি জানেন। বললেন ক্রাডক।
হ্যাঁ, বৃদ্ধ জোসিয়া ক্রাকেনথর্পেরও চিকিৎসা আমি করেছি। কিন্তু আমার কাছে আপনি কি জানতে এসেছেন বুঝতে পারছি না। বললেন ডাঃ মরিস।
ক্রাডক বৃদ্ধ ডাঃ মরিসকে সমস্ত ঘটনা বিবৃত করলেন।
–ওহ, সেই নির্বোধ কুইম্পারের কথা আপনি শুনছেন। একবার লুথার ক্রাকেনথর্পের গ্যাস্ট্রিকের প্রকোপ হয়েছিল, আমি তার চিকিৎসা করেছিলাম। কুইম্পারের মাথায় ঢুকেছে কেউ লুথারকে বিষ খাইয়ে মারার চেষ্টা করেছিল। উদ্ভট সব কথাবার্তা। আর্সেনিক প্রয়োগের ঘটনা দেখলে আমি চিনতে পারব, এটুকু বিশ্বাস আছে।
ক্রাডক বললেন, নিজেদের পেশায় খ্যাতিমান কিছু সংখ্যক ডাক্তার কিন্তু আর্সেনিকের ঘটনা ধরতে পারেননি।
ক্রাডক তার বক্তব্যের সমর্থনে কতগুলো ঘটনা তুলে ধরলেন।
–আপনার বক্তব্য বুঝতে পারছি। আমি ভুল করে থাকতে পারি, তাই তো। কিন্তু আমি তা মনে করি না। তা বেশ, কুইম্পারের কি ধারণা, বিষপ্রয়োগের ব্যাপারে সে কাকে সন্দেহ করছে?
–একটা বিরাট পরিমাণ টাকার প্রশ্নে পরিবারের অনেকেই জড়িত, আপনি তো জানেন।
-হ্যাঁ, জানি বৈকি। লুথারের মৃত্যুর পর সমস্ত বিষয়-আশয় তার ছেলেরা পাবে। তাদের টাকার প্রয়োজনও রয়েছে। তবু আমি মনে করি না তারা টাকার পাওয়ার জন্য বৃদ্ধ পিতাকে হত্যা করার চেষ্টা করবে।
-না, তা অপরিহার্য নয়।
-দেখুন ইনসপেক্টর, আমি আপনাকে এটুকু বলতে পারি, লুথার বারবার গ্যাস্ট্রিকে আক্রান্ত হয়েছেন, এটা ঠিক, কিন্তু আমি কখনো আর্সেনিকের কথা ভাবিনি। তার চিকিৎসক হিসেবে যে ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছি তা হল, লুথার হল স্বভাব-কৃপণ। তিনি তাঁর ব্যয় সংক্ষেপ করে যথেষ্ট অর্থ সঞ্চয় করেছেন বলেই আমার ধারণা–ছেলেদের তিনি সেই সঞ্চয়ে হাত দিতে দেন না।
ক্রাডক বললেন, পরিবারের এই অর্থনৈতিক বিষয়টাই আমাদের বিবেচনার মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প তার সঞ্চিত অর্থ নিশ্চয় কারোর নামে উইল করে দিয়েছেন–
–দেখুন, এই পরিবারের সঙ্গে বেশ কয়েক বছর আমার কোনো যোগাযোগ নেই। আমার পক্ষে আর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।
মিসেস কিডার বলল, তুমি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছ মিস। মাত্র একজনের ওপর দিয়ে বিপদটা কেটে গিয়েছে। ছত্রাক বড় ভয়ানক জিনিস।
–কিন্তু ছত্রাকগুলোয় কোনো দোষ ছিল না, বলল লুসি।
সে রুগীদের ঘরে পৌঁছে দেবার জন্য খাবারের ট্রে গুছিয়ে নিচ্ছিল।
–যাই বল, এ বাড়িতে শয়তানের খেলা শুরু হয়েছে আমি বলব। প্রথমে হল একটা খুন, পরে ছত্রাকের বিষে আলফ্রেড মারা গেল। আমার স্বামী তো আমাকে আসতে দিতেই চায় না।
–কিন্তু তুমি তো গা বাঁচিয়ে চলার মেয়ে নও। বলতে বলতে লুসি প্রথম ট্রে-খানা নিয়ে ওপর তলায় চলল।
বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন, এসব কি নিয়ে এসেছ? বীফ স্টিক ছাড়া আমি কিছু খাব না।
–ডাঃ কুইম্পার বলেছেন, এখনো আপনার বীফ স্টিক খাওয়ার সময় হয়নি।
-ওসব কথা ছাড়, আমি এখন যথেষ্ট সুস্থ হয়ে উঠেছি। কাল সকালেই দেখবে ঘুরে বেড়াব। ওরা কেমন আছে?
–মিঃ হারল্ড অনেক ভালো। কাল সকালে তিনি লন্ডন চলে যাচ্ছেন।
–কেড্রিক এখনো রয়েছে? এমা কি করছে?
–এখনো পুরোপুরি সুস্থ নন।
-দেখ মেয়ে, আমি কত দ্রুত সামলে উঠেছি। তবু ওরা বলে আমি বুড়ো মানুষ। তুমি ওসব কথায় কান দিও না। তোমাকে সেদিন যে কথাটা বলেছিলাম, সেটা মনে রেখো।
লুসি এরপরে এমার ঘরে ট্রে নিয়ে এলো।
–লুসি, আমি অনেকটা ভালো বোধ করছি। তোমার মাসীমার সঙ্গে বোধহয় এই কদিন দেখা করতে পারনি?
–একদম সময় পাইনি।
-তিনি নিশ্চয় তোমার কথা ভাববেন। বুড়ো মানুষ। তুমি আজও তার সঙ্গে ফোনে কথা বলো।
এমার উদ্বেগ লক্ষ্য করে লুসির অপরাধবোধ হল। মিস মারপলের প্রতি খুবই অবহেলা হয়ে গেছে। সে স্থির করল, কেড্রিককে খাবারটা দিয়েই মিস মারপলকে ফোন করবে।
কেড্রিকের ঘরে পৌঁছে লুসি দেখল সে বিছানায় উঠে বসেছে। কয়েক তাড়া কাগজের ওপর ব্যস্তভাবে কিসব লিখছে।
–আপনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন দেখে ভালো লাগছে। এখুনি লেখাপড়া শুরু করে দিয়েছেন দেখছি–
পরিকল্পনা ছকছি, বলল কেড্রিক, বুড়ো মারা গেলে এবাড়ি আর আশপাশের জায়গাটা নিয়ে কিছু একটা তো করতে হবে। প্লট ভাগ করে বিক্রি করে দেব, না, কারখানার জন্য রাখব বুঝতে পারছি না।
বাড়িটাতে অবশ্য নার্সিংহোম বা স্কুলও হতে পারে। আবার ভাবছি অর্ধেক জায়গাটা বিক্রি করে বাকি অর্ধেকে নিজে দুঃসাহসিক কিছু করব।
–আপনি যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন বোঝা যাচ্ছে।
–মাথা খেলাতে পারছি বলে? তো আলফ্রেডের ব্যাপারটা কি দাঁড়াল?
–তদন্ত মুলতুবি রয়েছে।
–বাড়িসুদ্ধ লোককে এমন বিষপ্রয়োগ, পুলিসও থৈ পাচ্ছে না। তুমি নিজের দিকে নজর রেখো সুন্দরী।
-তা রাখছি।
.
লাঞ্চের আগে লুসি মিস মাপলের কাছে ফোন করল।
–আপনার কাছে কদিন যেতে পারিনি বলে দুঃখিত। একদম ফুরসৎ করতে পারছি না।
–খুবই স্বাভাবিক। আমাদের অবশ্য এখন কিছু করার নেই, আরও কদিন অপেক্ষা করতে হবে।
–কিসের অপেক্ষার কথা বলছেন?
–এলসপেথ ম্যাকগিলিকার্ডির ফিরে আসার জন্য। আমি অবশ্য তাড়া দিয়ে লিখেছি। তুমি মেয়ে সাবধানে থেকো
–আপনি কি আশা করছেন–
-মৃত্যুর ঘটনা আর ঘটবে কিনা বলছ? দেখ, ভবিষ্যতের কথা কিছু বলা যায় না; বিশেষ করে কাছাকাছিই যখন একজন খুনী রয়েছে।
.
ফোন ছেড়ে লুসি রান্নাঘরে গেল। সে নিজের ট্রে নিয়ে ছোট পড়ার ঘরে গিয়ে বসল। তার খাওয়া শেষ হতে হতেই ব্রায়ান ইস্টালি দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করল।
-আপনি এসময়ে
–খবর নিতে এলাম, সকলে কেমন আছে?
–সামলে উঠেছেন। হারল্ড কাল লন্ডনে ফিরে যাচ্ছেন।
ব্যাপারটা কি সত্যিই আর্সেনিক ঘটিত, তুমি কি মনে কর?
–সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
বাড়ির মধ্যে চুপি চুপি ঢুকে খাবারে বিষ মেশাচ্ছে, এমন শত্রুতা কে করছে বলতো?
–তেমন লোক আমিও তো হতে পারি। সুযোগ অনেক বেশি।
-না, লুসি, একাজ তুমি করতে পার না। কারির মধ্যে যদি কেউ কারচুপি করে থাকে, তবে যে পাঁচজন খেতে বসেছিল, তাদেরই মধ্যে কেউ একজন।
লুসির খাওয়া শেষ হলে ব্রায়ান তার সঙ্গে রান্নাঘরে এলো।
–দেখো, যা বুঝতে পারছি, বাড়িটা শেষ পর্যন্ত কেড্রিকের হাতেই আসছে। কিন্তু আমি জানি সে সব বিক্রিবাটা করে বিদেশে চলে যাবে।
হ্যারল্ড অবশ্য এমন সেকেলে বাড়ি রাখতে চাইবে না। এমা তো একা মানুষ। এখনো পর্যন্ত বিয়েই করল না। এই নির্জন পুরী রেখে সে কি করবে? আমি আপাততঃ বেকার। কিন্তু বাড়িটা যদি আলেকজান্ডারের হাতে আসত তাহলে আমরা দুটিতে মিলে আনন্দে কাটাতে পারতাম। কিন্তু কি জান, আলেকজান্ডারকে এটা পেতে হলে এই বাড়ির সকলের মরা দরকার। ধ্যাৎ, কি সব আজেবাজে কল্পনা করছি। তবে যাই বল, বুড়ো অতি সহজে মরছে না।
-তাই মনে হয়।
.
রান্নাঘরের মেঝে ঘষে পরিষ্কার করছিল মিসেস কিডার। আর কাজের ফাঁকে রাদারফোর্ড হলের ঘটনা নিয়ে, বাইরে লোকের মুখে যে গুজব রটেছে তা লুসিকে শোনাচ্ছিল।
এমন সময় দরজায় ঘন্টা বাজল।
ডাক্তার কুইম্পার এসেছেন অনুমান করে লুসি এসে দরজা খুলল। কিন্তু দেখে অবাক হল, দীর্ঘাঙ্গী, অভিজাত চেহারার এক মহিলা দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। তার পেছনে বাড়িতে ঢোকার পথের ওপরে একটি রোলস গাড়ি দাঁড়ানো। মহিলার বয়স, পঁয়ত্রিশের গায়েই হবে।
এমা ক্রাকেনথর্পের সঙ্গে দেখা করতে পারি?
আগন্তুক মহিলার সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরে মুগ্ধ হল লুসি।
–আমি দুঃখিত, তিনি খুবই অসুস্থ।
–আমি জানি তিনি কিছুদিন ধরে অসুস্থ আছেন। আমার অনুমান, আপনিই মিস আইলেসব্যারো। আমার ছেলে স্টডার্ড ওয়েস্ট সারাক্ষণই আপনার প্রশংসা করছে। আলেকজান্ডার আপাততঃ আমার কাছেই আছে।
মিসেস স্টডার্ড ওয়েস্টের পরিচয় পেয়ে লুসি যথোচিত সম্ভ্রমের সঙ্গে তাকে ড্রইংরুমে এনে বসাল।
–আমার ছেলের কাছে একটা বিষয় জানতে পেরে আমি মিস ক্রাকেনথর্পের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। বিষয়টা খুবই জরুরী। যদি তাকে কথাটা বুঝিয়ে বলেন।
আগন্তুককে বসিয়ে লুসি ওপরে গিয়ে এমাকে সব জানাল।
তাকে নিয়ে এসো।
.
–বোধহয় স্কুলের স্পোর্টসের সময় আপনাকে দেখেছি।
এমার সঙ্গে করমর্দন করে বিছানার পাশে বসানো চেয়ারে আসন গ্রহণ করলেন লেডি।
-এখন মনে পড়েছে, আমিও আপনাকে দেখেছি। বলল এমা।
-একটা গুরুতর কারণেই আমাকে এভাবে চলে আসতে হল। এখানে যে হত্যাকাণ্ড হয়েছে, ছেলেরা এ নিয়ে খুবই উত্তেজিত। আমাকে তারা অনেক কথা বলেছে। তারা বলেছে, যে মেয়েটি খুন হয়েছে সে নাকি ফরাসি। আপনাদের ভাই যিনি যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন, তার পরিচিত ছিল। একথা কি সত্যি?
–এরকম একটা সম্ভাবনা আমরা বিবেচনা করেছি। আবেগকম্পিত স্বরে বলল এমা, ঘটনাটা সত্যি হতেও পারে।
নিহত স্ত্রীলোকটিই মার্টিন–পুলিসের এরকম মনে করার কারণ কি? তার সঙ্গে কিছু কাগজপত্র ছিল?
-সেরকম কিছু ছিল না। তবে এই মার্টিনের কাছ থেকে আমি একটা চিঠি পেয়েছিলাম।
–মার্টিনের কাছ থেকে? আপনি চিঠি পেয়েছিলেন?
-হ্যাঁ। সে আমাকে জানিয়েছিল যে সে ইংলন্ডে এসেছে, আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। আমি তাকে আমন্ত্রণ জানাই। কিন্তু পরেই একখানা তারবার্তা পাঠিয়ে সে জানায়, ফ্রান্সে ফিরে যাচ্ছে।
সে সত্যিই ফ্রান্সে ফিরে গিয়েছিল কিনা আমরা জানি না। এরপর এখানে তার ঠিকানা লেখা একটা খাম পাওয়া যায়। তাতেই অনুমান হচ্ছে যে সে এখানে এসেছিল। কিন্তু আসলে
এমার কথা শেষ হবার আগেই লেডি স্টডার্ড ওয়েস্ট বললেন, এ কাহিনীর সঙ্গে আমার কোথায় সম্পর্ক তা আপনার পক্ষে অনুমান করা সম্ভব নয়। আর পরিস্থিতি বিবেচনা করেই সেই কথা জানাবার তাগিদ বোধ করেছি আমি।
-বলুন।
–যেকথা কোনোদিনই আপনাকে বলব না বলে আমি ঠিক করেছিলাম, ঘটনাচক্রে তাই আজ প্রকাশ করতে হচ্ছে। দেখুন, আমিই মার্টিন ডুবয়।
বিস্ময়াহত এমা স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইল ভদ্রমহিলার দিকে। সে যেন কথাগুলোর অর্থ বুঝতে পারছিল না।
–মার্টিন–আপনিই মার্টিন
-হ্যাঁ, সত্যিই আমি মার্টিন। আপনার পক্ষে অবাক হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু কথাটা সত্যি। যুদ্ধের গোড়ার দিকে আমাদের গ্রামেই এডমান্ডের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমাদের মধ্যে বিবাহের কথা পাকা হয়েছিল। সে কথা আপনি জানেন। কিন্তু আমাদের বিয়ের আগেই যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল।
তারপর খবর পেলাম, সে যুদ্ধে হারিয়েছে। সেদিনের সেই বিভীষিকাপূর্ণ দিনগুলোর কথা এখন অতীতের ইতিহাস। তোমাকে, আজ এতদিন পরে, আমি এটুকু বলতে পারি, তোমার ভাইয়ের সঙ্গে আমার নিবিড় ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। সেই অকৃত্রিম ভালোবাসা আমাকে যুদ্ধের কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি নিয়ে দাঁড় করিয়েছিল। ফ্রান্স জার্মানির অধীন হল, আমি নাম লেখালাম প্রতিরোধ বাহিনীতে।
ফ্রান্সের ভেতর দিয়ে ইংরাজদের ইংলন্ডে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব যাদের ওপর পড়েছিল, আমি ছিলাম তাদের একজন। সেই সময়ই আমার বর্তমান স্বামীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সেই সময় তিনি ছিলেন বিমান বাহিনীর অফিসার।
যুদ্ধ শেষ হলে বিয়ে করলাম। অনেকবার আমার আপনার কথা মনে পড়েছে। ভেবেছিলাম এসে দেখা করব কিংবা চিঠি লিখব।
কিন্তু পরে চিন্তা করে দেখলাম, নতুন জীবন শুরু করেছি, অতীত স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলে আর কি লাভ। তাই কোনোদিনই আর কোনো ভাবে যোগাযোগ করা হয়নি।
কিন্তু অতীতকে ভুলতে চাইলেই কি সবসময় ভোলা যায়। যখন জানলাম, জেমসের স্কুলের প্রিয় বন্ধু এডমান্ডের ভাগনে, তখন অদ্ভুত আনন্দ হল।
আলেকজান্ডার আর জেমসের বন্ধুত্ব অপার এক সুখের বিষয় হয়ে উঠল আমার কাছে, তুমিও হয়তো লক্ষ্য করে থাকবে, আলেকজান্ডার অবিকল এডমান্ডের মত দেখতে হয়েছে।
যাই হোক, তোমাদের বাড়ির হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ভাষ্য শুনে আমি জানতে পেলাম, মৃত স্ত্রীলোকটিকে এডমান্ডের পরিচিত বা স্ত্রী বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তখন তোমার কাছে এসে সত্যি কথাটা জানাবার তাগিদ বোধ না করে পারলাম না। মৃত স্ত্রীলোকটি যে মার্টিন নয়, একথা তোমাকে অথবা পুলিসকে জানানো আমার কর্তব্য বলে মনে হল।
তার সম্মুখে বসা ভদ্রমহিলাকে নিবিড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল এমা, তার প্রতিটি কথা যেন সে গলাধঃকরণ করছিল। গভীর আবেগে সে যেন কথা হারিয়ে ফেলেছিল।
-আমি ভাবতেই পারছি না, ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে বলল সে, আমার ভাই যার কথা লিখেছিল, আপনিই সেই মার্টিন। কিন্তু, আমি বুঝতে পারছি না, তাহলে এমন একটা চিঠি কি আপনিই আমাকে লিখেছিলেন?
-না, না, আমি তোমার কাছে কোনোদিন চিঠি লিখিনি। বললাম যে, তোমাকে চিঠি লেখা উচিত হবে কিনা এই নিয়ে ভেবেছি কিন্তু লেখা হয়নি।
-তবে
এমা গম্ভীর হয়ে গেল। সে যেন অশুভ কিছুর আভাস পেল।
–নিশ্চয় অন্য কেউ তোমার কাছে মার্টিন বলে পরিচয় দিয়েছিল। উদ্দেশ্য বোঝাই যায়। নিশ্চয় কিছু টাকা তোমার কাছে আদায় করা উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু এরকম চিঠি কে লিখতে পারে?
যেই করে থাকুক, এমা বলল, বোঝা যাচ্ছে আপনাদের ব্যাপারটা তার জানা ছিল।
–হ্যাঁ, কোনোভাবে জেনে থাকতে পারে। কিন্তু সেই সময় আমার তেমন অন্তরঙ্গ কেউ তো ছিল না। ইংলণ্ডে আসার পরও কাউকে এবিষয়ে কিছু বলিনি। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না–এই নকল মার্টিন এতদিনই বা অপেক্ষা করল কেন?
এমা বলল, সবই কেমন গোলমেলে লাগছে। যাইহোক, ইনসপেক্টরকে জানাই, যা করবার তিনিই করবেন। এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে তোমার সঙ্গে পরিচয় হল, তবু আমার খুব ভালো লাগছে।
–এডমান্ড তোমাকে খুব ভালোবাসত। প্রায়ই তোমার কথা বলত।
এমা লেডির হাতের ওপর হাত রেখে বলল, আজ একটা ভারি বোঝা বুক থেকে নেমে গেল। মৃত স্ত্রীলোকটিকে মার্টিন বলে সন্দেহ হওয়ার পর থেকে কেবলই মনে হয়েছে, এই খুনের সঙ্গে আমাদের পরিবার জড়িত। সে যে কী অস্বস্তি তোমাকে বোঝাতে পারব না। হতভাগ্য মেয়েটি যেই হোক, তার সঙ্গে আমাদের পরিবারের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না।
.
আলফ্রেডের মৃতুতে হারল্ড ক্রাকেনথর্পের দুরকম প্রতিক্রিয়া হল।
বর্তমানে তার ব্যবসার খুবই টলমল। ভেতরের অবস্থাটা বাইরের ঠাটবাটের আড়ালে ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। দামী আসবাবপত্রে সজ্জিত অফিসে, নিখুঁত আদবকায়দায় সম্পন্ন অবস্থাটাকে ধরে রাখার উপযযাগিতা অস্বীকার করা যায় না।
এই অবস্থা থেকে নিস্তার পাবার একটা পথ হতে গিয়েও হল না। আলফ্রেডের বদলে যদি বৃদ্ধ মানুষটা সংসার থেকে ছুটি নিত,তাহলে ব্যবসার সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় লাগত না।
এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল যে তিয়াত্তর চুয়াত্তর বয়সের একজন মানুষ। বিষপ্রয়োগের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারবেন না। বয়সে জীর্ণ শরীর শক্তি আর কতটুকু আছে। তার ওপরে বছরের পর বছর অথর্ব হয়ে পড়ে আছেন।
অথচ বৃদ্ধ ঠিক সামলে উঠলেন আর যে কিনা সবল সুস্থ এক যুবক, অতি সাবধানী সেই আলফ্রেডই বিষক্রিয়ায় মারা গেল।
অবশ্য আলফ্রেডের মৃত্যু বিরাট একটা ক্ষতি কিছু নয়। অন্ততঃ পরিবারের ক্ষেত্রেও।
জীবনে সে কখনো বড় কিছু করার চেষ্টা করেনি। সব সময়ই দারিদ্র্য আর অপকর্ম তার সঙ্গী হয়েছিল। ফাটকাবাজদের যা হয়, দিন কতকের প্রাচুর্য তারপর আবার দারিদ্র্য আর অপকর্মে লিপ্ত হওয়া। এই ছিল জীবনচক্র। তাছাড়া তার প্রিয়পাত্রও সে ছিল না কোনোদিন।
তবে একটা দিক থেকে লাভবান হবার সুযোগ হয়েছে আলফ্রেডের মৃত্যুতে। সেটাই হারল্ডের আনন্দের বিষয়।
ঠাকুর্দা জোসেফ ক্রাকেনথর্পের অর্থের একজন ভাগিদার কমল। এখন আর টাকাটা পাঁচভাগ হবে না, চার অংশে বাঁটোয়ারা হবে। ফলে এখন হারল্ডের অর্থের পরিমাণ যথেষ্ট বৃদ্ধি পাবে।
শরীরে বেশ অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ ছিল, তবু অফিসে না এসে পারেনি হারল্ড। নিজের খাস কামরায় বসে এসব কথাই ঘুরপাক খেয়েছে মাথায়।
শরীরের অবস্থা বিবেচনা করে আরও একদিন বিশ্রাম নেবে, হারল্ড ভাবল। শরীর এখনো দুর্বল।
কিছুক্ষণ অফিসে থেকে আবার বাড়ি ফিরে এল সে। দরজা খুলে দিয়ে গৃহভৃত্য ডারউইন জানাল, মিসেস হারল্ড ফিরেছেন।
সতর্ক হয়ে গেল হারল্ড। অ্যালিসের যে আজই ফিরে আসার কথা তা সে একেবারেই ভুলে গিয়েছিল। এই ভুলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, এখন যা সম্পর্ক ওদের দুজনের মধ্যে দাঁড়িয়েছে।
অ্যালিস অতি সাদাসিধে ধরনের স্ত্রীলোক। মোহ তৈরি হবার মতো কিছু নয় সে। তবুও একসময় তার সান্নিধ্য খারাপ লাগত না। তাছাড়া মর্যাদাসম্পন্ন পরিবারের মেয়ে, সমাজের উঁচু মহলে বিস্তর আত্মীয়স্বজন তার।
তাদের সামাজিক মর্যাদা নানাভাবেই হারল্ডের উপকারে এসেছে। এসব কারণে স্ত্রীর প্রতি মনোযোগী থাকার একটা আকর্ষণ ছিল হারল্ডের।
তার আশা ছিল, আত্মীয় স্বজনের সুবাদে ভবিষ্যতে তাদের সন্তানও সামাজিক মর্যাদা ও গৌরবের অধিকারী হবে। কিন্তু হতাশ হয়েছে হারল্ড, তাদের কোনো সন্তান হয়নি। সন্তানহীনতার অনিবার্য ফল হল তাদের পারস্পরিক সাহচর্য কারোর কাছেই তেমন আনন্দদায়ক নয়। থাকতে হয় থাকা, নীরস একটা জীবনের ভারবহন মাত্র।
অ্যালিস তার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেই এখন থাকতে বেশি পছন্দ করে। এখন রিভিয়েরা থেকে ফিরে এসেছে।
হ্যারল্ড দোতলায় ড্রইংরুমে ঢুকে অ্যালিসের সঙ্গে মিলিত হল।
–আমি দুঃখিত অ্যালিস, স্টেশনে তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। গাড়ির ভিড়ে আটকে পড়েছিলাম। তা সান রাফেল কেমন লাগল?
অ্যালিসের ভাবে ভঙ্গিতে কথায় বার্তায় আভিজাত্যের ছোঁয়া। সে সান রাফেলের বিবরণ দিয়ে স্বামীর স্বাস্থ্যের কথা জানতে চাইল।
–তোমরা সবাই কি করে এমন অসুস্থ হয়ে পড়লে বুঝতে পারলাম না। এমার টেলিগ্রাম পেয়ে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
হারল্ড আর্সেনিকের কথা বলতে গিয়ে বলতে পারল না। একটা পরিবারের শান্তি শৃঙ্খলার পক্ষে ব্যাপারটা অমর্যাদাকর বলে বোধ হল তার।
হ্যারল্ড নিজের ঘরে গিয়ে ঘণ্টা দুয়েক বিশ্রাম করল। তারপর পোশাক পাল্টে ডিনার টেবিলে গিয়ে বসল। দু-চার কথার পর অ্যালিস বলল, তোমার জন্য একটা পার্সেল হলঘরের টেবিলে রাখা আছে।
বিকেলের ডাকে এল বোধহয়, খেয়াল করিনি–
–আচ্ছা শোন, একটা মেয়ে আমাকে বলল, কোনো এক রাদারফোর্ড হলে গুদামঘরে না কোথায় একটা স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। আমাদের রাদারফোর্ড হলে নিশ্চয় নয়?
হ্যারল্ড পলকে স্ত্রীর মুখে চোখ বুলিয়ে নিল।
–খুবই অপ্রীতিকর ঘটনা। মেয়েটির মৃতদেহ আমাদের গুদামঘরেই পাওয়া গেছে।
–আমাদের রাদারফোর্ড হলে! কি বলছ হারল্ড। আমাকে বলোনি তো।
–সময় পাইনি। কিন্তু ওই ঘটনার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তবু পুলিস যথেষ্ট জ্বালাতন করেছে সকলকে।
–খুনটা তাহলে কে করেছিল?
–পুলিস এখনো জানতে পারেনি। তদন্ত অব্যাহত আছে।
–স্ত্রীলোকটি কিরকম?
–কেউ তাকে সনাক্ত করতে পারেনি। তবে সন্দেহ করা হচ্ছে ফরাসি বলে।
ডাইনিং রুম ছেড়ে বেরিয়ে হারল্ড হলঘরে এল। পার্সেলটা তুলে নিল। দুজনে চুল্লির পাশে চেয়ারে গিয়ে বসল।
পার্সেলটা ছিঁড়ে একটা ট্যাবলেটের বাক্স বার করল হারল্ড। সঙ্গে একটুকরো কাগজ। তাতে লেখা, ডাঃ কুইম্পারের অনুরোধে পাঠানো হল। প্রতি রাতে দুটো ট্যাবলেট সেবনীয়।
বাক্সটা খুলে ট্যাবলেটগুলো চিনতে পারল হারল্ড। এরকম ট্যাবলেটই সে খাচ্ছিল। কিন্তু কুইম্পার বলেছিল, এখন এগুলোর আর দরকার নেই।
হ্যারল্ডের ভ্রূ কুঞ্চিত হল।
অ্যালিস ট্যাবলেটগুলোর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হারল্ড চিন্তিতভাবে বলল, কুইম্পারের পরামর্শে কেমিস্ট পাঠিয়েছে। এগুলো রাতে খেতাম। কিন্তু ডাক্তার আপাততঃ বন্ধ রাখতে বলছিল।
অ্যালিস বলল, দু-চারদিন হয়তো বন্ধ দেওয়া নিয়ম।
-তা হতে পারে। শরীরটা দুর্বল লাগছে। অসুখের পর আজই প্রথম বেরিয়েছিলাম। আমি শুতে যাচ্ছি।
-হ্যাঁ, তোমার এখন যথেষ্ট বিশ্রাম দরকার। তারপর ট্যাবলেটের বাক্সটা স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে বলল, এটা খেতে যেন ভুলে যেও না।
শোবার ঘরে এসে হারল্ড দুটো ট্যাবলেট জল দিয়ে গিলে ফেলল। তারপর বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল।
.
ডারমট ক্রাডককে খুবই ক্লান্ত হতাশ আর বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল।
ফ্লোরেন্সের বাড়িতে মিস মারপলের মুখোমুখি একটা চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে বসেছিলেন তিনি।
–এখন বুঝতে পারছি, ব্যাপারটা খুবই জট পাকিয়ে ফেলেছি। আমি নিজেই।
বিষণ্ণ ক্রাডককে সান্ত্বনা দিয়ে মিস মারপল বললেন, না, তেমন কিছু করেছ বলে মনে করছি না আমি। তোমার কাজ প্রশংসনীয়ই হয়েছে আমি বলব।
-আপনি বলছেন প্রশংসনীয় কাজ? এসব কি তাই–পাইকারিহারে একটা পরিবারের ওপর বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে, আর আমি কিছু করতে পারছি না। পরপর মারা গেল দুই ভাই, আলফ্রেড আর হারল্ড–চিন্তা করা যায় না পরিবারটার ওপরে কী চলেছে। সবই ঘটছে আমার চোখের সামনে।
–ট্যাবলেটগুলোতে বিষ মেশানো ছিল! চিন্তিতভাবে বললেন মিস মারপল।
–তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এক নারকীয় পরিকল্পনা।
-হ্যারল্ড যে ট্যাবলেট আগে খেয়েছিলেন হুবহু সেরকমই ছিল দেখতে। সঙ্গে একটুকরো কাগজে লেখা ছিল, ডাঃ কুইম্পারের নির্দেশ অনুসারে পাঠানো হল।
ডাঃ কুইম্পার ওগুলোর অর্ডার দেননি। একজন কেমিস্টের প্যাডে চিরকুট লেখা হয়েছিল। অথচ সেই কেমিস্টও এই ব্যাপারে কিছুই জানে না। একটা ব্যাপার পরিষ্কার বোঝা গেছে, ট্যাবলেটের বাক্সটা রাদারফোর্ড হল থেকেই পাঠানো হয়েছিল।
-তুমি কি নিশ্চিত যে ওটা রাদারফোর্ড হল থেকেই প্রেরিত হয়েছিল?
–আমি নিশ্চিত। আমরা তদন্ত করে দেখেছি, মানসিক উত্তেজনা প্রশমনের ওই ট্যাবলেটগুলো ওই বাক্সের মধ্যেই ছিল। ওগুলো এমার ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছিল।
–এমার জন্য
-হ্যাঁ। বাক্সের ওপর এমার আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। এছাড়া ছিল নার্সের আর যে কেমিস্ট তাতে ট্যাবলেট ভরেছিল তার হাতের ছাপ। অন্য কারো ছাপ ছিল না। খুবই সতর্কতার সঙ্গে কাজটা করা হয়েছিল।
–প্যাকেটের আসল ট্যাবলেটগুলো সরিয়ে অন্য ট্যাবলেট ভরা হয়েছিল।
–হ্যাঁ। ট্যাবলেটগুলো দেখতে একই রকম ছিল।
–আজকাল হরেক রকমের ট্যাবলেট বেরিয়েছে রোগের জন্য–একটা থেকে আরেকটার তফাৎ ধরা কষ্টকর। অথচ আমাদের সময়ে এমন গোলযোগ ঘটবার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। ডাক্তাররা নানান রঙের মিকশ্চার ব্যবহার করতেন। তা ওই ট্যাবলেটগুলো কিসের ছিল?
-একোনাইটের। বিষাক্ত। জলের সঙ্গে মিশিয়ে দেহের বাইরের অংশে প্রয়োগের জন্য দেওয়া হয়।
–সেগুলো খেয়ে হারল্ড মারা গেছে।
–ওকথা চিন্তা করলে এখনো আমার বুকে যন্ত্রণা হয়। ব্যাপারটা খুবই মর্মান্তিক। কাতর স্বরে বললেন ক্রাডক।
–আমি কোনো থৈ পাচ্ছি না। নিজের গলদটা ভালোভাবেই বুঝতে পারছি। গোটা ব্যাপারটাই কেমন গুলিয়ে ফেলেছি। এখানকার চিফ কনস্টেবল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ডেকে পাঠিয়েছে। আমি যে এখানে গর্দভের মতো কাজ করেছি তা তারা জেনে যাবে।
–তুমি অতো অধীর হয়ে পড়েছ কেন
–মিস মারপল, আপনার কাছে ভাবাবেগ প্রকাশ করে ফেলেছি বলে কিছু মনে করবেন না। আপনি চিন্তা করে দেখুন আমার ব্যর্থতা কী নিদারুণ। আলফ্রেডকে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছে, হারল্ডের মৃত্যুও বিষপ্রয়োগে। আমি জানি না শয়তানের মতো কে এসব কাজ করে চলেছে। আবার দেখুন, সেই নিহত স্ত্রীলোকটি, তার কি পরিচয় এখনো জানতে পারলাম না।
এডমান্ড ক্রাকেনথর্পের ঘনিষ্ঠ মহিলা মার্টিন ডুবয় রাদারফোর্ড হলে এসে নিহত হয়েছেন, এই কাহিনীর সঙ্গে সমস্ত ঘটনা এমন সুন্দর ভাবে মিলে যাচ্ছিল যে খুবই আশান্বিত হয়ে উঠেছিলাম।
কিন্তু দেখুন, অবিশ্বাস্য ভাবে আসল মার্টিন আত্মপ্রকাশ করলেন আর আমার এত পরিশ্রম যেন এক ফুকারে নস্যাৎ হয়ে গেল। এখন আর তল খুঁজে পাচ্ছি না।
স্যার রবার্ট স্টডার্ড ওয়েস্টের গৃহিণী বলে যিনি নিজের পরিচয় দেন, তার বক্তব্য সন্দেহাতীত। তাহলে গুদামঘরে পাথরের কফিনে যে মৃতদেহটি নিয়ে আমরা এত দৌড়ঝাঁপ করলাম, দফায় দফায় এত জিজ্ঞাসাবাদ, সেই স্ত্রীলোকটি কে? তার খুনের রহস্য যেখানে ছিল, সেখানেই রয়ে গেল। আমি তাহলে কোথায়? আবার সেই আন্না ট্রাভিনস্কির ব্যাপারটা দেখছি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, এই ঘটনার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই।
সম্পর্ক নেই বলেই ভাবছ?
মৃদু কাশির সঙ্গে ফিসফিস করে কথাগুলো বললেন মিস মারপল।
সন্দেহ পূর্ণ দৃষ্টিতে মিস মারপলকে লক্ষ্য করে ক্রাডক বললেন, জামাইকা থেকে লেখা সেই চিঠিতেই তো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল।
-কিন্তু সেটাকে সত্যি সত্যি প্রমাণ বলে কি মেনে নেওয়া যায়? বললেন মিস মারপল।
–কেন নয়?
-আমি বলতে চাইছি, ওরকম একটা চিঠি যে কোনো লোক পৃথিবীর যে কোনো জায়গা থেকে পাঠাতে পারে। মিসেস ব্রিয়ারলির ঘটনাটা শুনলেই তুমি পরিষ্কার বুঝতে পারবে আমি কি বলতে চাইছি। তার স্নায়বিক বিকার এত বেড়ে গিয়েছিল যে সকলে তাকে পরামর্শ দিল কোনো মানসিক হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। কিন্তু ছেলেদের এসব জানাতে তিনি সঙ্কোচবোধ করছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি অদ্ভুত এক কাণ্ড করলেন। তিনি চোদ্দখানা চিঠি লিখলেন এবং সেগুলো বিদেশের চোদ্দটা জায়গা থেকে পোস্ট করার ব্যবস্থা করলেন। চিঠিগুলোতে তার ছেলেদের জানানো হলো যে, তিনি মনের আনন্দে বিদেশ ভ্রমণ করছেন।
-বুঝতে পেরেছি, কি বোঝাতে চাইছেন, বললেন ক্রাডক, মার্টিনের কাহিনীটা আমাদের এত সম্ভবপর বলে মনে হল যে জামাইকার সেই চিঠির ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখার কথা বিবেচনা করিনি। জানি না সেখানে সম্ভাব্য কোনো সূত্র অবহেলায় পরিত্যক্ত হল কিনা।
মার্টিন ক্রাকেনথর্পের নাম সইকরা একটা চিঠি এমার কাছেও লেখা হয়েছে। লেডি স্টডার্ড পরিষ্কার জানিয়েছেন তিনি সেই চিঠি কখনওই লেখেননি। তাহলে কে পাঠালো সেই চিঠি? মার্টিন বলে পরিচয় দিয়ে এরকম একটা চিঠি পাঠাবার উদ্দেশ্যই বা কি? নিছকই কি কিছু অর্থ আদায়ের ফিকিরে? এগুলো যে জট পাকানো জটিল রহস্য নিশ্চয় আপনি তা স্বীকার করবেন?
হ্যাঁ, তা স্বীকার করি।
-তারপর আরও আছে দেখুন। এমা মার্টিনের নামে লন্ডনের ঠিকানায় যে চিঠিখানা লিখেছিল তার খামখানা পাওয়া গেল রাদারফোর্ড হলে। মার্টিন যদি সেখানে নাই এসে থাকে তাহলে চিঠির ঠিকানা লেখা খামখানা এলো কি করে? সত্যি সত্যি সে এসেছিল প্রমাণ হয়?
কিন্তু এসেছিল বলে তুমি যা বলতে চাইছ, নিহত স্ত্রীলোকটি সেই অর্থে রাদারফোর্ড হলে আসেনি। সে এসেছিল মৃত্যুর পরে। চলন্ত রেলগাড়ি থেকে তাকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল রেলবাঁধের ওপরে।
–হ্যাঁ, তা ঠিক।
তা যদি হয় তাহলে কি প্রমাণ হয়? ওই খামটা প্রমাণ করছে যে খুনী রাদারফোর্ড হলে এসেছিল। অনুমান করা যায় অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে খামখানাও মেয়েটির পকেটে ছিল। খুনী যখন পকেট থেকে সবকিছু তুলে নিয়েছিল তখন তার অজ্ঞাতে খামখানা পড়ে গিয়েছিল। অথবা, এমন হওয়াও সম্ভব যে, খুনী সেটা ভুল করে নয়, ইচ্ছাকৃতভাবেই ফেলেছিল। মৃতদেহ আবিষ্কার হবার পর রাদারফোর্ড হলের চত্বর ইনসপেক্টর বেকন এবং তোমার লোকজন আঁতিপাতি করে খুঁজেছে। কিন্তু খামখানা তাদের কারো চোখে পড়েনি। পরে খামখানা উদ্ধার হয় বয়লার হাউস থেকে। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে?
-সেটা বোঝা যাচ্ছে, ক্রাডক বললেন, বুড়ো মালী বাইরে আজেবাজে যা কিছু দেখতে পায় সবই বয়লার হাউসের মধ্যে নিয়ে জড়ো করে।
ছেলেদের কাছে সেই কারণেই ওই ঘরটা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার কথা। কোনো কিছু তাদের দৃষ্টিতে আনার খুব সহজ জায়গা।
–আপনি কি বলতে চাইছেন, আমাদের হাতে ফেলবার জন্যই পরে খামখানা সেখানে ফেলে রাখা হয়েছিল?
–কৌতূহলী হয়ে ছেলেরা আনাচেকানাচে রহস্যোর সূত্র খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তারা শেষ পর্যন্ত কোথায় যাবে তা অনুমান করা কিছু কঠিন ছিল না। তাছাড়া খোঁজার জায়গার একটা ইঙ্গিত তাদের দেওয়াও সম্ভব ছিল। এসব ভাবনা আসছে ওই খামখানা পাওয়ার পর। তোমরা তো আন্না ট্রাভিনস্কির সম্ভাবনার কথা বাদই দিয়েছিলে, তাই না?
তার মানে, আপনি বলতে চাইছেন নিহত মেয়েটি আন্নাই হতে পারে?
তা নয়। আমি ভাবছি আন্নার ব্যাপার নিয়ে তোমরা যখন অনুসন্ধান আরম্ভ কর, তখন কেউ তোমাদের সেই লাইন থেকে সরিয়ে আনার কথা ভেবে থাকবে।
-মূল ঘটনাটা তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে, নকল মার্টিন সেজে কেউ অগ্রসর হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কারণে সে বিরত হয়। কিন্তু সেই কারণটা কি হতে পারে?
বেশ তো বলছ তুমি।
–এমন যদি হয়, কোনো লোক তারবার্তা পাঠিয়ে জানিয়েছিল যে মার্টিন ফ্রান্সে ফিরে যাচ্ছে। তারপর সে মেয়েটিকে নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়ে তাকে হত্যা করে, এ পর্যন্ত আপনি নিশ্চয় মেনে নেবেন?
–এরকম হয়েছে বলে আমি মনে করি না, বললেন মিস মারপল, ঘটনাটা বড় বেশি সরল করে ফেলেছ তুমি।
–সরল করে ফেলছি। আপনার কথায় আবার সব গুলিয়ে যাচ্ছে আমার।
–তোমাকে কোনোরকম ধাঁধায় ফেলা আমার ইচ্ছা নয়।
–তা যদি হয়, স্পষ্ট করে বলুন, আপনি কি জানতে পেরেছেন নিহত স্ত্রীলোকটি কে ছিল?
–এখনো পর্যন্ত জানতে পারিনি, সে ঠিক কে ছিল। তবে সে কিরকম মেয়ে ছিল, তা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমি কি বলতে চাইছি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ?
–বুঝতে যা পেরেছি তাতে চোখের সামনে কেবল ধোঁয়া দেখছি।
এইসময় জানালার দিকে চোখ পড়ল ক্রাডকের। সেদিকে তাকিয়ে তিনি বললেন,-লুসি আইলেসব্যারো আসছেন, আপনার সঙ্গে দেখা করতে। আমি বরং এখন উঠি।
.
একটু চঞ্চলতা নিয়েই ঘরে ঢুকল লুসি। প্রাথমিক সম্ভাষণের পর সে বলল, আপনার টনটিন (Tontine) কথাটার অর্থ ডিক্সনারি খুঁজে বার করেছি।
পায়চারি করে ঘরের এটা সেটা নাড়াচাড়া করে দেখে বেড়াতে লাগল সে।
-দেখেছ তাহলে। শান্তকণ্ঠে বললেন মিস মারপল।
–দেখলাম, ইতালির এক ব্যাঙ্কার, লোরেঞ্জে তোতি, ১৬৫৩ খ্রি. একধরনের অ্যানুইটি, প্রবর্তন করেছিলেন, তারই নাম টনটিন। এর দ্বারা লগ্নীকারীদের মধ্যে মৃতদের অংশ যারা বেঁচে থাকে তাদের লাভের অংশের মধ্যে যুক্ত হয়। এই তো অর্থ, তাই নয়? বর্তমানে আমরা যেই সমস্যার মধ্যে রয়েছি টনটিনের অর্থ তার সঙ্গে বেশ মিলে যাচ্ছে। এখানে শেষ দুটি মৃত্যুর আগে আপনি কথাটা বলেছিলেন।
মিস মারপল কোনো জবাব দিলেন না। লুসির চঞ্চলতা নীরবে নিরীক্ষণ করে চললেন।
তাকের ওপরে রাখা একটা চিনামাটির কুকুর লক্ষ্য করতে করতে লুসি আবার বলল, –আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি বোঝবার পক্ষে শব্দটা যথোপযুক্ত। বৃদ্ধ জোসিয়া ক্রাকেনথর্প যে উইল করে গেছেন, তার নিষ্পত্তি হতে পারে যখন একজন মাত্র অংশীদার জীবিত থাকে এবং সে সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হয়। তবুও একটা বিরাট পরিমাণ টাকা ভাগাভাগি হলেও প্রতিভাগে টাকার পরিমাণ নেহাৎ কম দাঁড়ায় না।
কিন্তু মানুষ যখন অতিরিক্ত লোভী হয়ে পড়ে, বললেন মিস মারপল, তখনই অপ্রীতিকর ঘটনার সম্ভাবনা দেখা দেয়। প্রথমেই হয়তো লোভের বশবর্তী হয়ে কেউ খুন করে বসে না, কিংবা খুনের কথা চিন্তা করে না–কেবল কি করে নিজের অংশের চাইতে বেশি কি করে পাওয়া যেতে পারে, সেকথা ভাবতে থাকে।
কথা বলতে বলতে কোলের ওপর থেকে কাটা পশমগোলা নামিয়ে রেখে তিনি আবার বললেন, এরকম একটা ঘটনার সূত্রেই ক্রাডকের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়। অনেক টাকা পাওয়ার কামনা নিয়ে একটা লোক এমন সহজ একটা কাজ করল, যাকে কোনো ভাবেই অন্যায় বলা চলে না। হত্যার প্রশ্ন তখনো দেখা দেয়নি। কিন্তু শুরুটা হয়েছিল এভাবেই। আর ঘটনার নিস্পত্তি হয়েছিল তিন-তিনটা হত্যাকাণ্ড দিয়ে।
–এখানেও তো আমরা তিনটে হত্যাকাণ্ড দেখতে পাচ্ছি। যাকে মার্টিন বলে সন্দেহ করা হচ্ছিল, সে তার ছেলের জন্য সম্পত্তির একটা অংশ দাবি করতে পারত। সম্পত্তির দাবিদার ছিল আলফ্রেড এবং হারল্ডও। দাবিদারদের মধ্যে আর মাত্র দুজন এখন অবশিষ্ট আছে।
–কেড্রিক আর এমার কথা বলছ নিশ্চয়ই? বললেন মিস মারপল।
–এমাকে এর মধ্যে টানা যাচ্ছে না। কেন না সে দীর্ঘচেহারার কালো মানুষ নয়। এরকম মানুষ হল কেড্রিক আর ব্রায়ান ইস্টলি। তবে ব্রায়ান ফর্সা। তার চোখ নীল, কটা গোঁফ। কিন্তু সেদিন…।
বলতে গিয়ে থেমে গেল লুসি।
-হ্যাঁ, বল। কোনো ঘটনা নিশ্চয়ই তোমার চোখে পড়েছে; বুঝতে পারছি।
লেডি স্টডার্ড ওয়েস্ট যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন ঘটনাটা ঘটেছে। লুসি বলতে থাকে, বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে গাড়িতে উঠতে গিয়ে তিনি হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি যখন বাড়িতে ঢুকছিলাম, তখন রাস্তার ওপর একটি লম্বা কালো লোক দাঁড়িয়ে ছিল, সে কে?
-প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি, বাইরে রাস্তায় এসে কে দাঁড়াতে পারে। কেড্রিক তো শয্যাশায়ী এখনো। বাড়িতে দ্বিতীয় নোক বলতে ব্রায়ান ইস্টলি। আমি তার কথা বললাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, হ্যাঁ, ঠিক বলেছ, ব্রায়ানই হবে। ফ্রান্সে প্রতিরোধ আন্দোলনের সময় সে একবার আমাদের ডেরায় লুকিয়েছিল।
তাকে তখন কাছে থেকে দেখেছি, তার দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি, কাঁধের গঠন, সব আমার মনে আছে। পরে তিনি বললেন, এতদিন পরে তার সঙ্গে দেখা হলে খুশি হতাম। কিন্তু আমরা অনেক খুঁজেও ব্রায়ান ইস্টলিকে কোথাও পেলাম না।
মিস মারপল নীরবে লুসির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
লুসি বলে চলল, আমি পরে তাকে লক্ষ্য করলাম…সে আমার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়েছিল… আমি নজর করলাম, একজন মানুষ ফর্সা এবং তার চুল বাদামী হলেও তাকে সময় ও স্থান বিশেষে কালোও দেখাতে পারে। তখনই আমার মাথায় আসে আপনার বন্ধু যাকে ট্রেন থেকে দেখেছিলেন, সে ব্রায়ান হতে পারে।
–তা পারে।
–কিন্তু, অসহিষ্ণুভাবে বলে উঠল লুসি, এতে ব্রায়ানের লাভ কি? টাকাটা তো পাবে তার ছেলে আলেকজান্ডার। তাতে তার ভোগসুখের কিছুটা হেরফের যা হতে পারে, কিন্তু মূলধন নাড়াচাড়া করার অধিকার তো তার থাকবে না।
–সে অধিকার সে পেতে পারে যদি একুশ বছর হবার আগেই আলেকজান্ডারের জীবনে কিছু ঘটে।
সর্বনাশ..অমন কাজ…নিছক টাকার জন্য কোনো পিতা অমন কাজ করবে না–
মিস মারপল বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, টাকার জন্য মানুষ করতে পারে না এমন কাজ নেই। ইনসিওরেন্সের কিছু টাকার লোভে একজন স্ত্রীলোক তার তিনটি ছেলেকে খুন করেছিল–এমন ঘটনাও আমি জানি। টাকার লোভ এমনই যে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এক বুড়ীর কথা তোমাকে বলি, সাদামাটা ভালো মানুষ সে, কিন্তু তার ছেলে ছুটিতে বাড়িতে এলে তিনি তাকে খুন করেছিলেন।
আরও শুনবে? বৃদ্ধা মিসেস স্টানডইচের কাহিনী তো খবরের কাগজেও ছাপা হয়েছিল। প্রথমে তার মেয়ে মারা গেল, পরে ছেলে। তিনি জানালেন, মেয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। বিষ পাওয়াও গেল দইয়ের মধ্যে। পরে জানা গেল তিনি নিজেই তাতে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলেন। ধরা পড়েছিলেন তিনি তার অবশিষ্ট মেয়ে সন্তানটিকে বিষ প্রয়োগের সময়। এব্যাপারটা অবশ্য একটু অন্যরকম ছিল। জীবন উপভোগের আকাঙ্ক্ষা এই বৃদ্ধাকে উন্মাদ করে তুলেছিল। ছেলেমেয়েরা তার চেয়ে বেশি দিন বাঁচবে, জীবন উপভোগ করবে, এই ঈর্ষা থেকেই সে তার সন্তানদের খুন করেছিল।
যাইহোক, তুমি খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছ বুঝতে পারছি। ভেবো না; এলসপেথ ম্যাকগিলিকার্ডির আসার অপেক্ষায় রয়েছি আমি, যে কোনো দিন সে এখানে পৌঁছতে পারে।
তার সঙ্গে এখানকার কি সম্পর্ক তো বুঝতে পারছি না।
–হয়তো কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তার আসাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। তুমি বাছা অত দুশ্চিন্তা করো না।
–চিন্তা না করে তো পারছি না। এই পরিবারের সঙ্গে আমি কেমন জড়িয়ে পড়েছি।
–আমি সেটা লক্ষ্য করেছি। পরিবারের দুজনের প্রতি তুমি আসক্ত হয়ে পড়েছ।
–আপনার একথার অর্থ?
–এই পরিবারের দুটি ছেলের একজন ছেলে অন্যজন জামাই। দুঃখের বিষয় যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ দুজন মারা গেছে। আর যে দুজন বেশি আকর্ষণীয় তারা জীবিত। কেড্রিক আকর্ষণীয় একারণে যে সে নিজের মূলকে কখনো বড় করে তুলে ধরে না। তার এই দিকটাই তোমাকে আকর্ষণ করেছে।
মিস্টার ইস্টলি একটি দুর্বল ছিচকাঁদুনে বালক যেন। এরকম চরিত্রেরও আকর্ষণ আছে।
–কিন্তু এদের দুজনের একজন খুনী। কেড্রিক, দুই ভাইয়ের মৃত্যুতে সে একটুও বিচলিত নয়। এখন থেকেই মনের আনন্দে রাদারফোর্ড হল সম্পর্কে পরিকল্পনা তৈরি করছে। জায়গাটার উন্নতি করার জন্য অনেক টাকার দরকার, একথাও সে বলছে।
–এসব কথা শুনতে ভালো লাগে না। বললেন মিস মারপল।
এদিকে ব্রায়ানের অবস্থা দেখুন, তার মনোগত ইচ্ছা রাদারফোর্ড হলেই বাস করা। আলেকজান্ডারকে নিয়ে সে ওখানেই থাকতে পারবে। এসম্পর্কে অনেক মতলবও তার আছে।
-তাই বুঝি।
–কিন্তু অবাস্তব সব কল্পনা। খুব কার্যকর নয়। যুদ্ধবিমানের পাইলট বলেই বোধহয় কল্পনার আকাশে ভাসতে ভালোবাসে।
ব্রায়ান সম্পর্কে আর কি মনে হয় তোমার?
মিস মারপল চোখের কোণ দিয়ে তাকালেন লুসির দিকে।
–আর একটা বিষয় নজরে এসেছে দুদিন আগে। আমার সন্দেহ ব্রায়ান সত্যিই সেই গাড়িতে ছিল।
-প্যাডিংটন থেকে চারটে তেত্রিশে যে গাড়ি ছেড়েছিল? তবে সত্যটা না জানতে পারা পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
–আমরা জানতে পারব অবশ্যই, বললেন মিস মারপল, খুনীদের চরিত্র আমি জানি, তারা কখনো হাতগুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। দু দুটো খুন তারা করেছে–এর পর তারা চুপ করে বসে থাকবে না। আর তাই তারা অচিরেই আমাদের নজরে এসে যাবে। পুলিস সকলের ওপরেই নজর রেখেছে। সবচেয়ে বড় কথা হল, এলসপেথ যে কোনো মুহূর্তে এখানে হাজির হচ্ছে।
তুমি যেভাবে বললে, বুঝতে পারছি বটে, কিন্তু কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে, ওভাবে বলা–
বন্ধুর দিকে তাকিয়ে সলজ্জ কণ্ঠে বললেন মিসেস এলসপেথ ম্যাকগিলিকার্ডি।
–অস্বস্তির কি আছে বুঝতে পারছি না। বাড়ি পৌঁছলে, কথা বলতে বলতে তুমি বলতেই পার, আমি কি একবার ওপরে যেতে পারি
বন্ধুকে আশ্বস্ত করলেন মিস মারপল।
-যাই বল, বাড়ি পৌঁছেই সঙ্গে সঙ্গেই ওরকম বলা–
-দেখো, এরকম ঘটনা কেউ অস্বাভাবিক ভাববে না। তোমার হজমশক্তির পক্ষে আপত্তিকর যদি কিছু তুমি খেয়ে থাক–ওপরে যাওয়ার প্রয়োজন তোমার হতেই পারে–
–সে না হয় হল, তোমার উদ্দেশ্যটা এবার আমাকে বল।
–সেটা এখনই আমি বলতে চাই না।
–জেন, এ বড় বিরক্তিকর। জরুরী দরকার বলে তুমি আমাকে এতদূর ইংলন্ড অবধি ছোটা করিয়েছ, অথচ
আমি দুঃখিত এলসপেথ। কিন্তু এছাড়া আমার উপায় ছিল না। পুলিস সতর্ক নজর রেখেছে, তবু যে কোনো মুহূর্তে একজন তোক খুন হয়ে যেতে পারে, আমি আশঙ্কা করছি। এক্ষেত্রে আসাটা তোমার কর্তব্য বলেই মনে হয়েছে আমার। কর্তব্যকর্ম আমরা–তুমি বা আমি, কেউই অবহেলা করতে পারি না।
–তা অবশ্যই পারি না।
-কাজেই, তোমাকে যা করতে বলেছি, আমি ভেবেচিন্তেই বলেছি। চল, ওই তো ট্যাক্সি আসছে।
দুই বৃদ্ধা ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রাদারফোর্ড হলের দিকে যাত্রা করলেন।
.
ঘণ্টার শব্দ শুনে এমাই দরজা খুলে দিল। মিস মারপল ঘরে ঢুকলেন। তার পেছনে ঢুকলেন মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি।
প্রাথমিক সম্বোধন শেষ করে মিস মারপল বললেন, পরশু বাড়ি যাচ্ছি, তাই মনে হল, তোমাকে বিদায় জানিয়ে আর লুসির প্রতি তোমার সহৃদয় ব্যবহারের জন্য ধন্যবাদ না জানিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না।
আমার বন্ধু মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডিকেও নিয়ে এসেছি তোমার সঙ্গে পরিচয় করিতে দিতে। উনি এখন আমার কাছে রয়েছেন।
মিস ম্যাকগিলিকার্ডি এমার সঙ্গে করমর্দন করলেন।
এই সময় লুসি ঘরে ঢুকল। মিস মারপলদের দেখে সে খুশি হল।
-কী আশ্চর্য..মাসী তোমরা
–মিস ক্রাকেনথর্পকে বিদায় জানাতে এলাম। উনি তোমার প্রতি এত সহৃদয় ব্যবহার করেন
কেড্রিকও নেমে এসেছিল। তার দিকে তাকিয়ে মিস মারপল বললেন, তোমাদের অসুখের খবর পেয়ে খুবই মর্মাহত হয়েছিলাম। এখন ভালো আছ দেখে স্বস্তি পাচ্ছি।
-হ্যাঁ, আমরা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। বলল কেড্রিক।
–লুসির কাছে শুনলাম, ছত্রাক থেকে নাকি হয়েছে
বললেন মিস মারপল।
–কারণটা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। বলল এমা।
–তবে আর্সেনিকের একটা গুজব রটেছে চারপাশে। বলল কেড্রিক।
-কেড্রিক, ভাইকে ভর্ৎসনা করল এমা, ইনসপেক্টর ক্রাডক না এসব কথা বলতে বারণ করেছেন।
–সবাই তো এখন জেনে গেছে। বলল কেড্রিক, আপনারাও নিশ্চয় কিছু কিছু শুনে থাকবেন।
-আমি গত পরশু বিদেশ থেকে ফিরেছি। বললেন মিসেস এলসপেথ।
কেড্রিক হেসে বলল, তাহলে গুজব এখন আপনার কানে ওঠেনি। তবে লুসির মাসীমা নিশ্চয় শুনে থাকবেন যে কারিতে আর্সেনিক মেশানো ছিল–সবাই এখন একথা জেনে গেছে।
–আমি এরকমই কিছুটা শুনেছি। কিন্তু এসব কথা নিয়ে তোমাদের বিব্রত করতে চাইনি।
এই সময় দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প। তিনি লুসিকে চায়ের জন্য তাড়া দিলেন।
-এই মেয়ে, আমার চা এখনো আনননি কেন?
–চা তৈরি মিঃ ক্রাকেনথর্প। আমি এখুনি নিয়ে আসছি।
লুসি চলে গেল। বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প মিস মারপল ও মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডির সঙ্গে পরিচিত হলেন।
একটু পরেই ট্রে ভর্তি স্যান্ডউইচ, রুটি, মাখন, কেক নিয়ে ঘরে ঢুকল ব্রায়ান। লুসির হাতে চায়ের ট্রে।
-এত আয়োজন কিসের–এত? তীব্র স্বরে বলে উঠলেন বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প, আজকে আমাদের পার্টি হচ্ছে নাকি? আমাকে তো কেউ জানায়নি।
-বাবা আজ ডাঃ কুইম্পার আমাদের এখানে চা পান করতে আসছেন। তার জন্মদিন। বলল এমা।
-জন্মদিন? বৃদ্ধ চিড়বিড় করে উঠলেন, জন্মদিন তো শিশুবেলায় হয়, ও এসব দিয়ে কি করবে
এদিকে মিস মারপল ব্রায়ানের সঙ্গে পরিচিত হলেন।
লুসির কাছে তোমার কথা অনেক শুনেছি। তোমাকে দেখে আমাদের সেন্টমেরী মিডের এক সলিসিটরের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সে হল রনি ওয়েলস। বাপের ব্যবসায়ে ঢুকে কিছু করতে পারল না ছেলেটা। পরে পূর্ব আফ্রিকাতে গিয়ে আরও কিসব করার চেষ্টা করল। কিন্তু ব্যর্থ হল। সমস্ত মূলধন জলে গেল। তোমার সঙ্গে তার চেহারার এমন হুবহু মিল, আশ্চর্য তোমার কোনো আত্মীয় নয়তো?
–না, মাদাম, বলল ব্রায়ান, আমার কোনো আত্মীয় আছে বলে জানি না।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ জানালার দিকে সরে গেলেন মিস মারপল।
-বাঃ জানলা দিয়ে বাইরেটা সুন্দর দেখাচ্ছে তো! একেবারে ছবির মতো
এমা হাসিমুখে এগিয়ে গেলো তার দিকে।
–বিস্তর জায়গা ফাঁকা, বলল সে, শহরে আছি বোঝাই যায় না।
সেই মুহূর্তে মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি এমার কাছাকাছি এগিয়ে নিচুস্বরে বললেন, ওপরতলায় একটু যেতে পারি–মিস–
নিশ্চয় নিশ্চয়।
বলে উঠল এমা। লুসির দিকে তাকালো সে।
–আমার সঙ্গে আসুন।
মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডিকে নিয়ে লুসি চলে গেল।
এই তো কুইম্পার এসে গেছেন। বলল ব্রায়ান।
বাইরে গাড়ি থামার শব্দ হল। ঘরে ঢুকলেন হাস্যমুখ ডাঃ কুইম্পার।
-হ্যালো, এমা, কেমন আছ? সদাশয় ঈশ্বর, এসব কি
–আপনার জন্মদিন উপলক্ষ্যে জমানো কেকটা তৈরি করেছি, বলল এমা, আজকে আপনার জন্মদিন বলেছিলেন
-আশ্চর্য, আমি তো ভাবতেই পারিনি, গত একযুগ কেউ আমার জন্মদিনের কথা মনে করেনি।
মিস মারপলের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, আপনার সঙ্গে সেদিন পরিচয় হয়েছিল, আশা করি সুস্থ আছেন?
মিস মারপল মাথা নেড়ে স্মিত হেসে জানালেন তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন।
–তুমি এ কদিন আমাকে দেখতে আসনি ডাক্তার। বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প ডাঃ কুইম্পারকে উদ্দেশ্য করে অনুযোগ করলেন। এসো, চা খাওয়া যাক–সবই তৈরি।
-হ্যাঁ, সকলে আরম্ভ করুন। আমার বন্ধু না হয় অস্বস্তি বোধ করবেন। বললেন মিস মারপল।
চায়ের টেবিলে গোল হয়ে বসে সকলে চা ও খাবারের সদ্ব্যবহারে মন দিলেন।
মিস মারপল মাখন রুটি শেষ করে স্যান্ডউইচ হাতে নিলেন।
–এটা মাছের, নিন, বলল ব্রায়ান, এটা বানাতে আমি লুসিকে সাহায্য করেছি।
–ওহ, এ বাড়ির খাবার সাবধান, বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প বলে উঠলেন, আমার দুই ছেলেকে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছে। কে এসব করেছে জানা গেল না।
-ওঁর কথায় ভয় পাবেন না, বলল কেড্রিক, আমিও একখানা নিচ্ছি।
গোটা একখানা স্যান্ডউইচই সে মুখে পুরে দিল।
স্যান্ডউইচ চিবোচ্ছিলেন মিস মারপল। হঠাৎ তিনি হাঁসফাঁস করে উঠলেন। তার সমস্ত মুখ লাল হয়ে গেল। শ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগল। কোনো রকমে বলার চেষ্টা করলেন, গলায় কাঁটা ফুটেছে।
ডাঃ কুইম্পার উঠে এলেন। মিস মারপলকে জানালার দিকে মুখ করে বসালেন। তাকে মুখ খুলতে বললেন।
পকেট থেকে একটা কেস বের করলেন, তার ভেতর থেকে ছোট্ট একটা চিমটা বেছে নিলেন।
হাঁ মুখ হয়ে বসেছিলেন মিস মারপল। কুইম্পার সামান্য ঝুঁকে পেশাগত দক্ষতার সঙ্গে তার গলার ভেতর পর্যন্ত দেখার চেষ্টা করতে লাগলেন।
সেই মুহূর্তে দরজা খুলে মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি ঘরে ঢুকলেন। তার পেছনে লুসি।
সামনেই জানালার ধারে মিস মারপল চেয়ারের পেছনে হেলান দিয়ে বসে আর ডাঃ কুইম্পার তার গলা ধরে মাথাটা ওপরের দিকে কাত করে দিচ্ছেন। এই দৃশ্যটার দিকে চোখ পড়তেই মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, এই তো সেই লোকটা-ট্রেনের সেই লোকটা।
তৎক্ষণাৎ এক ঝটকায় ডাক্তারের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালেন মিস মারপল। দ্রুতপায়ে এগিয়ে এলেন বন্ধুর দিকে।
–লোকটাকে তুমি ঠিক চিনতে পারবে আমি জানতাম, বললেন মিস মারপল, এখন আর কিছু বলল না।
ডাক্তার কুইম্পারের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ডাক্তার, আপনি সেদিন যা ভাবতে পারেননি, তাই ঘটেছিল। ট্রেনে যখন একটি স্ত্রীলোকের গলা টিপে আপনি হত্যা করছিলেন, আপনার সেই কাজ পার্শ্ববর্তী ট্রেন থেকে এই বন্ধু দেখেছিলেন।
খুনে শয়তান, মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি তোমাকে দেখেছিল, বুঝতে পেরেছ?