১. ভিকারেজ থেকেই গল্পটা শুরু

মার্ডার অ্যাট দ্য ভিকারেজ – আগাথা ক্রিস্টি
অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ

০১.

ভিকারেজ থেকেই গল্পটা শুরু করা যাক।

সেদিন দুপুরে খাবার টেবিলে খেতে বসেছি আমি, আমার স্ত্রী গ্রীসলডা আর ভাইপো ডেনিস।

নানান প্রসঙ্গে গল্প হচ্ছে। কথা প্রসঙ্গে বললাম, কর্নেল প্রথেরো বড্ড গোলমাল বাঁধাচ্ছে। ও যে ব্যাপারে থাকে তাতেই গোলমাল বাঁধায়।

ডেনিস বলল, বুড়োটা বড্ড অহঙ্কারী গোঁয়ার। ওই স্বভাবের জন্যই মনে হয় আগের বউটা তার কাছ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল।

গ্রীসলডা বলল, কি হয়েছে বল তো। তোমরা দেখছি লোকটার ওপরে হাড়ে হাড়ে চটা।

আমি বললাম, চটা কি বলছ, কর্নেল প্রথেরোকে যদি কেউ খুন করে তাহলে নিঃসন্দেহে পৃথিবীর একটা বড় কাজ করবে।

ছুঁড়ে ছুঁড়ে না বলে, মোদ্দা ব্যাপারটা বল না। বলল গ্রীসলডা।

বলব কিনা ইতস্তত করছি। কেননা, গ্রীসলডা কোন ব্যাপারটাকেই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে পারে না। সেটা অবশ্য ওর বয়সের দোষ। আমার সঙ্গে ওর কুড়ি বছরের বয়সের ব্যবধান।

সুন্দরীরা সাধারণত চঞ্চলমতি হয়ে থাকে। গ্রীসলডাও সুন্দরী। ওর মানসিক উন্নতির জন্য ধৈর্য ধরে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু চেষ্টা কার্যকরী হয়নি।

মাঝে মাঝে মনে হয় আমার বিয়ে না করাই উচিত ছিল। কেন যে পরিচয় হবার পর ওকে বিয়ে করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলাম বুঝতে পারি না।

সব মানুষের জীবনেই বিয়েটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। খুব চিন্তাভাবনা করে পরস্পরকে ভালভাবে বুঝে বিয়ে করা উচিত। তা না করার ফলেই এখন মানসিক চাপ সয়ে আমাকে সংসার করতে হচ্ছে।

গ্রীসল ফের সাগ্রহে জানতে চাইল, তোমাদের মধ্যে গোলমালটা কি নিয়ে। বল না শুনি।

বললাম, খুবই সাধারণ ব্যাপার। বিপত্তিটা ঘটেছে মিস প্রাইস রিডলের পাউণ্ডের তুচ্ছ একটা নোট নিয়ে।

মিস রিডেল হলেন আমাদের মহাসভার একজন সদস্যা। ওঁর বাবার মৃত্যুবার্ষিকী পালনের সময় সংগ্রহ করা অর্থের সঙ্গেই নোটটা রাখা হয়েছিল। পরে সেটা পাওয়া যায়নি। ঘটনা এটুকুই। কিন্তু এ নিয়ে অভিযোগ করেছিল আমাকে।

আমি অবশ্য তাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম যে কোথাও একটু ভুল করে ফেলেছে। কিন্তু এ ব্যাপার নিয়েই ঝঞ্ঝাট পাকিয়ে ফেলল প্রথেরো।

সেদিনটা ছিল বুধবার। সেদিন সকালে আমি চার্চ ডে স্কুলে পড়াই। অহেতুক মনের ওপর চাপ পড়ায় সারা দিনটাই অস্বস্তিতে কাটাতে হয়েছিল।

সংক্ষেপে ঘটনাটা স্ত্রীকে জানালাম। সে স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে জবাব দিল, কর্নেল থেরো নিশ্চয় তামাসা করেছেন।

একটু থেমে ফের বলল, মানুষটার কথা তো জান, মন মেজাজ ভাল থাকে কি করে। আপনজন বলতে কেউ নেই। নতুন বউ আর মেয়ে দুজনেরই চক্ষুশূল। ওভাবে বলে মিস রিডলের একটু মন ভেজাবার চেষ্টা করেছিলেন সম্ভবত।

–তাই বলে ওই তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে অমন উঠেপড়ে লাগবার কিছু হয়নি। কিছুটা রুক্ষ শোনালো আমার গলা। তার কথার অর্থটা কি দাঁড়াতে পারে তা তার ভেবে দেখা উচিত ছিল। বোধবুদ্ধিহীন মন্তব্য করে চার্চের হিসেবনিকেশ দেখার প্রসঙ্গ পর্যন্ত তুলে ফেলল।

একটু থেমে পরে বললেন, ওকি মনে করে চার্চের তহবিলের টাকা আমি তছরুপ করে থাকি?

গ্রীসলডা কোমল সুরে বলল, ওরকম সন্দেহ তোমাকে কেউ করবে না। আসলে তুমি সন্দেহের এমন ঊর্ধ্বে যে সেটাই তহবিল তছরুপের একটা সুযোগ হয়ে উঠতে পাবে।

এই সময় মেরী ঘরে ঢুকল। আমি কথা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম।

টেবিলে রাইস পুডিং-এর ডিস রেখে মেরী চলে গেলে গ্রীসলডাকে বললাম, কাল সন্ধ্যাবেলা প্রথেরো আসছে। কথা হয়েছে, দুজনে মিলে হিসেব পরীক্ষা করব। আজকের মধ্যেই আমাকে সি.ই.এম-এর জন্য আমার মন্তব্য লিখে রাখতে হবে।

তারপরই আমি প্রসঙ্গান্তরে যাবার চেষ্টা করলাম, ভাল কথা আজ বিকেলে তুমি কি করছ?

গ্রীসলডা হেসে বলল, নতুন করে আর কি করব। দু-চারজন পাড়াপড়শী হয়তো আসবে। তাদের সঙ্গে চা সহযোগে পরচর্চার আসর বসবে আর কি।

কে কে আসবে তোমার আসরে?

গ্রীসলডা বলল, এই ধরো, মিস প্রাইস রিডলে, মিস ওয়েদারাই, মিস হাটনেল। সেই জাঁহাবাজ মহিলা মিস মারপল তো থাকছেনই।

আমি বললাম, তুমি জাঁহাবাজ বললেও মিস মারপলকে কিন্তু আমার বেশ ভালই লাগে। মহিলা রঙ্গরস বোঝেন, নিজেও রসিকা।

–তা যতই থাক, গ্রামের মধ্যে অমন ধুরন্ধর মহিলা দ্বিতীয় নেই। সব ঘটনাই কেমন করে জেনে যান আর সেই ঘটনা থেকে অদ্ভুত সব সিদ্ধান্ত টেনে বার করেন।

-তোমার চায়ের আসরে আমি কিন্তু থাকছি না। ডেনিস বলল আমার স্ত্রীকে।

–কেন কোথায় যাবে?

–প্রথেরো টেনিস খেলার আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

 খাওয়াদাওয়ার পাট চুকলে ডেনিস বেরিয়ে গেল। আমি আর গ্রীসলডা পড়ার ঘরে চলে এলাম।

লেখার টেবিলে একটা চেয়ার টেনে বসলাম। গ্রীসলডা টেবিলের ওপরে মুখোমুখি বসল। বলল, একটু ভুল হল বোধহয়।

-কি রকম? জানতে চাইলাম।

–আজকের চায়ের আসরে ডঃ স্টোন, মিস ক্ৰেম আর মিসেস লেসট্রেসকে আসতে বললে ভাল হত। কাল অবশ্য আমি মিসেস লেসট্রেসের বাড়ি গিয়েছিলাম। কিন্তু দেখা হয়নি, বাড়ি ছিল না।

টেবিলের ওপরে অকারণে আঙুল ঘষল ও। তারপর বলল, ভাবছি ওকে বলেই আসব। মহিলা কেমন যেন অদ্ভুত।

–কি রকম?

-এই দেখনা এখানে এসে থেকেই গেল। তারপর বাইরেও ক্কচিৎ কখনো বেরয়। সর্বদাই কেমন বিষণ্ণ ভাব।

গ্রীসলডা বকবকানির সুযোগ পেলে থামতে চায় না। তার ওপরে পরচর্চার সুযোগ পেলে তো কথাই নেই। আমি মজা করে বললাম, থেমে গেলে! বলে যাও।

ও হেসে বলল, তুমি এই কথাটাকে হাল্কাভাবে নিলে। তলিয়ে দেখলে না। ওই সুন্দরী মহিলা সত্যি সত্যি আমাদের কাছে রহস্যময়ী হয়ে আছে। তার অতীত ইতিহাস এখানে কেউ জানে না। তার প্রকৃত পরিচয়ও অজানা।

একটু থেমে অন্তরঙ্গ সুরে বলল, তবে আমার মনে হয় ডাক্তার হেডক ওর সম্পর্কে কিছু জানে।

–কথাটা তো গোয়েন্দার মত হয়ে গেল। ওসব গল্প আজকাল খুব পড়ছ মনে হচ্ছে।

এবারে চোখ বড় বড় করে গ্রীসল আমার দিকে তাকাল। বলল, কি ব্যাপার বলতো। কয়েকদিন আগে সিঁড়িতে দাগ বইটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। নিশ্চয় তুমি সরিয়েছিলে?

হেসে বললাম, পরে তো পেয়েছ। খানিকটা লেখা আমার চোখে পড়েছিল বলে বইটা তুলে রেখেছিলাম।

–আমি জানি লেখাটা কি।

বলতে বলতে আমার প্রতি মোহনীয় কটাক্ষপাত করে ঘর থেকে চলে গেল।

লাঞ্চের পরেই এ ঘরে চলে এসেছিলাম মেনস সোসাইটির চার্চের জন্য একটা বক্তৃতা লিখব বলে। গ্রীসলমবার্ড চলে যেতে এবারে কাগজ কলম টেনে নিয়ে বসলাম।

কিন্তু দুর্দৈব যাকে বলে। ঠিক এই সময় এসে হাজির হল লেটিস। ও হলো কর্নেল প্রথেরোর প্রথম পক্ষের মেয়ে।

আমাকে জিজ্ঞেস করল, ডেনিস কোথায়?

 লাঞ্চের পর কোথায় বেরিয়ে গেল। তোমাদের ওখানেই তো টেনিস খেলতে যাবে বলেছিল।

এরপর লেটিস গ্রীসলডার খোঁজ করল।

বললাম, বাগানের স্টুডিওর ঘরে পাবে। লরেন্স ছোকরা ওর ছবি আঁকছে।

লেটিস বলল, বাবার সঙ্গে লরেন্সের সেদিন খুব একচোট হয়ে গেছে।

–সেকি! কেন?

–সাঁতারের পোশাকে ওকে দিয়ে একটা ছবি আঁকাতে চেয়েছিলাম। তাইতেই বাবা যা-নয়-তাই বলে বাড়ি মাথায় করল।

দেখ, ওই পোশাকে বিচে যেতে পারি, তখন কোন দোষ হয় না, ছবি আঁকতে চাইতেই যত দোষ হয়ে গেল।

আমি কি বলব। চুপ করে রইলাম।

লেটিস ফের বলল, বাবা লরেন্সকে সোজা বলে দিল বাড়িতে না আসার জন্য। ওতে অবশ্য আমার কিছু যায় আসে না। তোমার স্টুডিওতে এসেই আমি ছবি আঁকিয়ে যাব।

-তা তো হয় না লেটিস, আমি বললাম, বিশেষ করে তোমার বাবার যখন আপত্তি রয়েছে।

–তোমরা দেখছি সবাই একই রকম। বড্ড সেকেলে। দিনরাত শাসনে শাসনে থেকে আমি একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছি।

যদি হাতে টাকা থাকতো, তাহলে এখান থেকে চলে যেতাম।

একটু থেমে ও আবার বলল, ভাল ব্যবহার তো কোনকালেই করবে না, বাবা যদি মারা না যায় তাহলে এখানে আমি স্বস্তিতে থাকতে পারব না।

–ওভাবে তোমার বলা উচিত হচ্ছে না, লেটিস।

–কেন বলব না, কোনদিন আমার হাতে একটা টাকা দেবে না। কঞ্জুসের হাড়।

লেটিসের গলায় ক্রমশ উত্তেজনা বাড়ছিল। একটু থেমে পড়ে বলল, মা বাবাকে ছেড়ে চলে গেছে শুনে আমি একটুও অবাক হইনি। তুমি তো জান না, ছেলেবেলা থেকে আমাকে শোনানো হয়েছে, আমার মা মৃত। এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারি যে পুরুষকে তার স্ত্রী ছেড়ে চলে যায় সে কি প্রকৃতির পুরুষ।

আমি কি বলতে যাচ্ছিলাম, বাধা দিয়ে লেটিস ফের বলতে লাগল, আমার সম্মা অ্যানা, জেনে রেখো, সে-ও বেশিদিন নেই। খুব শিগগিরই কারো প্রেমে জড়িয়ে পড়বে।

জানো, অ্যানা আমাকে ঘৃণা করে। অথচ ভাল ব্যবহার দিয়ে আমাকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে।

ওর কথার তোড় যেভাবে বাড়তে শুরু করেছে, আমি শঙ্কিত না হয়ে পারলাম না। আমার লেখাটা বরবাদ হয়। ভাগ্য ভাল, লেটিস নিজেই সেই আশঙ্কা দূর করল।

হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করে বসল, আমার গ্রামোফোন রেকর্ডগুলো তোমার চোখে পড়েছে?

-কেন কি হল সেগুলো?

–আমিই রেখেছি, কিন্তু কোথায় যে তা আর খুঁজে পাচ্ছি না। দিন দিন অন্যমনস্কতা কেমন বেড়ে যাচ্ছে। বড্ড বিশ্রী লাগছে। নাঃ এখন উঠি। তিনটের সময় আবার ডঃ স্টোনের গাড়ি দেখতে যাবার কথা।

আমি হাত ঘড়ির দিকে তাকালাম। চারটে বাজতে পঁচিশ মিনিট বাকি। হাসতে হাসতে ওকে সময়টা জানালাম।

–সর্বনাশ, বুঝতেই পারিনি। ওরা কি আর এতক্ষণ আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। তবু একবার ঘুরে আসি গে।

ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে বলল, তুমি ডেনিসকে বলে দিও।

 কি বলতে হবে বুঝতে পারলাম না। তবু ঘাড় নেড়ে সায় জানালাম।

ডঃ স্টোনকে আমি জানি। তিনি একজন সুপরিচিত প্রত্নতাত্ত্বিক। আমাদের ব্লু বারে থাকবার জন্য কিছুদিন হল এসেছেন। কর্নেল প্রথেরোর জমিতে লোকজন নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করছেন।

ইতিমধ্যেই লেটিসকে তার কাজ দেখাতে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার নিয়ে কর্নেলের সঙ্গে বারকয়েক ডঃ স্টোনের বিসংবাদ হয়ে গেছে। খবরটা শুনে অবশ্য আমার বেশ মজাই লেগেছিল।

ডঃ স্টোনের সেক্রেটারী মিস ক্রেমের সঙ্গে শুনেছি লেটিসের ভাব জমেছে। মহিলার বয়স পঁচিশ ছুঁয়েছে। বেশ স্বাস্থ্যবতী আর আমুদে ধরনের।

লেটিস যেরকম বাঁচাল আর চঞ্চল কি করে সেই মহিলার সঙ্গে তার পটলো বুঝতে পারি না। তাছাড়া তার সম্পর্কে গ্রামের মানুষের বিভিন্ন ধারণা। লেটিসেরও সে সব না জানার কথা নয়।

লেটিসের কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। বছর পাঁচেক হল কর্নেল প্রথেরো ফের বিয়ে করেছিল। দ্বিতীয় বউ সুন্দরী। মেয়ে আর সম্মায়ের মধ্যে যে সম্পর্ক সুখের নয় তা আমি আঁচ করতে পারতাম।

নাঃ বক্তৃতাটা লিখতে গিয়ে বড় বাধা পড়ছে। লেটিস যেতে না যেতেই সে এসে হাজির হল। প্রথেরোর সঙ্গে কালকের হিসেবনিকেশে বসার কথাটা জানতে চাইল।

দু-চার কথাটা সংক্ষেপে বলে ওকে বিদেয় করলাম। তারপর চটপট লেখাটা শেষ করলাম। সাড়ে চারটে নাগাদ পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে এলাম।, দেখলাম গ্রীসলডার চায়ের আসরের তোড়জোড় চলছে। ইতিমধ্যেই চারজন অতিথি এসে। হাজির হয়েছে।

গ্রীসলডা চায়ের টেবিলের পেছনে চেয়ারে বসে তাদের সঙ্গে গল্প করছে।

উপস্থিত সকলের সঙ্গেই আমি সম্ভাষণ বিনিময় করলাম। তারপর মিস মারপল আর মিস ওয়েদারবাই-এর মাঝখানের চেয়ারে গিয়ে বসলাম।

গ্রীসলডা কৌতুকহাস্যে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, শুনেছ, ডঃ স্টোন আর মিস ক্রেম-এর কথা?

–কি হল ওদের? জানতে চাইলাম আমি।

জবাব দিলেন মিস ওয়েদারবাই। গ্রীসলডার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওর মত সুন্দরী মহিলার একজন অবিবাহিত পুরুষের সেক্রেটারীর কাজ নেওয়াটা কিছুতেই ঠিক হয়নি।

আমি বললাম, তা কেন, মেয়েরা আজকাল ছেলেদের মতই কাজ করতে পারে।

এর পর অনিবার্যভাবেই আধুনিকতার হালচাল নিয়ে একটা ছোটখাট আলোচনা শুরু হয়ে গেল।

একসময় আমার স্ত্রী বলল, আসলে একটা অভিনব কিছু করার ইচ্ছেতেই মিস ক্ৰেম ডঃ স্টোনের সেক্রেটারীর কাজটা নিয়েছে।

আমাদের দুজনের কথাই দেখলাম অন্য চার মহিলার মনঃপুত হল না।

সব শেষে মিস মারপল আমার স্ত্রীর পিঠে আলতো করে চাপড় দিয়ে বলল, তুমি ভাই বড় সরল। অবশ্য কমবয়সী মেয়েদের মন এমনিই সরল হয়।

গ্রীসলডা সরাসরি প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, সরলতার প্রশ্ন নয়, ব্যাপারটা বাস্তবতার। তুমি কি সত্যি সত্যি ভাবছো, ওরকম টেকো মাথার বেরসিক লোককে মিস ক্রেম বিয়ে করে বসবে?

মিস মারপল বলল, লোকটা কেবল বেরসিক নয়, বদমেজাজীও। কদিন আগেই তো কর্নেলের সঙ্গে একপ্রস্থ ঝগড়া হয়ে গেল।

মিস ওয়েদারবাই বলল, ওই ছোকরা শিল্পী রেডিং-এর কথা শুনেছো তো; কি একটা গোলমালে কর্নেল নাকি তাকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে?

মিস মারপল মাথা নেড়ে মিস ওয়েদারবাইকে সমর্থন করল। বলল, লোকটা লেটিসের স্নানের পোশাকে ছবি আঁকতে গেছিল।

–আমার মনে হয় ওদের দুজনের মধ্যে লটঘট কিছু আছে। মিস প্রাইম রিডলে বলল, ওই শিল্পী ছোকরা ওই বাড়িতে ঘুরঘুর করে।

একটু থেমে ফের বলল, মেয়েটারই বা কি দোষ, জন্ম থেকে মায়ের স্নেহ পায়নি, বাপ তো ওই রকম গোঁয়ার গোবিন্দ। সম্মা আর কতটা হবে সেতো বুঝতেই পারছ। ছোকরার সঙ্গে না ঘেঁষে আর কি করে।

মিস ওয়েদারবাই বলল, তবে যাই বল শিল্পী ছোকরাকে দেখতে কিন্তু চমৎকার।

মিস হার্টনেল বলল, শিল্পীটিল্পীরা বরাবরই নারীঘেঁষা হয়। ওদের স্বভাব-চরিত্র ভাল হয়। না।

প্রাইস রিডলে বলল, তা না হলে কি আর স্নানের পোশাকে ছবি আঁকতে চায়।

–আমাকেও তো সে এঁকেছে। আমার স্ত্রী বলল।

 মিস মারপল তার দিকে কটাক্ষ করে বললে, এঁকেছে, তবে নিশ্চয় স্নানের পোশাকে নয়।

 গ্রীসলডার ভাষায় এই হল তাদের পরচর্চার আসর। একেবারে অক্ষরে অক্ষরে নির্ভুল।

 বড্ড একঘেয়ে হয়ে উঠেছিল। উঠব উঠব মনে করছি। বলতে একদম ভুলে গেছি। ডাক্তার হেডককে মিস লেসট্রেঞ্জের ঘর থেকে বেরুতে দেখলাম।

কথাটা শুনে ওরা একে অন্যের মুখের দিকে তাকাল।

মিস প্রাইস রিডলে বলল, তাহলে অসুখ-বিসুখ কিছু করেছে।

-তাহলে হঠাৎ করেই কিছু হয়েছে। আমি তো আজ বিকেল তিনটে নাগাদও ওকে বাগানে বেড়াতে দেখেছি। কই দেখে তো অসুস্থ বলে মনে হয়নি।

ডাক্তার আর লেসট্রেঞ্জ মনে হয় পূর্বপরিচিত। বলল মিস প্রাইস রিডলে।

–ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে কৌতূহলোদ্দীপক। মিস ওয়েদারবাই ফোড়ন কাটল।

গ্রীসলডা সামনের দিকে ঝুঁকে নিচু স্বরে বলল, আমি জানতে পেরেছি একজন মিশনারীর খপ্পরে ও পড়েছিল। কোন কিছুই আর বাকি রাখেনি–বউ করতে চেয়েছিল। শেষে ডাক্তার নাকি ওকে উদ্ধার করে।

সঙ্গে সঙ্গে ওদের আলোচনা বেশ সরস হয়ে ওঠে।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ পরচর্চার আসর একসময় ঝিমিয়ে এলো। চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে মিস ওয়েদারবাই বলল, তবে যাই বল ভাই, লরেন্স রেডিং-এর সঙ্গে লেটিস থেরোর সম্পর্ক অনেকদূর অবধি গড়িয়েছে। তুমি কি বল মারপল? গ্রামের কিছুই তো তোমার অজানা থাকে না।

মিস মারপল একমুহূর্ত কি ভাবল। পরে ধীরে ধীরে বলল, আমার ধারণা লেটিস নয়, যদি ওই ছোকরার সম্পর্ক হয়েই থাকে তবে সে সম্পূর্ণ অন্য কেউ।

.

০২.

 খানিক পরেই আমি চর্চা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। পথে নামতেই মিস লেসট্রেঞ্জের সঙ্গে দেখা হল। দুজনে গল্প করতে করতে চলতে লাগলাম।

বাড়ির কাছে পৌঁছলে ও অনুরোধ জানাল তার বাড়ি যেতে। আমি আপত্তি করলাম না। দুজনে বাড়ির ভেতরে গেলাম।

কিছুদিন আগে লেসট্রেঞ্জ এই সেন্ট মেরী মিড-এ এসেছে। এখন দেখছি পাকাপাকি ভাবেই রয়ে গেছে।

বুঝতে পারি না ওর মত একজন সুন্দরী আধুনিকা এই অজ পাড়াগাঁয়ে পড়ে আছে কেন। ওর পক্ষে এই পরিবেশ নির্বাসন ছাড়া কিছুই নয়।

বসার ঘরে পরিষ্কার আলোয় এই প্রথম ওকে সামনাসামনি এত স্পষ্ট করে দেখার সুযোগ পেলাম। ওকে কেবল সুন্দরী বললে কমই বলা হয়। দীর্ঘাঙ্গী, স্বর্ণকেশী। চোখের পাতা ভ্র গভীর কালো ডাগর আয়ত নীল চোখ দুটোকে মায়াময় করে রেখেছে। মুখের ডৌলটিও এককথায় নিখুঁত।

নির্দিষ্টভাবে কথাবলার প্রসঙ্গ কিছুই ছিল না। বই, ছবি, পুরনো দিনের চার্চের কথা–এসব নিয়েই খানিকক্ষণ টুকরো টুকরো গল্প হল। এর মধ্যেই আমার কেন যেন মনে হল, ও আমাকে কিছু বলতে চায়।

কিন্তু কিছুই বলল না। আমি একসময়ে উঠে পড়লাম। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার আগে আমি একপলক তাকালাম ওর চোখের দিকে। একমুহূর্ত ইতস্তত করে বললাম, আপনার জন্য কিছু করতে পারলে খুশি হব।

ও যেন আমার এই কথাটার জন্যই অপেক্ষা করেছিল। বলল, আপনার অনেক দয়া। কিন্তু এমন এক জটিল ব্যাপারে জড়িয়ে আছি, মনে হয় না আমাকে কেউ সাহায্য করতে পারে। তবু আপনি যে সাহায্য করতে চেয়েছেন তার জন্য ধন্যবাদ।

বুঝতে অসুবিধে হল না, ও দ্বিধা কাটিয়ে উঠে নিজের সম্পর্কে এই মুহূর্তে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেছে। আমাকে তার আর কিছু বলার নেই।

মিস লেসট্রেঞ্জের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পথে নামলাম। কিছুদূর যেতেই দেখি মিস হার্টনেল এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। বলল, দেখলাম লেসট্রেঞ্জের বাড়ি থেকে বেরুলেন। কিছু জানতে পারলেন?

-কি ব্যাপারে? বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলাম।

–ওই রহস্যময়ী লেসট্রেঞ্জ সম্পর্কে? ও কি সত্যিই বিধবা, নাকি স্বামী বাইরে কোথাও থাকে?

মহিলার কৌতূহল অশোভন ঠেকলেও বিস্মিত হলাম না। গ্রামের এসব মহিলার অপরের সম্পর্কে মাত্রাছাড়া কৌতূহল সম্পর্কে আমি যথেষ্টই ওয়াকিবহাল।

বললাম, এসম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারব না। এসব কোন কথা উনি আমাকে বলেননি।

ডাক্তার হেডকের সঙ্গে ওর কি অনেক দিনের পরিচয়?

 –মাপ করবেন, বলতে পারব না।

মিস হার্টনেল একমুহূর্ত কি ভাবল। কিছু গোপন করছি কিনা সম্ভবত তা আন্দাজ করবার চেষ্টা করল।

আমি তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবার সুযোগ না দিয়ে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে চললাম।

.

গেট খুলে ভিকারেজে ঢুকতে গিয়ে মনে হল লরেন্স রেডিং-এর স্টুডিওটা একবার ঘুরে যাওয়া যাক। গ্রীসলডার ছবি কতটা এগিয়েছে জানা যাবে।

স্টুডিওতে বাইরের কোন লোক থাকতে পারে আমার ধারণা ছিল না। তাছাড়া কথাবার্তার শব্দও কিছু পাইনি। আর ঘাসের ওপর দিয়ে আমার চলাচলও ছিল নিঃশব্দ।

কবাট ঠেলে ভেতরে তাকাতেই অপ্রস্তুত হয়ে যেতে হল। দুজন নারীপুরুষ পরস্পরকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে চুম্বনরত।

পলকের দেখাতেও চিনতে ভুল হল না। একজন ছোকরা শিল্পী লরেন্স। অপরজন কর্নেল প্রথেরোর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী।

সাড়াশব্দ না করে নিঃশব্দে পা ফেলে নিজের পড়ার ঘরে ফিরে এলাম।

একটা অস্বস্তিকর মানসিক অবস্থা। এমন একটা অবৈধ সম্পর্ক আবিষ্কার আমার প্রত্যাশার বাইরে ছিল।

ব্যাপারটা আমার কাছে আঘাত হিসেবেই এল। কেন না আজ বিকেলেই লেটিস এসে কিছুক্ষণ বকবক করে গেছে।

যেরকম ঘনিষ্ঠতা ওদের দেখা গেল তাতে বুঝতে পারছি ভদ্রমহিলার সঙ্গে ইতিমধ্যেই একটা বোঝাঁপড়া গড়ে উঠেছে। সত্যায়ের সঙ্গে লরেন্সের এই সম্পর্কের কথা লেটিস নিশ্চয়ই জানে না।

মিসেস প্রথেরো এমন একটা অবৈধ প্রণয়ের সঙ্গে জড়িত; চোখে দেখেছি বলেই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে না। নানান রকম চিন্তা মাথায় এসে ভিড় করতে লাগল।

মিসেস প্রথেরো আচমকা ঘরে ঢুকলেন। তাকে দেখে আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল। হাসবার চেষ্টা করে সোফায় বসতে বললাম।

তাকালাম মুখের দিকে। চোখ নামিয়ে নিল। মুখ ফ্যাকাশে। ঠোঁট শুকনো। এ যেন খানিক আগে দেখা মিসেস প্রথেরো নয়।

কয়েক মুহূর্ত নীরবে বসে রইল। মনে হল মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করল। তারপর মুখ তুলে বলল, সরাসরি আপনার কাছে চলে আসাটাই ভাল মনে হল। আপনি আমাদের দেখে ফেলেছেন…

আমি নীরবে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও বলতে লাগল, আমরা পরস্পরকে ভালবাসি। বলে পাথরের মূর্তির মতই বসে রইল।

আমি ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি আমার কাছ থেকে কোন ভৎর্সনা আশা করছেন?

-না, তা নয় মিঃ ভিকার।

–আপনি একজন বিবাহিত মহিলা।

 –আমি তা ভালরকমেই জানি। তবে আমি উচ্ছঙ্খল নই, আপনি যা ভাবছেন তা ঠিক নয়।

–তা যদি না হয়, আমি আনন্দিত হব।

–বিশ্বাস করুন মিঃ ভিকার, অসুখী মানুষের যন্ত্রণা বড় ভয়ানক। আমি আর পেরে উঠছিলাম না। মুক্তির একটা পথ হাতড়ে মরছিলাম।

বলতে বলতে মিসেস প্রথেরো থামল। তার ঠোঁট কাঁপছে। চোখের পাতা ঘন হয়ে উঠছে।

সহসা যেন সজাগ সচকিত হয়ে উঠল, এভাবে বলে উঠল আমার জীবনের যন্ত্রণার ইতিহাস কেউ জানে না।

বিয়ের প্রথম দিন থেকেই লোকটার সঙ্গ আমার কাছে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠেছে। কোন মেয়েই এমন লোকের সঙ্গে থেকে সুখী হতে পারে না।

আমি আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না আমার ভেতরের অস্থিরতা। আমি মনে প্রাণে চাইছি লোকটা মরে গিয়ে আমাকে মুক্তি দিক। ভালমন্দের কথা জানি না, তবু আমি তাই চাইছি…আমি মরিয়া হয়ে উঠেছি।

কথা বলতে বলতে মিসেস প্রথেরো দরজার দিকে ঘাড় ফেরালেন। বললেন, মনে হল কারো পায়ের শব্দ…সম্ভবত লরেন্স…

মৃদু একটা শব্দ আমার কানেও পৌঁছেছিল। আমি উঠে ঘরের বাইরে গেলাম। নিচে বাগানের দিকে তাকালাম। কিন্তু কাউকে কোথাও চোখে পড়ল না।

ঘরে ফিরে এলাম। মিসেস প্রথেরো নিচু হয়ে কপালে হাত দিয়ে বসেছিল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি। বুঝতে পারছি না কি করব। আমাকে বলে দিন…

একজন পাদরীর কর্তব্য হিসেবে আমি ওর পাশে বসে এই অবস্থায় যা বলা উচিত তাই বললাম। ঝোঁকের মাথায় মানুষ অনেকসময় নিজেরই চরম ক্ষতি করে ফেলে। তখন বুঝতে পারে না কিন্তু সারাজীবন তার খেসারত দেয়। ওকে নিষেধ করলাম যেন এমন কিছু করে না ফেলে।

আমার কথা কতদূর বুঝতে পারল বা মানল বোঝা গেল না। একসময় ও উঠে দাঁড়াল। আমাকে ধন্যবাদ জানাল। তারপর চলে গেল। আমি তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

এই মহিলাটিকে এতদিন আমরা কেউ বুঝতে পারিনি। তার চরিত্রের ভুল ব্যাখ্যা করেছি। আজ জীবন থেকে বঞ্চিত যন্ত্রণাকাতর এবং মরিয়া একটি মানুষকে দেখতে পেলাম।

লরেন্সকে ও পাগলের মত ভালবেসেছে। অথচ লরেন্স কিন্তু তার চাইতে বয়সে বেশ কয়েক বছরের ছোট।

.

০৩.

 একদম ভুলে গিয়েছিলাম যে লরেন্স রেডিং সেই রাত্রেই আমাদের এখানে নৈশভোজে আমন্ত্রিত। অনুমান হল সে আসবে না। পরে হয়তো কোন একটা অজুহাত দেবে।

কিন্তু না, লরেন্স এলো এবং আমরা চারজনে একসময় খাবার টেবিলে গিয়ে বসলাম।

এইবেলা তার দিকে একটু অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকালাম। রীতিমত আকর্ষণীয় পুরুষ। বয়স আন্দাজ তিরিশ ছুঁয়েছে। চকচকে নীল চোখে খুশির ঔজ্জ্বল্য। সর্বদা হাস্যময়।

আমার ধারণা ওর শরীরে আইরিশ রক্ত প্রবহমান।

লক্ষ্য করছিলাম, কথাবার্তা বলতে বলতে লরেন্স মাঝে মাজেই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল।

 ডিনারের পর লরেন্স পড়ার ঘরে আমার কাছে এসে বসল। আমাকে সরাসরি বলল, আমাদের ব্যাপার তো আপনার কাছে আর লুকনো নেই। এখন এ ব্যাপারে আপনি কি করতে চাইছেন?

লরেন্স পুরুষমানুষ। কোনরকম দ্বিধা না করে আমার বক্তব্য পরিষ্কার ভাবেই জানালাম।

সবশেষে বললাম, গ্রামের মানুষজন চুপ করে থাকবে না, তাদের চোখ কান যেমন সজাগ তেমনি মুখেরও আগল নেই। ওদের দুজনেরই জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে।

লরেন্স সবকথাই চুপ করে শুনল। আমার সবকথাই যে ঠিক তা সে স্বীকার করল।

পরে বলল, এটা যদি একটা নাটক হত, তাহলে ওই বুড়োটা নির্ঘাৎ মারা পড়ত। আর সকলেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচত।

বললাম, এসব কথা তোমার ভাবা বা বলা উচিত নয়।

লরেন্স বলল, আমি একথা বলতে চাইছি না যে বুড়োটাকে আমি খুন করব। তবে যদি কেউ এই কাজটা করে আমি অবাক হব না। কেননা, ওই বুড়োকে কোন মানুষই সহ্য করতে পারে না।

একটু থেমে পরে আবার বলল, বুড়োর দ্বিতীয় বউ তাকে একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু মহিলা এমনই চাপা স্বভাবের যে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই।

আপনি অনুমান করতে পারবেন না অ্যানা কিরকম মরিয়া হয়ে উঠেছে। যে কোন সময় ও যা খুশি করে বসতে পারে।

একমুহূর্ত থেমে কি চিন্তা করল। পরে বলল, আমার যদি সামর্থ্য থাকত তাহলে ওকে নিয়ে আমি এখান থেকে চলে যেতাম।

লরেন্সের কথায় আসন্ন একটা ঝড়ের আভাস পাওয়া গেল। শান্তভাবে বললাম, লরেন্স, আমার মনে হয় এই মুহূর্তে তোমার সেন্ট মেরী মিড ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। তা না হলে মিসেস প্রথেরো বড় বেশি অস্থির হয়ে পড়বে।

ব্যাপারটা একদিন মিঃ প্রথেরোর চোখেও ধরা পড়ে যাবে। লোকের কানাঘুষাও কানে যাবে। তখন একটা অনাসৃষ্টি কাণ্ড ঘটবে।

এরপর আর বেশি কথা হল না। আমার কথা ভেবে দেখবে, এ কথা জানিয়ে লরেন্স বিদায় নিল।

.

পরদিন প্রাতরাশের পরেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। কিছু রুগীকে দেখে ওষুধ দেবার ব্যাপার ছিল। গ্রীসলডা ট্রেনে করে লণ্ডন চলে গেল।

ভিকারেজে ফিরে এলাম বেলা সোয়া চারটে নাগাদ। ঢুকতেই মেরী জানাল, মিঃ লরেন্স আমার জন্য পড়ার ঘরে অপেক্ষা করছে।

পড়ার ঘরে এসে দেখলাম সে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে। মুখ শুকনো।

পায়ের শব্দ পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল। বলল, আপনাকে কয়েকটা কথা জানাবার জন্য অপেক্ষা করছি। সারারাত চোখে ঘুম ছিল না।

আপনার কথা ভেবে দেখলাম আপনি ঠিকই বলেছেন।

বলতে বলতে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে পরে বলল, আমি স্থির করেছি, অ্যানার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করে আমি এখান থেকে চলে যাব।

-খুব ভাল কথা। আমি যা বুঝতে পারছি, তুমি এখানে থাকলেই ওর বিপত্তি বাড়বে।

-হ্যাঁ। আমি নিজেও বুঝতে পারছি। আপনাকে কেবল একটা অনুরোধ করব, অ্যানাকে দেখবেন।

আমি ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, তুমি নিশ্চিন্ত থেকো।

আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লরেন্স বলল, আজ রাতেই সব গোছগাছ করে রাখব আমি যাতে কাল সকালেই এখান থেকে চলে যেতে পারি। অ্যানার সঙ্গেও দেখা করব আজ সন্ধ্যাবেলা। আঁকার কাজের জন্য আপনি এখানে আমাকে একটা ঘর দিয়েছিলেন, তার জন্য ধন্যবাদ। কেবল মিস ক্লেমেন্ট-এর ছবিটা সম্পূর্ণ করে উঠতে পারিনি।

–সে আর কি করা। ও নিয়ে ভেবো না। ঈশ্বর তোমাকে আশীর্বাদ করুন।

লরেন্স রেডিং ঘরথেকে বেরিয়ে গেল।

.

০৪.

 ভিকারেজে ফিরতে প্রায় সাড়ে ছটা বেজে গেল। দরজা খুলে ঢুকতে যাব এমন সময় লরেন্স ভেতর থেকে বেরিয়ে গেল।

তার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হতে হল। উদ্ভ্রান্ত মানুষের চেহারা পুরোপুরি। ভেতরে যেন তোলপাড় চলছে। কেমন যেন কাঁপছে।

বললাম, তুমি এসেছিলে? একটা কাজে একটু প্রথেরার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।

-প্রথেরার সঙ্গে! আমার কথা কেড়ে নিয়ে অদ্ভুতভাবে হেসে উঠল লরেন্স।

পরে বলল, আপনি দেখা করতে গিয়েছিলেন? হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখা করুন।

 কেমন অসংলগ্ন কথাবার্তা। কিছু বুঝতে না পেরে বললাম, তা চলে যাচ্ছ কেন, এসো

-না-না। আমাকে চলে যেতে হবে অবশ্যই।

 আমাকে বিস্মিত করে একরকম ছুটেই যেন লরেন্স বেরিয়ে গেল। হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম পেছন থেকে।

বাড়িতে ঢোকার মুখেই মেরীর সঙ্গে দেখা হল। জানাল কর্নেল প্রথেরো পড়ার ঘরে অনেকক্ষণ থেকে বসে আছেন।

জিজ্ঞেস করলাম, কখন এসেছেন?

-সোয়া ছটা নাগাদ।

বুঝতে পারলাম, এজন্যই তার বাড়ি গিয়ে দেখা পাইনি।

মেরীকে জিজ্ঞেস করলাম, লরেন্স রেডিং এসেছিল?

–কিছুক্ষণ আগেই এসেছিলেন। বসতে বলেছিলাম। কর্নেল যে পড়ার ঘরে আছেন সেকথাও বলেছিলাম। মনে হয় ওই ঘরেই অপেক্ষা করছেন।

-না চলে গেছে। গেটের মুখে দেখা হয়েছে আমার সঙ্গে।

হতে পারে। আমি দেখিনি কখন চলে গেছেন। এদিকে মিসেস ভিকারও তো ফিরলেন না এখনো।

মেরী রান্নাঘরে চলে গেল। আমি পড়ার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম।

দরজাটা বন্ধ ছিল। খুললাম। ভেতরে পা দিয়ে থমকে গেলাম। যেন পাথরের মূর্তি হয়ে গেলাম মুহূর্তের জন্য।

কর্নেল প্রথেরো আমার লেখার টেবিলে অস্বাভাবিক ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। মাথা থেকে ঘাড় বেয়ে রক্ত গড়িয়ে টেবিলে জমছে, মেঝেতে পড়ছে।

শরীরটাকে টেনে টেবিলের কাছে নিয়ে এলাম। নাড়ী দেখার জন্য একটা হাত তুলে নিয়েই চমকে উঠলাম।

বরফের মত ঠাণ্ডা। মানুষটা আর বেঁচে নেই। মাথায় গুলি করে মারা হয়েছে।

 কেমন একটা ঘোরের মত লাগছিল। দরজার কাছে গিয়ে মেরীকে ডাকলাম।

ডাক শুনে মেরী ছুটে এলো। ডাক্তার হেডক সামনের মোড়ের মাথাতেই থাকেন। বললাম, একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, এখুনি গিয়ে তাকে নিয়ে আসতে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার হেডক এসে পৌঁছলেন। তাকে কর্নেলের কাছে নিয়ে গেলাম।

ডাক্তারও থমকালেন। পরমুহূর্তেই সক্রিয় হয়ে উঠলেন। ঝুঁকে একবার দেখলেন। পরীক্ষা করলেন। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন।

আমি জিজ্ঞাসার দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম। ডাক্তার বললেন, আমার ধারণা প্রায় আধঘণ্টা আগে মারা গেছেন।

–এটা কি আত্মহত্যা?

–অসম্ভব। আঘাতটা মাথার পেছন দিকে। তাছাড়া আত্মহত্যার অস্ত্র তো কোথাও নেই।

ঘরে খুঁজে দেখা হল। কোন অস্ত্র পাওয়া গেল না।

 ডাক্তার হেডক পুনরায় বললেন, এখন কিছুতে হাত না দেওয়াই ভাল।

বলতে বলতে তিনি টেলিফোনের কাছে গিয়ে রিসিভারটা তুলে নিলেন। থানার সঙ্গে যোগাযোগ করে সংক্ষেপে ঘটনাটা জানালেন। পরে আমার পাশে এসে বসলেন।

–খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। মৃতদেহ আপনার চোখে পড়ল কখন?

আমার তখনই ঘটনাটা মনে পড়ল। বললাম, একটা অদ্ভুত কাণ্ড হয়েছে। বিকেল নাগাদ এক মহিলা ফোনে জানালেন তাঁর স্বামী খুবই অসুস্থ। আমি সঙ্গে সঙ্গে সেখানে গেলাম। কিন্তু মজার ব্যাপর হল, দেখলাম মহিলার স্বামী দিব্যি সুস্থ। ফোনের কথা জানাতে মহিলা অবাক হয়ে গেলেন। তারা কেউই ফোন করেননি।

কথা শুনে ডাক্তার হেডকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। বললেন, খুবই পরিকল্পিত ব্যাপার মনে হচ্ছে। আপনাকে এখান থেকে সরিয়ে দেবার জন্যই ফোন করা হয়েছিল। ভাল কথা, আপনার স্ত্রী কোথায়?

–তিনি লণ্ডনে গেছেন।

কাজের মেয়েটি?

–রান্নাঘরে।

রান্নাঘরটা কতদূরে?

–এই ঘরেরই উল্টো দিকে।

–কর্নেল প্রথেরো যে আজ বিকেলে এখানে আসবেন নিশ্চয় কেউ কেউ জানতো?

–হ্যাঁ, গ্রামের অনেকের সামনেই তো বলেছিল আসার কথাটা।

একটু থেমে ডাক্তার কি ভাবলেন। পরে বললেন, কর্নেলের ওপর ব্যক্তিগত রাগ বা আক্রোশ থাকতে পারে এমন কারোর কথা মনে পড়ে?

আমার মনে পড়ল সবার আগেই লরেন্স রেডিং-এর কথা। ওর উদভ্রান্ত চেহারাটা চোখের ওপর ভেসে উঠল। আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় করিডরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।

ডাক্তার হেডক দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, নিশ্চয় পুলিস আসছে।

 বলতে বলতেই পুলিস কনস্টেবল হার্স্ট ঘরে ঢুকলেন।

শুভসন্ধ্যা জানিয়ে তিনি বললেন, যে কোন মুহূর্তে ইনসপেক্টর এসে যাবেন, ইতিমধ্যে তিনি নির্দেশিত কাজগুলো সমাধা করে রাখতে চান।

হার্স্ট মৃতদেহের দিকে তাকালেন। বললেন, আমার বিশ্বাস কর্নেল প্রথেরোকে গুলিবিদ্ধ অবস্থাতে ভিকারেজের পড়ার ঘরে পাওয়া গেছে।

বলতে বলতে তিনি লেখার টেবিলটার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ঘরের কোন কিছুতে যেন হাত দেওয়া না হয়।

পকেট থেকে পেন্সিল নোটবুক বার করে এবারে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন হার্স্ট। আমি তাকে ব্যাপারটা আগাগোড়া খুলে বললাম।

ধৈর্য ধরে তিনি আমার কথা শুনলেন। পরে ডাঃ হেডকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ডাঃ হেডক, আপনার মতে মৃত্যুর কারণটা কি?

-খুব কাছে থেকে মাথায় গুলি করে মারা হয়েছে।

–অস্ত্রটা?

বুলেটটা শরীর থেকে বার না করা পর্যন্ত সেটা বলা যাচ্ছে না।

–কোন সম্ভাবনা

–হ্যাঁ, বাহ্যিক ব্যাপারটা পর্যালোচনা করে বলা যায় যে বুলেটটা কোন ছোট ক্যালিবারের পিস্তল থেকেই ছোঁড়া হয়েছে। সম্ভবত মসার পিস্তল ২৫।

কথাটা শুনে আমি চমকে উঠলাম। আগের দিন রাতেই লরেন্স রেডিং কথায় কথায় জানিয়েছিল তার কাছে একটা মসার পিস্তল রয়েছে।

কনস্টেবল হার্স্ট পুনরায় ডাঃ হেডককে জিজ্ঞেস করলেন, কখন দুর্ঘটনাটা ঘটেছে বলে আপনার ধারণা?

ডাঃ হেডক একটু ইতস্তত করলেন, পরে জানালেন, কর্নেল ঠিক আধঘণ্টা আগে মারা গেছেন। আমার মতে সময়টা ওই রকমই।

হার্স্ট এবার আমার দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ির কাজের মেয়েটা কি কিছু শুনতে পেয়েছিল?

–আমার মনে হয়, কিছু শুনতে পায়নি। তবে ওকে জিজ্ঞেস করলেই ব্যাপারটা সঠিক জানা যাবে।

সেই সময়েই ইনসপেক্টর স্লাক এসে পৌঁছলেন। ছোট ছোট কিছু প্রশ্নে প্রাথমিক সব কিছু জেনে নিয়ে তিনি পড়ার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন।

ঝুঁকে খুঁটিয়ে দেখলেন। পরে উৎফুল্ল ভাবে বললেন, হ্যাঁ, এটাই আমরা জানতে চেয়েছিলাম। গুলির আঘাতে লোকটা যখন কাত হয়ে পড়ে তখন ধাক্কা লেগে ঘড়িটা উল্টে পড়ে। খুনের সমগ্রর আঘাতে লোকটা যখন ভাবে বললেন, হয়

তারপর ঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে পরে বললেন, ছটা বেজে বাইশ মিনিট। আচ্ছা ডাঃ হেডক, আপনি মৃত্যুর সময়টা কখন বলেছিলেন?

হেডক জবাব দিলেন, আধঘণ্টা আগে। তবে..

নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে ইনসপেক্টর স্লাক বললেন, এখন সাতটা বেজে পাঁচ মিনিট হয়েছে। আমি খবরটা পেয়েছি দশ মিনিট আগে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, মৃতদেহটা আবিষ্কার হয়েছিল পৌনে সাতটা নাগাদ। ঠিক আছে, ওতেই যথেষ্ট হবে।

আমার ওই সময় একটা কথা মনে পড়ে গেল। বলবার চেষ্টা করলে বাধা দিয়ে স্লাক বলল, আপনাকে কিছু প্রশ্ন করব। সময় বড় কম।

–কিন্তু ওই ঘড়িটা

স্লাক আমার কথায় কান না দিয়ে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, লোকটা ওখানে কি কিছু লিখবার জন্যে বসেছিল? আরে ওটা কি?

বলতে বলতে এগিয়ে গিয়ে ছোট একটা চিরকূট টেবিল থেকে কুড়িয়ে নিলেন। উৎসাহে তার চোখ চকচক করে উঠল।

আমরা পাশে গিয়ে চিরকূটটার ওপরে চোখ ফেললাম। ছোট্ট একটুকরো কাগজ। মাথার দিকে লেখা ছটা কুড়ি। তার নিচে ডিয়ার ক্লেমেন্ট বলে লেখাটা শুরু হয়েছে।

মাত্র কয়েকটি শব্দ–দুঃখিত, আমি আর অপেক্ষা করতে পারলাম না। আমি নিশ্চয়…

 এর পরেই ছেদ পড়েছে। মিঃ প্রথেরো আর কোন শব্দ লিখে উঠবার সুযোগ পাননি।

কিছুক্ষণ পরেই মেরী এসে জানিয়ে গেল মিনিট পাঁচেক আগে গ্রীসলডা ফিরে এসেছে।

আমি গিয়ে বসার ঘরেই তাকে পেলাম। দেখে মনে হল কেমন ভীত ও উত্তেজিত হয়ে পড়েছে।

ওকে ঘটনাটা খুলে জানালাম। সবশেষে বললাম চিরকূটের মাথায় লেখা রয়েছে ছটা কুড়ি! আর ঘড়িটা উল্টে গিয়ে ছটা বাইশ মিনিটে বন্ধ হয়ে ছিল।

গ্রীসলডা বলল, তুমি বললে না কেন ঘড়িটা প্রায় সব সময়ই পনেরো মিনিট ফাস্ট হয়ে থাকে?

বললাম, বলতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ইনসপেক্টর আমাকে থামিয়ে দিয়েছিল।

হতভম্ব হয়ে গ্রীসলডা আমার মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। পরে বলল, এতে যে সব ব্যাপারটাই গুলিয়ে যাবে।

ঘড়িতে যখন ছয়টা কুড়ি, তখন প্রকৃত সময় হবে ছটা বেজে পাঁচ মিনিট। আমার ধারণা, ওই সময়ে প্রথেরো এখানে পৌঁছয়নি।

.

০৫.

 মেরী এসে খবর দিল ইনসপেক্টর স্লাক চলে গেছেন। যাবার সময় পড়ার ঘরে তালা দিয়ে বলে গেছেন ওই ঘরে কেউ যেন ঢুকবার চেষ্টা না করে।

ইনসপেক্টর আমার সঙ্গে একবার কথা না বলে চলে যাওয়ায় বিস্মিত না হয়ে পারলাম না।

গ্রীসলডা ওল্ড হলে যেতে চাইল। মিসেস প্রথেরোকে একবার এই সময়ে দেখে আসা দরকার। আমি আপত্তি করলাম না। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সে ফিরে এল।

ক্লান্ত শরীরে সোফায় বসে পড়ে বলল, আমি পৌঁছবার কিছুক্ষণ আগেই মিঃ স্লাক বেচারী অ্যানকে খবরটা পৌঁছে দিয়েছে।

-খুবই দুঃখজনক। খবরটা তিনি কিভাবে নিয়েছেন?

–ভালো। দেখে খুবই শান্ত মনে হল।

-ওটাই স্বাভাবিক। মিসেস প্রথেরো শোকে পাথর হয়ে যাবেন, এমনিটা আমি আশা করতে পারি না।

–লেটিস কি করছে?

 –টেনিস খেলতে গেছে, এখনো ফেরেনি।

–লেটিসও যে খবরটা পেয়ে খুব কাতর হবে মনে হয় না। বাবাকে ও একেবারেই পছন্দ করত না।

–তাহলেও, আঘাত তো বটে। মৃত্যু অনেক সময় মানুষের অনুভূতিগুলিকে পাল্টে দেয়।

.

পরদিন সকালে আমরা সবে প্রাতরাশ টেবিলে বসেছি। মেরী হাঁপাতে হাঁপাতে এসে জানাল রুটিওয়ালার কাছে খবর পেয়েছে, পুলিস নাকি লরেন্স রেডিংকে গ্রেপ্তার করেছে।

–অসম্ভব। এ হতে পারে না, গ্রীসলডা বলে উঠল, পুলিস নির্ঘাৎ ভুল করেছে।

মেরী বলল, গতরাত্রেই নাকি রেডিং পুলিসের কাছে গিয়ে পিস্তল সমেত আত্মসমর্পণ করেছে। পুলিসের কাছে স্বীকার করেছে নিজেই খুনটা করেছে।

গ্রীসলডা বলল, ব্যাপারটা অসম্ভব বলেই আমার মনে হচ্ছে। ওটা নির্ঘাৎ একটা দুর্ঘটনা হবে। কিসের স্বার্থে লরেন্স কর্নেল প্রথেরোকে খুন করবে? খুনের তো একটা উদ্দেশ্য থাকবে।

আমার মাথায় অনেক ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছিল। বললাম, কিছুদিন আগে তো ওদের দুজনের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল। তারই…

-হ্যাঁ, লেটিসের ছবি আঁকা নিয়ে। তাছাড়া গোপনে লেটিসের সঙ্গে তার প্রেমও যদি থাকে তার জন্য লরেন্স কর্নেলকে খুন করতে যাবে কেন?

আমি চিন্তান্বিত ভাবে বললাম, আসল ব্যাপারটা কি তা তো আমরা কেউই জানি না।

একটু থেমে আমি আবার বললাম, তোমাকে তো বলেছি, গেটের বাইরে লরেন্সের সঙ্গে যখন আমার দেখা হয় তখন তাকে কেমন উন্মাদের মত লাগছিল। ও কাঁপছিল রীতিমত।

–তা হতে পারে। কিন্তু খুন অসম্ভব। আমি মেনে নিতে পারি না।

–কিন্তু, ঘড়িটাও তো খুনের সাক্ষীই দিচ্ছে। নিজেকে বাঁচাবার জন্যই লরেন্স ঘড়ির কাঁটা পেছন দিকে ঘুরিয়ে রেখেছিল।

-তুমি ভুল করছ গ্রীসলডা বলল, আমাদের ঘড়িটা যে ফার্স্ট যায় তা লরেন্স জানতো। বোকার মত ঘড়ির কাঁটা ও ছটা বাইশে ঘোরাতে যাবে কেন? দিতে হলে পৌনে সাতটার দিকে এগিয়ে দেওয়াই স্বাভাবিক ছিল।

–এমন হতে পারে যে সে জানতো না প্রথেরো কখন এখানে এসেছে। অথবা ওই সঙ্গীন মুহূর্তে ঘড়ি যে ফাস্ট যায় সে কথা একদম ভুলে গিয়েছিল।

–সে হয় না কেউ যখন খুন করতে যায়, এসব বিষয়ে সে খুবই সতর্ক থাকে।

আমাদের কথাবার্তার মধ্যেই মিস মারপল এসে ঘরে ঢুকল। বলল, তখন থেকে ঠিক করেছি, ইনসপেক্টর স্লাকের সঙ্গে বুঝে শুনে চলব। উদ্ভট লোক।

কাল রাতে খবর দিয়েছিল আজ সকালে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। সকালে ফোন করে জানালো তার দরকার নেই।

আমি বললাম, আসামী! গ্রেপ্তার হয়ে গেছে, তাই হয়তো দরকার হয়নি।

গ্রেপ্তার! আসামী, কে? উত্তেজনায় মুখ লাল হয়ে উঠল মিস মারপলের।

বুঝতে পারলাম খবরটা তখনো পায়নি। তাই বললাম, একজন গ্রেপ্তার হয়েছে–লরেন্স রেডিং।

–সে কী! অসম্ভব। আমি ভাবতে পারছি না।

–আমিও খবরটা বিশ্বাস করি না। বলল গ্রীসলডা তবে সে নাকি নিজে স্বীকার করেছে।

–স্বীকার করেছে? মিস মারপল বলল, আমি দেখছি উল্টো দিকে চেয়ে আছি। তাহলে আমি খুশি।

উত্তেজনার মুহূর্তে ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেলেছিল, পরে নিশ্চয় অনুশোচনা হয়েছিল। বললাম আমি।

অনুশোচনা! মিস মারপল বলল, কিন্তু মিঃ ভিকার আপনি কি বিশ্বাস করছেন লরেন্স খুন করেছে?

আচমকা এই প্রশ্ন শুনে আমি চমকালাম। বলার চেষ্টা করলাম, ওই ধরা দেবার

–কিন্তু আমার ধারণা এই ঘটনায় তার কোন হাত নেই।

–তাই যদি হবে তবে এরকম অভিনয় করতে গেল কেন?

–অবশ্যই কারণ আছে। এসব কাজের পেছনে সবসময়ই কোন না কোন কারণ থাকে।

এর পর আগ্রহ সহকারে গতকাল সন্ধ্যার ঘটনাটা মিস মারপল আমার কাছ থেকে শুনে নিল। পরে বলল, আপনি দেখেছিলেন, লরেন্সকে উন্মাদের মত দেখাচ্ছিল? কিন্তু আমি বলতে পারি, ভাবনা চিন্তার পর কোন লোককে খুন করবার পরে কারো মুখের ভাব কখনোই অমন হবে না। খুনটা ছিল সুপরিকল্পিত।

-খুনের পরিবেশটা আমরা ঠিক জানি না, আমি বললাম, কথা কাটাকাটির সময় রাগের মাথায় হয়তো লরেন্স গুলি করে বসেছিল। পরে ব্যাপারটা মাথায় ঢুকতে হতভম্ব হয়ে গিয়ে ছিল। মনে হয়, এরকমই ঘটেছিল ঘটনাটা।

মিঃ ক্লেমেন্ট, আমার মনে হয় না ওদের মধ্যে কোন রাগারাগি হয়েছিল। আপনাদের বাড়ির মেরী তো বলেইছে, লরেন্স ওখানে বেশিক্ষণ ছিল না। ঝগড়া কথা কাটাকাটির জন্য একটা সময়ের দরকার।

তাছাড়া ভুলে যাচ্ছেন, মিঃ প্রথেরো যখন লিখছিলেন সেই সময় পেছন দিক থেকে তাকে গুলি করে মারা হয়েছিল।

একটু পরেই লেটিস এলো। চেয়ারে বসে জানতে চাইল, শুনলাম লরেন্স রেডিংকে নাকি গ্রেপ্তার করা হয়েছে?

-হ্যাঁ। গ্রীসলডা বলল।

-বাবাকে কেউ খুন করতে পারে এটা আমি কখনোই ভাবতে পারিনি। অবশ্য মুখে এমন কথা একসময়ে অনেককেই বলতে শুনেছি। আমি নিজেই তো বলেছিলাম।

অকম্পিত স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলল লেটিস কথাগুলো। পরে সে গ্রীসলডার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি জানতে এলাম তোমরা আমার টুপিটা এখানে পেয়েছ কিনা। কয়েকদিন ধরে সেটা পাচ্ছি না।

–মেরী বলতে পারে। ওই তো ঝটপাট দেয়। গ্রীসলডা বলল।

–দেখি তাহলে। বলে লেটিস উঠে দাঁড়াল।

–তুমি এখন ওটা থাকলেও পাবে না, আমি বললাম, মিঃ স্লাক ঘরটায় তালা ঝুলিয়ে দিয়ে গেছেন। তা ওই সামান্য জিনিসটা এই সময়ে তোমার কাছে এত জরুরী হয়ে পড়ল?

–আপনি শোকের কথা বলছেন? আমার ওসব আসে না।

পরে ভ্রূকুটি করে বলল, আমার ধারণা সব ব্যাপারটাই আমার চানের পোশাকে ছবি আঁকাকে কেন্দ্র করে।

বলতে বলতে লেটিস চলে গেল।

মিস মারপল হাসছিলেন। বললেন, আমার মনে হয় প্রত্যেক ব্যাপারকেই তার নিজ ক্ষেত্রে এগোতে দেওয়া দরকার। মেয়েটা অন্য কোন ধান্দা মাথায় নিয়ে এসে অভিনয় করছিল।

 এমন সময় মেরী এসে জানাল, কর্নেল, মেলচেট হলেন দেশের চীফ কনস্টেবল।