১. সুগঠিত জার্মান বাহিনী

এন অর এম (১৯৪১) / আগাথা ক্রিস্টি
অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ

১৯৪০ সাল। সুগঠিত জার্মান বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ফ্রান্সের পতন যখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে, নিচের ঘটনা সেই সময়ের!

টমি বেরেসফোর্ড ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের প্রাক্তন কর্মী। পত্নী টুপেনসকে নিয়ে তিনি অবসর জীবন যাপন করছে। তাদের দুই ছেলে ও মেয়ে বাইরে কর্মনিযুক্ত।

এমন একটা সময় ছিল যখন এই দম্পতি অনেক দুঃসাহসিক কর্ম করেছে, সত্য উদঘাটন করে অপরাধীকে শায়েস্তা করেছে, উত্তেজনা ও আনন্দে ভরা সেই দিনগুলো এখন কেবল স্মৃতিমাত্র।

অবসরের কর্মহীন অলস দিনগুলো তাই বড় একঘেয়ে ভাবেই অতিবাহিত হচ্ছে। তাই মাঝে মাঝে টমিকে আক্ষেপ করতে শোনা যায়, মিঃ কার্টারও আমাদের মনে রাখেননি, করার মত দু-একটা অন্তত কাজ তিনি দিতে পারতেন।

তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান মিঃ কার্টার (লর্ড এস্থাম্পটন) অবশ্য তার কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি স্কটল্যান্ডে থাকেন। মাছ শিকার করেই তার দিন কাটে।

সেদিন বেরেসফোর্ড দম্পতি ড্রইংরুমে বসে আছেন। এমন সময় লম্বা চওড়া এক ভদ্রলোক তাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন।

–আমি গ্রান্ট, লর্ড এস্থাম্পটনের বন্ধু। তারই পরামর্শে একটা কাজের সন্ধান নিয়ে মিঃ বেরেসফোর্ডের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।

কাজের কথা শুনে টমি এবং টুপেনস দুজনেই সজাগ হল। করার মত কাজ নেই বলেই তো এতদিন তারা আক্ষেপ করছিল।

টমি উৎসাহিত হয়ে কাজটা সম্পর্কে জানতে চাইলে গ্রান্ট বললেন, নিছকই ফাইল ঘাঁটাঘাঁটির সামান্য একটা কাজ।

তাদের কথাবার্তার মাঝেই টেলিফোন বেজে উঠল, টুপেনস উঠে গিয়ে ধরল। ফিরে এসে জানাল, সে আলোচনায় থাকতে পারছে না বলে দুঃখিত। তার এক বন্ধু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে, এখুনি তাকে তার কাছে যেতে হবে।

টুপেনস চলে গেলে গ্রান্ট জানালেন, লর্ড এস্থাম্পটন নিজেই টমির জন্য একটি কাজের ব্যবস্থা করেছেন। কাজটা গোপনীয়–এমনকি স্ত্রীকেও জানানো চলবে না।

কেন না, তাকে নিয়োগ করা হবে একটি নিষিদ্ধ এলাকায়–যেখানে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া সঙ্গত হবে না।

মিঃ গ্রান্ট বললেন, যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি অবিশ্বাস্যভাবে পালটে যাচ্ছে। যুদ্ধে আমাদের সৈনিকরা বীরের মতো লড়ছে, বোমারু ও যুদ্ধজাহাজগুলো সক্রিয় তবুও জার্মানদের সঙ্গে আমরা এঁটে উঠতে পারছি না।

পরিচালন ব্যবস্থায় রদবদল করেও কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত মূল গলদ কোথায় আবিষ্কার করা হল। পঞ্চমবাহিনী অর্থাৎ গৃহশত্রুদের অব্যাহত সহযোগিতা পেয়ে চলেছে জার্মানরা–তার বলেই অপ্রতিহত হয়ে উঠছে জার্মানবাহিনী। আমাদের নিজেদের লোকই প্রতিপক্ষকে সমস্ত গোপন সংবাদ সরবরাহ করে চলেছে। এরা ছড়িয়ে রয়েছে সরকারী উচ্চমহলে, সামরিক বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে এমনকি আমাদের গোয়েন্দা দপ্তরেও। এদেরই সক্রিয়তায় ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা।

টমি মনোযোগ দিয়ে সব শুনল। পরে বলল, আমি এখন একজন কর্মহীন শখের গোয়েন্দা মাত্র। নাৎসিপ্রেমী যেসব গৃহশত্রু দেশের সর্বনাশ করার চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে আমি কী করতে পারি? তাদের কাউকেই আমি চিনি না।

গ্রান্ট বললেন, পেশাদার গোয়েন্দাদের পক্ষে কাজটা করা কঠিন। এই কারণে একজন অভিজ্ঞ শখের গোয়েন্দার সন্ধানই আমরা করেছি। কাজটা আপনাকেই করতে হবে।

আমাদের গোয়েন্দা দপ্তরের সবচেয়ে কর্মতৎপর ও প্রাজ্ঞ কর্মীটিকে আমরা সম্প্রতি হারিয়েছি। গত মঙ্গলবারে সেন্টব্রিজ হাসপাতালে তিনি মারা গেছেন–তিনি যে কাজ হাতে নিয়েছিলেন তা অসমাপ্ত রেখেই।

-আপনি কার কথা বলছেন? সাগ্রহে জানতে চাইল টমি।

–গোয়েন্দা ফারকুয়ার। তিনি অনেকটাই অগ্রসর হয়েছিলেন। যখন জাল গুটিয়ে আনার সময় হয়েছিল, তখনই একটা ট্রাক তাকে চাপা দিয়ে যায়।

ঘটনাটা দুর্ঘটনা নয় বুঝতেই পারছেন। যাইহোক গোয়েন্দা ফারকুয়ার অসমাপ্ত কাজই আপনাকে সমাপ্ত করতে হবে।

টমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বললেন, বটে।

-মিঃ ফারকুয়ার ঠিক কতটা এগিয়েছিলেন আমরা কেউই জানি না। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে তার জ্ঞান ফিরে এসেছিল। সেই সময় তিনি কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ উচ্চারণ করেন, আমাদের সম্বল বলতে ওইটুকুই।

–শব্দগুলো কি শুনতে পারি?

–এন অর এম, সাংসুচি

–এর মধ্যে এমন কি রয়েছে যে

–মিঃ বেরেসফোর্ড, শব্দ কয়টি যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ। এর অর এম শব্দ দুটি আগেও আমরা শুনেছি। এরা দু-জন ঝানু জার্মান গুপ্তচর। এদের কার্যকলাপ ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন দেশে। নিখুঁত চতুরতায় দেশে পঞ্চম বাহিনী গড়ে তোলে এরা, যার ফলে নাৎসিবাহিনীর সাফল্য অনিবার্য হয়ে ওঠে।

আমরা জানতে পেরেছি, এন হলেন একজন পুরুষ এজেন্ট এবং এম মহিলা। দুজনই হিটলারের আস্থাভাজন।

–ফারকুয়ার এদের সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছিলেন?

-হ্যাঁ, অন্তত একজনের নাগাল উনি পেয়েছিলেন অনুমান করা হচ্ছে। তার পকেটে পাওয়া গিয়েছিল লিহাম্পটনে ফিরে যাবার একখানা রিটার্ন টিকিট যাতে পাওয়া গিয়েছে সাংসুচি শব্দের সঠিক পরিচয়। ফরাসি উচ্চারণে কথাটা সান্স সৌচি–সাংসুচি নয়।

–তা হওয়া সম্ভব, বলল টমি, তাহলে বলছেন, ওই জায়গায় গিয়ে আমাকে ঘাঁটি গাড়তে হবে।

-ঠিক তাই। আপনার বুদ্ধি ও পর্যবেক্ষণ শক্তি প্রয়োগ করবেন, আমি নিশ্চিত, সঠিক লোকটিকে আপনি পাকড়াও করতে পারবেন।

-বেশ। লিহাম্পটন জায়গাটা সম্পর্কে কিছু বলুন।

–বিশেষত্ব কিছু নেই। কয়েকজন অকেজো বুড়োবুড়ি, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল, দু-একজন বিদেশী কিংবা হয়তো ব্যবসায়ী–এরাই রয়েছে সেখানে।

-বলছেন এদের মধ্যেই মিশে আছেন এন অথবা এম?

–অথবা তাদের কোনো সহযোগী।

–চেষ্টা করে দেখা যাক তাহলে।

–ধন্যবাদ, আপনার সাফল্য কামনা করি।

.

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব পেয়েছে টমি। স্ত্রীকে রেখে এই প্রথম বাইরে যেতে হচ্ছে তাকে। অথচ আসল কাজের কথাটা গোপন রাখতে হল।

টমিকে বিচলিত দেখে টুপেনস স্বামীকে প্রবোধ দিয়ে বলল, সে-ও এখানে একটা নার্সের কাজ জুটিয়ে নিয়ে দিব্যি কাটিয়ে দেবে দিন।

সব গোছগাছ করে নিয়ে তিনদিন পর টমি এবারডিনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে পড়ল। টুপেনস স্টেশনে এসে তাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে গেল।

স্কটল্যান্ডে ট্রেন বদল করে ম্যানচেস্টার, সেখানে থেকে তিনদিন পর লিহাম্পটনে পৌঁছানো গেল। একটা হোটেলে সাময়িক আশ্রয় নিয়ে সান্স সৌচি ভিলা খুঁজে নিতে বিশেষ বেগ পেতে হল না।

পাহাড়ের পাশেই ভিক্টোরিয় যুগের একটা ভিলা সান্স সৌচি। ওপর তলার যে কোনো জানালা থেকেই অদূরবর্তী তরঙ্গায়িত সমুদ্র চোখে পড়ে।

হলঘরে ঢুকেই একটা ধোঁয়াটে গন্ধ পেল টমি। সরাসরি অফিসঘরে ঢুকে ভিলার মালিক মিসেস পেরিনারের সঙ্গে দেখা করল।

মাঝবয়সি ভদ্রমহিলা। মুখে চড়া প্রসাধনের প্রলেপ। মাথা ভর্তি কোকড়ানো চুল। বেশবাসে। পরিপাটির অভাব চোখে লাগে।

টমি মিঃ মিয়াদো নামে নিজের পরিচয় দিল। যুদ্ধের সময় লন্ডনে থাকা নিরাপদ মনে না করায় এখানে সরে এসেছে। বন্ধুদের কাছে এখানকার ব্যবস্থাপনার প্রশংসা শুনেই এককথায় চলে এসেছে।

প্রয়োজনীয় কথাবার্তা শেষ করে উপযুক্ত ভাড়ার বিনিময়ে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে নিল সে এবং পরদিন সকালেই হোটেল ছেড়ে সান্স সৌচিতে এসে উঠল।

মিসেস পেরিনা স্বাগত জানিয়ে হলঘরে নিয়ে গেল টমিকে। অন্যান্য বোর্ডাররা সেখানেই উপস্থিত ছিলেন। একে একে সকলের সঙ্গেই তাকে পরিচয় করে দেওয়া হল। এরা হলেন, মিসেস ওরুরকি, মেজর ব্লেচলি, মিঃ কার্ল ভন দিনিম; মিস মিন্টন।

মাথায় পরিপাটি ঘন চুল, চুপচাপ বসে উল বুনছেন এক মহিলা। ইনি হলেন মিসেস ব্লেনকিনসপ। সব শেষে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার মুহূর্তে নিঃশব্দে মুখ তুলে নেন তিনি।

চোখাচোখি হতেই বুকের ভেতরটা দুলে উঠল টমির। প্রচণ্ড বিস্ময়ে হকচকিয়ে গেল। মিসেস ব্লেনকিনসপ–এ যে টুপেনস।

মুহূর্তে সমস্ত হলঘরে দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে আবার তাকাল, নির্বিকার টুপেনস একাগ্র হয়ে আছে উলবোনা নিয়ে। চেনাজানার আভাসমাত্র তার চোখে নেই।

কিন্তু টুপেনস এখানে কেন? কীভাবে? টমির নিঃশ্বাস প্রশ্বাস মন্থর হয়ে গেল।

.

সন্ধ্যা পর্যন্ত একই জিজ্ঞাসা মাথায় নিয়ে ঘুরে ফিরে কোনোরকমে কাটিয়ে দিল টমি। মিসেস ব্লেনকিনসপকে যথাসাধ্য এড়িয়ে থাকবারই চেষ্টা করেছে। কিন্তু থেকেছে কাছাকাছিই।

ডিনারের সময় সান্স সৌচির আরও তিনজন বাসিন্দার সঙ্গে আলাপ হল। এরা হলেন মিঃ ও মিসেস ক্লে এবং মিসেস স্প্রট। এই যুবতী মায়ের সঙ্গে রয়েছে তার ছোট্ট মেয়ে বেটি। অল্প অল্প কথা বলতে শিখেছে সবেমাত্র।

টমির পাশের আসনেই বসে ছিলেন মিসেস স্প্রট। টমিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, যুদ্ধের সোরগোল কমে এলো, সবাই দেখছি নিজের নিজের জায়গায় ফেরার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন!

টমি জবাব দেবার আগেই পাশ থেকে অপর এক মহিলা বলে উঠলেন, কমল কোথায়? দেশের পরিস্থিতি এখনও অস্বাভাবিক। হিটলার বলেছেন, ইংলন্ডের জন্য মজুত রেখেছেন ব্লিটসীগ মনে হয় মারাত্মক কোনো গ্যাস ওটা।

 মেজর ব্লেচলি বলে উঠলেন, গ্যাস না হাতি। স্রেফ বোমা মেরেই উড়িয়ে দেবে ইংলন্ড। ফ্রান্সে যা করেছিল।

একপাশ থেকে টুপেনস বলে উঠল, আমার ছেলে ডগলাস তো বলে…

চমকে উঠল টমি। বেশ কৌতুক বোধ করল। নিজে ব্লেনকিনসপ সেজে আবার ডগলাসের নাম করা কেন?

.

ডিনারের পরে লাউঞ্জে জড়ো হয়েছে সকলে। যে যার মতো গল্প করে চলেছেন। মেয়েরা তাদের উল-কাটা নিয়ে ব্যস্ত।

মেজর তার সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বেশ রোমাঞ্চকর ভঙ্গিতে বর্ণনা করে চলেছেন। এমন সময় শ্রোতাদের মধ্য থেকে সুদর্শন যুবক ভন দিনিম উঠে দাঁড়ায়। সকলকে শুভরাত্রি জানিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যায়।

মেজর ঘাড় ঘুরিয়ে তার নিষ্ক্রমণ দেখলেন। তারপর টমিকে বললেন, এ হল জার্মান উদ্বাস্তু, বুঝলেন? যুদ্ধের একমাস আগে জার্মানি থেকে পালিয়ে এসেছে।

–উনি কি জার্মান?

–নির্ভেজাল জার্মান-ইহুদি নয়। ওর দুই ভাই হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মৃত্যুর দিন গুণছে। এ কোনো রকমে পালিয়ে এসে বেঁচেছে।

-কী সর্বনাশ!

-তবে বলছি কী। অপরাধ হল ওর বাবা নাৎসি শাসনের সমালোচনা করেছিলেন।

টমি আলোচনার একটা সূত্র পেয়ে নড়েচড়ে বসেছিল। কিন্তু এই সময়ে মিঃ ক্লে এসে জুটে সব ভণ্ডুল করে দিলেন। তিনি শুরু করলেন নিজের শরীর স্বাস্থ্যের ফিরিস্তি।

.

খুব সকালে উঠেই প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিল টমি। ভিলার বাইরে পথ ধরে অনেকটা চলে গিয়েছিল। ফেরার পথে দেখা হয়েগেল মিসেস ব্লেনকিনসপের সঙ্গে।

এরকম একটি সুযোগের জন্যই মনে মনে তৈরি হয়েছিল হয়তো টমি। চকিতে দেখে নিল আশপাশে কেউ নেই। মাথা থেকে টুপিটা খুলে নিয়ে কৌতুকভরা স্বরে বলে উঠল, সুপ্রভাত মাদাম…তুমিই তো!

-আমি এখন মিসেস ব্লেনকিনসপ মশাই। রসিকতা করল টুপেনস।

–কিন্তু এই চিড়িয়াখানায় এসে জুটলে কী করে?

-স্রেফ বুদ্ধির জোরে। তোমাকে আর তোমার সেই নাকউঁচু মিঃ গ্রান্টকে শিক্ষা দেবার জন্য।

–শিক্ষা বলতে শিক্ষা একেবারে আক্কেলগুড়ুম। কিন্তু রহস্যটা খোলসা কর।

–হিসেবটা এমন কিছু জটিল নয়। মিঃ গ্রান্টের মুখে মিঃ কার্টারের কথা শুনেই বুঝে নিয়েছিলাম কোনো গুরুতর কাজেই তোমার ডাক পড়বে। মিঃ গ্রান্ট উসখুস করছেন দেখে শেরীর বোতল আনবার অছিলায় বেরিয়ে গিয়ে বান্ধবী মরিনকে ফোন করলাম। বলে দিলাম, কিছুক্ষণ পরেই যেন আমাকে ফোন করে।

তার ফোন পেয়েই অসুস্থ বান্ধবীকে দেখতে যাবার নাম করে বেরিয়ে শোবার ঘরে গিয়ে আড়ি পেতে ছিলাম।

তোমাদের সলাপরামর্শ সবই কানে গেল। তখনই ঠিক করলাম উন্নাসিক গ্রান্টকে শিক্ষা দিতে হবে। কেন না মিঃ কার্টার আমাদের দুজনকে আলাদা করে ভাবেননি কখনও।

-ঠিকই বলেছ, গম্ভীর স্বরে বলল টমি, তবে আশ্চর্য হচ্ছি, আমরা দুজনেই আবার অদ্ভুতভাবে সক্রিয় হয়ে উঠলাম।

অতীতের সেই উজ্জ্বল দিনগুলি বুঝি আবার ফিরে আসবে। কিন্তু তুমি হঠাৎ ব্লেনকিনসপ এই বিচ্ছিরি নামটা নিতে গেলে কেন?

–আমার কাপড় সামলে চলার সুবিধা হবে বলে ওই নামটাই খুঁজে নিতে হয়েছে।

–কাপড় সামলে মানে?

–তোমার মাথা মোটা হয়ে গেছে। আমার গায়ের নিকারের গলায় B অক্ষরটা এমব্রয়ডারি করা আছে। B অক্ষর দিয়ে বেরেসফোর্ড হতে পারে আবার ব্লেনকিনসপও হতে পারে। তাই আমার নাম হয়ে গেল প্যাট্রিসিয়া ব্লেনকিনসপ। কিন্তু তোমার মিয়াদো পদবীটাও হতকুচ্ছি।

-তোমার মত B অক্ষরের সমস্যা তো আমার ছিল না,তবে মিয়াদো অতি সজ্জন ব্যক্তি, অতীবও সম্মানের।

–তাহলে তুমি কি বিবাহিত না বিপত্নীক?

–বিপত্নীক, মাথা ঝুঁকিয়ে সম্ভ্রমের সঙ্গে বলল টমি, দশ বছর আগে আমার স্ত্রী সিঙ্গাপুরে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।

-আবার সিঙ্গাপুর কেন?

–কোনো কারণ নেই, মনে হল

–মন্দ নয়। তবে আমি বিধবা।

–তোমার স্বামী কোথায় মারা যান?

–তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। লিভারে পচন ধরেছিল, কোনো এক নার্সিংহোমে ছিল–

–আহা বেচারা! আর ডগলাস–তোমার ছেলে?

–সে নেভিতে। আমার কিন্তু আরো দুটি ছেলে আছে। এয়ারফোর্সে কাজ করছে রেমন্ড, আর শিশুপুত্র কাইলি দেশের বাড়িতে।

টমি এমনি হালকা রসিকতার ইতি টানল একসময়। সান্স সৌচি ক্রমেই এগিয়ে আসছিল। সে জানতে চাইল, আমার আগেই তো তুমি এই ভিলায় নাম লিখিয়েছ। জার্মান স্পাই বলে কাকে সন্দেহ করছ?

টুপেনসের কপালে চিন্তার রেখা দেখা দিল। বলল, সেভাবে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে একটি সুদর্শন জার্মান যুবক এখানে আছে।

-হা, কার্ল ভন দিনিম। উদ্বাস্তু। পুলিশ নিশ্চয় তার কাগজপত্র খুঁটিয়েই পরীক্ষা করেছে। তোমার কি মনে হয়?

–আমি পুলিশের ওপর নির্ভর করে থাকতে পারি না। অনেক সময় ওদের চোখও এড়িয়ে যায়। আমি ভোলা মন নিয়ে লক্ষ্য করে চলেছি।

–আচ্ছা, মিসেস পেরিনা সম্পর্কে ভেবে দেখেছ?

–হ্যাঁ, তাকে আমার নজরে রাখার মত মনে হয়েছে।

–আমাদের কথা শেষ করা দরকার। আমাদের যোগাযোগের ব্যাপারটা কীরকম হবে? ঘন ঘন দেখা-সাক্ষাৎ হওয়া ঠিক হবে না।

অবশ্যই। আমি স্থির করেছি, তোমাকে বানাব বিধবার সম্ভাব্য শিকার,-নাছোড়বান্দা হয়ে পেছনে লেগে থাকব। ইতিমধ্যে আমি দু-জন স্বামীর সঙ্গে ঘর করেছি। তৃতীয়টির সন্ধানে রয়েছি–কাজেই লাউঞ্জে, কাফেতে তোমার সঙ্গে লেপ্টে থাকার চেষ্টা করব। তুমি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেও পৌরুষের খাতিরে পেরে উঠছ না। মনে হয় ব্যাপারটা সকলের কাছেই উপভোগ্য হয়ে উঠবে।

পরিকল্পনাটা জুতসই সন্দেহ নেই। ঠোঁটের কোণে হেসে টমি টুপেনসের দিকে তাকায়। পরক্ষণে আচমকা তার হাত টেনে ধরে।

–সামনে তাকিয়ে দেখ।

এক জোড়া যুবকযুবতী, অদূরে গাছগাছালির ছায়ায় ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে পরস্পরের অনুরাগ বিনিময় করছে।

টুপেনস নিচুস্বরে বলল, যুবকটি কার্ল ভন দিনিম। কিন্তু মেয়েটিকে চিনতে পারছি না। তুমি সরে যাও।

টমি তৎক্ষণাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বিপরীত মুখে চলতে শুরু করল।

 কিছুটা আসার পরেই মেজরের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎ। দু-জনেই সমস্বরে সুপ্রভাত বিনিময় করে।

সূর্য উঠবার আগেই বেরিয়ে পড়া আমার অভ্যাস। বললেন মেজর।

–আজ্ঞে, আমারও তাই, বহুদিনের অভ্যাস। জবাব দেয় টমি।

মেজর কথা বলার সুযোগ পেলে সাতকাহন জুড়ে দেবেন। তাই টমি প্রথমেই ভিন্নপ্রসঙ্গে চলে আসে।

–কী যেন নাম, ওই মহিলাটি, হা, মিসেস ব্লেনকিনসপ, তার সঙ্গে দেখা হল। আপনি মহিলাকে জানেন?

–মিসেস ব্লেনকিনসপ। দেখতে মন্দ নয়। খুব কথা বলে। তবে বোকা নয়। আমি তাকে ঠিক জানি না। সবে এসেছেন এখানে। তা বলল কিছু?

-না, বিশেষ কিছু না। বলল টমি। মেজর অন্তরঙ্গ স্বরে বললেন, খুব সাবধান মশায়। পড়তি বয়সি মহিলা। আপনি হয়তো জানেন না, ও কিন্তু বিধবা।

-তাই নাকি? অবাক হওয়ার ভান করে টমি।

 বেশ সরস হয়ে ওঠেন মেজর। টমির পিঠে থাবা বসিয়ে বলেন, আপনার যদিও বয়স ঢলে পড়েছে, তবু বিধবা বলে কথা। বুঝতেই তো পারেন ওরা কোনো শ্রেণির জীব। ইতিমধ্যেই মহিলা দু-জন স্বামীকে পার করেছে, তৃতীয় শিকারের সন্ধানে আছে বলেই সন্দেহ হয়। অতএব সাবধান–এ আমার উপদেশ।

কথা বলতে বলতে সান্স সৌচির গেটের কাছে পৌঁছে গেলেন তারা।

.

ওদিকে টুপেনস চলার গতি মন্থর করে। উৎকর্ণ হয়ে ধীরে ধীরে আলাপরত কপোতক পোতিকে অতিক্রম করে যায়। যুবতীর চাপা স্বর তার কানে আসে…সাবধান থেকো কার্ল…কোনোরকম সন্দেহ…

আর শোনা গেল না। আরও কয়েক পা এগোল টুপেনস। তারপর আবার ঘুরল। যুবতীর গলার স্বর কানে এলো–নিজের অবস্থার কথা ভুলে যেয়ো না…জঘন্য ইংরেজরা–

কিছুদূর গিয়েই টুপেনস আবার ফিরল। যুবক-যুবতী এখন আর একসঙ্গে নেই। মেয়েটি দ্রুতপায়ে পথে নেমে পড়েছে।

যুবকটি অন্যমনস্কভাবে টুপেনসের দিকেই এগিয়ে আসছে।

 দু-জনে চোখাচোখি হল। মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানাল যুবকটি।

–সুপ্রভাত মিঃ কার্ল ভন দিনিম, প্রতিঅভিবাদন করল টুপেনস। ভারী মনোরম আজকের সকালটা।

-হ্যাঁ, চমৎকার আবহাওয়া। স্মিত হাসল দিনিম, ম্যাডাম, আপনি কি সান্স সৌচিতে ফিরছেন? তাহলে আপত্তি না থাকলে আমরা একসঙ্গেই যেতে পারি।

ওরা দু-জনে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। চলতে চলতে টুপেনস জিজ্ঞেস করল, প্রাতঃরাশ করেছেন, না বাকি আছে?

–ওই পাট চুকিয়েই বেরিয়েছি। এখন কাজে যাচ্ছি।

–কী কাজ? জানতে চাইল টুপেনস।

-কেমিস্ট্রি নিয়ে রিসার্চ করছি। কিছু একটা করে এই বিদেশে পেট চালাতে হবে তো। তাই যেটা জানি তাই নিয়েই লেগে পড়েছি।

–বিদেশে দুঃসময়ে বিদ্যেই পরম সহায়। আপনি ঠিকই করেছেন। বলল টুপেনস।

কথা বলতে বলতে দিনিমের মুখাভাবে একটা কাঠিন্য ফুটে ওঠে। তিনি বলতে থাকেন, দুই ভাই এখনও পচছে অত্যাচারী নাৎসীদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। ওইরকম একটি ক্যাম্পেই বাবা প্রাণ হারান।

সেই শোক সইতে না পেরে মাও আতঙ্কে আর ভয়ে অকালে মারা যান। একা আমিই কোনোক্রমে পালিয়ে এসে নড়েচড়ে বাঁচবার চেষ্টা করছি।

দিনিম কেমন উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। কথা শেষ হলে সশব্দে পা ফেলে নীরবে হাঁটল কিছুক্ষণ। টুপেনসের মনে তার কথাগুলোই গভীর বেদনা মথিত করে তুলছিল।

দু-জন পথচারী ওদের অতিক্রম করে চলেছে। হঠাৎ একজন তার সঙ্গীকে উদ্দেশ্য করে বলল, ওই শয়তানকে চিনে রাখ, একটা বজ্জাত জার্মান।

প্রবল ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারিত মন্তব্যগুলো উত্তপ্ত শলাকার মতো দিনিমের কানে প্রবেশ করল। মুহূর্তের মধ্যে তার শান্ত চেহারা ক্ষোভে উত্তেজনায় ভয়ানক হয়ে ওঠে। কপালের শিরা ফুলে ওঠে। সে উত্তেজিত ভাবে বলে ওঠে, শুনলেন তো এরকম মন্তব্যই পথেঘাটে আমাকে শুনতে হয়। আমি এখুনি ওদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারি।

মারমুখী জার্মান যুবককে শান্ত করতে টুপেনস বলে উঠল, মাথা গরম করবেন না, শান্ত হোন। এই সময়ে বিবেচনাশক্তি হারালেই বিপদ।

-কী বলতে চাইছেন আপনি। গনগনে স্বরে জিজ্ঞাসা করে দিনিম।

ধীর কণ্ঠে টুপেনস বলল, দুটো দিকই আপনার ভেবে দেখা উচিত। এই দেশ এখন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় আপনি একজন জার্মান উদ্বাস্তু, স্থানীয় সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই আপনার দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে তাকাবে। তবু এটা তো সত্যিকথা আপনি বেঁচে আছেন, এবং স্বাধীন ভাবেই বেঁচে আছেন।

জার্মানদের মধ্যে যারা ভালো মন্দ চিনতে পারেন তেমন শিক্ষিত মানুষ পথেঘাটে সচরাচর ঘুরে বেড়ান না, এরা সব সাধারণ শ্রেণির মানুষ। সব জার্মানই এদের কাছে সমান। এদের মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

টুপেনসের কথায় দিনিম সংযত হয়। ধীর পদক্ষেপে সে সান্স সৌচি পর্যন্ত টুপেনসকে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেয়।

.

ডাইনিংরুমের দরজায় পৌঁছেই মিসেস পেরিনার গলা শুনতে পেল টুপেনস। তিনি তার মেয়ে শীলার গল্প শোনাচ্ছিলেন অতিথিদের।

-শীলার সঙ্গে আলাপ হলে আপনারা খুশি হবেন। কাল রাতে এসেছিল, আজই সকালে আবার ফিরে গেল।

টুপেনসকে দেখতে পেয়ে সুপ্রভাত জানিয়ে অভিবাদন করলেন। জানালেন, ডাইনিংরুমে তার ব্রেকফাস্ট দেওয়া আছে।

মিসেস স্প্রট, তার ছোট্ট মেয়ে এবং মিসেস ওরুরকি তখন ব্রেকফাস্ট সারছিলেন। টুপেনস সকলের সঙ্গে প্রাতঃকালীন অভিবাদন বিনিময় করল।

মিসেস স্প্রটের শিশুটি টুপেনসকে দেখতে পেয়েই আনন্দ করে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আধো-আধো স্বরে বলতে লাগল, গা-গা-ব (Ga-Ga-Bouch)।

মিসেস স্প্রট বললেন, সবে দু-বছর পার হল, ভালো করে কিছুই বলতে পারে না। বাব ওসবই আওড়াচ্ছে সারাক্ষণ।

বিপুল দেহী মিসেস ও রুরকি শিশুটির দিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন। তার বিকট আকৃতি দেখে শিশুটি ভয়ে আর্তনাদ করে ওঠে–Nazar

শিশুটির বিরাগ বুঝতে পেরে মিসেস ওরুরকি অপ্রতিভ হলেন। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।

মিসেস স্প্রট বললেন, কোনো কিছুতেই ভয় পেলেই ও এমনি ভাষায় চিৎকার করে ওঠে।

মিসেস ওরুরকি বাচ্চাদের ভালোইবাসেন, কিন্তু তার অমন অদ্ভুত চেহারাই বাচ্চাদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়।

এইসময় টুপেনস দেখতে পেল, মেজর ব্লেচলি ও টমি ডাইনিংরুমে ঢুকছেন। উৎসাহিত হয়ে সে বলে ওঠে, আসুন আসুন মিঃ মিয়াদো। কখন থেকে আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছি–

টুপেনসের গায়ে-পড়া অতি-উৎসাহে থতমত খেল টমি। বলার চেষ্টা করল, ধন্যবাদ সত্যিই একটু দেরি হয়ে গেল।

মেজর ব্লেচলি ও টমি আসনগ্রহণ করলেন। ছোট্ট বেটি অমনি মায়ের কোলে হুটোপাটা করে হাত বাড়িয়ে দেয় মেজরের দিকে। মুখে আওয়াজ তোলে-পুচপুচ

মেজর হাসিমুখে শিশুর দিকে তাকান। আদুরে গলায় বলেন—আ–পুঁচকে মিস পিপ–সকালটা কেমন কাটল

ছোট্ট বেটি মজা পেয়ে লাফিয়ে উঠে খিলখিল শব্দে হেসে উঠল।

শিশুর হাসির শব্দটি হঠাৎ কেমন অর্থবহ বোধহয় টুপেনসের। দুর্বোধ্য একটা সন্দেহের দোলা লাগে মনে।

মেজর আর শিশুটির আন্তরিক সম্পর্কের মধ্যে কিছু একটা অস্বাভাবিকতার ছায়া যেন দেখতে পায় সে। চমকিত হয়ে তাকায় ওদের দুজনের দিকে।

.

মিস মিল্টন সান্স সৌচির বাগানে চেয়ারে বসে আপন মনে উল বুনে চলেছেন। টুপেনস এগিয়ে এসে প্রাতঃকালীন অভিবাদন বিনিময় করে পাশের চেয়ারে বসল।

উলবোনা নিয়ে দুজনের মধ্যে কথাবার্তা চলতে থাকে। কথায় কথায় মিস মিল্টন হঠাৎ জিজ্ঞেস করেন, আপনার এক ছেলে নেভিতে আছে বলেছিলেন, তাই না?

টুপেনস সাগ্রহে বলে উঠল, হা বড়টি। পরেরটি রয়েছে বিমানবাহিনীতে। কোলেরটিকে ফ্রান্সেই রেখে আসতে হয়েছে।

–আহা, তাহলে তো বড়ই কষ্টে দিন কাটছে আপনার।

–দেশের এই সঙ্কট সময়ে ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্টের কথা বড়ো করে দেখা উচিত নয় আমাদের। আমাদের এখন সাহসী হতে হবে, তাই নয়?

তবে জার্মানদের দাপট শীঘ্রই কমে আসবে। আমার ধারণা, মাস দুয়েকের মধ্যেই ওরা ঝিমিয়ে আসতে বাধ্য।

মিস মিল্টন উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠলেন, আমারও তাই ধারণা।

তারপর গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন, আমি শুনেছি হিটলার এক মারাত্মক অসুখে ভুগছেন। অনেকেই অনুমান করেছেন, আগস্ট মাসের মধ্যেই সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে যাবেন।

টুপেনস বলল, জার্মানির ভেতরের অবস্থাও ভালো নয়। শ্রমিক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ছে। ক্রমশ। রসদেও টান পড়েছে।

-দুজনে বেশ জমে গেছেন মনে হচ্ছে।

মিঃ ও মিসেস ক্লে এসে উপস্থিত হলেন।

মিঃ ক্লে-এর কথার উত্তরে মিস মিল্টন বললেন, আমরা যুদ্ধের কথা বলছিলাম। এই শরতেই শেষ হয়ে যাবে, তাই নয়?

-বাজে কথা, বললেন মিঃ ক্লে, অত সহজ নয়। আরও দু-বছর এই রকমই চলবে।

চমকে ওঠার ভান করল টুপেনস। বলল, সর্বনাশ! আপনার কি ওরকমই মনে হচ্ছে মিঃ ক্লে?

নিজের আসনে নড়েচড়ে বসলেন মিঃ ক্লে। তিনি যে আগ্রহ সঞ্চার করতে পেরেছেন একথা ভেবে বেশ আত্মপ্রসাদের সঙ্গে হাসলেন।

-আমার তাই ধারণা–যুদ্ধের এই ডামাডোল আরও বছর দুই চলবে নির্ঘাৎ।

টুপেনস ও মিস মিল্টন দু-জনেই প্রতিবাদ জানাবার চেষ্টা করেন।

জার্মানিকে আমি ভালোভাবেই চিনি, বললেন মিঃ ক্লে, একসময়ে নিজের কাজে ওই দেশের কোথায় না গেছি। বার্লিন, হামবুর্গ, মিউনিক বাদ নেই কোথাও। ওদের আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। ওই ব্লিটসীগ–ওতেই এরা আমাদের কাবু করার মতলব এঁটেছে। তার ওপর যদি রাশিয়া পাশে এসে দাঁড়ায় তাহলে তো আর কথাই নেই।

এইসময় ছোট্ট বেটিকে নিয়ে তার মা মিসেস স্প্রট এসে হাজির হলেন। শিশুটির হাতে ধরা একটা পুতুল। নিজের মনেই সে বকবক করে চলেছে।

ওদের দিকে তাকিয়ে সকলেই কয়েক মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হলেন। বেটি মায়ের কোল থেকে নেমে ছোটাছুটি আরম্ভ করল।

টুপেনস প্রসঙ্গের খেই ধরিয়ে দিয়ে বলল, তারপর বলুন মিঃ ক্লে।

মিস মিল্টনও সাগ্রহে তাকাল মিঃ ক্লে-এর দিকে। টুপেনসকে আচমকা মিসেস ক্লে-এর দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করল, আপনারও কি একই অভিমত মিসেস ক্লে? আমাদের বিপন্নতা আর দীর্ঘস্থায়ী হবে?

আকস্মিক এই প্রশ্নে হকচকিয়ে যান মিসেস ক্লে। তিনি আমতা-আমতা করে বলেন, আমাকে বলছেন? আমি কি বলব? তবে দু-বছর চলবে বলে মনে হয় না।

-হ্যাঁ, সময়টা বড়ো বেশি। বলল টুপেনস।

-কিন্তু আলফ্রেড তো বলছে আরও দু-বছর চলবে। নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না আমি।

উপস্থিত সকলেই নীরব থেকে মিসেস ক্লে-এর মতামত শুনল। টুপেনস দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সে আশা করেছিল, এই আলোচনার সুযোগে তাদের মধ্যে সে একজনকে চিহ্নিত করতে পারবে।

কয়েক মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল টুপেনস। সম্বিৎ ফিরে পেল মিসেস পেরিনার আবির্ভাবে।

নিঃশব্দে তিনি পেছন থেকে আলোচনারত নারী-পুরুষদের মধ্যে এসে দাঁড়ান। তার মুখের দিকে তাকিয়ে টুপেনসের অনুভূতিগুলি সজাগ হয়ে উঠল। পলকের জন্য তার মনে একটা সন্দেহের ছায়াপাত হল। সে ভাবল, ওই মহিলা সম্পর্কে নজর খোলা রাখা দরকার।

.

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই টমির সঙ্গে মেজর ব্লেচলি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। দুই বন্ধু তখন বেশির ভাগ সময়ই একসঙ্গে থাকেন।

গলফ খেলার মাঠের দিকে চলতে চলতে কার্ল দিনিম সম্পর্কে মেজর বলতে লাগলেন, ওই জার্মান ছোকরাকে কিন্তু আমি সন্দেহ না করে পারছি না, যাই বলুন। যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার একমাস আগেই এখানে এসে গেড়ে বসেছে। বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য না থাকলে-বুঝলেন কাজটা নির্ঘাত গুপ্তচরবৃত্তি।

টমি কৌতূহলী হয়ে বলল, কিন্তু এখানে তো কোনো সামরিক ঘাঁটি নেই

–নেই তো কী, ঈষৎ উত্তেজনা মিশল মেজরের কণ্ঠস্বরে। এই সময়ে এমন নিরিবিলি জায়গায় থেকে কাজ করাই নিরাপদ। প্লাইমাউথ বা পোর্টসমাউথে থাকলে সদাসতর্ক পুলিশের নজরে পড়ে যাবার ষোলআনা সম্ভাবনা।

আমাদের ইংরাজ সরকারও হয়েছে তেমনি, আগ বাড়িয়ে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিয়ে বসে আছে। নাৎসীরা সব কমবয়সিই হয়-কার্ল ছোকরারও সেই বয়স। লক্ষ করে দেখবেন, তার চালচলনও সন্দেহজনক মনে হবে।

টমি মৃদু হাসল। বলল, অবস্থা যা দেখছি প্রেত-তাড়ানো ওঝা-বদ্যির দরকার এখন আমাদের দেশে।

-তারা কী করবে?

–কেন, টমি বলল, গন্ধ-শুঁকেই গুপ্তচর ধরে দেবে।

মেজর মাথা দোলালেন। বললেন, ঠিক বলেছেন গন্ধ শুঁকেই গুপ্তচর ধরা গেলে খুবই ভালো হত।

কথা বলতে বলতে দু-জনে ক্লাবের সামনে উপস্থিত হলেন। টমি এই ক্লাবের অস্থায়ী সদস্য।

ময়দানে নামার মুখে পাশ থেকে হ্যাল্লো সম্বোধন শুনে দু-জনেই ঘুরে তাকালেন। আর এক খেলোয়াড় এগিয়ে আসছেন।

মেজর উল্লাসে বলে ওঠেন, আরে এসো এসো হেডক। মিঃ বেরেসফোর্ড, ইনি হলেন আমার পুরোনো বন্ধু অ্যাডমিরাল হেডক। এখন অবশ্য স্থানীয় এ. আর. পি.দের কামাণ্ডার।

ততক্ষণে এগিয়ে এসেছেন কামাণ্ডার হেডক। বন্ধুর বন্ধু টমির সঙ্গে পরিচিত হয়ে সোল্লাসে করমর্দন করলেন।

আমার বন্ধু ব্লেচলি আপনাকে পেয়ে বেশ আনন্দেই আছে দেখছি, হেসে বললেন হেডক, তবে ওর আসল আনন্দ কিসে জানেন, কিহে ব্লেচলি, তাহলে বলি, মেয়েরা বসে গালগল্প করবে, উল বুনবে, ব্লেচলি তাদের মধ্যে উপস্থিত থেকে উপভোগ করবে।

কথা শেষ করে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে সশব্দে হেসে উঠলেন তিনি।

মিঃ ব্লেচলিও পালটা আক্রমণ করলেন, তাহলে তো মিস পেরিনার কথা আমাকে বলতেই হয়।

–শীলা। সত্যিই চমৎকার মেয়ে। রূপও আছে যাই বলো।

–ইদানীং অবশ্য তাকে নিয়ে আমাকে বিশেষভাবে ভাবতে হচ্ছে। বললেন ব্লেচলি।

সকলে ক্লাবঘরের বারান্দায় এসে বসলেন। মদ্যপানের ছোট্ট আসর বসল।

হেডক মিঃ ব্লেচলির দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার বলো, শীলা সম্পর্কে কী বলছিলে তুমি।

ব্লেচলি ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন, সান্স সৌচির সেই জার্মান ছোকরা–তোমার শীলার সঙ্গে খুব ভাব জমেছে

-হুম, লক্ষ্য করেছ? আজকালকার মেয়েরা কী হয়েছে বলে তো, নীতিবোধ বলে কিছু নেই। শত্রুর সঙ্গে ঘর বাঁধতেও আটকাচ্ছে না। হামেশাই এরকম ঘটনা চোখে পড়ছে।

–ওই শীলা মেয়েটাও অঘটন ঘটালো বলে।

কথাপ্রসঙ্গে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতির বিষয়ও বাদ থাকল না। কামাণ্ডার হেডক একসময় বললেন, এই লিহাম্পটনের অবস্থাও মোটে ভালো নয় হে। যে কোনো দিন জার্মান ছত্রীবাহিনী নেমে পড়তে পারে। ওপরমহলের ব্যবস্থাপনা যে কীরকম বুঝতে পারি না। কাছে ধারে একটা বিমানবিধ্বংসী কামান পর্যন্ত বসানো হয়নি।

হেডকের আলোচনা বিশেষ জমল না। কেন না, মেজর ও টমি উৎসাহ বোধ করলেন না। ওদের ওঠবার তাড়া ছিল।

বিদায় জানাবার আগে হেডক তাদের দুজনকে নিজের বাড়িতে একদিন মদ্যপানের আমন্ত্রণ জানালেন।

.

মধ্যাহ্নভোজের কিছু পরেই টমি সান্স সৌচি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। আপন মনে ঘুরতে ঘুরতে লিহাম্পটনের এক প্রান্তে চলে এলো। দুটো পত্রিকা নিয়ে পুরোনো জেটির ধার ধরে হাঁটতে লাগল।

একটা মাছ শিকারের মঞ্চে ছিপ হাতে বসেছিলেন একজন বয়স্ক লোক। ফাতনার দিকে নিবদ্ধদৃষ্টি।

এই বৃদ্ধ আমাদের পরিচিত। ইনি হলেন ছদ্মবেশী মিঃ গ্রান্ট।

 টমি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কিছু মিলল?

মাছ-শিকারি ফাতনা থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই মাথা ঝাঁকান। মৃদুস্বরে জবাব দেন, ঠোকরাচ্ছে। কম।…মিঃ মিয়াদো, এগুলেন কদ্দূর?

–সবে হামাগুড়ি দিচ্ছি। বলল টমি।

–এগিয়ে চলুন। আসুন, আপনার অগ্রগতির রিপোর্টটা শোনা যাক।

টমি মিঃ গ্রান্টের পাশে আসন নেয়। মধ্যাহ্নের খাড়া রোদ মাথায় ঝরছে। ধীরে ধীরে বলতে থাকে, সান্স সৌচির বাসিন্দাদের একটা তালিকা তো আমি আগেই পেশ করেছি।

–হ্যাঁ, পেয়েছি। মিঃ গ্রান্ট মাথা ঝাঁকালেন।

-এখনও পর্যন্ত বলার মতো অগ্রগতি কিছু হয়নি। আপাতত মেজর ব্লেচলির সঙ্গে বন্ধুত্ব জমে উঠেছে। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার। তবে নিতান্ত সাধারণ বলেই মনে হচ্ছে। নিজেই স্বীকার করেছেন। একসময় কোথায় না গেছেন।

সূত্রটা গুরুত্বপূর্ণ।

 সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেন মিঃ গ্রান্ট।

–জার্মান ছোকরা কার্ল ভন দিনিমের ওপরও নজর রাখছি।

–ছোকরা সম্পর্কে আমিও আগ্রহী। বললেন মিঃ গ্রান্ট।

–ভন দিনিম এন (N) বলে আপনার মনে হয়? জানতে চায় টমি।

–তা মনে হয় না। সান্স সৌচির বাসিন্দাদের মধ্যে সম্ভবত এম বা এন কেউই নেই। তাদের হয়ে হয়তো কাজ করে চলেছে ভন দিনিম। জার্মান উদ্বাস্তু পরিচয়টা খোলস হওয়া অসম্ভব নয়। লোকটির ওপর নজর রাখবেন।

–পুলিশি রেকর্ডে তার পূর্ব ইতিহাস তো রয়েছে

মাথা ঝাঁকালেন মিঃ গ্রান্ট। বললেন, সান্স সৌচিতে সে নিজের সম্পর্কে যা বলছে, পুলিশের নথিতে তার সমর্থন রয়েছে। নাৎসীদের সমালোচনা করায় তার বাবাকে প্রাণ দিতে হয়েছে, কথাটা ঠিক। তার বড়ো ভাই এখনও কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় দিন গুনছে।

মানসিক যন্ত্রণা সইতে না পেরে মা মারা গেছে। যুদ্ধ শুরু হবার একমাস আগে কোনোক্রমে প্রাণ নিয়ে এদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় ভন দিনিম। শপথ করেছে, ইংলন্ডকে যথাসাধ্য সাহায্য করবে।

রসায়ন নিয়ে গবেষণা করে ইতিমধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেছে। গ্যাস আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে তার আবিষ্কার যথেষ্ট কার্যকর।

–তাহলে তো দিনিম ইংলন্ডের বন্ধু, তাকে সন্দেহ করা বৃথা।

–ওই ভুলটি করবেন না, বললেন মিঃ গ্রান্ট, আপনি গোয়েন্দা, আবেগের প্রশ্রয় দেবেন না। জার্মান ভাইয়ের কাজ অতি নিখুঁত। ভন দিনিমের ক্ষেত্রে এমন হতে পারে, ওই নামটা আদৌ তার নিজের নয়-নাম ভাঁড়িয়ে আছে।

তবে আমাদের শত্রুদের মধ্যে মারাত্মক হল সেই পঞ্চমবাহিনী মনে রাখবেন, যারা দেশের সন্তান হয়েও বিদেশী শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।

এই ঘৃণ্য জীবগুলোর জন্যই আমাদের যাবতীয় প্রয়াস বৃথা হয়ে যাচ্ছে। মুশকিল হল এই ঘরশত্রুরা ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে। শত্রুর জয় হলে এদেরও পদোন্নতি হবে।

টমি দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করল, ঘৃণ্য শয়তানের দল

–এই শয়তানদেরই কবজায় আনতে হবে আমাদের।

এক মুহূর্ত নীরব থাকলেন মিঃ গ্রান্ট। পরে বললেন, ওখানকার মহিলাদের সম্পর্কে কিছু বলুন।

–একজন মহিলাকেই আমার অন্যরকম মনে হয়েছে।

–মিসেস পেরিনার কথা বলছেন?

–হ্যাঁ। ওর সম্পর্কে আপনার কিছু জানা আছে?

–সন্ধান নিতে হবে।

 –আর একটা খবর আছে স্যার।

–বলুন।

–মিসেস ব্লেনকিনসপ নামে এক মহিলা সম্প্রতি এসে জুটেছেন।

বেশ তো, নজর রাখবেন।

 –স্যার, ইনি আমার স্ত্রী।

 বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠে পড়ে মিঃ গ্রান্টের। প্রায় চিৎকার করে বলে ওঠেন, কী বলছেন? স্ত্রীর কাছে ব্যাপারটা গোপন রাখার কথা আপনাকে বলেছিলাম।

–আমি স্যার কিছুই ফাস করিনি। এর পর টমি টুপেনসের কায়দা-কৌশল সব খুলে জানাল। শুনে মিঃ গ্রান্ট প্রথমে গুম হয়ে রইলেন। পরে উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠে বললেন, অদ্ভুত, সত্যিই অদ্ভুত। এমন মহিলা বুঝতে পারছি এজন্যেই এস্থাম্পটন এই মিশনে আপনার স্ত্রীকেও নিতে বলেছিলেন। আমিই রাজি হতে পারিনি।

এখন দেখছি বুদ্ধির দৌড়ে তিনি সকলকে টেক্কা দিতে পারেন। এস্থাম্পটন শুনলে নিঃসন্দেহে খুশি হবেন।

যাইহোক, ডিপার্টমেন্ট আপনাদের দুজনকেই স্বীকৃতি দিচ্ছে–তাঁকে জানাবেন। আপনাদের যৌথ অভিযান সফল হোক।

.

ডিনার শুরু হতে তখনও কিছু সময় বাকি। টুপেনস লাউঞ্জে ঢুকে দেখতে পেলেন মিসেস ওরুরকি একাই বসে আছেন। জানালার বাইরে তাকিয়ে আপন মনে কী ভাবছেন।

টুপেনসকে দেখতে পেয়েই সোল্লাসে চিৎকার করে আহ্বান জানালেন।

বিশাল বপু ওরুরকিকে দেখলে কারোরই পছন্দ করবার কথা নয়। স্তূপীকৃত চর্বির মস্ত বাণ্ডিল যেন। বিশাল মাথা, গোল গোল পাকানো চোখ, গালে কুচিকুচি দাড়ি আর গোঁফের রেখা। তবু তার আহ্বান শুনে টুপেনসের মনে হল, তার প্রতি ভদ্রমহিলার কিছুটা টান আছে।

হাসিমুখে এগিয়ে এসে টুপেনস বলল, লিহাম্পটন জায়গাটার গুণ আছে বলতে হবে। মনের ভার সহজেই লাঘব করে দিতে পারে।

মিসেস ওরুরকি বললেন, অত ভাববেন না, আপনার ছেলেরা নিরাপদেই আপনার কাছে ফিরে আসবে। একজন তো বিমানবাহিনীতে আছে, তাই না?

টুপেনস মাথা ঝাঁকালো। মুখে দুশ্চিন্তার ভাব ফুটিয়ে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।

–এখন কি ফ্রান্সে আছে?

মিশরে আছে। চিঠিতে তো ওসব জানাতে পারে না–সংকেতে লেখা আমাকে বুঝে নিতে হয়।

–মা আর ছেলের ব্যাপার–আর এক ছেলে তো নৌবাহিনীতে?

 নিজের ছেলে ডগলাসের কথা মনে পড়ে যায় টুপেনসের। নীরবে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। পরে বলে, তিনজনকেই ছেড়ে দূরে এসে আছি।

লন্ডনের বাড়িটা লিজ নেওয়া–ওটা নিয়েও ভাবনা হচ্ছে। ভাবছি লিজের মেয়াদ বাড়িয়ে আর কাজ নেই।

লন্ডনের কথা বলবেন না, বললেন মিসেস ওরুরকি, ওখানে আমাদের বহুকালের বাস, ছোটখাট একটা ব্যাবসাও আছে, কিন্তু এই যুদ্ধ আমাদের সর্বনাশ করেছে।

একটু থেমে তিনি আবার বলতে থাকেন, অবশ্য এই পরিণতি নিয়ে কাউকেই দোষারোপ করার কিছু নেই। রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে আমাদের। এখানে তো দেখছি সবারই নানান অভিযোগ। মিসেস স্প্রট তো তার স্বামীর ওপরেই দেখছি যত ঝাল ঝাড়েন।

–ওর স্বামী কি সীমান্তের যুদ্ধে আছেন? জানতে চাইল টুপেনস।

–না যুদ্ধে যাননি। জীবনবীমা অফিসের সামান্য চাকুরে। বোমার ভয়ে বউ মেয়েকে এখানে রেখে গেছেন। সময় সুযোগ করে এসে এদের দেখে যান। বেচারির কি হয়রানি বলুন।

-হ্যাঁ, খরচের ব্যাপারটা তো কম নয়।

–তবু তো বলব, মিসেস পেরিনা কম খরচে যথেষ্ট সুবন্দোবস্ত করেছেন। মহিলার তুলনা হয় না। কিন্তু কী জানেন, ওকে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।

-কেন? অবাক হয়ে তাকায় টুপেনস, তার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েছে। আপনার?

সবার ওপরেই চোখ রয়েছে আমার। ভাববেন না, আমি বকবক করছি। নজরে পড়ে তাই বলছি। কে কোথায় যান, কী করেন, দেখতে পাই সবই তাই বলছি, মিসেস পেরিনা এক বিচিত্র ধরনের মহিলা। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই।

–আপনার এরকমই মনে হয়?

–আজকাল হচ্ছে। নিজেকে একটা রহস্যোর জালে জড়িয়ে রেখেছেন মহিলা। তাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, আয়ারল্যান্ডের মেয়ে। কিন্তু জিজ্ঞেস করলে বেমালুম বলে দিলেন, তিনি আইরিশ নন।

–সত্যিই কি উনি তাই?

–আমি আমার দেশের মেয়েদের চিনতে পারব না? উনি আয়ারল্যান্ডের কোন অঞ্চলের মেয়ে তা-ও আমি বলে দিতে পারি। অথচ উনি সকলকে বলে বেড়ান তিনি ইংরেজ। তার স্বামী ছিলেন স্প্যানিশ।

বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলেন ওরুরকি। টুপেনস তাকিয়ে দেখল লাউঞ্জে প্রবেশ করছেন মিসেস স্প্রট আর তার পেছনে টমি।

টুপেনস মুহূর্তে চঞ্চল হয়ে উঠল। টমির দিকে তাকিয়ে সোল্লাসে বলে উঠল, মিঃ মিয়াদো, আপনাকে দারুণ সতেজ লাগছে।

টমি হাসল। বলল, অনেক কসরত করে এলাম যে। গলফের মাঠ থেকে আসছি।

মিসেস ওরুরকি হঠাৎ টুপেনসের সোয়েটারের দিকে মনোযোগী হয়ে পড়েন। হাতে টেনে পরীক্ষা করে বলেন, এটা নিজের হাতে বোনা?

টুপেনস জবাব দেয়, আজ্ঞে হ্যাঁ।

–দারুণ বোনা হয়েছে। কিন্তু মিস মিল্টন বলছিলেন, আপনি নাকি উল বোনায় তেমন দক্ষ নন।

কথাটা শুনে কেমন চমকে উঠল টুপেনস। তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল মিসেস ওরুরকির দিকে। পরে হেসে বলল, উল যথেষ্টই বুনেছি আমি। তবে মিস মিল্টন অন্য কারুকে স্বীকার করতে চান না

সকলে একসঙ্গে হেসে উঠল টুপেনসের কথা শুনে।

.

ডাইনিং টেবিলে নানা প্রসঙ্গের অবতারণা হয়। আজ আলোচনা চলছিল জার্মান গুপ্তচরদের নিয়ে। তারা ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চতুর্দিকে।

কোনো এক গির্জার পাদ্রী শত্রুপক্ষের স্পাই। এক অস্ট্রিয়ান পাচিৎকার ঘরে ওয়ারলেসের যন্ত্রপাতি আবিষ্কার হয়েছে। এবার স্পাইদের সঙ্গে যোগ হয়েছে ঘরশত্রু পঞ্চমবাহিনী এভাবেই আলোচনা এগিয়ে চলেছে।

টুপেনস চোখ কান খোলা রেখে সজাগ হয়ে রয়েছে। যদি কোথাও গন্ধ পাওয়া যায়। তার মাথা জুড়ে রয়েছে এম ও এন।

মিসেস পেরিনার মেয়ে শীলা একপাশে চুপচাপ বসে রয়েছে। এককথায় তাকে সুন্দরী বলা চলে, মনে হল টুপেনসের। কিন্তু বিশেষ কথা বলছিল না সে।

মিসেস স্প্রট বলছিলেন, জার্মানরা বড় নৃশংস, গতযুদ্ধে তারা ক্যাভেল নামে একজন নার্সকে গুলি করে মেরেছিল। এমন অমানবিক কাজ ভাবা যায়?

শীলা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানিয়ে সুরেলা কণ্ঠে বলে উঠল, একজন গুপ্তচরকে হত্যা করা কিছু অমানবিক কাজ হতে পারে না। ক্যাভেল অনেক ইংরেজ বন্দিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।

-না, না, উনি স্পাই ছিলেন না।

সমবেতভাবে প্রতিবাদ জানাল সকলে।

শীলা তীব্রস্বরে চেঁচিয়ে বলল, স্পাই ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জার্মানরা কিছু অন্যায় কাজ করেনি।

তেজের সঙ্গে উঠে দাঁড়াল শীলা। তারপর সকলকে অবাক করে ড্রইংরুম ছেড়ে বাগানে চলে গেল।

কয়েকমুহূর্ত সকলেই নীরব হয়ে রইলেন। সামনের খাবারের প্লেটে মনোযোগী হয়ে ধীরে ধীরে আবার গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

টমি এক ফাঁকে উঠে ধীরে ধীরে ডাইনিংরুম থেকে বেরিয়ে বাগানে নেমে গেল।

শীলা বাগানের একদিকে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দূর সমুদ্রের দিকে তাকিয়েছিল। নিঃশব্দ পায়ে টমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। প্রবল উত্তেজনায় শীলার হাত মুঠো করে পাকানো।

–বড় মনোরম রাত।

প্রথম কথা বলল টমি।

 শীলা চকিতে টমিকে দেখে নিল। মৃদু স্বরে বলল, না, রাতের সেই সৌন্দর্য আর নেই।

টমি সংযত কণ্ঠে বলল, যুদ্ধের জন্য বলছেন?

-না, তা আমি বলিনি, তবে যুদ্ধকে আমি ঘৃণা করি।

–যুদ্ধ কেউ মেনে নিতে পারে না।

–কিন্তু আমার দৃষ্টিভঙ্গি অন্যরকম। ক্ষিপ্ত দেশাত্মবোধ আমি বরদাস্ত করতে পারি না।

–দেশাত্মবোধ-কেন? বিস্মিত হয় টমি।

তীব্র দেশাত্মবোধ বড় মারাত্মক। কেবল দেশ দেশ করা–দেশকে সেবা করা। দেশের জন্য আত্মত্যাগ, দেশের সঙ্গে শত্রুতা করা–সব ভাঁওতা। একজনের দেশ বলতে এই যে বিশেষ কিছু একটা বোঝনো, এটাই অসহ্য, কেন এমন হবে?

-ঠিক বলেছেন, আমি তা মনে করি না। মৃদুস্বরে বলতে চাইল টমি।

-আমি কি বলছি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদে বিশ্বাসী আপনারা, দেশের জন্য প্রাণত্যাগ করতেও কুণ্ঠিত নন।

–কিন্তু দেশের স্বার্থে আত্মত্যাগ করতে চাইবে প্রতিটি দেশপ্রেমী মানুষ।

 –এ আমি বিশ্বাস করি না। আমি অনেক দেখেছি–অনেক আঘাত পেয়েই একথা বলছি। বলতে বলতে সহসা টমির দিকে ঘুরে দাঁড়ায় শীলা। আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলতে থাকে, আমার বাবা প্যাট্রিক মেগুয়ির পরিণতির কথা আপনি জানেন?

-না।

–গতযুদ্ধের সময় তাকে বিশ্বাসঘাতক অপবাদ দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। অথচ বাবার কোনো অপরাধ ছিল না। কিন্তু একজন জাতীয়তাবাদী আইরিশ হিসেবে স্বাধীন আয়ারল্যান্ডের কথা তিনি ভাবতেন, উত্তেজিত হয়ে উঠতেন। এই অপরাধেই তাকে কয়েদ থাকতে হয়, পরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মরতে হয়।

তাহলে দেখুন, এক পক্ষের কাছে তিনি হলেন বিশ্বাসঘাতক, অপরপক্ষের কাছে তিনি দেশপ্রেমী শহীদ বলে বন্দিত।

কিন্তু আমি মনে করি, আমার বাবা ছিলেন একজন নিপাট মূর্খ। তার পরিণতি আমাদেরও স্পর্শ করেছে।

–খুবই স্বাভাবিক। বলল টমি।

-কিন্তু আমি সবকিছু মুছে ফেলতে চাই। আমার মাও তাই চায়। তিনি তার নাম বদলে ফেলেছেন। পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি সর্বত্র বলেন আমার বাবা ছিলেন একজন স্প্যানিয়ার্ড। আমরা কিছুদিন স্পেনে ছিলাম।

তারপর ইউরোপের নানা স্থান ঘুরে শেষ পর্যন্ত এখানে এসে থিতু হয়েছি। একটা নিচু শ্রেণির ব্যবসা অবলম্বন করতে হয়েছে।

কথা শেষ করে নীরব হয়ে থাকে শীলা। পরে চকিতে মুখ তুলে বলে, আপনাকে কেন এতসব কথা বলে ফেললাম, জানি না। কিন্তু দেশাত্মবোধকে আমি ঘৃণা করি।

বলেই আর দাঁড়াল না সে। দ্রুত সরে গিয়ে গাছপালার ছায়ায় মিলিয়ে গেল।