২. দরজায় ধাক্কার শব্দ

০৬.

দরজায় ধাক্কার শব্দে তন্দ্রার ভাবটা কেটে যায়, ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন ডাঃ আরমস্ট্রং।

দরজা খুলতেই দেখেন রজার্স দাঁড়িয়ে, তার চোখে জল, মুখ শুকনো।

–তোমার কি হয়েছে রজার্স?

–আমার স্ত্রী, গলা ধরে আসে রজার্সের, সে কোনো সাড়া দিচ্ছে না।

–চলো, দেখি ব্যাপারটা।

ড্রেসিং গাউন জড়িয়ে রজার্সের ঘরে উপস্থিত হন ডাক্তার। বিছানায় বসে আস্তে করে রজার্সের স্ত্রীর হাতটা তুলে নিলেন।

বরফের মত শীতল হাত। চোখের পাতা তবু টেনে দেখলেন। তারপর গম্ভীর মুখে । অন্যদিকে তাকান।

রজার্স এগিয়ে আসে, কোন কথা বলতে পারে না, দুচোখে জল।

ডাক্তার মৃতদেহ আর একবার পরীক্ষা করলেন। তারপর বিছানা, পাশের টেবিল, ওয়াশস্ট্যান্ড সবকিছু খুঁটিয়ে দেখলেন।

–স্যার, রজার্স ধীরে ধীরে ডাকে।

–বলো।

–ও কি হার্টফেল করেছে?

–তোমার স্ত্রীর কি কোন অসুখ ছিল?

–বাতে ভুগত মাঝে মাঝে।

–তার জন্য কি কোন ওষুধ খেতো?

–তেমন না। অনেক দিন কিছু খায়নি, কেবল

–কেবল কি?

–কেবল গতকাল রাতে আপনি যে ঘুমের ওষুধ দিয়েছিলেন, সেটা খেয়েছিল।

প্রাতঃরাশের ঘন্টা তখনো বাজেনি। ডগলাস এবং ওয়ারগ্রেভ বারান্দায় পায়চারি করছেন। দেশের রাজনীতির পরিস্থিতি নিয়ে তারা গভীর আলোচনা করছেন।

এই বাড়ির পেছনেই একটা উঁচু টিলা। দ্বীপের মধ্যে সেটাই সবচেয়ে উঁচু জায়গা। সকালে ঘুম থেকে উঠে সেখানে বেড়াতে গিয়েছিল ভেরা আর  লমবার্ড। সেখানে তারা দেখতে পায় ব্লোর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ওদের দেখতে পেয়ে ব্লোর বলে, মোটরবোটের কোনো চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি না।

ভেরা বলে, একটু বেলা হলে হয়তো আসবে।

এমন সময় প্রাতঃরাশের ঘন্টা বেজে ওঠে। এরা সকলে ফেরার পথ ধরল।

চলতে চলতে ব্লোর বলল, কাল মার্সটন কেন আত্মহত্যা করল, কিছু বোঝা গেল না।

 ভেরা বলল, আত্মহত্যা বলেই মনে হচ্ছে আপনার?

–এছাড়া আর কি? খুন হলে তার প্রমাণ কোথায়? মোটিভটা কি?

ওরা বাড়ির কাছে পৌঁছলে দেখতে পেল, এমিলি জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছেন। ওদের দেখতে পেয়ে জানতে চাইলেন, বোট আসছে?

ভেরা বলে, কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

সকলে তখন খাওয়ার ঘরে উপস্থিত। রজার্স খাবার আনতে গেছে। ভেরা বলল, রজার্সকে যেন কেমন বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। কাল তো বেশ হাসিখুশি ছিল।

ডাক্তার জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এগিয়ে এসে সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আজ রজার্সের ত্রুটি মার্জনা করবেন। ওকে নিজের হাতেই সব করতে হচ্ছে আজ।

এমিলি জানতে চায়, কেন, কি হয়েছে তার?

ডাক্তার বললেন, আসুন, আগে খাওয়াটা সেরে নেওয়া যাক। তারপর সকলে মিলে একটু আলোচনায় বসব।

.

প্রাতঃরাশের পাট চুকলে ডাক্তার রজার্সের স্ত্রীর মৃত্যুর সংবাদটা সকলকে জানালেন।

–আর্তনাদ শোনা গেল অনেকের কণ্ঠেই।

–চট করে বলা যাচ্ছে না।

–গতকাল সন্ধ্যাবেলা খুব মানসিক আঘাত পেয়েছিল। তাছাড়া শরীরও ছিল দুর্বল। হয়তো সহ্য করতে পারেনি। ভেরা বলল।

ডাক্তার বললেন, হার্টফেল কিনা, তা-ও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। ওর স্বাস্থ্য সম্পর্কে কোনো কথাই আমার জানা নেই।

এমিলি কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলেন, তাহলে বিবেকের আঘাতই হবে। গতকাল সন্ধ্যায় ওর স্বামীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তো সকলেই শুনেছেন।

ডাক্তার তার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন, সেই অভিযোগ শুনে কি–

–হ্যাঁ, পাপের ভয় ঢুকেছিল মনে। দেখেননি কেমন করে কাঁদছিল। ভয় না পেলে অজ্ঞান হবে কেন?

–ভয় পেয়েছিল, এটা সত্যি। তবে সেদিক থেকে চিন্তাটা একটু বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে না কি?

–মোটেই না। ভগবানের অভিশাপ ঠেকানোর সাধ্য কারুর নেই। আমি অন্তত বিশ্বাস করি।

পাপীকে ঈশ্বর শাস্তি দেন না। পাপকে তিনি ঘৃণা করেন, ব্যঙ্গের সুরে বলেন ওয়ারগ্রেভ, পাপীকে শাস্তি দেয় সাধারণ মানুষ। তবে খুব সহজে তা সম্ভব হয় না।

ব্লোর প্রশ্ন করে, আচ্ছা, গতকাল রাতে শুতে যাবার আগে রজার্সের স্ত্রী কি কিছু খেয়েছিল? ডাক্তার বললেন, কিছু না।–যেমন ধরুন চা, জল বা ওই ধরণের কিছু?

–রজার্স আমাকে বলেছে, ওসব কিছুই তার স্ত্রী খায়নি।

–ওকথা বলা রজার্সের পক্ষে অসম্ভব নয়।

ঈঙ্গিতটা বুঝতে পেরে ডাক্তার ক্লোরের চোখের দিকে তাকান। ব্লোর পুনরায় বলে, কাল রাতের অভিযোগটা পাগলামো কি না এখনো প্রমাণ হয়নি। যদি সত্যি বলে ধরে নেওয়া যায়, তাহলে সেই বৃদ্ধা মহিলাটিকে স্বর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করে এতদিন বেশ নিশ্চিন্তেই ছিল। কিন্তু হঠাৎ কাল–

ভেরা বেশ জোর দিয়ে বলে, ওসব শোনার পর রজার্সের বউ কিন্তু মোটেও অস্বস্তি বোধ করেনি, আমি লক্ষ্য করেছি।

ব্লোর ভেরার দিকে তাকিয়ে বলল, গতকাল রাতে ওসব কথা শোনার পর রজার্সের স্ত্রী অজ্ঞান হয়ে যায়। রজার্সও দারুণ অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। তার আশঙ্কা ছিল পাছে না অজ্ঞান অবস্থায় তার স্ত্রী সত্যি কথাটা বলে বসে।

ব্লোর এক পলক সকলের মুখের দিকে তাকায়।–পরে এই পরিস্থিতিতে একেবারে নিষ্কন্টক হওয়ার জন্য স্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। সেই কাজটাই সেরে নিয়েছে রজার্স।

ডাক্তার বললেন, কিন্তু ওর বিছানার পাশে তো কাপ-টাপ কিছু চোখে পড়ল না। তাছাড়া স্ত্রীকে কি এভাবে মেরে ফেলা সম্ভব?

–আপনি কি এর আগে শোনেননি স্বামী স্ত্রীকে গলা টিপে হত্যা করেছে, অথবা অন্য উপায়ে চিরদিনের মতো সরিয়ে দিয়েছে?

সকলেই চুপ করে এদের দুজনের কথা শুনছে। সকলের মনেই বিচিত্র একটা ভাব খেলা করছে।

এই সময়ে দরজা ঠেলে রজার্স ঘরে ঢুকল। ডাক্তার তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, মোটরবোট এসেছে?

ঘরের দেয়ালের ঘড়িতে ঢং ঢং শব্দে দশটা বাজল। রজার্স বলল, না স্যার। এত দেরি তো তার হয় না। অন্যদিন আটটার মধ্যেই চলে আসে।

ব্লোর আর  লমবার্ড বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।

লমবার্ড বলল, সকলেই আমরা মোটর বোটের জন্য অপেক্ষা করে রয়েছি। অথচ–

–রজার্সের কথা মত সেটা আসবার সময় দুঘন্টা পার হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ব্যাপারটা পূর্বপরিকল্পিত। মোটরবোট আসবে না।

 লমবার্ড কি বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় পেছন থেকে কে হঠাৎ বলে উঠল, কোনোদিনই আর আসবে না।

ওদের চমকে দিয়ে ডগলাস এসে পাশে দাঁড়াল।–মজাটা ওখানেই। আমরা অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে থাকব, দ্বীপ ছেড়ে কেউ যেতে পারব না। বুঝতে পারছ না এখনো–এই দ্বীপই আমাদের চিরশান্তিলাভের স্থান।

কথা শেষ করেই ডগলাস বারান্দা ছেড়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন, তারপর সমুদ্রের দিকে।

ওদের দুজনের মনে হল জেনারেল যেন উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। আগের সেই ফৌজি মেজাজটা আর নেই।

ডঃ আরমস্ট্রং বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। তার চোখে পড়ল বাঁ দিকে নিচু গলায় কথা বলছে ব্লোর আর  লমবার্ড। আর ডানদিকে অস্থিরভারে পায়চারি করছে ওয়ারগ্রেভ। তাকে খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে।

ডাক্তার একমুহূর্ত দ্বিধা করে বিচারপতির দিকে এগিয়ে গেলেন।

এমনি সময় রজার্স ছুটে এল ডাক্তারের কাছে। বলল, স্যার, একটা কথা বলার ছিল।

রজার্সের মুখ ফ্যাকাশে। হাত দুটো কাঁপছে থরথর করে। ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, কি হল রজার্স, এত ভয় পাচ্ছ কেন?

রজার্স ডাক্তারকে বসার ঘরে নিয়ে এল। তার চোখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। ঘন ঘন সেঁক গিলছে। কোনরকমে হাত তুলে ইঙ্গিত করে বলল, স্যার, ওই পুতুলগুলো।

ডাক্তার তাকালেন সেদিকে,–হা, কি হয়েছে পুতুলগুলো?

–ওখানে দশটা পুতুল ছিল

–হ্যাঁ, সে তো আমরা সকলেই দেখেছি।

–কাল রাতে খাওয়ার পরে ঘর পরিষ্কার করতে এসে হঠাৎ চোখ পড়তে দেখি–দশটা নয়–নয়টা পুতুল রয়েছে।

–তারপর, কিছু হয়েছে?

–হ্যাঁ, সে তা আমরা সকলেই দেখেছি?

–হ্যাঁ, স্যার। এখন কটা আছে দেখুন–আটটা–

ডাক্তার পুতুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, আটটা–দুজন মারা গেছে, সঙ্গে সঙ্গে দুটো পুতুল কমে গেল–কিন্তু কে সরালো? আমাদের মধ্যে কি কেউ? নাকি সেই অদৃশ্য লোকটা?

.

০৭.

 প্রাতরাশের পর এমিলি আর ভেরা বেড়াতে বেরুলো। তারা সেই টিলাটার ওপরে গিয়ে উঠল।

মৃদু বাতাসে সমুদ্রে ঢেউগুলো চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কোনদিকে একটাও জেলেডিঙি দেখা যাচ্ছে না। মোটরবোটের তো কোনো চিহ্নই নেই।

এমিলি বলল, বোট নিয়ে যদি লোকটা না আসে তাহলে কি হবে বলতো?

ভেরা খেলাধূলা করা মেয়ে। অত সহজে সে ভয় পায় না। তবু এখন সে বলল, এখানে একদম ভালো লাগছে না।

–এখানে কারুরই ভাল লাগবার কথা নয়, ভেরা।

 টিলার ওপরে পাশাপাশি বসে আছে ওরা। দৃষ্টি সামনের সমুদ্রের দিকে। যদি মোটরবোটটা চোখে পড়ে।

ভেরা হঠাৎ বলল, প্রাতঃরাশের সময় যে আপনি বললেন, রজার্স আর তার স্ত্রী সেই বৃদ্ধা ভদ্রমহিলাকে মেরে ফেলেছে, একথা কি আপনি বিশ্বাস করেন?

সমুদ্রের দিকে চোখ রেখেই এমিলি ধীরে ধীরে জবাব দেয়, হ্যাঁ, আমি বিশ্বাস করি। তা না হলে, কথাটা শুনেই রজার্স নার্ভাস হয়ে পড়বে কেন? তার স্ত্রীও অজ্ঞান হয়ে গেল। এ থেকেই ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝা যায়–ওরা এই মহাপাপ করেছে।

ভেরা বলল, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, রজার্সের স্ত্রীর মুখে আতঙ্কের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু অন্যদের সম্পর্কে কি বলবেন আপনি?

–তোমার কি মতামত?

–অভিযোগ তো সকলের নামেই একটা করে শোনা গেল। সকলেই সেটাকে উড়িয়ে : দিচ্ছে। কিন্তু আপনি কেবল রজার্সদের বেলায় বলছেন ওরা মহাপাপ করেছে।

এমিলি বললেন, তুমি কি বলতে চাইছ বুঝতে পেরেছি। কতগুলো অভিযোগ ভিত্তিহীন হলেও কয়েকটি আবার নির্ভুল।

যেমন ধরো, লমবার্ডের ব্যাপারটা। বিপদেই মানুষ মানুষের বন্ধু হয়। তার গায়ের রং কি, কোন দেশের লোক, এসব বিবেচনায় আসে না। অথচ কুড়িটা লোককে বিপন্ন অবস্থায় ফেলে রেখে সে পালিয়ে এসেছিল।

আবার দেখ, মিঃ ওয়ারগ্রেভ, তিনি তাঁর পবিত্র কর্তব্য পালন করেছেন। সেটা অপরাধ হতে যাবে কেন?

ব্লোরের সম্পর্কেও একই কথা খাটে। তিনি এককালে পুলিসের অফিসার ছিলেন। আমার নিজের ব্যাপারও তাই।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে তিনি সংযতকণ্ঠে বললেন, সব কথা পুরুষদের সামনে বলা যায় না। তাই কাল আমি কিছু বলতে চাইনি। তোমাকে আজ বলছি শোন।

ভেরা বিস্মিত হয়ে এমিলির দিকে তাকায়। বলে, বলুন।

–আমার বাড়িতে একটি মেয়ে কাজ করত। তার নাম ছিল বিয়াত্রিচে স্টেলার। কাজকর্ম বেশ ভালোই করত, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কিন্তু সাজপোশাক পরতে খুব ভালবাসতো।

পরে জানতে পেরেছিলাম, মেয়েটির স্বভাবচরিত্র ভালো নয়। বিয়ের আগেই সে একজনকে সব বিলিয়ে দিয়েছিল। ছেলেটি নাকি কোন বড় ঘরের।

ওই কাণ্ড ঘটার পর ছেলেটি মেয়েটিকে এড়িয়ে যেতে চাইলো। পরে বড় ঘরেরই অপর একটি মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায়।

বিয়াত্রিচে ততদিনে মা হতে বসেছে। জানতে পেরে সেই পাপিষ্ঠাকে আর বাড়িতে ঢুকতে দিইনি–দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম।

পাপ কখনো কাউকে রেহাই দেয় না ভেরা। তাকেও দেয়নি। কদিন পরেই সে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।

হতভাগী, নিজের বুড়ো বাবামায়ের কথাও একবার ভাবল না।

ভেরা বলল, মেয়েটিকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন কিংবা তার যে অমন শোচনীয় পরিণতি হল, এসবের জন্য আপনার কোন দুঃখ বা অনুশোচনা হয়নি? কখনো আপনার মনে হয়নি যে মেয়েটির মৃত্যুর জন্য আপনিই দায়ী?

-ওসব কী বলছ? এমিলি স্পষ্ট জবাব দেন, আমার কেন অনুশোচনা বা দুঃখ হতে যাবে? আমি তো কোন অন্যায় করিনি। পাপকে কি ঘরে রেখে পুষবো?

একটু থেমে এমিলি ফের বলতে লাগলেন, সে তার পাপের ফল ভোগ করছে। আমি পাপকে প্রশ্রয় দিতে যাব কেন? এমন শিক্ষা কখনো পাইনি।

ভেরা অদ্ভুত দৃষ্টিতে এমিলির মুখের দিকে তাকায়। তার মনে হয় সেই মুখ বড় নিষ্ঠুর ভয়ঙ্কর।

বারান্দায় বসে আছেন বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ। খানিকটা দূরে নিচু গলায় কথা বলছেন লমবার্ড আর ব্লোর। ডাক্তার বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন।

একবার বৃদ্ধ বিচারপতির দিকে তাকালেন। মনে মনে তিনি কি যাচাই করলেন। ভদ্রলোক অভিজ্ঞ বিচক্ষণ সন্দেহ নেই কিন্তু অশক্ত। তার চাই বলিষ্ঠ কর্মপটু লোক। মনে মনে আরো একবার হিসেব করলেন ডাক্তার। লমবার্ডদের দিকেই তিনি এগিয়ে গেলেন। বললেন, লমবার্ড, তোমার সঙ্গে একটু পরামর্শ ছিল।

–আমার সঙ্গে? অবাক হয়ে তাকায়  লমবার্ড।

–হ্যাঁ, একটু অন্য ব্যাপার

–বলুন কি বলবেন।

পরিস্থিতিটা তোমার জটিল মনে হচ্ছে কি না বলতো?

–খুবই জটিল এবং রহস্যময়।

–রজার্সদের সম্পর্কে ব্লোর যে কথাটা বলল, তোমার সত্যি বলে মনে হয়?

লমবার্ড বলে, আমার তো মনে হয়, ঠিকই বলেছে। ভদ্রমহিলাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়ে থাকতে পারে।

ডাক্তার অন্তরঙ্গ সুরে বললেন, তার চাইতেও সহজে ব্যাপার ঘটতে পারে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে যা বুঝতে পারছি তাই বলেছি তোমাকে–

কিভাবে বলতে চাইছেন আপনি?

–ওই ভদ্রমহিলার হার্টের অসুখ ছিল। অসুস্থ বোধ করলেই এক ধরণের ক্যাপসুল খেতেন। তাই সব সময় ওটা হাতের কাছে রাখতে হত।

লমবার্ড উত্তেজিতভাবে বলল, আপনি কি বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি। ভদ্রমহিলা যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন সেই সময় সেই ক্যাপসুল না দিয়ে ডাক্তার আনতে ছুটেছিল রজার্স, তাই তো?

বলতে বলতে লমবার্ড চুপ করে গেল। একমিনিট কি চিন্তা করল। পরে বলল, এবারে আমার কাছে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল।

–কি ব্যাপার?

–অনেক ঘটনাই আছে যার বিচার আইনের চোখ এড়িয়ে যায়। অপরাধী সাজা পায় না। রজার্সের অপরাধটি যেমন। অবশ্য এ তালিকায় স্বয়ং বিচারপতিও বাদ যাবেন না।

–তুমি বিশ্বাস করো ওকথা?

-হ্যাঁ, করি। ওয়ারগ্রেভ খুন করেছেন এডওয়ার্ড সেটনকে। অথচ তা করেছেন সম্পূর্ণভাবে আইনের আশ্রয় নিয়ে বিচারকের আসনে বসে।

সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের নিজের কথাও মনে পড়ে যায়। অপারেশন টেবিলে হত্যার কথা কারুর জানবার কথা নয়।

লমবার্ড বলে চলে, সেই কারণেই এই পান্না দ্বীপ, আওয়েন এসব কিছু আমাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। আমরা এমন এক জেলখানায় বন্দি, যেখান থেকে পালাবার পথ বন্ধ।

ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে কথাটা ঘুরিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে বলেন, রজার্সের মৃত্যুর ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের একটু তলিয়ে চিন্তা করা দরকার। আমার ধারণা, তার মৃত্যুর পেছনে দুটো কারণ রয়েছে। এক হল, সে গোপন কথা ফাঁস করে দিতে পারে এই আশঙ্কা, দ্বিতীয়, সে নার্ভাস হয়ে আত্মহত্যা করেছে।

–আত্মহত্যা? তা মনে করা যেতে পারে অবশ্য। আবার ওদিকে মার্সটনের ঘটনাও–কিন্তু মাত্র বারো ঘন্টার ব্যবধানে দু-দুটো আত্মহত্যার ঘটনা, কেমন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না? আমি–

-হ্যাঁ, বল, চুপ করলে কেন? ডাক্তার উৎসুক হলেন।

–আমার মনে হয় মার্সটনের মৃত্যু আত্মহত্যা নয়। ডাক্তার চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে সায় দেন, কথাটা অযৌক্তিকও নয়। ওর গ্লাসেই কেবল সায়ানাইড গেল কি করে? আরও তো গ্লাস ছিল–

লমবার্ড হেসে বলল, হয় সে সায়ানাইড নিজে এনেছিল, নয়তো

নয়তো কি? ডাক্তার তাকান লমবার্ডের দিকে।

–বুঝতেই তো পারছেন ভাল করে। তবু আমার মুখে যখন শুনতে চাইছেন বলছি–মার্সটনকে হত্যা করা হয়েছে।

–তাহলে রজার্সের স্ত্রীর ব্যাপারটা কি বলবে, তুমি? ডাক্তার জানতে চান।

কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে  লমবার্ড বলে, আসলে দুটো মৃত্যুর মধ্যে সূক্ষ্ম যোগসূত্র আছে বলে আমার ধারণা।

ডাক্তার বললেন, তোমার কথায়, একটা ব্যাপার আমার মনে পড়ে গেল।

এরপরে তিনি খাওয়ার ঘরের টেবিল থেকে দুটো পুতুল নিখোঁজ হওয়ার কথাটা জানালেন।

শুনে লমবার্ডের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। কিছু সময় কি চিন্তা করল। তারপর বলল, আওয়েন লোকটা বিপজ্জনক। সবই তার কীর্তি। দুটো লোক মারা গেল আর অমনি দুটো পুতুল অদৃশ্য–ওই লোক ছাড়া এ কাণ্ড কে করবে।

ডাক্তার বললেন, কিন্তু রজার্স তো বলল এই দ্বীপে আমরা ছাড়া অন্য কোন লোক নেই।

লমবার্ড বলল, রজার্স হয় মিথ্যে বলছে, নয় সে ভুল করছে।

 ডাক্তার বললেন, ভয় পেয়ে মিথ্যা বলা অসম্ভব নয়।

–এদিকে দেখুন, অন্যদিন মোটরবোট সকালেই আসে, আর আজ তার কোন পাত্তা নেই। সবই আওয়েনের ষড়যন্ত্র। তবে–

ডাক্তারের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল এই কথা শুনে। কোনরকমে বললেন, তবে কি?

–দ্বীপটা ছোট আর জনমানবহীন। আওয়েনকে খুঁজে বার করা কষ্টকর ব্যাপার নয়। তাই করতে হবে আমাদের।

–কিন্তু লোকটা তো একটা খুনে। যদি–

–কোনো যদি নেই। ওটা একটা শেয়াল। একবার আমার সামনে পড়লেই সে বুঝতে পারবে।

এরপর সে বলে, চলুন ডাক্তার, একটা কাজ করা যাক। ব্লোর লোকটি ভালো, তাকে সঙ্গে নিয়ে দ্বীপটা খুঁজে দেখা যাক।

মেয়েদের এসব ব্যাপারে দরকার নেই। জেনারেল আর ওয়ারগ্রেভ তো ভয়েই জড়োসড়ো হয়ে পড়েছে। কাজটা আমরা তিনজনেই করতে পারব।

.

০৮.

 দ্বীপটা তন্নতন্ন করে খুঁজতে হবে। ব্লোর সহজেই রাজি হয়ে গেল। কেবল বলল, এই সময় একটা রিভলভার সঙ্গে থাকলে ভাল হতো।

লমবার্ড প্যান্টের পকেটের ওপর চাপ দিয়ে দেখিয়ে বলল, আমার কাছে একটা আছে।

ডাক্তার ও ব্লোর চমকে উঠে লম্বার্ডের দিকে তাকায়। একটা অশুভ ইঙ্গিত যেন ওরা দেখতে পায়।

ব্লোর বলল, সবসময়েই ওটা সঙ্গে থাকে নাকি?

–হ্যাঁ, অনেক গোলমেলে জায়গাতেই তো যেতে হয়।

ডাক্তার বললেন, ভালই হল। আওয়েনের কাছে কোন অস্ত্র থাকা অসম্ভব নয়। মোকাবিলা করা যাবে।

.

দ্বীপটা ছোট্ট । গাছপালা ঝোপঝাড় নেই বলে এখানে আড়াল-আবডালের কোন ব্যাপার নেই। একদিকে কেবল সেই ছোট্ট টিলা। তাতেও গুহাটুহা কিছু নেই। ওপরটা বেশ চওড়া আর সমতল।

ওদের তিনজনের দলটা দ্বীপটা খুঁজতে লেগে গেল। ঘুরতে ঘুরতে একজায়গায় এসে দেখল, জলের ধারে জেনারেল ডগলাস চুপচাপ বসে আছেন। তার দৃষ্টি দূর আকাশের শূন্যতায়।

সাড়া পেয়েও ডগলাস ওদের দিকে ফিরে তাকালেন না। নিজের চিন্তাতেই তন্ময় হয়ে আছেন।

ব্লোর গলাটা একটু ঝেড়ে আলাপের ভঙ্গিতে বলল, জায়গাটা সত্যি চমৎকার।

ডগলাস ভুরু কুঁচকে তাকায় এবারে। বলে, আমি একটু একলা থাকতে চাই–সময় ফুরিয়ে এসেছে–

ব্লোর লজ্জিতভাবে বলল, আমি আপনাকে বিরক্ত করতে চাই না। একটা লোককে আমরা তিনজন খুঁজে বেড়াচ্ছি। আপনার সঙ্গে দেখা হল বলে জানলাম।

–সময় নেই হে, তোমরা কিছুই বুঝতে পারছ না। ব্লোর আর তাকে ঘাঁটাল না। দলে ফিরে গেল।

বলল, লোকটার কথাবার্তা কেমন গোলমেলে হয়ে গেছে। আমাকে বলল, সময় ফুরিয়ে আসছে, একা থাকতে চায়।

ডাক্তার বিড়বিড় করে বললেন, তাই তো। ওরকম কথা বলছে, একটু ভেবে দেখা দরকার।

.

সারা দ্বীপ ঘুরে ঘুরে কাউকে কোথাও পাওয়া গেল না। কোন লোক লুকিয়ে থাকতে পারে, এমন জায়গাও কোথাও নজরে পড়ল না।

ক্লান্ত হয়ে ডেভনের দিকে তাকিয়েছিল লমবার্ড। বলল, ঝড় আসছে।

ব্লোর জলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, এই পাড়টা অনেকটা উঁচু। আচ্ছা, এখানে আড়ালে কেউ লুকিয়ে নেই তো?

ডাক্তার মাথা নেড়ে বলেন, খাড়া পাড় নিচে নেমে গেছে। এখানে কারোর লুকিয়ে থাকা সম্ভব নয়।

ব্লোর বলল, কিন্তু কোনো গর্ত তো থাকতে পারে।

 লমবার্ড বলে, তবে কিনারের দিকে একটা নোক লুকিয়ে থাকতে পারে এমন জায়গা আছে। একটা দড়ি পেলে আমি নিচে নেমে যেতে পারতাম।

ব্লোর বলল, সন্দেহটা মিটিয়ে নেওয়া ভাল। আমি দেখছি, দড়ি জোগাড় করতে পারি কিনা।

ব্লোর চলে গেল।  লমবার্ড বলল, আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে, অন্ধকার হয়ে আসছে।

ডাক্তার চিন্তিতভাবে বললেন, ভাবছি, ডগলাসের মাথাটা বোধহয় খারাপই হয়ে গেল। মানসিক চাপ সইতে না পেরেই এমনটা হয়েছে।

.

সেই কথাবার্তার পর থেকে ভেরা এমিলিকে এড়িয়ে চলবার চেষ্টা করছে। তাই সকালটা খুব অস্বস্তির মধ্যে কেটেছে তার।

খানিকটা করে দুরত্বে বারান্দায় তিনটে চেয়ারে বসে আছে ওয়ারগ্রেভ, এমিলি আর ভেরা।

ওয়ারগ্রেভের মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। নিজের চেয়ারে বসে একমনে উল বুনে চলেছেন এমিলি।

তার মুখটা করুণাহীন, নিষ্ঠুর মনে হওয়ায় চোখ ফিরিয়ে নিল ভেরা। সে আর বসে থাকতে পারল না। চেয়ার ছেড়ে উঠে ধীরে ধীরে সমুদ্রের দিকে হেঁটে চলল।

.

হঠাৎ চমকে ওঠে ভেরা। জেনারেল ডগলাসের গলা। এমিলি এমিলি বলে কি যেন বলছেন। সে এগিয়ে যায়।

দেখে ডগলাস সমুদ্রের ধারে বসে আছেন। তাকে দেখতে পেয়ে বললেন, ওঃ তুমি এসেছে। আমি ভাবলাম লেসলি।

–লেসলি আপনার কে হয়?

–আমার? একদিন ওই আমার সব ছিল।

–আপনার স্ত্রী নিশ্চয়ই?

–হ্যাঁ। আমাকে ভালবাসতো প্রাণ দিয়ে। তাকে নিয়ে আমি শান্তিতে ছিলাম।

–তারপর?

-তারপর–দ্বিধাহীন কণ্ঠে ডগলাস বললেন, আজ আর তোমাকে লুকিয়ে লাভ নেই ভেরা, সবই স্বীকার করছি, রিচমণ্ডকে আমিই পাঠিয়েছিলাম মৃত্যুর মুখে। তাকে আমি যুদ্ধে পাঠিয়েছিলাম, কাজেই সেদিক থেকে বিচার করলে তার মৃত্যুর কারণ আমিই। কিন্তু–..

কিন্তু কি?

–লেসলি এসব কিছুই জানত না। মনে যন্ত্রণা থাকলেও একদিনের জন্যও তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিনি। কিন্তু তবু লেসলি দিন দিন কেমন শুকিয়ে যেতে লাগল। আমার কাছ থেকে যেন নিজেকে গুটিয়ে নিতে লাগল। তারপর একদিন সেই অবস্থাতেই আমাকে নিঃসঙ্গ করে চলে গেল।

দুজন অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারল না। পরে ডগলাসই প্রথম কথা বললেন, বসে আছি এখন তার অপেক্ষায়–

–কিসের?

–জীবনের শেষ ডাক, ভেরা!

ভেরা অস্থিরভাবে বলে ওঠে, না, না, ওসব কথা আপনি ভাববেন না।

–আমি ঠিকই ভাবছি ভেরা। আমি ভাল করেই বুঝতে পারছি, এই দ্বীপ থেকে কেউই কোনদিন বাইরে যেতে পারব না। এখানেই চিরবিদায় নিতে হবে। ওহো, ভারাক্রান্ত হৃদয়ের বোঝা বড় ভয়ঙ্কর। এর থেকে নিষ্কৃতি চাই। লেসলি-লেসলি

বলতে বলতে ডগলাস আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। ভেরার কেমন ভয় করতে লাগল। সে কোন কথা না বলে পা টিপে টিপে সেখান থেকে সরে এলো।

.

কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্লোর দড়ি নিয়ে ফিরে এলো। এসে দেখে ডাক্তার পাহাড়ের নিচের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছেন। সে জিজ্ঞেস করল, লমবার্ড কোথায়?

–অ্যাঁ, লমবার্ড? আছে এদিকে কোথাও নিশ্চই। আমি অন্য একটা কথা ভাবছিলাম ব্লোর।

–কি কথা?

–আমরা তো আওয়েনকে খুঁজছি, তাই না? কিন্তু ডগলাস লোকটিকে তোমার কেমন মনে হয়?

এমনিতে তো সন্দেহজনক কিছু মনে হয়নি। তবে তিনি যেন কি একটা আন্দাজ করছেন, সেটা জানা দরকার।

এমনি সময়  লমবার্ড এসে গেল। সে দড়িটা পরীক্ষা করে দেখে নিল। তারপর একটা প্রান্ত নিজের কোমরের সঙ্গে বেঁধে নিল।

অন্য প্রান্ত ডাক্তার ও ব্লোরকে দিয়ে বলল, শক্ত করে ধরতে হবে। আমি যাচ্ছি। বলেই সে উঁচু পাড় বেয়ে নিচের দিকে নামতে লাগল।

ব্লোর নিচু গলায় ডাক্তারকে বলল, কিছু মনে করবেন না, আমার কেবলই একটা কথা মনে হচ্ছে–

–আমি লমবার্ডকে একদম বিশ্বাস করতে পারছি না।

–বুঝতে পারছি। কিন্তু মানুষটা একটু অন্যরকম তাই অমন মনে হচ্ছে। খুবই অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ।

-হ্যাঁ, অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়, সেই কারণেই সবসময় সঙ্গে রিভলভার নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

–ওটা একরকমের বাতিক।

–না, না, ডাক্তার। আপনি বা আমি তো এরকম করি না। বাতিক তো কতরকমেরই মানুষের হতে পারে। সব ছেড়েছুঁড়ে এরকম বাতিক হবে কেন? তাছাড়া–

–কি তাছাড়া?

–তাছাড়া, দেখুন, এখানে তো আমরা সকলেই বেড়াতে এসেছি। কিন্তু কেউ তো স্লিপিং, ব্যাগ, ছারপোকা মারার পাউডার, জলের বোতল, ফাস্ট-এড বক্স এসব সঙ্গে করে নিয়ে আসিনি। অথচ আমি দেখেছি এই সমস্ত কিছুই ওর ব্যাগে রয়েছে।

ডাক্তার কোন কথা বলেন না, ব্লোরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

ব্লোর ফের বলে, না, না, ডাক্তার, আমরা ছায়ার পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছি, কেউ কোথাও নেই। যদি থেকে থাকে, আমাদের মধ্যেই রয়েছে।

.

প্রাসাদের মত বাড়িটাও তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখা হল। কিন্তু কাউকে কোথাও পাওয়া গেল না। একতলা দেখা হলে দোতলা দেখা হল।

ছাদের দক্ষিণ দিকে তেতলার ছাদে ওঠার সিঁড়ি। ব্লোর বলল, একবার ওপরটা দেখা দরকার।

ঠিক সেই সময়েই ওপাশের ঘরে থেকে একটা শব্দ পাওয়া গেল। রজার্সের স্ত্রীর মৃতদেহ ওখানে রয়েছে।

শব্দটা লক্ষ্য করে ব্লোর পা টিপে টিপে ঘরটার দিকে এগিয়ে চলল। অন্যরা তাকে অনুসরণ করে চলল।

দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ করে টান মেরে কপাট দুটো হাট করে খুলে ফেলল। সকলে অবাক হয়ে দেখল, কতগুলো জামাকাপড় হাতে করে রজার্স দাঁড়িয়ে আছে।

.

ব্লোর বলল, ওহে রজার্স, কিছু মনে করো না। কি রকম একটা শব্দ হল তাই–

রজার্স বলল, মনে করবার কিছু নেই। আমি আর এঘরে থাকতে পারছি না। তাই দু-চারটে জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছি, ভাবছি ওপাশের ছোট ঘরটায় থাকব।

–ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ, তাই ভালো।

ঘরের ভেতরে খাটের ওপরে রজার্সের স্ত্রীর মৃতদেহ সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা। সেদিকে কেউই তাকিয়ে দেখল না।

ওখান থেকে সরে এসে তিনতলার ছাদটা দেখা হল। জলের ট্যাঙ্কের নিচে, ভেতরে কিছুই বাদ গেল না।

খোঁজার পালা শেষ হলে ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে সকলে একটা সত্য নতুন করে উপলব্ধি করল। দশজনের মধ্যে তারা আটজন জীবিত, দুজন মৃত।

এই কজন ছাড়া আর কোনো লোক বাড়িতে বা দ্বীপের কোথাও নেই।

.

০৯.

 একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল তারা। নীরবতা ভঙ্গ করল  লমবার্ড। বলল, মনে হচ্ছে, আমরা সবাই ভুলই করেছি।

আমরা ছাড়া অন্য লোক এখানে নেই। যে দুটো মৃত্যু এখানে পর পর ঘটল, এগুলোর মধ্যে কোন রহস্য নেই।

ডাক্তার প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, না, একথা আমি মেনে নিতে পারি না। একজন ডাক্তার হিসাবে আত্মহত্যার কেস আমি কিছু কম দেখিনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মার্সটন আত্মহত্যা করার মত মানুষ ছিল না–অসম্ভব।

ব্লোর বলল, ওটা নিশ্চয়ই একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু রজার্সের স্ত্রীর ঘটনাটাকে কিছুতেই দুর্ঘটনা। বলা চলে না।

একটুক্ষণ থেমে পরে পুনরায় বলল, একটা কথা বলব ডাঃ আরমস্ট্রং?

স্বচ্ছন্দে।

–গতকাল রাতে রজার্সের স্ত্রীকে আপনি কিছু খেতে দিয়েছিলেন?

–হ্যাঁ, একটা ঘুমের ওষুধ।

–মাত্রাটা একটু বেশি হয়ে যাওয়া কিন্তু অসম্ভব নয়।

ডাক্তার প্রতিবাদ করে বললেন, একথার কোন অর্থ হয় না। ডাক্তারদের এরকম ভুল হয় না, হলে চলে না।

ব্লোর বলল, কিন্তু গ্রামাফোনের কথাটা আমরা অবিশ্বাস করতে পারছি না। সেখানে আপনার বিরুদ্ধেও অভিযোগ করা হয়েছিল।

শেষ দিকে ব্লোরের কথার সুর এবং চোখের দৃষ্টির কোন পরিবর্তন ঘটেছিল কি?

লমবার্ড সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, এভাবে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করবার কোন মানে হয় না। বিপদ থেকে কি করে উদ্ধার পাওয়া যায় এখন আমাদের সেকথাই ভাবা উচিত। তা না করে তুমি এখন গ্রামাফোনের কথা তুলছ। তালিকায় তো তুমিও বাদ ছিলে না।

–ওসব ডাহা মিথ্যে। আমি গ্রাহ্য করছি না। কিন্তু ওসব বলে তুমি আমাকে চুপ করিয়ে দিতে পারবে না। তোমার সম্পর্কেও আমি জানতে চাই। ব্লোর বলল দৃঢ় স্বরে।

লমবার্ড বলল, আমার কথা বিশ্বাস করা না করা তোমার ব্যাপার। তবু বলছি, এখানে কোনরকম বিপদ হতে পারে এই কথা ভেবেই ওটা সঙ্গে এনেছি। তবে, সকলকে জানাবার জন্য আরো একটু বলা দরকার যে আমার এখানে আসাটা একটু অন্যরকম। অন্য সকলেই এসেছেন নিমন্ত্রণের চিঠি পেয়ে।

মরিস নামে একটা লোক আমাকে বলেছিল, এখানে এলে আমি একটা কাজ পেতে পারি। কাজটা সাহসের। আমি রাজি হয়ে যেতে, সে আমাকে কিছু টাকাও দেয়।

লমবার্ড ব্লোরের দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার সম্পর্কে কিছু বলার আছে?

ব্লোর হেসে বলে, না, নেই।

ডাক্তার জানতে চাইলেন, মরিস তোমায় আর কিছু বলেছিল?

–না, আর কিছু বলেনি। আমিও পীড়াপীড়ি করিনি। আমার টাকার দরকার ছিল, তাই কথা না বাড়িয়ে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।

ব্লোর বলল, গতকাল রাতে তাহলে একথাটা তুমি চেপে গেলে কেন?

–চেপে যেতে চাইনি। এরকম একটা পরিস্থিতির যে উদ্ভব হবে আমি তা ভাবতেই পারিনি।

ডাক্তার জানতে চাইলেন, কিন্তু এখন তুমি নিশ্চয়ই অন্যরকম ভাবছ?

লমবার্ডের মুখভাব কঠিন হয়ে ওঠে। সে বলে, এখন আমার অবস্থা আর সকলেরই মত–কুচক্রী আওয়েনের ফাঁদে পড়েছি।

একটু থেমে সে আবার বলে, দুজন লোক মারা গেল, অমনি দুটো পুতুলও উধাও হল, কেউ দেখতেই পেল না কখন এসব হল। সবই সেই শয়তান আওয়েনের কাজ।

কথা শেষ হবার পরক্ষণেই লাঞ্চের ঘন্টা বেজে উঠল। খাওয়ার ঘরে প্রথম ঢুকল  লমবার্ড। রজার্স অপেক্ষা করে ছিল।

লমবার্ড জিজ্ঞেস করল, রজার্স রান্নাবান্না করতে খুব অসুবিধা হয়েছে?

–না স্যর। তেমন কিছু হয়নি। টিনের খাবার তো প্রচুর ছিল। তাই দিয়েই কাজ চালিয়ে নিয়েছি। নারাকোট তো আর এল না–ব্যাপারটা আমার ভাল ঠেকছে না।

-হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ।

তারপর একে একে সকলেই এসে পৌঁছলেন। আবার টেবিলে বসার পর দেখা গেল জেনারেল তখনো অনুপস্থিত।

রজার্স জানতে চাইল, আপনারা শুরু করবেন না জেনারেলের জন্য অপেক্ষা করবেন?

ভেরা জানাল, তাঁকে তো সমুদ্রতীরে বসে থাকতে দেখে এলাম। কেমন অন্যমনস্ক। মনে হয় ঘন্টার শব্দ শুনতে পাননি।

রজার্স বলল, আমি তাহলে তাকে গিয়ে লাঞ্চের কথাটা জানিয়ে আসি।

 ডাক্তার বললেন, তুমি সকলকে পরিবেশন কর, আমি তাকে নিয়ে আসছি।

সমুদ্রের গর্জন ক্রমশই বেড়ে উঠছিল। বাতাসও প্রবল হচ্ছে সেই সঙ্গে। আসন্ন ঝড়ের ইঙ্গিত।

রজার্স সকলকে পরিবেশন করতে লাগল। মাংস দিতে দিতে সে বলল, কেউ যেন দৌড়ে আসছেন?

সমুদ্রের গর্জনের ভেতরেই পায়ের আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাওয়া গেল।

ডাক্তার হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে এসে ঢুকলেন, জেনারেল—

জেনারেল কি? মারা গেছেন? ভেরা ব্যগ্র হয়ে ওঠে।

–হ্যাঁ।

 চমকে ওঠে সকলে। একে অপরের দিকে তাকাল। কিন্তু কারো মুখে কথা নেই।

সমুদ্রের দাপাদাপি আর বাতাসের হাহাকারের শব্দে ঘর ভরে ওঠে।

.

শেষ পর্যন্ত ঝড় শুরু হয়ে গেল।

সবাই মিলে ধরাধরি করে জেনারেলের দেহটা দোতলায় তুলে নিয়ে গেল।

খাবারের প্লেট কেউ স্পর্শও করেনি। ভেরা দরজায় এসে দাঁড়ায়।

রজার্স সবার আগে নেমে আসে নিচে। ভেরাকে বলে, দেখতে এলাম কটা পুতুল রয়েছে।

 ভেরা তাকিয়ে দেখল। বলল, ওই দেখ সাতটা পুতুল।

–সাতটা!

.

জেনারেলের ঘরেই খাটের ওপরে শুইয়ে দেওয়া হল মৃতদেহ। সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল। ডাক্তার শেষবারের মতো তাকে পরীক্ষা করলেন। তারপর নিচে নেমে এলেন।

ভেরা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। কোলের ওপর উল আর কাটা পড়ে রয়েছে, এমিলি আর বুনছেন না।

ব্লোর হাঁটুর ওপরে কনুই আর মাথায় হাত রেখে বসে আছে।

অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন লমবার্ড। ঘরের এক কোণে বড় আরাম কেদারায় চোখ বুজে বসে রয়েছেন ওয়ারগ্রেভ।

ডাক্তার ঘরে প্রবেশ করতে ওয়ারগ্রেভ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি বুঝলেন ডাক্তার?

গম্ভীর স্বরে ডাক্তার জবাব দিলেন, ভারি কিছু দিয়ে পেছন থেকে মাথায় আঘাত করা হয়েছে। তাতেই মৃত্যু ঘটেছে।

একটা চাপা ফিসফিসানি ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল।

–যে জিনিসটা দিয়ে আঘাত করা হয়েছে সেটা কি আপনি দেখেছেন?

–না। তবে আমি নিঃসন্দেহ।

ওয়ারগ্রেভ এবারে সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এক কঠিন জটিল পরিস্থিতির মধ্যে আমরা পড়ে গেছি। আপনারা আজ যখন ব্যস্ত ছিলেন, আমি বারান্দায় চুপচাপ বসে ছিলাম। আপনারা যে সেই গুপ্তঘাতককে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম।

লমবার্ড বলল, কিন্তু কোথাও কিছু পাওয়া গেল না।

ওয়ারগ্রেভ যেন সভাপতিত্ব করছেন, যেন সকলের নেতৃত্বের ভার নিজের হাতে নিয়েছেন, এমনি ভঙ্গি ও স্বরে বললেন, এখন নিশ্চয়ই আর কারো সন্দেহ নেই যে রজার্সের স্ত্রী এবং মাসটনের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। এখানে আমাদের নিমন্ত্রণ জানানো যে আওয়েনের ষড়যন্ত্র তাও এখন আর অপরিষ্কার নেই।

ব্লোর বলল, ওটা একটা পাগল কিন্তু বিপজ্জনক।

ওয়ারগ্রেভ বললেন, পাগল হোক যাই হোক, তাকে নিয়ে আলোচনা করে আর লাভ নেই। এখন আমাদের উদ্ধারের পথ ভাবা দরকার।

ডাক্তার বললেন, কিন্তু এই দ্বীপে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। আজ তন্নতন্ন করে খুঁজেছি আমরা। ….

ওয়ারগ্রেভ বললেন, নেই যে আজ সকালে আমিও বুঝতে পেরেছি। যাই হোক, আমি চিন্তা করে দেখলাম, আওয়েন কতগুলো লোককে শাস্তি দেবার জন্য আঁটোসাঁটো পরিকল্পনা এঁটেছে। এই লোকগুলোর অপরাধ আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়েছে। তার এই পরিকল্পনা মতই মাসটন, রজার্সের স্ত্রী এবং ডগলাস প্রাণ হারিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে দশটা পুতুলের তিনটে পুতুল উধাও হয়েছে।

এখন কথা হল, পরিকল্পনা কার্যকরী করবার জন্য আওয়েনকে এখানে থাকা প্রয়োজন–এবং সে যে আছে তার প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে।

একটু থেমে তিনি আবার বললেন, একটি উপায়েই তার এখানে থাকা সম্ভব। আমার বিশ্বাস সে আমাদের মধ্যেই একজন।

–না, না-তা হতে পারে না। ভেরার গলা কান্নায় ভিজে এলো।

ওয়ারগ্রেভ ভেরার দিকে তাকিয়ে বললেন, ভেরা, এখন এমন একটা সময়, এড়িয়ে চলা বিপজ্জনক। অদৃশ্য আওয়েন যে আমাদের মধ্যেই একজন তাতে কোন সন্দেহ নেই।

আমরা দশজন ছিলাম, তার মধ্যে এখন রয়েছি সাতজন। এই সাতজনের মধ্যে যে কেউ হতে পারে।

একটু নেমে তিনি ফের বললেন, আশা করি সকলেই একমত হবেন।

ডাক্তার মৃদুস্বরে বললেন, আপনার কথা সত্যি ভাবতে বড় খারাপ লাগছে। তবু মনে হচ্ছে, আপনার ধারণাই ঠিক।

ব্লোর বলল, আমার দ্বিমত নেই। একেবারে খাঁটি কথা বলেছেন বিচারপতি।

দেখা গেল একমাত্র ভেরা ছাড়া সকলেই সহমত পোষণ করছে। ভেরা দৃঢ়স্বরে বলল, আমি ওকথা বিশ্বাস করি না।

ব্লোর বলল, আমার একটা কথা, তাকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছে, লমবার্ডের কাছে একটা রিভলভার আছে, গতকাল কিন্তু একথা সে স্বীকার করেনি। আজ নিজেই বলেছে।

লমবার্ড মৃদু হেসে বলল, আমি আগেই ব্যাপারটা ডাক্তার ও ব্লোরকে বুঝিয়ে বলেছি। তবু মনে হচ্ছে এখন সকলের কাছেই বুঝিয়ে বলা দরকার। বন্ধুবর ব্লোর, ব্যাপারটা নিয়ে খুবই সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠেছেন–এটা দূর হওয়া দরকার।

এরপর  লমবার্ড তার বক্তব্য সকলকে শোনালো।

ব্লোর তবু বলল, এটা যে একটা বানানো গল্প নয়, তার কি প্রমাণ?

বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ বললেন, প্রমাণ আমাদের কারো কাছেই নেই। এক্ষেত্রে পরস্পরকে মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

আমরা এখন চরম সংকটের মুখে। এই অবস্থা আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। তবে একটা কথা সকলের মনে রাখতে হবে যে পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায়, এমন একজনও আমাদের মধ্যে নেই।

এমিলি মেঝের দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন। তিনি এবারে বললেন, কথাটা মিথ্যা নয় যে, আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেককে সন্দেহ করছি। আমাদের মধ্যেই এমন একজন নিশ্চয় আছে, যার কাঁধে শয়তান ভর করেছে।

ওয়ারগ্রেভ বললেন, তাহলে দেখা গেল এ বিষয়ে আমরা সকলেই একমত যে আমরা সবাই পরস্পরকে সন্দেহের চোখে দেখছি।

বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ এবারে বললেন, এবারে একথা ভাবতে হবে, আমাদের পক্ষে কার পক্ষে তিন তিনটে মানুষকে হত্যা করা সম্ভব হতে পারে।

ব্লোর সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, তাহলে ঘটনাগুলো একটু তলিয়ে দেখা যাক। মার্সটনের ব্যাপারটা এখনো সন্দেহের মধ্যে রয়েছে। কি হয়েছিল তা স্পষ্ট নয়।

তবে রজার্সের স্ত্রীর ব্যাপারে দুজনকে সন্দেহ করা যায়। এর মধ্যে একজন স্বয়ং রজার্স অপরজন ডাক্তার আরমস্ট্রং।

ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র প্রতিবাদ জানালেন, আমি একথার আপত্তি জানাচ্ছি।

ওয়ারগ্রেভ বললেন, ডাক্তার আরমস্ট্রং, আপনার আপত্তি থাকা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তথ্যের মুখোমুখি আপনাকে হতেই হবে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে রজার্সের স্ত্রীকে কিছু খাইয়ে দেওয়ার সুযোগ আপনার এবং রজার্সেরই সবচেয়ে বেশি ছিল।

অবশ্য এ ব্যাপারে অন্যদের ভূমিকাও বিচার্য। আমরা কেউই, মান, সম্মান, যশ, প্রতিপত্তি, নির্বিশেষে, সন্দেহের বাইরে নই।

ভেরা বলল, রজার্সের স্ত্রীর ত্রিসীমানার মধ্যে আমি ছিলাম না।

এমিলি ডাক্তারকে বললেন, ডাক্তার, আপনার দেওয়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে রজার্সের স্ত্রী নিশ্চই ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই সময় কেউ ঘরে ঢুকে থাকলে তাকে ঘুমন্ত অবস্থাতেই দেখেছে, তাই না ডাক্তার?

ডাক্তার বললেন, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ এক ওষুধ সবার ক্ষেত্রে একই রকম কাজ দেয় না। পরীক্ষা ছাড়া সঠিক বলা সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, ঘুমের ওষুধ কাজ করেছে অনেকটা সময় নিয়ে।

 লমবার্ড চড়াসুরে বলল, আপনি তো এখন আপনার সুবিধামত কথাই বলবেন।

ডাক্তার কি জবাব দিতে যাচ্ছিলেন, ওয়ারগ্রেভ তাকে বাধা দিয়ে বললেন, এভাবে পরস্পরকে হেনস্তা করে কোন লাভ নেই। আমাদের অন্য পথ ধরতে হবে।

.

এরপর ওয়ারগ্রেভ বললেন, আসুন, জেনারেল ডগলাসের মৃত্যু নিয়ে এবারে আলোচনা করা যাক। আমি অবশ্য এব্যাপারে কিছুই জানি না।

সকাল থেকে বারান্দায়ই বসেছিলাম। আমি সেই সময় সমুদ্রতীরেই গিয়ে থাকতে পারি, আমার ওপরে নজর রাখার মত কেউ ছিল না। তবে আমার এজাহার হিসাবে সকলকে জানাতে চাই, আমি সারাক্ষণ বারান্দায়ই ছিলাম।

ব্লোর বলল, আমি সকালটা ডাক্তার এবং লম্বার্ডের সঙ্গে কাটিয়েছি। তারাই এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবেন বলে আমি আশা করছি।

ডাক্তার বললেন, একথা ঠিকই। তবে একবার তুমি দড়ি আনতে বাড়ি গিয়েছিলে।

–সঙ্গে সঙ্গেই তো দড়ি নিয়ে ফিরে এলাম। খুঁজে নিতে যেটুকু সময় লেগেছিল।

ওয়ারগ্রেভ বললেন, ব্লোর যখন দড়ি আনতে গেল তখন আপনি আর  লমবার্ড কি একসঙ্গেই ছিলেন?

ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ, তবে  লমবার্ড সামান্যক্ষণের জন্য যেন কোথায় গেছিল, আমি ওখানেই ছিলাম।

 লমবার্ড জানাল, হ্যাঁ গিয়েছিলাম দেখতে যে দ্বীপটা থেকে বাইরে খবর পাঠাবার কোন উপায় করা যায় কিনা দেখতে। তবে সে তো দু-এক মিনিটের জন্য।

ডাক্তার বললেন, তা ঠিক, ওইটুকু সময়ের মধ্যে একটা মানুষকে খুন করা যায় না।

ওয়ারগ্রেভ বললেন, ডাক্তার নিশ্চয়ই সেই সময় ঘড়ি দেখেননি?

–না।

এমিলি জানালেন, সবটাই আন্দাজ। এতে সঠিকভাবে কিছু বলা যায় না। এবারে আপনার কথা বলুন।

ওয়ারগ্রেভ বললেন, সকালে ভেরাকে নিয়ে একটু বেড়িয়েছি, তারপর বারান্দাতেই ছিলাম।

বারান্দায়? কিন্তু আমি তো আপনাকে দেখতে পাইনি।

–আমি পুবদিকটায় ছিলাম, বেশ বাতাস আসছিল।

–লাঞ্চ পর্যন্ত আপনি ওখানেই ছিলেন?

-হ্যাঁ।

 –ভেরা, তোমার কথা বল এবারে।

–আমি মিস এমিলিকে নিয়ে এদিক সেদিক খানিক্ষণ ঘুরে বেড়িয়েছি। সে সময় জেনারেলকে দেখেছিলাম। তাকে কেমন অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল।

ওয়ারগ্রেভ জিজ্ঞেস করলেন, অস্বাভাবিক কিরকম?

–তিনি বলেছিলেন, শেষ ডাকের অপেক্ষা করছেন। এই দ্বীপই আমাদের সকলের শেষ শান্তির জায়গা। শুনে আমার কেমন ভয় করছিল।

–এরপর তুমি কি করলে?

বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। লাঞ্চের সময় হয়নি বলে পেছনের বাগানে একটু ঘুরেছিলাম।

ওয়ারগ্রেভ বললেন, রজার্সের সাক্ষ্যই বাকি রইল। তবে তা শুনে খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না।

যথারীতি রজার্সেরও সাক্ষ্য নেওয়া হল। সে জানাল, সে সকাল থেকে রান্নার কাজেই ব্যস্ত ছিল। জেনারেলের ব্যাপারে কিছু জানে না। সবার শেষে বলল, তবে তখন আমি পুতুল আটটাই দেখেছিলাম।

 লমবার্ড বলাল, মিঃ ওয়ারগ্রেভ এবারে আপনার শুনানি বলুন।

ওয়ারগ্রেভ এজলাসে রায় ঘোষণার মত করে বললেন, এতক্ষণ তিনজন মানুষের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে আমরা আলোচনা করলাম।

কিন্তু কারোর ওপর সন্দেহ করা হয়নি। যদিও আমরা কেউই সন্দেহমুক্ত নই। শয়তান আমাদের মধ্যেই রয়েছে।

আমার এটাই পরামর্শ, যেভাবেই হোক উপকূলের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে হবে। তবে অপরাধী এখন থেকে যথেষ্ট সাবধান হয়ে যাবে। কোন রকম ঝুঁকি নেওয়া কারোরই উচিত হবে না।

 লমবার্ড বলল, তাহলে আলোচনা আজকের মত এখানেই শেষ হল।

.

১০.

 নির্জন ঘরে লমবার্ড আর ভেরা কথা বলছে। বাইরে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। শার্সি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

ভেরা এক সময় জিজ্ঞেস করল, বিচারপতি যা বললেন, তা আপনি বিশ্বাস করেন?

–ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।

–আমি বিশ্বাস করি না ওসব কথা।

–সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন অবিশ্বাস্য ঠেকছে। একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মত লাগছে। এর শেষ হলে বাঁচি।

-আমিও সেকথাই ভাবছি।

–তবে সতর্ক আমাদের সকলকেই থাকতে হবে; নইলেই বিপদ।

–ওকথা বললে তো আমাকেও ওদের দলে ফেলা হয়। কিন্তু আমি হত্যাকারী নই।

 লমবার্ড মুগ্ধ দৃষ্টিতে ভেরার দিকে তাকিয়ে বলে, আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি মিস। আপনার সততা সম্পর্কে আমার কোন প্রশ্ন নেই।

–ধন্যবাদ। ভেরা নতমুখে বলল, তবে গ্রামাফোনে আপনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ জানানো হয়েছে, আমার ধারণা, আপনি তা থেকে মুক্ত নন।

লমবার্ড স্মিত হেসে বলল, আপনার অনুমান যথার্থ। দেখুন, আমি বাস্তব মেনে চলা পছন্দ করি। প্রয়োজন হলে কাউকে হত্যা করতেও অরাজি হব না। তবে এরকম হত্যা আমার পক্ষে কখনই সম্ভব নয়।

একটু থেমে লমবার্ড আবার বলল, আমাদের বাকি পাঁচজনের মধ্যে কাকে আপনার সন্দেহ হয়? আমি কিন্তু ওয়ারগ্রেভকে সন্দেহ করি।

–সে কী, কেন?

-বৃদ্ধ জীবনে অনেক কিছু দেখেছে। একদিন বিচারকের আসনে বসে বিচারও করেছে। সেই অভ্যাস এখনো হয়তো ছাড়তে পারেনি। এখন চাইছে স্বয়ং ভগবানের ভূমিকা নিতে।

ভেরা বলল, আশ্চর্য কিছু নয়। তবে আমার দৃষ্টি কিন্তু ডাক্তারের ওপর।

–কেন? ওঁকে আমার কখনোই সন্দেহজনক মনে হয়নি।

-দেখুন, প্রথম দুটো মৃত্যুর কারণ ছিল বিষ। ডাক্তারের পক্ষেই সেই বিষ সংগ্রহ করা সবচেয়ে সহজ। রজার্সের বউকে অবশ্য ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল।

-হ্যাঁ, মিথ্যে বলেননি। তবে জেনারেলের মৃত্যুর ব্যাপারে তাকে আপনি জড়াতে পারবেন না। কেন না উনি সারাক্ষণ আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। আমি অবশ্য একটু সময়ের জন্য অন্যত্র গিয়েছিলাম। ওই সময়ে তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়।

তখন আপনাদের সঙ্গে থাকলেও পরে তো সুযোগ ছিল।

–কি রকম?

লাঞ্চের সময় অনুপস্থিত থাকায় ডাক্তারই তাকে ডাকতে গেছিলেন। আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই।

–হ্যাঁ।

–তারপর দেখুন, মৃতদেহ পরীক্ষা করে তিনি বললেন এক ঘন্টা আগে মারা গেছে। ডাক্তারই এই কাজ করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রতিবাদ করবে কে?

–আপনার কথায় যুক্তি আছে স্বীকার করছি, তবে …

.

–আমাদের মধ্যে একজন অপরাধী, বিচারপতি বলেছেন, তাহলে সেই লোকটি কে? ব্লোরকে জিজ্ঞেস করল রজার্স।

-ওটা অনুমানের কথা।

–হ্যাঁ। নিশ্চিত হবার তো কোন উপায় নেই তবে অপরাধী যেই হোক, যেমন বুদ্ধিমান তেমনি নিষ্ঠুর। পর পর খুনগুলো ঠান্ডা মাথায় করে চলেছে।

-আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। বড্ড ভয়ে ভয়ে থাকতে হচ্ছে।

.

বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছেন। তার দৃষ্টি দূরে। চশমাটা বাঁ হাতে ধরা, নাড়াচাড়া করছেন।

ডাক্তার আরমস্ট্রং সেদিকে তাকিয়ে বললেন, যে ভাবেই হোক আমাদের এখান থেকে চলে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে।

বিচারপতি বললেন, আবহাওয়ার যা অবস্থা দেখছি, তাতে আগামী চব্বিশঘন্টার মধ্যে জলঝড় থামবে বলে মনে হচ্ছে না।

আকাশ পরিষ্কার না হলে, বোটের আসারও সম্ভাবনা নেই।

তার মধ্যে হয়তো আমরাও শেষ হয়ে যাব।

বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ জানালার কাছ থেকে সরে এসে বললেন, তা যাতে হতে না হয়, তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে।

ডাক্তার এবারে অন্তরঙ্গ সুরে বললেন, আচ্ছা, কার দ্বারা এসব কাজ সম্ভব হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

–আদালতে যেমন কিছু প্রমাণ করবার জন্য তথ্যের প্রয়োজন হয়, এক্ষেত্রেও তাই। এখনো তেমন কিছু সংগ্রহ করতে পারিনি। তবে এটা বুঝতে পারছি সব ঘটনার মূলে একজন রয়েছে।

ডাক্তার খানিকটা অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না।

এমিলির মন অশান্ত হয়ে আছে। তিনি একটা বাইবেল পড়বার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু মন বসাতে পারছিলেন না।

শেষে বাইবেল রেখে ড্রয়ার খুলে ডায়েরিটা বার করে আনলেন।

 কলম তুলে নিয়ে ডায়েরীর পাতায় লিখতে শুরু করলেন–

জেনারেল ডগলাস মারা গেলেন। তাকেও হত্যা করা হয়েছে। এ নিয়ে আজ লাঞ্চের পরে বিচারপতি চমৎকার বক্তৃতা দেন। তার ধারণা আমাদের মধ্যেই কেউ আত্মগোপন করে রয়েছে, যে একের পর এক এমন কাণ্ড করে চলেছে। আমি আগেই বলেছিলাম, কোন একজনের কাঁধে শয়তান ভর করেছে…

ঘুমে চোখ বুজে আসছিল। এই পর্যন্ত লিখে এমিলি টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়লেন।

 একটু পরেই তন্দ্রা কেটে যায়। হাতে ধরা কলম তুলে আবার তিনি লিখতে শুরু করেন–

প্রত্যেকেই জানতে চাইছেন, কার পক্ষে এসব কাজ করা সম্ভবপর। কিন্তু সঠিক উত্তর কারোরই জানা নেই। কিন্তু আমি জানি, একজনের ওপরে ভর করেছে বিয়াত্রিচে টেলার।

হঠাৎ তার খেয়াল হল। লেখার শেষ অংশটুকু পড়ে তিনি ভাবেন, এসব কি লিখেছি? ও নাম কেন লিখলাম? সঙ্গে সঙ্গে শেষের লাইন দুটো কেটে দিলেন ভালভাবে যাতে পড়তে পারা না যায়।

.

জোরালো হাওয়ার গর্জন ক্রমশ বেড়ে উঠছে। সঙ্গে সমুদ্রের ফোসানি। সকলেই ঘরের মধ্যে রয়েছে। শার্সিগুলো বন্ধ। ঘর জুড়ে মেঘলা দিনের আবছা অন্ধকার।

কেউ কোন কথা বলছেন না। মন সকলেরই বিক্ষিপ্ত যেন প্রত্যেকেই এক একজন আসামী।

রজার্স চায়ের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। ভেরা এমিলির দিকে তাকিয়ে বলল, চা টা আপনিই তৈরি করবেন।

এমিলি বললেন, আমার মন মেজাজ ভাল নেই, তুমিই কর।

ভেরা চা তৈরি করে পরিবেশন করল। ঘরের গুমোট ভাবটা খানিক হাল্কা হল।

একটু পরেই রজার্স ফের ঘরে ঢোকে। সে জানাল, ওপরের একটা স্নানের ঘরের পর্দা কে। খুলে নিয়েছে।

–কি রকম পর্দা ছিল? ব্লোর জানতে চায়।

 –লাল সিল্কের।

–ও নিয়ে কেউ আর মানুষ খুন করতে পারবে না। যেতে দাও।

এমিলি বললেন, আমারও দুটো উলের গোলা খুঁজে পাচ্ছি না।

ভেরা বলল, কোথাও পড়ে গেছে হয়তো।

–তাই হবে।

রজার্স চলে গেল। সকলেই যার যার মত চা পান করতে লাগলেন। সকলের মনেই সন্দেহের মেঘ জমাট বাঁধতে শুরু করেছে।

.

সবে ডিনার শেষ হয়েছে। রাত তখন নটা। সকলকেই শুতে যেতে হবে।

 প্রথমে উঠে দাঁড়াল এমিলি এবং ভেরা।

বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ বললেন, শুভরাত্রি জানাবার আগে সকলকেই আর একবার মনে করিয়ে দিচ্ছি, শুতে যাবার আগে দরজা ভাল করে বন্ধ করে দেবেন। সাবধানতা অবলম্বন করতে ভুলবেন না। কাল আবার সকলে এখানে মিলিত হব।

চারজন পরপর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। দরজা বন্ধ করবার শব্দও পাওয়া গেল।

রজার্সকে একাই সব কাজ করতে হচ্ছে তখন। সে খাওয়ার ঘর পরিষ্কার করে। তারপর আলো নিবিয়ে ঘরে চাবি দিয়ে দেয়।

রজার্স তার নতুন ঘরে চলে আসে। দরজা বন্ধ করে ঘরটা একবার ভাল করে দেখে নেয়। আলমারি, খাটের তলা, কোন কিছু দেখতে বাকি রাখে না।

রজার্স শুয়ে পড়বার আগে ভাবল, আজ রাতে নিশ্চয় পুতুল কম হবে না। সংখ্যাটা একই থাকবে।