কাম টেল মী হাউ ইউ লিভ
জীবনের দোলাচলে
গল্প শুরুর আগে—এই বই হল সমস্ত প্রশ্নের উত্তর। কোন্ প্রশ্ন? যা আমাকে প্রায়শই করা হয়—সিরিয়াতে তুমি কী করেছ? সেখানে কেমন ভাবে দিন কেটেছে তোমার?
তাঁবুর মধ্যে?
বেশির ভাগ মানুষের এ সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা নেই। কথায় কথায় আমি তা জানতে পেরেছি। কিন্তু দু’জন মানুষ এব্যাপারে সত্যি সত্যি আগ্রহী। তাদের কেউ একজন হয়তো প্রত্নতাত্ত্বিক, সে জানতে চেয়েছে আমার অতীত দিন যাপনের গল্পকথা
আমি কীভাবে উত্তর দেব? কীভাবে বলব, আমার সেই ভ্রমণজাত দিনগুলির কাহিনী? হয়তো কোনো এক রাজকীয় প্রসাদে, কোনো মন্দিরে, অথবা অভিজাতদের সমাজের ক্ষেত্রে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার এই ভ্রমণের কথা কোনো সংবাদ পত্রের শিরোনাম হয়নি। দেখানো হয়নি কোনো পর্দায়। তবে তা রয়ে গেছে আমার অন্তরের অন্তঃপুরে। আমি খননকাজে ব্যস্ত ছিলাম। অতীত ইতিহাস ধীরে ধীরে চোখ মেলছে। সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। এর পাশাপাশি আমি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাত্রার দিকে সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে দেখেছি। ওই যে লোকটি চাষ করছে, ওই যে লোকটি তাঁর বুনছে, ওই যে লোকটি চামড়ার ব্যবসা করছে, ওদের প্রত্যেকের নিজস্ব এক গল্পকথা আছে। সত্যি কথা বলতে কী, একজন কসাই, একজন পাউরুটি প্রস্তুতকারক, মোমবাতি তৈরি করা গৃহবধূ—সবাই কিছু একটা বলতে চায়।
তবে জানিয়ে রাখি হয়তো এই বইটি পড়লে আপনি সর্বাংশে খুশি হতে পারবেন না। এখানে খুব বেশি কথা বলার অবকাশ নেই। মোটামুটি আমি আমার সিরিয়া ভ্রমণের দিনগুলির কথা বলতে চেয়েছি। সেখানে কী ঘটে গেছে, কী ঘটতে পারত, কী ঘটেনি—সবকিছু…..
।। এক।।
শরত সকালে অথবা শীতের মধ্য দিনে দাঁড়িয়ে গরমের পোশাক কেনার ব্যাপারটা সত্যি বিরক্তিকর। গতবছরের গরমের পোশাকগুলি এখনও কী ভালো আছে? জানি না, সবকিছু দেখতে হবে। বাছতে হবে। তারপর—
প্রস্তুতি এগিয়ে চলেছে পুরোদমে। যে কোনো মুহূর্তে শেষ সঙ্কেত চলে আসবে। আমি তাকিয়ে আছি স্যুটকেসগুলোর দিকে। কী নেই? সিল্ক, নাকি সুতি?
একটির পর একটি দোকানে চলছে আমার অভিযান। বিপণীর চকচকে সুন্দরী মেয়েরা সব কিছু খুলে খুলে দেখাচ্ছে। লিনেন দেওয়া ট্রাউজার, স্কার্টের মতো কিছু একটা। যে মেয়েটি প্লে স্যুট আমার সামনে বের করে দিল, সে কি জানে, আমি সেটা পরতে কতখানি ভালো বাসি?
এটা একটা বিরাট দোকান, নানা ধরনের পোশাকে ঠাসা। মেয়েটি একগাল হেসে বলল- ম্যাডাম, এই পোশাকটা আপনাকে খুবই মানাবে।
আমি তার কথার কোনো উত্তর দিলাম না। সব বিভাগীয় বিপণিতে গরম পোশাকের ঠাসা সম্ভার আছে। সেখানে গেলে মনে হয় আমি বুঝি অচেনা অজানা এক জগতে চলে এসেছি। সবকিছু মনের মতো করে কিনতে হবে। যা পরলে মানাবে আমাকে, গরমের সাথে লড়াই করতে পারব!
মেয়েটি এক গাল হেসে বলল—ম্যাডাম, এগুলি পরুন, সূর্যের আলো থেকে আপনাকে রক্ষা করবে।
—ঠিক বলেছ। কিন্তু মাথায় টুপি পরে আমি চলতে পারবো না।
—ম্যাডাম, আমরা কি ইলাস্টিক টুপির ব্যবস্থা করব?
–না, আমার মাথার ওপর একেবারে বসে যাবে।
—নিশ্চয়ই ম্যাডাম, এটা বোধহয় আপনাকে ভালো মানাবে।
এইভাবে চলতে থাকে আমাদের বিকিকিনির আসর। ধীরে ধীরে ব্যাগ আরও ভরতি হতে থাকে। রিস্টওয়াচ কেনা হয়। গরম দেশে কী ধরনের ঘড়ি পরতে হবে, কে জানে? এ সম্পর্কে আমার সামান্যতম অভিজ্ঞতা নেই। গল্পে পড়েছি, আরবের রূপকথা, তারপর……
প্যাকিং শুরু হয়ে গেল। সেও এক বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা। এত বেশি জিনিস নিতে হবে। অথচ বেশি বোঝা নেওয়া যাবে না। এই সমস্যার সমাধান হবে কী করে?
যদি কখনো কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক দলের অভিযাত্রী হয়ে থাকেন, তাহলে বুঝতে পারবেন, এই ব্যাপারে কতটা ঝামেলা ঝঞ্ঝাট আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে। কারণ, অনেক কিছু নিতে হবে, গবেষণার কাজে, তার পাশাপাশি নিজস্ব জিনিস নেবার অবকাশ কোথায়?
সময়ের কাঁটা এগিয়ে চলেছে। আমরা ভিক্টোরিয়ার দিকে এগিয়ে গেলাম। ইংল্যান্ডের বাইরে যে জগত আছে, সেখানেই এবার আমাদের যাত্রা শুরু হবে। হে ভিক্টোরিয়া, তোমাকে আমি সত্যি ভালা বাসি। তোমার বুকে একটির পর একটি ট্রেনের যাতায়াত। কত রকম ট্রেন আছে, কারোর ইঞ্জিনে হিসহিসে শব্দ, মনে হয় সে যেন মেঘ সমুদ্রে সাঁতার কাটছে। হয়তো বলতে চাইছে, আমাকে এখনই যেতে হবে, আমাকে এখনই….
আমাদের পুলম্যানের দরজা খুলে গেল। বিদায় সম্ভাষণ জানাতে দাঁড়িয়ে আছে বন্ধুদের দল। কিছু বাজে কথাবার্তা। ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি। শেষ কটি শব্দ বেরিয়ে এল আমার ঠোঁট থেকে—পোষ্য কুকুরগুলোর ব্যবস্থা কী করে করতে হবে, শিশুদের দেখাশোনা, চিঠিপত্র পাঠিয়ে দেওয়া, নিয়মিত বই পাঠানো, কত কিছু ভুলে গেছি, নাঃ, এটা পড়ে আছে পিয়ানোর ওপর, এটা আছে বাথরুমের শেলফে, সংসার থেকে বেরোনো কি চাট্টিখানি কথা!
ম্যাকস ব্যস্ত ছিল তার আত্মীয়দের নিয়ে। আমার নিজস্ব পরিজনরা ঘিরে ছিল আমাকে।
আমার বোন বলল—তার মধ্যে এমন একটু অনুভূতি হচ্ছে যে ভাষার প্রকাশ করতে পারবে না। মনে হচ্ছে, সে বুঝি আর কখনো আমাকে দেখতে পাবে না। তার কথা শুনে আমি মোটেই আশ্চর্য হইনি। আমি যখনই প্রাচ্য দেশে বেড়াতে যাই, তখন একথাই বলে সে। আমার আমি ফিরে আসি, রোজালিনকে দুঃখ দিয়ে কী লাভ? এভাবে যদি সে কথা বলে বলুক না। আমার চোদ্দো বছরের মেয়েটি অ্যাটটিকসের ব্যথায় ভুগছে। এখনই তাকে অপারেট করানো হবে না। আমার বোন এ ব্যাপারে অভিজ্ঞা। কত জটিল অপারেশন একা হাতে করেছে।
ম্যাকস আর আমি নীরবে চোখের বিনিময়ে ভাষা বদল করলাম। আমার প্রিয় শাশুড়ি দাঁড়িয়ে আছেন আর আমাকে নানা ধরনের উপদেশ দিচ্ছেন।
কিছু কথা বাকি থেকে গেল। কিছু কি সত্যি বাকি ছিল? আমার সেক্রেটারি এগিয়ে এল। বলল—গুড বাই। আবার দেখা হবে।
পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড। শরীরে শীতল শিহরণ। তারপর ভিক্টোরিয়া স্টেশন চোখের আড়ালে চলে গেল। আমি চোখ বন্ধ করলাম, এখন মধ্য আফ্রিকার ধু ধু মরু প্রান্তরের ছবি ভেসে উঠছে চারপাশে।
এখন আমরা কোথায় যাব? সোজা গোহার। সেখান থেকে ভ্যালোন ড্যামেক্স। চুপচাপ বসে থাকা। যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি ম্যাকসের সাথে টুকরো টুকরো কথা বলছি।
কত বছর আগে আমরা রিভেয়ারাতে গিয়েছিলাম, অথবা প্যারিসে, ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের যাত্রিনী হয়ে। আবার সেই ওরিয়েন্ট? এই ট্রেনে না উঠলে বোঝা যাবে না, অভিজ্ঞতাটা কেমন হতে পারে। মনে হবে তুমি বুঝি আকাশের মধ্যে দিয়ে ভেসে চলেছ। এমনই দ্রুতগামী এই ট্রেনটি। হুইসেলের শব্দ শোনা গেল। আমরা কমপার্টমেন্টে উঠে বসলাম।
প্রথম অ্যালেক্স, সেখান থেকে বেইরুট, দেখা হল আমাদের বন্ধুর সাথে, সেখান থেকে হাবু, তারপর আর একটি স্টেশন। আমরা বোধহয় নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে পৌঁছে গেছি।
॥ দুই ॥
বেইরুট! কেমনভাবে বর্ণনা করব তার সৌন্দর্যকে—নীল সমুদ্র, আঁকাবাঁকা সৈকত, দিগন্ত রেখার সাথে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে নীল পর্বতমালা। হোটেলের টেরেস থেকে এমনিটিই দেখতে লাগে এই শহরকে। আমি আমার বেডরুমে বসে চারপাশে তাকাই। নানা ফুলের রঙিন এক বাগান চোখে পড়ে। ঘরটা চমৎকার। তবে দেখলে মনে হয়, বুঝি এক বন্ধ কারাগার। জানলা দরজা বেশি কিছু নেই। ওয়াস মেশিনটা আধুনিক। নতুন কল বসানো।
এই বোধ হয় প্রাচ্যের রহস্য। যেখানে যাই, সেখানে গেলে কেমন একটা ভালোবাসার জন্ম হয়। এই আমি, প্রতীচ্য দেশের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও প্রাচ্যকে ভালোবেসে ফেলেছি।
ম্যাক আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের নতুন স্থপতি ম্যাকস, সেও এসে গেছে। কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা তিনমাসের অভিযান শুরু করতে চলেছি। আমাদের সঙ্গে এক বন্ধুও জুটে গেছে। সবাই মিলে শুরু হবে এই অভিযান।
ম্যাক আমাকে শান্ত ভাবে অভ্যর্থনা জানাল। সকালে প্রাতরাশ শুরু হবে।
মনটা কোনো এক কারণে বিষণ্ন হয়ে আছে। কেন জানি না। চারপাশের পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।
ম্যাক অত্যন্ত লাজুক। কম কথা বলে। মাঝে মধ্যে ভুরু তুলে তাকায়। মনে হয়ে সে যেন কিছু জানতে চাইছে।
আমাদের কথাবার্তা এগিয়ে চলেছে। লাঞ্চ শেষ হল, এবার কিছু ব্যবসায়িক আলোচনা। এসব ব্যাপারে আমার মোটেই মন দিতে ইচ্ছে করে না। আমি মানসিক স্থৈর্য বজায় রাখার চেষ্টা করলাম। নিজের মনকে প্রশ্ন করলাম, এখানে এসে আমি কি ঠিক করেছি? নাকি এই অভিযানে যোগ দেওয়া উচিত হয়নি আমার। এতদিন কি এই আফ্রিকাতে থাকতে পারব? কিছু দিন বাদে যদি মন কেমন করে তাহলে?
স্থানীয় ভাষা-দু-একটা শিখতে হবে। কাছের সাহায্যে তা শিখব? না হলে মনের কথা জানাব কী করে?
পুরোদমে প্রস্তুতি এগিয়ে চলেছে। কত কিছু কিনতে হচ্ছে। একটা ভালো সোফেয়ারের সন্ধান করা হল। একজন পাঠক। সরকারি তরফে কিছু কথাবার্তা। যোগাযোগ হল মি. সিরিগের সঙ্গে। তিনি হলেন প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের ডাইরেক্টার। ওনার বউ ছটফটে তরুণি। সব সময় কথা বলতে ভালোবাসে।
এই দেশের সরকার আমাদের নানা ভাবে সাহায্য করছে। তাই মনের ভেতর উষ্মা পুষে রাখা উচিত নয়। যতদিন এগিয়ে যাচ্ছে, মনের ভেতর একটা চাপা উত্তেজনা। শেষ পর্যন্ত সবকিছু হবে তো?
এটা হল বেইরুট শহরে আমাদের শেষ সন্ধ্যা। আমরা ডগরিভার পর্যন্ত ড্রাইভ করে গেলাম। না হলে হল গালেফ। এখানে ভারি সুন্দর একটা ক্যাফে আছে। এখানে বসে তুমি মনের আনন্দে কফি পান করতে পারো। ছায়াচ্ছন্ন পথে হাঁটতে পারো একা একা। গাছের সাথে মেতে উঠতে পারো অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায়।
তবে আমার মনে হয় নীহার এলকেলেবের আসল রহস্য লুকিয়ে আছে সেই পাহাড়টার মধ্যে। যা ইতিহাসের অনেক স্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লেবাননের কথা মনে পড়ে? এখানেই তো এক সময় ইজিপ্টের মহামান্য সম্রাটদের আগমন বার্তা ধ্বনিত হয়ে ছিল। লেখা হয়েছিল হাইরোগ্রাফিক লিপিতে কত না কথামালা। দ্বিতীয় রামোসিসের কথা মনে পড়ে গেল। আসিরিয়ান এবং ব্যাবিলিয়ন সৈন্যবাহিনীর কথা। এখানে প্রথম টিগাফাইজারের ছবি আছে। ৭০১ খ্রি. পূর্বাব্দ—কত বছর হয়ে গেল? আলেকজান্ডারের কথাও মনে পড়ে যায়। এসারটন আলো নেবুকারনেজার এই অঞ্চল এতগুলি ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের পদধূলি পেয়েছে। আর এখন, কত বছর কেটে গেল, আমি এখানে এসেছি, ইতিহাসের এক নতুন সংযোজক হিসাবে।
ম্যাক তখনও পর্যন্ত তার ভদ্রতা বজায় রেখেছে। মাঝে মাঝে শান্ত শিষ্ট কণ্ঠস্বরে প্রশ্ন করছে। আমাদের দল তৈরি হয়ে গেছে। ম্যাকস্, হামুন্ডি, আমি, জ্যাক, আবদুল্লা, অ্যারিসটাইল এবং ঈশা—আগামী তিনমাস আমরা এক পরিবার হয়ে কাজ করব।
প্রথমেই আমরা বুঝতে পারলাম, আবদুল্লা ড্রাইভার হিসাবে মোটেই ভালো নয়। তারপর? নাকচ করতে হল আমাদের পাচক মহাশয়কে। একটু বাদেই বোঝা গেল অ্যারিসটাইপ একজন ভালো ড্রাইভার, কিন্তু তার ট্যাক্সিটা খুবই বাজে।
আমরা উপকূলের পাশের রাস্তা দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করে চলেছি। নীহার এলকেলেবের সাথে আর হয়তো কখনো দেখা হবে না। সমুদ্র দূর থেকে আরও দূরে চলে গেল। এবার সত্যি এক বিপদসঙ্কুল পথে যাত্রা শুরু করতে হবে।
এলাম হোমসের এক সুন্দর হোটেলে। হামুন্ডি এই হোটেলের কথা আগে থেকেই বলেছে। এই হোটেলের মধ্যে একটা আশ্চর্য গন্ধ আছে, গন্ধ মধ্য যুগের কথা ঘোষণা করে।
গতকাল আমরা এখানে সেখানে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘুরে বেড়িয়েছি। মনে হয়েছে আমরা যেন সভ্য জগত থেকে অনেক দূরের বাসিন্দা হয়ে গিয়েছি। আধুনিক জীবনযাত্রার উপকরণ মুঠোবন্দী করতে পারব না। কিন্তু এই জীবনের মধ্যে একটা আশ্চর্য বন্য মাদকতা লুকিয়ে আছে। ভীষণ—ভীষণ গরম পড়েছে। সূর্যের তাপ আগুন আঁচে জ্বলছে। ভাবতে পারবেন না এত গরম।
কোনো কোনো জিনিস মনে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে। এতদিন এখানকার খাদ্যাভ্যাস হজম করতে পারব তো? দামাস্কাস আর বাগদাদের মধ্যে এই বিশাল মরুভূমি। সেখানে গেলে কী হবে? গায়ে ফোসকা পড়বে। সত্যিই তাই। দগ্ধ দহন ভরা মধ্য দিন, একা একা নিজের সঙ্গে কথা বলি।
প্যালমাইরা—উষ্ণবালুকের মাঝে একটুকরো আশীর্বাদ। অসাধারণ, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। স্বপ্নের মধ্যে হাতছানি।
আমি প্যালমাইরাকে কখনো ভুলতে পারব না। হয়তো আর কখনো এখানে আসব না। কিন্তু যখন এসেছি তখন এর সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ করতেই হবে আমায়।
ম্যাকস সবসময় আমার পাশাপাশি থাকছে। বলছে—শোনো, তুমি যেখানে যাবে, গন্ধ নেবার চেষ্টা করবে। গন্ধের মধ্যেই বিপদ লুকিয়ে থাকে।
আমি জানি না, ম্যাকস কোন বিপদের আশঙ্কা করছে।
প্রথমেই আমি জলের দিকে তাকালাম। জলের রং কেমন হলুদ হয়ে গেছে। ম্যাকস নাকের কাছে নিল, শুঁকে বলল—না, জলটা এখনো ভালো আছে।
আমি হেসে উঠলাম। ও কি জ্যোতিষচর্চা করে নাকি? গন্ধ শুঁকে সব কিছু বিচার করা যায় নাকি?
এভাবেই দিন এগিয়ে চলেছে। আমরা আরও ভেতরে প্রবেশ করব। সত্যিকারের অ্যাডভেঞ্চার যেখানেই শুরু হবে।
আজ আমরা ইউফেট্রিস নদীর ধারে ভেরএজ-এর প্রাচীন শহরে এসে গেলাম। নাঃ, এই শহরের গন্ধটা মোটেই উত্তেজক নয়। ম্যাক যেমনটি বলেছিল আমায়।
নিজের এই উদ্ভাবনী ক্ষমতায় নিজেই হেসে উঠি আমি। ম্যাকসের মতো আমিও কি শেষ পর্যন্ত গন্ধ বিশারদ হয়ে উঠলাম নাকি? বন্ধু-বান্ধবীরা একথা শুনলে হো হো করে হেসে উঠবে। আমরা যথেষ্ট পরিমাণ শাকসবজি কিনলাম। অনেকগুলো ডিম। কে জানে, হয়তো এর ওপরেই দিন কাটাতে হবে।
বসেরা—পুলিশ পোস্ট পার হয়ে গেলাম। ইউফ্রেটিসের সাথে হাতুল নদীর সঙ্গম। মস্ত বড়ো রোমান স্থাপত্যের চিহ্ন আছে।
বসেরাকে দেখেও খুব একটা ভালো বলে মনে হল না আমার। অথচ বসেরা একদিন ইতিহাসের অনেক ঘটনার সাক্ষ্য দিয়েছিল। হামুন্ডি সব কথা বলার চেষ্টা করচে। অদম্য উৎসাহ আছে তার।
রোমান সভ্যতার কথা মনে পড়ে গেল। কতবছর আগে শুরু হয়েছিল তাদের জয়যাত্রা। হাইটাইটিসের সৌভাগ্যের কথাও মনের ভেতর উঁকি দিল আমার। মিটানিদের সেই সামরিক বংশপরম্পরা। একটির পর একটি দেশের ঝাঁপিয়ে পড়া। না, এব্যাপারে আমার জ্ঞান খুব একটা বেশি নয়। শেষ অব্দি আমরা এই রাজ্যের রাজধানী শহরে পৌঁছে গেলাম। এখনও সেখানে যুদ্ধের চিহ্ন আঁকা আছে। আমরা ইজিপ্টিয় সভ্যতার ধারে কাছে পৌঁছে গিয়েছি?
আমার কেবলই মনে হচ্ছে মানুষ বোধহয় ইতিহাসের দাস। নাঃ, বসেরা আমাকে মোটেই আকর্ষণ করতে পারেনি। আরও এগিয়ে চলেছি দক্ষিণের দিকে। ম্যাকস চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি মেলে দিয়েছে। হাবুল নদীর তীরে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমরা দুজন।
এখানেই আমি হাবুলকে প্রথম দেখলাম, না, নদীটা খারাপ নয়। হাবুলের ভেতর কত গল্প আছে, আছে কত ইতিহাস। ম্যাকস সব কথা বর্ণনা করতে চায়। ভাবতে অবাক লাগে, এত গল্প ও জানল কোথা থেকে?
ম্যাকস উপকথা লোককথাও বলে যাচ্ছে।
প্যালেস্টাইনের গল্প, ইহুদিদের উত্থান ও পতনের ইতিহাস। তুর্কিদের অভ্যুত্থান…ইতিহাস এগিয়ে চলেছে তার আপন যাত্রাপথে
মায়াডিন—ক্যাম্পজীবনের সূত্রপাত। নক্ষত্রখচিত আকাশের নীচে সারা রাত জেগে বসে থাকা। না, আমি কি কখনো টেন্টের মধ্যে ঘুমোতে পারব? আমার মাথার ভেতর একটা অদ্ভুত চিন্তা এল—আমি যদি ঘুমিয়ে পড়ি তাহলে ওই ভয়ঙ্কর ইঁদুররা আমাকে ছিঁড়ে খাবে।
ম্যাকসের কাছে আমার দুশ্চিন্তার কথা বললাম। হো হো করে সে হেসে উঠল। বলল—বান্ধবী, এত চিন্তা করছ কেন? ঘুমিয়ে পড়ো, দেখবে ঘুম তোমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
ম্যাকসের কথা মতো ঘুমোবার চেষ্টা করলাম। কী আশ্চর্য, ঘুম ভাঙল পরের দিন সকাল পাঁচটায় এবং আমি তখনও অক্ষত অবস্থায় বসে আছি। তার মানে ইঁদুরের উৎপাত একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়।
আজ আমরা তেল-আজজাতে এসে পড়েছি। শহরটা মোটামুটি খারাপ নয়। ছোট ছোট বসতি গড়ে উঠেছে চারপাশে। এখান থেকেই অভিযানের আসল যাত্রাপথের শুরু হবে। মাটির তলা খুঁড়ে দেখতে হবে। ইতিহাস কী লুকিয়ে রেখেছে আমাদের জন্য।
।। তিন।।
এসে গেল শরত সকাল, মেঘমালা কানে কানে শোনাল ভালোবাসার গল্পকথা। কিন্তু এখন কি উৎসব করার সময়?
ম্যাকস প্রচণ্ড খাটাখাটনি করছে। তাকে এই অবস্থায় দেখে আমি একেবারে অবাক হয়ে গিয়েছি। যে ম্যাকসকে আমি চিনতাম, যার সাথে আমার নিত্য দেখাশোনা, সে কি এই ম্যাকস? নিজেকে সে অনেকখানি পালটে ফেলেছে। পরিবেশ আর পরিস্থিতি বোধ হয় এভাবেই মানুষকে পালটে দেয়। এখন তার চোখে মুখে জেগেছে এক অদ্ভুত কাঠিন্য। মাঝে মধ্যে অহগকার দুটি হাত মুঠোবদ্ধ করছে সে। আকাশের দিকে দু’হাত তুলে চিৎকার করে কী যেন বলতে চাইছে।
ম্যাকস দারুণ পড়াশোনা করেছে। আরব দেশের ইতিহাস কণ্ঠস্থ হয়ে গেছে তার। ভারি ভালো লাগে ম্যাকসকে এই কারণে, সত্যি, যখন যে কাজটা করে, একশো ভাগ ঝাঁপিয়ে পড়ে তার মধ্যে।
দুটো একটা শব্দ জেনে নিয়েছি আমি, কথা বলতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না। আবহাওয়ায় পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। বাতাস বইছে, খুব একটা খারাপ নয়। তবে ধুলোর ঝড় যখন ওঠে, মনে হয় আমি বুঝি অন্ধকারের যাত্রা পথে একলা এই যাত্রিনী।
কাজ শুরু হয়ে গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা মাঝে মধ্যে ভিড় করে। জীবন হয়ে উঠেছে কর্মব্যস্ত। প্রতি মুহূর্তে কিছু একটা ঘটবে এমনই সম্ভাবনা। সারাদিন ধরে হাবুল নদীর তীরে বসে থাকি। রাতে ক্লান্ত শরীর এবং মন নিয়ে ফিরে আমি হোটেলে। কখনো বা টেন্টে বসে থাকতে হয়। তাকিয়ে থাকি নদীর উচ্ছ্বসিত জলধারার দিকে। সারা পৃথিবী সব নদী কি একই গল্পকথা শোনাতে চায়?
সত্যি, আরও পালটে গেল বাতাবরণ। ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। এমন বৃষ্টিতে ভিজতে ভারি ইচ্ছে হল আমার। ম্যাকসের কাছে মনোবাসনা খুলে বললাম। হো হো করে হেসে উঠল। না, এখন এসব ছেলেমানুষি উন্মাদনা লুকিয়ে রাখতে হবে আমাকে। ম্যাকস এখন সত্যি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তার অভিযানে। আহা বেচারী, কত বড়ো একটা দায়িত্ব তার মাথায় চাপানো আছে? সে কি এসব উল্লাসে মেতে উঠতে পারে?
আজ আমরা আমুগাতে এসে পৌঁছে গিয়েছি। এক মার্কিন পাদরি সাহেবের সঙ্গে দেখা হল। টাক্সিটা রাখা হয়েছে তাঁর বাড়ির উঠোনে। তিনি ভারি অতিথি বৎসল। আমাদের সাদর সম্বর্ধনা জানালেন। এখানকার জীবন যাত্রার টুকরো টুকরো ছবি এঁকে দিলেন। খারাপ লাগছে না এই শহরটা। প্রথম দেখাতেই কোনো কোনো শহরকে আমরা ভালোবেসে ফেলি। এই শহরটা হয়তো সেই তালিকভুক্ত হতে পারে।
খারাপ দিনগুলো কেটে গেল। আবহাওয়া আবার ঝলমলে হয়ে উঠেছে। আমাদের কাজ ভালোভাবেই এগিয়ে চলেছে। মাঝে মধ্যে বিপদ সংকতে ভাসছে বাতাসে। কিন্তু ম্যাকস তাকে অতিক্রম করে যেতে পারছে।
ধীরে ধীরে আমি এই কাজের গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করছি। সত্যিই তো, এভাবে মৃত ইতিহাস জীবন্ত না হলে মানুষ তার পূর্বপুরুষদের কথা জানবে কী করে?
স্থানীয় কিছু মানুষের সাথে ভাব জমেছে আমার। আমি তাদের আপ্রাণ বোঝাবার চেষ্টা করি সব কিছু। –আমার ইংরাজিতে। তারা অবাক বিস্ময়ে হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
তখন একটা অসহায় আর্তনাদ বেরিয়ে আসে বুকের শূন্য খাঁচা থেকে। আমি ভাবি, হায়, আমি ওই নিজে যদি একটু শিখতে পারতাম, তাহলে কত সহজে মনের বাসনা খুলে বলতে পারতাম সকলের কাছে—
ম্যাকস আমার ছেলেমানুষি খেলার দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে ওঠে। আমাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে বিলে—ডার্লিং, তুমি কি লন্ডন শহরে আছো নাকি? এসব ছেলেমানুষি ভাবনা মন থেকে দূরে সরিয়ে দাও। না হলে তুমি শক্ত সমর্থ কঠিন হবে কী করে? আমার যোগ্য সাঙ্গিনী !
ম্যাকসের কথার মধ্যে সারবত্তা লুকিয়ে আছে আমি বুঝতে পারি।
এসে গেল ঠাণ্ডা শীতার্ত সকাল–আমরা তখন ডেলহামদানে বসে আছি। দারুণ শীত পড়েছে। প্রকৃতির জগতে পরিবর্তন ঘটে গেছে। ম্যাকস আর আমি মাঝে মাঝে কফিশপে গিয়ে বসি। পাশাপাশি চেয়ার নিয়ে। অনেক কথাবার্তা হয়। ইদানিং আমি প্রত্নতত্ত্ববিষয়ে এক মাস্টারনি হয়ে গিয়েছি।
কখনো কখনো মলে গিয়ে কিছু জিনিসপত্র কিনে আনি। পাচক অর্থাৎ রাঁধুনিটা মাঝে মধ্যেই বদমাইসি করে। আমার ভারি সাধ জাগে নিজের হাতে রান্না করতে। ম্যাকস কি অনুমতি দেবে না? এই ভাবেই জীবন এগিয়ে চলেছে আপন ছন্দে। আয় আয় করে ডাকছে—ইজিপ্টের সভ্যতা। এবার বোধহয় মিশরের সাথে মোলাকাত হবে আমাদের।
।। চার।।
বসন্তকালে বেইরুটে ফিরে এলাম। ম্যাকস আগের মতোই আছে। হাসি মাখা মুখ। আতিয়েতায় ভরা।
বেইরুট থেকে আমাদের যাত্রা অ্যালেপের দিকে। আবার সেই দোকানে গিয়ে জিনিসপত্র কেনা। এসে গেল নির্দিষ্ট দিন। আমুডার দিকে চলে যেতে হবে। হামুন্ডি আর ম্যাকস, তার সঙ্গে ম্যারি থাকবে, ম্যারিকে অনেকে নীলম্যারি বলে থাকে, ম্যারি কে? সে আমাদের নতুন সঙ্গিনী—ম্যাকস আর আমি ট্রেন ধরে চলে যাব। তারপর এক জায়গায় সকলে মিলিত হব।
এভাবেই যাত্রাপথ রচিত হয়েছে। কিন্তু সব কিছু পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে চলল না। মাঝে মধ্যে বাধা বিপত্তি দেখা দিচ্ছে। কোথায় যেন ছন্দ পতন ঘটে গেছে।
কিছুদিনের মধ্যে আমরা আসল ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারলাম।
যে বাড়িটা আমার ভাড়া নিয়েছিলাম, ছেড়ে দিতে হবে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, হামুন্ডি আর ম্যাক এ বিষয়ে আলোচনা করছে। সাতটি মার্কিন পরিবার এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে। এখনও সমস্যা সমাধানের সূত্র আবিষ্কৃত হয়নি। ম্যাকস এবং আমার জন্য দুটি আলাদা তাঁবুর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া সর্বত্র বিরাজ করছে বিশৃঙ্খলা।
হামুন্ডি অবশ্য বারবার আমাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছে। তার ঠোটে অপ্রতিরোধ্য হাসির টুকরো লেপে আছে।
মার্কিন পরিবারের সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের কিছু ঝামেলা বেঁধে গেছে। এর কারণ কী, আমি ঠিক জানি না। দেখলাম স্ত্রীলোকরা, বাচ্চারা, এমনকি মুরগিরা এবং কুকুররাও কান্নার মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। চারপাশে চিৎকার, বিশৃঙ্খল আবহাওয়া, অভিশাপের মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছে। কেউ হো হো করে হাসছে। কেউ কুকুরের মতো চিৎকার করছে। এমন এক অবস্থার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলতে হবে আমাদের।
তারই মধ্যে মাথা ঠিক রেখেছে ম্যাকস। তার পৌরুষ দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। এজন্যই তাকে আমার এতখানি ভালো লাগে।
ডিনারের সময় হয়ে গেল। বিশৃঙ্খল অবস্থাটা অনেকটা শান্ত হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। আমিও মানিয়ে নেবার চেষ্টা করছি। কাজ তো করতেই হবে। তবুও দেশের কথা মনে পড়ে যায়।
বাড়িটা বেশ গুছিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন আর কোথাও আরশোলার চিহ্ন চোখে পড়ে না। ডাইনিং রুমটা সাজিয়ে নিয়েছি। খাবারগুলো ঠিক জায়গায় রাখা হয়েছে। আমি যেখানেই যাই, এভাবে যত্নের পরশ দেবার চেষ্টা করি।
জীবন আবার তার গতানুগতিক ছন্দে ফিরে এসেছে। ম্যাকস সকালবেলা আমাদের ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেল। ম্যাকসের কথা খুবই মনে পড়ছে আমার। হাসিখুশি মানুষ ছিল সে। পুরোদমে কাজ শুরু হবে। অনেক কাজ এখনও বাকি থেকে গেছে। মাটি খুঁড়তে হবে, অতীত ইতিহাসের গল্পকথা শোনাতে হবে পৃথিবীর মানুষকে। এ কী কম সহজ কথা !
আমি আর একটি কাজে নিজেকে মগ্ন রেখেছি। তা হল স্থানীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করা ব্যাপারটা খুব একটা সহজ নয়। তবু চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?
স্থানীয় মেয়েদের সাথে আলাপ হচ্ছে। কুর্দিশ মেয়েরা খুব খারাপ নয়। আমার মতো এক শ্বেতাঙ্গিনীকে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করেই এগিয়ে আসছে। গল্পকথা জমে আছে তাদের বুকের মধ্যে, দু-একজন ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে সবকিছু বলার চেষ্টা করছে। আমি তাদের সঙ্গে বেশ মিশে গিয়েছি এখন। নিত্য নতুন মানুষদের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে। দু-একটা কথা বলতে পারছি অনায়াসে। স্থানীয় ভাষাটা খুব একটা খারাপ নয়।
ম্যাকস আপন মনে তার কাজে ব্যস্ত আছে। আগামী পরিকল্পনার খুঁটি নাকি বিষয়গুলির দিকে চোখ বোলাচ্ছে। আমার কেবলই মনে হচ্ছে এখন তাকে সাহায্য করা উচিত। কিন্তু আমি তা করব কেমন করে?
বেশ বুঝতে পারছি, আগামী দিনগুলো আরও কর্মমুখর হয়ে উঠবে। তার জন্য মানসিক এবং শারীরিক প্রস্তুতি দরকার। যে কোনো কাজ সুন্দরভাবে সম্পাদন করতে হলে মনকে তৈরি করতে হয়। মন শান্ত না-হলে কোনো কাজই করা যায় না।
দিন এগিয়ে চলেছে, এবার বোধহয় বিরক্তির বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে চারপাশে।
।। পাঁচ।।
কী আর লিখব? লিখতে লিখতে ভালো লাগে না। ইংল্যান্ডের কথা মনে পড়ে যায়। ইউরোপীয় আবহাওয়া। কর্তাব্যক্তিরা দেখা করতে আসেন ম্যাকসের সাথে। ম্যাকস শান্ত ভাষায় তাদের সঙ্গে কথা বলে। ম্যাকস আবার ফিরে এসেছে। ফিরে এসেছে তার প্রিয় ঘোড়াটিকে সঙ্গে নিয়ে ঘোড়ার সাথে খেলা করতে সে বিশেষ ভালোবাসে।
আমরা এখন মুখোমুখি ডিনার টেবিলে বসে থাকি। বাতাস তপ্ত হয়ে উঠছে। নতুন নতুন ফুল ফুটেছে। যদি আমি উদ্ভিদ বিজ্ঞানী হতাম, তাহলে হয়তো তাদের নাম জানতে পারতাম। কিন্তু নাম দিয়ে কী হবে? ফুল গন্ধ বিতরণ করছে, সৌগন্ধে আমাদের মনে জাগছে মৌতাতিমেজাজ। এটাই তো যথেষ্ট।
নতুন করে বাড়িটা তৈরি করা হচ্ছে। কাঠের আচ্ছাদন দেওয়া হয়েছে। প্লাস্টার করা হয়েছে। বেশ ভালোই লাগছে। এই বাড়িটা তৈরি করার অন্তরালে ম্যাকসের মস্তিষ্ক কাজ করেছে। ম্যাকসের মধ্যে একটা সৃজনশীল প্রতিভা লুকিয়ে আছে। মাঝে মধ্যে তার বিচ্ছুরণ ঘটে যায়।
গরম আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। যেসব শ্রমিকরা কাজ করছে তাদের মাথাও গরম হয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে ম্যাকসের সঙ্গে তাদের ঝগড়া ঝাঁটি লেগে যায়। ম্যাকস এমনিতে শান্ত স্বভাবের। কিন্তু রেগে গেলে তার মাথার ঠিক থাকে না। একদিন এক শ্রমিকের সঙ্গে হাতাহাতি হবার উপক্রম। আমি সেখানে গিয়ে ঝগড়া থামিয়ে দিলাম।
সেখানে আমরা কাজ করতে এসেছি, সেখানে কি মাথা গরম করলে চলে?
স্থানীয় ইয়েজিদি শ্রমিক এসে নানা বিষয়ে অভিযোগ করতে শুরু করল। জলের অভাবে সে কাজ করতে পারছে না। পান করার মতো যথেষ্ট জলের দরকার, না হলে সে তার বন্ধুদের নিয়ে এখনই এখান থেকে চলে যাবে।
এই কথা শুনে আমরা অবাক হয়ে গেলাম। আমি জানতে চাইলাম—এই জল তুমি খাও না কেন?
—আমি এ জল কখনোই খাব না। জলটা কূপ থেকে নেওয়া হয়। কূপের মধ্যে সকালবেলা শেখের ছোট ছেলে একটা লেটুস পাতা ফেলে দিয়েছে।
ইয়েজিদিরা কখনোই লেটুস খায় না—এটা তাদের ধর্মে বারণ করা আছে। এমনকি লেটুস পাতার সংস্পর্শে থাকা কোনো জিনিস তারা স্পর্শ করতে পর্যন্ত পারে না।
ম্যাকস বলল—আচ্ছা, তোমাকে আমি একটা কথা বলি। আজ সকালে আমি শেখের ছেলেকে কমিচিলিতে দেখেছি, দু-দিন ধরে সে সেখানে আছে। কেউ মনে হয় একথা বলে তোমার মন বিষিয়ে দেবার চেষ্টা করছে।
একে একে নির্মাণ কর্মীরা জড়ো হল। ইয়েজিদি শ্রমিকদের বোঝাবে কে?
ঝামেলা বেঁধে গেছে। এ হল এক নেহাত ধার্মিক ঝামেলা। এখানে আমার যোগ দেওয়া উচিত নয়।
ইয়েজিদিরা এক আশ্চর্য স্বভাবের মানুষ। তারা শয়তানকে পুজো করে থাকে। শয়তানকেই তারা ঈশ্বর ভেবে থাকে। তারা ভাবে শয়তান বোধহয় প্রকৃতির প্রতিমূর্তি।
শেখ আদি নামে এক পবিত্র বেদী আছে মসুরে। কুর্দিশ পাহাড়ের কাছে। আমরা এটা দেখতে গিয়েছিলাম। তখন সেখানে খননের কাজ শুরু হয়ে গেছে। জায়গাটা ভারি চমৎকার। নৈশব্দ্যের চাদর মোড়া। পাহাড় থেকে ছুটে আসা বাতাস তোমার মন ভরিয়ে দেবে। ফুলের গন্ধ পাওয়া যাবে। তিরতিরে একটা ঝরনা আপন মনে এগিয়ে চলেছে। এত সুন্দর পবিত্র একটা জায়গা, আমি পৃথিবীতে আর কোথাও দেখিনি কখনো। কাছাকাছি মানুষ জনের বসতি নেই নেই বলেই বোধ হয় জায়গাটা এখনও তার কুমারীত্ব বজায় রাখতে পেরেছে।
তুমি ওই বেদীর পাশে এসে বসো। বিরাজ করছে স্তব্ধতা। গাছ আছে, ছোট ছোট বেদী, ছুটন্ত জল—আর কী চাও? এখানে এলে ঈশ্বরের সান্নিধ্য উপভোগ করা যায়। আর দেখবে মস্ত বড়ো একটা কালো সাপ শুয়ে আছে। এই সাপটা অত্যন্ত পবিত্র। ইয়েজিদিরা বিশ্বাস করে নোয়ার নৌকাতে এই সাপটা উঠে পড়েছিল।
আমরা জুতো খুলে মন্দিরে প্রবেশ করলাম। একটির পর একটি সিঁড়ি পার হয়ে। মনে হয় এখানে বোধহয় অনেক দিন কোনো মানুষের পদচিহ্ন আঁকা হয়নি।
ভেতরটা অন্ধকার এবং ঠাণ্ডা। জলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তার মানে ওই পবিত্র ঝরনাধারা? যা নাকি মক্কার সঙ্গে সংযুক্ত। এই মন্দিরের ভেতর ময়ূরের মূর্তি নিয়ে আসা হয়। এই ময়ূরকে শয়তানের প্রতিভু বলে মনে করা হয়। অনেকে বলে থাকে, ময়ূরের নামের সাথে একটা নিষিদ্ধ করা লুকিয়ে আছে। এ কী অৰ্দ্ধবশ্বাম? সকালের সন্তান, নাকি সে হল ইয়েজিদি ধর্ম বিশ্বাস অনুসারে ময়ূর ছদ্মবেশে এক পবিত্র দেবদূত?
আমরা মাঝে মধ্যে সেখানে পৌঁছে যাই। সেখানকার শান্ত নীরবতা আমার মনকে আকর্ষণ করে। বেদীর চারপাশে সমাহিত আছে সৌন্দর্য। আছে শান্তি। এই শান্তি তুমি কোথায় পাবে? শেখ আদি হল এমন একটা জায়গা, যা আমার স্মৃতিকে চিরদিন আচ্ছন্ন করে রাখবে। আমি সেখানকার নিরবচ্ছিন্ন শান্তি এবং সন্তুষ্টির কথা কখনো ভুলতে পারব না।
মীর হল ইয়েজিদিদের প্রধান। সে একদিন ইয়াটে এসে আমাদের সঙ্গে কথা বলেছিল। দীর্ঘ দেহী মানুষ, বয়স হয়েছে, অভিজ্ঞতার ভারে আক্রান্ত। কিন্তু মুখমণ্ডলে বিষণ্ণতার ছাপ। সে হল এখানকার পোপের মতো। তবে মীর কিন্তু তার প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেনি। তার কাছে—সকলেই নতজানু হয়। সে সকলকে জ্ঞান ও আশীর্বাদ বিতরণ করে।
আজ আমাদের ছুটির দিন, এই সারাদিন আমরা কী করব? আমার ইচ্ছে আছে, আশেপাশে লোকালয়গুলি ঘুরে বেড়ানো। ইতি মধ্যে স্থানীয় মুসলমান নেতারা একটা অদ্ভুত দাবি পেশ করেছে। তারা বলেছে, যেহেতু এই খননকারীদের মধ্যে বেশিরভাগই মুসলমান, এই শুক্রবার ছুটি দিতে হবে। আমেরিকানরা এই প্রস্তাবে রাজী হয়নি। তারা রোববার কাজ করতে চায় না। কারণ রোববার খ্রিষ্টীয় ধর্ম মতানুসারে ছুটির দিন।
এই নিয়ে এক অনভিপ্রেত ঝগড়া বেধে গেল। আমরা শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম যে, মঙ্গলবার ছুটি দেওয়া হবে। মঙ্গলবার হল এই স্থানীয় ধর্মাবলম্বীদের বিনোদনের দিন।
শেষ অব্দি সকলে এই প্রস্তাব মানতে বাধ্য হল।
বাড়িটা তৈরি হয়ে গেছে। ভারি সুন্দর দেখতে হয়েছে এটি। এখানেই এখন বেশ কিছুদিন থাকতে হবে আমায় ব্যাপারটা ভাবতে গেলে সারা শরীরে শিহরণ জাগছে।
।। ছয়।।
অবশেষে আমরা খননেন শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি। ম্যাকস প্যালেস্টাইনে একবার এক খননকারীদের দলে যুক্ত ছিল। এখন এখানে এসে আমাদের সঙ্গে সে যোগ দিয়েছে। এবিষয়ে তার অভিজ্ঞতা অসাধারণ।
আমি শান্ত মনে সব কিছুর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি। স্থানীয় লোকদের সাথে ভালোহীন আলাপ হয়ে গেছে আমার। তারা এক বিদেশিনীকে সাহায্য করতে উদগ্রীব। আমি বেশ বুঝছি পারছি। অশিক্ষিত হলে কী হবে, তাদের মনের ভেতর লুকিয়ে আছে এমন সম্পদ যাকে হীরের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
সকালবেলা সূর্যের আলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। সূর্য এসে জানলা পথে আমার ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। তারপর? তারপর আর কী? ধীরে ধীরে দিকচক্রবাল রেখার কাছে চলে আসে সে। ধু ধু রুক্ষ্ম প্রান্তরের ওপর ছড়িয়ে পড়ে তার মুঠো মুঠো লজ্জা। সেই লজ্জা গায়ে মেখে আমি এক লাজবতী হয়ে যাই।
এখন অবশ্য এত আবেশের ব্যাপার নিয়ে ভাববার মতো সময় নেই। অতি দ্রুত এগিয়ে চলেছি। ম্যাকস এখন আর আমার সঙ্গে কথাই বলে না। বুঝতে পারি সে পরিকল্পনা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত। বেশিদিনতো আমরা এইভাবে খননের কাজে লিপ্ত থাকতে পারব না। এই কাজটা শেষ করতে অজস্র অর্থের প্রয়োজন। সরকারি অনুদান আছে। বেসরকারি সংগঠন এগিয়ে এসেছে, কিন্তু এই দলের নেতা হিসাবে ম্যাককে সব কাজ সুচারুভাবে করতে হবে। না হলে তার সুনাম হানি হবে।
আমি যথাসাধ্য তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি। কিন্তু এই ব্যাপারে আমি কতটুকুই বা বুঝি? মাঝে মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে ভুল হয়ে যাচ্ছে আমার। ম্যাকস কিন্তু কখনোই আমার ওপর রাগ করে না। কারণ এটাই তার চরিত্রের সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য।
***
পথ গেছে অ্যালেপের দিকে। ম্যাকস সেখানে যেতে চাইছে। আমিও তার সঙ্গিনী হলাম সেই যাত্রায়।
পথ চলতে চলতে দুজনের মধ্যে অনেক কথা হল। আমরা শেষ পর্যন্ত অ্যালেপে পৌঁছে গেলাম। স্থানীয় লোকজনদের সাথে নিজেকে ম্যাকস মিশিয়ে নিয়েছে। এই ব্যাপারে তার জুড়ি মেলা ভার। যখন যেখানে যায়, সেখানকার স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলে। এতে কাজের অনেক সুবিধা হয়।
চলতি পথে এক পাদরির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আমার। পাদরি ভদ্রলোক সোৎসাহে বললেন—তোমার স্বামী তো ভালো আরবি ভাষা বলতে পারে।
আমি আমতা আমতা করলাম। আমি বললাম—না, ও আমার স্বামী নয়।
পাদরি ভদ্রলোক অবাক হয়ে গেলেন। তিনি আমার দিকে তাকালেন। উনি বললেন– সে কী, তোমরা বিবাহিতা স্বামী-স্ত্রী নও?
আমি মুখ নীচ করলাম।
মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বলল—না, আমি এব্যাপারে ছেড়ে দিয়েছি।
হঠাৎ দেখি পাদরি সাহেবের মুখমণ্ডল রক্তিম হয়ে উঠেছে।
একটু বাদে আমরা দুজনেই হেসে উঠলাম।
পাদরি সাহেব বললেন—ও, তোমরা বুঝি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছো?
গাড়িটা হোটেলের সামনে এসে থেমে গেল। আমরা নেমে এলাম।
উনি বললেন—ভগবান তোমাদের দুজনকে আশীর্বাদ করুন। তোমরা সুখে-শান্তিতে জীবনের বাকি দিনগুলোকে অতিবাহিত করো।
।। সাত।।
রাজার বাজারের দিনগুলো শুরু হয়ে গেছে। ম্যাকস ইতিমধ্যে আমাকে বলেছে, কোনো কোনো শিখ তার আভিজাত্য নিয়ে মশগুল। তারা নিজস্ব জগতের মধ্যে বাস করতে ভালোবাসে। বিশাল পৃথিবীর বাসিন্দা হতে চায় না।
এটাই বোধহয় তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তারা থাকুক তাদের জীবনধারা নিয়ে, এতে আমরা কী বা করার আছে।
মানসুর নামে ছেলেটি যথেষ্ট চটপটে। কাজকর্মে অনন্ত উৎসাহ আছে তার। সব সময় আমাদের সাহায্য করার জন্য উদগ্রীব।
প্রত্যেকটা দিন একটা। নতুন বার্তা বহন করে আনে। আমি জানি না আজকের দিনটার কপালে কী লেখা আছে। কত রকমের আলোচনা হয়। কর্মপন্থা নিয়ে। আমাদের খননকাজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। সরকারি সাহায্য। স্থানীয় মানুষদের বন্ধুত্ব অথবা অসহযোগিতা।
সকাল থেকে এলোমেলো বাতাস বইতে শুরু করেছে। দুপুরবেলা তা ঝড়ে পরিণত হল। এমন ঝড়, যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। এক হাত দূরের জিনিসকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। মনে হল পৃথিবী বুঝি রাগে উত্তাল হয়ে উঠেছে।
আমরা কোনোরকমে মাথা গুঁজে পড়ে আছি। নির্মাণ কর্মীদের মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাথা গরম করছে। আমাদের ছুতোর লোকটা বদমেজাজী। সে কারো সাথে মানিয়ে চলতে চাইছে না।
ম্যাকস সকলের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। সকলকে শান্ত করার আপ্রাণ প্রয়াস। তা সত্ত্বেও কেউই তার কথা শুনছে না।
এমনটি হতে থাকলে শেষ পর্যন্ত কী হবে? এইসব শ্রমিকদের মধ্যে এক ধরনের আশ্চর্য অহমিকা কাজ করে। যে যার সাম্রাজ্যের সম্রাট হয়ে বেঁচে থাকতে ভালোবাসে। মিলেমিশে কাজ করতে চায় না।
তাহলে? ঝড় বন্ধ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। শেষ অব্দি ঝড়টা থেমে গেল। সব কিছু ঠাণ্ডা হয়ে গেল। আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনস্রোতে ফিরে এলাম।
এখানে এসে জীবনের ছোট খাট দিকগুলি সম্পর্কে অনেক খবর জানতে পারছি আমি। আমি বুঝতে পারছি কী ভাবে মানুষকে নিরন্তর সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। স্থানীয় মানুষ জনের সকলেই যে শত্রুভাবাপন্ন, এমনটি মনে করার কোনো সঙ্গত কারণ নেই। অনেকে আমাদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বিদেশী জানা সত্ত্বেও ভালোবাসছে। এটাই বোধহয় মানুষের সবথেকে বড় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
কত নতুন মানুষদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। তাদের অনেকে এখানে বছরের পর বছর ধরে আছে। কেউ এসেছে ভাগ্য অন্বেষণে। কেউবা নতুন কোনো অভিযানের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে। কেউ নেহাত কৌতূহলে। কেউ আবার পর্যটক। কেউ বা ব্যবসায়ী। প্রতি ইঞ্চিতে সোনার সন্ধান করছে। কেউ ধর্মপ্রচারক। স্থানীয় মানুষদের কাছে যিশুখ্রিস্টের মহানবাণী পৌঁছে দিতে চাইছে।
এভাবেই জীবনটা পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কত রকম মানুষের আনাগোনা।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি মাঝে মধ্যে অশান্ত হয়ে ওঠে। বিবদমান বিভিন্ন গোষ্ঠী পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়ায় মেতে ওঠে। তখন এক অদ্ভুত অবস্থার সৃষ্টি হয়। তারপর সব কিছু ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করছি, এরা যত সহজে রেগে যায়, আবার ততটাই সহজে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এদের মধ্যে শাহুরিক সভ্যতা নেই বলে বোধহয় এরা এত সহজে মনের আবেগ পরিবর্তন করতে পারে।
স্থানীয় শেখের সঙ্গে আলাপ হয়েছে আমাদের। তার হারেমে একাধিক পত্নী ও উপপত্নীর বসবাস। দেখছি সকলের মুখই ওড়না ঢাকা। যারা গ্রামীণ মহিলা তারা কিন্তু মুখ খোলা রেখেই ঘুরে বেড়ায়।
কর্নেলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। কর্নেল লোকটা মন্দ নয়। তবে শেখা বেশ উদার মনের মানুষ। ম্যাকসের সঙ্গে দেখা হলে সে মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত গর-গর শব্দ করে। মনে হয়, সে বোধহয় এভাবেই আমাদের অভিবাদন জানাচ্ছে।
আমরা ছোট্ট সেটার হাউসের দিকে পৌঁছে গেলাম। দরজাটা খুলে দেওয়া হল। ম্যাকস ও শেখ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তারা সবাই ওই শেখের পত্নী? ভাবতে অবাক লাগে। কিন্তু তাদের সকলেরই স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে।
পর্দার আড়ালে কী লুকিয়ে আছে? একজন মুখের ওড়না খুলে ফেলল। তাকে দেখে আমি চমকে গেলাম। এত রূপ এই হারেমের মধ্যে? আমি ভেবে দেখলাম, তাঁর অতীত জীবন কেমন ছিল। সে কি এক হয়ে দিদি পরিবার থেকে এসেছে? যে শেখের প্রধানপত্নী, তার বেশ বয়স হয়েছে। তাকে দেখে মনে হল। সে বোধহয় মধ্য চল্লিশে পৌঁছে গেছে। কিন্তু তার আসল বয়স কত? সব মেয়েরাই নানা ধরনের গয়না পরে বসে আছে। তাদের দেখতে কুরদিশ বলেই মনে হচ্ছে।
মধ্য বয়সিনী এক মহিলা তার চোখ তুলল। চোখ বড় বড় করে তাকাল। তার মুখমণ্ডলে অদ্ভুত বিবর্ণতা খেলা করছে। সে অসুস্থ, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। তাকে এখনই অন্য কোথাও নিয়ে যেতে হবে। তার রক্ত বিষিয়ে গেছে।
আমি কিছু বলার চেষ্টা করলাম। আমি ম্যাকসের কাছে আমার আশঙ্কার কথা ভুলে বললাম। এখনই অ্যালেপের হাসপাতালে মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়া দরকার। বিষ কাজ করছে তার শরীরে। এমনটি চলতে থাকলে সে হয়তো মরে যাবে। তাকে এখনও চিকিৎসা করতে হবে।
ম্যাকস এই আশঙ্কার কথা শেখকে বলল। শেখ নির্বিকার।
ম্যাকস বলল—শেখ তোমার বুদ্ধিমত্তায় খুশি হয়েছে। বাগদাদের এক ডাক্তার এই কথা বলেছে। বলা হয়েছে মেয়েটিকে এখনই ইনজেকশন করা দরকার। তুমিও এই কথা বলছ। সে বোধহয় ব্যাপারটা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করবে। সে তার বউকে অ্যালেপে নিয়ে যাবে।
আমি ভাবলাম, শেষ পর্যন্ত শেখের যদি মনোভাবের পরিবর্তন হয়, তাহলে অসহায় মেয়েটি বেঁচে যাবে।
গরমকাল পড়ে গেল। এখনও শেষ নির্বিকার। লোকটা কি নিষ্ঠুর স্বভাবের? আমি ভেবে অবাক হয়ে গেলাম। শেখ হয়তো চাইছে না, ওই মেয়েটি বেঁচে থাকুক
হারেমবাসীনীদের সাথে আমার বেশ আলাপ হয়ে গেছে। তারা অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে তাকে। আমার পোশাক পরিচ্ছদ দেখে অবাক হয়ে যায়। সত্যিই তো, আমি তাদের মতো পোশাক পরি না। আমার অলঙ্কার তাদের চোখে পরম বিস্ময় নিয়ে আসে। কত কথা জমে আছে তাদের বুকের মধ্যে। আমার সাথে কথা বলে তারা কিছুটা হালকা হতে চায়। আমি ভাবি, আমি যখন এখানে থাকব না, তখনও হারেম জীবন এমনভাবে কেটে যাবে।
অনেকদিন ধরেই ছবি তোলার শখ ছিল আমার। এখানে এসে শখটা পূরণ করতে পারছি ভালো ভাবে। নিজস্ব ডার্করুমে বসে ছবিগুলো ডেভলপ করি। নিজেরই এই কাজে নিজেই খুসি হয়ে উঠি। হ্যাঁ, এখন এই কাজে আমি বেশ পাকা হয়ে উঠেছি।
এখন জীবনের ভেতর নানা ধরনের উন্মাদনা এসেছে। ম্যাকস আরও ভালোভাবে কাজে লেগে পড়েছে। স্থানীয় কিছু সমস্যার সমাধান তাকে করতে হচ্ছে। অনেকে তাকে নেতা বলে মেনে নিয়েছে।
আমরা নদীর ধারে আর্মেনিও গ্রামে একটি বাড়ি ভাড়া করলাম। এখানকার বেশির ভাগ বাড়ি একেবারে ফাঁকা। এক সময় হয়তো মানুষের বসতি স্থাপন করা হয়েছিল। এখন কোনো কারণে তা অন্যত্র সরে গেছে। এমন ফাঁকা নির্জন শহরে বাস করতে মনটা কেমন যেন হয়ে যায়! সর্বত্র সভ্যতার চিহ্ন, অথচ মানুষ নেই। মানুষ না থাকলে সভ্যতার কোনো দাম আছে কি?
এখানকার জীবনে একটা অন্য ছন্দ আছে। আছে অন্য আনন্দ। স্থানীয় মানুষজন বলতে কাউকেই চোখে পড়ে না। নিজেদের মধ্যে গল্প গুজব করে সময় চলে যায়।
মনসুর ছেলেটি চমৎকার। ইতিমধ্যে আমাদের পরিবারের একজন হয়ে গেছে সে। সব সময় আমার প্রতি নজর রাখে। কীসে আমার সুবিধা, তা দেখতে চায়। আমি ভাবি, এর সঙ্গে পরে আমার দেখা হবে না, কিন্তু তাকে আমি ভুলতে পারব কি?
ধীরে ধীরে খননের কাজ এগিয়ে চলেছে। ম্যাকসকে এখন ভীষণ পরিশ্রম করতে হচ্ছে। ম্যাকস এখন ভোর থেকেই কীসব খাতাপত্র নিয়ে বসে যায়। অনেকের সাথে কথা বলে। প্রতিটি পদক্ষেপকে মেপে চলতে চায়। ম্যাকসের এই সাহস, এই একাগ্রতা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
ম্যাকস যদি এই কাজে সফল হয়, তাহলে সেটা আমার কাছে একটা মাইল ফলক হয়ে থাকবে।
জীবনের রেখা কখন কীভাবে কোথায় পালটে যায়, কেউ জানে না। আমি কি কখনো জানতাম যে, এইভাবে আফ্রিকায় এসে আমাকে থাকতে হবে? একেই বোধহয় সত্যিকারের জীবন বলে।
।। আট।।
এবার আমাদের গন্তব্য রাকা। পথ ক্রমশ কমে আসছে। একটির পর একটি অভিযান শেষে হয়ে যাচ্ছে। আজ বাদে কাল এখান থেকে চলে যেতে হবে।
রাকাতে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু ঘটেনি। দিনগুলি একই রকমভাবে এগিয়ে গেছে। সেখানকার খনন কাজে তেমন কোনো ব্যস্ততা ছিল না। কেমন একটা মন্দাক্রান্তা ছন্দ। আমি এর কারণ জানি না। ম্যাকসকে জিজ্ঞেস করলে ও কোনো কথার জবাব দিতে চায় না। তাই বলতেই হয়, চিরবিদায় রাকা। জানি না, তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে কিনা।
শেষের কথা
এভাবেই শেষ হয়ে গেল আমার ডাইরি। লেখাটা হয়তো এলোমেলো হয়ে গেল। আসলে মনটা খুবই বিক্ষিপ্ত ছিল আমার। যখন যা ঘটেছে, তা ঠিকমতো তুলে ধরতে পারিনি আপনাদের সামনে। এজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
……আর কখনো হয়তো মধ্যপ্রাচ্যে খাবার সুযোগ হবে না আবার। তাই বলছি, মনের ক্যানভাসে সব ছবি আঁকা আছে। থাকবে চিরকাল।
বসন্ত, ১৯৪৪।