১. মিস জেন মারপল

ক্যারিবিয়ান মিস্ট্রি (১৯৬৪) – আগাথা ক্রিস্টি
অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ

০১.

মিস জেন মারপল সেন্টমেরী মিডের শান্ত গ্রামীণ পরিবেশ ছেড়ে বেড়াতে এসেছেন ক্যারিবিয়ান সাগরের ছোট্ট দ্বীপভূমি ওয়েস্ট ইণ্ডিজে।

এখন বয়স হয়েছে তাঁর। গীর্জার কাছেই জীবনের দীর্ঘ বছরগুলো কেটেছে। গত শীতে কঠিন নিমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। ডাক্তারের উপদেশ ছিল উন্মুক্ত সূর্যালোক-স্নানের।

এর পরেই ক্যারিবিয়ান সাগরের দ্বীপভূমি ওয়েস্ট ইণ্ডিজে আসার রাজসিক ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ভাইপো রেমণ্ড ওয়েস্ট।

রেমণ্ড একজন সফল ঔপন্যাসিক। বই থেকে তার আয়ও যথেষ্ট। কর্তব্যবশেই পিসীর জীবন আনন্দময় করে তুলতে সে প্রস্তাব করেছিল ওয়েস্ট ইণ্ডিজে আসার।

গোড়ায় মৃদু আপত্তি প্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত তিনি সম্মত হয়েছিলেন সেণ্টমেরী মিডের বাড়ি ছেড়ে আসতে।

রেমণ্ড ব্যবস্থার কোন ত্রুটি রাখেনি কোন দিকে। তারই এক বান্ধবীর সঙ্গে আকাশ পথে এসেছেন ত্রিনিদাদ পর্যন্ত। তারপর সেখান থেকে সমুদ্র তীরে সেন্ট অনবরাতে গোল্ডেন পাম হোটেলে।

এই হোটেলটা আগে চালাতেন স্যাণ্ডারসনরা। কিছুকাল আগে তারা ইংলণ্ডে চলে আসেন। তাদের জায়গায় হোটেল চালাচ্ছে কেণ্ডাল দম্পতি।

রেমণ্ডকে তারা নিশ্চিন্ত থাকার আশ্বাস দিয়ে জানিয়েছিল তার পিসীর জন্য কোন ভাবনা তাকে করতে হবে না।

এখানে একজন ভাল ডাক্তারও রয়েছেন। দরকার হলেই পাওয়া যাবে। আর তারা নিজেরা তো আছেনই।

মলি কেণ্ডাল খুব উদ্যমী যুবতী। বয়স কুড়ি ছুঁয়েছে। বেশ হাসিখুশি। মিস মারপলকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে যথাসময়েই তার জন্য সবরকমের আরামের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

মলির স্বামী টিম কেণ্ডাল। অত্যন্ত সদাশয় যুবক। সামান্য কৃশ দেখতে, গায়ের রঙ গাঢ়।

একেবারে নিজের মত করে একটা চমৎকার বাংলো পেয়েছেন মিস মারপল। পশ্চিম ভারতীয় মেয়েরা হাসিমুখে আদেশ পালন করতে সব সময়েই তৈরি।

এখানে আসার পর থেকে রোজই তিনি বাংলোর সামনের রাস্তা ধরে সমুদ্রের তীরের এলাকায় একটা চেয়ারে এসে বসেন, স্নানের দৃশ্য দেখেন আর অভ্যস্ত হাতে উল বোনেন। সঙ্গী হিসেবে দু-একজন বয়স্ক অতিথিকেও পেয়েছেন।

এরা হলেন বৃদ্ধ মিঃ র‍্যাফায়েল, ডাঃ গ্রাহাম, ক্যানন প্রেসকট আর তার বোন। এদের সঙ্গে আছেন মেজর প্যালগ্রেভ।

একজন বৃদ্ধার পক্ষে উন্মুক্ত সামুদ্রিক পরিবেশ, নিশ্চিন্ত আবাস আর অনর্গল গল্প করার মত সঙ্গী–এর পর আর কি চাই! অসংখ্য পামের অরণ্যে রোজকার জীবনযাত্রায় দুদিনেই বেশ অভ্যস্ত করে নিয়েছেন তিনি নিজেকে।

আপাততঃ মেজর প্যালগ্রেভ সঙ্গ দিচ্ছিলেন মিস মারপলকে। ভদ্রলোক ঘুরেছেন অনেক, দেখেছেন অনেক। তিনি নিজের অভিজ্ঞতার গল্প করেনও বেপরোয়া ভাবে।

–কেনিয়ায় না গেলে জায়গাটা সম্পর্কে কোন ধারণাই করা সম্ভব নয়। জীবনের সেরা চোদ্দটি বছর আমার কেটেছে সেখানে।

এভাবেই স্মৃতিচারণ করে চলেছিলেন মেজর। মিস মারপলের মত একজন নীরব শ্রোতা পেয়ে অতীতের আনন্দের দিনগুলোর কথা শুনিয়ে অপার আনন্দ লাভ করছিলেন তিনি।

উপজাতিদের বিচিত্র রীতির রঙ চড়ানো কাহিনী শুনতে শুনতে মিস মারপল মেজরকে উৎসাহিত করতে বললেন–আপনার অভিজ্ঞতা সত্যিই বড় বিচিত্র। অবশ্য এ জায়গাটাও চমৎকার।

মেজর প্যালগ্রেভ চারদিকে তাকিয়ে খুশির স্বরে বললেন–হ্যাঁ, সত্যিই চমৎকার।

–এমন জায়গাতেও নিশ্চয়ই অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে থাকে।

-তা ঘটে বৈকি। শুনবেন নাকি? ক বছর আগে একটা খুন হয়েছিল। লোকটির নাম হ্যারি ওয়েস্টার্ন। কাগজে এনিয়ে কদিন খুব লেখালেখিও হয়েছিল।

-হ্যারি ওয়েস্টার্ন তার স্ত্রীর প্রেমিক কাউন্ট ফেরারিকে গুলি করে হত্যা করেছিল। অবশ্য টাকার জোরে সবই পরে ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল।

মিস মারপলের পশমের গুলি গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল। কথা বলতে বলতে মেজর সেটা নিচু হয়ে তুলে দিলেন।

-আমিও একবার অদ্ভুত এক ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম, বলতে লাগলেন মেজর, ঠিক নিজে নয়, ক্লাবে আড্ডা দেবার সময় এক ডাক্তার ভদ্রলোক তার জীবনের ঘটনা শুনিয়েছিলেন।

স্ত্রী গলায় দড়ি দিয়েছিল বলে মাঝরাতে এক তরুণ তাকে ডেকে তুলেছিল। তরুণটি স্ত্রীর খুবই অনুগত ছিল।

কিছুদিন যাবৎ সে স্ত্রীর আচরণে অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করছিল। কেমন হতাশার ভাব তাকে জড়িয়ে থাকত সবসময়।

ডাক্তার ঠিক সময়ে পৌঁছে উপযুক্ত ব্যবস্থাদি করায় মেয়েটি সেযাত্রা বেঁচে গিয়েছিল বটে কিন্তু একমাস পরেই ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল।

খুবই দুঃখের ঘটনা, মৃদুস্বরে বললেন, মিস মারপল, খুনের ঘটনা বর্ণনায় মেজরের উৎসাহ লক্ষ্য করে বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন তিনি।

এমনি আরও দু-একটা অদ্ভুত ঘটনার বিবরণ শুনিয়ে মেজর একসময় বললেন, আমার এক ডাক্তার বন্ধু একবার তার এক বন্ধুর একটা ফটো বার করে দেখায়। বন্ধুটির নাম রবিনসন না কি যেন ছিল। সে তার বাড়িতেই ছিল। তার বন্ধুটি আবার সবসময় ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াত। অদ্ভুত কিছু দেখলেই ছবি তুলে নিত।

রবিনসনদের সদর দরজার সামনে একটা দুর্লভ হিবিসকাস গাছ দেখতে পেয়ে একটা ছবি তুলে নেয়। ঠিক যেই মুহূর্তে সাটার টেপে তখনই মহিলার স্বামী সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছিল। ক্যামেরায় সে-ও ধরা পড়ে গেল। অবশ্য ছবিটা একটু ফোকাসের বাইরে চলে গিয়েছিল।

মেজর বললেন, সেই ছবির একটা কপি আপনাকে আমি দেখাতে পারি–ডাক্তার বন্ধু নিছক আমার কৌতূহল মেটাবার জন্য দিয়ে দেন। ছবিতে ধরা পড়া সেই লোকটি এমন এক খুনের আসামী যে ঘটনার রহস্য আজও সমাধান হয়নি। খুনী নির্বিবাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

মেজর প্যালগ্রেভ তার ব্যাগ বের করে হাজারো জিনিসের মধ্যে ফটোর খোঁজ করতে লাগলেন।

মিস মারপল বুঝতে পেরেছিলেন, মেজর তার গল্পে যথেষ্ট রঙ চড়াতে অভ্যস্ত। এধরনের লোকেরা যতবার গল্প শোনায় ততবারই তাতে নতুন করে পলেস্তারা পড়ে।

–সব ঘটনা প্রায় ভুলেই গেছি। মহিলা বেশ সুন্দরী ছিলেন। কিন্তু কোথায় যেন–এই তো–বলতে বলতে ব্যাগের ভেতর থেকে একটা ছোট্ট ফটো টেনে বার করলেন।

–একজন খুনীর ছবি এটা।

ছবিটা মিস মারপলের হাত চালান করবার মুহূর্তে পায়ের শব্দ পেয়ে মিস মারপলের ডান কাঁধের ওপর দিয়ে দৃষ্টি ফেললেন তিনি।

-যাচ্ছেতাই, গোল্লায় যাক।

 বিরক্ত হয়ে হাত গুটিয়ে নিলেন মেজর। সবকিছু আবার মানিব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলেন। এবং প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ পাল্টে হাতির দাঁতের গল্প করতে শুরু করলেন। পরক্ষণেই বলে উঠলেন–হ্যালো

মেজরের কণ্ঠ কেমন কৃত্রিম বলে বোধ হতে লাগল মিস মারপলের।

এগিয়ে আসা পদশব্দের দিকে তাকিয়ে মেজর বললেন, দেখুন কারা এসেছেন–বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ–পুষ্প ও প্রাণীসংগ্রাহক।

মিস মারপল এগিয়ে আসা চার অতিথিকে আগেই দেখেছিলেন। বিরাট চেহারার একঝাঁক খাড়া ধূসর চুলের মানুষটির নাম গ্রেগ ডাইসন আর স্বর্ণকেশী স্ত্রীলোকটি তার স্ত্রী লাকি ডাইসন।

অন্য দম্পতির একজন কৃশ চেহারার মানুষ। তিনি কর্নেল এডওয়ার্ড হিলিংডন আর তার স্ত্রী ইভিলিন হিলিংডন।

প্রথম দম্পতি প্রকৃতিবিদ, দ্বিতীয় পাখি সম্পর্কে খুব আগ্রহী।

মেজর মিস মারপলের সঙ্গে সকলের আলাপ করিয়ে দিলেন। সকলেই তাঁকে শুভেচ্ছা জানালেন।

ইভিলিন হিলিংডন মিস মারপলের পাশে বসে তার সঙ্গে গল্প করতে শুরু করলেন। মিস মারপল ঘাড়ের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন। তবু আস্তে আস্তে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। তার চোখে পড়ল বেশ একটু দূরে ধনকুবের মিঃ র‍্যাফায়েলের বিরাট বাংলোটা কিন্তু মানুষজন কাউকে দেখা গেল না সেখানে।

ইভিলিনের গল্প শুনতে শুনতে মিস মারপল অন্যমনস্ক ভাবে হলেও যথাযথ সায় দিয়ে যাচ্ছিলেন। পুরুষ দুজনকে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত ছিল তাঁর চোখ।

এডওয়ার্ড হিলিংডন শান্ত সুদর্শন। বেশ ভালমানুষ বলেই মনে হয়।

আর গ্রেগ ডাইসনের বিরাট চেহারা। বেশ হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল।

এর পরে মেজরের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন তিনি।

.

০২.

 গোল্ডেন পাম হোটেলের সন্ধ্যা।

কোণের দিকে একটা চেয়ারে বসেছিলেন মিস মারপল। প্রকাণ্ড ডাইনিং রুমটার তিনদিক খোলা। ভেতরে হাওয়ায় ভাসছিল বেশ মিষ্টি গন্ধ। টেবিলে টেবিলে ছড়িয়ে পড়েছে হালকা রঙীন আলো।

আনন্দমুখর এই সন্ধ্যায় বেশির ভাগ মহিলারই দেহে রঙিন সান্ধ্য পোশাক। হলের আলোয় প্রকট হয়ে উঠেছে তাদের বাদামী কাঁধ আর পেলব হাত।

নানা বয়সের মানুষ চারপাশে। প্রৌঢ় ধনীদের দেখে বোঝা যাচ্ছিল তাদের সঙ্গিনীরা তৃতীয় বা চতুর্থ ঘরণী।

মধ্যবয়স্ক অনেক দম্পতি এসেছিল উত্তর ইংলণ্ড থেকে। সন্তানসহ হাসিখুশি এক দম্পতি এসেছে কারাকাস থেকে।

দক্ষিণ আমেরিকার নানা রাজ্যের মানুষও কিছু কম ছিল না। সকলের মুখের নানা ভাষার শব্দ মিলেমিশে এক বিচিত্র গুঞ্জনধ্বনি তৈরি হয়েছে হলে।

আরো ছিলেন দুই ইংরাজ যাজক। একজন ডাক্তার আর একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক। একপাশে এক চীনা পরিবারকেও চোখে পড়ছিল।

দীর্ঘাঙ্গী কালো স্থানীয় যুবতীরা নিপুণ হাতে খাদ্য পরিবেশন করছিল। তাদের তদারক করছিল ইতালির প্রধান ওয়েটার আর পানীয় পরিবেশনকারী।

সকলের ওপর সতর্ক নজর রাখছিল টিম কেণ্ডাল। তাকে সহায়তা করছিল তার স্ত্রী মলি। একরাশ সোনালী চুল আর হাসিঝলমল মুখের মলিকে বেশ সুন্দরী দেখাচ্ছিল।

একটু পরেই শুরু হল স্টীল ব্যাণ্ড। দ্বীপে এই জোরালো বাজনা খুবই জনপ্রিয়। যদিও মিস মারপলের মোটেই ভাল লাগল না।

গান আর বাদ্যের তালে তালে নাচও শুরু হয়েছিল। মিস মারপল লক্ষ্য করলেন এ নাচে ব্যায়ামের ধাঁচে অদ্ভুতভাবে সারা শরীর বেঁকে যায়। তরুণ-তরুণীরা বেশ উপভোগ করছে।

কাছেই টেবিলে বসেছিলেন গোলগাল চেহারার ক্যানন প্রেসকট আর তার বোন। কেমন ভয় জাগানো মুখভাব মহিলার। চেহারাও কৃশ।

মিস প্রেসকট সারাদিন ধরে কোথায় কোথায় ঘুরেছেন সেই বিবরণ শোনাতে লাগলেন মিস মারপলকে। এরা দুই ভাইবোন বেশ কিছুদিন গোল্ডেন পাম হোটেলে রয়েছেন। কফি পানের ফাঁকে অতিথিদের সম্পর্কে নানা কথা বলতে লাগলেন।

বৃদ্ধ মিঃ র‍্যাফায়েল প্রতি বছরই এখানে আসেন। লোকটি টাকার পাহাড়ের মালিক। বয়স প্রায় আশি। তার সঙ্গে রয়েছে সেক্রেটারী অল্পবয়সী একটি মেয়ে। এসথার ওয়াল্টার্স। সে চিচেস্টারে থাকে, বিধবা।

মিঃ র‍্যাফায়েলের সঙ্গে তার ভ্যালেও রয়েছে। তার নাম জ্যাকসন। পক্ষাঘাতগ্রস্ত মিঃ র‍্যাফায়েলের অঙ্গসংবাহন করে সে একজন নার্সের মতই।

ক্রমে সকলেই আলাদা দল করে হলঘরে ছড়িয়ে পড়ছিল। হিলিংডন-ডাইসন চারজনের দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন মেজর প্যালগ্রেভ।

মিস মারপল সেই দিকে ইঙ্গিত করে তাদের সম্পর্কে কৌতূহল প্রকাশ করলেন।

ক্যানন প্রেসকট জানালেন, প্রতিবছরই তারা ওয়েস্ট ইণ্ডিজে নানা দ্বীপে ঘুরে তিনমাস কাটিয়ে যান। এখানে গত বছরও এসেছিলেন।

লম্বা লোকটি হলেন হিলিংডন, তারা স্বামী-স্ত্রী উদ্ভিদবিদ। অন্য দুজন হলেন আমেরিকান মিঃ ও মিসেস ডাইসন। ভদ্রমহিলা প্রজাপতির ওপরে লেখালেখি করে থাকেন। পাখির বিষয়েও সকলে উৎসাহী।

এই টেবিলে যাদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল তাদের দিক থেকে স্টীল ব্যাণ্ডেল শব্দ ছাপিয়ে হাসির শব্দ ভেসে আসছিল।

সেদিকে তাকিয়ে মিস মারপল বললেন, মানুষের পরিচয় জানাটা বেশ আনন্দের।

–এবং মজার। গতবছর আমি ওদের দেখে তো ভেবে নিয়েছিলাম মিসেস ডাইসনই বুঝি মিসেস হিলিংডন। পরে ভুল ভেঙ্গেছিল।

মিস মারপল বললেন, মিঃ ডাইসন তার স্ত্রীকে ডাকেন লাকি বলে। ওটা কি তার ডাকনাম?

মিঃ ক্যানন বললেন, স্ত্রীর দৌলতে ভাগ্য ফিরেছিল বলে মিঃ ডাইসন ওই নামে ডাকেন বলে শুনেছি।

এমনি একে একে অন্যান্য সকলের সম্পর্কেই নানা কথা জানা হয়ে গেল মিস মারপলের।

একসময় মিঃ র‍্যাফায়েলের টেবিলে দৃষ্টি পড়ল তার। অবিশ্বাস্য ধনী এই লোকটিকে জরাগ্রস্ত শিকারী পাখি বলে মনে হল তার।

শরীর অত্যন্ত কৃশ। তবে দৃষ্টি বেশ তীক্ষ্ণ। খুবই খিটখিটে মেজাজের হলেও লোকে মানিয়ে নেয় তিনি ধনী বলে। ব্যক্তিত্ব অসাধারণ।

ভদ্রলোকের ভ্যালে সঙ্গী সুদর্শন দীর্ঘাকৃতি মিঃ জ্যাকসন দাঁড়িয়ে আছেন পাশে।

.

০৩.

 শয্যায় বসেই প্রাতরাশ সারলেন মিস মারপল। চা, সেদ্ধ ডিম আর এক টুকরো পেঁপে।

প্রাতঃরাশ শেষ হলে অভ্যাস মত হোটেলের পথ ধরে এগোলেন। পথেই দেখা হয়ে গেল মলি কেণ্ডেলের সঙ্গে। তার চোখেমুখে কেমন একটা বিপর্যন্ত ভাব।

উদ্বিগ্ন হয়ে তিনি জানতে চাইলেন, কি হল? অমন উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে কেন?

মলি বিমর্ষভাবে জবাব দিল, খুবই দুঃসংবাদ। সকলেই জানছেন একে একে–মেজর প্যালগ্রেড পরা গেছেন।

-সেকি, কখন? গতকালও তাকে বেশ হাসিখুশি দেখেছি। বিস্মিত হলেন মিস মারপল।

–গত রাত্রিতে আকস্মিকভাবেই মৃত্যুটা হয়েছে। তিনি রক্তচাপের রোগী ছিলেন।

–কিন্তু আজকাল তো এ রোগের যথেষ্ট ভাল ওষুধ আছে।

–তা আছে। সেটা খেতেই হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন কিংবা বেশি খেয়ে ফেলেছিলেন।

–ডাক্তার কি বলছেন? উদ্বিগ্ন ভাবে জানতে চাইলেন মিস মারপল।

-অবসর নেবার পর থেকে ডাঃ গ্রাহাম তো হোটেলেই থাকেন। তিনি দেখেছেন, স্থানীয় ডাক্তারও দেখেছেন। তারাই ডেথ সার্টিফিকেট দিলেন। তাদের অভিমত উচ্চ রক্তচাপ থাকলে এরকম হতে পারে। তার ওপর গতরাত্রে মদের পরিমাণটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল।

একটু থেমে মলি আবার বলল, কিন্তু আমাদের কাছে ঘটনাটা মস্ত বড় আঘাত। হোটেলের খাবার সম্বন্ধে লোকের মনে সন্দেহ দেখা দিতে পারে।

–কিন্তু চলতে চলতে বললেন মিস মারপল। তার মনে পড়ল, গতকালই হিলিংডন আর ডাইসনদের সঙ্গে বেশ হাসিখুশি মেজাজে ছিলেন। কথাটা মনে হতেই তিনি গতি পাল্টে সমুদ্রতীরে না গিয়ে বারান্দার ছায়ায় এসে বসলেন।

হাতের উলের কাটা খুব দ্রুত চলছিল। আকস্মিক দুঃসংবাদটা তাকে খুবই ছন্দহারা করে তুলেছিল।

গতকালই মেজর প্যালগ্রেভ কেনিয়ার কথা, ভারতের কথা, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত তারপর খুনের ঘটনা অনেককিছুই সোৎসাহে শুনিয়েছিলেন।

পশমের গুলি পড়ে গেলে মেজর তা তুলে দিয়ে সেই খুনীর ফটোর কথাটা বলেছিলেন।

তেমন আগ্রহ নিয়ে তখন শুনতে চাননি তিনি…কোন ক্লাবে তার ডাক্তার বন্ধু শুনেছিলেন তার এক ডাক্তার বন্ধুর কাছে। একজন ডাক্তার ছবি তুলেছিলেন সেই খুনী যখন সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছিল।

বিশেষ করে এই ঘটনাটাই ঘুরেফিরে মনে আসতে লাগল মিস মারপলের। ফটোটা দেখাবেন বলে মেজর পকেটব্যাগ বার করেছিলেন। সেই মুহূর্তেই তিনি পদশব্দ লক্ষ্য করে তাকিয়েছিলেন।

তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, সেই সময় মুখ লাল হয়ে উঠেছিল মেজরের। কেমন কাঁপা হাতে আচমকা সব গুটিয়ে নিয়েছিলেন। অস্বাভাবিক ভাবে হাতির দাঁতের গল্প শুরু করেছিলেন।

কয়েক মুহূর্ত পরেই হিলিংডন আর ডাইসনরা তাদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। সেই সময় ডান দিকে মাথা ঘুরিয়ে মিস মারপল তাকিয়েছিলেন। কাউকে দেখতে পাননি। কেবল একটু দূরে হোটেলের দিকে টিম কেণ্ডাল আর তার স্ত্রীকে চোখে পড়েছিল।

মেজর প্যালগ্রেভ সেদিকে অবশ্য তাকাননি।

এই অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা নিয়ে মধ্যাহ্নভোেজ পর্যন্ত চিন্তায় ডুবে রইলেন মিস মারপল। বিকেলেও বেড়াতে বেরলেন না। কি মনে করে ডাঃ গ্রাহামকে তার শরীর ভাল লাগছে না বলে একটা চিরকূট পাঠালেন।

.

০৪.

 ওয়েস্ট ইণ্ডিজে দীর্ঘদিন ডাক্তারী করার পর অবসর জীবন কাটাচ্ছিলেন ডাঃ গ্রাহাম। বয়স এখন পঁয়ষট্টির কোঠায়। বেশ সদাশয় মানুষ।

চিরকূট পেয়েই তিনি উপস্থিত হলেন এবং শুভেচ্ছা জানিয়ে মিস মারপলের শরীরের অসুবিধার কথা জানতে চাইলেন।

হাঁটুর ঝামেলা মিস মারপলের নিত্যসঙ্গী। সেই কথাটাই তিনি জানালেন।

ডাক্তার যথারীতি ওষুধের কথা লিখে দিলেন। পরে মিস মারপলের একাকীত্বের কথা ভেবে কথা বলতে লাগলেন।

মিস মারপল নিজের মনে লজ্জিত বোধ করছিলেন। মিথ্যা কথা বলে ডাক্তারকে ডেকে এনেছেন বলে। এছাড়া আর কিই বা তাঁর করার ছিল।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সত্যবাদী এবং সত্যকে শ্রদ্ধা করার মানুষ। কিন্তু দরকারে নির্বিচারে মিথ্যার আশ্রয় নিতেও দ্বিধা করেন না।

একসময় তিনি নিজেকে প্রস্তুত করে নিলেন। সামান্য কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, ডাঃ গ্রাহাম, আপনাকে আর একটা কথা বলতে চাইছিলাম। মেজর প্যালগ্রেভকে নিয়ে। সকালে তার মৃত্যু সংবাদটা পেয়ে খুবই আঘাত পাই।

–হ্যাঁ। এমন হাসিখুশি মানুষটা…

–গতকালই তিনি দুনিয়ার নানা অঞ্চলের গল্প শোনাচ্ছিলেন।

–গল্প করার সুযোগ পেলে বেশ বেপরোয়া হয়ে উঠতেন। অনেকেই বিরক্ত বোধ করত অবশ্য।

–মেজর তার ছেলেবেলার কথা শুনিয়েছিলেন, মিস মারপল অকম্পিত গলায় বলতে লাগলেন, সেই সময় আমি আমার এক ভাইপোর ছবি তাঁকে দেখাই। আমার কাছে সে চিরকালই খুব আদরের।

উনি যখন ছবিটা দেখছিলেন ঠিক সেই মুহূর্তেই ওই যে ফুল আর প্রজাপতি সংগ্রহ করেন..কর্নেল আর মিসেস হিলিংডন…ওরা উপস্থিত হন।

মেজর তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অন্যমনস্কভাবে ছবিটা তার ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলেন। সেই সময় আর তাকে বিরক্ত করতে চাইনি। ভেবেছিলাম সকালে চেয়ে নেব। কিন্তু সকালেই তো…

কথা শেষ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মিস মারপল।

 ডাঃ গ্রাহাম সহানুভূতির স্বরে বললেন, সেই ছবিটা আপনি ফেরত চাইছেন, এই তত?

সঙ্কোচের সঙ্গে মিস মারপল বললেন, আমার ভাইপো, প্রিয় ডেনজিল পাঁচবছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।

খুবই বিব্রত বোধ করছি আপনাকে বলতে–মেজরের জিনিসপত্র কে দেখাশোনা করছে জানি না তো তাই আপনাকে

-আমি বুঝতে পারছি। কাল অন্ত্যেষ্টি হবে। তার জিনিসপত্রের ব্যাপারটা কালই দেখা হবে–আচ্ছা, ফটোটার একটু বর্ণনা যদি দেন সুবিধা হয়।

মিস মারপল সহজ গলায় বললেন, ছবিটা তুলেছিল আমার আর এক ভাইপো। হিবিসকাস বা লিলিজাতীয় কোন ফুলের ছবি তুলছিল, সেই সময় ডেনজিল দরজা দিয়ে বেরচ্ছিল। খুব ভাল ওঠেনি যদিও, কিন্তু ওই ছবি দেখেই আমি তার স্মৃতিচারণ করি।

–মনে হচ্ছে ছবিটা আপনাকে ফিরিয়ে দিতে কোনো অসুবিধা হবে না।

বলে ডাঃ গ্রাহাম উঠে দাঁড়ালেন।

মিস মারপল তাকে কৃতজ্ঞতা জানালেন।

.

০৫.

 যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গেই পরলোকগত মেজর প্যালগ্রেভের অন্ত্যেস্টিক্রয়া সম্পন্ন হল পরদিন। কিন্তু এই স্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা এখানকার সামাজিক আনন্দের জীবনে কোন দাগ কাটতে পারল না। যেন খুব তাড়াতাড়িই সকলে ভুলে গেল।

মেজরকে অবশ্য তেমন করে কেউই চিনতেন না এখানে। নিজের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করতেই বেশি পছন্দ করতেন তিনি। কিন্তু অন্যেরা শুনতে চাইতেন না।

বহুবছর আগেই স্ত্রী গত হয়েছিল তার। নিঃসঙ্গ জীবন অতীত দিনের গল্প আর হাসিখুশিতে ভরিয়ে রাখতে চাইতেন।

একসপ্তাহ পরে হয়তো কেউ আর তাকে মনেও করবে না।

মিস মারপল কিন্তু এত সহজে ভুলতে পারলেন না মেজরের কথা। এতে অবশ্য ব্যক্তিগত কোন আকর্ষণের ব্যাপার নেই। আলাপচারিতার মাধ্যমেই দুজন বয়স্ক মানুষের মধ্যে একটা মানবিক আবেদনের সূত্র তৈরি হয়েছিল।

মেজরের দুঃখজনক আকস্মিক মৃত্যুর জন্য তিনি শোকসন্তপ্ত না হলেও তার অভাব বেশ বোধ করছেন।

অন্ত্যেষ্টির দিন বিকেলে মিস মারপল যথারীতি তার পছন্দের জায়গায় বসে উল বুনছিলেন। ডাঃ গ্রাহাম এসে তার সঙ্গে মিলিত হলেন। পরে তিনি দুঃখপ্রকাশ করে জানালেন, মিস মারপলের মূল্যবান ফটোটি খুঁজে পাওয়া যায়নি।

হতাশকণ্ঠে মিস মারপল বললেন, কি আর করা যাবে। কিন্তু ছবিটা মেজর প্যালগ্রেভের ব্যাগেই তো ছিল।

পকেট, অন্যান্য জিনিসপত্র, সবই খুঁজে দেখা হয়েছে। কয়েকটা চিঠি, খবরের কাগজের টুকরোটাকরার সঙ্গে আরো কয়েকটা ফটোও ছিল। কিন্তু আপনি যেমন বলেছেন তেমন কোন ফটো ছিল না।

দুর্ভাগ্য। আপনি যথেষ্ট করেছেন ডাঃ গ্রাহাম। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

কথা শেষ করে একমুহূর্ত থামলেন মিস মারপল। পরে বললেন, বাড়ির বাইরে এমনভাবে মৃত্যু হওয়াটা খুবই দুঃখজনক। ফুসফুসের কোন দোষ ছিল নিশ্চয়ই

-তা মনে হয় না, বললেন ডাঃ গ্রাহাম, মনে হয় উচ্চ রক্তচাপে ভুগতেন।

–এসব ক্ষেত্রে অবশ্য মৃত্যু ঘটা স্বাভাবিক। তবে রোগের কথা তো কখনো বলতে শুনিনি।

-তার চিকিৎসা আগে আমি কখনো করিনি। ব্লাড প্রেসারও নিইনি। তবে ব্লাড প্রেসারে অ্যালকোহল খুবই ক্ষতিকর।

–এজন্য তো শুনেছি ট্যাবলেট খেতে হয়।

–হ্যাঁ। ওর ঘরেও সেরেনাইটের একটা শিশি ছিল।

-আজকাল বিজ্ঞান নানা দিকেই কত উন্নতি করেছে। আচ্ছা, বলছেন মেজরের পকেটে কোন ছবি ছিল না।

–আপনার বর্ণনা মত আপনার ভাইপোর ছবি ছিল না। মেজরের নিজের কিছু ছবি ছিল।

 এরপর মিস মারপলের হাঁটুর খোঁজখবর নিয়ে ডাঃ গ্রাহাম বিদায় নেন।

মিস মারপলের মুখে গভীর চিন্তার ছাপ পড়ে তিনি উদাস ভাবে পাম সারি আর সুনীল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

একটা সন্দেহের নিরসন হয়েছে। এবারে যা জেনেছেন তা নিয়ে তাঁকে ভাবতে হবে। তার সামনেই ছবিটা মেজর পকেটব্যাগে রেখেছিলেন। অথচ তার মৃত্যুর পর সেই ছবিটাই পাওয়া গেল না।

যে ছবি এত যত্ন করে রেখে দিয়েছেন, মেজর যে সেটা ফেলে দিতে পারেন না তা সহজেই অনুমান করা চলে।

ছবিটা তার মৃত্যুর পরেও ব্যাগেই থাকা উচিত ছিল। টাকা চুরি হতে পারে, কিন্তু বিশেষ উদ্দেশ্য না থাকলে কোন ফটো কেউ চুরি করবে না।

যত চিন্তার গভীরে প্রবেশ করছিলেন, মিস মারপলের মুখ ততই গম্ভীর হচ্ছিল। একটা সিদ্ধান্ত তাকে নিতেই হবে। রহস্যের গন্ধ নাকে লেগেছে।

একেবারেই আকস্মিকভাবে মৃত্যুটা ঘটেছে, ডাক্তারদের মত অত সরলভাবে মেনে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। _ যদি মেজর অসুস্থ বোধ করেই থাকেন, উচ্চ রক্তচাপের ট্যাবলেট তো তার ঘরেই ছিল–সেটা কেন খাননি?

আর যদি রক্তচাপের ব্যাপারটা বানানো হয় আর মেজরের পকেট থেকে ছবিটা সরিয়ে ফেলে থাকে কেউ; তবে নিঃসন্দেহে সেই ব্যক্তির পক্ষেই ওষুধের শিশি তার ঘরে রেখে দেওয়া সম্ভব।

তবে মিস মারপল নিজে কখনো মেজরকে ওষুধ খেতে দেখেননি। উচ্চ রক্তচাপের কথাও কখনো তিনি বলেননি।

তবে তার মনে পড়ছে, মেজরের উচ্চ রক্তচাপের কথাটা কেউ যেন তাকে শুনিয়েছিল। কিন্তু কে বলেছিল মনে করতে পারছেন না।

মিস মারপল ধীরে ধীরে একেবারে গোড়ায় ফিরে গেলেন। খুন আর খুনীদের নিয়ে মেজর যে গল্প করেছিলেন সেটাই পর্যালোচনা করতে শুরু করলেন।

.

০৬.

 পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই মিস মারপল সিদ্ধান্ত নিলেন, খুনের ঘটনার সন্দেহ নিরসন করবার জন্য খোঁজখবর নেবেন তিনি।

এতে হয়তো উপযাচক হয়ে তাকে একটু বেশিই কথা বলতে হবে। তবে বৃদ্ধাদের বেশি কথা বলাটা সকলেই প্রায় মেনে নেয়। সেই সুযোগই নিতে হবে।

কথাবার্তা আলোচনা চালিয়ে তাকে কিছু মানুষ সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হবে। মিস মারপলের চিন্তা ঘিরে এমনি কয়জন মানুষের মুখ পর্যায়ক্রমে ভেসে বেড়াচ্ছিল।

মেজর যদি খুন হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি তার জীবনের কোন গোপন রহস্যের জন্য কিংবা অর্থের জন্য অথবা প্রতিশোধের জন্য খুন হননি।

মিস মারপলের ধারণা মেজর বেশি কথা বলতেন, অনেক কথা সকলকে জানাতেন,এটাই খুনের মুখ্য উদ্দেশ্য।

ডাঃ গ্রাহামের কাছ থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা খবর জানতে পেরেছেন তিনি। নিজেরই বেশ কিছু ছবি–পোলো খেলার পোশাকের, বাঘ শিকারীর পোশাকের এমনি ধরনের, মেজরের ওয়ালেটে ছিল। এসব ছবি রেখে দেয়ার কি কোন উদ্দেশ্য ছিল? মেজর হয়তো ওসব ছবি দেখিয়ে ঘটনার বর্ণনা শুনিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করতেন…সন্দেহভাজন খুনী হয়তো তাতেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। ভবিষ্যতে তার ফটো দেখিয়েও কোন কাহিনীর জন্ম নেবার সম্ভাবনা ছিল।

মিস মারপলের মনে পড়ল, খুনের ঘটনার প্রসঙ্গে বলতে গিয়েই পকেট থেকে ব্যাগ বার করে মেজর বলেছিলেন, লোকটাকে দেখে খুনী বলে মনে হয় কিনা বলুন তো।

তিনি বুঝতে পারছেন, এভাবে সকলকে বলে বেড়ানো তার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। খুনীর কাহিনীর সঙ্গে অনিবার্য ভাবে ছবিটাও নিশ্চয় প্রদর্শিত হত। খুনের গল্প বেশ উৎসাহের সঙ্গেই বলতে লক্ষ্য করেছেন তিনি।

সম্ভবতঃ এখানে এ গল্প নিশ্চয় তিনি আগেও কাউকে শুনিয়ে থাকবেন। হয়তো কয়েকজনকেই তাহলে কাহিনীর বর্ণনার সঙ্গে ছবির খুনীরও একটা চেহারার আভাস কারো কাছ থেকে নিশ্চয়ই পাওয়া যেতে পারে।

হ্যাঁ, এটাই ঠিক পথ। ভাবলেন মিস পারপল। এভাবেই শুরু করবেন তিনি।

তার মনের সন্দেহভাজন। ব্যক্তিদের কথা মনে করতে গিয়ে মিস মারপলের স্মরণে এল মেজর যেভাবে খুনীর বর্ণনা করেছিলেন, তাতে বোঝা যায় সে একজন পুরুষ। কিন্তু এখানে পুরুষ দুজন। কর্নেল হিলিংডন এবং মিঃ ডাইসন।

আপাতদৃষ্টিতে এদের কাউকেই খুনী ভাবা যায় না। তবে বাইরের চেহারাটাই তো মানুষের সব নয়। কিন্তু আর কেউ কি থাকা সম্ভব?

আশপাশে তো সেই মুহূর্তে মাথা ঘুরিয়ে আর কাউকে চোখে পড়েনি। কেবল মিঃ র‍্যাফায়েলের বাংলোটা চোখে পড়েছিল।

কেউ বাংলো থেকে বেরিয়ে এসে আবার ভেতরে চলে যায়নি তো?

মিস মারপল ভাবলেন, যদি সত্যি এমন হয়, তাহলে নির্ঘাৎ সেই লোক ধনকুবেরের সেই সঙ্গী-জ্যাকসন। ছবির বিষয়ের মতই কি সে-ও দরজা দিয়ে বাইরে আসছে? আর সেই সময়েই নজরে পড়ে গিয়েছিল মেজরের? এবং তিনি চিনতে পেরেছিলেন?

দেখাবার জন্য ফটোটা হাতে নিয়ে মেজর মিস মারপলের ডান কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন…তখনই কি তিনি দরজা দিয়ে ছবির সেই খুনীকে বাইরে আসতে দেখে সতর্ক হয়ে গিয়েছিলেন?

রাতে শুতে যাবার আগে মিস মারপল তার আগামীকালের কাজের তালিকা করলেন এভাবে–হিলিংডনদের, ডাইসনদের আর আর্থার জ্যাকসন সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হবে।

.

মাঝরাতে ডাঃ গ্রাহামের বরাবরই ঘুম ভেঙ্গে যায়। পরে আবার ঘুমিয়ে পড়েন।

আজ রাতে ঘুম ভাঙ্গতেই কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করলেন তিনি। অস্বস্তিটা কি কারণে ঠিক বুঝতে পারলেন না। কিন্তু এমন উদ্বেগের ভাব বহুকাল তার হয়নি।

সহসা তার মনে হল, মেজরের মৃত্যু সম্পর্কে সব কি ঠিকঠাক আছে? কিন্তু তিনি তো ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিলেন।

মেজরের ঘরে সেরেনাইট ট্যাবলেটের শিশি পাওয়া গিয়েছিল। আর মেজর নিজেও তার ব্লাডপ্রেসারের কথা সবাইকে বলেছিলেন।

না, মেজরের মৃত্যুর মধ্যে কোন রহস্য লুকিয়ে থাকা সম্ভব নয়। নিশ্চিন্ত হয়ে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লেন ডাঃ গ্রাহাম।

.

জায়গাটা হোটেলের চৌহদ্দির বাইরে খাড়ির পাশে। এখানে এলোমেলো ভাবে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট কিছু কুটির। তাদেরই একটির ভেতরে নিজের বিছানায় উঠে বসেছে ভিক্টোরিয়া জনসন।

এই অঞ্চলের অন্যতম দ্রষ্টব্য বলা যায় ভিক্টোরিয়াকে। তাকে দেখলে কষ্টিপাথরে গড়া একটি অপূর্ব ভাস্কর্য বলেই ভুল হয় সকলের।

পাশেই নিদ্রিত ছিল ভিক্টোরিয়ার সঙ্গী। কোঁকড়ানো চুলে হাত বোলাতে বোলাতে সে তাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুলল।

-এই, ওঠ শিগগির

–কি হল, এখনও রাত শেষ হয়নি।

ঘুমজড়ানো গলায় বিশালদেহী পুরুষটি বলে উঠল। তার সাদা দাঁতের সারি যেন অন্ধকারেই ঝিকিয়ে উঠল।

-কি বলছিস?

–যে মেজর লোকটা মারা গেছে–সেই ব্যাপারটা আমার ভাল লাগছে না। কোথাও একটা যেন গোলমাল আছে।

-বুড়ো মারা গেছে–এ নিয়ে তুই অত ভাবছিস কেন?

–পিলগুলোর কথা যে ভুলতে পারছি না।

–বেশি করে খেয়ে ফেলেছিলেন হয়তো।

ভিক্টোরিয়া রীতিমত হাঁপাচ্ছিল। সে কাছে এগিয়ে এসে বলল, শোন, সকাল হলেই আমি মিসেস কেণ্ডালকে বলব। নির্ঘাৎ কোথাও একটা গোলমাল হয়েছে।

লোকটির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়নি ভিক্টোরিয়ার। তবু তারা দুজনে স্বামীস্ত্রী হয়ে আছে। সে হাই তুলে বলল, বোকার মত গণ্ডগোল ডেকে আনিস না। এখন ঘুমো।

দুজনে আবার পাশাপাশি শুয়ে পড়ল।

.

০৭.

 হোটেলের সামনে বেলাভূমিতে বেলা এগারোটার মধ্যেই বেশ ভিড় জমে ওঠে। সামাজিক মেলামেশায় জায়গাটা জমজমাট হয়ে ওঠে।

ইভিলিন হিলিংডন জল ছেড়ে তীরে উঠে স্নানের টুপি খুলে বালির ওপরে বসে পড়ল।

ইভিলিনের ডান পাশেই একটা চেয়ারে বসেছিলেন সেনোরা দ্য ক্যাসপিয়েরো। তিনি ভেনেজুয়েলা থেকে এসেছেন।

খানিক তফাতেই হুইলচেয়ারে বসেছিলেন অর্থবান ব্যক্তি মিঃ র‍্যাফায়েল। আপাতত তিনিই হোটেলের প্রধান ব্যক্তিত্ব। তার দেখাশোনার জন্য পাশেই উপস্থিত রয়েছে এসথার ওয়াল্টার্স।

মিস মারপলও একপাশে বসে পশম বুনে চলেছেন। তার কান ছিল বাইরের কথাবার্তার দিকে। তবে প্রয়োজনে দু-একটা মন্তব্যও যে করছিলেন না তা নয়।

ইভিলিন হিলিংডন মাঝে মাঝে কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছিল মিস মারপলের দিকে।

একসময় ইভিলিনকে উদ্দেশ্য করে মিস মারপল বললেন, এমন একটা চমৎকার জায়গায় আসব আগে কখনো ভাবিনি। এখানে তো আপনি আগেও এসেছেন, তাই না মিসেস হিলিংডন।

–বার দুয়েক এসেছিলাম।

নিশ্চয়ই প্রজাপতি আর ফুলের নেশায়? সঙ্গে আপনার বন্ধুরাও ছিলেন নিশ্চয়ই?

–হ্যাঁ, স্রেফ বন্ধু। কয়েক বছর একসঙ্গেই ঘোরাঘুরি করছি।

এভাবে শুরু করা কথা একসময় মেজর প্যালগ্রেভের প্রসঙ্গে চলে এলো। দেখা গেল তার ব্লাডপ্রেসার সম্পর্কে দুরকম ধারণা প্রচারিত। হা এবং না।

মিঃ র‍্যাফায়েল তো জোর দিয়েই বললেন, তিনি নিজে আমাকে বলেছিলেন ওরকম কোন অসুবিধা তার ছিল না। বয়স অনুপাতে তার রক্তচাপ খুবই ভাল ছিল।

মিস মারপল বললেন, শুনেছি তিনি সেরেনাইট না কি-একটা ওষুধ খেতেন।

মিঃ র‍্যাফায়েল বললেন, প্রত্যেকেরই নিজের রোগভোগের বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত।

বেলা বারোটা বেজে গিয়েছিল। মিসেস এসথার ওয়ালটার্সের সাহায্য নিয়ে মিঃ র‍্যাফায়েল উঠে দাঁড়ালেন। তার স্নানের সময় হয়ে গিয়েছিল। দুজনে সমুদ্রের দিকে অগ্রসর হলেন।

সেনোরা দ্য ক্যাসপিয়েরোকে উদ্দেশ্য করে মিস মারপল বললেন, মিসেস ডাইসন কোথায়। তাকে তো দেখতে পাচ্ছি না।

–সেই। লাকি নিশ্চয় অন্য কোন পুরুষের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে কোথাও। সেনোরা দ্য ক্যাসপিয়েরো উত্তর করলেন।

-তাই বুঝি?

–ওর স্বভাবই ওই। ওর স্বামীরও নজর অন্য দিকে। মেয়ে দেখলেই ছোঁকছোঁক করে।

–হ্যাঁ, আপনার পক্ষে জানা সম্ভব।

.

অফিস ঘরে বসেছিল একা মিসেস কেণ্ডাল। হঠাৎ ধবধবে সাদা পোশাকে সজ্জিতা ভিক্টোরিয়া জনসন ঘরে প্রবেশ করল এবং অত্যন্ত সঙ্গোপন ভঙ্গীতে জানালো, ডাক্তারের কথায় ঘরে কি কি আছে দেখতে গিয়ে সে পরলোকগত মেজরের বাথরুমে তাকের ওপরে। দাঁতের মাজন, হজমের ওষুধ, অ্যাসপিরিনের সঙ্গে একটা পিলের শিশিও পেয়েছিল। সেরেনাইট। আগে কিন্তু সে এই শিশিটা সেখানে দেখেনি। তার সন্দেহ, কেউ গোপনে পিলগুলো সেখানে রেখেছিল আর সেগুলো খেয়ে মেজর মারা গেলেন।

মলি ভিক্টোরিয়ার কথার গুরুত্ব বুঝতে পেরে তীক্ষ্ণস্বরে বলল, আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি, তোমাকে ওসব ভাবতে হবে না। দয়া করে এধরনের বাজে গুজব ছড়িয়ে বেড়িয়ো না। তাতে আমাদের হোটেলের ক্ষতি হবে।

ভিক্টোরিয়া চলে গেলে মলি চিন্তিতভাবে কথাটা টিমকে জানালো। কিন্তু সে ব্যাপারটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিল না। তবে বলল ডাঃ গ্রাহামের কাছে গেলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার জানা যাবে।

রোজ ঘর সাফাই করত বলে ঘরে জিনিসপত্র কোথায় কোনটা আছে ভিক্টোরিয়ার মনে গেঁথে গিয়েছিল। মেজরের মারা যাবার পরদিনের আগে সে বাথরুমের তাকে সেরেনাইটের শিশি কখনো দেখেনি। তার বিশ্বাস নিশ্চয়ই কেউ বিষের বড়ির শিশি সেখানে রেখে গিয়েছিল।

কেণ্ডাল দম্পতি এসবকথাই ডাঃ গ্রাহামকে জানান। তিনি ব্যাপারটা যাচাই করবার জন্য তখনই ভিক্টোরিয়াকে ডেকে পাঠালেন।

ভিক্টোরিয়া এসে বেশ জোরের সঙ্গেই একই কথা শোনালো ডাক্তারকে। ব্যাপারটা একেবারে যেন তার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল।

ডাক্তার বললেন, ওটা বিষ নয় মেয়ে, খুব ভাল আর দরকারী ওষুধ। অসুখ থাকলে ওই ওষুধ মানুষকে খেতে হয়। তুমি মিছেই ভেবে হয়রান হচ্ছ।

উঃ বাঁচালেন আপনি আমাকে। ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল ভিক্টোরিয়া। স্থানীয় মেয়েটি চলে গেলে ডাক্তার গ্রাহামের মনে রাতের অস্বস্তিটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তার মনের চাপটা যেন হঠাৎই বেড়ে গেল।

.

০৮.

 মিঃ র‍্যাফায়েলের সেক্রেটারী এসথার ওয়াল্টার্স খুব সুন্দরী না হলেও যথেষ্ট আকর্ষণীয়। সেদিন বিকেলে তার সঙ্গে বসে গল্প করছেন মিস মারপল। মেয়েটিকে একটু যাচাই করা তার উদ্দেশ্য।

কথার ফাঁকে মিস মারপল ওয়াল্টার্সের প্রসঙ্গ তুললেন।

-ও খুবই কাজের লোক। অঙ্গসংবাহক হিসেবেও যথেষ্ট দক্ষ। বলল মিস ওয়াল্টার্স।

–মনে হয় অনেক দিন আছে মিঃ র‍্যাফায়েলের কাছে? জানতে চাইলেন মিস মারপল।

খুব বেশি দিন নয়, আট-ন মাস হবে।

বিবাহিত নিশ্চয়ই?

–মনে হয় না।

–বেশ সুদর্শন যুবক।

–আমারও তাই মনে হয়।

খুবই নিরাসক্ত ভাবে জবাব দিল এসথার ওয়াল্টার্স। মিস মারপলের মনে হল, স্বামীহারা বলেই হয়তো এমন মানসিকতা হয়েছে।

–আপনি কি মিঃ র‍্যাফায়েলের কাছে অনেকদিন কাজ করছেন?

-বছর পঁচেক হবে। স্বামী মারা যাবার পর মেয়েটির জন্য একটা কাজের দরকার হয়ে পড়েছিল।

দৃষ্টিতে খানিকটা কৌতুক খানিকটা সহানুভূতির আভাস ফুটিয়ে মিস মারপল বললেন, মিঃ র‍্যাফায়েলের কাজ করা খুবই কঠিন, তাই না?

কঠিন ঠিক নয়, বুঝে চলতে হয়। মাঝে মাঝে পরস্পরবিরোধী কথা বলেন এই যা। মনে হয় খুব অল্পেই কোন মানুষ সম্পর্কে বিরূপ ধারণা করে ফেলেন। তবে আমি ভালই মানিয়ে চলতে পারছি।

মিঃ জ্যাকসনকেও খুব বাধ্য বলে মনে হয়।

–ও খুব কৌশলী আর যথেষ্ট বুদ্ধিমান।

এমনি কথাবার্তার ফাঁকে নানা প্রসঙ্গ উত্থাপন করে মিস মারপল এক সময় চলে এলেন চার প্রকৃতিপ্রেমিক ডাইসন আর হিলিংডনদের বিষয়ে।

এসথার ওয়াল্টার্স বলল, ওরা চার বছর ধরে এখানে আসছেন। তবে গ্রেগরী ডাইসন অনেকবার এসেছেন। সম্ভবতঃ প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম এসেছিলেন, তার শরীর তখন ভাল ছিল না।

–তিনি কি মারা যান? না বিবাহবিচ্ছেদ?

-খুব সম্ভব এদেশেই ওয়েস্ট ইণ্ডিজের কোন দ্বীপে মারা যান। মনে হয় কোন গোলমাল ঘটেছিল। তবে স্ত্রী সম্পর্কে উনি কিছু বলতে চান না। সবই অবশ্য আমার শোনা কথা।

–ও আচ্ছা, তার পরই বুঝি কি রে মহিলাকে বিয়ে করেন! নামটা খুব অদ্ভুত।

–শুনেছি আগের স্ত্রী বর্তমান স্ত্রীর আত্মীয়া।

–হিলিংডনদের সঙ্গে ওদের পরিচয় বোধহয় অনেক দিনের।

বছর তিন-চার আগে এখানেই সম্ভবত আলাপ হয়।

–হিলিংডনদের খুবই শান্ত প্রকৃতির বলে মনে হয় আমার।

–হ্যাঁ। দুজনেই খুব নম্র।

–সবার কাছে তো শুনতে পাই ওদের দুজনের মধ্যে মনের টান খুব।

–কেন, আপনার সেরকম মনে হয় না!

বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল এসথার ওয়াল্টার্স। এর পরে আসল প্রসঙ্গে মোড় নিলেন মিস মারপল। বললেন, আচ্ছা আপনার কি মনে হয়, যা ব্যাপার চলছে সে বিষয়ে মিঃ ডাইসন ওয়াকিবহাল।

–আমার কোন ধারণা নেই।

স্পষ্ট বিরক্তি প্রকাশ পেল এসথার ওয়াল্টার্সের কণ্ঠে।

-যাই বলুন, মিঃ প্যালগ্রেভের ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক। কেণ্ডালরাও বিপাকে পড়ে গেল।

-হ্যাঁ, ওদের হোটেলেই তো ঘটনাটা ঘটল। মাত্র ছ মাস হল ওরা স্যানডারসনদের কাছ থেকে হোটেলের দায়িত্ব নিয়েছে।

তবে এখানে তো আনন্দের পরিবেশ। মৃত্যুর ঘটনা অতি অল্প সময়ই মানুষের মনে স্থায়ী হয়।

–একথা আমিও মলিকে বলেছি। ও খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে।

-মিসেস কেণ্ডালকে দেখে অবশ্য খুবই উদ্বেগহীন মনে হয়। আমার মনে হয় ওর স্বামীর দুশ্চিন্তাই বেশি।

–মলি জোর করেই হাসিখুশি থাকে। হোটেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আগে থেকেই ভেবে ভেবে কেমন যেন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে।

-বেচারি। খুবই দুঃখজনক। তবে মৃত্যুটা তত খাদ্যে বিষক্রিয়া বা ওই ধরনের কিছু নয় তাই রক্ষে। এসবক্ষেত্রেই মানুষের সন্দেহ জাগে। তবে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল, মেজর প্যালগ্রেভের কাছে কখনো শুনতে পাইনি যে তার উচ্চ রক্তচাপ ছিল। আপনাকে কোনদিন বলেছিলেন?

-কেউ হয়তো মিঃ র‍্যাফায়েলকে বলে থাকতে পারে। তবে মিঃ র‍্যাফায়েল আবার উল্টো কথা বলেন। জ্যাকসন একবার আমাকে বলেছিল, মেজরের মদ খাওয়া কমিয়ে দেওয়া উচিত।

মেজর প্যালগ্রেভকে তার বকবকানি স্বভাবের জন্য দেখছি অনেকেই পছন্দ করত না। . বিরক্তিকর ভাবে তিনি বারবার একই কাহিনী শোনাতেন।

–হ্যাঁ, নানা কৌশল করে তার গল্প বন্ধ করতে হত।

–আমার অবশ্য বারবার একই গল্প শুনতে অসুবিধা হয় না। কারণ, শোনার পর তা আর আমার মনে থাকে না।

মৃদু হাসলেন মিস মারপল।

–একটা কাহিনী শোনাতে তিনি খুব ভালবাসতেন, আবার বললেন মিস মারপল, একটা খুনের কাহিনী। আপনাকেও নিশ্চয়ই সেই গল্প শুনতে হয়েছে?

মনে হয় শুনেছিলাম। স্ত্রী তার স্বামীকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে গ্যাসের উনুনে তার মাথা চেপে ধরে খুন করেছিল।

-না, ওই গল্প নয়–একটা ছবি ছিল মেজরের কাছে, সবাইকে দেখাতেন

 –ঠিক মনে করতে পারছি না। আপনাকে দেখিয়েছিলেন?

–দেখাতে এনেছিলেন, তখনই বাধা পড়ে যায়।

.

০৯.

 অনেক চেষ্টার পর মিস প্রেসকটকে একান্তে পেয়ে মিস মারপল নানা বিষয়ে আলোচনা জুড়লেন। একসময় ডাইসনদের প্রসঙ্গ এলো।

মিস প্রেসকট বললেন, প্রথম স্ত্রীর বিষয়ে মনে হয় কিছু কুৎসা রটনা হয়েছিল। তিনি এখানেই সম্ভবত মার্টিনিক বা টোবাগো দ্বীপে মারা যান। শুনেছি ওই অদ্ভুত নামধারী লাকি প্রথমা স্ত্রীর মাসতুতো বোন। লোককে এ নিয়েও নানা কথা বলতে শুনেছি।

তাই নাকি? বললেন মিস মারপল।

–মিঃ ডাইসন তো শুনেছি প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর একমাসের মধ্যেই দ্বিতীয় বিয়েটা করেছিলেন।

–মাত্র একমাস। নিশ্চয় এর সঙ্গে টাকাপয়সার ব্যাপার ছিল।

–ঠিক জানি না। তবে মিঃ ডাইসন তো শুনতে পাই প্রায় নাকি মজা করে বলেন লাকি তার ভাগ্য ফিরিয়েছে।

-হ্যাঁ, আমিও শুনেছি কথাটা।

–দ্বিতীয়জন অবশ্য খুবই সুন্দরী। তবে যতদূর জানি প্রথমা স্ত্রী স্বামীর জন্য যথেষ্ট টাকাকড়ি রেখে যান।

হিলিংডনদের অবস্থাও বোধহয় খুব ভালো।

–আমিও সেরকমই শুনেছি। ইংলণ্ডে নিজস্ব বাড়ি আছে। সারা শীতকালটা বেড়িয়ে বেড়ায়।

এই সময় ক্যানন প্রেসকট এলেন। মিস প্রেসকট তার সঙ্গে বেড়াতে চলে গেলেন। চেয়ারে একাই বসে রইলেন মিস মারপল।

একটু পরে পাশ দিয়ে হোটেলের দিকে যেতে যেতে মিঃ গ্রেগরী ডাইসন মিস মারপলকে দেখে একগাল হেসে চলে গেলেন।

মিস মারপল ভাবতে লাগলেন, সবকিছুই কেমন খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। মিসেস ডাইসনের মৃত্যুর কাহিনী-মেজর প্যালগ্রেভও একজন স্ত্রী-হত্যাকারী পুরুষের কাহিনী বলেছিলেন।

হঠাৎ পেছনে শব্দ পেয়ে চিন্তার সূত্র ছিঁড়ে গেল। তাকিয়ে দেখেন লাকি এগিয়ে আসছে।

গ্রেগকে এদিকে দেখেছেন?

–এইমাত্র তো হোটেলের দিকে গেলেন।

–আশ্চর্য, অথচ আমি—

বলতে বলতে লাকি দ্রুত হোটেলের দিকে চলে গেলেন।

–এই সময় মিস মারপল দেখতে পেলেন মিঃ জ্যাকসনের সাহায্যে হুইল চেয়ারে বসে মিঃ র‍্যাফায়েল সকালের ভ্রমণে বেড়িয়েছেন। ভদ্রলোকের সঙ্গে একা কিছুক্ষণ কথা বলার ইচ্ছা তার।

হুইল চেয়ার কাছাকাছি আসতেই তিনি সরাসরি বললেন, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করার ছিল মিঃ র‍্যাফায়েল।

-বলুন কি দরকার। নিশ্চয় আফ্রিকার কোন মিশন কিংবা গির্জা সারাইয়ের জন্য চাঁদা চাইবেন?

-হ্যাঁ, এসব ক্ষেত্রে কিছু চাঁদা পেলে তো খুশি হওয়াই যায়। তবে আপাতত আমার জিজ্ঞাসা হল, মেজর প্যালগ্রেভ আপনাকে কি কোন খুনের গল্প বলেছিলেন?

ওহ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলেন মিঃ র‍্যাফায়েল, আপনাকেও শুনিয়েছিলেন দেখছি।

–আপনাকে ঠিক কি বলেছিলেন জানতে ইচ্ছে করছে।

-মনে হয় স্বর্ণকেশী কোন তরুণী স্বামীকে খুন করেছিল।

একটু থিতিয়ে গেলেন মিস মারপল। তবু জানতে চাইলেন, কিভাবে, বিষ খাইয়ে?

–না। খুব বুদ্ধি খাঁটিয়ে ছিলেন মহিলা। ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে গ্যাসের উনুনে চেপে ধরেছিলন। তারপর রটিয়ে দিয়েছিলেন আত্মহত্যা বলে।

–মেজর কোন ফটো দেখিয়েছিলেন আপনাকে?

–কার, সেই স্ত্রীলোকটির? না–

এই সময় ডাঃ গ্রাহাম একটা বই হাতে এসে চেয়ারে বসে পড়লেন। তাকে দেখে মিস মারপল জিজ্ঞেস করলেন, টিম কোল খুব চিন্তিত দেখছি।

–হ্যাঁ। আমরা সকলেই তো চিন্তায় রয়েছি।

–নিশ্চয় মেজর প্যালগ্রেভের মৃত্যুর ব্যাপারে ভাবছেন?

–না, স্ত্রীকে নিয়েই ভাবনায় পড়েছি। মাঝে মাঝেই খুব খারাপ স্বপ্ন দেখে ভয় পায়।

–কি ধরনের স্বপ্ন দেখে?

–কারা সব ওকে তাড়া করে, তার ওপরে নজর রাখে। জেগে উঠেও সেই রেশ থেকে যায়। ইদানিং মেজর প্যালগ্রেভের মৃত্যুর পর থেকে কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছে দিন দিন।

কোন ডাক্তার

–ডাক্তারের নাম একদম শুনতে পারে না। দেখি কি করা যায়। এবারে উঠি মিস মারপল–কিছু কাজ পড়ে আছে।

 বিদায় নিল টিম কেণ্ডাল।

অদূরে একটা চেয়ারে বসেছিলেন ডাঃ গ্রাহাম। তার দিকে তাকিয়ে মনস্থির করে নিলেন মিস মারপল। তারপর উঠে ডাঃ গ্রাহামের মুখোমুখি চেয়ারে বসে পড়লেন।

–আপনার কাছে মাপ চাইতে এলাম ডাঃ গ্রাহাম। সেদিন ইচ্ছে করেই মিথ্যা কথা বলেছিলাম।

অবাক হয়ে তাকালেন ডাঃ গ্রাহাম। বললন, এ নিয়ে অত ভাববার কি আছে? বলুন শুনি।

–এক ভাইপোর ছবির বিষয়ে বলেছিলাম মেজর প্যালগ্রেভকে দেখিয়েছিলাম। তিনি সেটা আমাকে ফেরত দেননি।

-হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ফটোটা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

–আসলে এরকম কোন ফটো ছিল না।

–কি বলছেন? তাহলে বলেছিলেন কেন?

এরপর মিস মারপল সবকথা খুলে বললেন। মেজর প্যালগ্রেভের খুনের কাহিনী-একটা ফটো বার করা, তারপর কিভাবে দেখাতে গিয়ে ব্যর্থ হন।

সবশেষে দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, আমার মনে হয়েছিল মিথ্যা কিছু বললে হয়তো ফটোটা দেখা সম্ভব হতে পারে।

–কোন খুনীর ফটো আপনাকে মেজর দেখাতে চেয়েছিলেন?

-হ্যাঁ, ওরকমই বলেছিলেন তিনি। আশ্চর্য ব্যাপার হল তার পরদিনই তিনি মারা যান। আর ফটোটাও অদৃশ্য হয়।

ডাঃ গ্রাহাম অদ্ভুত দৃষ্টিতে মিস মারপলের দিকে তাকালেন। মিস মারপল ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, এখন আপনি আমার কথা নিশ্চয়ই অবিশ্বাস করবেন না। আমি পরে স্থির করি সবকথা আপনাকে বললে হয়তো কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।

.

১০.

 সেদিনই ডাঃ গ্রাহাম জেমসটাউন অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের অফিসে তার বন্ধু ডেভেনট্রির সঙ্গে দেখা করলেন। গোড়া থেকে সব ঘটনা তাকে খুলে বললেন। সবশেষে বললেন, মেজরের মৃত্যুটাকে স্বাভাবিক বলেই অন্য সকলের মত আমিও মেনে নিতে পারতাম যদি না ফটো অদৃশ্য হয়ে যেত। তাছাড়া হোটেলের পরিচারিকাটিও জোরের সঙ্গেই ওষুধের বোতলের কথাটা জানিয়েছিল।

ডেভেনট্রি বললেন, মেজর ব্লাডপ্রেসারে মারা না গিয়ে থাকলে, তুমি বলতে চাইছ আসল ওষুধের বদলে কেউ অন্য ওষুধ রেখে দিয়েছিল?

ডাঃ গ্রাহাম বললেন, ভিক্টোরিয়া ওরকমই ভেবেছে। তবে আসল ঘটনা তা নয়। মেজরকে কেউ মারার উদ্দেশ্যে পানীয় বা অন্য কিছুর সঙ্গে কিছু খাইয়ে দিয়েছিল। আর মৃত্যুটাকে স্বাভাবিক রূপ দেওয়ার জন্য ব্লাডপ্রেসারের ওষুধের শিশি তার ঘরে রেখে দেওয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে রটনা করে দেওয়া হয় মেজর উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। ব্যাপারটা অত্যন্ত বুদ্ধির সঙ্গে করা হয়েছে।

-হ্যাঁ, বুঝতে পারছি, মেজরের মৃত্যুর পর সবাই তার ব্লাডপ্রেসারের ব্যাপার নিয়েই আলোচনা করছে। তাহলে ব্যাপারটা আমি কি গোয়েন্দা দপ্তরকে জানাব? তাহলে মেজরের দেহ বের করে তদন্ত করা যায়।

করতে হবে খুব গোপনে।

-কিন্তু এখনো ভেবে দেখো–গোটা ব্যাপারটাই একটা কল্পনার প্রাসাদ বলে প্রমাণ হয়ে যাবে না তো?

–তেমন হলে তো আমিও স্বস্তি পাই।