০৬.
পরদিন সকালে সকলে গেলেন রানি অ্যানের জমিদারী ভবন দেখতে। ইতিহাস জড়ানো সুন্দর বাড়িটির সঙ্গে একটি অপূর্ব বাগানও রয়েছে।
বাড়িটির স্থাপত্যের নিদর্শন দেখে স্থপতি রিচার্ড জেনসন খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। আবেগে তিনি ঘুরে ঘুরে প্রতিটি ঘরের নানা বর্ণনা সকলকে শোনাতে শুরু করলেন। অনেকেই ভিড় করে তার বক্তৃতা শুনতে লাগলেন।
মিস মারপল সিঁড়ি বেয়ে নিচের তলায় চলে গেলেন। তার পেছন পেছন এলেন মিস কুক আর মিস ব্যারো।
নিচে নেমে একটা খুনের ঘটনা নিয়ে কথা বলতে লাগলেন তারা। খুনটা হয়েছিল এই বাড়িতেই। সতেরোশো সালের কোন বছর।
কথিত আছে সেই সময় লেডি মোফাটের এক প্রেমিক ছিল। সে গোপন দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করতো আবার গোপন দরজা দিয়েই বেরিয়ে যেতো।
স্যার রিচার্ড মোফাট সাগরপাড়ে কোথাও ছিলেন। তিনি ফিরে এসে স্ত্রী আর তার প্রেমিককে ঘনিষ্ঠ ভাবে আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। তার পরেই সেই তরুণকে ছোরাবিদ্ধ অবস্থায় কার্পেটের ওপর পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।
কথা বলতে বলতে মিস কুককে লক্ষ্য করছিলেন মিস মারপল আর মনে করবার চেষ্টা করছিলেন কোথায় তাকে দেখেছেন।
ঠিক মনে পড়ে গেল। কিন্তু যখন তাকে দেখেছেন তখন মিস কুকের চুলের রঙ ছিল কালো। এখন তা গাঢ় হলুদ। ব্যাপারটা চিন্তায় ফেলে দিল তাকে।
নিচ তলা থেকে ডাইনিং হল পার হয়ে সকলে একসময় চলে এলেন সংলগ্ন বাগানে। মিস মারপল বাগানে একটি আসনে আরাম করে বসে পড়লেন।
ইতিমধ্যে মিস এলিজাবেথ টেম্পল এবং মিসেস রাইজেল পোর্টারও বাগানে নেমে এসেছেন।
মিস এলিজাবেথ টেম্পল মিস মারপলের পাশে এসে বসলেন।
দুজন কিছুক্ষণ নীরবে বসে থাকার পর এলিজাবেথ এই বাগান সম্পর্কে কথা বলতে আরম্ভ করলেন।
–এই চমৎকার বাগানের পরিকল্পনা করেছিলেন হেলম্যান সম্ভবত ১৭৯৮ কিংবা ১৮০০ খ্রিঃ। খুব প্রতিভাধর ছিলেন তিনি। খুব অল্প বয়সেই মারা যান।
–অল্প বয়সে মৃত্যু হয়েছে শুনলে বড় দুঃখ হয়। বললেন মিস মারপল। যে কোন জীবনই অসম্পূর্ণ থেকে যায় যদি মাঝপথে তার গতি স্তব্ধ করে দেওয়া হয়।
–আপনি এই ভ্রমণে এসেছেন কি বাড়ি দেখতে না বাগান? এলিজাবেথ টেম্পল বললেন।
–বাড়ি দেখতেই এসেছি, বললেন মিস মারপল, এক দয়ালু বন্ধু আমার জন্য এই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সেরকম বিখ্যাত বাড়ি দেখার সুযোগ জীবনে পাইনি।
একটু থেমে তিনি আবার বললেন, আপনি প্রায় ভ্রমণে বের হন?
প্রায়ই না। এবারে অবশ্য শুধু ঘুরে বেড়াব বলেই আসা নয়। আপনি নিশ্চয় ভাববেন, তাহলে কি উদ্দেশ্য নিয়ে বেরিয়েছি ভেবে, তাই না?
মিস মারপল সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তীক্ষ্ণ নজরে তিনি যেন তার সঙ্গিনীকে জরীপ করতে লাগলেন।
পরে তিনি বললেন, আমি জানি আপনি একজন বিখ্যাত মানুষ। আপনার স্কুলেরও খুব নামডাক আছে। আপনাকে দেখে মনে হয়, আপনি তীর্থযাত্রায় এসেছেন। তীর্থযাত্রী বলেই মনে হয় আপনাকে।
–চমৎকার বলেছেন। হ্যাঁ, আমি তীর্থযাত্রাতেই বেরিয়েছি।
মিস পারপল দু-এক মুহূর্ত নীরব থাকার পরে বললেন, যে বন্ধু আমার জন্য এই ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, তিনি মারা গেছেন। তার নাম আপনিও নিশ্চয় শুনে থাকবেন মিঃ র্যাফায়েল।
জ্যাকসন র্যাফায়েল? হ্যাঁ, তার নাম আমার পরিচিত। অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে তাকে চিনি না বা দেখিনি। আমাদের এক শিক্ষা প্রকল্পে তিনি প্রচুর অর্থ দান করেছিলেন। কয়েক সপ্তাহ আগে কাগজে তার মৃত্যু-সংবাদ পড়েছি। তিনি তাহলে আপনার পুরনো বন্ধু ছিলেন।
–না, বললেন মিস মারপল, একবছর আগে ওয়েস্ট ইণ্ডিজে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তার আগে তার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানতাম না। আপনি তার পরিবারের কাউকে চিনতেন?
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন এলিজাবেথ। পরে বললেন, একটি মেয়ে একসময় আমার স্কুলে পড়ত, সে মিঃ রাফায়েলের ছেলের বাগদত্তা ছিল।
–ছেলেটি ওকে বিয়ে করেনি? জানতে চান মিস মারপল।
–না।
–কিন্তু কেন?
–আমি ঠিক জানি না। ছেলেটির আগ্রহ জাগাবার মতই চেহারা ছিল। মেয়েটি অত্যন্ত সুন্দর ছিল দেখতে। তবু কেন যে ওদের বিয়ে হয়নি…মেয়েটি মারা যায়…
–মারা যায়…কিন্তু কেন?
এলিজাবেথ অন্যদিকে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি একটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করলেন, ভালোবাসা।
–ভালোবাসা? মিস মারপল যেন কথাটার প্রতিধ্বনি করলেন।
–হ্যা…পৃথিবীর সবচেয়ে ভয় জাগানো কথা–ভালোবাসা।
.
০৭.
বিকেলে চতুর্দশ শতাব্দীর একটা প্রাচীন গীর্জা দেখতে গিয়েছিল সকলে। মিস মারপল ইচ্ছে করেই বিরতি দিয়েছিলেন। তিনি একটু বিশ্রাম করে বড় রাস্তার ধারে চা-ঘরে হাজির হলেন।
একটা আরামপ্রদ আসনে বসে তিনি ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে ভাবতে লাগলেন।
ইতিমধ্যে অন্যরাও ফিরে এসেছে। মিস মারপলের পাশের দুটি চেয়ারে এসে বসলেন মিস কুক আর মিস ব্যারো। চতুর্থ চেয়ারটিতে বসলেন মিঃ ক্যাসপার।
মিস মারপল মিস কুককে জিজ্ঞেস করলেন, আমার কেমন মনে হচ্ছে, আপনাকে আগে কোথাও দেখেছি।
মিস কুক তার বান্ধবী মিস ব্যারোর দিকে তাকালেন। যেন একথার জবাবটা তিনিই দেবেন। মিস মারপলও মিস ব্যারোর দিকে তাকালেন। পরে বললেন, আমি সেন্ট মেরী মিডে থাকি। মাচ বেনহ্যাম থেকে বেশিদূরে নয়। আমার কাছাকাছি কোথাও আপনি ছিলেন কিনা মনে করতে পারছি না।
–মাচ বেনহ্যাম, লুমাউথ আমি ভালই চিনি। সম্ভবত
আচমকা খুশি হওয়ার মত শব্দ করে মিস মারপল বলে উঠলেন, মনে পড়েছে হা–সেন্ট মেরী মিডে আমার বাগানে একদিন আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম, আপনি ফুটপাথ দিয়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। আমার মনে পড়ছে, আপনি বলেছিলেন, ওখানেই কোন বান্ধবীর সঙ্গে…।
–ঠিক! এবারে আমারও মনে পড়েছে। আমরা বাগানের বিষয়ে কথা বলেছিলাম।
–হ্যাঁ, আপনি কোন বান্ধবীর ওখানে গিয়েছিলেন সম্ভবত।
–হ্যাঁ,.. আমার একজন বান্ধবী…
মিস কুক কেমন ইতস্তত করতে লাগলেন যেন বান্ধবীর নামটা মনে করতে পারছেন না।
–হেস্টিংস। বললেন মিস ব্যারো।–
হ্যাঁ হ্যাঁ…নতুন বাড়িগুলোর কোন একটায়…মিস মারপল বললেন।
–আমরা সকলেই দেখছি বাগান ভালোবাসি।
.
রাতের খাওয়া সেরে মিস মারপল ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। মিস কুকের ব্যাপারটা তার মাথায় গেঁথেছিল। তিনি স্বীকার করেছেন সেন্ট মেরী মিডে ছিলেন…তার বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন।
মিস মারপল চিন্তা করলেন তার ওখানে আসার বিশেষ কোন উদ্দেশ্য ছিল কি? তাকে কি ওখানে পাঠানো হয়েছিল? কিন্তু তার উদ্দেশ্য কি ছিল?
একটু পরে নিজের চিন্তার গতি উপলব্ধি করে তিনি নিজের মনেই হেসে উঠলেন। এসব কি ভাবছেন তিনি। মিস কুক আর মিস ব্যারোকে দুজন স্বাভাবিক মানুষ বলেই মনে হয়। দেখে বেশ হাসিখুশি বলেই মনে হয়।
কিন্তু…কিন্তু মিস কুক যেন মনে হল প্রথমে সেন্ট মেরী মিডে থাকার কথা অস্বীকার করতে চাইছিলেন। তিনি তাঁর বান্ধবী মিস ব্যারোর দিকে তাকিয়েছিলেন কেন? কোন নির্দেশ চাইছিলেন কি?
আচমকা মিস মারপলের মনে বিপদ কথাটা ছায়া ফেলল। প্রথম চিঠিতে মিঃ র্যাফায়েল কথাটা উল্লেখ করেছিলেন।
এই সূত্রেই দ্বিতীয় চিঠিতে দেবদূতের সাহায্যে কথা বলেছিলেন।
তিনি এই ব্যাপারে বিপদে পড়তে পারেন…কিন্তু কেন….কোন দিক থেকে?
নিশ্চয় মিস কুক বা মিস ব্যারোর কাছ থেকে নয়? খুবই সাধারণদর্শন দুই বান্ধবী।
কিন্তু এটাও তো ঠিক যে মিস কুক তার চুল রঙ করে, চুলের বিন্যাস বদলে চেহারার আদল পাল্টাতে চেয়েছেন।
একে নিশ্চয় ছদ্মবেশই বলতে হবে। ব্যাপারটা নিশ্চয় অদ্ভুত।
মিঃ ক্যাসপার–মানুষটিকে সহজেই বিপজ্জনক বলে মেনে নেওয়া যায়। তিনিও পাশে বসেছিলেন। দু-একবার কথায় অংশ নিতেও চেষ্টা করেছেন।
বিদেশীদের সম্পর্কে কিছুই বলা যায় না। মিস মারপল বিদেশী যাত্রীদের বিষয়ে না ভেবে পারলেন না।
.
গোল্ডেন বোরো নিজের কামরা থেকে বেরিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য নিচে নামছিলেন। এই সময় টুইডের কোট পরিহিতা একজন মহিলা ব্যস্তসমস্ত ভাবে সামনে এসে দাঁড়াল।
–মাপ করবেন, আপনিই কি মিস জেন মারপল?
–হ্যাঁ, ওটাই আমার নাম। একটু অবাক হলেন মিস মারপল।
-আমার নাম মিসেস গ্লাইন-ল্যাভিনিয়া গ্লাইন। আমি আর আমার দুই বোন কাছেই থাকি। আমরা শুনেছিলাম আপনি আসছেন–
–আপনারা শুনেছেন আমি আসছি
অবাক হয়ে ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করলেন মিস মারপল।
–হ্যাঁ। আমাদের এক পুরনো বন্ধু লিখেছিলেন। তিনি বিখ্যাত হাউজেন অ্যাণ্ড গার্ডেনসের ভ্ৰমণতারিখ জানিয়ে বলেছিলেন তার এক নামী বন্ধু এই ভ্রমণে থাকবেন। আমরা যেন তারিখটা মনে রাখি।
মিস মারপল ঘটনার আকস্মিকতায় কথা হারিয়ে ফেলেছিলেন।
-ওঃ! মিঃ র্যাফায়েল, মিস মারপল বলতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু আপনারা জানেন, তিনি…
–হ্যাঁ, তিনি মারা গেছেন। খুবই দুঃখের কথা। মনে হয়, আমাদের কাছে লেখার কিছু পরেই তার মৃত্যু ঘটে। তিনি যা বলেছেন তা হল, আপনি হয়তো দু-এক রাত আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে যেতে পছন্দ করবেন।
ভ্রমণের পরবর্তী অংশ আপনার পক্ষে খুবই কষ্টকর হবে। বহু মাইল হেঁটে খাড়াই বেয়ে ওপরে ওঠার দরকার হবে।
আমরা তিনবোন খুবই খুশি হব যদি আপনি কয়েকটা দিন আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে যান। হোটেল থেকে আমাদের বাড়ি মাত্র দশ মিনিটের পথ। এই কদিন স্থানীয় ভাবে অনেক সুন্দর জিনিস আপনাকে দেখিয়ে দিতে পারব।
মিস মারপল নীরবে মিসেস গ্লাইনকে পর্যবেক্ষণ করলেন। হৃষ্টপুষ্ট চেহারার মানুষটিকে বেশ বন্ধুভাবাপন্ন বলেই মনে হলো তার।
দু-এক মিনিট ভাবলেন তিনি। এটা কি মিঃ র্যাফায়েলেরই নির্দেশ…তার পরবর্তী কর্তব্য সম্পর্কে! তিনি মিসেস গ্লাইনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ধন্যবাদ, আপনাদের ওখানে যেতে পারলে সত্যিই খুশি হব।
.
০৮.
প্রাচীন এক জমিদার ভবন। তার একটি ঘরে বিছানায় বসে আছেন মিস মারপল। পাশেই পড়েছিল তার সুটকেস।
জানলা দিয়ে বাগানের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল, খুবই অযত্নে লালিত। সম্ভবত কয়েক বছর পরিচর্যা হয়নি। বাড়িটিও অবহেলিত। ঘরের আসবাবপত্রও খুবই মূল্যবান, কিন্তু তাতে বহুকাল পালিশ পড়েনি।
এই ভবনের লোকজনেরা হয়তো অন্য কোথাও চলে যাওয়ার পরে মিসেস গ্লাইনরা এখানে বাস করতে এসেছেন। তার মুখেই তিনি শুনেছেন, বাড়িটি উত্তরাধিকার সূত্রে মিসেস গ্লাইন তার কোন কাকার কাছ থেকে পেয়েছেন। স্বামী মারা যাবার পরে বোনেদের নিয়ে এখানে বাস করতে আসেন।
অন্য দুই বোন অবিবাহিতই রয়ে গেছেন। তারা হলেন মিস ব্র্যাডবেরি ও মিস স্কটস।
বাড়িতে কেবল তিন বোনই থাকেন। কোথাও কোথাও এমন কিছু নেই যা থেকে কোন শিশুর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। এরা রুশীয়–শেখভ বা দস্তয়ভস্কি এরকম কিছু হবেন, মনে হল তার।
গ্লাইন তাকে অন্য দুই বোনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তাদের হাবভাব বেশ মার্জিত।
বাগানের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল, এই ক্ষয়িষ্ণু পরিবারটির সঙ্গে মিঃ র্যাফায়েলের সম্পর্ক কি রকম? বুঝতে পারছিলেন, তার এখানে আসার সকল ব্যবস্থা তিনিই করে গেছেন। মৃত্যুর কয়েকমাস আগেই সম্ভবত সবকিছু করেছেন।
মিস মারপলের মনে হল তার ওপর যে দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে, তিনি যেন ধীরে ধীরে তা বুঝে নিতে পারছেন।
সুন্দর এক পরিকল্পনা বেশ অনেকদিন ধরে চিন্তার পর, ছকে ছিলেন মিঃ র্যাফায়েল। কিন্তু কী এমন সমস্যায় পড়েছিলেন তিনি যার জন্য এমন বিস্তৃত এক পরিকল্পনা নিতে হয়েছিল তাকে?
এ সমস্যা এমনই যে মিঃ র্যাফায়েল নিজে সমাধান করতে পারেননি। সময়ও ছিল না, শয্যাশায়ী হয়ে তিনি মৃত্যুর দিন গুণছিলেন।
নিশ্চয় এমন কিছু ব্যাপার ছিল বা কেউ যার কোন ব্যবস্থা তিনি করে যেতে পারেন নি। নিশ্চয় অর্থের বিনিময়ে এই সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব ছিল না। ব্যবসায়িক চাল বা আইনজ্ঞের সাহায্যেরও বাইরে ছিল না।
তবে, মিস মারপলের মনে হল, বিষয়টা নিশ্চয়ই অপরাধমূলক কিছু বা অপরাধের সঙ্গে তার যোগসূত্র রয়েছে।
ওয়েস্ট ইণ্ডিজে, তার এলাকায় ঘটে যাওয়া কোন অপরাধ হওয়াও বিচিত্র নয়।
যাই হোক, ভাগ্যের কিছু আনুকূল্য, সঙ্গে কঠিন শ্রম আর চিন্তা, সেই সঙ্গে কিছু পরিমাণে বিপদ–এই দুজ্ঞেয় বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশেষ সেই কাজের জন্য তাকে সেন্ট মেরী মিডের বাড়ি থেকে বাইরে নিয়ে আসা হয়েছে। জোসেলিন সেন্ট মেরীর এই প্রাচীন জমিদার ভবনে বাস করছেন মিসেস গ্লাইন, মিস ক্লোটিলডা ব্র্যাডবেরি স্কট আর মিসেস অ্যানথিয়া ব্র্যাডবেরি স্কট। তার এখানে আসার ব্যবস্থা মিঃ র্যাফায়েলই করে গেছেন মৃত্যুর আগে। তার আইনজ্ঞদের নির্দেশ দিয়ে নিশ্চয় ভ্রমণ সংস্থার আসন সংরক্ষণ করেছিলেন। বিশেষ কোন উদ্দেশ্য ছাড়া–কেবল দুটি রাতের জন্য, এমন বন্দোবস্ত করা তার মত লোক কখনোই করেননি।
মিস মারপলের ধারণা হল, মিসেস গ্লাইন আর তার দুটি বোন নিশ্চিত সেই ব্যাপারটির সঙ্গে জড়িত। তাকে তা বের করতে হবে।
খুব সতর্ক হয়ে তাকে পদক্ষেপ করতে হবে। কোন ভাবেই, কোন সংবাদেই উত্তেজনা বা কৌতূহল প্রকাশ করা তার ঠিক হবে না।
সচেতন থেকে তাকে বের করতে হবে কোন আত্মীয়তা বা ঘটনা বা জীবনের ঘটনার কথা যা এই তিন বোনের সঙ্গে জড়িত নয় অথচ এদের কাছাকাছিই ঘটে থাকবে সেই ঘটনা।
যাই হোক, দুদিন এখানে থাকবেন স্থির করলেন তিনি। তারপরে আবার ভ্রমণে যোগ দেবেন। হয়তো তিনি যা চাইছেন, তা ওই কোচেই রয়েছে।
একজন বা বহুজন, কোন নির্দোষ বা নির্দোষ নন, হয়তো দীর্ঘ অতীতের কোন কাহিনী।
এই সময় দরজায় শব্দ করে মিসেস গ্লাইন ঘরে প্রবেশ করলেন।
আশা করি আরাম বোধ করছেন এখানে। আপনার জিনিসপত্র বের করে দেব?
–ওঃ ধন্যবাদ। টুকিটাকি সামান্য জিনিসটা আমিই বার করে নিয়েছি।
এরপর বাড়ির নিচতলাটা দেখাবেন বলে মিসেস গ্লাইন মিস মারপলকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন।
–বাড়িটা সত্যিই চমৎকার, বললেন মিস মারপল, ১৭০০ সালে তৈরি মনে হয়।
–১৭৮০ সালে। বললেন মিসেস গ্লাইন।
চমৎকার বড় একখানা ঘরে এনে বসানো হলো মিস মারপলকে। অন্য দুই বোন সেই সময় ঘরেই ছিলেন।
তিন বোন। ল্যাভেনিয়া গ্লাইন। ক্লোটিলডা ব্র্যাডবেরি স্কট। অ্যানথিয়া ব্র্যাডবেরি স্কট।
মিস মারপল তিন বোনকে কথার ফাঁকে ফাঁকে লক্ষ্য করতে লাগলেন।
ক্লোটিলডা সুন্দরী। ল্যাভেনিয়া সরল। অ্যানথিয়া আকর্ষণীয়া। তার একটি চোখের পাতা মাঝে মাঝেই কেমন কেঁপে ওঠে। আচমকা পেছনে ফিরে তাকায়। এতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। যেন কেউ তাকে সব সময় লক্ষ্য করছে। অ্যানথিয়ার এই অভ্যাসটা খুবই অদ্ভুত মনে হল মিস মারপলের।
.
০৯.
মাত্র তিনদিন হয়েছে। মিস মারপল ভ্রমণে বেরিয়েছেন। ভ্রমণের বিষয়ে বিবরণ দেবার তেমন কিছু ছিল না।
–মিঃ র্যাফায়েল নিশ্চয় আপনার পুরনো বন্ধু ছিলেন? জ্যেষ্ঠ বোন ব্র্যাডবেরি স্কট প্রশ্ন করলেন।
–ঠিক তা নয়, বললেন মিস মারপল, তাঁকে প্রথম দেখি–যখন ওয়েস্ট ইণ্ডিজে যাই। সম্ভবত তিনিও সেখানে স্বাস্থ্য ফেরাতে গিয়েছিলেন।
-হ্যাঁ। শেষ দিকে তিনি অক্ষম হয়ে গিয়েছিলেন, অ্যানথিয়া বললেন, আপনি লণ্ডনে থাকেন?
-না, গ্রামের দিকে থাকি। লুমাউথ আর মার্কেট বেসিংয়ের মাঝামাঝি আমাদের গ্রামটা। লণ্ডন থেকে পঁচিশ মাইল। মিঃ র্যাফায়েল মনে হয় লণ্ডনেই থাকতেন?
–কেন্টে তাঁর এক বাগানবাড়ি ছিল ক্লোটিলডা বললেন, কালেভদ্রে লণ্ডনে গেলে তার সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হত।
-আপনারা আমাকে যে অনুগ্রহ করে নিমন্ত্রণ জানালেন এটা তার সদাশয়তা।
এর আগে তাঁর অনেক বন্ধুকেই ভ্রমণের ফাঁকে আমরা নিমন্ত্রণ করে এনেছিলাম, বললেন ক্লোটিলডা, আগামীকাল সেন্ট বোনাভেঞ্চারে আপনাদের ভ্রমণ খুবই ক্লান্তিকর হবে।
-আপনি বাগান ভালবাসেন? অ্যানথিয়া বললেন।
–হ্যাঁ। এদের তালিকায় ঐতিহাসিক ভবন আর সংলগ্ন চমৎকার বাগান দেখতে পাব বলে উদগ্রীব হয় আছি।
এইরকম কথোপকথন ছিল খুবই সাধারণ আর নীরস। সবই স্বাভাবিক মনে হলেও মিস মারপলের মনে হল এখানে অস্বাভাবিক কিছু আছে।
মধ্যহ্নভোজের পরে মিস মারপলকে বাগানে নিয়ে যাওয়া হল। বাগানটি হতশ্রীই বলা যায়। কিছু গুল্ম আর কিছু লতা গাছ। একদিকে বিস্তর ঝোপ গজিয়ে উঠেছে।
অ্যানথিয়া সঙ্গী হয়েছিল তার। ঘাসের ওপর দিয়ে চলতে চলতে দেয়ালের পাশে একটা ঢিবির কাছে এসে দাঁড়ালেন।
–এটা আমাদের কাচ-ঘর। বললেন অ্যানথিয়া। চারদিকটা ভাঙ্গাচোরা। লতাগুল্ম জড়িয়ে আছে।
একটা ফুল দেখিয়ে মিস মারপল জিজ্ঞেস করলেন, এ তলার নাম কি?
-খুব সাধারণ লতাগাছ। বললেন অ্যানথিয়া, নামটা পি দিয়ে…ঠিক মনে পড়ছে না।
–নামটা আমার জানা আছে, বললেন মিস মারপল, পলিগোনাম বল্ডস্কৃয়ানিকাম। খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে। কাচ-ঘরটি বেশ বড় ছিল বোঝা যায়।
অ্যানথিয়া তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে এসে দেওয়ালের পাশের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলতে লাগল।
মিস মারপলের মনে হল, ইচ্ছাকৃত ভাবেই পলিগোনামের ঢিবি থেকে তাকে সরিয়ে নিতে চাইছে অ্যানথিয়া।
হঠাৎ একটা ভাঙ্গা শুয়োরের খোঁয়াড়ের ওপর নজর পড়ল তার। সেটার চারপাশে কয়েকটা গোলাপ চারা গজিয়ে উঠেছে।
চলতে চলতে আচমকাই অ্যানথিয়া প্রশ্ন করল,আপনি প্রায়ই এরকম ভ্রমণে আসেন?
-খুব খরচের ব্যাপার তো। হয়ে ওঠে না। একজনের দয়ায়—
ওয়েস্ট ইণ্ডিজ বা এরকম জায়গায় যান—
আমার ভাইপোর কল্যাণে যাওয়া হয়েছিল।
–ওঃ বুঝেছি।
–আপনার বোন মিসেস গ্লাইনের কোন ছেলেমেয়ে নেই? জিজ্ঞেস করলেন মিস মারপল।
–না ওদের কোন সন্তান হয়নি। একদিকে সেটা ভালই হয়েছে।
কথাটা কেমন খট করে কানে গেঁথে গেল। এরকম কেন বলল, ভাবলেন মিস মারপল
.
১০.
পরদিন সকালের চা-খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকল একটি স্ত্রীলোক।
হাতের ট্রে টেবিলে রাখতে রাখতে সে বলল, বোনাভেঞ্চার পাহাড়ে না গিয়ে ভালই করেছেন। পায়ে খুব ব্যথা হতো।
–এখানে এসে আমি খুব আনন্দ পেয়েছি, বললেন মিস মারপল।
–বাড়িতে কেউ এলে আমাদেরও খুব ভাল লাগে। এ বাড়িটা আজকাল খুবই দুঃখের হয়ে উঠেছে।
-তুমি এ বাড়িতে অনেকদিন আছ?
–খুব ছোট বয়সে এসেছিলাম–পরিচারিকা হয়ে। সেই বুড়ো কর্নেলের আমলে। কর্নেলের দুর্ভাগ্য নিজের চোখেই দেখেছি। অল্পবয়সে স্ত্রীকে হারালেন, যুদ্ধে ছেলেটাও মারা গেল। এক মেয়ে ছিল সেও নিউজিল্যাণ্ডের একজনকে বিয়ে করে বিদেশে চলে যায়। একাই তিনি এখানে বাস করে গেছেন। মারা যাবার সময় ভাইঝি ক্লোটিলডাকে আর তার অন্য দুই বোনকে এ বাড়ি দিয়ে যান। তিনি আর মিস অ্যানথিয়া বাস করতে থাকেন। পরে স্বামী মারা গেলে ল্যাভিনিয়াও চলে আসে। তারপর থেকে, ওদের ক্ষমতা ছিল না, দিনে দিনে বাড়িটা, বাগানটাও নষ্ট হতে থাকে।
-খুবই দুঃখের কথা। বললেন মিস মারপল।
–তবে ওরা সবাই খুব ভাল। কেবল অ্যানথিয়া যেন কেমন কেমন। জানেন, আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, বাড়িটায় কোন দোষ আছে।
মিস মারপল স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন পরিচারিকার দিকে।
-একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। স্পেনে যুদ্ধ লাগল–সবাই মারা গেল। মিস ক্লোটিলডার দুই বন্ধু মারা গেলেন। তারা স্বামী-স্ত্রী ছিলেন। একটা মেয়ে সৌভাগ্যবশত স্কুলে ছিল বলে সে বেঁচে যায়। তবে মিস ক্লোটিলডা তাকে এখানে নিয়ে এসে সবই করেছিলেন তার জন্য। খুব হাসিখুশি, মিষ্টি স্বভাব ছিল মেয়েটির। কী ভয়ানক ব্যাপার যে ঘটল, আপনি ভাবতেও পারবেন না।
–কি হয়েছিল? ভয়ানক কিছু ঘটেছিল এখানে?
–তা এখানেই ঘটেছিল বলতে পারেন। সে তাকে এখানেই প্রথম দেখে। কাছাকাছিই থাকতো। তিন বোনই তার বাবাকে চিনতেন–দারুণ পয়সাওয়ালা লোক। ছেলেটি এখানে বেড়াতে এসেছিল–আর তখন থেকেই শুরু হয়–
–ওরা প্রেমে পড়েছিল?
–হ্যাঁ। ছেলেটির চমৎকার চেহারা ছিল। আপনি ভাবতে পারবেন না কী সাংঘাতিক –
মেয়েটি আত্মহত্যা করেছিল?
–বৃদ্ধা আশ্চর্য হয়ে তাকাল মিস মারপলের দিকে।
-ওঃ ওসব নয়–খুন–একেবারে খুন। গলা টিপে মেরে তার মাথাটা একেবারে খেলে দেওয়া হয়েছিল। মিস ক্লোটিলডাকে গিয়ে সনাক্ত করতে হয়েছিল। তার পর থেকেই তিনি কেমন হয়ে গেলেন।
একটু থামল সে। পরে আবার বলতে শুরু করল, এখান থেকে ত্রিশ মাইল দূরে একটা পরিত্যক্ত খনির পাশে ঝোপের মধ্যে তার দেহটা পাওয়া গিয়েছিল। এরা সবাই বলে, এরকম অনেক মেয়েই নাকি সে খুন করেছিল। ছমাস ধরে মেয়েটা নিরুদ্দেশ ছিল। পুলিসও খুঁজে পায়নি।
ওরা বলে আজকাল যারা এরকম মেয়েদের মারে, তাদের নাকি মাথার ঠিক নেই। তাদের ফাঁসিও দেয় না। আমি ওসব বিশ্বাস করি না। ওই ছেলেটা…পাকা শয়তান ছিল।
-ওরা তাকে কি করেছিল?
–ওর বয়স কম ছিল। ঠিক মনে নেই আমার, ফাঁসি দিয়েছিল না, বোস্টল বা ব্রডম্যাণ্ড এমনি কোন একটা জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছিল।
–ছেলেটির নাম কি ছিল বলতো।
দশ বছর আগের ঘটনা–সব মনেও নেই। কি যেন মাইকেল–তারপর মনে হয় র্যাফল
–মাইকেল র্যাফায়েল?
–ঠিক বলেছেন।
মিস মারপল নিঃশ্বাস ফেললেন। তাহলে এখন বোঝা যাচ্ছে এই খুনের কারণটাকেই এলিজাবেথ টেম্পল বলেছিলেন ভালবাসা।
এক তরুণী কোন খুনীর প্রেমে পড়েছিল। সেই প্রেমেই তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।
ঘটনাটা ভাবতে গিয়ে শিহরিত হলেন মিস মারপল।
সেদিন সকালেই নিচে নেমে গৃহকর্ত্রীকে দেখতে পেলেন না কোথাও। তিনি বাগানে এসে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। একটা অদ্ভুত অনুভূতি তার সারা মন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তার মনে হতে লাগল, এই বাগানে এমন কিছু আছে যা তার প্রয়োজন–যা তাঁর লক্ষ্য করা দরকার। জেনেটের বলা ঘটনাটা লক্ষ্য করবেন স্থির করলেন।
দেয়ালের গায়ে একটা ভোলা দরজা দিয়ে মিস মারপল রাস্তায় এসে পড়লেন। কিছু দোকানপাট পার হয়ে একটা গীর্জার চত্বরে ঢুকলেন। কয়েকটি সমাধির কাছে ঘুরে বেড়ালেন।
পুরনো দিনের সব সমাধি। কয়েকটির গায়ে কয়েকজন প্রিন্সের নাম চোখে পড়ল। আর কয়েকজন ব্রড।
ফিরে আসার পথে একজন বয়স্ক মহিলার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হল। তাকে সুপ্রভাত জানিয়ে কথা শুরু করলেন তিনি।
কথার মাঝখানে সেই মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ওই পুরনো জমিদার বাড়িতে আছেন, তাই না?
–হ্যাঁ বললেন মিস মারপল, আমার এক পুরনো বন্ধু মিঃ র্যাফায়েল এখানে তার কজন বন্ধুকে লিখেছিলেন, তারাই কয়েকটা রাত কাটাবার জন্য নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মিসেস গ্লাইন আর তার দুই বোন খুব যত্ন করেছেন। তারা সম্ভবত অনেককাল এখানে আছেন?
–তেমন বেশিদিন নয়–বছর কুড়ি হবে। বাড়িটা ছিল কর্নেল ব্র্যাডবেরি স্কটের।
কর্নেলের কোন ছেলেমেয়ে ছিল না?
–এক ছেলে ছিল, সে যুদ্ধে মারা গিয়েছিল। সেজন্যই তো বুড়ো ভাইঝিকে বাড়িটা দিয়ে গেছেন।
কথা শেষ করে বৃদ্ধাটি কবরের সারির দিকে চলে গেল। মিস মারপল গির্জায় প্রবেশ করলেন।
একটা ছোট আসনে বসে মিস মারপল নানা কথা চিন্তা করতে লাগলেন।
দশ-বারো বছর আগের ঘটনা। নতুন করে কোন সমস্যার সমাধান করার কিছু নেই। এতে তার কিই বা করার আছে। মিঃ র্যাফায়েল কি আশা করেছিলেন তার কাছে?
এলিজাবেথ টেম্পল নিশ্চয় আরো কিছু বলতে পারেন। তিনি তার এক ছাত্রীর কথা জানিয়েছিলেন, সে মাইকেল র্যাফায়েলের বাগদত্তা ছিল। কিন্তু সত্যিই কি তাই?
তার গ্রামেও এমনি একটি ঘটনা ঘটেছিল। বিয়ের আগেই সে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিল। এরপর মেয়েটি ছেলেটিকে বিয়ের কথা বলে। ছেলেটির ততদিনে মেয়েটিকে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তার অন্য সঙ্গিনী জুটেছিল। নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে সে মেয়েটিকে। তারপর যাতে আত্মীয়স্বজন সনাক্ত করতে না পারে তার জন্য মেয়েটির মুখ গুঁড়িয়ে দিতে চেষ্টা করল। সব যেন একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি।
ওরা তিন বোন কি কিছু জানে? এলিজাবেথ টেম্পল? কালতো আবার সকলের সঙ্গে তিনি ভ্রমণে যোগ দেবেন। তখন তার কাছ থেকে আরও কিছু জানার চেষ্টা করবেন।
কিছুক্ষণ পরে উঠে দাঁড়ালেন মিস মারপল। ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।
গেটের কাছে আসতেই দেখলেন দুজন স্ত্রীলোক দাঁড়িয়ে আছে। একজন এগিয়ে এলো–মিসেস গ্লাইন।
-আপনি এখানে? আমরা চিন্তা করছিলাম।
–প্রাচীন গির্জাটা একটু ঘুরে দেখছিলাম। বললেন মিস মারপল, এটা মনে হয় ভিক্টোরিয়ার আমলের।
-হ্যাঁ।
আপনারা এখানে আগাগোড়াই আছেন?
–না। মাইল ত্রিশেক দূরে আমরা থাকতাম। লিটল হার্ডসনেতে। আমার বাবা ছিলেন অশ্বারোহী বাহিনীর মেজর। কাকাকে দেখতে প্রায়ই আমরা এখানে আসতাম। তারও আগে আসতাম ঠাকুর্দাকে দেখতে। আমার বোনেরা কাকার মৃত্যুর পর এখানে চলে আসে। সেসময় আমি স্বামীর সঙ্গে বিদেশে ছিলাম। বছর পাঁচ আগে তিনি মারা গেছেন। ওরাই আমাকে আগ্রহ করে এখানে নিয়ে আসে। স্বামীর মৃত্যুর আগে আমি স্বামীর সঙ্গে কয়েকবছর ভারতবর্ষেও ছিলাম।
-ওহ আচ্ছা
লণ্ডনের কাছে আমি ছোট একটা কটেজও কিনেছি–হ্যাম্পটন কোর্টে। মাঝে মাঝে লণ্ডনের দু-একটা দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করতে হয়, সেজন্য বোনেদের কাছে বেশি থাকা হয় না। ওদের নিয়ে আজকাল খুব চিন্তা হয়। বিশেষ করে অ্যানথিয়ার জন্য ভাবনা হয়। মাঝে মাঝে যেন কেমন হয়ে যায়। দেখেছেন তো
-হ্যাঁ। খুব ভাবনাচিন্তা করলে মানুষের এরকম হয়।
–কিন্তু, ওর চিন্তাভাবনার কি কারণ থাকতে পারে বুঝতে তো পারি না। বাগানটা নিয়ে খুব চিন্তা করে অবশ্য। কাচঘর, পীচ, আঙুরলতা এসবের কথা খুব বলে
–দেওয়ালের গায়ে চেরি পাই-এর কথাও–এছাড়াও সেই ফুলের বেড়া
–আপনি দেখছি মনে রেখেছেন। সেই ফুলের বেড়া আবার ও লাগাতে চায়। অনেক কিছুই নতুন করে লাগাতে চায়। ক্লোটিলডা অবশ্য ওকে বলে এখন আর অত খরচ সম্ভব নয়। তবু কি শোনে, কদিন আগে এক নামী কোম্পানিকে বাগানটা সাজিয়ে তোলার জন্য বায়না দিয়েছে। কাচঘর নাকি আবার আগের মত করে তুলবে।
আজকাল সবেতেই খুব খরচ। কিছু করা কঠিন। বললেন মিস মারপল।
একটু চুপ করে থেকে তিনি বললেন, কাল সকালেই তো আমাকে যেতে হবে। গোল্ডেনবোরে খোঁজ নিয়েছিলাম। সকাল নটায় ওখানেই যাত্রীরা ফিরে এসে আবার যাত্রা করবেন। শুনেছি এবারে আমাদের দেখানো হবে স্টারলিং সেন্ট মেরী-গির্জা আর কেল্লা
-বেশ। আজ বিকালটা বিশ্রাম নিয়ে নিন। কথা বলতে বলতে ওরা দুজন বাড়িতে ঢুকলেন।