এন্ডলেস নাইট – আগাথা ক্রিস্টি
অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ
প্রথম পর্ব
০১.
আমাদের জীবনে কোন ঘটনা যে কি পরিণতি নিয়ে আসবে তা কি আগে থেকে কেউ বলতে পারে, না বুঝতে পারে!
কখন দুর্দৈব নেমে আসবে কিংবা ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে এর কোনটাই আমাদের জানার সীমানায় থাকে না। আমারও হয়েছে তাই।
এই ঘটনাকে দুটো পর্বে ভাগ করা চলে, এবং বলতে হলে যে কোন দিক থেকেই শুরু করা যায়। তবে আমি জিপসি একর থেকেই শুরু করব।
হ্যাঁ, জিপসি একর।
সেদিন হাতে বিশেষ কাজ ছিল না। কিংসটন বিশপের প্রধান সড়ক ধরে খেয়াল খুশিমত হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম। এদিকটায় সচরাচর আসা হয় না। আজ কি মনে হতে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছিলাম।
হঠাৎ জর্জ অ্যাণ্ড ড্রাগনের দেয়ালের নোটিশ বোর্ডে চোখ পড়ল। টাওয়ার নামে একটা পুরনো বনেদী বাগানবাড়ি নিলামে বিক্রির কথা লেখা রয়েছে তাতে।
টাওয়ারের বিশদ বিবরণও দেওয়া হয়েছে।
বেশ কয়েক একর জায়গা জুড়ে বাগান বাড়ি। প্রাকৃতিক পরিবেশও মনোরম। প্রায় একশ বছরের পুরনো বাড়ি।
বিবরণ পড়ে বুঝতে পারলাম, একদিন যে বাড়ি লোকজনের সমাবেশে গমগম করত, এখন সেই গৌরবময় অতীত স্মৃতি বুকে আঁকড়ে ধরে পড়ে আছে একটা ধ্বংসস্তূপ।
এই যে আচমকাই ঘটনাটা ঘটল, অর্থাৎ টাওয়ার বিক্রির নোটিশটা আমার চোখে পড়ল এটা কোন দুর্দৈব না ভাগ্যের প্রসন্নতা, সেই মুহূর্তে বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারছি, দুদিক থেকেই ব্যাপারটাকে অনায়াসে নেওয়া যায়।
প্রসিদ্ধ স্থপতি স্যানটনিক্সের সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয়ের প্রসঙ্গটাও এই প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য। কেননা ভদ্রলোকের সঙ্গে প্রথম আলাপ পরিচয়ের দিন থেকেই এই কাহিনীর সূত্রপাত এমন মনে করলেও অযৌক্তিক হবে না।
স্যানটনিক্সের শীর্ণ, পাণ্ডুর গাল, অত্যুজ্জ্বল চোখ এই চেহারাটা চোখ বুঝলে এখনো পরিষ্কার দেখতে পাই।
দক্ষ হাতে তিনি কাগজের ওপরে নানান ছাঁদের বাড়ির নক্সা আঁকেন, আর সেসব বাড়ি বাস্তবে রূপদান করেন তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। তার মধ্যে বিশেষ একটা বাড়ি আবার এমনই সুন্দর যে দেখলে মনে হয়, এরকম একটা স্বপ্নময় বাড়ির মালিক না হতে পারলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকাই নিরর্থক।
মনের মত একটা বাড়ির মালিক হব এই সাধ আমার আবাল্যের। তাই আশা করতাম, আমার সেই স্বপ্নের সৌধ একদিন স্যানটনিক্সই বানাবেন আর ততদিন অবশ্যই বেঁচে থাকবেন।
নিলামের নোটিশ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে যখন বাইরে তাকালাম মনে হল আমার চোখের সামনে যেন স্বপ্নরাজ্যের সেই অসম্ভব সুন্দর বাড়িটা দেখতে পাচ্ছি।
সুপ্ত বাসনার কি মৃত্যু হয় না? তা না হলে যা অবিশ্বাস্য অসম্ভব কল্পনা তা বারে বারে ঘুরে আসে কেন? বুকের ভেতর তার শেকড় কি এতই গভীর?
রাস্তার মোড়ে একটা লোক বিশাল একটা কাঁচি দিয়ে পথের ধারের ঝোপঝাড় কেটে হেঁটে পরিষ্কার করছিল। সম্ভবত স্থানীয় পৌরসভারই নিম্নপদস্থ কর্মচারী।
পায়ে পায়ে তার কাছে এগিয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ভাই টাওয়ার নামের বাগান বাড়িটা এদিকে কোথায় বলতে পার?
আমার প্রশ্ন শুনে লোকটার মুখের চেহারা মুহূর্তে কেমন বদলে গেল। তার মুখের সেই ছবি আজও আমি ভুলতে পারিনি।
আমার দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকাল। কি ভাবল। পরে বলল, ওই নামে আজকাল আর কেউ ডাকে না। পুরনো দু চারজন মনে রেখেছে। অনেক বছর আগে যারা ওখানে বাস করত তারাই বাড়িটার টাওয়ার নাম রেখেছিল।
–তাহলে জায়গার এখন কি নাম হয়েছে? জানতে চাইলাম আমি।
প্রৌঢ় লোকটার চোখ মুখ কেমন থমথমে হয়ে উঠল লক্ষ্য করলাম। সে যেন যথেষ্ট বিরক্তির সঙ্গেই বলল, এখন সকলে বলে জিপসি একর।
–ভারী অদ্ভুত নাম তো? এরকম নামকরণ হল কেন?
-আমি অবশ্য সঠিক বলতে পারব না। নানান জনের কাছে এ নিয়ে নানান কাহিনী শোনা যায়। সেগুলো বড় অদ্ভুত।
–কি রকম বল তো ভাই। আমি কৌতূহল প্রকাশ করি। লোকটা যেন ক্রমশই কেমন রহস্যময় হয়ে উঠছিল।
রকম কিছুই না, জায়গাটাতেই বেছে বেছে দুর্ঘটনাগুলো বেশি ঘটে।
–মোটর অ্যাকসিডেন্ট নাকি?
–কেবল মোটর অ্যাকসিডেন্ট হলে তবু রক্ষা হত, অনেক রকমের অ্যাকসিডেন্টই ঘটে। তবে মোটর অ্যাকসিডেন্টের সংখ্যাই বেশি।
-কারণটা কি?
একটু এগিয়ে গেলেই দেখতে পাবেন, রাস্তাটা ওখানে বিশ্রী বাঁক নিয়েছে। বিপজ্জনক ওই পাহাড়ী বাঁকে অ্যাকসিডেন্ট হবে না তো কি?
এতটুকু বাড়িয়ে বলেনি লোকটা।
পাহাড়ী রাস্তাটা আচমকা বাঁক নিয়েছে এমন ভাবে যে একটু অসাবধান হলেই দুর্ঘটনার মুখে পড়া স্বাভাবিক।
চোখে পড়ল, বাঁকটার আগেই স্থানীয় পৌরসভার নোটিশ বোর্ড। বেশ বড় বড় করে বিপজ্জনক কথাটা লেখা রয়েছে।
লোকটি বলল, ওই বোর্ড কোন কাজ দেয় না। দুর্ঘটনা যে এর জন্য কমেছে তা নয়।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, জিপসি কথাটা ওর মধ্যে এলো কেন?
লোকটার ভ্রূজোড়া কুঁচকে উঠল। থেমে থেমে বলল, লোকের মুখে অনেক কথাই শোনা যায়। অনেক বছর আগে নাকি জিপসিরা ওখানে বাস করত। তাদের সেখান থেকে হটিয়ে ওই টাওয়ার বানানো হয়েছিল।
লোকটা একটু থামল। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
–চলে যাবার আগে জিপসিদের বুড়ো সর্দার নাকি ভীষণ অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিল।
লোকটার মুখে ওরকম একটা গ্রাম্য কথা শুনে আমি হেসে না উঠে পারলাম না।
লোকটা আমার হাসি দেখে রেগে গেল। রুক্ষস্বরে বলল, তোমাদের শহুরে লেখাপড়া শেখা ছেলেদের ওটাই দোষ। দুনিয়ার কোন খবরই রাখ না। তাই সব বিষয় নিয়েই হাসিমস্করা কর।
আমি লোকটার মুখের দিকে তাকালাম। চোখ দুটো কেমন চকচক করছে। বলল, বিধাতার এই সংসারে এমন কিছু জায়গা আছে যেগুলো অভিশপ্ত। ওই জিপসি একরও তার মধ্যে একটা।
বাড়িটা তৈরির সময় সবাই জানে, খাদ থেকে পাথর বয়ে আনার সময় অনেক শ্রমিক মারা গিয়েছিল।
একটু থেমে আমার মুখে একপলক দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে ফের বলল, এই গ্রামের বুড়ো জর্জ, তাকেও একরাতে ওখানে ঘাড় মটকে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল।
–তাতে কি, নিশ্চয় মাতাল হয়ে পথ চলেছিল।
–বুড়ো মদ খেত ঠিকই তবে তেমন বেশি কিছু না। কিন্তু অনেকেই তো মদ খেয়ে ওই পথে চলাচল করে। তাদের কেউ তো জর্জের মত ঘাড় মটকে পড়ে থাকে না।
পাইন গাছে ঢাকা সবুজ পাহাড়ের কোলে জিপসি একর সেই দিনই আমাকে যেন কোন অদৃশ্য বন্ধনে বেঁধে ফেলল। সেই মুহূর্তে আমি কি ভাবতে পেরেছিলাম যে এখান থেকেই আমার কাহিনীর সূত্রপাত হবে?
শুরু থেকে সমস্ত ঘটনা আমার স্মৃতিতে হুবহু আঁকা হয়ে আছে।
অনাবশ্যক কৌতূহল বসেই লোকটাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তা সেই জিপসিরা তারপর কোথায় গেল?
–কোথায় গেল কেউ জানে না। আজকাল তাদের কাউকেই আর এ তল্লাটে দেখা যায় না। পুলিসও সতর্ক নজর রেখেছে।
আমি বললাম, অনেককেই দেখি জিপসিদের নাম শুনতে পারে না। তাদের ঘৃণা করে, না ভয় করে বুঝতে পারি না।
–ওরা হল ছিঁচকে চোরের দল।
বলতে বলতেই আমার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমাকে নিরীক্ষণ করতে লাগল।
তারপর ধীরে ধীরে বলল, তোমার মধ্যেও তো দেখছি খানিকটা জিপসি রক্ত রয়েছে, তাই না?
চট করেই লোকটার প্রশ্নের জবাব দিতে পারলাম না। আমি ভাল করেই জানি জিপসিদের সঙ্গে আমার চেহারার কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু লোকটাকে সেকথা আমি সেই মুহূর্তে বলতে পারলাম না।
দু চোখে কৌতুকের ঝিলিক নিয়ে আমি লোকটার দিকে তাকালাম। তার চোখের দৃষ্টি দেখেই কেন জানি না সেই মুহূর্তে আমার মনে হল, সত্যি সত্যিই হয়তো আমার শরীরে জিপসি রক্ত মিশে আছে।
লোকটার কাছ থেকে সরে এসে আমি পাহাড়ী পথটা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম।
রাস্তাটা ঘুরে ঘুরে পাহাড়ের ওপর উঠে গেছে, পথের শেষ প্রান্তে পাহাড়ের চূড়াতে জিপসি একর। ওদিকটা বেশ সমতল।
হাঁটতে হাঁটতে চুড়ায় উঠে চোখে পড়ল দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশি। নজরে পড়ল বহুদূর দিয়ে স্টীমার যাতায়াত করছে।
দৃশ্যটা মনোরম সন্দেহ নেই। পাহাড়ে বসে সমুদ্র দেখা, ভাবতেই বুকের ভেতরে পুলক নৃত্য করে ওঠে। কেন জানি না, হাস্যকর ভাবেই মনে হল, আহা, জিপসি একর যদি আমার হত।
পাহাড়ের ওপরে বেশিক্ষণ থাকিনি। ফেরার পথে সেই প্রৌঢ় লোকটার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। এখনো সে ঝোপঝাড়ে কঁচি চালিয়ে চলেছে।
আরো কিছু কথাবার্তা হল তার সঙ্গে। আমার কথায় সে কি বুঝল কে জানে, বলল, এখানে যদি কোন জিপসির সঙ্গে কথা বলতে চাও তাহলে একজনের কথা বলতে পারি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কে সে?
মিসেস লী নামে এক জিপসি বুড়ি আছে। মেজরই তাকে এখানে এনে বসবাস করিয়েছে।
–এই মেজরটি আবার কে?
লোকটার চোখ বিস্ময়ে বিস্ফোরিত হল। অদ্ভুত স্বরে বলল, তুমি মেজর ফিলপটের কথা শোননি?
-না, ভাই সেই সৌভাগ্য হয়নি। কে এই ফিলপট বলতো?
তার কাছ থেকে যা শোনা গেল তাতে বুঝলাম, এই অঞ্চলের লোকের কাছে মেজর ভদ্রলোক দেবদূতের মতই শ্রদ্ধাভক্তির পাত্র। তারা এখানকার বনেদী পরিবার। লীকে মেজরই সাহায্য দিয়ে রেখেছেন।
আমি আর বিশেষ কৌতূহল দেখালাম না কোন বিষয়েই। যখন চলে আসছি, লোকটা যেন আপন মনেই বলে উঠল, একেবারে শেষ মাথার কুঁড়েটাতেই বুড়ি লী থাকে। কিন্তু ঘরে থাকে না একমুহূর্তের জন্য। আশপাশেই ঘুরঘুর করে বেড়ায়। জিপসি বলেই হয়তো ঘরে থাকতে চায় না।
শিস দিতে দিতে আমি পাহাড়ী পথ ধরে নিচের দিকে নামতে লাগলাম। জিপসিদের কথাটাই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। কখন যে মিসেস লীর কুঁড়ের কাছাকাছি চলে এসেছি বুঝতেই পারিনি।
একমাথা রুক্ষ তামাটে চুলের বুড়ি তার উঠোনে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। সামনাসামনি চলে এসেই আমার খেয়াল হল।
কোমর ছাপানো চুলের রাশি বাতাসে উড়ছে। একপলকেই চিনতে পারলাম এই হল জিপসি বুড়ি লী।
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কাছেই তো আসছিলাম। শুনলাম, বহুদিন ধরে এই অঞ্চলে রয়েছ?
রোমশ পাকা ভ্রূজোড়ার ফাঁক দিয়ে বুড়ি আমাকে বড় বড় চোখ করে দেখল। তারপর খসখসে গলায় বলল, তোমাকে দেখতে শুনতে তো ভালই লাগছে, কিন্তু এটা জান না, সব ব্যাপার নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা ঠিক নয়। তোমাকে এখানে কে টেনে এসেছে? যদি ভাল চাও তো জিপসি একরের কথা মন থেকে মুছে ফেল। এখানে অভিশাপ আছে, কারুর কোন দিন মঙ্গল হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না।
–নোটিশ দেখলাম, জায়গাটা নিলামে বিক্রি হবে।
–তাই বুঝি। তা হোক, কিন্তু সম্পত্তিটা যে কিনবে তার সর্বনাশ হবে নির্ঘাৎ।
–এতবড় জমি কারা কিনবে কিছু শুনেছ?
–জমিটা কেনার কথা মাত্র জনাকয়েকের মাথাতেই ঘুরছে। দাম তত বেশি উঠবে না, সবাই জানে অভিশপ্ত জমি। খুব কমদামেই তাই বিক্রি হয়ে যাবে।
সস্তায় পেলে কোন একজন ধনী ব্যক্তিই হয়তো কিনে নেবে। কিন্তু এখানে এসে কি করবে?
কথাটা শুনে বুড়ি কেমন খলখল শব্দে হেসে উঠল। অজানা আতঙ্কে আমার সমস্ত শরীর ছমছম করে উঠল।
বুড়ি বলল, কেন পুরনো প্রাসাদ ভেঙ্গে নতুন সব ফ্ল্যাটবাড়ি বানাবে। তারপর সেগুলো হয় ভাড়া দেবে নয় তো বিক্রি করবে।
বলতে বলতে বুড়ি আবার সেই মারাত্মক হাসি হেসে উঠল। হাসি থামলে কেমন তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, অভিশপ্ত মাটিতে সবকটা বাড়িই হবে অভিশপ্ত। সুখে বাস করা কারোর ভাগ্যে হবে না।
বুড়ির প্রথম কথাটাই কানে লেগেছিল। তাই বললাম, অতীতের এমন একটা বনেদী বাড়ি ভেঙ্গে ফেলাটা কোন কাজ নয়।
-শোনহে ছোকরা, এ জমি কিনে ক্ষতি ছাড়া কারুর লাভ হবে না। এখানে কাজ করবার জন্য যেসব শ্রমিক মজুর আসবে, তাদের অনেকেই দুর্ঘটনায় মারা পড়বে। তারপর থেকে নানান রকমের দুর্ঘটনা লেগেই থাকবে।
আমি লক্ষ করছিলাম, বুড়ি কেমন জোরের সঙ্গেই কথাগুলো বলছে। কেমন দুর্বোধ্য ঠেকছিস আমার।
বুড়ি নিজের মনেই বলে চলল, এটা হল জিপসি একর–পুরো তল্লাট অভিশপ্ত। এখানে কারুর কখনো ভাল হতে পারে না।
শেষ কথাগুলো বুড়ি এমন ভাবে বলল যে আমি শব্দ করে হেসে উঠলাম।
-না বাছা, বুড়ির সারামুখে এখন রাগ গমগম করছে, অমন দাঁত দেখিয়ে হেসো না। আমি দেখতে পাচ্ছি, ওই হাসি একদিন চোখ ভরা কান্না হয়ে ঝরবে।
এখনো বলছি, আখেরে ভাল চাও তো এই অঞ্চলের বিষ নিঃশ্বাস গায়ে লাগবার আগে পালিয়ে যাও।
–কিন্তু, তুমি তো জানবে নিশ্চয়ই অমন বাড়িটার এই ভগ্নদশা হল কেন? বর্তমান মালিক কোথায় থাকে?
–বর্তমান মালিক? অতশত বলতে পারব না। কিন্তু শুনে রাখ যারা এখানে বাস করবে বলে এসেছিল তারা আর একজনও বেঁচে নেই। ভূত হয়ে গেছে।
-তারা মারা গেছে কিভাবে?
রহস্যময় হাসি হেসে বুড়ি লী বলল, সে সব পুরনো কথা আর বলতে চাই না। শুধু এটুকু শুনে রাখ, তারপর আর কেউ এখানে থাকতে আসেনি। অতবড় বাড়ি খালি পড়ে থেকে এখন একটা ধ্বংসস্তূপ হয়ে যাচ্ছে। মালিকরা আর এই বাড়ির কথা মনে করতে চায় না। অবশ্য সেটাই মঙ্গল।
–কিন্তু পুরনো সেই ইতিবৃত্ত তুমি আমাকে বলতে পারতে। সবইতো জান তুমি।
–না বাছা জানলেও ওসব নিয়ে কারো কাছে গল্প করি না।
বলে বুড়ি হঠাৎই থেমে গেল। আমার দিকে দু-পা এগিয়ে এল। আমার মুখের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মিনতিভরা গলায় বলল, তবে, তুমি যদি জানতে চাও, তোমার ভাগ্য আমি বলে দিতে পারব। তার জন্য আমাকে একটা রুপোর মুদ্রা দিলেই হবে, বেশি দিতে হবে না।
বুড়ির আগেকার কণ্ঠস্বর যেন সম্পূর্ণ পাল্টে গেল।
গলার খসখসে ভাবটা অদ্ভুত রকমের মোলায়েম করে সে বলতে লাগল, তোমার হাতের রেখা দেখেই ভবিষ্যতের ভালমন্দ সবকথা আমি বলে দিতে পারব। তোমার সুন্দর কপাল দেখেই বুঝতে পারছি ভবিষ্যতে অনেক উন্নতি করবে তুমি।
আমি হেসে বললাম, তোমাদের জিপসিদের ওসব বুজরুকি আমি একদম বিশ্বাস করি না। তাছাড়া দানখয়রাত করার মত মুদ্ৰাটুদ্রাও আমার কাছে নেই।
বেশ তো, আধ শিলিংই না হয় দিও। তুমি ভাগ্যবান যুবক, এ আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।
অগত্যা একটা ছ পেনীর মুদ্রা বুড়ির হাতে দিতে হল। ওর চোখের লোলুপ দৃষ্টি কেমন ঝকঝক করে উঠল। ফোকলা দাঁতে অদ্ভুত হাসি ছড়িয়ে বলল, তোমার দু হাতের মুঠো আমার সামনে মেলে ধর।
আমি হাত মেলে ধরলাম। বুড়ি তার শীর্ণ থাবার মধ্যে টেনে নিয়ে রেখাগুলো খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।
কয়েক মুহূর্ত মাথা নিচু করে কি দেখল। তারপর আচমকা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিল। নিজেও দু পা পিছিয়ে গেল। তার ঘোলাটে চোখের দৃষ্টি অসম্ভব ধারালো হয়ে উঠল।
চিলের মত কর্কশ কণ্ঠে সে বলে উঠল, পালাও পালিয়ে যাও এখান থেকে। যদি নিজের মঙ্গল চাও তো কোনদিন আর জিপসি একরে পা দিও না। নাম পর্যন্ত মুখে আনবে না।
-কেন, ওকথা বলছ কেন?
–এখানে তোমার জন্য কেবল চরম দুঃখকষ্টই অপেক্ষা করে আছে। একদম খাঁটি কথা বলছি, মারাত্মক কোন বিপদে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
এখান থেকে আমাকে তাড়াবার ব্যস্ততা দেখে হেসে ফেললাম। বললাম, এত লোক থাকতে শেষে আমার জন্যই বেছে বেছে বিপদগুলি সব…
বুড়ি আমাকে কথা শেষ করতে দিল না। দ্রুত পায়ে তার ঝুপড়ির ভেতরে গিয়ে ঢুকল। তারপর দরজা বন্ধ করে দিল।
বুড়ির ভাবসাব দেখে মনে হল যেন আমাকে এখান থেকে সে তাড়াতে পারলে বাঁচে। হয়তো দক্ষিণাটা মনমতো হয়নি বলেই এমন ব্যবহার।
হাত দেখা, ভবিষ্যৎ গণনা–এসবে কোন কালেই আমার বিশ্বাস নেই। তবে জীবনের পথে নানা উত্থানপতনের মধ্যে দিয়ে চলে ভাগ্যকে অবিশ্বাস করি না।
ইতিমধ্যে সূর্য অস্ত গেছে। চারপাশে রহস্যময় অন্ধকার নেমে আসছে। হাওয়ার বেগও সুবিধার মনে হল না। গাছপালা দুলতে শুরু করেছে প্রবল ভাবে। আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে।
দ্রুত পায়ে নিয়ে থেমে এলাম। টাওয়ার বিক্রির নোটিশ বোর্ডটা চোখে পড়ল আবার। নিলামের দিনক্ষণ দেখে নিলাম ভাল করে।
এর আগে কোন রকম নিলামের ব্যাপারে আমি উপস্থিত থাকিনি। সে কারণে কোন কৌতূহলও ছিল না।
কিন্তু কি জানি কেন, মনে হল, টাওয়ার নিলামের দিনে উপস্থিত থাকব। অন্ততঃ যারা সম্পত্তিটা কেনার জন্য নিলাম ডাকবে, তাদের তো চেনার সুযোগ পাওয়া যাবে।
.
০২.
যোগাযোগটা দৈবাৎই হল বলা চলে। যেদিন টাওয়ার নিলাম হবে, একটা কাজের যোগাযোগে সেদিনই আমাকে জিপসি একরের কাছাকাছি আসতে হল।
এক প্রৌঢ় দম্পতি লণ্ডন থেকে গাড়িভাড়া করেছিলেন। আমি ছিলাম সেই গাড়ির চালক।
আমার বহু বিচিত্র জীবন কাহিনীর সেটা ছিল এক পর্ব।
বাইশ বছরের জীবনের যেটুকু পথ পাড়ি দিয়েছি তাতে অনেক বিষয়েই প্রচুর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি।
এই সুযোগ অবশ্য করে দিয়েছে আমার অন্তর-প্রকৃতি। কোন কাজেই আমি সুস্থির হতে পারতাম না। তাই দিনের পর দিন একটার পর একটা কাজ পাল্টেছি। আর সে কাজও হরেক রকমের।
কি করিনি আমি–আয়ারল্যাণ্ডে কিছুদিন এক ঘোড়ার আস্তাবলে কাজ করেছিলাম। আবার মাদকদ্রব্য পাচারকারী একটি দলের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েছিলাম। তবে ভাগ্য ভাল, সর্বনাশের পথে বেশিদূর এগুবার আগেই সরে আসতে পেরেছিলাম।
এছাড়া, ফলের বাগানে কাজ করেছি, হোটেলের ওয়েটার হিসেবে ছিলাম, সমুদ্র-সৈকতে লাইফ-গার্ডের কাজও করতে হয়েছে কিছুদিন।
অনেক ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধার করেছি।
আবার একটা সময় দোরে দোরে ঘুরে বিশ্বকোষ বিক্রি করেছি। বোটানিক্যাল গার্ডেনে গাছপালার তদারকের কাজেও নিযুক্ত হয়েছিলাম।
এমনি নানা ধরনের কাজের মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই অনেক বিষয়ের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছি।
কাজ পাল্টানো যেন একটা নেশার মত হয়ে গেছে আমার। যত পরিশ্রম সাপেক্ষ কাজই হোক আমার তাতে আলস্য ছিল না।
আসলে দুনিয়াটাকে দেখতে বুঝতে, জানতে আমার খুব আনন্দ। সববিষয়েই আমার দুরন্ত কৌতূহল। তাই সারাক্ষণই কেবল ছুটে বেড়াচ্ছি।
বর্তমানে আমি গাড়ির চালক। গাড়ির কলকজা, কোন কিছুই আমার অপরিচিত নয়। ভাল মেকানিক হিসেবে পরিচিতও হয়েছি।
এছাড়া চালক হিসেবেও আমি যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য।
বর্তমানে অনেকগুলো মূল্যবান বিলাসবহুল গাড়ির আমি চালক। ওকাজে বিশেষ পরিশ্রম নেই বটে, তবে বড্ড একঘেয়ে।
একটা অশান্ত বিক্ষুব্ধ মন আমাকে সেই ছেলেবেলা থেকেই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। স্কুলের গণ্ডি পেরুবার পর থেকেই আমার জীবন এই কর্মস্রোতে ভেসে চলেছে।
মাঝে মাঝে রেসের মাঠে ঢু মারার অভ্যাসও তৈরি হয়েছিল। সম্প্রতি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছে। একটা অনামী ঘোড়ার পেছনে কপাল ঠুকে যাবতীয় সম্বল লাগিয়ে দিয়েছিলাম। সেই ঘোড়াই বাজি জিতে গেল এই সুবাদে বেশ মোটা অঙ্কের অর্থ আমার পকেটে এসে গেছে। এখন আমি একজন ধনী ব্যক্তি।
জিপসি একরের কথা আমি ভুলতে পারছি না। সারাক্ষণই যেন কানের কাছে গুঞ্জন করে চলেছে।
ঠিক এরকমটা হয়েছিল স্যানটনিক্সের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনও।
স্যানটনিক্স পেশায় একজন স্থপতি। তার সঙ্গে পরিচিত হবার মত কোন সূত্র আমার ছিল না। বস্তুতঃ স্থপতিদের সঙ্গে যোগাযোগের কোন প্রয়োজনও আমার ছিল না।
সেই সময় আমি এক আন্তর্জাতিক ট্যুরিস্ট কোম্পানিতে সোফারের কাজে নিযুক্ত। দেশ-বিদেশের পয়সাওয়ালা যাত্রীদের নিয়ে আমাকে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করতে হয়।
কর্মসূত্রেই আমাকে জার্মানী ও ফ্রান্সে কয়েকবার যেতে হয়েছে। দুই দেশের ভাষাও। মোটামুটি রপ্ত করে নিয়েছিলাম।
পয়সাওয়ালা লোকদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে দেখেছি ব্যক্তিগত জীবনে এরা কেউই সুখী মানুষ নয়।
শারীরিক আর মানসিক রোগে সারাক্ষণই ব্যতিব্যস্ত, বিধ্বস্ত। গরীব মানুষদের নিয়ে তারা কখনো মাথা ঘামায় না।
অথচ অর্থবিত্তের অধিকারী না হয়েও জীবনটা ছিল আমার ভারী মজার, আনন্দময়। শরীর স্বাস্থ্যও বরাবরই ভাল। কোন উৎপাত নেই কোনদিকে।
যৌবনের সেই দিনগুলোতে একটা স্বপ্নেই বিভোর হয়ে আছি, কোন দিন অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা লাভ করব।
একবার এক বৃদ্ধ ভদ্রলোককে নিয়ে বিভারিয়া যেতে হয়েছিল। প্রচুর টাকা খরচ করে ভদ্রলোক সেখানে একটা বাড়ি তৈরি করাচ্ছিলেন। সেই বাড়ির স্থপতি ছিলেন মিঃ স্যানটনিক্স। কাজটা হচ্ছিলও তারই তত্ত্বাবধানে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন কাজটা কতদূর এগোলো দেখার জন্য।
মিঃ স্যানটনিক্সকে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি কোন দেশের মানুষ। আমার ধারণা স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ান। তবে খুবই যে অসুস্থ তা একপলক দেখেই বোঝা যায়। অবশ্য বয়স বেশি নয়।
অতিশয় ক্ষীণ আর দুর্বল। কিন্তু কথাবার্তায় তার মানসিক দৃঢ়তা আর কাজের অফুরন্ত বিশ্বাস ফুটে বেরয় প্রতিক্ষণে।
এই সুযোগেই আমার আলাপ হয়েছিল মিঃ স্যানটনিক্সের সঙ্গে। কথায় কথায় তিনি বলেছিলেন, আমি সকলের বাড়ি তৈরি করি না। আমাকে দিয়ে বাড়ি তৈরি করাতে হলে অগাধ বিত্ত সম্পদের মালিক হতে হয়। সে কারণে আমি আমার পছন্দমত মক্কেল বেছে নিই।
প্রথম আলাপের পর বিভারিয়াতেই আমাদের পরেও বার কয়েক দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। তিনি যে প্রাসাদপুরী তৈরি করেছিলেন, সৌন্দর্যে ও বৈশিষ্ট্যে এককথায় তা ছিল অপূর্ব। সেই সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করবার মত শব্দ আমার জানা নেই।
প্রাসাদের মালিকও গোড়ার দিকে খরচের জন্য কিছুটা খুঁতখুঁত করলেও বাড়িটা দেখার পর গর্বিত হয়েছিলেন।
সেই প্রাসাদপুরী দেখে আমার মনের সুপ্ত বাসনাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, এমন বাড়িতেই বাস করে সুখ। দশজনকে ডেকে দেখানোর মত।
একদিন হঠাৎ মিঃ স্যানটনিক্স আমাকে বললেন, তোমার জন্যও একটা বাড়ি আমি তৈরি করে দিতে পারি। তুমি কি চাও আমি জানি। কিন্তু এটাই দুর্ভাগ্য যে তুমি ধনীব্যক্তি নও।
তারপর মৃদু হেসে বললেন, তোমার মনের মত বাড়ি তৈরি করবার মত ধনী তুমি কোনদিনই হতে পারবে না।
আমি মৃদু আপত্তি প্রকাশ করে বলেছিলাম, এমন কথা কি কখনো বলা যায়? গরীব হয়ে জন্মালেই যে গরীব হয়েই থাকতে হবে এমন কোন বাঁধা ধরা নিয়ম তো নেই। কার ভাগ্য কখন প্রসন্ন হবে, সেকথা কে বলতে পারে।
স্যানটনিক্স বলেছিলেন, তুমি পারতে পার, কেননা, আমি তোমার কথা শুনেই বুঝতে পারছি উচ্চাকাঙ্ক্ষার বীজ তোমার ভেতরে সুপ্ত আছে।
যেদিন সেটা প্রবলভাবে জেগে উঠবে তুমিও অগাধ বিত্তের অধিকারী হতে পারবে।
আমি হেসে বলেছিলাম, তাহলে কথা থাকল, যেদিন আমি সেই অবস্থায় পৌঁছাতে পারব, সেদিন আমার জন্য একটা বাড়ি তৈরি করার জন্য আপনার কাছেই আমি যাব।
একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে স্যানটনিক্স বলেছিলেন, দুর্ভাগ্য এটাই যে, তার আগেই আমার দিন ফুরিয়ে আসবে। কতবড় জোর আর বছর দুয়েক, এই সময়ের মধ্যে কটা কাজ আর শেষ করে উঠতে পারব।
একটু থেমে পরে আবার বললেন, সময়ের আগেই অনেককে চলে যেতে হয়, যদিও যৌবনের মধ্যিখানে এসে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছে হয় না আমার।
আমি বলেছিলাম, তাহলে তো দেখছি আমাকে অতি দ্রুত একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী পুরুষ হয়ে উঠতে হচ্ছে। তা না হলে মনের মত বাড়ি আর কপালে জুটবে না।
এরপর মিঃ স্যানটনিক্সের সঙ্গে দেখা হয়নি আর। তবে প্রায়ই তার কথা আমার মনে পড়ে। তিনি আমার মনের গভীরে দাগ কাটতে পেরেছিলেন।
স্যানটনিক্সের সঙ্গে আমার স্বপ্নের মধ্যে অনিবার্য ভাবে এসে হানা দিত জিপসি একরের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে টাওয়ার নামের প্রাচীন প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ, রহস্যময় জিপসি বুড়ি, তার ছোট্ট ঝুপড়িটি।
আর একটা কথাও বলা দরকার, চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় পরিভ্রমণকালে যেসব মেয়ের সংস্পর্শে আসতে হয়েছে, তাদের কথা, আমার দু-চারজন বিশিষ্ট যাত্রীর কথাও মনে পড়ত।
দুর্জ্ঞেয় একটা অনুভূতি আমার মন জুড়ে বসেছিল। কেবলই মনে হয় দুর্লভ কোন বস্তু যেন আমার অপেক্ষায় রয়েছে, আশ্চর্য কোন সৌভাগ্য। যেন অবিশ্বাস্য কিছু আমার জীবনে ঘটবে।
সম্ভবতঃ আমার মনের অবচেতনে কোন মেয়ের কথাই থেকে থাকবে। ঠিক মনের মত একটা মেয়ে।
কিন্তু ভালবাসার স্পর্শ তখনো জীবনে পাইনি। ভালবাসা কি তা-ও জানি না। নারীর শরীর, তার বিশেষ বিশেষ অংশ, খাজখোঁজ–এসবই ছিল বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনার বিষয়। তবে এমন কোন স্বপ্ন বা কল্পনা আমার ছিল না, কোন ডানাকাটা পরীর সঙ্গে পথের কোন মোড়ে আমার সাক্ষাৎ হয়ে যাবে, সেই হবে আমার মনের মত জীবনসঙ্গিনী। দুজন শুধু আমরা দুজনের জন্যেই বেঁচে থাকব।
কিন্তু আমি যদি জানতে পারতাম, স্বপ্নও আকস্মিকভাবে কোন একদিন সত্য হয়ে উঠতে পারে–অবচেতনের সমস্ত সুপ্তবাসনা বাস্তব হয়ে দেখা দিতে পারে, আর যদি জানতে পারতাম তার পরিণতি তাহলে আমি চিরকালের মত দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গিয়ে অব্যাহতি পেতে পারতাম।
কিন্তু নিয়তি তো লঙ্ন করার উপায় নেই।
.
০৩.
নিলামের তারিখটায় হাজির হয়েছিলাম বিচিত্র উপায়ে। আমার সওয়ারী তখন এক প্রৌঢ় দম্পতি।
তাদের চাল-চলন, ব্যবহার কোন কিছুই আমার পছন্দ ছিল না। এমন রূঢ় কথা কখনো আমি শুনিনি। নিজেদের সুখ সুবিধা নিয়েই সর্বদা ব্যস্ত। অন্যের ব্যাপারে লেশমাত্র ভাবনা চিন্তা নেই।
দেখতেও দুজন ছিলেন অতিমাত্রায় কুৎসিত। তাই গোড়া থেকেই মেজাজ খিঁচড়ে ছিল। কিছুতেই আর সহ্য করতে পারছিলাম না।
মনের ভাব প্রকাশ করবারও উপায় ছিল না। কেননা আমার সেরা ও ব্যবহারের সঙ্গে কোম্পানির সুনাম ও ব্যবসার প্রশ্ন জড়িত।
বাধ্য হয়েই আমাকে অন্য পথ নিতে হল। কাছাকাছি একটা হোটেল থেকে লণ্ডনে আমার অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিলাম, হঠাৎ আমার শরীর খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমার পক্ষে গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। কোম্পানি যেন অনুগ্রহ করে অন্য কোন ড্রাইভারকে সত্বর এখানে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে।
আমার যাত্রী দুজনেরও কিছু বলার ছিল না। আমার অসুস্থতার খবর জানিয়ে সহজেই সব কিছু সামলে নেওয়া হল। আমি যথাসময়েই নিলামে হাজির হতে পেরেছিলাম।
আগেই বলেছি ইতিপূর্বে কোন নিলামে উপস্থিত হবার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। তাই ভেতরে ভেতরে অজানাকে জানার একটা আগ্রহ ও উত্তেজনা আমার ছিল।
কিন্তু নিলাম আসরে উপস্থিত হয়ে আমাকে পুরোপুরি হতাশ হতে হল। এমন একটা বর্ণহীন নিষ্প্রাণ সমাবেশে আসতে হবে কল্পনাই করতে পারিনি।
আধা অন্ধকার একটা থমথমে হল ঘরে মাত্র জনা ছয়-সাত মানুষ উপস্থিত হয়েছে। নিলামদারের চেহারা ভাবলেশহীন আর কণ্ঠস্বর নিষ্প্রাণ। সম্পত্তিটার একটা বিবরণ দেবার পরেই ডাক শুরু হল।
যারা নিলাম ডাকতে উপস্থিত হয়েছিল তারা সকলেই সম্ভবতঃ স্থানীয় গ্রামাঞ্চলের অধিবাসী। এদের মধ্যে একজনই ছিল পোশাক-আসাকে ফিটফাট, কেতাদুরস্ত। সম্ভবত লণ্ডন থেকে সরাসরি চলে এসেছিলেন। তিনি অবশ্য নিলাম ডাকাডাকির মধ্যে সক্রিয় ভূমিকা নেননি।
পাঁচ হাজারের বেশি দর উঠল না। নিলামদারের মুখে কেমন একটা হতাশার ভাব ফুটে উঠল। সে ঘোষণা করল এই সম্পত্তির জন্য ন্যূনতম যে দাম বাঁধা ছিল ডাক সেই পর্যন্ত না পৌঁছনোর ফলে আজকের মতো নিলাম বন্ধ রইল।
ফিরে আসার পথে এক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ হল। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে তিনি বললেন, সবটাই পণ্ডশ্রম হল। জানতাম এরকমই হবে। আপনাকে তো নিলামে অংশ নিতে দেখলাম না।
আমি জানালাম, তেমন কোন উদ্দেশ্য নিয়ে আমি আসিনি। ব্যাপারটা কিরকম ঘটে সে সম্পর্কে একটা কৌতূহল ছিল, তাই এসেছিলাম।
ঘরবাড়ি জমিজমা নিলামের ক্ষেত্রে এরকমই হয়। ওরা এভাবে জেনে নিতে চায়, সম্পত্তিটার বিষয়ে আগ্রহী কারা কারা। এখানে যা দেখা গেল, তিনজনের সামান্য কিছু আগ্রহ আছে।
আমি জানতে চাইলাম, এরা কারা কারা?
–একজন হলেন হেলমিনস্টার গ্রামের মিঃ ওয়াটারবি। জমি কেনা বেচার ব্যবসায় ভদ্রলোক ইতিমধ্যেই বেশ মোটা পয়সা কামিয়ে নিয়েছে। লিভারপুলের এক নামী সংস্থার প্রতিনিধিকেও দেখলাম। লণ্ডন থেকেও এসেছিলেন একজন।
যারা যারা এসেছিলেন নিলাম ডাকতে তাদের মধ্যে এই কজনই প্রধান।
ভদ্রলোক কয়েক পা নীরবে হাঁটলেন। তারপর বললেন, দাম বেশি পাবে না, খুব কম দামেই সম্পত্তিটা বিক্রি হয়ে যাবে দেখবেন।
–জায়গাটার একটা দুর্নাম আছে শুনেছিলাম।
–তাহলে আপনিও শুনেছেন জিপসি একরের কাহিনীটা। ওসব মশায় গ্রামের অশিক্ষিত লোকজনের গালগল্প। তবে পথের বাঁকটা বাস্তবিকই একটা মরণ-ফাঁদ বিশেষ। স্থানীয় পৌরকর্তৃপক্ষ যদি রাস্তাটাতে আরও চওড়া করে ধারে ধারে লোহার রেলিং বসিয়ে দিত তাহলে অতটা বিপজ্জনক থাকত না।
-শুনেছি ওই এলাকাটা নাকি অভিশপ্ত। জিপসিরা নাকি জমিটা ছেড়ে যাবার সময় কি সব অভিশাপ দিয়ে গেছে।
–ওসবে কান দেবেন না মশায়। নিতান্তই গ্রাম্য মানুষের কুসংস্কার। ওসব তোয়াক্কা করলে কি আর লিভারপুলের অতবড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান থেকে লোক আসে। মনে হচ্ছে ভেতরে ভেতরে ওরাই কিনে নেবে।
অতবড় প্রাচীন প্রাসাদ ভেঙ্গে ফেলে তার ওপর আধুনিক ধাঁচের বাড়ি করা কিরকম ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার বুঝতে পারছেন! কজনের সামর্থ্যে কুলোবে বলুন।
আজকাল লোকে বনেদী অঞ্চলে ফ্ল্যাট কেনাটাই বেশি পছন্দ করে। অত জায়গা নিয়ে বাগানবাড়ির দিকে ঝোঁক নেই কারো।
–আধুনিক ছাঁদের বাড়ি তো এই জমিটার ওপরেও তৈরি করা চলে।
–তা যায়। কিন্তু শহর এলাকা ছেড়ে অমন নির্জন জায়গায় কে বসবাস করতে আসবে বলুন।
এরপর ভদ্রলোক বিদায় নিয়ে বাঁদিকের পথ ধরলেন। আমি যেমন চলছিলাম, তেমনই সোজা চলতে লাগলাম।
কোথায় যাব সে বিষয়ে কোন ধারণা ছিল না আমার। আপনা থেকেই যেন পা জোড়া আমাকে টেনে নিয়ে চলেছিল সর্পিল পাহাড়ী পথে।
এই ছায়াঘেরা পাহাড়ী পথেরই এক বাঁকের মুখে এসে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল ইলিয়ার। এক ফার গাছের নিচে একা দাঁড়িয়ে ছিল ও।
আয়ত চোখের গভীরে যেন এক অজানা স্বপ্নের ঘোর। গাঢ় সবুজ টুইডের পোশাক পরা। মাথায় একরাশ বাদামী চুল।
আমার মনে হল যেন আচম্বিতেই এক বনদেবীর আবির্ভাব হয়েছে সামনে। আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
মেয়েটিও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। মনে হল কিছু যেন বলতে চেয়েছিল। কিন্তু বলল না।
আমি সহসা সংযত বিনীত কণ্ঠে বললাম, মাপ করবেন, আপনাকে চমকে দেবার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না। এখানে আর কেউ যে আছে আমি বুঝতেই পারিনি।
মৃদু হেসে ইলিয়া বলল, না, না, আপনি বৃথাই সঙ্কুচিত হচ্ছেন। চারপাশটা কেমন অদ্ভুত নির্জন, আমি তাই দেখছিলাম।
এই জনপ্ৰাণীহীন পাহাড়ী পরিবেশে কথা বলার মত একজন সঙ্গী পেয়ে ভালই লাগল। বললাম, সত্যিই এখানে কেমন একটা গা-ছমছম ভাব যেন।
পাহাড়ের ওপরের ওই প্রাচীন প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ এই পরিবেশকে যেন আরও গুরুগম্ভীর করে তুলেছে।
-হ্যাঁ ওই বাড়িটার নাম নাকি টাওয়ার।
আমি মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বললাম, হ্যাঁ আমিও শুনেছি।
মেয়েটির ঠোঁটে হাসির আভাস খেলল। বলল, জায়গাটা নাকি নিলামে বিক্রি হবার কথা হচ্ছে।
আমি হেসে বললাম, সেই নিলাম থেকেই তো আমি আসছি।
–তাই বুঝি। আপনিও বুঝি জমিটার ব্যাপারে আগ্রহী।
আমি প্রতিবাদ জানিয়ে বললাম, না না, আমি নিতান্তই একজন সাধারণ ব্যক্তি। ওরকম ভাঙাচোরা বাড়ি আর পতিত জমি কিনে নেবার মত সামর্থ্য আমার নেই।
–জায়গাটা কি বিক্রি হয়ে গেছে?
–না। বাঁধা দামটা ওঠেনি বলে ডাক স্থগিত করা হয়েছে। আপনিও নিশ্চয় এমন একটা জায়গা কিনতে চান না।
–অবশ্যই না।
তবে, সত্যি কথা বলতে জায়গাটা আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। টাকা থাকলে আমি কিনে নিতাম।
-কিন্তু বাড়িটাতো একটা ধ্বংস্তূপ বিশেষ।
-তা ঠিক। তবে সাবেকী বাড়ি থাকা না থাকা সমান। তার প্রতি আমার কোন মোহ নেই। পরিবেশটা বড়ই মনোরম। এদিকটায় দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ, পাহাড়ের সারি, ও দিকটায় রয়েছে অন্তহীন নীল জলরাশি–
সব মিলিয়ে বড় মোহময়। আসুন দেখবেন। বলে মেয়েটির হাত ধরবার জন্য আমি হাত বাড়ালাম।
আমার ব্যবহারে শিষ্টাচারের ব্যাঘাত ঘটল কি না সেকথা সেই মুহূর্তে মনে হল না। কেন মেয়েটিকে এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যের সঙ্গে পরিচয় করে দেওয়া ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য আমার ছিল না।
সে সাগ্রহে হাত বাড়িয়ে দিল। তাকে আমি পাশেই একটা জায়গায় নিয়ে এলাম।
এরপর তাকে সমুদ্রে যাবার আঁকাবাঁকা পথ, সারিবদ্ধ পাহাড়ের চুড়ো, তাদের কোলে ছোটখাট শহরটি, দুপাশে পাহাড়ের মধ্যে সবুজ আরণ্যক উপত্যকা, সব একে একে দেখিয়ে দিলাম।
পরিবেশের প্রভাবেই আমি হয়তো কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। বললাম, এই মনোমুগ্ধকর পটভূমিতে ফাঁকা জমির ওপর ঠিক প্রকৃতির অঙ্গ করেই বড় সুন্দর একটা বাড়ি তৈরি করা যায়।
তবে যথার্থ প্রতিভাবান স্থপতি হলেই তেমন একটি বাড়ি তৈরি সম্ভব হবে।
মেয়েটি মুগ্ধ হয়ে আমার কথা শুনছিল। কথা শেষ হলে বলল, তেমন দক্ষ স্থপতি কি আপনার জানা আছে?
–তেমন একজনকে অবশ্য আমি জানি। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম আমি।
কথা বলতে বলতে একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে পাশাপাশি বসলাম আমরা। আমি তাকে স্যানটনিক্সের কথা বললাম। প্রসঙ্গক্রমেই আমার সঙ্গে তার শেষ সাক্ষাৎকার কালের কথাগুলোও এসে পড়ল।
নবপরিচিতা মেয়েটির সঙ্গে এভাবেই কথা বলতে যেন অতি সহজেই অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠল। আমাদের সম্বোধন আপনি থেকে তুমিতে পৌঁছে গেল। সম্ভবতঃ পরিবেশই এভাবে অতি সামান্য সময়ের মধ্যে আমাদের দুজনকে কাছে এনে দিল।
সেই পাহাড়ী নির্জন পরিবেশে একজন সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে সহজ অন্তরঙ্গ সুরে কথা বলার সুযোগ পাব, এখানে আসার আগে ভুলেও চিন্তায় আসেনি।
আমরা দুজনেই দুজনের কাছে অপরিচিত। কোনদিন কেউ কাউকে দেখিনি পর্যন্ত। কিন্তু তবু আলাপ পরিচয়ের ফাঁকে তার কাছে আমি আমার নানান রঙিন স্বপ্নের কথা নিঃসঙ্কোচেই খুলে বলতে পারলাম।
আমার আবাল্যপোষিত মনের মত একখানি বাড়ির কথা শুনে ইলিয়া বলল, এমন একটা বাড়ির সাধ বহুদিন থেকে আমিও মনে পোষণ করে রেখেছি। এখন মনে হচ্ছে এরকম একটা পরিবেশই আমার স্বপ্নের মধ্যে ছিল।
সত্যিই একেবারে প্রকৃতির নিজস্ব লীলানিকেতন। শহরের যন্ত্রণাময় কোলাহল এখানে পৌঁছবে না, নগরজীবনে কৃত্রিমতার ছোঁয়া বাঁচিয়ে শিষ্টাচার আর রীতিনীতির বেড়াজালের বাইরে একান্ত নিজের মত করে বেঁচে থাকার ইন্ধন এখানে ভরপুর।
এখন মনে হচ্ছে এটাই আদর্শ জায়গা। আমিতো রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছি।
আমি আর ইলিয়া–দুজনের প্রথম পরিচয়ের সূত্রপাতটা এভাবেই হয়েছিল।
সেদিন ইলিয়াই প্রথম আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার নাম?
বলেছিলাম, মাইকেল রজার। তুমি মাইক বলে ডেকো।
-তোমার নাম তো বললে না।
–আমার? কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলেছিল, ফিনেলা, ফিনেলা গুডম্যান।
ওকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখে আমার সন্দেহ হল, ওকি আমাকে আসল নাম গোপন করল? কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল, মনগড়া নাম কেন বলতে যাবে, আমিতো তাকে আসল নাম গোপন করিনি। আমার ধারণাটা ঠিক নয়।
সেদিন খুব বেশি কথা না হলেও যতক্ষণ কাছাকাছি ছিলাম, দুজন দুজনকে লক্ষ্য করেছিলাম। বুঝতে পারছিলাম দুজনেরই অনেক ব্যক্তিগত কথা বলার ছিল, কিন্তু প্রথম দিনেই মানসিক আড়ষ্টতা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আর সেই কারণেই কবে আবার দেখা হতে পারে, কোথায় দেখা হতে পারে, কে কোথায় থাকি এসব কথা জিজ্ঞেস করবার সাহস পাচ্ছিলাম না।
ফাঁকা জায়গায় ঠাণ্ডাটা ক্রমেই বেড়ে উঠছিল। তাই একসময় আমরা সেই প্রাচীন প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ ছেড়ে নিচে নেমে চললাম।
চলতে চলতে আচমকাই আমি প্রশ্ন করে বসলাম, মিস গুডম্যান, তুমি কি আশপাশেই কোথাও থাক?
ফিনেলা জানালো সে মার্কেট কডওয়েলের একটা হোটেলে উঠেছে। আমি অনুমান করলাম এখান থেকে মাইল পাঁচেক দূরের বাণিজ্যকেন্দ্র কডওয়েলের কোন অভিজাত হোটেলেই সে উঠেছে।
পরক্ষণেই আমাকে ও জিজ্ঞেস করল, রজার, তোমার বাড়ি কোথায়?
আমি ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললাম, আমি থাকি অনেক দূরে। কেবল আজকের জন্যই এখানে এসেছিলাম।
সামনের গ্রামের একটা সরাইখানার ধারে ফিনেলা তার গাড়ি রেখে এসেছিল। সেই অবধি আমরা গল্প করতে করতে হেঁটেই যাব ঠিক করলাম।
পাহাড়ী রাস্তাটা সাপের মত এঁকেবেঁকে নিচে নেমে গেছে। এই পথেরই একটা মোড় দুর্ঘটনার জন্য কুখ্যাত হয়েছে।
খানিকটা পথ এগুবার পর একটা বাঁকের মুখে আচম্বিতে আমাদের চোখের সামনে একটা ছায়ামূর্তির আবির্ভাব হল। একটা ঝকড়া মাথা ফার গাছের আড়ালে ছিল, সেখান থেকেই পথের ওপরে এসে দাঁড়াল মূর্তিটা।
ইলিয়া আর্ত চিৎকার করে পেছনে সরে এল। আমিও প্রথমে হকচকিয়ে গেলাম। পরে ভাল করে তাকিয়ে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আমার আগের দেখা সেই জিপসি বুড়ি লী।
তার চেহারা আজ আরও বেশি উগ্র আর ভয়ঙ্কর। মাথার রুক্ষ চুলের রাশি সাপের লেজের মত বাতাসে উড়ছে। গায়ে একটা লাল রঙের পোশাক।
খনখনে গলায় বুড়ি প্রশ্ন করল, এই জিপসি একরে এসেছ কি উদ্দেশ্যে? দুটিতে মিলে জোড় বেঁধেছ?
জবাবটা দিল ইলিয়াই। বলল, কেন, এতে দোষের কি হল? তাছাড়া কারুর জমিতেও আমরা বেআইনী প্রবেশ করিনি।
-এটা ছিল আমাদের এলাকা–মানে জিপসিদের। সেই জন্যেই জায়গাটার নামও হয়েছে জিপসি একর। কিন্তু, জানতো ওরা জিপসিদের থাকতে দেয়নি। গায়ের জোরে তাদের তাড়িয়ে দিয়ে পুরো এলাকা দখল করে নিয়েছে। সেই থেকে এখানকার হাওয়ার সঙ্গে জিপসিদের অভিশাপ মিশে আছে।
এখানে কারোর কোনদিন মঙ্গল হয়নি। তাই তো তোমাদের বলছি, এখানে এভাবে ঘুরে বেড়ানোটা তোমাদের পক্ষেও শুভ হবে না।
ইলিয়া মুহূর্তের জন্য যেন থমকে গেল। পরে শান্ত সংযত কণ্ঠে বলল, এ জায়গাটা নিলাম হচ্ছে শুনলাম তাই দেখতে এলাম। চমৎকার জায়গাটা। খুবই ভাল লাগল।
বুড়ি কর্কশ কণ্ঠে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, শোন বাছারা, এ জমি কেনার মন করো না। যে কিনবে জমির সঙ্গে দুর্ভাগ্যও তার ঘাড়ে চাপবে।
তোমাদের দুটিকে দেখতে বেশ সুন্দর। তাই তোমাদের ভালর জন্যেই বলছি, এখানে ঘোরাঘুরি করে নিজেদের দুর্ভোগ ডেকে এনো না।
বহু যুগ আগে থেকে এ এলাকা অভিশপ্ত হয়ে আছে। যে কিনবে তার কখনো মঙ্গল হবে না। জিপসি একর থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করবে। মনেও ঠাই দিও না। আমি জানি এখানে বাতাসের সঙ্গে মিশে আছে মৃত্যুর হিম নিশ্বাস। মরবে-নির্ঘাৎ মরবে যে এখানে আসবে।
যারা এসেছিল সব মরে ভূত হয়ে গেছে। মনে রেখো এটা জিপসি বুড়ির সতর্কবার্তা।
গায়ে কাঁটা ধরানো বুড়ির কথাগুলো ধৈর্য ধরে শুনল ইলিয়া। পরে বলল, আমরা তো কারো ক্ষতি করছি না।
আমিও এগিয়ে গিয়ে বললাম, শোন বুড়ি, কেন তুমি মিছে এই মহিলাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছ! আমরা তো চলেই যাচ্ছি।
পরে ইলিয়াকে বললাম, বুড়ি লী এই গ্রামেই থাকে। বুড়ির গুণও কম নয়। ভাল হাত দেখতে জানে। কি বল মিসেস লী?
বুড়ি জবাব দিল, হা, সে ক্ষমতা আমার কাছে। আমাদের জিপসি সম্প্রদায়ের সকলেই জন্মসূত্রে এই ক্ষমতার অধিকারী। তোমার দুহাতের তালু দুটো মেলে ধরো তো মেয়ে, তোমার ভবিষ্যৎ জীবনের ভাল মন্দ সব খবরই আগাম জানিয়ে দেব। কেবল একটা রৌপ্য মুদ্রা আমার মজুরি।
ইলিয়া বলল, কিন্তু আমি তো আমার ভবিষ্যৎ জীবনের কথা কিছু জানতে চাই না।
–নারে মেয়ে, ওটা বুদ্ধিমানের কথা নয়। আগে থেকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানা থাকলে বিপদ আপদ ঘায়েল করতে পারে কম, তাই না? ভবিষ্যৎ শুনলেই ঘাবড়ে যাবার কি আছে। তোমার তো অঢেল টাকা।
ওই কোটের পকেটেও টাকার অভাব নেই। কি করে চললে মঙ্গল হবে, সব আমি তোমাকে বলে দেব।
আমি কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টি মেলে ইলিয়ার দিকে তাকিয়েছিলাম। ভবিষ্যৎ জানার ব্যাপারে মেয়েদের দুর্বলতা আমি আগাগোড়া দেখে এসেছি।
ইলিয়াও তার ব্যতিক্রম হল না। নিজের ব্যাগ খুলে আধ ক্রাউনের দুটো মুদ্রা বের করে বুড়ির হাতে দিল।
–এই তো সোনা মেয়ে। তোমার উপযুক্ত কাজই তুমি করেছ। এবার জিপসি বুড়ির কথা মন দিয়ে শোন। বলে হাতের থাবা পাতল।
ইলিয়া পশমের দস্তানা খুলে বাম হাতের পেলব তালু সামনে মেলে ধরল।
হাতটা চোখের সামনে টেনে নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে বুড়ি খানিকক্ষণ রেখাগুলো দেখল। দেখতে দেখতে তার ক্লিষ্ট বলিরেখাঙ্কিত মুখমণ্ডলে অদ্ভুত থমথমে ভাব ফুটে উঠল। তারপর নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলতে লাগল–এ আমি কি দেখছি–এ আমি কি দেখছি
বলতে বলতে ইলিয়ার হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে উঠল, যত শীঘ্র পার এখান থেকে পালিয়ে যাও।
জিপসি একর তোমাকে এখানে টেনে নিয়ে এসেছে। এখানকার অভিশাপের কথাতো তুমি শুনেছো, তবু কেন এলে?
তোমার হাতের রেখা আমাকে স্পষ্ট অশুভ কথা বলছে। এখনো সময় আছে অভিশপ্ত জিপসি একর ছেড়ে অন্য কোথাও পালিয়ে যাও।
ভুলেও কখনো মনে করো না। জিপসি বুড়ি লীর কথা অগ্রাহ্য করো না, তাহলে তোমার মঙ্গল হবে না। এখানকার বাতাসে অভিশাপের বিষ ছড়িয়ে আছে, গায়ে লাগলে রক্ষে নেই।
বুড়ি, তুমি দেখছি, সকলকেই ভয় দেখিয়ে জিপসি একর থেকে তাড়াতে চাইছ। এই মহিলা নেহাৎ বেড়াতে বেড়াতেই এখানে চলে এসেছেন। জিপসি একরের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই।
রীতিমতো ধমকের সুরেই বললাম বুড়িকে।
বুড়ি কিন্তু আমার কথা কানেই তুলল না। সে ইলিয়াকে লক্ষ্য করে বলেই চলল, তোমার মঙ্গলের জন্যই তোমাকে সাবধান করে দিতে চাইছি মেয়ে।
তোমার দয়ার শরীর। সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নিয়েই তুমি জন্মেছ। কিন্তু বিপদ সম্পর্কে সাবধান না হলে সেই সুখও টেকে না। আমার কথা মনে রেখো, যে জায়গা অভিশপ্ত, বিপজ্জনক, তেমন জায়গায় কখনো পা দেবে না।
সবসময় সতর্ক থাকবে, সাবধানে চলাফেরা করবে। আমার এই নির্দেশ যদি অগ্রাহ্য কর তাহলে কিন্তু-না সে কথা আমি ভাবতেও চাই না। না না, তোমার হাতের ওই রেখাগুলো আর দেখতে চাই না।
বুড়ি লীর হাত কাঁপছিল। সে ইলিয়ার দেওয়া মুদ্রা দুটো অদ্ভুত ভঙ্গীতে আবার তার হাতেই গুঁজে দিল।
তার মুখে কিন্তু বিরাম ছিল না। স্বগতোক্তির মত কি যে বলে চলেছে, সব বোঝা যাচ্ছিল না। কয়েকটা টুকরো কথা কেবল কানে এলো–হ্যায় বিধাতা–একী তোমার খেলা–নিয়তি কি নিষ্ঠুর কেউ রেহাই পায় না।
জিপসি বুড়ি লী আর সেখানে দাঁড়াল না। দ্রুত পায়ে সেখান থেকে সরে গেল।
ইলিয়া বুড়ির গমনপথের দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। স্বগতোক্তির মত তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো–বাপরে, কি সাংঘাতিক বুড়ি।
ইলিয়াকে স্বাভাবিক করে তুলবার জন্য বললাম, বুড়ির মাথার ঠিক নেই। সকলকে ভয় দেখানোর বাতিকগ্রস্ত। এসব কথার কখনো গুরুত্ব দিতে নেই।
ইলিয়া জানতে চাইল, এখানে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, তাই না?
–এই রাস্তার কয়েকটা বাঁক খুবই বিপজ্জনক। তাছাড়া রাস্তাটাও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক সরু। দুর্ঘটনা ঘটবার মত জায়গাই এটা। অথচ স্থানীয় পৌরপ্রশাসন মনে হচ্ছে এ বিষয়ে নিষ্ক্রিয়। এদের নামে মামলা করা উচিত।
ইলিয়া যেন কেমন ঘোরের মধ্যে পড়েছে মনে হল। বলল, শুধুই মোটর দুর্ঘটনা, না অন্য আরো
-পথেঘাটে বিশেষ করে এরকম পাহাড়ী পথে কতরকমের দুর্ঘটনাই ঘটতে পারে। কিন্তু গ্রামের মানুষের তিলকে তাল করে তোলাই স্বভাব। এভাবেই অভিশাপ শব্দটা এই জায়গাটার কপালে জুটেছে।
–এখন বুঝতে পারছি, এই কারণেই সম্পত্তিটার দাম উঠছে না।
ইলিয়ার গলার স্বর কাঁপছিল। লক্ষ্য করে বললাম, অনেকটা পথ যেতে হবে। চল তাড়াতাড়ি নেমে পড়া যাক।
চলতে চলতেই এক ফাঁকে বলে ফেললাম, আগামীকাল আমার একবার মার্কেট কডওয়েলে যাবার কথা আছে। সেখানে আমাদের কি আবার দেখা হতে পারে?
ইলিয়া বলল, তা সম্ভব হতে পারে। সন্ধ্যার ট্রেনে লণ্ডনে ফিরে যাব আমি। বিকেলে দেখা হতে পারে।
–তাহলে কোন কাফেতে–ব্লু ডগ অথবা
ইলিয়া হঠাৎ অদ্ভুতভাবে হেসে উঠল। কি জানি কেন। পরে বলল, ব্ল ডগ খুবই ভাল কাফে–ঠিক আছে বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ আমি সেখানে পৌঁছে যাব।
ইলিয়া সহজভাবে সাড়া দিয়ে আমাকে শঙ্কামুক্ত করল। আমি উল্লাসভরে বলে উঠলাম, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকব।
ততক্ষণে আমরা গ্রামের প্রান্তে এসে পৌঁচেছি। পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নেবার লগ্ন এসেছে। সহসা ইলিয়া আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, আচ্ছা জায়গাটা কি সত্যিই ভীতিজনক?
আমি এবারে উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলাম। বললাম, জিপসি বুড়ির প্রলাপগুলো দেখছি এখনো তোমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
এখানে ভয় পাবার মত তো কিছুই আমার নজরে পড়ল না। গ্রামের লোকে যাই বলুক জিপসি একর আমার খুব পছন্দ হয়েছে। মনের মত বাড়ি বানাতে হলে এমন প্রাকৃতিক পরিবেশই উপযুক্ত।
.
পরদিন বিকেলে মার্কেট কডওয়েলে আবার আমাদের দেখা হল। চা খেতে খেতে আমরা গল্প করলাম। কিন্তু নিজেদের সম্পর্কে কথা বিশেষ হল না। বাইরের নানা বিষয় নিয়ে গল্প করতে করতেই সময় কেটে গেল।
কথায় কথায় ইলিয়া জানাল, গতকাল যে গাড়িটার কথা বলেছিল সেটা তার নিজের গাড়ি নয়। তবে সেটা কার সেকথা খুলে বলল না।
সাড়ে পাঁচটায় ইলিয়ার গাড়ি ছাড়বার কথা। তার অনেক আগেই আমরা উঠে পড়লাম। চায়ের বিল আমি মিটিয়ে দিলাম।
ইলিয়া একসময় বলল, আগামী দু সপ্তাহ আমি লণ্ডনেই আছি।
তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে আমার ভাল লাগল। বললাম, তাহলে কোথায় কখন
.
তিনদিন পরে রিজেন্ট পার্কের নির্ধারিত স্থানে আমাদের দেখা হল। এই নিয়ে তৃতীয়বার।
দিনটা ছিল ঝকঝকে। একটা রেস্তোরাঁয় বসে আমরা খাওয়া দাওয়া করলাম, তারপর কুইন মেরীর বাগানে কিছু সময় ঘুরে বেড়ালাম। তারপর বাগানের এক নির্জন প্রান্তে ডেক চেয়ারে বসে গল্প জুড়লাম।
আজ আমি ইচ্ছে করেই নিজের ব্যক্তিগত কথা কিছু বললাম। খুব সাধারণ একটা স্কুলে আমি লেখাপড়া শিখেছিলাম।
স্কুল ছাড়ার পরেই শুরু হয়ে যায় আমার বিচিত্র বর্ণময় জীবন। একটা অন্তর্নিহিত অস্থিরতা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে।
কোন একটা কাজে বেশি দিন লেগে থাকতে পারতাম না। কিছুদিন পরেই একঘেয়ে লাগত। সবকথাই আমি খুলে বললাম।
ইলিয়া আমার যাযাবর জীবনের কাহিনী শুনে উত্তেজিত ভাবে বলে উঠল, আমাদের দুজনের জীবনধারা দেখছি একেবারে বিপরীত।
আমি হালকা সুরে বললাম, তুমি ধনী মহিলা—
কিন্তু ভাগ্যহত।
–ভাগ্যহত?
–হ্যাঁ।
এরপর একটু একটু করে নিজের জীবনকাহিনী শোনাল ইলিয়া। ওদের বিপুল সম্পদের কথা, সুখস্বাচ্ছন্দ্য ভোগের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ধনীদের জীবন যে কত ক্লান্তিকর, দুর্বিষহ সবই খুলে বলল।
আভিজাত্যের কৃত্রিম বেড়াজাল চারপাশে। নিজের খেয়াল খুশিমত সেখানে কোন কিছু করার সুযোগ নেই। বন্ধুবান্ধব নির্বাচনের ব্যাপারেও স্বাধীনতা থাকে না। সারাক্ষণ মাপাকথা, মাপাহাসি।
পুতুলের মত হাত পা নেড়ে কেবল নিয়ম রক্ষা করে যেতে হয়। পাছে মুখোস না একটু খসে পড়ে সেজন্য আশপাশের সকলের সদাসতর্ক নজর আর খবরদারি। খুব অল্প বয়সে মাকে হারিয়েছে ইলিয়া। বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন। বছর কয়েক আগে বাবাকেও হারিয়েছে সে। ঘরে এখন সৎমা।
স্পষ্ট করে না বললেও বুঝতে অসুবিধা হল না যে সম্মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক মধুর নয়। ভদ্রমহিলা বছরের অর্ধেকটাই কাটান আমেরিকায়। বাইরে ঘুরে বেড়ানোটাই তার জীবন।
আমার কাছে ওর জীবন এক অবিশ্বাস্য যন্ত্রণার জীবন বলেই মনে হল। প্রভূত বিত্তের মালিক হয়েও কৃত্রিম নিয়মের নিগঢ়ে দুঃসহ বন্দিজীবন।
সমগ্র পরিবেশ, আনন্দ অনুষ্ঠান, কোথাও আনন্দের ছিটেফোঁটা নেই শুনতে শুনতে আমার যেন দম আটকে আসতে লাগল।
সব শুনে মনে হল বাস্তবিকই আমাদের দুজনের জীবনে কোথাও মিল নেই এতটুকু। দুজন দুই মেরুর বাসিন্দা–কথাটা আমাদের জন্যই যেন তৈরি হয়েছিল।
-তাহলে তো দেখছি তোমার কোন বন্ধু নেই, আমি বিস্ময় প্রকাশ করলাম, পুরুষ বন্ধুও কি নেই?
বন্ধু কেউ নেই। বাছাই করা এমন পুরুষদের সঙ্গে আমাকে মিশতে দেওয়া হয় যে তাদের সঙ্গ বড় বৈচিত্র্যহীন ক্লান্তিকর।
-বন্ধু ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে? তোমার প্রাণের বন্ধু—
একজন তেমন আছে–গ্রেটা তার নাম।
–গ্রেটা কে?
-আমাকে জার্মান ভাষা শেখাবার জন্য গ্রেটাকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। মেয়েটি অন্য সকলের চেয়ে একেবারেই আলাদা। সে আমাকে নানাভাবে সাহায্যও করে।
একটু চুপ করে থেকে কি ভাবল ইলিয়া। পরে আবার বলতে লাগল।
ওর জন্যই আমি খানিকটা হাঁপ ছাড়তে পেরেছি। মাঝে মাঝে মর্জিমাফিক ঘুরে বেড়াতে পারি। আমার জন্য বেচারীকে মিথ্যেও বলতে হয় ঝুড়ি ঝুড়ি। জিপসি একরে আসার সুযোগ পেয়েছি ওরই জন্যে।
আমার সৎমা এখন প্যারিসে। আমি যে কদিন লণ্ডনে থাকব, আমার দেখাশোনা করবার জন্য গ্রেটাও থাকবে আমার সঙ্গে।
সপ্তাহে তিনটে করে চিঠি সৎমাকে লিখতে হয়। আমি যখন লণ্ডনের বাইরে যাই, দু-তিনখানা চিঠি লিখে গ্রেটার কাছে রেখে আসি। ও কয়েক দিন অন্তর সেগুলো ডাকে পাঠিয়ে দেয়। সত্য বুঝতে পারেন আমি লণ্ডনেই আছি।
মৃদু হেসে আমি বলি, হঠাৎ করে এই জিপসি একরে আসতে গেলে কেন?
–আমি আর গ্রেটা মিলে ঠিক করেছিলাম। সত্যি বন্ধু হিসেবে গ্রেটার তুলনা হয় না। আমি সকৌতুকে জিজ্ঞেস করি, তোমার এই বন্ধুটি দেখতে কেমন?
–গ্রেটা সুন্দরী। দেহের গড়নও চমৎকার। তার ওপরে অসম্ভব বুদ্ধিমতী। ইচ্ছে করলে গোটা পৃথিবী গ্রেটা জয় করে নিতে পারে। তুমিও তাকে পছন্দ না করে পারবে না।
আমি বিনীত কণ্ঠে বলি, মেয়েদের বেশি বুদ্ধি থাকাটা আমি হজম করতে পারি না। তাছাড়া গ্রেটা তোমার এত বেশি প্রিয়পাত্র যে আমি হয়তো তাকে হিংসে না করে পারব না।
–গ্রেটাকে তুমি হিংসে করো না। ও আসার পর থেকে আমার জীবনটা স্বাভাবিক হতে পেরেছে।
–কিন্তু গ্রেটা তোমাকে এখানে আসার পরামর্শ কেন দিল তা বুঝতে পারছি না। জিপসি একরে দর্শনীয় কিছুতো নেই। ব্যাপারটা খুবই রহস্যময় ঠেকছে।
–সেটা একটা গোপনীয় বিষয়, আমি আর গ্রেটাই কেবল জানি।
–আচ্ছা, আমাদের এই দেখা-সাক্ষাতের কথাও কি গ্রেটা জানে?
–জানে, তবে বন্ধুটি কে বা তার পরিচয় কি সে বিষয়ে কিছু জানে না। আমি সুখী, এতে সে আনন্দিত।
এরপর সপ্তাহখানেক ইলিয়ার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। তার সম্মা প্যারিস থেকে ফিরে এসেছেন। তার সঙ্গে আর একজনও এসেছেন, ইলিয়া তাকে ফ্র্যাঙ্ককাকা বলে ডাকে।
কয়েকদিন পরেই লণ্ডনে ইলিয়ার জন্মদিন পালিত হবে। সেই উপলক্ষ্যে সকলেই নাকি খুব
একটা বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। গ্রেটা নামের মেয়েটি ইলিয়ার জীবনের অনেকখানি দখল করে নিয়েছে। তার প্রশংসায় সর্বদাই সে পঞ্চমুখ। কেবল তাই নয় অতিমাত্রায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে কার্পণ্য করে না।
ইলিয়ার বিমাতা ও অন্যান্য অভিভাবকরা তার সমস্ত দায়-দায়িত্ব গ্রেটার ওপরই ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন।
তার ফ্র্যাঙ্ককাকার বিষয়ে ইলিয়া জানিয়েছিল, তিনি ঠিক তার কাকা নন–পিসেমশাই। তার সঙ্গে রক্তসম্পর্ক নেই।
অদ্ভুত প্রকৃতির এই মানুষটা সর্বদা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান। কোন কাজ করেন না, কিন্তু খরচের বেলা বেহিসাবী। ইলিয়ার ধারণা তার কাকাটি সঙ্গী হিসেবে চমৎকার। তবে মাঝে মাঝে যেন কেমন হয়ে যান
দেখাসাক্ষাতের মধ্য দিয়ে আমরা দুজন দুজনের অনেক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। কিন্তু লক্ষ্য করলাম, ইলিয়া কখনো তার আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য উৎসাহ দেখায়নি।
ব্যাপারটা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না। একদিন আমি নিজে থেকেই কথাটা জিজ্ঞেস করে ফেললাম।
ইলিয়া মৃদু হেসে বলল, না, মাইক, এখনই তাদের সঙ্গে তোমার পরিচয় হোক, আমি তা চাই না। কথাটা শুনে স্বাভাবিকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছিলাম। আমার আত্মমর্যাদায় আঘাত লেগেছিল।
ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলেছিলাম, আমি অবশ্য খুবই সাধারণ শ্রেণীর মানুষ, নিতান্তই নগণ্য….
ইলিয়া বলল, না মাইক, আমি সেকথা বলতে চাইনি। আসলে আমাদের সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে তখনই সকলে মিলে নানাভাবে গণ্ডগোল পাকাবার চেষ্টা করবে। সেটা আমার বাঞ্ছিত নয়।
আমি বললাম, আমার যেন মনে হচ্ছে, কেমন একটা লুকোচুরি খেলায় জড়িয়ে পড়েছি।
ইলিয়া বলল, আমার বয়স একুশ হতে চলল। একুশে পড়লেই আমি পছন্দমত আমার সঙ্গী নির্বাচন করার আইনসিদ্ধ অধিকার লাভ করব।
কেউই তখন আমার ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। আমার কথা নিশ্চয় তুমি বুঝতে পারছ।
একুশ বছরে পড়বার আগে সেকারণেই একটা গণ্ডগোল বাধাতে চাইছি না। তাহলে হয়তো আমাকে দূরে এমন কোথাও কৌশল করে পাঠিয়ে দেবে যে তোমার সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখাই সম্ভব হবে না। কটাদিন একটু ধৈর্য ধর মাইক…
–তোমার অসুবিধাটা আমি অনুধাবন করতে পারছি। তবে আমি এভাবে আড়ালে থাকার পক্ষপাতী নই বললাম।
আমাদের কথাবার্তার ফাঁকে জিপসি একরের প্রসঙ্গও এসে পড়ত। অবশ্য ইলিয়া নিজেই উত্থাপন করত।
কেমন স্বপ্নবিষ্ট গলায় বলে উঠত, আচ্ছা আমরা যদি জিপসি একর জায়গাটা কিনে নিই। কেমন হয়? পরে সেখানে একটা বাড়ি তুলব
ইলিয়ার কাছে স্যানটনিক্সের অনেক গল্পই করেছিলাম। আমি বুঝতে পারতাম না তার বাড়ি তৈরির কল্পনার সঙ্গে তার নামও জড়িয়ে ছিল কিনা।
ইতিমধ্যে আমি ইলিয়ার জন্য একটা সবুজ আংটি কিনে রেখেছিলাম। সেটা আমার তরফ থেকে তার জন্মদিনের প্রীতি উপহার স্বরূপ তুলে দিলাম। আনন্দে ইলিয়ার দুচোখ ঝকঝক করে উঠল।
বলল, জন্মদিনে অনেক উপহারই আমি পেয়েছি। তবে এটাই সবচেয়ে সুন্দর আর মূল্যবান।
ইলিয়া দু-একটা গয়না যা পরে থাকত, তা সবই মূল্যবান হীরে-জহরত বসানো। কিন্তু লক্ষ্য করেছিলাম আমার আংটিটা পেয়ে সে অকৃত্রিম আনন্দ প্রকাশ করেছিল।
দিন কয়েক পরে ইলিয়ার কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম। সে জানিয়েছে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দক্ষিণ ফ্রান্সে বেড়াতে যাচ্ছে, হপ্তা তিনেকের মধ্যেই ফিরে আসবে। আমি যেন বিশেষ চিন্তিত না হই।
ফিরে এসে আবার আমাদের দেখা হবে। সে এবারে একটা জরুরী বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করবে।
ইলিয়ার দর্শনবিহীন তিনটে সপ্তাহ খুব অস্থিরতার মধ্যে কাটল আমার। একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে ইলিয়া ও আমার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। এই সম্পর্কের পরিণতি কি তা বুঝতে পারছিলাম না।
ইতিমধ্যে জিপসি একর সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেল সম্পত্তিটা কিনে নিয়েছে লণ্ডনের এক সলিসিটর সংস্থা। তবে কার নির্দেশে কেনা হয়েছে সে সম্পর্কে কিছু জানা সম্ভব হয়নি।
সময় যেন কাটতে চাইছিল না। মন ক্রমেই অশান্ত হয়ে উঠেছিল। এই অবস্থায় একদিন মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। অনেক দিন তাঁর কাছে যাওয়া হচ্ছিল না।
.
০৪.
আমার মা গত কুড়ি বছর ধরে একটা বাড়িতে বাস করছেন। মায়ের ফ্ল্যাটের নম্বর ছেচল্লিশ। কলিং বেলের বোতাম টিপতে মা নিজেই এসে দরজা খুলে দিলেন। নির্বিকার ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে বললেন, ওঃ তুমি! এসো।
মায়ের পাশ কাটিয়ে আমি ভেতরে ঢুকলাম।
আমার মা স্নেহময়ী। কিন্তু তা কখনো বাইরে প্রকাশ হতে দেননি। আমার অস্থির জীবনধারা তাকে পীড়া দিত, আমাকে শুধরাবার অনেক চেষ্টাই তিনি করেছেন। তবে সে চেষ্টা ফলবতী হয়নি।
এই নিয়েই দুজনের সম্পর্ক একটা অস্বস্তিকর পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে।
ভেতরে এসে গভীর অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন মা। পরে বললেন, অনেকদিন পরে এলে। এতদিন কি করছিলে?
–এই যা করি, নানান রকম কাজ।
–আমার সঙ্গে শেষবার দেখা হবার পর এর মধ্যে কতগুলো নতুন চাকরি করলে?
আমি মৃদু হেসে বললাম, গোটা পাঁচেক।
-তুমি কি আর সাবালক হবে না?
-আমি তো পূর্ণমাত্রায় সাবালক এখন। আমি আমার নিজের পথ বেছে নিয়েছি। তা তুমি কেমন আছ?
–আমার অবস্থাও তোমারই মত, কোন পরিবর্তন নেই।
একটু থেমে হঠাৎ সুর পাল্টে মা জিজ্ঞেস করলেন, তোমার হঠাৎ এভাবে হাজির হবার কি কারণ ঘটল?
-তোমার কাছে কি বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে আসতে হবে?
–তোমাকে তো তাই দেখে আসছি।
-আচ্ছা, মা আমি এই দুনিয়াটাকে বুঝতে জানতে চাই, এতে তোমার এত আপত্তি কেন, বলতো?
–একটার পর একটা চাকরি ছাড়াই কি তোমার পৃথিবীকে জানা বোঝা?
–তাই তো।
–এতে তুমি কতটা সফল হবে আমার মাথায় ঢোকে না।
–আমি আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পথেই তো এগিয়ে চলেছি।
এরপর মা দু পেয়ালা কফি নিয়ে এলেন। প্লেটে করে আমাকে হাতে তৈরি কেক দিলেন। আমি আর মা মুখোমুখি বসলাম।
মা বললেন, এবারে তোমাকে কিছুটা অন্যরকম লাগছে।
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালাম। মা বললেন, কি এমন ব্যাপার ঘটল, বলতো?
–কিছুই ঘটেনি।
–কিন্তু তোমাকে একটু উত্তেজিত লাগছে।
–হ্যাঁ, তুমি তো আমার সবকিছুই জেনে বসে আছ।
–না, তা জানি না। তোমার জীবনযাপন এমন যে আমার পক্ষে কিছুই জানা সম্ভব না। কিন্তু এবারে ব্যাপারটা কি? তোমার কোন বান্ধবী
আমি হেসে বললাম, তুমি দেখছি কাছাকাছি চলে এসেছ!
মেয়েটি কেমন?
–ঠিক আমার মনের মত।
–তাহলে তাকে কি আমার কাছে নিয়ে আসছ?
–না।
–কেন, পাছে আমি তোমায় নিষেধ করি?
–তোমার ওজর আপত্তি কি আমি গ্রাহ্য করি?
তা না করলেও, ভেতরে একটা নাড়া তো পাবেই। মেয়েটা কি কোনভাবে তোমাকে হাত করে ফেলেছে?
–ওসব কিছুই নয় মা। ওকে দেখলে তুমি খুশি হবে।
–তুমি তাহলে এখন আমার কাছে কি চাও?
–আমার কিছু অর্থের প্রয়োজন।
–কেন, ওই মেয়েটার পেছনে খরচ করবে বলে?
–না, বিয়ের জন্য আমাকে একটা ভাল পোশাক কিনতে হবে।
–তাহলে ওই মেয়েটিকেই বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছ?
–তার তরফ থেকে যদি কোন আপত্তি না থাকে।
মায়ের মুখের ভাব হঠাৎ পাল্টে গেল। কঠিন ভাবটা সরে গেল। বিচলিত কণ্ঠে বললেন, খোকা, আমাকে যদি সব খুলে বলতে!
তারপর আক্ষেপের সুরে বলতে লাগলেন, আমি বুঝতে পারছি, সাংঘাতিক কোন বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছ। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। এই আশঙ্কাটাই আমার ছিল, পাত্রী নির্বাচনের ব্যাপারে তুমি ঠিক ভুল করে বসবে।
–আমার পাত্রী নির্বাচনে ভুল হয়েছে–তোমার কাছে আসাই আমার ভুল হয়েছে।
আমার মাথার ভেতরে যেন হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠল। আমি লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর কোন কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে পথে নেমে পড়লাম।
.
০৫.
বাসায় এসেই অ্যান্টিবাস থেকে পাঠানো ইলিয়ার একটা তার পেলাম। ছোট্ট করে জানিয়েছে–
আগামীকাল বেলা সাড়ে চারটের সময় নির্দিষ্ট জায়গায় তোমার জন্য অপেক্ষায় থাকব।
রিজেন্ট পার্কের সেই পুরনো জায়গাতেই আমাদের দেখা হল। যেন একযুগ পরে ওকে দেখলাম।
অনেক কথা জমে ছিল। কিন্তু বলতে গিয়ে যেন বাধ বাধ ঠেকতে লাগল। মনে হল, ইতিমধ্যে ইলিয়া কি অনেক পাল্টে গেছে? ওর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দক্ষিণ ফ্রান্সের কোন শহরে এতদিন কাটিয়ে এসেছে, তার মধ্যে কি ধরনের পরিবর্তন সম্ভব? কিন্তু আমি তো জানি ইলিয়া আমাকে ভালবাসে।
আমাকে ইতস্ততঃ করতে দেখে ইলিয়াই প্রথম কথা বলল, তোমার সেই স্থপতি বন্ধু যে বাড়িটা তৈরি করেছে বলেছিলে, এবারে আমি সেটা দেখে এসেছি।
আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কে মিঃ স্যানটনিক্সের কথা বলছ?
-হ্যাঁ। আমরা একদিন সেখানে লাঞ্চ খেতে গিয়েছিলাম।
–এরকম ব্যাপারটা সম্ভব হল কি করে? বাড়ির মালিক কি তোমার সম্মায়ের পরিচিত?
–ভদ্রলোকের নাম দমিত্রি কনস্ট্যানটাইন। ভদ্রলোকের সঙ্গে আমাদের কারো আলাপ পরিচয় ছিল না। গ্রেটাই কি করে সব ব্যবস্থা করেছিল। ফ্র্যাঙ্ককাকাও সঙ্গে ছিলেন।
-তোমার প্রিয়পাত্রী গ্রেটার কথা তো বললে না। সে-ও নিশ্চয় সঙ্গে ছিল?
-না, গ্রেটা আমাদের সঙ্গে যায়নি। আসলে আমার সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতা করা–মানে আমার সম্মা ঠিক সুনজরে দেখেন না।
-তাতে আশ্চর্য কি। তার কাছে গ্রেটা তো একজন মাইনে করা কর্মচারীর বেশি নয়। তাছাড়া নিশ্চয় সে সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একজন। বিত্তবানদের পরিবারের একজন হিসেবে গণ্য হবার উপযুক্ত নয়।
-না, মাইনে করা কর্মচারী হলেও আমি তাকে সেভাবে দেখি না। ও আমার বান্ধবী, সহচরী।
-ওসব কথা এখন থাক। তোমার সঙ্গে আমরা দরকারী কথাগুলো সেরে নিই।
–বেশ বলো।
-ভদ্রলোকের কাজের সত্যিই তুলনা হয় না। এককথায় অপূর্ব। তিনি যদি আমাদের জন্যও এমন একটা বাড়ি তৈরি করে দিতেন!
বিভারিয়ার বাড়িটার বিস্তারিত বর্ণনা আমি ইলিয়াকে দিয়েছিলাম। গ্রেটার ব্যবস্থাপনায় সে নিজেই উদ্যোগী হয়ে সেই অপূর্ব সুন্দর বাড়িটা দেখে এসেছে এবং এমন একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখছে।
আমাদের জন্য কথাটা বলে তার এই স্বপ্নের সঙ্গে আমাকেও জড়িয়ে নিয়েছে। ইলিয়ার যে মানসিক পরিবর্তন হয়নি বুঝতে পেরে আশ্বস্ত হলাম।
ইলিয়া হঠাৎ প্রশ্ন করল, এতদিন তুমি কি করেছ?
বারবার যা করে থাকি তাই করেছি। একটা নতুন কাজ করেছি, আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।
-তোমার মায়ের সম্পর্কে তো এতদিন আমাকে কিছু বলনি।
বলার মতো কি আছে, বল?
–কেন, তোমার মাকে ভালবাস না?
সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্নটার উত্তর দিতে পারলাম না। পরে ধীরে ধীরে বললাম, ঠিক বলতে পারব না। মানুষ যখন স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে তখন ক্রমেই তো জীবনে পিতামাতার প্রয়োজন কমে আসে। তবে এটুকু বলতে পারি, দুনিয়ায় মাকেই যা আমি একটু ভয় পাই। তার কাছে আমার কোন অপকীর্তিই লুকনো থাকে না। মুখ দেখেই ঠিক বুঝে যান।
ইলিয়া হেসে বলল, একজনকে তো জানতে হবে।
আমি ওর ডানহাতের আঙুলগুলো নিয়ে খেলা করতে করতে বললাম, আচ্ছা ইলিয়া আমার সম্পর্কে তুমি কতটুকু জান?
–তোমার সবটা জানি বলেই তো বিশ্বাস।
–কিন্তু বিশেষ কিছু তো তোমাকে আমি বলিনি।
-তোমার একান্ত ব্যক্তিগত কথা হয়তো কিছু বলনি। কিন্তু তুমি মানুষটা আমার কাছে লুকনো নেই। তোমার কোনটা পছন্দ কোনটা পছন্দ নয় তা আমি ঠিক বুঝতে পারি।
–আমি যে তোমায় ভালবাসি সে কথাও?
–হ্যাঁ। আমার মনের কথা তোমার কাছেও নিশ্চয় লুকনো ছিল না? তাই নয় কি?
–কিন্তু ইলিয়া, একটা বিষয়ে আমি পরিষ্কার নই। দেখ, লণ্ডন শহরের অতি নগণ্য একটা পাড়ায় আমার মা বাস করেন। আমি কে, কিভাবে জীবনযাপন করি সবই তুমি জান। তোমার জীবনের সঙ্গে আমার জীবনের দুস্তর ব্যবধান। এই পরিস্থিতিতে আমাদের এই সম্পর্কের পরিণতি কি?
–আমাকে কি তুমি একবার তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যেতে পার না?
–তা পারি। কিন্তু তা আমি করব না। দয়া করে তুমি আমাকে নিষ্ঠুর ভেবো না। আসলে আমার ইচ্ছা, দুজন দুজনের জীবনের পরিবেষ্টনী থেকে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জীবনযাপন করব। সম্পূর্ণ নতুন ভাবে আমাদের জীবন গড়ে তুলবে হবে। নাহলে বাঁচতে পারব না আমরা।
–আমার মনের কথাটাই তুমি বলেছ। আমিও তোমাকে একথাই বলতাম। জিপসি একরে আমরা কেবল আমাদেরই জন্য একটা বাড়ি তৈরি করব।
তোমার স্থপতি বন্ধু মিঃ স্যানটনিক্সই সেই বাড়ি তৈরি করবেন। তবে তার আগে আমাদের বিয়েটা হয়ে যাওয়া দরকার।
-হ্যাঁ, আমিও তাই চাই। কিন্তু এর ফলে তোমার কোন অসুবিধা যদি হয়
-অসুবিধার কিছু নেই। আইনের চোখে আমি এখন সাবালিকা। এখন নিজের খেয়াল খুশিমত চলতে আমার কোন বাধা নেই। ভাবছি, আগামী সপ্তাহেই আমাদের বিয়েটা চুকিয়ে ফেলতে পারব।
তবে আত্মীয়-পরিজনের মধ্যে আমাদের বাস করা হবে না। দুই তরফের কেউই ভালভাবে মেনে নিতে পারবে না।
-তুমি আমাকে কি করতে বলছ?
–বিয়ের কথা আমি আমার আত্মীয় পরিজনদের কিছু বলব না, তুমিও তোমার মাকে কিছু বলবে না। বিয়ে হয়ে যাবার পরে জানাজানি হলে বিশেষ অসুবিধা হবে না। দু চারদিন কিছু হৈ-চৈ হবে এই যা।
একটা কথা মনে পড়ে গেল আমার বললাম, কিন্তু এদিকে যে জিপসি একরের সম্পত্তিটা বিক্রি হয়ে গেছে।
–সে খবর আমার অজানা নয় মশাই। দুচোখে হাসির ছটা বিচ্ছুরিত করে বলল ইলিয়া, জিপসি একরের খোদ মালিকই এখন তোমার সামনে বসে রয়েছে।
.
০৬.
সবুজ মাঠের ওপরে কৃত্রিম ঝরনার পাশে বসে আছি আমরা পাশাপাশি। আশপাশে জোড়ায় জোড়ায় আরো অনেকে বসে আছে। যে যার নিজের স্বপ্ন নিয়েই ব্যস্ত।
এসময় গম্ভীর স্বরে ইলিয়া বলল, মাইক, আজ আমার নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। বক্তব্যটা অবশ্য জিপসি একর বিষয়ে।
আমি বললাম, সম্পত্তিটা কি তুমি তোমার নিজের নামে কিনে নিয়েছ? এতসব করলে কিভাবে, তুমি তো আমাকে তাজ্জব করে দিলে।
-এতে তাজ্জব হবার কি আছে। আমার অ্যাটর্নিই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ওসব নিয়ে আপাতত তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে। এখন আমার কথা শোন।
-শোন ইলিয়া, তোমার অতীত কোন ইতিহাস আমি শুনতে চাই না। আমার কোন আগ্রহ নেই।
-না মাইক, আমি সেকথা বলতে চাইনি। আসলে আমি যেটা বলতে চাইছি, অনেক আগেই তা বলা উচিত ছিল। কিন্তু পাছে তুমি আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাও, সেই ভয়ে বলতে পারিনি। মাইক, আমি সত্যিই ধনী।
-তুমিতো আগেই একথা বলেছ।
–কেবল ওইটুকুই বলেছিলাম। কিন্তু ওটুকুই শেষ নয়। আমার ঠাকুরদার কল্যাণেই আমাদের যত বিত্ত সম্পত্তি। খনিজ তেল থেকেই তিনি অগাধ সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। তেল ছাড়াও নানা ধরনের ব্যবসা ছিল তাঁর।
ঠাকুর্দার তিন ছেলের মধ্যে বাবা ছিলেন বড়। আমার দুই কাকা অবিবাহিত অবস্থাতেই মারা গিয়েছিলেন। ফলে বাবা একাই বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন।
মৃত্যুর আগেই বাবা আমার সম্মায়ের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রেখে দিয়ে গিয়েছিলেন। বলতে গেলে পিতার সমস্ত সম্পত্তি আমিই পেয়েছি।
এই সম্পত্তির পরিমাণ যে কত তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। তুমি জান না, আমি এখন আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ ধনীদের একজন।
-হায় ভগবান। বিস্ময়ে হতবাক হবার মত অবস্থা আমার, এমনটা সত্যিই আমার ধারণায় ছিল না।
আমি ইচ্ছে করেই তোমাকে একথা জানতে দিইনি। আমার নামটা পর্যন্ত গোপন করে গিয়েছিলাম, পাছে তোমার মনে কোন সন্দেহ না দেখা দিতে পারে।
ইলিয়া গুডম্যান হল আমার আসল নাম। মাইক, বাধ্য হয়েই আমাকে এই ছলনার আশ্রয়টুকু নিতে হয়েছিল।
বিত্তবান হতভাগ্য মানুষদের একজন আমি। আমার চারধারে নানান বাধানিষেধের প্রাচীর। পেশাদার গোয়েন্দারা সারাক্ষণ আমার গতিবিধির ওপর নজর রাখে।
কারুর সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠার আগে সে আমার উপযুক্ত কিনা তা নানাভাবে যাচাই করে নেওয়া হয়।
আমার সেই দুর্বিষহ নিঃসঙ্গ জীবনের কথা তোমাকে সব বুঝিয়ে বলতে পারব না। আমার কাছে তা এক দুঃস্বপ্নের মত।… তোমাকে পেয়ে আমি মুক্তির স্বাদ পেয়েছি।
এখন আমার ইচ্ছে, জিপসি একরেই আমাদের জন্য একটা বাড়ি তৈরি হবে। এই দেখ, কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই সেই জিপসি বুড়ির চেহারাটা চোখের ওপরে ভেসে উঠল।
-ওই ছিটেল বুড়ির কথা তুমি মন থেকে মুছে ফেল।
তবে জায়গাটা যে অভিশপ্ত বুড়ি লী কিন্তু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে।
–জিপসিদের স্বভাবই ওরকম। সব সময়েই তারা এমনি ধরনের অলৌকিক অথবা অভিশাপের কাহিনী বলে লোককে চমকে দেবার চেষ্টা করে। মানুষের কুসংস্কারকে উস্কে দেওয়াই ওদের জীবিকা।
-কিন্তু কি জান–
-তবে জিপসি একর সম্পর্কে যদি তোমার মনে কোন দ্বিধা থাকে তাহলে আমরা অনায়াসে অন্য কোনও সুন্দর জায়গায় গিয়ে বাস করতে পারি।
ধর ওয়েলস-এর পাহাড়ী অঞ্চলে কিংবা স্পেনের সমুদ্রোপকূলে স্যানটনিক্স আমাদের মনের মত বাড়ি তৈরি করে দিতে পারেন।
ইলিয়া দৃঢ়কণ্ঠে প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, তা হবে না, জিপসি একরেই আমরা বাড়ি তৈরি করব। সেখানেই আমাদের প্রথম পরিচয় হয়েছিল।
-হ্যাঁ, সেকথা আমারও হৃদয়ে গাঁথা হয়ে আছে।
–তোমাকে বলা হয়নি, আমি তোমার বন্ধু মিঃ স্যানটনিক্সের কাছেও গিয়েছিলাম। দক্ষিণ ফ্রান্সে থাকার সময় ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।
–ইলিয়া, তুমি দেখছি আজ আমাকে কেবল চমকেই দিচ্ছ। তোমাকে এক নতুন রূপে আবিষ্কার করছি।
যাই হোক কাজের কথা শোন। ভদ্রলোককে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। জিপসি একরে আমাদের বাড়ি তৈরির পরিকল্পনাটা তাঁকে খুলে জানালাম। তিনি সানন্দে সম্মতি দিয়েছেন। কথা দিয়েছেন, টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষ অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার কাজ চুকলেই খুব দ্রুত কাজ শুরু করে দেবেন।
আমি বললাম, তুমি দেখছি কেবল দক্ষিণ ফ্রান্স সফরেই যাওনি, আমাদের কাজগুলোও ঠিক ঠিক ভাবে গুছিয়ে ফেলেছ।
-হ্যাঁ, শোন, আগামী মঙ্গলবার দিনটা শুভ, আমাদের বিয়েটা সেই দিনই সেরে নেব। ভাবছি।
–কিন্তু, আপাততঃ সে খবর কাউকে জানানো চলবে না।
–শুধু গ্রেটা জানবে। প্রয়োজনীয় সাক্ষীসাবুদ বাইরে থেকেই আমরা জোগাড় করে নেব।
বেশ তাই হবে।