১.১ সাহিত্যের ভোজসভা

এলিফ্যান্টস ক্যান রিমেমবার (১৯৭২) – আগাথা ক্রিস্টি
অনুবাদ : পৃথ্বীরাজ সেন

সাহিত্যের ভোজসভা

মিসেস অলিভার কেশবিন্যাস নিরীক্ষণ করতে আয়নায় নিজের দিকে তাকাতেই হঠাৎ ম্যান্টলপিসের ওপর রাখা ঘড়িটার দিকে তাকালেন কারণ তার ধারণা সেটা কুড়ি মিনিট স্লো যাচ্ছে। তিনি খোলাখুলিভাবেই স্বীকার করেন যে, তার কেশবিন্যাসের স্টাইল সবসময়েই কেমন যেন বদলে যায়। তিনি প্রায় সর্বতোভাবে চেষ্টা করেন কেশবিন্যাসের স্টাইল একইরকম রাখতে এবং ভ্রূ-লেখা বুদ্ধিদীপ্ত করে তুলতে। আঁটো করে চুলগুলো থোকায় থোকায় কুঞ্চিত করতে চেষ্টা করেছিলেন আবার কখনও বা চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে একধরনের চুলের আর্ট সৃষ্টি করার চেষ্টাও করেছিলেন। তার কেশবিন্যাস কী ধরনের হবে সেটা কোনো ব্যাপারই। নয় আজ কারণ আজ তিনি যা করতে যাচ্ছেন তা তিনি কদাচিত করে থাকেন।

তার ওয়ারড্রবের একেবারে ওপরের তাকে চারটি টুপি শোভা পাচ্ছিল। আপনি যখন বিয়েবাড়িতে যাবেন অবশ্যই টুপি ব্যবহার করতে হবে। তাই মিসেস অলিভার দুটি টুপি রেখেছেন বিবাহবাসরের জন্য চিহ্নিত। একটা হল পাখির পালকের তৈরি গোলাকৃতি ব্যান্ডবক্সের মতো, সেটা মাথার ওপর বেশ আঁটো করে বসানো যায় ফলে এর সুবিধা হল যে, হঠাৎ বৃষ্টি হলে বিবাহবাসরে যেতে গিয়ে চুল ভিজে যাওয়ার ভয় থাকে না।

অপরটি আরো বেশি সম্প্রসারিত, এ ধরনের টুপি গ্রীষ্মের কোনো এক শনিবারের অপরাহ্নে বিয়েবাড়িতে যোগ দিতে যাওয়ার পক্ষে উপযুক্ত। তাতে ফুল সিফনে লাগানো থাকে লজ্জাবতী লতা জড়ানো একটা হলুদ জালের আবরণে ঢাকা থাকে।

অপর দুটি টুপি সর্বপ্রয়োজনের উপযোগী। একটা টুপির তো তিনি নাম দিয়েছেন–কান্ট্রি হাউস হ্যাট।

মিসেস অলিভার শীতের দিনে কাশ্মীরী পুলওভার এবং গরমের দিনে পাতলা পুলওভার ব্যবহার করেন। কিন্তু তিনি পুলওভার গায়ে চাপালেও টুপি বড়ো একটা ব্যবহার করেন না। সত্যি কথা বলতে কি মফসসলে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ভোজ সারতে টুপি পড়ার দরকার হয় না।

চতুর্থ টুপিটা অত্যন্ত দামি এবং অস্বাভাবিক টেকসইও বটে। সম্ভবত তিনি কিছু সময়ের জন্য ভাবলেন কারণ সেটা অত্যন্ত দামি।

একটু দোটানায় পড়ে তাকে সহযোগিতার জন্য হাঁক দিলেন। মরিয়া ছুটে এলো, পরামর্শ দেবার জন্য তাকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

মরিয়া জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনার সুন্দর স্মার্ট টুপিটা কি আপনি পড়তে যাচ্ছেন?

এই কথার উত্তরে হ্যাঁ বলেছিলেন মিসেস অলিভার এবং জানতে চেয়েছিলেন এইভাবে কিংবা অন্য কীভাবে পড়লে ভালো দেখাবে তাকে।

মরিয়ার দিক থেকে সাহায্যের আশায় বেশ কয়েকবার ট্রায়াল দেবার পর টুপিটা মাথার থেকে সরিয়েছিলেন। উলের পোশাক পরিহিতা মিসেস অলিভারের মাথায় টুপিটা চাপিয়ে সামান্য একটু আধটু এদিক ওদিক ঘুরিয়ে মরিয়া বলেছিল, আপনাকে এরকম স্মার্ট আগে কখনও দেখা যায়নি।

তাকে কিছু বলার সুযোগ দিলেই সব সময়েই তার পছন্দে সায় দেয়, তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে, এই জন্যই মরিয়াকে খুব পছন্দ করেন।

মধ্যাহ্নভোজে বক্তৃতা দিতে যাচ্ছেন, মরিয়া জিজ্ঞাসা করায় মিসেস অলিভার যেন দারুণ ভয় পাওয়ার মতন চমকে উঠলেন এবং বললেন, না, অবশ্যই নয়। এবং বললেন, তুমি ত জানো আমি কখনও বক্তৃতা দিই না।

মরিয়া ভেবেছিল, সাহিত্যিকদের মধ্যাহ্নভোজে সবাই যা করে থাকেন আপনিও তাই করতে যাচ্ছেন। ১৯৭৩ সালের সব বিখ্যাত লেখকরা কিংবা যে বছরেই হোক না কেন আমরা এখন তাদের কাছে পেয়েছি।

মিসেস অলিভার বললেন, আমি কোনো বক্তৃতা দিতে চাই না, যাঁরা বক্তৃতা দিতে পছন্দ করে থাকেন তারাই দেবেন, আর তারা আমার থেকে ভালোই বক্তা।

মরিয়া বলল–আমি নিশ্চিত, আপনি এতে ঠিক মতো মন দিলে ভালো বক্তৃতা দিতে পারবেন।

মিসেস অলিভার বললেন, না, আমার বলা উচিত নয়, আমি জানি কী করতে পারি, এবং এও জানি আমি কী করতে পারি না। আমি বক্তৃতা দিতে পারি না কারণ স্নায়ু দুর্বল হয়ে ওঠে আমার, সম্ভবত তখন আমি তোতলাতে থাকি কিংবা একই কথা দুবার বলে ফেলি, আমি চিন্তায় পড়ে যাই তখন আমি কেবল অপমান বোধ করি না, সম্ভবত তখন আমাকে ভীষণ অপমানিত দেখায়। বক্তৃতা লিখে নিয়ে গিয়ে পড়া যায় আমি সেটাও পারি, কিন্তু আমি সেটাকে বক্তৃতা বলে মনে করি না।

মরিয়া বললেন, বেশ, আশাকরি সব কিছুই ভালোভাবে সম্পন্ন হবে। তবে আমি এও নিশ্চিত যে, মধ্যাহ্নভোজ দারুণ সুন্দর হয়ে উঠবে।

বিমর্ষ গলায় মিসেস অলিভার বললেন, অনেক অনেক ভালো মধ্যাহ্নভোজ।

মুখে প্রকাশ না করে তিনি ভাবলেন যে, আমি নরকে যাচ্ছি? একটু সময়ের জন্য নিজের মনে চিন্তা করলেন কারণ কোনো কিছু করার পর ভাবার থেকে কিছু করার আগে ভেবে দেখাটাই বেশি পছন্দ করেন তিনি।

তিনি নিজের মনে বললেন, স্টোভের ওপর জ্যাম উতলে পড়ার গন্ধ পেয়ে সে তখন ছুটে গিয়েছিল রান্নাঘরে। আমি দেখতে চাই সেটা কী রকম অনুভূত হয়, সব সময়েই সাহিত্যবাসরের মধ্যাহ্নভোজে আমি আমন্ত্রিত হয়ে থাকি, বা সে রকম ধরনের কিছুতে আর আমি কখনও যাই না।

সুন্দর মধ্যাহ্নভোজের শেষ পদে এসে মনে মনে সন্তোষ প্রকাশ করলেন মিসেস অলিভার যে, তাঁর প্লেটে তখনও ডিমের শ্বেতাংশের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে মিষ্টি খাবারের কিছু অবশিষ্ট পড়েছিল। মিষ্টি খাবার তার খুব পছন্দ, মধ্যাহ্নভোজের শেষ পাতে এটা খুবই সুস্বাদু। সেটা বেশ তৃপ্তি সহকারে খেতে গিয়ে ভাবছিলেন কেউ যখন মাঝ বয়সে যায় এই মিষ্টি খাবারের ব্যাপারে তাকে খুব সতর্ক থাকতে হবে, বিশেষ করে দাঁতের ব্যাপারে। তার দাঁতগুলো দেখতে সুন্দর সাদা ঝকঝকে কিন্তু এটা সত্যি আসল জিনিসের মতন হলেও ওগুলো আসল দাঁত নয়। বরং কুকুরের দাঁতগুলো সব সময়ে তার মনে হয় সত্যিকারের হাতির দাঁতের মতন, কিন্তু তার ধারণা মানুষের দাঁতগুলো নকল প্লাস্টিকের নেহাতই হাড় বৈ কিছু নয়। যাইহোক লজ্জাজনক কোনো ব্যাপারে জড়িয়ে না পড়াই ভালো যেমন লবণাক্ত কাজুবাদাম কিংবা চকোলেটে লোভ না করাই ভালো, একটা পরিপূর্ণ তৃপ্তিতে শেষ গ্রাসটা মুখভর্তি করে খেলেন। বেশ ভালো মধ্যাহ্নভোজ বলতে হয়।

মধ্যাহ্নভোজ যেমন উপভোগ করলেন সেই সঙ্গে উপস্থিত অতিথিদের সঙ্গও তেমন ভাবে উপভোগ করলেন। শুধুমাত্র মহিলা লেখিকাদের সংবর্ধনা জানানোর জন্যই এই মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন–কিন্তু সৌভাগ্যবশত সেটা আর কেবল মহিলা লেখিকাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না। সেখানে অন্য লেখক সমালোচক এবং পড়ুয়ারাও উপস্থিত ছিল, দু-জন আকর্ষণীয় পুরুষের মাঝে বসেছিলেন মিসেস অলিভার। একজন হল এডউইন অ্যাবাইন যাঁর কবিতা তিনি সবসময়ে উপভোগ করে থাকেন, সাহিত্যে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারও বিরাট। এবং তিনি দারুণ আতিথ্যপরায়ণ ব্যক্তি। বিদেশ ভ্রমণে তার অনেক আতিথেয়তার অভিজ্ঞতা আছে। শুধু তাই নয় রেস্তোরাঁ এবং ভালো ভালো খাবারেও যথেষ্ট আগ্রহী তিনি। তারা দু-জনে অত্যন্ত খুশি মনে খাবারের প্রসঙ্গে আলোচনা করলেন সাহিত্যের আলোচনা দূরে সরিয়ে রেখে।

অপরজন হলেন স্যার ওয়েসলি কেল্ট, মধ্যাহ্নভোজের একজন ভালো সঙ্গী। তিনি তার বই-এর প্রসঙ্গে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বললেন। কিন্তু এমন কোনো মন্তব্য করলেন না যাতে মিসেস অলিভার অসন্তুষ্টি বোধ করেন, এই কারণেই মিসেস অলিভার তাকে তার পক্ষের একজন বলে মনে করলেন। মিসেস অলিভার মনে করেন, পুরুষদের প্রশংসা সবসময়ই গ্রহণযোগ্য। এ ব্যাপারে মহিলারাই সাধারণত উৎসাহিত হয়ে থাকে। এমন কিছু কিছু কথা মহিলারা লিখে থাকে তাকে। এক এক সময়ে দেশের অনেক দূর থেকে কিছু ভাবপ্রবণ যুবকও চিঠি লেখে তাকে। গত সপ্তাহে তিনি তার এক ভক্ত যুবকের কাছ থেকে একটা চিঠি পান যার শুরুটা ছিল : আপনার বই পড়ে আমার মনে হয়েছে, আপনি নিশ্চয়ই মহৎ মহিলা। দ্য সেকেন্ড গোল্ডফিশ, বইটা পড়ার পর ছেলেটি তার সাহিত্য সম্পর্কে প্রচণ্ড উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। যা তিনি মনে করেন সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। বিনয়ীর সম্মান পাওয়ার যোগ্য তিনি কিনা জানেন না কারণ তার ধারণা, যে সব গোয়েন্দা কাহিনি তিনি লেখেন সেই নিরিখে খুব ভালো কিছু কাহিনি আছে অন্য সব কাহিনির থেকে অনেক অনেক বেশি ভালো হয়তো বরং তাতে কেউ যদি তাকে একজন মহৎ মহিলা বলে আখ্যা দেয় তাতে তিনি কোনো যুক্তি খুঁজে পান না। এবং তিনি একজন ভাগ্যবতী মহিলা যিনি কিছু কাহিনি লিখে তার পাঠকদের কাছে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন ভালোভাবে, এবং তিনি মনে মনে ভাবলেন একেই বলে হয়তো চমৎকার সৌভাগ্য।

অবশেষে সব কিছু বিবেচনা করে মনে হয় তিনি তার ভাগ্য পরীক্ষায় বেশ ভালোভাবেই উত্তীর্ণ হতে পেরেছেন। এখন তারা কফির উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে যেখানে আপনি আপনার সঙ্গী বদল করতে পারেন। এবং নতুন সঙ্গীর সঙ্গে খোসগল্প করতে পারেন। মিসেস অলিভার ভালোভাবেই জানেন এখন মহিলারা যেখানে জমায়েত হবে সেখানে তাকে আক্রমণ করবে এবং এধরনের আক্রমণ মানে নক্কারজনক প্রশংসা, এ-সব ক্ষেত্রে তিনি সব সময় সঠিক উত্তর দেবার পরে নিজেকে ভীষণ অনভিজ্ঞ বলে মনে করেন কারণ তিনি জানেন আপনার দেবার মতন সত্যিকারের সঠিক উত্তর সেই। সেই আলোচনা এমনভাবে চলে যেন মনে হয় বিদেশ ভ্রমণে ভাষার প্রকাশভঙ্গি সহ একটা ভ্রমণসঙ্গী জাতীয় বই সঙ্গে নিয়ে যাওয়া।

একজন প্রশ্ন করলেন, আপনার বই পড়তে কি দারুণ ভালো লাগে আমার, এবং আরও মনে হয় কী রকম বিস্ময়করই না সেগুলো।

লেখিকা উত্তরে বললেন, এটা আপনার অত্যন্ত দয়া আমি যে কী খুশি

পরবর্তী প্রশ্ন করলেন, আপনার বোঝা উচিত আপনার সঙ্গে মিলিত হবার জন্য মাসের পর মাস ধরে অপেক্ষা করছি এটা তো সত্যিই বিস্ময়কর।

ঠিক, এইভাবেই চলে তাদের আলোচনার গতিপথ। সব কথাই বলতে হবে আপনার বই সম্পর্কে কিংবা অন্য কোনো লেখিকার বই সম্পর্কে। এর বাইরে আপনি একটি কথাও বলতে পারবেন না। কিন্তু মিসেস অলিভার বেশ ভালোভাবেই জানেন তার সঠিক ক্ষমতা। সেই যখন তিনি বিদেশের দূতাবাসে ছিলেন তার বন্ধু তার সামনে কয়েকটি প্রশ্ন রেখেছিলেন।

আলবারটিনা বললেন, আপনার সব কথা আমি শুনেছি, এবং তিনি আরও বলেছিলেন সংবাদপত্রের সেই তরুণ প্রতিনিধিটি আপনার সাক্ষাৎকার নেবার সময় আপনি তাকে কী বলেছিলেন আমি তাও শুনেছি। আপনার ভালো কাজের জন্য যে গর্ব হওয়া উচিত ছিল সেটা আপনি দেখাতে পারেননি তাই না! আপনার তখন বলা উচিত ছিল গোয়েন্দা গল্প আর যাঁরা লেখেন তাদের থেকে অনেক ভালো আমি লিখি, হ্যাঁ আমি ভালো লিখি।

সেই মুহূর্তে মিসেস অলিভার বলেছিলেন, না–কিন্তু আমি সেরকম নই।

না, না বলবেন না, আমি সেরকমই নই। আপনি অবশ্যই বলবেন আপনি খুব ভালো লেখেন। আপনি যদি এই মুহূর্তে মনে করেন যে, আপনি পারেন না তখন আপনাকে বলতেই হবে যে, আপনি পারেন।

মিসেস অলিভার আলবারটিনাকে বললেন, যে সব সাংবাদিকরা আসে তাদের তুমি সাক্ষাৎকার নিতে পারো, কারণ এ কাজটা তুমি বেশ ভালোভাবেই করতে পারো দেখছি। এবং তুমি আমার হয়ে এদের সাথে ভাব করো আর আমি দরজার আড়ালে থেকে শুনব।

আলবারটিনা বললেন, আমি তা করতে পারি এবং সেটা একটা বেশ কৌতুক হবে কিন্তু তারা যে জানবে আমি আপনি নই, আপনার মুখ তারা চেনে, সেই জন্যেই বলছি বরং আপনি নিজেই ওকে থামিয়ে দিয়ে বলবেন হা হা জানি অন্যদের থেকে অনেক ভালো লেখা আমি লিখি। সবাইকে আপনার বলতে হবে এবং সেটা তাদের জানা উচিত। তা না করে সেখানে বসে যদি আপনাকে বলতে শুনি আপনি নিজে ভালো লেখার জন্য গর্ববোধ না করে উলটে বিনয় দেখিয়ে বলছেন, না, না আমি অত ভালো লেখিকা নই, অসম্ভব বেমানান লাগবে সেই কথাগুলো।

মিসেস অলিভার ভাবলেন এ যেন নবাগতা অভিনেত্রীকে কি করে অভিনয় করতে হয় শেখাচ্ছে এবং পরিচালক তাকে তার নির্দেশ দেবার পক্ষে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ বলে ধরে নিলো। যাইহোক এখানে খুব বেশি অসুবিধা হবে না, টেবিলে যে কয়জন মহিলা অপেক্ষা করবে তাদের কাছে হাসি মুখে এগিয়ে যাবেন তিনি এবং খুব সুন্দর করে বলবেন আপনাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। এমনকি কারোর বই-এর মাধ্যমে যে কেউ মানুষকে জেনে আনন্দ পেতে পারে, এ যেন কথামালার বাক্সে হাত ঢুকিয়ে কতকগুলো দরকারি শব্দ তুলে নেওয়া যা আগেই রুদ্রাক্ষের মালার মতন গাঁথা হয়ে গেছে।

তার চোখ টেবিলের চারপাশে ঘোরাফেরা করছিল কারণ তিনি তার কয়েকজন বন্ধু ও ভক্তদের সেখানে দেখেছিলেন। একটু দূরে মায়রিন গ্র্যান্টকে দেখতে পেলেন। দারুণ কৌতুকপ্রিয় তিনি। এবং বিপদের সময় মিসেস অলিভার প্রায়ই নিজের মতন মনে ভেবে থাকেন। ককটেল পার্টিতে এবং সাহিত্যিকদের সভায় কখনও তিনি গিয়ে থাকেন। এখানে যে কোনো মুহূর্তে বিপদ এসে যেতে পারে। যেমন–আপনি যাকে মনে রাখতে পারেননি তিনি ঠিক আপনাকে মনে রেখেছেন, অথবা আপনি হয়তো কারোর সঙ্গে কথা বলতে চান না, কিন্তু তাকে দেখে আপনিও এড়িয়ে যেতে পারবেন না। এক্ষেত্রে তার সামনে উভয় সংকট দেখা দেবে।

একজন ভারিক্কি চেহারার সাদা দাঁতওয়ালা ভদ্রমহিলা মিসেস অলিভারের সাথে পরিচিত হতে চান।

উচ্চৈঃস্বরে তিনি মিসেস অলিভারকে বললেন, আজ আপনার সাথে দেখা হওয়াতে আমার কী আনন্দ। আপনার বই আমার খুব প্রিয়। আবার আমার ছেলেরও। এবং আমার স্বামী ভ্রমণে গেলে আপনার দুটো বই সঙ্গে নেবার জন্য চাপ দেবে।

মিসেস অলিভার ভাবলেন ভদ্রমহিলাটি আমার মনের মতো নয়।

একজন পুলিশ অফিসার ঠিক যেমন করে থাকে সেইভাবে তিনি নিজেকে মহিলার হাতে সঁপে দিলেন। এবং তার নতুন বন্ধু এক কাপ কফি গ্রহণ করে তার সামনে আর এক কাপ কফি রাখলেন।

মিসেস অলিভারকে নতুন বন্ধুটি বললেন, আপনি নিশ্চয়ই আমার নাম জানেন না, আমি মিসেস বার্টন কক্স।

মিসেস অলিভার হ্যাঁ বলে বিহ্বল দৃষ্টিতে ভাবতে লাগলেন যে, উনিই কি গল্প উপন্যাস লেখেন? তাঁর সম্পর্কে সত্যিই তিনি কিছু খেয়াল করতে পারছেন না, তবুও তার মনে হয় তার নাম তিনি শুনেছেন, একটা ক্ষীণ ভাবনা তার মনে এলো। রাজনীতির ওপর কোনো বই না ফিকসন-না কৌতুক? এমনকি অপরাধমূলক লেখাও নয়। কিংবা বুদ্ধিদীপ্তির সঙ্গে রাজনীতির গাঁটছাড়া? এবং সেটা অবশ্যই সহজ হতে পারে এই ভেবে স্বস্তি পেয়ে মিসেস অলিভার নিজের মনেই বললেন ওঁর সঙ্গে কথা বলা যায়। তারপর তিনি বললেন, কেমন মজার বলুন

মিসেস বার্টন কক্স বললেন, শুনে সত্যি খুব আশ্চর্য হবেন আমি যা বলতে যাচ্ছি। আমি আপনার বই পড়ে অনুভব করেছি যে, আপনি কত সহানুভূতিশীল এবং মানুষের স্বভাব কত সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন এবং আমার ধারণা আমি এমন একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছি তার উত্তর যদি কেউ না পারেন আপনি ঠিক পারবেন।

মিসেস অলিভার বললেন, আমি তা মনে করি না। সঙ্গে সঙ্গে ভাববার চেষ্টা করলেন তিনি যে অত্যন্ত অনিশ্চিত বোধ করছেন তা একটা ছোট্ট কথায় কীভাবে তাকে বোঝানো যায়।

মিসেস বার্টন কক্স তার কফিতে চিনির একটা ডেলা ফেলে সেটা এমনভাবে চিবুলেন ঠিক যেন মাংসাশী হাড় চিবুচ্ছেন, মিসেস অলিভার আনমনে ভাবলেন তার দাঁতগুলি সম্ভবত হাতির দাঁতের মতন, হাতির দাঁতের কর্মক্ষমতা বিরাট।

মিসেস বার্টন কক্স তখন বলছিলেন–এখন প্রথমেই আমি স্থির নিশ্চিত যে আমার অনুমান ঠিক এবং আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই আপনার একটি ধর্মকন্যা আছে কিনা এবং সেই ধর্মকন্যাটির নাম কি সিলিয়া র‍্যাভেন্সক্রফট?

কতকটা আনন্দের আতিশয্যে বিস্মিত হয়ে তিনি বলে উঠলেন, তার অনেক ভালো ভালো ধর্মকন্যা আছে এবং ধর্মপুত্র সেই ব্যাপারে। তাকে এখন স্বীকার করতেই হবে যে বার্ধক্যের ভার পড়ছে তার দেহমনে। ফলে সেই সময়ে তিনি সবাইকে মনে রাখতে পারতেন না। একজনের যা কর্তব্য হয়ে থাক তিনি তাই পালন করে গেছেন, আগের বছরগুলোতে খিস্টমাসের দিনে ধর্ম সন্তানদের জন্য খেলনা পাঠানো, তাদের ও তাদের অভিভাবকদের কাছে যাওয়া, ছেলে ও মেয়েদের স্কুল থেকে নিয়ে আসা এবং জীবনের সেই সেরা দিন একুশতম জন্মদিনে যা ধর্মমা-র অবশ্যই করা উচিত। তিনি বেশ জাঁকজমক সহকারেই পালন করে এসেছেন, তা ছাড়া তাদের বিবাহের সময় অনুরূপ উপহার, আর্থিক সাহায্য এবং আশীর্বাদ জানিয়ে এসেছেন। সেইসব ধর্মর্সন্তানরা যে যার কর্মস্থলে অনেক দূরে চলে গেছে এবং একটু একটু করে তারা তার জীবন থেকে সরে গেছে, যদি তাদের সামনে দেখতে পান আপনি নিশ্চয়ই খুব খুশি হবেন? কিন্তু আপনাকে ভাবতে হবে যে, শেষ কবে আপনি তাদের দেখেছিলেন এবং তারা কাদের কন্যা ছিল এবং আপনি তাদের ধর্মমা হওয়ার সূত্রটাই বা কী ছিল?

সিলিয়া র‍্যাভেন্সক্রফট স্মরণ করার চেষ্টা করলেন এবং বললেন মিসেস অলিভার, হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই।

তার মানে এই নয় যে সিলিয়ার কোনো ছবি তার চোখের সামনে ভেসে উঠল অথবা একেবারে ছোটোবেলার কোনো ঘটনার কথা। কিংবা খ্রিস্টের নামে নামকরণের সময়। ও হ্যাঁ সিলিয়ার খ্রিস্টিয়ান নামকরণের সময় তিনি গিয়েছিলেন। উপহার স্বরূপ একটা সুন্দর কুইন অ্যানি মার্কা রূপার ছাঁকনি দিয়েছিলেন, যাতে ভালোভাবে দুধ ছাঁকা যেতে পারে অথবা কখনও যদি অর্থের প্রয়োজন হয় ধর্মকন্যা সেটা বিক্রিও করতে পারে। কুইন অ্যানির সেই ছাঁকনিটার কথা তিনি মনে করতে পারেন-সতেরোশো এগারো হবে। ব্রিটানিয়ার ছাপ ছিল তাতে। অবাক লাগে কত সহজেই রূপার কফি পেয়ালা বা ছাঁকনির কথা স্মরণ করা যায় কিন্তু যে সন্তানটিকে উপহার দেওয়া হয় তাকে ঠিক মনে রাখা হয় না। তিনি আবারও বললেন, আমার ধারণা বহুদিন সিলিয়াকে আমি দেখিনি।

মিসেস বার্টন কক্স বললেন, ও এখন অবশ্যই আবেগপ্রবণ মেয়ে হয়ে উঠেছে। আমি বলতে চাইছি যে, সম্প্রতি ও ওর ধারণা পালটে ফেলেছে কারণ ও খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব ভালো ফল করেছে কিন্তু আমার মনে হয় ওর রাজনৈতিক ধারণা আজকের দিনের সব তরুণ তরুণীদেরই মতো রাজনৈতিক ধারণা জন্মাচ্ছে।

মিসেস অলিভার বললেন, রাজনীতি নিয়ে আমি খুব বেশি মাথা ঘামাই না কারণ তার কাছে রাজনীতি সবসময়েই অভিশাপ বলে মনে হয়।

দেখুন আমি আপনার ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখেই এমন একটা কিছু বলতে যাচ্ছি যার সঠিক উত্তর আমি আপনার কাছ থেকে জানতে চাই এবং আমি নিশ্চিত যে, আপনি তাতে কিছু মনে করবেন না। আমি অনেকের কাছ থেকে শুনেছি আপনি কতো দয়ালু এবং কেমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সব কিছু সম্পন্ন করে থাকেন।

মিসেস অলিভারের মনে বিস্ময় জাগছে কারণ যদি উনি টাকা ধার চেয়ে বসেন আমার কাছ থেকে এবং তিনি এও জানেন যে, অনেকে সাক্ষাৎকার শুরু করেন প্রথমে এইরকম মনভেজানো কথাবার্তা বলে।

দেখুন, আমার কাছে এটা একটা বিরাট মুহূর্তের ব্যাপার। কারণ সত্যিই আমি এমন একটা কথা ভাবি যা আমাকে অবশ্যই খুঁজে বার করতে হবে। ভাবুন সিলিয়া বিয়ে করতে যাচ্ছে অথবা সিলিয়া আমার ছেলেকে বিয়ে করতে যাচ্ছে, ডেসমন্ডকে।

মিসেস অলিভার বললেন, তাই বুঝি?

বর্তমানে অন্তত সেটা তাদের ধারণা। মানুষ সম্পর্কে প্রত্যেকেই জানতে চায় এবং সেটা আমি ভীষণভাবে জানতে চাই। এটা এমন একটা অস্বাভাবিক জিনিস যা যে কোনো মানুষকে জিজ্ঞেস করা যায় না। কারণ আমি বলতে চাই যে, একজন আগন্তুকের কাছে জিজ্ঞেস করা, না তা আমি পারব না। বরং আমি মনে করি না, আপনি একজন আগন্তুক প্রিয় মিসেস অলিভার।

মিসেস অলিভার ভাবলেন যে, আমার ইচ্ছা আপনি করুন। কারণ তার স্নায়ু দুর্বল হতে চলেছে। কিন্তু তার উৎকণ্ঠা সিলিয়া অবৈধ সন্তানের জন্ম দেয়নি তো অথবা একটা অবৈধ সন্তানের জন্ম দিতে যাচ্ছে এবং তিনি কি এই ব্যাপারে কিছু জানতে চান বিস্তারিতভাবে? এবং সেটা খুবই বেমানান হবে। অপর পক্ষে মিসেস অলিভার ভাবলেন যে, পাঁচ-ছ বছর হল আমি ওকে দেখিনি এবং ওর বয়স এখন পাঁচশ কিংবা ছাব্বিশ হবে নিশ্চয়ই। সুতরাং খুব বলা সহজ আমি কিছুই জানি না।

সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন মিসেস বার্টন কক্স যেন দেখে মনে হল নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার।

আমি চাই আপনি আমাকে বলুন, কারণ আমি নিশ্চিত হই আপনি জানেন নতুবা আপনার বেশ ভালো ধারণা আছে কী করে সেই সব ঘটল। আচ্ছা বলতে পারেন ওর মা কি ওর বাবাকে খুন করেছিল কিংবা ওর বাবা ওর মাকে খুন করে?

মিসেস অলিভার যা কিছুই অনুমান করে থাকুন না কেন মিসেস বার্টন কক্সের দিকে অবিশ্বাস্যভাবে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু আমি তা জানি না–একটু থামলেন আমি বুঝতে পারছি না ব্যাপারটা আমি বলতে চাইছি কোনো কারণে

প্রিয় মিসেস অলিভার আপনি নিশ্চয়ই জানেন। মানে আমি বলতে চাই এমন ধরনের একটা বিখ্যাত কেন…এবং অবশ্যই আমি জানি এটা অনেকদিন আগের ঘটনা, মনে হয় অন্তত দশ বারো বছর আগেকার তো হবেই। সেই সময় কিন্তু দারণ আলোড়ন তুলেছিল। আমি নিশ্চিত যে আপনি মনে রেখেছেন এবং আপনার অবশ্যই মনে রাখা উচিত।

 মিসেস অলিভারের স্নায়ুকোষগুলো তখন বেপরোয়াভাবে কাজ করতে শুরু করে দিয়েছিল কারণ সিলিয়া ছিল তাঁর ধর্মকন্যা এবং সেটা খুবই সত্য। সিলিয়ার মা ছিল মলি প্রেস্টন গ্রে এবং সে ছিল তার বন্ধু যদিও ঠিক অন্তরঙ্গ নয়। আর হ্যাঁ অবশ্যই একজন সৈনিককে বিয়ে করেছিল। সে কী যেন নাম ছিল তার–হ্যাঁ স্যার অমুক র‍্যাভেন্সক্রফট। নতুবা কোনো এক রাষ্ট্রদূত? না, অস্বাভাবিক এ সব জিনিস কেউ কখনও মনে রাখতে পারে না। শুধু তাই নয় তিনি যে নিজে মলির বিবাহবাসরে তার সহচরীরূপে উপস্থিত ছিলেন সে কথাও মনে করতে পারছেন না। তিনি ভেবেছিলেন, তার মনে আছে, যেমন গাউস চ্যাপেলে স্মার্ট বিবাহ অনুষ্ঠান, অথবা সে ধরনের একটা কিছু। যে কেউ সেটা ভুলে যেতেই পারে, কিন্তু তারপর বেশ কয়েক বছর তাদের সঙ্গে তার আর দেখা হয়নি। হয়তো কোথাও যেন চলে গিয়েছিল তারা মধ্যপ্রাচ্যে? পারসিয়ায়? ইরাকে? একসময়ে ইজিপ্ট? অথবা মালয়ে? যদি কদাচিৎ তারা ইংল্যান্ডে বেড়োতে আসত তিনি আবার দেখা করতেন তাদের সঙ্গে। কিন্তু সে তো ছবি তোলার মতন এবং সেই ভোলা ছবির দিকে তাকিয়ে থাকার মতন। যদি কোনো লোককে অস্পষ্টভাবে মনে রাখলে পরে এবং সেই মনে রাখার ব্যাপারটা ধীরে ধীরে যে ভাবে মন থেকে মুছে যায় এবং সত্যিই পরবর্তীকালে তাদের চেনা বা মনে রাখা যায় না কে ছিল সে। আর আশ্চর্য তিনি এখন মনে করতে পারেন না, স্যার র‍্যাভেন্সক্রফট ও লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট ওরফে মলি প্রেস্টন গ্রে তার জীবনে প্রবেশ করেছিল কিনা। কই সে রকম তার কিছু মনে হয় না। কিন্তু আশ্চর্য তারপর…তখনও তাঁর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন মিসেস বার্টন কক্স। তাঁর মনে রাখার অক্ষমতা দেখে মিসেস বার্টন কক্স হতাশ হয়ে উঠেছিলেন। আর সেই ঘটনার কারণই বা কী থাকতে পারে তাও তিনি ভেবে পান না।

খুন? আপনি বলতে চাইছেন মানে–একটা দুর্ঘটনা? ওহো না! দুর্ঘটনা নয়, সমুদ্রের ধারের বাড়িগুলোর মধ্যে একটিতে তারা থাকত। অথবা আমার মনে হয়, কর্নওয়াল যাইহোক সেখানে কাছাকাছি কোথাও পাহাড় ছিল। এবং সেখানেই তাদের একটা বাড়ি ছিল এবং সেই দুর্গম পাহাড়ের এই পাশে একদিন দুজনকে পাওয়া যায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায়। কিন্তু এই থেকে পুলিশ সত্যিই বুঝতে পারে না যে, হয় প্রথমে স্ত্রী তার স্বামীকে গুলি করে এবং তারপর সে নিজেকে গুলিবিদ্ধ করে অথবা স্বামী তার স্ত্রীকে গুলি করে পরে সে নিজেই নিজেকে গুলি করেছিল কিনা। কিন্তু তারা কতকগুলো প্রমাণ ও তথ্য যাচাই করে দেখে বুঝলেন যে, সেগুলোর কয়েকটি হল বুলেট আর অন্য আরও কয়েকটি জিনিস কিন্তু সেই সব জিনিস দিয়ে সেই হত্যার কিনারা করা খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার। তারা এও ভাবল হয়তো দু-জনে যুক্তি করে আত্মহত্যা করে থাকবে–সেই বিচারে কি রায় বেড়িয়েছিল মনে নেই। সেটা একটা ব্যর্থ অভিযান বা ওই ধরনের কিছু একটা হতে পারে। এবং প্রত্যেকেই অবশ্যই জানত যে, এর একটা অর্থ ছিল আর এই জোড়া খুনকে কেন্দ্র করে বহু গল্প লোকের মুখে মুখে আলেচিত হত

মিসেস অলিভার বললেন, সম্ভবত সই মনগড়া এমনকি তিনি একটা গল্পও মনে করার চেষ্টা করলেন, যদি পারেন।

ওহো মনে পড়েছে হয়তো মনে পড়ছে। তবে কিন্তু এটাও ঠিক যে, জোর করে সেটা বলা শক্ত আমি জানি। হয়তো সেদিন অথবা আগের দিন ওদের দুজনের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ হয়–ফলে অন্য আর একজন পুরুষের কথা ওঠে, এবং তারপর অবশ্যই স্বাভাবিক কারণেই অন্য আর এক নারীর প্রসঙ্গ উঠে থাকবে সেই ঝগড়ার মাঝে, এবং কেউ কখনও জানতেও পারবে না যে, ওদের ঝগড়া কী ভাবে শুরু হয়েছিল। আমার ধারণা ব্যাপারটা বেশ ভালোভাবেই গোপন করা হয়, কারণ জেনারেল র‍্যাভেন্সক্রফটের পদমর্যাদা ও সামাজিক মর্যাদা ছিল অনেক উঁচুতে। এবং আরও শোনা যায় যে, সেই যে, সেই বছরেই একটা নার্সিংহোমে সে ভর্তি হয় এবং সেখানেই হয়তো সে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে থাকবে যার পরিণাম সে সত্যিই জানত না, সে কী করতে যাচ্ছে?

দৃঢ়স্বরে মিসেস অলিভার বললেন, সত্যিই আমি বিস্মিত। এবং অবশ্যই আমার বলা উচিত যে, এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না, এবং আপনিই প্রথম উল্লেখ করলেন বলেই এখন আমার একটু মনে পড়ছে যেন এ ধরনের একটা কেস হয়েছিল বটে তবে নামগুলো আমি খেয়াল করতে পারি এবং এই লোকগুলোকেও আমি চিনি। কিন্তু তারপরে ও ব্যাপারে কী ঘটেছিল সে খবর আমার জানা নেই এবং সত্যিই মনে করি না এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণা আমার আছে যে…

মিসেস অলিভার ভাবলেন যে, তিনি সত্যিই যথেষ্ট সাহসের সঙ্গেই কথাগুলো বলতে পেরেছেন। অবার মিসেস বার্টন কক্সের দিকে তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ চিন্তা করলেন এ সব প্রশ্ন করার ধৃষ্টতা আপনার কি করে হল কে জানে!

এই ঘটনা অত্যন্ত জরুরি বলেই আমার জানা উচিত, বললেন মিসেস বার্টন কক্স। তখন তার চোখ দুটো মার্বেল পাথরের মতো কঠিন হয়ে উঠতে দেখা গেল এবং বললেন, দেখুন এটা বিশেষ জরুরি কারণ আমার পুত্র সিলিয়াকে বিয়ে করতে চায় বলে।

মিসেস অলিভার আর বললেন, আমি কিছুই শুনিনি কখনও। তাই আমার আশঙ্কা, আমি আপনাকে হয়তো সাহায্যে করতে পারব না।

কিন্তু আপনি অবশ্যই জানেন মানে আমি বলতে চাই যে, যখন আপনি এই রকম চমৎকার গল্প লেখেন তখন অপরাধ সম্পর্কে আপনি সব কিছুই জানেন। এবং আপনি এও জানেন কে অপরাধ করে থাকে আর কেনই বা তারা করে থাকে এবং আমার বিশ্বাস যে, সব ধরনের মানুষই সেই সব কাহিনির আড়ালে থাকে যে সব কাহিনি তারা আপনাকে হয়তো বলে থাকবে। বললেন মিসেস বার্টন কক্স।

আমি কিছুই জানি না এবার বেশ রুক্ষস্বরেই বললেন মিসেস অলিভার।

অথচ দেখুন, সত্যি কথা বলতে কী, এ ব্যাপারে কাকেই বা জিজ্ঞাসা করতে যাব? এবং কেউ জানেও না ব্যাপারটা। আমি বলতে চাইছি মানে আজকের দিনে কেউ পুলিশের কাছে যেতে পারে না। এবং আমার মনে হয় না যে, তারা আপনাকে কিছু বলবে। কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে তারা নিশ্চয়ই এটা গোপন করার চেষ্টা করবে। অথচ আমি মনে করি যে, সত্যকে অস্বীকার করা অত্যন্ত জরুরি।

ঠান্ডা গলায় মিসেস অলিভার বললেন, আমি তো কেবল বই লিখে থাকি। সেগুলো সম্পূর্ণ কাল্পনিক। এবং কারোর ব্যক্তিগতভাবে অপরাধ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না এবং অপরাধতত্ত্বের ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা বা মতামতও জানা নেই, সুতরাং আমার আশঙ্কা আমি কোনোভাবেই আপনাকে সাহায্য করতে পারব না।

কিন্তু আপনি কি আপনার ধর্মর্কন্যাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন না?

সিলিয়াকে জিজ্ঞেস করব? এবার আবার মিসেস অলিভারের চোখ দুটো স্থির হল। এবং বললেন, জানি না কী ভাবে জিজ্ঞেস করব আমার ধারণা যখন এই বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটেছিল তখন ও খুবই বাচ্চা ছিল।

হ্যাঁ আমার ধারণা, এ ব্যাপারে সব কিছুই জানে ও। মিসেস বার্টন কক্স আরও বললেন, আমার মনে হয় না আপনি জানেন বলে, ডেসমণ্ড এটা পছন্দ করবে এবং এও জানেন যেখানে সিলিয়া জড়িত সেখানে খুবই স্পর্শকাতর সে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী আমার মনে হয় না যে-না–এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ও আপনাকে সব খুলে বলবে।

মিসেস অলিভার বললেন, সত্যিই আমি ওকে জিজ্ঞেস করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি।, এবং তিনি তার ঘড়ির দিকে তাকাবার ভান করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলে উঠলেন, ওহে প্রিয়, আমরা দীর্ঘ সময় ধরে এই সুন্দর মধ্যাহ্নভোজ উপভোগ করলাম, অথচ এখনি আমাকে ছুটতে হবে কারণ আমার একটা জরুরি সাক্ষাৎকার আছে। কিন্তু, আপনাকে সাহায্য করতে না পারার জন্য সত্যিই আমি খুব দুঃখিত, বিদায়, মিসেস বেডলি কক্স, কিন্তু এ সব প্রসঙ্গ অত্যন্ত জটিল এবং সত্যি কথা বলতে কী আপনার ধারণার কি কোনো তফাত হতে পারে তা যে ভাবেই হোক?

ওহো, হ্যাঁ আমি কিন্তু মনে করি অনেক পার্থক্য হতে পারে।

 ঠিক সেই সময়ে একজন লেখিকাকে সেদিকে এগিয়ে আসতে দেখলেন মিসেস অলিভার এবং তিনি তাকে বেশ ভালো করেই জানতেন, হঠাৎ লাফিয়ে উঠে তিনি তার একটা হাত ধরে ফেললেন।

সম্বোধন করলেন, লুইস, আমার প্রিয় লুইস, তোমাকে দেখতে পেয়ে কী যে ভালো লাগছে আমার। আচ্ছা, এর আগে তো তোমাকে দেখতে পাইনি।

হাই! এ্যারিয়াডন, বহুদিন হল তোমার সাথে কোনো দেখাসাক্ষাত হয়নি। অথচ তুমি কি খুব রোগা হয়ে গেছ, তাই না?

কী সুন্দর সুন্দর কথা না তুমি আমাকে বলল, বন্ধুকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন মিসেস অলিভার এবং সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি এবং আবার বললেন, একজনের সাথে আমাকে দেখা করতে হবে, আমি যাচ্ছি বন্ধু।

মিসেস অলিভারের বন্ধু তাঁর কাঁধের ওপর দিয়ে আড়চোখে মিসেস বার্টন কক্সকে একবার দেখলেন এবং বললেন, আমার অনুমান ওই ভয়ঙ্কর মহিলার পাল্লায় পড়ে তুমি নিশ্চয়ই আটকে পড়েছিলে, তাই না?

কথার উত্তরে মিসেস অলিভার বললেন, উনি আমাকে যত সব অস্বাভাবিক প্রশ্ন করছিলেন। ওহো, তুমি কি জানতে না যে, কী ভাবে সেগুলোর উত্তর দেওয়া যায়?

না। কিন্তু সেগুলো কোনোভাবেই কাজের এক্তিয়ারে পড়ে না, এবং আমি যেসব প্রশ্নের বিন্দুবিসর্গ পর্যন্ত জানি না। কিন্তু সেগুলোর উত্তর দিতে আমি চাইনি।

কোনো আগ্রহে ব্যাপার আছে?

আমার মনে হয় বললেন মিসেস অলিভার। এবং তখন তার মাথায় একটা নতুন ধারণার আগমন ঘটছিল। যদিও মনে হয়, হয়তো সেটা আগ্রহ জাগাতে পারে কিন্তু কেবল–

বন্ধুটি জিজ্ঞেস করলেন, উইন কি তোমাকে তাগাদা করছিলেন? কিন্তু তোমার যদি গাড়ি না থাকে আমি তোমাকে লিফট দেব, এবং তুমি তোমার খুশিমত জায়গায় নেমে যেও। কিন্তু লন্ডনে আমি কখনও গাড়ি নিয়ে বেরোই না, কারণ পার্ক করা কি যে ভয়ঙ্কর ব্যাপার তা আমি জানি। এক কথায় যাকে বলে অচল অবস্থা।

ধন্যবাদ, পার্টিতে তাঁর সঙ্গ ভালো লাগে। সবাইকে বিদায় জানিয়ে আরও অনেক ভালো ভালো কথা বিনিময়ের পর মিসেস অলিভার তার বন্ধুর গাড়িতে গিয়ে বসলেন এবং গাড়িটা লন্ডন স্কোয়ারের দিকে ছুটে যাচ্ছিল।

ইটন টেরেস তাই না? তার বন্ধুটি জিজ্ঞেস করলেন।

হ্যাঁ, বললেন মিসেস অলিভার, অথচ এখন আমি কোথায় যাব, ও হ্যাঁ আমার মনে হয় হোয়াইটার ফায়ার্স ম্যানসনে। কিন্তু আমি সেটার নামটা কিছুতেই মনে রাখতে পারি না। অথচ আমি জানি, সেটা কোথায়?

ওহো, ফ্ল্যাটগুলো বেশ আধুনিক ধরনের। অত্যন্ত চারচৌকো এবং জ্যামিতিক।

ঠিকই তাই বললেন মিসেস অলিভার।

.

হাতি

মহান আল্ট অ্যালিসের জ্ঞানের পথনির্দেশ, মিস লিভিংস্টোন ঠিকানা লেখা বইটা খুঁজে দিতে পার কি?

তার উত্তরে বললেন, বাঁ হাতের কোণায় আপনার ডেস্কের ওপরই আছে মিসেস অলিভার।

মিসেস অলিভার বললেন, সেটার কথা আমি বলছি না। আমি যেটা বলছি মানে এখন যেটা আমি ব্যবহার করছি। অর্থাৎ আমার শেষেরটা বা আগের বছর কিংবা তার আগের আগেরটা, সন্দেহ প্রকাশ করে মিস লিভিংস্টোন বলল সেটা ফেলে দেওয়া হয়নি তো?

না, ঠিকানার বই আমি ফেলে দিই না কারণ সেটা তোমার প্রায়ই দরকার হয়ে থাকে, অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি কিছু ঠিকানা তুমি নতুন বইতে কপি করোনি? তবে আমার মনে হয় টলবয়েজের ড্রয়ারগুলোর মধ্যে যে কোনো একটায় আছে সেটা।

মিস সেডউইকের স্থলাভিষিক্ত হল মিস লিভিংস্টোন সুতরাং বলতে গেলে একরকম নবাগতা। অ্যারিয়াডন অলিভার মিস সেডউইককে হারিয়েছেন। অনেক কিছু জানত মেয়েটি এবং সে আরও জানত কোন কোন সময়ে মিস অলিভার কোন জিনিস কোথায় রাখতেন। যে সব লোকেদের সুন্দর সুন্দর চিঠি লিখতেন মিসেস অলিভার তাদের নাম কী সুন্দর মনে রাখত। শুধু তাই নয় আবার যে সব লোকেদের রুক্ষ ভাষায় চিঠি লিখতেন তাদের নামও মনে রাখতেন। অত্যন্ত কাজের এই মেয়েটি যে কোনো কারণেই হোক সে অকাজের হয়ে পড়ে থাকবে হয়তো। মিসেস অলিভার বললেন, কী যেন বইটার নাম? সে ছিল সেই বইটার মতন, তার মনটাকে ফেলে আসা দিনগুলোতে পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে মনে করার চেষ্টা করলেন এবং বললেন, ও হ্যাঁ আমি জানি। বাদামি রঙের একটা বড়ো বই ভিক্টোরিয় যুগের সব কিছুই তাতে এনকোয়্যার উইদিন আপন এভরিথিং। কী করে নিকেলের ওপর থেকে লোহার নোংরা দাগ তোলা যায়, এবং বিশপের কাছে খোশগল্পের চিঠি লেখা কী করে শুরু করতে হয় সব জানা এই বই থেকে। সব কিছু আছে এনকোয়্যার উইদিন আপন এভরিথিং। বইটি মহান আল্ট অ্যালিসের মহান নির্ভরযোগ্য আশ্রয়।

আনট অ্যালিসের বই-এর যোগ্য ছিল মিস সেডউইক এবং মিস লিভিংস্টোন মোটেও তার মতন নয়। মিস লিভিংস্টোন সব সময় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন। গায়ের রং পাণ্ডুর বর্ণ, লম্বাটে ধরনের মুখ এবং নিজেকে একজন দক্ষ বলে দেখানোর প্রবণতা আছে কারণ তার মুখের প্রতিটি রেখাই বলে দেয় দেখো আমি অত্যন্ত দক্ষ। কিন্তু মিসেস অলিভার ভাবেন সে কিন্তু সত্যি সেরকম নয়। সে কেবল সব জায়গাগুলো জানে যেখানে প্রাক্তন কর্মীরা বইপত্তর রাখত এবং মিসেস অলিভার যেখানে কোনো জিনিস রাখতে পারেন সেই সব জায়গাগুলিই ছিল তার কাছে পরিষ্কারভাবে বিবেচিত হত।

বকে যাওয়া ছেলের মতন খুব জোরে চিৎকার করে বললেন, আমি কী চাই জানো? আমার চাই ১৯৭০ সালের ঠিকানার বই এবং সেই সঙ্গে ১৯৬৯ সালেরটাও লাগবে। যত শিগগির সম্ভব তুমি কি খোঁজ করবে?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বলল মিস লিভিংস্টোন। মেয়েটি এমনভাবে শূন্যে তার দিকে তাকাল যেন দেখে মনে হল এমন একটা জিনিস তাকে খোঁজ করতে বলা হয়েছে, যার নাম সে আগে কখনও শুনেছে বলে মনে হয় না, অভাবনীয়ভাবে ভাগ্য তার সহায় না হলে মনগড়া দক্ষতা দিয়ে সে কীভাবে খুঁজে বার করবে।

মিসেস অলিভার নিজের মনে ভাবলেন সেডউইককে না পেলে আমার সব কিছু অচল হয়ে যাবে এবং আমি পাগল হয়ে যাব।

মিস লিভিংস্টোন মিসেস অলিভারের স্টাডি ও লেখার ঘরের ফার্নিচারের সমস্ত ড্রয়ারগুলো খুলতে শুরু করল।

মিস লিভিংস্টোন বেশ খুশি হয়ে আনন্দে বলে উঠল এখানে গত বছরেরটা, অনেক বেশি হাল আমলের লেখা ১৯৭১ চলবে না?মিসেস অলিভার বললেন, ১৯৭১ আমি চাই না। একটা অস্পষ্ট চিন্তা এবং স্মৃতিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বললেন, চায়ের পেটির টেবিলে দেখো তো? মিস লিভিংস্টোন চারদিকে তাকিয়ে দেখে এবং যতই তাকায় ততোই চিন্তিত দেখায় তাকে, ওই যে ওই-টেবিলটা টেবিলের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন। চায়ের পেটির ওপর একটা ডেস্ক বুক রয়েছে, সেটা কি? মিস লিভিংস্টোন মিসেস অলিভারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ ওটা হতে পারে, আমার মনে পড়ছে মিসেস অলিভার বললেন।

কিন্তু এ তো দেখছি চার বছর আগেকার সেই ১৯৬৮ সালের মিসেস অলিভার।

ওটাই প্রায় ঠিক, মিসেস অলিভার বললেন এবং সেটি হস্তগত করে ডেস্কে ফিরে গেলেন। এর মধ্যে হাল আমলেরও সব কিছু আছে কিন্তু এখন দেখ তো আমার জন্মদিনের বইটা তুমি পাও কিনা মিস লিভিংস্টোন।

আমি তো জানি না।

ওটা এখন আর আমি ব্যবহার করি না তবে এক সময় করতাম। বেশ বড়ো আকারের ছিল, মিসেস অলিভার বললেন এবং আরও বললেন, আমি যখন শিশু ছিলাম তখন থেকেই শুরু করি। আমার ধারণা সেটা ওপরের তলায় আছে, তুমি জানো ছেলেরা ছুটির সময় বাড়িতে এলে আমরা যে ঘরটা ব্যবহার করে থাকি এবং বিছানার পাশে যে আলমারিটা আছে–

ওহো আমি কি সেটার খোঁজ করব? হা, আমি ঠিক তাই চাই, বললেন মিসেস অলিভার। মিস লিভিংস্টোন যেই ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন তিনি একটু উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন এবং দরজাটা বন্ধ করে দিলেন ভেতর থেকে, তিনি ডেস্কের সামনে গিয়ে ঠিকানাগুলোর ওপর চোখ বুলোতে থাকেন। লেখাগুলো অবশ্য ফিকে হয়ে গেছে, তখন চায়ের গন্ধ তার নাকে ভেসে আসছিল। ঠিকানাগুলো দেখতেই চোখে পড়ল র‍্যাভেন্সক্রফট! সিলিয়া র‍্যাভেন্সক্রফট। হ্যাঁ ১৪ ফিশাফ্রে মিউস. এস. ডব্লু ৩। এটাই সিলিয়ার ঠিকানা এবং সেখানেই ও থাকত। কিন্তু আরও একজন ছিল স্ট্যান্ড অন দি গ্রীন, কিউ ব্রিজের কাছে হবে হয়তো। তিনি আবার কয়েকটা পাতা ওল্টালেন, এটা মনে হচ্ছে মারডিক গ্রোভ। সেটা বোধহয় ফুলহাম রোডে বা ওই রকম কোথাও হবে হয়তো, অত্যধিক রবার ঘষা হয়েছে, ওর কি টেলিফোন আছে? মনে হয় ওটাই ছিল ফ্ল্যাক্সম্যান…তবে যাইহোক আমি অন্তত সেটা চেষ্টা করব।

টেলিফোনের দিকে তিনি এগিয়ে গেলেন, সাথে সাথে দরজা খুলে যায় এবং লিভিংস্টোন ভেতরের দিকে তাকায়।

আপনি কি সেটার কথা ভাবছেন?…

আমি যেটা চাইছিলাম ঠিক সেটা আমি পেয়ে গেছি, মিসেস অলিভার বললেন, যাও জন্মদিনের বইটা খুঁজে দেখো কারণ ওটা খুবই জরুরি।

আপনি যখন সিলি হাউসে যান, আপনার কি মনে আছে যে সেটা আপনি দেখে গিয়েছিলেন?

না আমার মনে পড়ছে না, যাও গিয়ে খুঁজে দেখো, বললেন মিসেস অলিভার।

তোমার ইচ্ছা মতন যত পারো দেরি করো, নিজের মনেই বিড়বিড় করে বললেন।

টেলিফোনে ডায়াল করলেন এবং অপেক্ষা করতে থাকলেন। হঠাৎ দরজা খুলে ওপরতলার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে উঠলেন, স্প্যানিশ আলমারিতে খুঁজে দেখো, সেটা পিতল দিয়ে বাঁধানো বই এবং সেটা যে এখন কোথায়, আমি সম্পূর্ণ ভুলে গেছি। তবে আমার মনে হয় টেবিলের মধ্যেই রয়েছে সেটা।

মিসেস অলিভার প্রথম ডায়ালে সফল না হওয়ায় তিনি যোগাযযাগ করলেন মিসেস স্মিথ পোটারের সঙ্গে। তিনি যে শুধু বিরক্তই হলেন তা নয় কোনো রকম সাহায্যও করলেন না। আগে যারা সেই ফ্ল্যাটে থাকত তাদের কারোরই এখনকার টেলিফোন নম্বর দিতে পারলেন না। সুতরাং আরও একবার ঠিকানার বইটা উলটে-পালটে দেখলেন। আরও দুটো ঠিকানা মিসেস অলিভার আবিষ্কার করলেন। যাইহোক তৃতীয়বারের চেষ্টায় র‍্যাভেন্সক্রফটের একটা অস্পষ্ট ঠিকানা খুঁজে পেলেন। নামের পাশে একটা ক্রস চিহ্ন সই করা। এটা দেখে তিনি মনে করলেন তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন। কথাটা যেই মাত্র ভাবলেন তৎক্ষণাৎ তিনি ডায়াল করলেন।

একটা নারীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। তিনি মনে মনে ভাবলেন সিলিয়ার!

ওহে প্রিয়, হা, তা বেশ কয়েকবছর হল এখানে ও থাকছে না এবং আমার মনে হয় এখন ও নিউক্যাসেলে আছে। সম্ভবত শেষবার সেখান থেকেই ওর কণ্ঠস্বর শুনেছিলাম।

মিসেস অলিভার বললে, ওখানকার ঠিকানা আমি পাইনি।

না দুঃখিত আমার কাছেও নেই। তখন মেয়েটি বলল, আমার ধারণা একজন ভেটনারি সার্জেনের সেক্রেটারির কাজ করছে সম্ভবত। সেটা কোনো কাজের কথা নয়। মিসেস অলিভার শেষবারের মতো চেষ্টা করলেন ১৯৬৭ সালের ঠিকানা লেখা বইটার ওপর চোখ বোলাতে। দূরাভাষে প্রশ্ন আসে আপনি কি সিলিয়া র‍্যাভেলক্রফটের কথা বলছেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক তাই।

দূরাভাষে লোকটি বলল, আমার কাছে প্রায় দেড় বছর আগে কাজে করে। সে কাজের খুব উপযুক্ত ছিল, এবং সে যদি আরও কিছুদিন থাকত আমি খুব খুশি হতাম। আমার ধারণা এখান থেকে হারলে স্ট্রিটে চলে গেছে। কিন্তু অন্য আর এক জায়গার ঠিকানা আছে আমার কাছে, দাঁড়ান মিঃ এক্স নাম অজানা ঠিকানা। আমি এখানে পেয়েছি ঠিকানা, মনে হচ্ছে ইসলিংটনে কোথাও হবে। আপনার কি ধারণা সেটা সম্ভব?

তার উত্তরে মিসেস অলিভার বললেন, সব কিছুই সম্ভব এবং তিনি মিঃ এক্সকে ধন্যবাদ জানিয়ে ঠিকানাটা লিখে রাখলেন।

লোকের ঠিকানা পাওয়া আজকাল বড়ো কষ্টকর ব্যাপার। যাইহোক তিনি ইসলিংটনের নম্বর চেষ্টা করলেন। ভারিকি গলায় একজন উত্তর দিল, বলুন আপনি কাকে চান? সে কি এখানেই থাকে? নাম বলুন।

মিস সিলিয়া র‍্যাভেন্সক্রফট।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে এখানেই থাকে। তবে এখন সে বাইরে। ঘরে ফেরেনি এখনও।

সন্ধ্যায় সে ফিরবে তো?

হ্যাঁ, হ্যাঁ খুব শিগগিরই সে ঘরে আসবে এবং পোশাক বদল করেই আবার সে বেড়িয়ে যাবে কারণ একটা পার্টি আছে তার। খবরটা দেওয়ার জন্য মিসেস অলিভার তাকে ধন্যবাদ জানালেন।

তিনি অনেকক্ষণ ধরে ভাবার চেষ্টা করলেন যে, শেষ কবে তিনি তার ধর্মকন্যা সিলিয়াকে দেখেছিলেন? তিনি কিছুতেই খেয়াল করতে পারলেন না। সমস্ত ব্যাপারটাকে আবার তিনি ভাবলেন, এখন নিশ্চয়ই ও লন্ডনে আছে। ওর বয়ফ্রেন্ডও কি লন্ডনে আছে এবং ওর বয়ফ্রেন্ডের মাও কি লন্ডনে আছে, এই ব্যাপারগুলি খালি মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। তিনি ভাবলেন সত্যিই দেখছি এটা এখন আমার মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াল, এবং মিস লিভিংস্টোনকে দেখে তিনি তার মাথাটা তার দিকে ঘোরলেন।

মিস লিভিংস্টোনের সারা শরীরে ধুলো কালিঝুলি এবং তাকে সেই জন্য খুব বিরক্ত দেখাচ্ছিল এবং সে একগাদা ফাইল নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল।

জানি না এগুলোর মধ্যে একটাও আপনার কাজে লাগবে কিনা মিসেস অলিভার। ফাইলগুলোর চেহারা দেখে মনে হয় বহুদিন এগুলি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়েছিল। হতেই পারে, বললেন মিসেস অলিভার। আমার মনে হয় না, যাইহোক সোফার এক কোণায় ওগুলো রেখে দাও। সন্ধ্যার সময় আমি দেখব ওগুলো। মিসেস অলিভার বললেন। মিস লিভিংস্টোন তার অসন্তুষ্ট মনোভাব চেপে রেখে বলল, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি বরং ততক্ষণে ধুলো পরিষ্কার করে ফেলি। মিসেস অলিভার বললেন, সে তো তোমার অসীম দয়া এবং একটু থেমে মেয়েটির দিকে আপাদমস্তক তাকালেন এবং আবার বললেন, তোমার নিজের চেহারার যা অবস্থা হয়েছে নিজেকেও তার সঙ্গে সাফ করে নিও। আর হ্যাঁ, তোমার বাঁ কানে ছছটা মাকড়সার জাল আটকে গেছে, বিদ্যুতের গতিতে তিনি হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ইসলিংটনের নম্বরটা আবার ডায়াল করলেন। দূরাভাষে উত্তর শোনা গেল খাঁটি এ্যাংলো ফ্যাসনের কিন্তু কথাগুলো বেশ ধারালো, যদিও তাতে সন্তুষ্ট হলেন মিসেস অলিভার। মিস র‍্যাভেন্সক্রফট মানে সিলিয়া র‍্যাভেন্সক্রফট? হ্যাঁ আমিই সিলিয়া র‍্যাভেন্সক্রফট বলছি।

আমার ধারণা আমাকে তোমার ভালো মনে আছে। আমি হচ্ছি অ্যারিয়াডন অলিভার। দীর্ঘ দিন ধরে আমরা পরস্পর পরস্পরকে দেখিনি, আমি হলাম তোমার ধর্ম মা।

হ্যাঁ, অবশ্যই আমি সেটা জানি। আর এও সত্যি আমরা কেউ কাউকে অনেক দিন দেখিনি।

তোমাকে দেখার জন্য মনের অবস্থা বুঝতেই পারছ। ভীষণ ছটফট করছে মন, যদি তুমি আমার বাড়িতে আসো কিংবা তুমি যদি মনে করো এক ভোজসভায় কিংবা…।

ঠিক আছে, আপাতত এক্ষুনি একটু অসুবিধা আছে কারণ যেখানে আমি কাজ করি তাদের তরফ থেকে। আচ্ছা আজ সন্ধ্যায় আসতে পারি অবশ্য যদি আপনি পছন্দ করেন, সময় সাড়ে সাতটা অথবা আটটা। তার পরে কিন্তু অন্য জনকে ডেট দেওয়া আছে…

হ্যাঁ, হ্যাঁ তুমি যদি তাই এসো আমি খুবই খুশি হব।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আমি আসব।

মিসেস অলিভার তার ঠিকানা দিলেন সিলিয়াকে, টেলিফোন প্যাডের ওপর একটা নোট লিখে রাখলেন। এমন সময় বিরাট একটা অ্যালবাম হাতে নিয়ে লিভিংস্টোন ঘরে ঢুকলেন। তাকে দেখেই তার সারা মুখ বিরক্তিতে ভরে উঠল। সম্ভবত এটা হতে পারে। দেখুন তো মিসেস আলভার?

না এটা নয়, এটা হল রান্নার বই।

 মিস লিভিংস্টোনকে একটু আহত হতে দেখে মিসেস অলিভার বললেন, ঠিক আছে ওগুলোর মধ্যে থেকে আমার প্রয়োজনীয় অ্যালবামটা দেখে নেব। তিনি বললেন, আর একবার যাও এবং ভালো করে দেখে এসো। লিলেন কাপবোর্ডের কথা আমি যে ভেবেছিলাম সেটা তুমি জানো, বাথরুমের পরের দরজাটা বাথ টাওয়েলের একেবারে ওপরের তাকে কখন কখন বই বা কাগজপত্র আমি রেখে থাকি। দাঁড়াও, তোমার সাথে আমিও যাব এবং নিজের চোখে দেখব।

মিনিট দশেক পরে ফিকে হয়ে যাওয়া একটা অ্যালবাম দেখছিলেন মিসেস অলিভার। কিন্তু তখন মিস লিভিংস্টোন, মানসিক যন্ত্রণায় তার শহীদ হবার মতো অবস্থা।

ঠিক সেই সময় মিসে অলিভার বললেন, এটা ঠিক আছে, তুমি বরং ডাইনিং রুমে গিয়ে সেই পুরানো ডেস্কের ওপর চোখ বুলিয়ে এসো কারণ কম করে দশ বছরের পুরানো যদি কিছু ঠিকানা লেখা বই দেখতে পাও, আজ আর অন্য কিছুর প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না।

মিস লিভিংস্টোন সেখান থেকে চলে গিয়ে একটা সোফার ওপর হেলান দিয়ে বসলেন এবং নিজের মনে মনে বললেন, আঃ কি বিস্ময়! আবার অ্যালবামের পাতাগুলো ওল্টালেন এবং ভাবলেন তিনি নিজে গেলে না কি ওকে আমার এখানে দেখতে পেলে কে বেশি খুশি হবে? যাইহোক সিলিয়া আসুক বা চলে যাক একটা ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে সন্ধ্যাটা আমাকে কাটাতে হবে।

একটা নতুন খাতা নিয়ে টেবিলের ওপর রাখলেন এবং তাতে একটার পর একটা তারিখ, সম্ভাব্য ঠিকানা এবং নাম লিখে চললেন। টেলিফোন বইতে কি যেন দেখলেন এবং তারপর মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারোকে ফোন করলেন।

হ্যালো মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি কি কথা বলছেন?

 হ্যাঁ, ম্যাডাম নিজেই বলছি।

মিসেস অলিভার জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি কিছু করলেন?

 কিছু মনে করবেন না, মাপ করবেন। কিন্তু আমি কী করব বলুন তো?

মিসেস অলিভার বললেন, গতকাল আমি কী বলেছিলাম আপনাকে?

ও হ্যাঁ, দ্রুতগতিতেই কাজ এগিয়ে নিয়ে চলেছি। তবে আরও কয়েকটা খোঁজখবর নেবার ব্যবস্থা করেছি।

আবার মিসেস অলিভার জিজ্ঞেস করলেন, ওইগুলো এখনও করে উঠতে পারেননি এই তো? পুরুষদের কাজকর্মের ওপর আমি খুব একটা ভরসা পাই না।

আপনি ম্যাডাম?

আমি এখন খুব ব্যস্ত, তার কথার উত্তরে মিসেস অলিভার বললেন।

 পালটা খোঁচা দিয়ে পোয়ারো বললেন, শুনি ম্যাডাম আপনিই বা কতদুর কী করেছেন?

বেশ উত্তেজিত হয়ে মিসেস অলিভার বললেন, হাতিগুলোকে একজায়গায় জড়ো করেছি। এর কোনো অর্থ কি আপনার কাছে আছে?

হ্যাঁ, আপনি কী বলতে চাইছেন মনে হয় তা আমি বুঝেছি।

মিসেস অলিভার মন্তব্য করলেন, অতীত নিয়ে চিন্তা করলে এটা যে খুব সহজ ব্যাপার নয় তখন বোঝা যায়। আরও একটা আশ্চর্যের ব্যাপার নাম মনে করে কজন লোকই বা তাদের চিনতে পারে? আমি এখন মনে করতে পারি না তখন আমার বয়স ষোলো, সতেরো কিংবা তিরিশ হবে। কেন যে আমি আমার জন্মদিনের খাতায় তাদের লিখতে বলেছিলাম! ওই বিশেষ দিনটিতে এক একজন কবির বাণী লিখে দিত এবং তাদের মধ্যে কিছু লেখা অর্থহীন।

আপনি কি আপনার সন্ধানকার্যে উৎসাহিত?

না, ঠিক তা বলব না, তবে আমি মনে করছি যে, আমি ঠিক পথেই চলেছি এবং মিসেস অলিভার আরও বললেন, আমি আমার ধর্মকন্যাকে ফোন করেছিলাম

আর আপনি ওর সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন এই তো?

না, ও আসছে আমার সাথে দেখা করতে। আজ রাত সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে আসার কথা। কিন্তু যদি সে না আসে, জোর দিয়ে কিন্তু কেউ বলতে পারে না ও আসবে কিনা, কারণ আজকালকার তরুণ তরুণীরা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

মিসেস অলিভার বললেন, জানি না, ঠিক খুশি নয় ও, কারণ ওর কণ্ঠস্বরটা যেন কেমন বলে মনে হল। এবার আমার মনে পড়ছে ওকে আমি শেষ দেখেছি বছর ছয়েক আগে, সেই জন্য হয়তো ভাবলাম যে ও হয়তো ভয় পেয়েছে। আমি আপনাকে বোঝাতে চাইছি আমি যত বেশি তর্জন গর্জন করে ওকে বলতাম তার থেকে অনেক বেশি গর্জন করে আমাকে বলত এই আর কী।

সেটা তো ভালোও হতে পারে বরং খারাপ তো নয়ই। আপনি কি তাই মনে করেন?

যদি কোনো লোক মনঃস্থির করে থাকে যে, তারা একদম আপনাকে পছন্দ করে না, সে ক্ষেত্রে কিন্তু তারা তাদের মনোভাব লুকিয়ে রেখে আপনার সাথে বেশ খুশি মনেই কথা বলবে। এবং তারা আপনাকে বেশ ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক খবর দেবে। কিন্তু তারা যদি আপনার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে কথা বলত ঠিক তার ভিন্ন ব্যবহারই তারা করত।

তার মানে আপনি বলতে চাইছেন সেবার ভান করে, তোষামোদ করে আমাকে খুশি করার চেষ্টা করবে, হ্যাঁ কিছু একটা জিনিস আপনি পেয়েছেন, সেই জন্যই তারা ভেবে নিয়েছে আপনি যেভাবে খুশি হন সেই ভাবেই তারা বলবে। আবার অপর দিকে তারা যদি বিরক্ত হয় আপনার ওপর সেক্ষেত্রেও তারা সেইভাবেই কথা বলবে যাতে বিরক্ত হন। সিলিয়ার যখন পাঁচ বছর বয়স তখন ওকে আমি খুব ভালো করে জানতাম, এবং ওর একজন নার্সারি গভরনেস ছিল, তার দিকে ও ওর বই ছুঁড়ে ফেলত। আমার আশঙ্কা যে সিলিয়াও যদি আমার সাথে সেইরকম ব্যবহার করে?

শিশুর প্রতি গভরনেস না গভরনেসের প্রতি শিশু?

 মিসেস অলিভার বললেন, অবশ্যই গভরনেসের প্রতি শিশু।

রিসিভার নামিয়ে রেখে সোফায় গিয়ে বসলেন এবং অতীতের স্মৃতি মন্থন করলেন। নিজের মনে নামগুলো বিড়োবিড়ো করে বলছিলেন ঠিক নিঃশ্বাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। মারিয়ানা যোশেফিন পোল্টারলিয়ার–বেশ কয়েক বছর হল তার কথা একদম ভাবিনি। আমার মনে হয়েছিল সে বুঝি মারা গেছে। হা, হ্যাঁ, আন্না ব্রেসবি জগতের সেই প্রান্তে সে বসবাস করত। আমি এখন বিস্মিত এই ভেবে–এই সমস্ত কথা ভাবতে ভাবতে বেল বেজে উঠল এবং তিনি চমকে উঠলেন। এবং তিনি নিজেই উঠে গেলেন দরজা খোলার জন্য।

.

সেই প্রথম হাতির উল্লেখ

 মিসেস অলিভার বন্ধু এরকুল পোয়ারোকে তাঁর বাড়িতে পেলেন না ফলে টেলিফোনে যোগাযোগ করলেন।

আজ সন্ধ্যায় আপনি কি বাড়িতে থাকবেন, জিজ্ঞেস করলেন মিসেস অলিভার।

তখন তিনি তার টেলিফোনের সামনে বসেছিলেন এবং একটু স্নায়ু দুর্বলতায় পীড়িত হয়ে টেবিলের ওপর অযথা আঙুলের আঁচড় কাটছিলেন।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে আপনি বলুন তো?

অ্যারিয়াডন, অলিভার বললেন, মিসেস অলিভার তিনি নাম সবসময় উল্লেখ করে থাকেন না। কারণ তিনি আশা করেন যে, তাঁর বন্ধুরা তার কণ্ঠস্বর শুনেই তাকে চিনতে পারে যেন।

হ্যাঁ, আজ সারাটা সন্ধ্যা আমি বাড়িতেই থাকব। তাহলে তার মানে কি ধরে নিতে পারি যে, আমার বাড়িতে আপনার পায়ের ধুলো নিশ্চয়ই পড়বে? যদি পরে আমি খুব খুশি হব।

আমি আপনার কাছে গেলে আপনি যে খুশি হন শুনে খুব ভালো লাগল, বললেন মিসেস অলিভার। কিন্তু আমার কোনো ধারণা নেই সেরকম কোনো খুশির কারণ আমি হব কিনা।

আপনার সঙ্গে দেখা হলেই সব সময়ে আমি খুশি হয়ে থাকি ম্যাডাম।

–জানি না, বললেন মিসেস অলিভার। আপনাকে বিরক্ত করতে হয়তো যেতে পারি, অথবা কিছু জিজ্ঞেস করতে। এবং আমি জানতে চাই কিছু একটা ব্যাপারে আপনি কি কিছু মনে করেন?

যে কোনো লেডিকে যখন তখন সেকথা বলতে আমি সবসময়েই প্রস্তুত, বললেন পোয়ারো।

একটা কিছু উদয় হয়েছে, বললেন মিসেস অলিভার। তবে একটা কিছু ক্লান্তিকর যাকে বলে আর আমি কিছুই জানি না সে ব্যাপারে কি করতে হবে?

তাহলে আপনি আসুন এবং আমার সঙ্গে দেখা করুন। আমি প্রশংসিত এবং অতিরঞ্জিত ভাবে প্রশংসিত।

মিসেস অলিভার জানতে চাইলেন, কোন সময়টা হলে আপনার ভালো হয়?

পোয়ারো বললেন, নটার সময়। আমরা দুজনে এক সঙ্গে কফি খাব কিন্তু তা নাহলে যদি আপনি গ্রেনাডাইন কিংবা সিরাপ পছন্দ করেন। কিন্তু যত দূর মনে পড়ছে আপনি আবার এসব পছন্দ করেন না।

জর্জ, পোয়ারো তার ভৃত্যকে ডাকলেন এবং বললেন, আজ রাতে মিসেস অলিভার আসছেন আমাদের বাড়িতে, তাকে অভ্যর্থনা জানাতে হবে তাঁর কী পছন্দ আমি ঠিক নিশ্চিত নই, তবে আমার ধারণা কফি আর এক ধরনের মদ হলেই চলবে।

আমি ওঁকে ক্যারেশ পান করতে দেখেছি স্যার।

তাহলে তো খুব ভালোই হয় বললেন পোয়ারো। তবে তাই হোক–

একেবারে ঠিক সময়ে এলেন মিসেস অলিভার, পোয়ারো যখন নৈশভোজ সারছিলেন তখন তিনি বিস্মিত হয়ে ভাবছিলেন যে তার কাছে মিসেস অলিভারের আসার উদ্দেশ্য কি হতে পারে এবং তিনি যা করতে যাচ্ছেন সে সম্পর্কে তার সন্দেহই বা কেন? তিনি কি কোনো কঠিন সমস্যা নিয়ে তার কাছে আসছেন অথবা কোনো অপরাধের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চান? পোয়ারো কিন্তু ভালো করেই জানেন মিসেস অলিভারের ক্ষেত্রে অতি সাধারণ কিছু, অথবা অত্যন্ত অস্বাভাবিক জটিল কিছু যে কোনো কিছু হতে পারে। কারণ তার কাছে সবই সমান। ভদ্রমহিলাকে খুবই চিন্তিত দেখে নিজের মনে এরকুল পোয়ারো ভাবলেন, সব সময় সব কাজেই তিনি মানিয়ে নিতে পারেন মিসেস অলিভারের সঙ্গে। হয়তো কোনো কোনো সময়ে তিনি তাকে পাগল করে তোলেন, তা সত্ত্বেও তারা দুজনে একসঙ্গে অনেক অভিজ্ঞতা এবং পরীক্ষা নিরীক্ষার অংশীদার হয়েছেন। সে দিনই সকালে নাকি সান্ধ্য পত্রিকায় তার সম্পর্কে কিছু লেখা তিনি পড়েছেন। তিনি এসে পড়ার আগেই সেটা তাকে মনে করতে হবে। সবে মনে করছেন সেই সময় তাঁর আগমন বার্তা ঘোষিত হল।

ঘরের ভেতর ঢুকলেন তিনি এবং সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলেন পোয়ারো, তার উদ্বেগের বিশ্লেষণ যথেষ্ট সত্য। এবং তার চুলের স্টাইল দেখে মনে হল সময়ের অভাবে হয়তো তাড়াতাড়িতে চুলের মধ্যে হাত চালিয়ে কেশবিন্যাসের কাজটা সেরে নিয়েছেন। তিনি প্রায়ই এরকম করে থাকেন একটু তাড়া থাকলে। যাইহোক তিনি তাকে স্বাগত জানালেন খুশি হয়ে এবং তাকে একটা চেয়ারে বসালেন। তার জন্য নিজের হাতে কাপে কফি ঢেলে দিলেন এবং ক্যারেশ ভর্তি একটা গ্লাস তুলে দিলেন তার হাতে।

আহ। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন এবং বললেন, আমার মনে হয়, আপনি হয়তো ধরে নিয়েছেন, আমি খুব ভয় পেয়ে গেছি, কিন্তু এখনও…

তা তো আমি নিজেই দেখতে পাচ্ছি এবং কাগজে দেখেছি আজ সব বিখ্যাত বিখ্যাত মহিলা লেখিকারা, সেই সাহিত্যিকদের ভোজসভায় যোগ দিচ্ছেন আপনি। আমি ভেবেছিলাম, আপনি তো কখনও পার্টিতে যান না।

সাধারণত আমি যাই না, বললেন মিসেস অলিভার, এবং ফিরে আর কখনও যাবও না।

 সহানুভূতির সঙ্গে পোয়ারো বললেন, মনে হচ্ছে আপনি খুব কষ্ট পেয়েছেন?

মিসেস অলিভারের অস্বস্তির মুহূর্তগুলির সঙ্গে তিনি পরিচিত। এবং তাঁর বই সম্পর্কে কারোর অতিরিক্ত প্রশংসা সব সময়ে তাঁকে অতি ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলে দেয় এবং একসময় তিনি তাকে বলেছিলেন, সঠিক উত্তর কখনও তার জানা থাকে না।

কেন, আপনি কি সেটা উপভোগ করেননি? উত্তরে মিসেস অলিভার বলেন, একটা সময় পর্যন্ত উপভোগ করেছি, তারপরেই একটা ক্লান্তিকর ঘটনা ঘটে যায়।

ও, সেই জন্যই বুঝি আপনি আমার কাছে ছুটে এসেছেন?

হ্যাঁ, কিন্তু সত্যি আমি জানি না কেন এর সঙ্গে আপনার কোনো সম্পর্ক নেই অথবা বলতে পারি কিছু করার নেই এবং আমার মনে হয় না যে, এ ব্যাপারে আপনি আগ্রহ প্রকাশ করবেন। আর সত্যি কথা বলতে কী আমি নিজেও একেবারেই আগ্রহী নই। এ ছাড়া আমার অন্তত মনে হয়েছে এ ব্যাপারে আপনি কী ভাবেন সেটা জানতে আপনার কাছে ছুটে আসব না। কিন্তু এসেছি কেন, এবং কী জানতে? জানতে এসেছি, আমার মতন অবস্থায় পড়লে আপনি কী করতেন?

পোয়ারো বললেন, এটা অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন। আমি জানি যে কোনো ব্যাপারে কাজ করব সম্পূর্ণ আমার মতো করে। কিন্তু আপনার মধ্যে কি রকম প্রতিক্রিয়া হবে, অথবা আপনি কীভাবে সেটা সম্পন্ন করবেন, তা আমার জানা নেই। যদিও আমি আপনাকে বেশ ভালোভাবেই জানি।

মিসেস অলিভার বললেন, যথেষ্ট দীর্ঘ সময় ধরে আপনি আমাকে জানেন, আর আপনার নিশ্চয়ই একটা ধারণা হয়ে গেছে

ঠিক কতদিন বলুন তো–এখন থেকে কুড়ি বছর আগে কি?

–ওহো, ও আমি জানি না। কত বছর থেকে আমি খেয়াল করতে পারি না। কোনো তারিখ সেটা মনে করা তো আরও বেশি মুশকিল। তবে আমি জানি সেটা ১৯৩৯ সাল কারণ সেই সময় যুদ্ধ শুরু হয়েছিল এবং অন্য তারিখও কিছু জানি কারণ সেইসব তারিখগুলোতে এদিক ওদিক অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে যেতে দেখেছিলাম।

যাইহোক, সাহিত্যিকদের ভোজসভায় আপনি গিয়েছিলেন এবং সেটা আপনি খুব বেশি উপভোগ করতে পারেননি।

মধ্যাহ্নভোজ উপভোগ করেছি ঠিকই, কিন্তু ঠিক তার পরেই…

যেমন করে চিকিৎসক তার রোগীর কাছ থেকে রোগের লক্ষণ জানতে চায় ঠিক তেমন একজন চিকিৎসকের মতো করুণা দেখিয়ে পোয়ারো বললেন, লোকেরা আপনাকে কিছু বলে। ওহো ভালো কথা ওরা যখন আমাকে কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, হঠাৎই তাদের মধ্যে কর্তৃত্ব করার মতো একজন বিরাট কাজের মহিলা সব সময় যিনি প্রত্যেকের ওপর কর্তৃত্ব করতে ভালোবাসে, এবং যিনি আপনাকে দারুণ একটা অস্বস্তিতে ফেলে দিতে পারেন। জানেন কেউ যেমন প্রজাপতি ধরার জন্য লাফিয়ে ওঠে সেইরকমভাবে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তার কেবল দরকার ছিল প্রজাপতি ধরে রাখার জন্য একটি জাল। তিনি আমার চারপাশে একবার প্রদক্ষিণ করে একরকম ধাক্কা দিয়ে আমাকে একটা সোফার ওপর বসিয়ে দেন এবং তারপর কথা বলতে শুরু করে দেন, আমার ধর্মকন্যার প্রসঙ্গ নিয়ে।

আহ, হ্যাঁ আপনার তো একটি ধর্মকন্যা এক সময় আপনার খুব প্রিয় ছিল, তাই না?

মিসেস অলিভার বললেন, বেশ কয়েক বছর ওকে আমি দেখিনি এবং সবার সঙ্গে আমার বড়ো একটা যোগাযোগও হয় না। তারপর তিনি আমাকে একটা ভীষণ চিন্তার প্রশ্ন করলেন এবং তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন–ওহে প্রিয়, সেটা বলতে যে কত কষ্ট আমার পক্ষে–না, তা নয়, খুব নম্র গলায় বললেন পোয়ারো, এটা খুবই সহজ, এবং প্রত্যেকেই সবকিছু বলে থাকে আমাকে। দেখুন আমি কেবল একজন বিদেশী, তাই তাতে কিছু এসে যায় না।

বেশ তো, আপনাকে বলা যখন সহজ বলছেন, মিসেস অলিভার তখন বললেন, দেখুন, তাহলে বলি মেয়েটির বাবা ও মার সম্পর্কে খোঁজখবর নেন আমার কাছ থেকে। এবং তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন মেয়েটির মা তার বাবাকে খুন করেছিল, নাকি তার বাবা তার মাকে খুন করেছিল।

আমাকে ক্ষমা করবেন, বলে উঠলেন পোয়ারো। হ্যাঁ, আমি জানি পাগলের প্রলাপের মতো শোনাচ্ছে, ঠিকই আছে আমি ভাবলাম এটা বুঝি পাগলামো।

আপনার ধর্মকন্যার মা তার বাবাকে খুন করেছিল অথবা তার বাবা তার মাকে খুন করেছিল?

তা ঠিক, বললেন মিসেস অলিভার, কিন্তু এটা কি ঘটনা? যে তার বাবা তার মাকে খুন করেছিল নাকি তার মা তার বাবাকে খুন করেছিল?

ভালো কথা ওদের দুজনকেই গুলিবিদ্ধ দেখতে পাওয়া যায়, মিসেস অলিভার আরও বলেন যে, পাহাড়ের একেবারে চূড়ায়, আমি ঠিক মনে করতে পারছি না, হয় সেটা কর্নওয়াল নয় করসিকায়। সেইরকমই একটা জায়গা হবে।

তাহলে সেটা সত্য বটে, পরে তিনি কী বললেন? ওঃ হ্যাঁ, ওই অংশটা সত্য। তা বেশ কয়েক বছর আগে ঘটনাটা ঘটেছিল। হ্যাঁ ভালো কথা, আমি কিন্তু বলতে চাই–আমার কাছে এলেন কেন?

কারণ আপনি একজন অপরাধ কাহিনির লেখিকা কোনো সন্দেহই নেই এবং তিনি নিশ্চয়ই বলে থাকবেন যে সমস্ত অপরাধের ব্যাপারে আপনি জানেন, এটাই কি সত্য, যা ঘটেছিল? বললেন পোয়ারো।

ওঃ হ্যাঁ, এটা সেরকম কিছুই নয় যা এ করতে পারে। অথবা ধরুন আপনার মা আপনার বাবাকে হত্যা করল, কিংবা আপনার বাবা আপনার মাকে হত্যা করল, সে সব ক্ষেত্রে ঠিক মতো কীভাবে অগ্রসর হওয়া যায়। এটা এমনিই একটা কিছু যা সত্যি সত্যি ঘটেছিল, আমার কী মনে হয় জানেন? এ ব্যাপারে আপনাকে সব খুলে বলাই ভালো। কারণ এখন আমি সবকিছু মনে করতে পারি না, সেই সময় সেটা কিন্তু খুবই পরিচিত ছিল। আমার মনে হয় সে প্রায় বছর বারো আগের ঘটনা হবে। ওই যে বললাম লোকগুলোর নাম কিন্তু আমি মনে করতে পারি কারণ আমি তাদের চিনতাম। স্ত্রী আমার সঙ্গে স্কুলে ছিল, আমরা দুজনে বন্ধুর মতন ছিলাম। সেটা ছিল একটা সুপরিচিত মামলা, আর জানেন কেসটা এতোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, সমস্ত খবরের কাগজে ছাপা হয়েছিল। স্যার অ্যালিস্টার র‍্যাভেন্সক্রন্ট এবং লেডি র‍্যাভেন্সক্রক্ট, তাঁরা অত্যন্ত সুখী দম্পতি। এবং ভদ্রলোক ছিলেন একজন কর্নেল অথবা জেনারেল, তারা সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছিল, তারপর তারা কোনো এক জায়গায় আমি ঠিক মনে করতে পারছি না সম্ভবত সেটা বিদেশ হবে এই বাড়িটা কেনে। হঠাৎই একদিন সমস্ত কাগজে এই কেসের খবর বেরুল। অন্য কেউ তাদের খুন করেছে কিনা অথবা তারা পরস্পরকে হত্যা করেছিল কিনা এখন সেটাই একটা প্রশ্ন। এবং আমার যতদূর মনে হয় সেই রিভলবারটা বছরের পর বছর ধরে তাদের বাড়িতে ছিল।

সেই সময় তিনি যা শুনেছিলেন এক এক করে অল্পবিস্তর সব খুলে বললেন পোয়ারোকে, এবং তিনি মাঝে মাঝে বিশেষ বিশেষ জায়গায় এক এক সময় মিলিয়ে নিচ্ছিলেন।

সব শেষে তিনি বলে উঠলেন, কেন সেই ভদ্রমহিলা এ খবর জানতে চাইছেন?

হ্যাঁ, আমিও সেটা জানতে চাই। মিসেস অলিভার বললেন, কারণ আমি সিলিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে পারি। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি ও এখনও লন্ডনেই আছে। এবং আমার ধারণা সে এতদিনে ডিগ্রি পেয়ে গেছে। হয় কেমব্রিজ নয় অক্সফোর্ডে থাকে। সেখানে হয় লেকচারার হিসাবে নয়তো অন্য কোথাও শিক্ষকতার কাজে নিযুক্ত, ও অত্যন্ত আধুনিকা। বড়ো বড়ো চুলওয়ালা পুরুষের সঙ্গে ভয়ঙ্কর পোশাকে মেলামেশা করে। তবে আমার মনে হয় না যে ও ড্রাগে আসক্ত। কখনও কখনও খবর পাই ওর কাছ থেকে। ও আমাকে খ্রিস্টমাসের কার্ড এবং ওই রকম কিছু জিনিস পাঠিয়ে থাকে। ওহো হা, কেউ কি তার ধর্মসন্তানদের কাছ থেকে সব সময় এটা আশা করে না? ওর বয়স তো এখন সবে পঁচিশ কিংবা ছাব্বিশ।

বিবাহিতা নয়?

না। তবে আপাতদৃষ্টিতে বিয়ে করতে যাচ্ছে মিসেস ব্রিটল না বার্টন কক্স-এর ছেলেকে। এবং মিসেস বার্টন কক্স চান না তার ছেলে এই মেয়েটিকে বিয়ে করে কারণ ওর বাবা ওর মাকে হত্যা করেছিল কিংবা ওর মা ওর বাবাকে হত্যা করেছিল।

হ্যাঁ আমিও তাই মনে করি, বললেন মিসেস অলিভার। আমি, একটা জিনিসই খালি চিন্তা করি যেমন ধরুন যদি কারোর অভিভাবকদের মধ্যে কেউ কাউকে হত্যা করে থাকে এবং কোনো ছেলের মায়ের কাছে যাকে মেয়েটি বিয়ে করতে যাচ্ছে, সত্যিই কি সেটা কোনো চিন্তার কারণ হতে পারে?

এই জিনিসটাই সবাইকে চিন্তা করতে হবে, এটা খুবই আগ্রহের ব্যাপার, তবুও আমি মনে করি না যে, স্যার অ্যালিস্টার র‍্যাভেন্সক্রফট কিংবা লেডি র‍্যাভেন্সক্রক্টদের সম্পর্কে কেউ এরকম আগ্রহী হবে। কিন্তু মিসেস বার্টন কক্স-এর ব্যাপারটা অত্যন্ত বিস্ময়কর। ওঁর ছেলে কি ওঁর কাছে খুব প্রিয়? তাই সম্ভবত ওঁর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

মিসেস অলিভার আদৌ চান না তার ছেলে এই মেয়েটিকে বিয়ে করুক।

উনি সেইরকমই কোনো আশঙ্কা করছেন যেমন যদি মেয়েটি জন্মসূত্রে ওর মায়ের ভালো-মন্দ গুণগুলো পেয়ে থাকে, যদি ও ওর মায়ের মতো ওঁর ছেলেকেও খুন করে বসে? বা ওই ধরনের অন্য কোনো অপরাধ?

তা আমি কী করে জানব? মিসেস অলিভার বললেন, তিনি হয়তো ভাবছেন, আমি এর বেশি বলতে পারি, কিন্তু সত্যিই তিনি আমাকে এর বেশি কিছু বলেননি। আপনি কি মনে করেন এ সবের আড়ালে কেউ থাকতে পারে? এবং এর কি কোনো অর্থ হতে পারে?

এগুলো খুঁজে বের করা খুব আগ্রহের ব্যাপার, বললেন পোয়ারো।

মিসেস অলিভার বললেন, হ্যাঁ, এই জন্যই তো আপনার কাছে এসেছি। আপনার কি খুব পছন্দ সেগুলোর সন্ধান করার? কিন্তু প্রথমে আপনি সে সব ব্যাপারের কোনো কারণ খুঁজে পাবেন না, কারণ কেউই তা পায় না।

পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি মনে হয় মিসেস বার্টন কক্স-এর বিশেষ কোনো পক্ষপাত আছে?

তার মানে আপনি বলতে চাইছেন স্বামী তার স্ত্রীকে খুন করার চেয়ে স্ত্রী তার স্বামীকে খুন করার পক্ষে তিনি তার মতামত জানতে চান? আমার তা মনে হয় না।

পোয়ারো বেশ সহানুভূতি প্রকাশ করে বললেন, আপনার উভয়সঙ্কটের কথা আমি বুঝতে পারছি। এটা খুবই গোপনীয় ব্যাপার যে, পার্টি থেকে আপনি বাড়িতে এলেন এবং আপনাকে এমন একটা কাজ করতে বলা হয় যা আপনার পক্ষে অসম্ভব বলা চলে এবং আপনি অবাক হয়ে ভাবছেন এরকম একটা ঘটনা ঠিকমতো কী করে মোকাবিলা করা যায়।

হ্যাঁ, এবার বলুন এর সঠিক পথ কোনটা? মিসেস অলিভার জিজ্ঞেস করলেন।

আমার পক্ষে বলা অত সহজ নয় কারণ আমি মহিলা নই। বললেন পোয়ারো। তিনি এমন একজন মহিলা, যাকে আপনি চেনেন না এবং আপনি আজই সেই পার্টিতে প্রথম তার সঙ্গে মিলিত হন এবং যিনি আপনার সামনে এই সমস্যাটা রেখেছেন এবং তিনি আপনাকে এই সমসম্যার সমাধান করতে বলেছেন নির্দিষ্ট কোনো কারণ না দেখিয়েই।

হ্যাঁ ঠিক তাই, স্বীকার করলেন মিসেস অলিভার। তিনি জানতে চাইলেন যে, এখন অ্যারিয়াডন কী করবেন আর ওই বা কী করবে? অপরপক্ষে খুব জানতে ইচ্ছা করছে এ-ধরনের সমস্যার খবর আপনি কি খবরের কাগজে পড়েছেন নাকি?

পোয়ারো বললেন, আমার ধারণা তিনটে জিনিস এ করতে পারে। মিসেস বার্টন কক্সকে একটা নোট পাঠাতে পারে, এ বলতে পারে আমি খুবই দুঃখিত। সত্যিই আমি মনে করি এ ব্যাপারে আমি আপনাকে বাধিত করতে পারব না। অথবা আপনি আপনার ধর্মকন্যার সঙ্গে যোগাযোগ করে ওকে বলুন যে, ছেলেটির মা যা যা জানতে চান, অথবা সেই তরুণটি কিংবা যাকে ও বিয়ে করার কথা ভাবছে, আপিন ওর কাছ থেকে জেনে নিতে পারবেন সত্যি সেই যুবকটিকে বিয়ে করার কথা ভাবছে কিনা এবং তাই যদি হয় মেয়েটির কোনো ধারণা আছে, অথবা সেই যুবকটি কী ওকে কিছু বলেছে? তার মার মাথায় কী মতলব এসেছে, যে যুবকটিকে ও বিয়ে করতে যাচ্ছে তার মার সম্পর্কে মেয়েটি কী ভাবে? তৃতীয় জিনিসটা আপনি নিজেও করতে পারেন। আমি আপনাকে দৃঢ়ভাবে পরামর্শ দিতে যাচ্ছিলাম, সেটা…

আমি জানি, বাধা দিয়ে বলেন উঠলেন মিসেস অলিভার। স্রেফ একটা শব্দ।

 কিছুই নয়, বললেন পোয়ারো।

মিসেস অলিভার সায় দিয়ে বললেন, আমি জানি সেটা খুব সহজ সরল। একটি মেয়েকে গিয়ে বলা কে আমার ধর্মকন্যা, আর তার ভাবী শাশুড়ি কী বলছেন এবং লোকদের কী জিজ্ঞেস করছেন। কিন্তু

সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন পোয়ারো, আমি জানি এটা মানুষের কৌতূহল।

মিসেস অলিভার বললেন, আমি শুধু জানতে চাই ওই জঘন্য প্রকৃতির মহিলাটি কেন আমার কাছে এসেছিলেন আর কেনই বা অমন সব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলেছিলেন। কিন্তু যতক্ষণ না জানতে পারছি…

হ্যাঁ, বললেন পোয়ারো। আপনি কিছুতেই ঘুমাতে পারবেন না। আর ঘুমালেও রাতে আপনি জেগে উঠবেন। আর আমি যদি আপনাকে জেনে থাকি তাহলে বলতে পারি আপনার মাথায় অত্যাধিক বিস্ময়কর সব ধারণা গিজগিজ করছে। সেগুলোকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে একটা আকর্ষণীয় অপরাধমূলক কাহিনি তৈরি করতে পারবেন। রহস্যময় গোয়েন্দা থ্রিলার–এ ধরনের আর কি।

বেশ আমি যদি সেইভাবে ভেবে নিয়ে থাকি তো নিশ্চয়ই পারব। মিসেস অলিভার বললেন। এবং এই সময়ে তার চোখ দুটি একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

ছেড়ে দিন ম্যাডাম, পোয়ারো বললেন, এ-ধরনের প্লট বা উপন্যাসে রূপ দেওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ, আর তাছাড়া মনে হয় না এর জন্য তেমন কোনো ভালো কারণ আছে।

কিন্তু ভালো যে কারণ সেই সেই ব্যাপারে আমি একেবারে নিশ্চিত হতে চাই।

পোয়ারো মন্তব্য করলেন, এটা তো মানুষের স্বাভাবিক কৌতূহল এবং তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এবং বললেন যে, ইতিহাসের কাছে আমরা কত না ঋণী, জানি না কে প্রথম এই কৌতূহল আবিষ্কার করেছিল। শোনা যায় বিড়ালের সাথে এর সম্পর্ক আছে। আবার এই কৌতূহলই গ্রাস করে বিড়ালকে।

বাধা দিয়ে মিসেস অলিভার বললেন, ঠিক করে আমাকে বলুন তো আমি একজন ভয়ঙ্কর দীর্ঘনাসা পার্কার? আপনি কী মনে করেন?

না, আমি তা মনে করি না। সব কিছু খতিয়ে দেখলে আমার তো মনে হয় না আপনি একজন বিরাট কৌতূহলী মহিলা, বললেন পোয়ারো। কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সাহিত্যসভায় আপনি বেশ অস্বস্তিবোধ করেছেন, খুব বেশি দয়া ও প্রশংসা আপনার সহ্য হয়নি, বরং একটা বিশ্রী উভয়সঙ্কটে পড়ে গেছেন এবং এক ব্যক্তিকে আপনার ভীষণ অপছন্দ যিনি আগ বাড়িয়ে আপনার কাছে ছুটে এসেছিলেন।

হ্যাঁ, উনি অত্যন্ত ক্লান্তিকর মহিলা যাকে একদম পছন্দ করা যায় না।

অতীতে এই স্বামী-স্ত্রীর খুন হওয়ার ব্যাপারটা কেমন যেন রহস্যজনক। কারণ আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে তাদের দুজনের মধ্যে বেশ ভালো সদ্ভাব ছিল। ঝগড়াঝাটির কোনো লক্ষণ ছিল না, অন্তত আপনার মতে কেউ কখনও সেরকম ঘটনা শোনেনি অথবা কাগজে পড়েনি।

তারা গুলিবিদ্ধ হয়, এটা মনে হয় একটা আত্মহত্যার চুক্তি হতে পারে। আমার মনে হয় প্রথমে পুলিশ এই রকমই একটা কিছু ভেবে থাকবে। অবশ্য বহুবছর পরে কেউ কখনও অন্য কোনো ব্যাপার যদি থাকেও সেটা খুঁজে বার করতে পারে না।

হ্যাঁ, ঠিকই। তবে আমার মনে হয় এ ব্যাপারে হয়তো কিছু একটা হদিশ পেলেও পেতে পারি, বললেন পোয়ারো।

তার মানে আপনি কী মনে করেন–উত্তেজিত বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে আপনি পেয়েছেন?

বেশ তাই হবে। তবে উত্তেজিত বন্ধুবান্ধব আমি বলব না, অবশ্যই কিছু জ্ঞানী বন্ধুবান্ধব, যারা নির্দিষ্ট কয়েকটা রেকর্ড সংগ্রহ করতে পারে এবং অপরাধ অনুষ্ঠানের সেই সময়ে তদন্তের রিপোর্ট দেখতে পারে। আবার সেইসব রেকর্ডের ভেতর থেকে কিছু ফাঁক ফোকর বার করলেও করতে পারি।

মিসেস অলিভার আশান্বিত হয়ে বললেন, সেটা যদি খুঁজে বার করতে পারেন তাহলে আমাকে বলবেন।

হ্যাঁ, পোয়ারো বললেন, আমার ধারণা এই কেসের পুরো ঘটনা যে ভাবেই হোক আপনাকে জানাতে পারব বলে মনে হয়। হয়তো বা একটু সময় লাগতে পারে।

দেখছি, আপনাকে আমি যা করতে বলেছি আপনি যদি সেটা করেন, অবশ্য নিজেকেও মেয়েটির সাথে দেখা করতে হবে এবং জানতে হবে এ ব্যাপারে কোনো কিছু জানে কিনা, ওকে এও জিজ্ঞেস করব ওর শাশুড়িকে জ্ঞান দেব কিনা মানে অন্য কোনো ভাবে আমি ওকে সাহায্য করতে পারি কিনা। আর হ্যাঁ, যে ছেলেটিকে ও বিয়ে করতে যাচ্ছে তাকে দেখার ইচ্ছা আমার আছে।

চমৎকার! তা ঠিক, বললেন পোয়ারো এবং আমার ধারণা মিসেস অলিভার বললেন, যদি কিছু লোক–হঠাৎ মাঝপথে থেমে গেলেন এবং ঐ তুলে তাকালেন তিনি।

এরকুল পোয়ারো তার অভিমত জানালেন যে, এটা একটা অতীতের ঘটনা। সেই সময়ে এর পিছনে একটা কারণ থাকলেও থাকতে পারে, এবং কী সেই কারণ আর কখন থেকে সেটা ভাবতে শুরু করেন? একটা বিস্ময়কর কিছু বলে মনে না হলে এক্ষেত্রে সেটা অনুপস্থিত এবং কেউ সেটা মনেও রাখে না।

না, সে কথা খুবই সত্য, বললেন মিসেস অলিভার। সেই সময়ে খবরের কাগজগুলোতে বেশ কিছুদিন ধরে এই কেসের ব্যাপারে অনেক লেখালেখি হয়। তারপর সব ক্ষেত্রে যা হয় একটু একটু করে ফিকে হয়ে একেবারে চাপা পড়ে যায়। এবার ঘটনাটা একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক। আজ থেকে পাঁচ কিংবা ছয় বছর আগে অন্য আর একটি মেয়ে সেই মেয়েটির মতন তার বাড়ি থেকে একা একা বেরিয়ে পড়ে। হঠাৎ একটি ছেলে বালির স্তূপের ওপর খেলা করার সময় একটা পাথরের স্কুপের খাঁজে মেয়েটির মৃতদেহ আবিষ্কার করে। হয়তো তখন সেখান থেকে বালির স্তূপ সরে গিয়ে থাকবে। পাঁচ কিংবা ছয় বছর পরের ঘটনা।

পোয়ারো বললেন, সে কথা সত্যি, এবং আরও বললেন যে মৃত্যুর দীর্ঘদিন বাদে সেই মৃতদেহ পাবার পর এবং সেই বিশেষ দিনটিতে কী ঘটেছিল এবং লিপিবদ্ধ করে রাখা নানা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে দেখলে খুনির সন্ধান নিশ্চয়ই পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে কাজটা খুবই কঠিন হবে তার কারণ যে, এর উত্তর হয় একটা নয় দুটোও হতে পারে। হয় স্বামী তার স্ত্রীকে অপছন্দ করতেন তাই তার হাত থেকে রেহাই পেতে চেয়েছিলেন। কিংবা তাঁর স্ত্রী তাকে ঘৃণা করতেন। আবার এমন ঘটনাও হতে পারে যে ভদ্রমহিলার অন্য কোনো প্রেমিক ছিল। সুতরাং এর থেকে মনে করে নেওয়া যেতে পারে যে, এটা একটা আবেগপ্রবণ অপরাধ। কিংবা ভিন্ন ধরনের কিছু। সুতরাং এ কেসের রহস্য খুঁজতে গিয়ে সফল না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এবং হয়তো কিছুই পাওয়া যাবে না সেই সময় পুলিশ যদি কোনো কিছুর হদিশ করতে না পারে। তাহলে খুব সম্ভবত এই কেসের মোটিভ জানা যাবে না। অতএব সেই নদিনের বিস্ময়ের মতোই এটা থেকে যাচ্ছে।

আমার ধারণা আমি ধর্মকন্যার কাছে যেতে পারব, ওই ভয়ঙ্কর মহিলা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে এই কাজটা আমাকে দিয়ে করাতে চেয়েছিল। তিনি ভেবেছেন যে মেয়েটি জানে-ধরে নিলাম মেয়েটি জানে। এবং এও বললেন মিসেস অলিভার, জানেন আজকালকার ছেলেমেয়েরা অস্বাভাবিক অনেক কিছুই জানে।

আচ্ছা বলুন তো সেই সময় আপনার এই ধর্মকন্যার বয়স কত ছিল?

আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে আমার মনে হয় মেয়েটি তখন ন-দশ বছরের হবে। তবে বয়সের অনুপাতে তখন বয়স্কাই দেখাচ্ছিল। এটা আমার কল্পনা যে তখন ও স্কুলে ছিল এবং খবরের কাগজে যা পড়েছিলাম যেটুকু মনে আছে বলছি।

কিন্তু আপনি কী মনে করছেন মিসেস কক্স-এর ইচ্ছা আপনাকে দিয়ে মেয়েটির কাছ থেকে খবর সংগ্রহ করা হয় মেয়েটি কিছু জানবে নয়তো ছেলেটিকে ও কিছু বলে থাকবে এবং ছেলেটি তার মাকেও কিছু হয়তো বলে থাকবে। তবে আমার অনুমান মিসেস বার্টন কক্স নিজেই মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করেছিলেন এবং প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। তাই তিনি ভাবলেন মিসেস অলিভার যখন মেয়েটির ধর্ম মা, শুধু তাই নয়, অপরাধতত্ত্ব সম্পর্কে তার প্রভূত জ্ঞান আছে, হয়তো তিনি খবর সংগ্রহ করতে পারেন। তিনি এই ব্যাপারটাকে নিয়ে কেন যে এত মাথা ঘামাচ্ছেন তার কোনো মানে বা কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছেন না পোয়ারো। এই একটু আগে আপনি অস্পষ্টভাবে বললেন, লোকেরা সেটাও আমার কাছে ঠিক মতন বোধগম্য হচ্ছে না। কারণ এতদিন বাদে তারা কি আমাদের কোনো সাহায্য করতে পারবে অথবা কেউ কি মনে রাখতে পেরেছে?

মিসেস অলিভারের ধারণা, তারা মনে রেখেছে, হতভম্বের মতো তার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললেন, লোকেরা মনে রাখবে?

হ্যাঁ, ভালো কথা, মিসেস অলিভার বললেন, আমি সত্যি সত্যি হাতিদের কথা ভাবছিলাম, হাতিদের?

মিসেস অলিভার যেন সব যুক্তিতর্কের বাইরে। এবারেও ভাবলেন পোয়ারো অকারণে কিছু কিছু এমন কথা বলে ফেলেন যা বোঝা খুব মুশকিল। এখানে হঠাৎ হাতির প্রসঙ্গ এলো কী করে?

গতকাল মধ্যাহ্নভোজের সময় আমি হাতিদের কথা ভাবছিলাম, বললেন মিসেস অলিভার।

পোয়ারো কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ হাতিদের কথা ভাবছিলেন কেন? ওহো, হা, ভালো কথা, সত্যিই আমি দাঁতের কথাই ভাবছিলাম। কারণ এই দাঁত দিয়েই শক্তজাতীয় কোনো খাবার খাওয়া হয়। এবং আপনার যদি নকল দাঁত থাকে কোনো মতেই কিন্তু আপনি ভালোভাবে খেতে পারবেন না। এবং আপনাকে জানতে হবে কী আপনি খেতে পারেন এবং কী খেতে পারেন না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পোয়ারো বললেন, ওই ডেন্টিস্টরা আপনার জন্য অনেক কিছু করতে পারে কিন্তু সব কিছু নয়।

তা ঠিকই বলেছেন, অথচ জানেন–আমি ভাবলাম আমাদের দাঁতগুলি কেবলই হাড়, ভয়ঙ্কর ভালো কিছু নয়, অথচ দেখুন কুকুরদের দাঁতগুলোকে সত্যিকারের হাতির দাঁত বলা যেতে পারে। হাতির দাঁতের কথা যখন আপনি ভাবেন তখন নিশ্চয়ই হাতির কথাও ভাবেন? বিরাট হাতির দাঁত। সত্যি ভাবেন না?

মিসেস অলিভার ঠিক কী বলতে চাইছেন সেটা পোয়ারোর কাছে বোধগম্য হল না। তাই আমাদের যা করতে হবে সেটা হল হাতির মতো দাঁত যাদের তাদের খুঁজে বের করা। কারণ হাতিরা বলে থাকে ভুলে যায় না কখনও।

এই প্রবাদটা শুনেছি বৈকি! কথার সায় দিয়ে পোয়ারো বললেন।

হাতিরা কখনও ভোলে না। বাচ্চাদের একটা গল্প নিশ্চয়ই জানেন যে একজন ভারতীয় দর্জি একবার একটি হাতির দাঁতে না উদরে সূচ বা ওই জাতীয় কিছু ফুটিয়েছিলেন। অনেকদিন পরে ঘটনাচক্রে সেই দর্জির সামনে দিয়ে হাতিটা যাচ্ছিল এবং হাতিটার মুখে ছিল ভর্তি জল। অথচ হাতিটার সঙ্গে দজিটার বেশ কয়েক বছর কোনো দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। তখন হাতি কী করলো জানেন? তার মুখ ভর্তি জল লোকটার গায়ে ছিটিয়ে দিল। হাতি কিন্তু ভুলে যায়নি যে লোকটা তার পেটে সূচ বিঁধিয়েছিল। এখন আমার কাজ কী জানেন–কয়েকটি হাতির সংস্পর্শে আসতে হবে আমাকে, বললেন মিসেস অলিভার।

এরকুল পোয়ারো বললেন, আপনি যে কী বোঝাতে চাইছেন এবং কাকে হাতি হিসাবে বিশ্লেষণ করতে চাইছেন, আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে। ঠিক আপনি চিড়িয়াখানায় যাচ্ছেন কিছু খবর সংগ্রহের জন্য।

ভালো কথা, এটা ঠিক সেরকম নয়। বললেন মিসেস অলিভার। যে সব লোক হাতির সাদৃশ্য তাদের সন্ধান করাই হল আমার কাজ। সত্যি কথা বলতে কী কিছু লোক আছে যারা সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা মনে রাখতে পারে। যেমন অনেক কিছুই আমি মনে রাখতে পারি। কারণ সেই সব ঘটনাগুলোকে আমি চোখের সামনেই ঘটতে দেখেছিলাম। আমার বয়স তখন পাঁচ। একটি জন্মদিনের পার্টির কথা আজও মনে আছে, তার ছিল একটা ফ্যাকাসে লাল রঙের কেক। এবং কেকের উপরে ছিল একটা চিনির পাখি, অথবা যেদিন আমার প্রিয় গায়ক ক্যানারি পাখিটা খাঁচা থেকে উড়ে পালিয়ে গেল, স্পষ্ট মনে আছে তখন আমি খুব কেঁদেছিলাম। কোনদিন সেটাও আমার স্পষ্ট মনে আছে। দিনটা ছিল মঙ্গলবার কিংবা আর একটা দিনের কথা মনে পড়ে, যে দিন আমি মাঠে গিয়েছিলাম। সেই মাঠে ছিল একটা ষাঁড়। কে যেন বলল ষাঁড়টা গুতিয়ে দিতে পারে, তখন আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম এবং মাঠ থেকে ছুটে পালিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। আর আমার মনে আছে চমৎকার একটা পিকনিকের কথা। সেই পিকনিকে আমার খুব প্রিয় ফল জাম ছিল যার ডালপাতায় খোঁচা লাগার মতো খুব কাটা ছিল। খোঁচাও লেগেছিল ভয়ঙ্করভাবে, কিন্তু খোঁচা লাগার যন্ত্রণা আমি ভুলে গিয়েছিলাম কারণ অন্যদের থেকে আমি অনেক বেশি জাম পেয়েছিলাম বলে। তখন আমার বয়স ছিল মাত্র নয়। কিন্তু পরিণত বয়সে একশোরও বেশি বিবাহ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেছি কিন্তু দুটি অনুষ্ঠান ছাড়া আর কোনো অনুষ্ঠানের আনন্দ উপভোগের কথা আজ আর আমার মনে নেই। সেই দুটি বিশেষ বিবাহ অনুষ্ঠানের কথা কেন মনে আছে তার কারণ হল একটি অনুষ্ঠানে আমি কনের সহচরী হিসাবে যাই। অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হয়েছিল নিউফরেস্টে এবং সেখানে আর কে কে ছিল মনে নেই। তবে মনে হয় এক খুড়তুতো বোনের বিয়ে ছিল। কিন্তু আমি তাকে খুব একটা জানতাম না, সে শুধু চেয়েছিল একজন ভালো সহচরী, আর আমার অন্তত সে রকম ধারণা যে আমিই কেবল তার নাগালের মধ্যে ছিলাম। দ্বিতীয় বিবাহ অনুষ্ঠান ছিল আমার এক বন্ধুর। সে নেভিতে কাজ করত। একবার সাবমেরিন থেকে পড়ে গিয়ে জলের তলায় তলিয়ে যাচ্ছিল। শুধু তাই নয় অনেক কষ্টে সে রক্ষা পায়। সেই সময়ে যে মেয়েটির সঙ্গে তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল তার বাড়ির লোকেরা প্রথমে চায়নি এই ছেলেটির সঙ্গে তাদের মেয়ের বিয়ে হোক। সেই জলে ডুবে যাওয়া ঘটনার পরই তারা এই বিয়েতে রাজি হয়। এবং সেই বিয়েতেই কনের সহচরী হিসাবে হাজির হই। সুতরাং আমার এতগুলো কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই সেটা হল এমন কতগুলো ঘটনা আছে যা আপনার মনে গেঁথে যায় চিরদিনের জন্য। চেষ্টা করলেও ভুলতে পারবেন না।

এখন দেখছি আপনার যুক্তি বেশ আকর্ষণীয়, পোয়ারো তখন বললেন। তাহলে আপনি হাতি নয় হাতি সদৃশ্য মানুষের খোঁজে যাবেন। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন তবে যাবার আগে সেই ঘটনার সঠিক তারিখ আমাকে জানাতে হবে। পোয়ারো তাকে ভরসা দিয়ে বললেন, আমি নিশ্চয়ই এই ব্যাপারে সাহায্য করতে পারব।

তাহলে আমি সেই সময়কার লোকেদের কথা মানে যে সব লোক জেনারেলের বন্ধুবান্ধবদের চিনত, এবং সেই সব বন্ধুবান্ধবরা জেনারেলের সব খবর রাখত, এবং এও হতে পারে যারা জেনারেলের বন্ধুদের চিনত তারা হয়তো বিদেশে চলে গেছে। তিনি এও বললেন, যাদের আমি দীর্ঘদিন ধরে চিনি তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই আমার। অথচ আপনি দেখবেন এমন অনেক লোককে আপনি চেনেন কিন্তু দীর্ঘদিন কোনো দেখাসাক্ষাৎ নেই। হঠাৎ যদি একদিন দেখেন তখন দেখবেন খুব খুশি হবে অথবা তারা আপনাকে ভালো করে চিনতে না পারলেও চেনবার চেষ্টা করবে। এবং তখনই আপনি সেই নির্দিষ্ট দিনের ঘটনার প্রসঙ্গ তুলে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারবেন।

পোয়ারো বললেন, দারুণ তো, এটা খুবই আকর্ষণীয় ব্যাপার। আপনার কোনো কাজে অসুবিধা হবে না কারণ আপনি খুব ভালোভাবেই প্রস্তুত হয়ে আছেন। যে সব লোক র‍্যাভেন্সক্রফটদের চিনত ভালোভাবে অথবা ভালোভাবে নয়, কিংবা যেসব লোক সেই ঘটনাস্থলের কাছাকাছি বাস করত, তাদের খুঁজে বার করা একটু কঠিন হলেও আমি মনে করি শেষ পর্যন্ত সাফল্য আসবেই। সেই দিন কী ঘটেছিল এবং সেই ঘটনার ব্যাপারে তারা কী চিন্তা করে বা কেউ কী আপনাকে কিছু বলেছে, এইভাবে আলোচনা চালিয়ে যেতে যেতে একটু গভীরে গিয়ে প্রশ্ন রাখবেন তাদের কাছে, স্বামী অথবা স্ত্রীর অন্য কোনো নারী অথবা পুরুষের সঙ্গে প্রেমঘটিত কোনো ব্যাপার ছিল কিনা। কিংবা কোনো অর্থের উত্তরাধিকারী কেউ ছিল কিনা। আমার মনে হয় এই পথ ধরে এগোলে অনেক অজানা তথ্যের সন্ধান আপনি হয়তো পেতে পারেন।

মিসেস অলিভার বললেন, ওহে প্রিয়, আমার মনে হয় সত্যিই আমি দীর্ঘনাসা-পার্কার।

পোয়ারো বললেন, আপনাকে এখন একটা কাজ দেওয়া হয়েছে, আপনার পছন্দমতো কারোর দ্বারা নয় বা আপনি কাউকে বাধিত করতে চান এমন কারোর দ্বারাও নয়। কিন্তু সে এমন একজন যাকে আপনি অপছন্দ করেন, আপনাকে মনে রাখতে হবে জ্ঞান সঞ্চয়ের অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন, অবশ্য সেটা কোনো ব্যাপার নয়। সুতরাং আপনি আপনার নিজের পথ গ্রহণ করুন। সে পথ হচ্ছে হাতিদের। কারণ হাতিরা মনে রাখতে পারে।

মিসেস অলিভার বললেন, আমি সত্যিই ক্ষমা চাইছি আপনার কাছে।

পোয়ারো বললেন, যে সব হাতিরা মনে রাখে তাদের খোঁজে আপনাকে আবিষ্কারের অভিযানে আমি পাঠাচ্ছি।

মিসেস অলিভার খুব দুঃখের সঙ্গে বললেন যে, এ আমার পাগলামো এবং আমার মনে হয় আমি পাগল। স্ট্রেট ওয়েলপিটারের ছবির মতো নিজেকে ফুটিয়ে তোলার জন্য তিনি তার চুলের ভেতর হাত চালালেন। গোল্ডেন রিট্রিভার-এর বিষয়ে একটি গল্প লিখতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কিছুতেই শুরু করতে পারিনি এবং ঠিকমতো এগোতে পারছিলাম না কারণ আমি কী বোঝাতে চাইছি আপনি যদি তা জানেন–

ঠিক আছে এখন বরং গোল্ডেন রিট্রিভারের কথা বাদ দিন, এখন শুধু হাতিদের ওপর মনোযোগ দিন।

.

সিলিয়া

বাইরে ম্যাটের ওপর একটি মেয়েকে দাঁড়াতে দেখে মিসেস অলিভার হতভম্বের মতো তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে দেখলেন এবং মনে মনে ভাবলেন এই তাহলে সিলিয়া। মিসেস অলিভারের মতো অনুভূতি অন্য আর কারোর মধ্যে দেখা যায় না। জীবন এবং জীবনশক্তির প্রভাব খুবই শক্তিশালী।

তিনি তাকে দেখে যেন ভাবছিলেন এ যেন অন্য এক মেয়ে যার সম্বন্ধে অন্য কিছু ভাবা যেত। হয়তো আগ্রাসী নয়তো কঠিন বা একেবারেই বিপজ্জনক। যে সব মেয়েদের জীবনে একটা উদ্দেশ্য থাকে সেই সব মেয়ে হয়তো সংঘর্ষের পথে নিজেকে উৎসর্গ করে এবং হয়তো বা তার পিছনে কোনো কারণ থাকতে পারে। অবশ্যই আকর্ষণীয় বটে।

আরে এসো এসো ভেতরে এসো। অনেক দিন বাদে আবার তোমার সাথে আমার দেখা, খুব সম্ভবত কোনো একটা বিবাহ অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম কনের সহচরী হয়ে, এবং তোমার পরনে ছিল সিফনের পোশাক, এবং কিসের যেন বড়ো বড়ো গুচ্ছ ঠিক মনে পড়ছে না। কি ছিল সেটা, অনেকটা গোল্ডেন রডের মতন দেখতে?

খুব সম্ভব গোল্ডেন রডই ছিল, বলল সিলিয়া র‍্যাভেন্সক্রফট। আমরা অনেক হাঁচি দিয়েছিলাম–ঠিক তৃণাদি বা বালি নাকে ঢুকে গেলে যে অবস্থা হয় ঠিক আমাদের হাঁচি দেখে–সেরকমই মনে হয়েছিল। মারথা লেবাহন তাই না? সে এক যেন ভয়ঙ্কর বিয়ের আসর। এমন বিশ্রী সহচরীর পোশক আগে কখনও দেখিনি এবং অমন বিশ্রী পোশাক কখনও পড়িনিও।

হ্যাঁ, ঠিক অন্যদের থেকে একেবারে আলাদা এবং আমি বলব, তোমাকেই সবচেয়ে ভালো দেখাচ্ছিল।

সেটা আপনার চোখে ভালো লাগা। মোটেই আমার কাছে ভালো লাগেনি, সিলিয়া বলল। একটা চেয়ারে মিসেস অলিভার তাকে বসতে বললেন এবং বললেন, শেরি না অন্য কিছু, তুমি কী পছন্দ করো?

না, শেরিই আমি পছন্দ করি।

ও আমি ভেবেছিলাম তোমার এটা বিশ্রী লাগবে। মিসেস অলিভার বললেন, হঠাৎ তোমাকে কেন ডেকেছি জানো?

না, আমি জানি না। নিশ্চয়ই কোনো বিশেষ ব্যাপারে।

আমি যে খুব একটা বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন ধর্ম মা নই এই ব্যাপারে আমার মনে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

এই বয়সে আপনি কেন সেরকম হতে যাবেন?

তুমি ঠিকই বলেছ। মিসেস অলিভার বললেন, কারোর কর্তব্য আবার কারোর অনুভব করার স্পৃহা একটা নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয়ে যায়। আবার নিজেকে পরিপূর্ণভাবে ভরিয়ে তুলতে পেরেছি তাও নয়। কিন্তু তোমার পাকাপাকি স্বীকৃতিতে যাওয়ার কথা আমার মনে পড়ে না।

আমার বিশ্বাস ধর্মমা-র কর্তব্য হল ধর্মসন্তানদের প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া এবং যা কিছু খারাপ সব পরিত্যাগ করা, তাই নয় কী? এই কথা বলার সময় সিলিয়ার ঠোঁটে কৌতুকের হাসি ফুটে উঠল।

মিসেস অলিভার ভাবলেন মেয়েটি খুব নম্র বিনয়ী। কিন্তু কতকগুলো ব্যাপারে সাংঘাতিক বিপজ্জনক মেয়ে।

হ্যাঁ, ভালো কথা, মিসেস অলিভার বললেন, কেন আমি তোমাকে ডেকেছি তা বলব এবং সমস্ত ব্যাপারটাই অদ্ভুত। আমি কখনও কোনো সাহিত্য সভায় যাই না কিন্তু তবু গত পরশু একটা সাহিত্যের ভোজসভায় আমাকে যেতে হয়েছিল।

হ্যাঁ, খবরের কাগজে আপনার নাম মিসেস অ্যারিয়াডন অলিভার আমি দেখেছি। বলল সিলিয়া এবং খবরটা পড়ে আমি বিস্মিত হই। কারণ সচরাচর আপনি এরকম পার্টিতে যান না কখনও।

তার উত্তরে মিসেস অলিভার বললেন, না, এ রকম পার্টিতে আমার যেতেও ইচ্ছা করে না।

কেন আপনি আনন্দ উপভোগ করেননি? হ্যাঁ আনন্দ করেছিলাম বৈকি। এই প্রথমই এই ধরনের পার্টিতে আমি যাই। এখানে কিছুটা আমেজ থাকে কিছুটা আনন্দ থাকে কিন্তু এমন কিছুও থাকে যা বিরক্তির কারণ হতে পারে।

এমন কিছু ঘটেছিল কি যাতে আপনি বিরক্তি বোধ করেন?

হ্যাঁ, আর সেই ঘটনা তোমাকে জড়িয়ে এবং আরও ভাবলাম তোমাকে এ-সম্বন্ধে বলতেই হবে কারণ যা ঘটেছিল আমি একদম সেটা পছন্দ করি না।

সিলিয়া বলল, এটা যেন ঠিক ষড়যন্ত্রের মতো শোনাচ্ছে, এই বলে সে শেরিতে চুমুক দিল।

একজন ভদ্রমহিলা উপযাচক হয়ে কথা বলতে এলেন যাঁকে আমি চিনি না এবং তিনিও আমাকে চেনেন না।

আপনার জীবনে এসে রকম ঘটনাও ঘটেছে বলেও আমার মনে হয়।

মিসেস অলিভার বললেন, হ্যাঁ নিশ্চিতভাবেই ঘটেছিল। সাহিত্য জীবনে আকস্মিক ব্যাপারটা, তুমি মনে করো তোমার সামনে দাঁড়িয়ে কোনো লোক বলল, আমি আপনার বই খুব ভালোবাসি এবং আপনার সঙ্গে মিলিত হতে পেরে আমি খুব খুশি। এই রকম ব্যাপারটা আর কি।

ওই রকম কঠিন সব ব্যাপার আমার জানা আছে কারণ একসময় আমি একজন সাহিত্যিকের সেক্রেটারি ছিলাম।

হ্যাঁ, ঠিক এই ধরণের ঘটনা বটে, তবে তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম। এবং সেই মহিলাটি আমার কাছে এসে বললেন, আপনার একজন ধর্মকন্যা আছে এবং তার নাম সিলিয়া র‍্যাভেন্স ক্রট।

আপনার কাছে এসেই আমার কথা বললেন, কী বিশ্রী ব্যাপার, সিলিয়া বলল। কোথায় প্রথমে আপনার বই প্রসঙ্গে আলোচনা করবেন এবং আরও বলবেন আপনার শেষতম বইটি পড়ে খুব আনন্দ পেয়েছি বা সেই রকম কিছু। তারপর নয় আমার প্রসঙ্গে আসতে পারতেন। আমি বুঝতে পারছি না আমার বিপক্ষে তিনি কী এমন খুঁত পেয়েছেন?

তোমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ওঁর নেই বলেই আমার মনে হয়, বললেন মিসেস অলিভার।

তিনি কি আমার বন্ধু?

শুধু জানি না বললেন মিসেস অলিভার। ঠিক এই সময়ে দুজনের মধ্যে একটা নীরবতা নেমে এলো এবং শেরির গ্লাসে চুমুক দিয়ে সিলিয়া মিসেস অলিভারের দিকে তাকালেন সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে।

সিলিয়া বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপনি কোনো পথ ধরে চলছেন? আমার ধারণা আপনি আমাকে ষড়যন্ত্রের মধ্যে ফেলছেন।

ঠিক আছে, আশা করি আমার ওপর রাগ করবে না তুমি, বললেন মিসেস অলিভার।

আমি আপনার ওপর রাগ করতে যাব কেন?

কারণ তোমাকে এমন কিছু কথা বলব এবং এমন কিছু একটার পুনরাবৃত্তি করতে যাব তুমি শুনে হয়তো বলবে এটা আমার কোনো ব্যাপার নয় বা এমনও হতে পারে আমাকে মুখ বুজে চুপ করে থাকতে হবে এবং সেটা আর কখনও উল্লেখ করতে পারব না।

সিলিয়া বলল, আপনি কিন্তু আমার কৌতূহল জাগিয়ে তুলছেন।

 তিনি আমাকে তাঁর নাম বলেছিলেন মিসেস বার্টন কক্স।

 সিলিয়া বলল, ওঃ যথেষ্ট।

তুমি কি ওঁকে চেনো?

 হ্যাঁ, ওঁকে আমি চিনি।

আমিও কিন্তু মনে মনে ভেবেছিলাম তুমি হয়তো চিনতে পারো কারণ—

কারণ কী বলে মনে হয় আপনার?

কারণ এমন কিছু তিনি বলেছিলেন

কী–আমার ব্যাপার? তিনি আমাকে চেনেন বলে?

তিনি বলেছিলেন যে তার ধারণা তার ছেলে হয়তো তোমাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। এই কথা শোনার পর সিলিয়ার মুখের ভাবের পরিবর্তন দেখা গেল। সে কঠিন চোখে মিসেস অলিভারের দিকে তাকালো। আপনি কি সেই ব্যাপারে কিছু জানতে চান?

মিসেস অলিভার বললেন, না, এই ব্যাপারে আমি জানতে চাই না। তোমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমি নাক গলাতে চাই না। সেটা তোমাদের দুজনের মন দেওয়া নেওয়া ব্যাপার। আমি শুধু উল্লেখ করলাম, কারণ প্রথমেই তিনি এই প্রসঙ্গটা তুলেছিলেন আমার কাছে। আর যেহেতু তুমি আমার ধর্মকন্যা তাই তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করতে পারব কয়েকটা খবর আমাকে দেবার জন্য। তোমার কাছ থেকে সেই খবরটা পেলে আমি অন্তত তাকে সেটা জানতে পারব, তিনি হয়তো সেটা ভেবেছিলেন আমার ধারণা।

কী খবর?

ওঃ ভালো কথা, আমি যে কথাটা তোমাকে এখন বলতে যাব আমার মনে হয় না তোমার সেটা পছন্দ হবে। অবশ্য আমি নিজেও সেটা পছন্দ করি না। আমি মনে করি ভদ্রমহিলার অমন বিশ্রী স্বভাব এবং নোংরা মনোভাব একেবারেই ক্ষমার অযোগ্য। তিনি আমাকে এও বলেছিলেন যে, মেয়েটির বাবা তার মাকে খুন করেছিল অথবা তার মা তার বাবাকে খুন করেছিল, আপনি কি খবরটা খুঁজে বার করতে পারবেন?

একথা তিনি আপনাকে বলেছেন এবং সেটা করতেও আপনাকে বলেছেন?

হ্যাঁ।

আপনাকে একজন লেখিকা জেনেও সেই সাহিত্যের ভোজসভায় এ-ধরনের কথা আপনাকে বলতে পারলেন কী করে?

তিনি আমাকে আদৌ চেনেন না কারণ তিনি কখনও আমার সঙ্গে মিলিত হননি এবং আমিও তাকে দেখিনি কখনও।

সেটা কি আপনার কাছে বিস্ময়কর বলে মনে হয়নি?

না, ওই ভদ্রমহিলার মধ্যে আমি তেমন বিস্ময়কর কিছু দেখতে পাইনি। উপরন্তু তিনি কেবল আমাকে আঘাত করে গেছেন। মিসেস অলিভার বললেন, তিনি একজন জঘন্য প্রকৃতির মহিলা।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন।

তুমি তার ছেলেকে বিয়ে করছ নাকি?

এই বিষয়ে আমরা দুজনে আলোচনা করছি। এখনও পর্যন্ত কিছুই ঠিক হয়নি। আপনি কি জানেন তিনি এই বিষয়ে কথা বলেছিলেন?

হ্যাঁ, আমি জানি। কারণ আমার ধারণা যে কেউ সেটা জানতে চাইবে যে, তোমাদের পরিবারের সঙ্গে কে কে পরিচিত?

আমার বাবা আর মার সম্পর্কে বলছি তাহলে শুনুন। সেনাবিভাগ থেকে অবসর নেবার পর কান্ট্রিতে একটা বাড়ি কেনেন আমার বাবা। একদিন ওঁরা দু-জন পাহাড়ের পথে বেড়াতে যান এবং সেখানেই ওঁদের দুজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। সেখানে যে রিভলবার পাওয়া যায় সেটা ছিল আমার বাবারই। আমার বাবা মাকে প্রথম গুলিবিদ্ধ করে পরে নিজে করেন কিংবা আমার মা বাবাকে প্রথম গুলি করে পরে নিজেকে গুলিবিদ্ধ করেন অথবা সেটা আত্মহত্যার চুক্তি কিনা কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে, আমার মনে হয় আপনি এই খবর আগেই পেয়ে গেছেন।

মিসেস অলিভার বললেন, হ্যাঁ, একরকম ভাবে জেনেছি। তবে আমার মনে হয় প্রায় ছয় বছর আগে এটা ঘটেছিল।

হ্যাঁ, প্রায় সেই রকমই হবে।

এবং সেই সময় তোমার বয়স ছিল বারো অথবা চোদ্দ।

হ্যাঁ।

মিসেস অলিভার বললেন, এ ব্যাপারে আমি বেশি কিছু জানি না কারণ সেই সময় আমি আমেরিকায় যাই লেকচার টুরে। আমি শুধু খবরের কাগজে পড়েছিলাম। খবরটা বেশ বড়ো করে বেড়িয়েছিল। তখন আসল সত্যটা জানা খুব কঠিন ছিল কারণ খুনের মোটিভের কোনো চিহ্ন ছিল না, তোমার বাবা-মার মধ্যে বেশ ভালো সম্ভব ছিল এবং তারা খুব সুখী ছিলেন। সেটাও কিন্তু কাগজে উল্লেখ করা হয়েছিল। আমার আগ্রহ থাকার একটাই কারণ তোমার মা স্কুল থেকেই আমার বন্ধু ছিল এবং পরবর্তীকালে তোমার বাবা-মার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়। তার কিছুদিন পর আমাদের দুজনের পথ আলাদা হয়ে যায় কারণ আমার বিয়ে হয়ে অন্যত্র চলে যাই এবং তোমার মা বিয়ে করে অন্য জায়গায় চলে যান। তবে আমার যতদূর মনে পড়ে মালায়েতে অথবা সেরকম জায়গায় তার সৈনিক স্বামীকে নিয়ে সে চলে যায়। তোমার মা আমাকে বলেছিলেন তার যে কোনো একটি সন্তানের ধর্ম মা হবার জন্য এবং তোমাকেই আমি ধর্ম কন্যা হিসাবে নিলাম। বছরের পর বছর ধরে তোমার মা বাবা বিদেশে থাকতেন ফলে তাদের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হত না এবং তোমার সাথেও আমার দেখা হত একটা বিশেষ উপলক্ষে।

হ্যাঁ, আমার একটু একটু মনে আছে। আপনি আমাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতেন এবং ভালো ভালো খাবার খাওয়াতেন।

কাগজে, এই ব্যাপারের লেখা দেখে আমি খুব মর্মাহত হয়েছিলাম। এই খুনের নির্দিষ্ট কোনো মোটিভ ছিল না, ঝগড়া বিবাদের কোনো চিহ্ন ছিল না এবং বাইরে থেকে তাদের কোনো আক্রমণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আমি এসব জেনেছি কারণ এই মামলার বিচারের রায় খোলাখুলি ছিল। মিসেস অলিভার বললেন, তারপর ব্যাপারটা আমি একদম ভুলে যাই। আমি শুধু চিন্তা করি এবং অবাক হই কোন পরিস্থিতি তাদের হত্যা বা আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিতে পারে এবং এই ঘটনার পিছনে কী ভয়ঙ্কর ঘটনা থাকতে পারে? যেহেতু আমি সেই সময় আমেরিকায় ছিলাম সেইহেতু এই ব্যাপারে বেশি দূর এগোতে পারিনি। তারপর যখন তোমাকে দেখি স্বভাবতই তোমাকে এই ব্যাপারে কোনো কথা বলতে পারিনি।

না, তার জন্য আমি তারিফ করি, বলল সিলিয়া।

মিসে অলিভার বললেন, সারাজীবন ধরে কেউ তার বন্ধু বা পরিচিত কাউকে কেন্দ্র করে দারুণ কৌতূহলের মধ্যে পড়ে থাকুক। তার মনের অবস্থা তখন কেমন হবে বা হতে পারে ভাবতে পারো। যদি বন্ধু হয় তবে তোমার একটা অন্তত ধারণা হতে পারে যে, কোনো ঘটনার থেকে সেই কৌতূহলের সৃষ্টি-কিন্তু সেই ঘটনা যদি দীর্ঘ সময়ের হয় অথবা যদি তুমি দেখো সেটা নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা করতে, তুমি কিন্তু তখন সম্পূর্ণ অন্ধকারে। অথচ তোমার এমন কেউ নেই যার কাছে তুমি কৌতূহল দেখাতে পারো।

সিলিয়া বলে, আমার বেশ মনে আছে যে, যখন আমার বয়স একুশ আপনি খুব সুন্দর সুন্দর উপহার পাঠিয়েছিলেন।

তার কথা শুনে মিসেস অলিভার বললেন, একটা সময় আসে যখন মেয়েদের বাড়তি নগদ টাকার প্রয়োজন হয় কারণ তখন তারা অনেক কিছু করতে চায় আর তাদের হাতে তখন যদি নগদ বাড়তি টাকা না থাকে, তাহলে তাদের ইচ্ছা পূরণ করবে কী করে?

হ্যাঁ, আমি ভাবি আপনি একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি আর আপনি এও জানেন কার কী পছন্দ। আপনি আমাকে বাইরে নিয়ে যেতেন অদেখা জিনিস দেখানোর জন্য বা চমৎকার খাবার খাওয়ানোর জন্য। আমার সঙ্গে মিশে সুখ দুঃখের গল্প করতেন দূর সম্পর্কের কোনো আত্মীয়ার মতন। আমি আমার জীবনে বহু দীর্ঘনাসা পার্কারের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। কিন্তু সব সময়ে নিজেকে প্রশ্ন করে আপনার সম্পর্কে জানতে চাই।

হ্যাঁ, আগে কিংবা পরে প্রত্যেকে সেটার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠবে। মিসেস অলিভার বললেন, এই বিশেষ পার্টিতে আমার সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে, আমার মনে হচ্ছে একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত আগন্তুকের নির্দেশে একটা বিস্ময়কর কাজ আমাকে করতে হবে এবং সেই আগন্তুকটি হলেন মিসেস বার্টন কক্স।

আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না কেন তিনি এই বিষয়ে জানতে চাইছেন। আর যখন এটা তার ব্যাপার নয় যদি না…আপনি হয়তো ভেবেছেন ডেসমন্ডকে যদি আমার বিয়ে করার প্রশ্নটা জড়িয়ে না থাকত, হা তা তো বটেই। শত হলেও ডেসমন্ড তাঁর ছেলে।

হ্যাঁ, আমারও ধারণা তাই। তবুও কিছুতেই আমি বুঝতে পারছি না কী করে বা কেমন করে এটা তার ব্যাপার হতে পারে।

সবকিছুই তার কাছে নিজের ব্যাপার বলে মনে হয়। দেখেছেন তো তাঁর নাকটা কতটা উঁচুতে। ওই যে আপনি বলেছিলেন না কী যেন ও হা একজন জঘন্য প্রকৃতির মহিলা।

আমি কিন্তু খবর নিয়েছি যে, ডেসমন্ড জঘন্য চরিত্রের ছেলে নয়।

না, না আমি ডেসমন্ডের খুব প্রিয় এবং ডেসমন্ডও আমার প্রতি অনুরক্ত। কিন্তু তথাপি ওর মাকে আমি মোটেই পছন্দ করি না।

সে কি তার মাকে পছন্দ করে জানো?

খোলাখুলিভাবে সিলিয়া বলল, বিশ্বাস করুন আমি কিছু জানি না। আমার মনে হয় সে তার মাকে পছন্দ করে থাকতে পারে। যাইহোক আমি এখনি বিয়ে করতে চাই না এবং সেরকম কিছু অনুভবও করি না। আর এই বিয়ের পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক বাধা বিপত্তি তো থাকবেই, আপনি সেটা জানেন। সিলিয়া আরও বলল যে, এটা আপনাকে কৌতূহলের চেয়ে নিশ্চয়ই অনুভবের খোরাক জোগাবে। কারণ রোজি কক্স কেন আপনাকে বলবেন আমার কাছ থেকে গরম গরম খবর বের করার চেষ্টা করতে। আর সেটা আপনার কাছে ফাস করে দিতে, আমি বলতে চাইছি আপনি কী সেই বিশেষ প্রশ্নটা করবেন।

তুমি কী বলতে চাইছ আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করব তোমার মা কি তোমার বাবাকে খুন করেছিলেন অথবা তোমার বাবা তোমার মাকে খুন করেছিলেন বা এটা জোড়া আত্মহত্যা? তুমিও কি তাই মনে করো?

আমার মনে হয় সেটাই। কিন্তু আমার মনে হয় আপনি আমার কাছ থেকে যে সব খবর পাবেন কিংবা ধরুন যদি-যদি সেই খবরগুলো পান আপনি তাহলে কি মিসেস বার্টন কক্সকে খবরগুলো পাচার করবেন?

না, মিসেস অলিভার বললেন, ওই জঘন্য চরিত্রের মহিলাকে আমি কোনো কিছু বলার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। বরং তাকে বলব এটা তার বা আমার কারোরই কোনো ব্যাপার নয়।

আমিও সেটা ভেবেছি, সিলিয়া বলল। আমার মনে হচ্ছে আপনাকে আমি বিশ্বাস করতে পারি। তাই আমি যতটুকু জানি ঠিক ততটুকুই বলতে আমার কোনো আপত্তি নেই। যেমন ধরুন

আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি না আর তোমারও আমাকে বলার প্রয়োজন নেই।

 তবে উত্তর আমি আপনাকে দেবই এবং সেই উত্তরটা হল–কিছুই নয়।

কিছুই নয়, চিন্তিত গলায় মিসেস অলিভার জিজ্ঞেস করলেন।

না। সেই সময় আমি সেখানে ছিলাম না। এখন আমি মনে করতে পারছি না ঠিক তখন আমি কোথায় ছিলাম। তবে আমার মনে হয় আমি তখন সুইজারল্যান্ডের একটা স্কুলে ছিলাম অথবা স্কুলের ছুটির দিনগুলিতে আমার স্কুলের এক বন্ধুর কাছে ছিলাম। আমার যেন কেমন সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

মিসেস অলিভার সন্দেহ প্রকাশ করে বললেন, আমারও ধারণা তোমাকে যে জানতেই হবে তার কোনো মানে নেই, কারণ সেই সময় তোমার বয়সের কথা চিন্তা করলে এরকম একটা ধারণা করে নেওয়া যায়।

সিলিয়া বলল, আমার জানতে খুব আগ্রহ হয় আপনার কি মনে হয় আমি সব কিছু জানি? অথবা জানি না?

কেন, তুমিই তো বলেছ সেই সময় তুমি বাড়িতে ছিলে না। সেই সময় যদি তুমি বাড়িতে থাকতে আমি তখন বলতাম হা, তবুও আমার মনে হয় তুমি কিছু জানেনা, শিশুরা এবং টিনএজাররা জানে। তারা অনেক কিছুই দেখে থাকে। তারা যা জানে তারা সব বলতে চায় না। পুলিশি তদন্তের কথা তুমি শুনবে?

না, আমি জানি আপনার বিবেচনা শক্তি আছে। আমার জানার কোনো দরকার নেই এবং আমি এও ভাবি না যে, আমি কিছু জানি। আমি মনে করি না যে, এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা আছে। পুলিশ কী ভাবছে? অবশ্য আমার এই জিজ্ঞেস করার জন্য আপনি যেন কিছু মনে করবেন না। আমি জানতে আগ্রহী কারণ তদন্তের রিপোর্ট বা কোনো কিছু সেরকম আমি কাগজে পড়িনি।

আমার মনে হয় তারা এটাকে জোড়া আত্মহত্যা বলে ভেবে নিয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি না। তার কারণ সম্পর্কে তাদের সামান্য ধারণা তাদের আছে।

আপনি জানতে চান আমার ধারণা কী?

 তুমি আমাকে বলতে না চাইলে বলো না–বললেন মিসেস অলিভার।

আমার মনে হচ্ছে আপনি জানতে খুবই আগ্রহী। বিশেষ করে অপরাধ কাহিনি যখন লিখে থাকেন। যারা নিজেদের হত্যা করে বা পরপর খুনোখুনি করে মারা পড়ে। অথবা এ-ব্যাপারে যাদের সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। আমার নিশ্চয়ই ভাবা উচিত যে, আপনি অবশ্যই আগ্রহী হবেন।

হ্যাঁ, আমি অবশ্যই তা স্বীকার করি। মিসেস অলিভার বললেন। কিন্তু একটা খবর জানতে চেয়ে তোমাকে হয়তো আমি অপমান করব যা জানতে চাওয়া আমার এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না।

বুঝেছি, সিলিয়া বলল। এক সময় আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই মানে আমি বলতে চাই, বাড়ির পরিবেশ তখন কী রকম ছিল এবং কী কী ঘটনা ঘটত সেখানে। সেই ছুটির আগে আমি কন্টিনেন্টে চলে যাই। সেই সময়ের হাল আমল বলতে যা বোঝায় আমি কিছুই জানি না। আমার স্কুল জীবনে বাবা মা যতদিন জীবিত ছিলেন মাত্র একবার কী দুবার আমাকে আনার জন্য সুইজারল্যান্ডে গিয়েছিলেন। ওঁদের তখন আমার স্বাভাবিক বলেই মনে হত। মনে হয় বাবা খুব অসুস্থ ছিলেন এবং দিনকে দিন দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। ওঁর হার্টটা হয়তো খারাপ হয়েছিল। আমার মাও যেন স্নায়ুর অসুখে ভুগছিলেন। তবে ওঁরও স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছিল। ওঁদের বেশ বন্ধুর মতন সম্পর্কে ছিল আমি অন্তত সেটাই দেখেছিলাম। কোনো কোনো সময়ে কারোর মনে একটা বিরূপ ধারণা হতে পারে। কিন্তু কেউ ভাবতে পারে না সেটা সত্য হোক অথবা প্রয়োজনে সেটা ঠিক হোক। কিন্তু কেউ অবাক হয় যদি

আমি মনে করি না এ-ব্যাপারে আর কোনো কথা বলা ঠিক হবে। আমাদের আর এ-ব্যাপারে কোনো অনুসন্ধান করার অথবা জানার দরকার নেই। এবং বিচারের রায়ও সন্তোষজনক। এর পিছনে কোনো রকম মোটিভও নেই। বললেন মিসেস অলিভার।

সিলিয়া প্রত্যুত্তরে বলল, আমি চিন্তা করি কোনটা সম্ভব হতে পারে। আমার মনে হয় আমার বাবাই মাকে খুন করেছিলেন। কারণ এটাই ভাবা স্বাভাবিক। একজন পুরুষের পক্ষে যে কোনো লোককে গুলি করাটা যতটা সম্ভব একজন নারীর ক্ষেত্রে যে কোনো কারণেই তোক একজন নারী, আরও পরিষ্কার করে বলা উচিত অর্থাৎ আমার মতো নারী আমার বাবাকে গুলি করতে পারেন আমি কল্পনাই করতে পারি না। আবার আমার মনে হয় বাবা যদি সত্যি সত্যিই মৃত্যু চাইতেন তাহলে তোত অন্য উপায়ও ছিল। আবার এও মনে মনে হয় ওঁরা কেউ কারোর মৃত্যু চাইতেন না।

সুতরাং বাইরের কেউ একজন হতে পারে?

হ্যাঁ, কিন্তু বাইরের লোক বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন? সিলিয়া জিজ্ঞেস করল।

সেই বাড়িতে আর কে কে থাকত? ওঃ ওই বাড়িতে ছিলেন একজন হাউজকিপার বয়স্ক অথচ বোবা ও কালা, একজন বিদেশিনী মেয়ে সে ছিল আমার গভরনেস। কিছুদিন মা হাসপাতালে ছিলেন, ওখান থেকে ফিরে আসার পর আমার গভরনেস আবার এসেছিলেন মাকে দেখাশুনা করার জন্য। সে খুব ভালো মেয়ে ছিল। এবং আরও একজন ছিলেন মামিমা, তাকে আমি মোটেই পছন্দ করতাম না। তাদের মধ্যে কোনো এক জনের কোনো রাগ বা বিদ্বেষ ছিল, আমার কিন্তু তা মনে হয় না। কারণ ওঁদের মৃত্যুতে তাদের মধ্যে কেউই লাভবান হবে না, আমি আর আমার চার বছরের ছোটো ভাই এডওয়ার্ড ছাড়া। আমার বাবামা-র যা সঞ্চিত অর্থ ছিল অবশ্য খুব বেশি টাকা ছিল না, বাবার পেনসন ছিল আর মার নিজস্ব স্বল্প আয় ছিল। আমরা দুই ভাই বোন তার উত্তরাধিকারী হই।

আমি দুঃখিত, সত্যিই আমার খুব খারাপ লাগছে তোমাকে জিজ্ঞেস করার জন্য এবং আমি হয়তো তোমাকে অসুবিধায় ফেললাম। মিসেস অলিভার বললেন।

না, আমাকে একটুও অসুবিধায় ফেলেননি বরং ব্যাপারটাকে আপনি আমার মনে জাগিয়ে তুললেন এবং সেটার প্রতি আমার আগ্রহ জাগছে জানার জন্য। আমার আগ্রহ হচ্ছে এই কারণে যে আমার এখন বোঝবার জানবার বয়স হয়েছে। তারা ছিলেন অতি প্রিয়জন, অবশ্য প্রত্যেক মানুষের কাছেই তাদের অভিভাবক অতি প্রিয় এবং কাছের মানুষ হয়ে থাকে। আমি ঠিক জানি না কিন্তু উপলব্ধি করতে পারি তারা কী রকম ছিলেন এবং তাদের জীবন কী রকম ছিল। আমার খুব কৌতূহল হয় এবং জানারও প্রচণ্ড ইচ্ছা যে, কী এমন সঙ্কটময় ঘটনা তাদের জীবনে ঘটেছিল? জানেন মিসেস অলিভার এটা ঠিক সাপের উঁচ গেলার মতন। আপনি না পারবেন পুরোপুরি গিলতে আর না পারবেন বার করে দিতে। তবে হ্যাঁ আমি পুরো ব্যাপারটা জানতে চাই এবং আমার জানারও প্রবল ইচ্ছা, কারণ সমস্ত ব্যাপারটা জানা হয়ে গেলে মনের মধ্যে আর কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না আবার নতুন করে কিছু জানার। তাই না?

তাহলে কি তুমি এই ব্যাপারে কিছু চিন্তা করবে?

এক মুহূর্তের জন্য তাঁর দিকে সিলিয়া তাকিয়ে রইল এবং ওর মুখের ভাব দেখে মনে হল, কোনো কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ও চেষ্টা করছে।

মেয়েটি বলল, হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমি সব সময়ই চিন্তা করি। আমি এবং ডেসমন্ডা দুজনেই জানতে চাই, এ ব্যাপারে আপনার যদি কিছু জানা থাকে।